বাইরে রাত।

ভেতরে দু’জন নীরবে বসে।

আশেপাশে কারো কোন সাড়া শব্দ নেই।

সমস্ত পৃথিবী যেন চুপ করে আড়ি পেতে আছে ওরা কি বলে শুনবার জন্য। কাসেদ বললো, আপনার আঙ্গুলে একটা কালো দাগ পড়ে গেছে।

জাহানারা বললো, সেতার শিখতে গেলে প্ৰথম প্রথম অমন হয় শুনেছি।

কাসেদ বললো, হুঁ।

আবার দু’জনে চুপ করে গেলো ওরা।

বাইরে তারা জ্বলছে, ভেতরে বাতি।

কাসেদ ভাবলো, জাহানারাকে মন খুলে আজ সব কিছু বললে কেমন হয়।

এখানে কেউ নেই।

এইতো সময়।

কাপটা মুখের কাছে এনে নামিয়ে রাখলো কাসেদ।

জাহানারা নীরবে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে।

সেও কিছু বলতে চায় ওকে।

সে বলুক। প্রথম সেই বলুক। কাসেদ নড়েচড়ে বসলো।

জাহানারা বললো, আপনি যেন আগের চেয়েও শুকিয়ে গেছেন।

কাসেদ বললো, মা-ও তাই বলেন।

হ্যাঁ, মা কেমন আছেন?

ভালো।

নাহার?

সেও ভালো।

আপনার শরীর কেমন?

মোটামুটি যাচ্ছে।

আবার নীরবতা। শূন্য চায়ের কাপ দুটো সামনে নামিয়ে রেখেছে ওরা। ওরা এখন মুখোমুখি বসে। জাহানারা জানালার দিকে তাকিয়ে। হয়তো আকাশ দেখছে কিম্বা আঁধারের আলো। কাসেদ দেখছে জাহানারাকে। ওর চোখ, ওর মুখ, ওর চিবুক।

কী সুন্দর।

আমাকে কিছু বললেন, জানালা থেকে চোখ সরিয়ে এনে ওর দিকে তাকালো জাহানারা।

কাসেদ অপ্ৰস্তুত গলায় বললো কই না, নাতো।

জাহানারা মৃদু হাসলো। কিছু বললো না।

জাহানারা। আস্তে করে ওকে ডাকলো কাসেদ।

বলুন। চাপা স্বরে জবাব দিলো জাহানারা।

আমি এখন চলি।

সেকি, এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন? অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালো জাহানারা। যেন এমন কিছু একটু আগেও সে ভাবতে পারে নি। যেন এ সময় চলে যাওয়াটা কোনমতে বিশ্বাস করতে পারছে না সে।

কাসেদ বললো, অনেকক্ষণ বসা হলো। আর কত?

জাহানারা আরো কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর অস্পষ্ট গলায় বললো, আচ্ছা।

বলতে বলতে উঠে দাড়ালো সে। এ মুহুর্তে ওকে বড় দুর্বল দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে শরীরটা যেন ক্লান্তির ভারে ভেঙ্গে পড়তে চাইছে। বাইরে বারান্দা পর্যন্ত ওকে এগিয়ে দিলো জাহানারা।

আবার আসছেন তো?

আসবো।

বাইরে মুক্ত বাতাসে বেরিয়ে একটা জোর শ্বাস নিলো কাসেদ।

দিন কয়েক পরে নিউ মার্কেটের মোড়ে শিউলীর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো ওর। শিউলীর পরনে বাদামী রঙের একখানা শাড়ি। চুলগুলো খোঁপায় বাঁধা। হাতে একটা কাপড়ের থলে।

আপনি বেশ মানুষ তো, অনুযোগ ভরা কণ্ঠে শিউলী বললো, এত করে বললাম। শুক্রবার দিন গেটের সামনে আমার জন্যে অপেক্ষা করবেন, কই আপনি এলেন না তো? সারাটা বিকেল শুধু ঘর-বার করেছি। শিশুসুলভ হাসিতে সারা মুখ ভরে এলো তার।

কাসেদ আস্তে করে বললো, ভুলে গিয়েছিলাম।

ভুলে তো যাবেনই। আমি আপনার কে যে আমার সঙ্গে দেখা করার কথা আপনার মনে থাকবে। গলাটা যেন ঈষৎ কেঁপে উঠল তার।

শিউলীর সঙ্গে পরিচয়ের পর এই প্রথম চমকে উঠলো কাসেদ। ওর চোখের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকালো সে। কী বলতে চায় শিউলী।

কী বলতে চায় সে?

সেই পুরোনো সুরে সহসা হেসে উঠলো শিউলী। আমার দিকে অমন করে চেয়ে থাকবেন না কিন্তু। সুন্দর চোখের চাউনি আমি বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারি না। কে বললো আমার চোখ দু’টি সুন্দর। কাসেদ তখনো ওর দিকে তাকিয়ে। হাতের ব্যাগটা সজোরে দুলিয়ে শিউলী বললো, শুধু কী সুন্দর, অদ্ভুত মায়াময় চোখ দুটো আপনার, দেখলে ভালবাসতে ইচ্ছে করে।

তাই নাকি? বলতে গিয়ে ঢোক গিললো কাসেদ।

শিউলী হাসছে।

সেই পুরনো হাসি।

রাস্তার মোড়ে একটি ছেলে আর একটি মেয়েকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলাপ করতে দেখে আশপাশের লোকজন আড়চোখে লক্ষ্য করছিলো ওদের। ওদের দৃষ্টির অর্থ বুঝতে বিলম্ব হয় না কাসেদের।

শিউলীকে সজাগ করে দিয়ে কাসেদ বললো, আপনি সত্যি একেবারে ছেলে মানুষ।

শিউলী হাসি থামিয়ে বললো, আপনি বুঝি চাপা হাসি পছন্দ করেন?

এ প্রসঙ্গ নিয়ে আর বেশিদূর এগুতে ইচ্ছে করলো না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বললো, মার্কেটিং করতে এসেছিলেন বুঝি?

শিউলী হাতের থলেটি দেখিয়ে বললো, হ্যাঁ।

এখন কি হোষ্টেলে ফিরবেন?

ইচ্ছে তাই ছিলো কিন্তু এখন আর ফিরছি নে।

তাহলে কী করবেন? একটু অবাক হয়ে শিউলীর দিকে তাকালো কাসেদ। শিউলী নির্বিকার গলায় বললো, আপনার সঙ্গে ঘুরবো, বেড়াবো, গল্প করবো। কাসেদ বিব্রত বোধ করলো। ইতস্তত করে বললো, কিন্তু আমি এক বন্ধুর বাসায় যাব ভাবছিলাম।

ঠিক আছে, সঙ্গে আমিও যাবো। শিউলী পরক্ষণে বললো, আপনার বন্ধুটি নিশ্চয়ই আমাকে বের করে দেবেন না।

না, তা কেন করবে, কিন্তু–

আপনার আপত্তি আছে। এই তো। শিউলী মুখ টিপে হেসে বললো, বন্ধুর ওখান থেকে কোথায় যাবেন শুনি?

বাসায় ফিরবো।

বাহ্‌ কি মজা। হঠাৎ যেন হাততালি দিতে ইচ্ছে করলো শিউলীর, আনন্দে আটখানা হয়ে বললো, আপনাদের বাসায়ও যাওয়া যাবে আজ। একবার চিনে আসি তো, তারপর আপনার সঙ্গে দেখা হোক না হোক বাসায় গিয়ে হামলা করবো।

কাসেদ গম্ভীর হয়ে গিয়ে বললো, তারচে এক কাজ করুন, হোষ্টেলে ফিরে যান আজ। অন্যদিন নিয়ে যাব বাসায়।

মুখখানা কালো করে ওর দিকে কিছুক্ষণ নীরবে তাকিয়ে রইলো শিউলী। অদ্ভুত করে একটুখানি হাসলো সে। ধীরে ধীরে বললো, কোন কিছুতে অতিমাত্রায় আগ্রহ দেখানোটা বোকামো। যাকগে, আপনার বাসায় যাবার স্পৃহা আমার আর নেই। চলি। হোষ্টেলের দিকে পা বাড়ালো শিউলী। প্রথমে রীতিমত অপ্ৰস্তুত হয়ে গেলো কাসেদ। পর মুহুর্তে কয়েক পা এগিয়ে ডাকলো, এই যে শুনুন। শিউলী ফিরে দাঁড়িয়ে গম্ভীর স্বরে বললো, কিছু বলার থাকলে বলুন। আমার আবার দেরি হয়ে যাচ্ছে। হাতজোড়া কোথায় রাখবে ভেবে না পেয়ে, একটা হাত নিজের চুলের মধ্যে বুলোতে বুলোতে আর অন্যটা দিয়ে শিউলীর ব্যাগটা টেনে ধরে কাসেদ আস্তে করে বললো, বলছিলাম কী চলুন।

কোথায়? একটু অবাক হলো শিউলী।

কাসেদ বললো, কেন আমাদের বাসায়।

ওর মুখের দিকে আবারো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো শিউলী। একটা সুন্দর হাসির তরঙ্গ সারা মুখে ছড়িয়ে পড়লো, হেসে দিয়ে শিউলী বললো, এতক্ষণ এত ঢং করছিলেন কেন শুনি?

কাসেদ নিরুত্তর রইলো।

বাসায় এসে ওর বইপত্র খাতাগুলো ছড়িয়ে একাকার করলো শিউলী।

এক একটা করে খুললো, পড়লো, বন্ধ করে আবার খুললো সে।

হঠাৎ তালাবদ্ধ সুটকেসটার দিকে চোখ পড়লে বললো, দেখি, চাবিটা দেখি আপনার?

কাসেদ বললো, কোন চাবি দিয়ে কী করবেন আপনি?

সুটকেসটা খুলবো।

কেন?

খুলে দেখবো। ওর মধ্যে কী আছে। শিউলীর কণ্ঠস্বর আশ্চর্য নির্লিপ্ত।

কাসেদ বললো, না, ওটার চাবি আমি কাউকে দিই না।

ও, ভ্রূজোড়া বিস্তারিত করে ঈষৎ হাসলো। সামনে এগিয়ে এসে চাপা স্বরে বললো, ওর মধ্যে প্রেমপত্রগুলো সব লুকিয়ে রেখেছেন বুঝি? তাহলে থাক।

ওসব কাউকে না দেখানোই ভালো। হাসতে হাসতে আবার টেবিলটার দিকে সরে গেলো শিউলী।

ও চলে গেলে মা শুধোলেন, মেয়েটি কে রে?

কাসেদ বললো, জাহানারার চাচাত বোন।

মা বললেন, ও তাই, গলার স্বরটা অনেকটা জাহানারার মত।

মেয়েটি কী করে?

কলেজে পড়ে।

এখানে বুঝি বাসা আছে ওদের।

না। ও হোষ্টেলে থাকে।

মা। তবু এত কথা জিজ্ঞেস করলেন, নাহার একটি কথাও জিজ্ঞেস করলো না। ওরা যখন ভেতরের ঘরে বসে কথা বলছিলো তখন নিজ হাতে চা বানিয়ে ওদের দিয়ে গেছে নাহার। আর কিছু লাগবে কিনা, কথা না বলে ইশারায় কাসেদকে প্রশ্ন করেছে। তারপর কাসেদ যখন শিউলীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে ওর, তখনো উত্তরে একটা ছোট্ট আদাব জানিয়ে নিজের কাজে ফিরে গেছে নাহার। ওর ব্যবহারটা বড় অসামাজিক বলে মনে হলো কাসেদের।

শিউলী চলে গেলে নাহারকে ডাকলে সে, আচ্ছা, তোমার একী স্বভাব বলতো? একজন ভদ্রমহিলা বাসায় এসেছে, তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম, পরিচয় করিয়ে দিলাম, দু’চারটে কথা বলবে, একটু আলাপ করবে, তা নয়, একেবারে চুপ। তোমার কি কথা বলতে কষ্ট হয় নাকি।

বুড়ো-আঙ্গুল দিয়ে মেঝেতে দাগ কাটতে কাটতে নাহার জবাব দিলো, আলাপ করার কিছু থাকলে তো। বলে এলোমেলো করে রাখা বইগুলো গুছাবার কাজে লেগে গেলো নাহার। একটার পর একটা, বইগুলো আবার সুন্দর করে সাজিয়ে রাখছে সে। কাসেদ চুপ করে রইলো। আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না।

Leave a Reply