দরজার ঝুলানো ময়লা পর্দাটা ঈষৎ নড়ে উঠলো।
কে যেন পাশে দাঁড়িয়ে।
অন্ধকারে তাকে ঠিক দেখা গেলো না।
চুড়ির আওয়াজ শুনে মনে হলো একটি মেয়ে।
হয়তো সেই মেয়েটি, যে একটু আগে আঙ্গিনার পাশে বসে বসে মাথায় উকুন খুঁজছিলো।
কাসেদ নড়েচড়ে বসলো।
মকবুল সাহেব হাতের ছাতাখানা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।
পর্দার ওপাশ থেকে একখানা শীর্ণ হাত বেরিয়ে এলো সামনে। এক পেয়ালা চা আর একটা পিরিচে কিছু মিষ্টি।
হাতজোড়া সরে গেলো।
পর্দাটি ঈষৎ নড়ে উঠলো আবার।
কাপ আর পিরিচখানা সামনে নামিয়ে রাখলেন মকবুল সাহেব। বললেন, গরিবের বাসায় এসেছেন– কথাটা শেষ করলেন না তিনি। এ ধরনের কথা সাধারণত শেষ করা হয় না।
চায়ের কাপটা নীরবে সামনে টেনে নিলো কাসেদ।
চা খেয়ে যখন রাস্তায় বেরিয়ে এলো তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে।
জাহানারাদের ওখানে অনেকদিন যাওয়া হয় নি।
আজ রাতে, এমনি রাতে একবার গেলে মন্দ হয় না। কিন্তু জাহানারা সেতার শেখবার জন্যে একটা মাষ্টার রাখার কথা বলেছিলো। গেলেই হয়তো প্রশ্ন করবে, কই আমার মাষ্টার ঠিক করেন নি?
জবাবে কোন রকমের অজুহাত দেখানো যাবে না। বলা যাবে না, কাজের চাপ ছিলো কিম্বা সময় করে উঠতে পারি নি। তাহলে হয়তো অভিমান করে বসবে সে। বলবে, আমার জন্যে না হয় কাজের একটু ক্ষতিই হতো।
মেয়েরা এমনি হয়। তারা যাকে ভালবাসে তাকে বড় স্বাৰ্থপরের মত ভালবাসে।
লালবাগের চৌরাস্তায় এসে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো কাসেদ। যাবে কী যাবে না।
রাস্তার মোড়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে একখানা চলন্ত বাসে উঠে পড়লো সে। বসবার জায়গা নেই। রড ধরে এখানেও দাঁড়িয়ে থাকতে হলো তাকে।
জাহানারাদের বুড়ি চাকরানীটা বারান্দায় বসে বসে কি যেন সেলাই করছিলো।
কাসেদকে দেখে একগাল হেসে বললো, আপা মাষ্টারের কাছে সেতার শিখছে।
বাড়িতে ঢুকে থমকে দাঁড়ালো কাসেদ। তাহলে জাহানারা কাসেদের অপেক্ষায় না থেকে নিজেই একজনকে খুঁজে নিয়েছে। নিজেকে এ মুহুর্তেও বড় অপরাধী মনে হলো তার। কাসেদের জন্যে অপেক্ষা করে হয়তো হতাশ হয়ে পড়েছিলো জাহানারা। অবশেষে নিজেই একজনকে খুঁজে নিয়েছে।
ওকে চুপ থাকতে দেখে বুড়ি চাকরানীটা কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো, তারপর মৃদু হেসে সেলাইয়ে মনোযোগ দিলো আবার।
বুড়ির সামনে সহসা অস্বস্তি বোধ করলো কাসেদ।
জাহানারার ঘর থেকে সেতারের টুং-টাং আওয়াজ শোনা যাচ্ছে আর মুদু হাসির শব্দ।
সেতার শিখতে বসে হাসছে জাহানারা। কেন?
সেতারের সঙ্গে হাসির কোন সম্পর্ক নেই।
দৌড়গোড়ায় একটু ইতস্তত করে ভেতরে ঢুকে পড়লো কাসেদ।
মেঝের উপর একখানা ফরাস পেতেছে জাহানারা; একপাশে একটা সেতার হাতে সে বসে; অন্য পাশে ফর্সা রঙের রোগা পাতলা একটি ছেলে। পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা।
কাসেদ ভেতরে ঢুকতেই সেতারের ওপর ধরা হাতখানা সহসা থেমে গেলো। কাসেদের চোখের দিকে এক পলকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো জাহানারা। তারপর হেসে দিয়ে বললো, আপনি? এতদিন আসেন নি যে?
কাসেদ সহসা কোন জবাব দিতে পারলো না। কিছু বলতে গিয়েও পাশে বসা ছেলেটির দিকে চোখ পড়তে থেমে গেল সে।
জাহানারা বললো, উনি আমাকে সেতার শেখাচ্ছেন।
দু’জনে হাত তুলে আদাব বিনিময় করলো ওরা।
কাসেদ বললো, ওনার কথা আগেই শুনেছি।
জাহানারা কৌতুহলভরা চোখে তাকালো ওর দিকে, কার কাছ থেকে শুনেছেন?
কাসেদ বললো, বুড়ির কাছ থেকে।
জাহানারার সেতারের মাষ্টার বললেন, দাঁড়িয়ে কেন, বসুন না।
কাসেদ ইতস্তত করে বললো, তাহলে আমি এখন যাই। আপনাদের গুরুছাত্রীর সাধনায় অকারণ ব্যাঘাত সৃষ্টি করা উচিত নয়। ওর গলার স্বরে অসতর্ক অভিমান ঝরে পড়লো।
পরক্ষণে নিজেই সেটা বুঝতে পারলো কাসেদ। লজ্জায় দু’জনের কারো দিকে তাকাতে পারলো না সে।
জাহানারা স্থিরচোখে ওর দিকে তাকিয়ে। একটু আগে মৃদু হাসছিল সে, এখন তার লেশমাত্র নেই। মাষ্টার বললেন, একটু বসে গেলেই পারেন। আপনার উপস্থিতি আমাদের কোন ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে না। বলে হেসে উঠলেন তিনি।
হাসি নয়। এ যেন কাসেদকে বিদ্রুপ করা হলো।
জাহানারা অত্যন্ত শান্ত গলায় বললো, জানেন তো সাধনার সময় আশ-পাশের কারো অস্তিত্বের কথা সাধকের মনে থাকে না। আমরাও আপনার উপস্থিতির কথা ভুলে যাবো।
কী বলেন? বলে নতুন মাষ্টারের দিকে তাকালো জাহানারা। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসলো। যেন অনেকদিনের চেনাজানা। অনেক কালের আপনজন।
কাসেদ বসলো নীরবে।
আজকের এই রাতে না এলেই ভালো হতো। কেন আসতে গেলো সে?
স্নেহ-প্ৰেম ভালবাসা এর মূল্য নেই।
এর কোন অর্থ নেই কেরানী জীবনে।
জাহানারা। একী করলে তুমি জাহানারা। যে তার হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে তোমাকে ভালবাসলো তার কথা তুমি একটুও ভাবলে না। একটিবার স্মরণ করলে না তাকে যে গোপনে তোমাকে নিয়ে অশেষ স্বপ্ন এঁকেছে মনে মনে। দুদিনের পরিচয়ে যাকে পেলে, তাকেই ভালবেসে ফেললে তুমি?
ভালো বলেই ওকে আমি ভালবেসেছি। জাহানারার গলার স্বর তীব্র এবং তীক্ষ্ণ শোনালো কানে।
কিন্তু ওযে ভালো এ কথা কেমন করে বুঝলে? ক’দিন ওর সঙ্গে মিশেছো তুমি? ওর কতটুকু তুমি জানো? ও একটা ঠগ হতে পারে, জোচ্চোর হতে পারে। তোমার ফুলের মতো পবিত্র জীবন নিয়ে হয়তো ছিনিমিনি খেলতে পারে সে।
যদি খেলেই তাতে আপনার কিবা এলো গেলো।
হয়তো কিছুই এসে যাবে না। কিন্তু জাহানারা, তুমি বাচ্চা খুকী নও, বোঝার মত বয়স হয়েছে তোমার। যে চরম সিদ্ধান্ত তুমি নিতে চলেছে, তার আগে কি একটুও ভাববে না, চিন্তা করবে না?
চিন্তা আমি করি নি সেকথা কেমন করে বুঝলেন? জাহানারা হাসলো।
হাসলে ওকে আরো সুন্দর দেখায়।
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আর কোন কথা বলতে পারলো না কাসেদ।
হঠাৎ সুর কেটে গেলো।
জাহানারা বললো, একী, সাধনা না হয় আমরা করছি। কিন্তু আপনি তন্ময় হয়ে আছেন কেন?
কাসেদ ইতস্তত করে বললো, একটা কবিতার বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম।
ও, তাহলে আপনি কবিতার ভাবে মগ্ন ছিলেন। আমি ভাবছিলাম বুঝি সেতারের সুর শুনে।
মাষ্টার সবিনয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমি তাহলে এখন চলি?
জাহানারা ঘাড় দুলিয়ে বললো, কাল আসছেন তো?
হ্যাঁ, আসবো।
দেখবেন, আবার ভুলে যাবেন না যেন।
না, ভুলবো না।
আপনি সব ভুলে যান কিনা, তাই বললাম। মাষ্টারকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেলো জাহানারা।
ও ফিরে এলে কাসেদ বললো, আমি চলি।
যাবার জন্যে অমন উতলা হয়ে গেলেন কেন? আপনি এসেছেন বলেই তো মাষ্টারকে তাড়াতাড়ি বিদায় দিলাম। জাহানারা মৃদু গলায় বললো, এখানে চুপটি করে বসুন। আমি দু’কাপ চা করে নিয়ে আসি। আমি না আসা পর্যন্ত যাবেন না যেন। শাসনের ভঙ্গিতে ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে ভেতরে চলে গেল জাহানারা।
ওর শেষ কথাগুলো মুহুর্তে শান্ত করে দিয়ে গেলো তাকে। তাহলে এতক্ষণ যা নিয়ে এত চিন্তা করছিলো সে, তার কোনটাই সত্য নয়।
কাসেদের সঙ্গে কথা বলবে বলে মাষ্টারকে তাড়াতাড়ি বিদায় করে দিয়েছে জাহানারা।
জাহানারা তুমি বড় ভালো মেয়ে। বড় লক্ষ্মী মেয়ে তুমি। তাইতো তোমাকে এত ভাল লাগে। ভালবাসি।
দু’কাপ চা হাতে ওর সামনে এসে বসলো জাহানারা।
চা আনতে গিয়ে মুখহাত ধুয়ে এসেছে সে।
শাড়িটা পালটেছে।
চুলে চিরুনি বুলিয়েছে কয়েক পোঁচ।
কাসেদ বললো, তাহলে সেতারের মাষ্টার ঠিক করেই ফেললেন আপনি?
আপনার অপেক্ষায় আর কতকাল বসে থাকবো।
চায়ের কাপটা টেনে নিতে গিয়ে হাত কেঁপে উঠলো কাসেদের।