দুটো ঘটনাই পরপর ঘটলো।
আগের দিন পুরো অফিসটা একটা চাপা উত্তেজনায় ভুগেছে। কারণটা তেমন অভাবিত কিছু নয়। বড় সাহেবের সঙ্গে তার বউয়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। বউ ডিভোর্স করেছে তাকে। হাজার হোক অফিসের বড় সাহেব, তাকে নিয়ে হাসির হুল্লোর ছড়ান যায় না। গলা কাটা যাওয়ার ভয় আছে। তবু কর্মচারীরা এ নিয়ে আলোচনা করতে ছাড়ে নি।
অবশেষে এমনি কিছু যে ঘটতে পারে তা সবাই আঁচ করছিলো। যেখানে স্বামী-স্ত্রীতে আদায়-কাচকলায় সম্পর্ক, সেখানে সকল সম্পর্ক বর্জন করাই বাঞ্ছনীয়।
তবু অনেকে সাহেবের জন্যে আফসোস করলো। বললো, বেচারা।
আবার কেউ কেউ বললো, ভালই হয়েছে, সাহেব বেঁচেছে। নইলে সারাটা জীবন ছারপোকা হয়ে থাকতে হতো।
কেউ বললো, বিয়ে করে বড় ঠেকেছে সাহেব! কী লোক ছিলো কেমন হয়ে গেছে।
সাহেবকে নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ না হতেই পরবর্তী ঘটনাটা ঘটলো।
মকবুল সাহেব, যিনি সারাদিন পান খেতেন আর অফিসটাকে জমিয়ে রাখতেন, তিনি হঠাৎ পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
সেদিন অফিসে এসেই দারোয়ানের কাছ থেকে খবরটা শুনলো কাসেদ। প্ৰথমে চমকে গিয়েছিলো, পরে সামলে নিয়ে শুধালো, কার কাছ থেকে শুনলে?
দারোয়ান জানালো, তার ছেলের কাছ থেকে।
অফিসের সবাই জেনেছে একে একে।
দুঃখ করেছে, আহা লোকটা বড় ভালো ছিলো। তাদের শোক প্রকাশের ধরন দেখে মনে হলো, যেন বুড়ো মকবুলের মৃত্যু-সংবাদ শুনেছে তারা। তা পক্ষাঘাতে ভোগা আর মারা যাওয়া এক কথা। আফসোস জানাতে গিয়ে একাউণ্টেণ্ট বলেন, যতদিন বেঁচে থাকবে একটানা কষ্ট করতে হবে। কাসেদ শুধালো, এখন তিনি আছেন কোথায়?
কনিষ্ঠ কেরানী বললো, হাসপাতালে। সকালবেলা নাকি মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
একাউণ্টেণ্ট বললেন, মেডিক্যাল গেলে কি হবে, ও রোগ ভালো হবার নয়। কথাটা বেশ জোরের সঙ্গে বললেন তিনি। গলাটা অস্বাভাবিক শোনালো। মনে হলো রোগটা না সারুক তাই যেন চান তিনি।
টাইপরাইটারের উপর হাত জোড়া ছড়িয়ে দিয়ে চুপচাপ একাউণ্টেণ্টের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কাসেদ।
মকবুল সাহেবের অনুপস্থিতে তাঁর কাজের দায়িত্ব পড়বে একাউণ্টেণ্ট সাহেবের হাতে। প্রমোশন হবে তাঁর। আয় বাড়বে। পদমর্যাদা বাড়বে।
খোদা করুন। তিনি ভালো হয়ে যান তাড়াতাড়ি। কাজের ফাঁকে এক সময় একাউণ্টেণ্ট বললেন, আল্লা তাকে আবার আমাদের মাঝখানে ফিরিয়ে আনুক। এটা কী তার মনের কথা? সত্যি কি তিনি মনেপ্ৰাণে তাই চাইছেন? কাসেদের কেন যেন বিশ্বাস হলো না। মানুষ মাত্র স্বার্থপর। স্বার্থের প্রশ্নের সঙ্গে বিরোধ বাঁধে। বাবাতে ছেলেতে সম্পর্ক ছিন্ন হয়। ভাই ভাইয়ের বুকে ছুরি বসায়।
একাউণ্টেণ্ট সাহেব ভালো করে জানেন, বুড়ো মকবুল যদি সুস্থ হয়ে আবার কাজে ফিরে আসে তাহলে তাঁর পক্ষে সেটা শুভ হবে না। এসব জানা সত্ত্বেও কি তিনি পক্ষাঘাত আক্রান্ত ব্যক্তিটির রোগমুক্তি কামনা করছেন? নাকি, এ তাঁর বাইরের কথা। মনে মনে হয়তো ভাবছেন অন্য কিছু। ভাবছেন বুড়ো আর সুস্থ না হোক। হয় মারা যাক কিম্বা অসুস্থ অবস্থায় পড়ে থাকুক বিছানায়।
মানুষ তাই চায়। নিজের মঙ্গলের জন্যে অন্যের ক্ষতি চিন্তা করতে সে একটুও বিলম্ব করে না।
কাসেদ কাজে মন বসাতে চেষ্টা করলো।
কিন্তু বুড়ো মকবুলের কথা বারবার করে মনে হতে লাগলো তার।
বিকেলে অফিস শেষ হবার কিছু আগে বড় সাহেব ডেকে পাঠালো তাকে। স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর এ ক’দিন কারো সামনে আসেন নি তিনি। কথা বলেন নি কারো সঙ্গে। অফিসে এসেছেন। থেকেছেন। কাজ করেছেন। কাসেদ যখন বড় সাহেবের রুমে এসে ঢুকলো, সাহেব তখন একগাদা ফাইলের মধ্যে মুখ গুজে আছেন। তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে কয়েকবার কাশলো কাসেদ। তবু তিনি তাকাচ্ছেন না দেখে নীরবে সে দাঁড়িয়ে রইলো।
দেয়ালঘড়ির পেণ্ডুলাম দুলছে, দোলনার মত শব্দ হচ্ছে।
বড় সাহেব ফাইলটা বন্ধ করে রাখলেন। তারপর কাসেদের দিকে চোখে পড়তে একটু অবাক হয়ে শুধালেন, আপনি এখানে কেন?
কাসেদ বললো, আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।
সাহেব কী যেন ভাবলেন। কপালের আঁকাবাঁকা রেখাগুলো ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে আসছে তাঁর। দু’চোখে কী এক শূন্যতা।
হঠাৎ নড়েচড়ে বসলেন সাহেব। বললেন, হ্যাঁ, আপনাকে ডেকেছিলাম। ডেকেছিলাম মকবুল সাহেবের খবর জানতে। ও’র কী খবর?
কাসেদ বললো, আমি ঠিক জানি নে। শুনেছি হাসপাতালে আছেন। মেডিক্যাল কলেজে।
হুঁ। টেবিলের উপর ছড়ানো কয়েকখানা কাগজ ফাইলের মধ্যে রেখে দিতে দিতে সাহেব শুধালেন, আপনার কি এখন কোন কাজ আছে?
না।
তাহলে চলুন। একবার হাসপাতালে যাওয়া যাক। টেবিলের ড্রয়ারগুলো বন্ধ করে রেখে উঠে দাঁড়ালেন বড় সাহেব।
হাসপাতালে মকবুল সাহেবের বেডটা খুঁজে বের করতে বিশেষ বেগ পেতে হলো না। পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের সতেরো নম্বর বেড।
দূর থেকে কাসেদ দেখতে পেলো বিছানার চারপাশে মকবুল সাহেবের বউ এবং ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে রয়েছে।
বড় সাহেব চাপা গলায় শুধোলেন, এখন কি ওখানে যাওয়া ঠিক হবে?
কাসেদ কী বলবে ভাবছিলো, এমন সময় মকবুল সাহেবের স্ত্রীর চোখ পড়লো এদিকে।
এদের সেদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাথায় ঘোমটা টেনে এক পাশে সরে দাঁড়ালেন।
বড় ছেলে সামনে এগিয়ে বিনীত স্বরে বললো, আসেন স্যার।
সাহেব যেতে যেতে শুধোলেন, এখন উনি কেমন আছেন?
আগের চেয়ে কিছুটা ভাল আছেন স্যার।
ওরা বেডের যে পাশে গিয়ে দাঁড়ালো তার অন্য পাশে পাশাপাশি তিনটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। তিনজনের মাথায় ঘোমটা টানা।
প্রথম জনের কোলে একটি বাচ্চা মেয়ে। হয়তো সে সবার বড়। বিবাহিতা। দ্বিতীয় জনের বয়স কুড়ি একুশের মতো হবে। মুখখানা ভালো করে দেখতে না পেলেও কাসেদের চিনতে ভুল হয় না।
এই সেই মেয়ে যাকে বিকেলে বাড়ির আঙ্গিনায় বসে থাকতে দেখেছিলো সে। তৃতীয় মেয়েটির গায়ের রঙ ওদের চেয়েও ফর্সা। বয়স অল্প।
সাহেব অত্যন্ত স্নেহের সঙ্গে মকবুল সাহেবের কপালে একখানা হাত রাখলেন। চোখ মেলে তাকালেন মকবুল সাহেব।
একদৃষ্টি তাকিয়ে রইলেন সাহেবের দিকে। চোখের পলক পড়ছে না। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে শুধু। যেন কিছু বলতে চান তিনি।
সাহেব মৃদু গলায় বললেন, চিন্তার কিছু নেই। ভালো হয়ে যাবেন।
মকবুল সাহেবের খোলা চোখ দিয়ে দরদর করে অশ্রু ঝরতে লাগলো।
ওপাশে দাঁড়ান তিনটি মেয়ে আর তাদের মা আঁচলে চোখ মুছলো।
ওরাও কাঁদছে।
কাঁদছে না শুধু ছেলেরা।
ওদের সারা মুখ স্নান। চেহারায় যন্ত্রণার ছাপ। কিন্তু চোখে অশ্রু নেই। সাহেব বললেন, চাকরীর জন্য চিন্তা করবেন না। ওটা আপনারই থাকবে, কিছুদিন পর ভালো হয়ে গেলে আবার জয়েণ্ট করবেন।
মকবুল সাহেব আবার কিছু বলতে চেষ্টা করলেন। বলতে পারলেন না, ওপাশে দাঁড়ান স্ত্রী-কন্যার ওপর চোখের দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে আবার বড় সাহেবের দিকে তাকালেন তিনি। পলক পড়ছে না চোখের।
শুধু পানি ঝরছে আর ঠোঁট জোড়া কাঁপছে।
সাহেব বললেন, টাকা-পয়সার কথা ভাবতে হবে না। আমি বন্দোবস্ত করে দেবো।
এবার, এতক্ষণে কান্না কমে এল তার। যেন অনেকটা আশ্বস্ত বোধ করলেন তিনি।
কাসেদকে দেখলেন। দেখলেন চারপাশে।
কাসেদের দিকে মুখখানা এনে বড় সাহেব চাপা স্বরে বললেন, এদের দেখাশোনার দায়িত্বটা আপাততঃ আপনাকেই নিতে হবে।
কাসেদ সন্মতি জানিয়ে মাথা নত করলো।
বড় সাহেব আবার বললেন, আমি অফিস থেকে কিছু টাকা স্যাঙ্কশন করিয়ে দেবো। প্রয়োজন মত খরচ করবেন।
কাসেদ আবার মাথা নোয়ালো।
একটা নার্স টেম্পারেচার নিয়ে গেলো। তাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে কী যেন আলাপ করলেন বড় সাহেব।
মকবুল সাহেবের মুখের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এসে সেই মেয়েটিকে দেখতে চেষ্টা করলো কাসেদ।
দেখা গেলো না।
সন্ধ্যার মত আবছা-ই রয়ে গেলো সে।
রাস্তায় বেরিয়ে একটা ফলের দোকান থেকে কিছু ফল কিনে দিলেন সাহেব। বললেন, এগুলো হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে আপনি বাসায় চলে যান।
ফলের ঠোঙ্গাটা হাতে নিয়ে চলে আসছিলো কাসেদ।
সাহেব পিছন থেকে আবার ডাকলেন, বললেন, আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি। কিছু মনে করবেন না। সাহেবের গলার স্বরটা কেমন যেন ক্লান্ত আর জড়ানো। কাসেদ অবাক হয়ে তাকালো ওর দিকে।
গাড়ি আছে। বাড়ি আছে। চাকরী আছে ভালো, টাকা-পয়সার অভাব নেই। তবু সুখী হতে পারলো না লোকটা।
কাসেদ নীরবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ওঁর দিকে। কিছু বললো না। পুরো অফিসটা চাপা কথার গুমোট হাওয়ায় ভরে আছে সেই সকাল থেকে।