আগামী রোববার বাসায় আসবে বলেছে জাহানারা। কেন আসবে? কিছু কথা আছে তার। কী কথা?
একবার ডেকেছিল সেতারের মাষ্টার ঠিক করে দেবার জন্য।
এবার হয়তো বলবে, মাষ্টারের সঙ্গে আমার বিয়ের আয়োজন করে দাও।
কাসেদ যেন এ জন্যেই এসেছিলো জাহানারার জীবনে।
দরখাস্তখানা লিখে পকেটে রাখলো কাসেদ।
সাত দিনের ছুটি চাই তার। যদি না দেয় তাহলে, ও চাকরিই ছেড়ে দেবে সে। কী হবে দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত গাধার খাটুনি খেটো?
তারচে’ লিখবে সে। দিন রাত শুধু লিখবে আর লিখবে।
সেই ভালো।
দরখাস্ত নিয়ে অফিসে এসে, খবর শুনে বোবা হয়ে গেলো কাসেদ। বড় সাহেব আবার বিয়ে করছেন। বিয়ে করছেন মকবুল সাহেবের মেজো মেয়েকে।
আগেই জানতাম, এ না হয়ে পারে না। এক নম্বর কেরানী বিশেষ জোরের সঙ্গে বললেন, বলি নি আমি, এতো যে ছুটোছুটি এর পিছনে কিন্তু আছে, দেখলেন তো?
একাউণ্টেণ্ট বললেন, আমারও তাই সন্দেহ হয়েছিল। বলে একটা লম্বা হাই তুললেন তিনি, কিন্তু কি বলেন, ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না? দুনিয়াতে কতো মেয়ে থাকতে কিনা ওই কালো কুৎসিত মেয়েটাকে– কথাটা শেষ করলেন না তিনি। অঙ্গভঙ্গী দিয়েই বাকিটুকু বুঝিয়ে দিলেন।
এক নম্বর কেরানী হাসলেন কাসেদের দিকে তাকিয়ে।
কাসেদ নিজের খবরটা বিশ্বাস করতে পারছিলো না। সেই সেদিন মকবুল সাহেবের বাড়িতে, সন্ধ্যার আবছা আলোয় আবিষ্কার করা মেয়েটি এখন গিন্নি সেজে বড় সাহেবের বাড়িতে এসে উঠেছেন ঘর-সংসার করার জন্য। ইচ্ছে করলে কাসেদও বিয়ে করতে পারতো।
তাহলে এখন বড় সাহেবের ঘরে না থেকে মেয়েটি থাকতো কাসেদের ঘরে। অফিস শেষে বাড়ি ফিরে গেলে ছুটে এসে দরজা খুলে দিত সে। হেসে বলতো, ফিরতে এতো দেরী হলো যে?
কাসেদ গম্ভীর গলায় বলতো, একগাধা কাগজ ফেলে আসি কী করে বল তো?
বলতে বলতে এক হাতে দরজাটা বন্ধ করে দিতো সে আর অন্য হাতে কাছে টেনে নিতো তাকে।
কিন্তু এসব কী চিন্তা করে কাসেদ?
গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে, বেয়ারার হাতে দরখাস্তখানা বড় সাহেবের কাছে পাঠিয়ে দিলো কায়েদ।
একটু পরে বড় সাহেব ডেকে পাঠালেন।
কাসেদ ভাবছিলো, কী বলে ছুটি নেবে।
কিন্তু সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে সব ভাবনা মুহুর্তে দূর হয়ে গেলো।
অবাক হয়ে তাঁর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো সে।
কোট-প্যাণ্ট নয় আজ পায়জামা-পাঞ্জাবী পরে অফিসে এসেছেন তিনি। সারা মুখে পরিতৃপ্তির উজ্জ্বল আভা। দু’চোখে আনন্দের অপূর্ব ঝিলিক। যেন জীবনে এ প্রথম প্রেমে পড়েছেন বড় সাহেব। তার এ রূপ আর কখনো দেখে নি কেউ।
সাহেব মৃদু গলায় শুধোলেন, হঠাৎ ছুটি চাইছেন, কী ব্যাপার?
কাসেদ বললো, মায়ের ভীষণ অসুখ। সারাক্ষণ তার কাছে থাকতে হচ্ছে, তাই। কথাটা সম্পূর্ণ সত্য না হলেও একেবারে মিথ্যে নয়। সাহেব উৎকণ্ঠা জানিয়ে বললেন ভীষণ অসুখ, সেকি? ভালো দেখে ডাক্তার দেখিয়েছেন তো?
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো কাসেদ, বললো, ডাক্তার বলেছে সব সময় রোগীর কাছে কাছে থাকতে, তাইতো–কথাটা শেষ করলো না সে।
টেবিলের ওপর থেকে কলামটা তুলে নিয়ে দরখাস্তের একপাশে কী যেন লিখলেন বড় সাহেব। বললেন ছুটি আমি দিয়ে দিচ্ছি, কিন্তু এর মধ্যে মায়ের শরীর যদি ভালো হয়ে আসে, তাহলে অফিস করবেন এসে। নইলে অনেক কাজ জমা হয়ে পড়ে থাকবে।
দরখাস্তখানা টেবিলের এক পাশে রেখে দিয়ে বেয়ারাকে ডাকবার জন্য বেল টিপলেন বড় সাহেব। তাকে সালাম জানিয়ে ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে এলো কাসেদ।
রোববার দিন আসবে বলেছিলো জাহানারা।
এলো না। সকাল থেকে বাসায় অপেক্ষা করেছে কাসেদ। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো, দুপুর পেরিয়ে বিকেল, তখনো না আসায় বিচলিত বোধ করলো সে। একবার মনে হলো, হয়তো সে আর আসবে না, কাপড় পরে বাইরে বেরুবার তোড়জোড় করলো। কিন্তু কাপড় পরা হয়ে গেলে মনে হলো যদি সন্ধ্যার পরে আসে সে, তাহলে? কাসেদকে ঘরে না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যাবে জাহানারা। কে জানে, কী কথা বলার আছে তার– এমনো হতে পারে শিউলী যা বলেছে তার সবটুকু মিথ্যা। হায় খোদা, যদি তাই হতো।
ভাবতে গিয়ে আর বাইরে বেরুনো হয় না তার।
কিন্তু সন্ধ্যার পরেও এলো না জাহানারা। রাতেও না।
বিরক্ত হয়ে রাত দশটার পরে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে কাসেদ।
ফিরেছে রাত দুটো বাজিয়ে।
সে রোববার না এলেও পরের রোববারে এলো জাহানারা।
তখন বিকেল।
ঘরে এসে মায়ের মাথার কাছে বসলো সে।
অসুস্থ মা অনুযোগভরা কণ্ঠে বললেন, এতদিন পরে এলে মা।
জাহানারা মৃদু গলায় বললো, কাজ ছিলো।
কাজ ছিলো না হাতি ছিলো। অদূরে দাঁড়ানো কাসেদ আনমনে বিড়বিড় করে উঠলো।
মা অত্যন্ত স্নেহের দৃষ্টিতে দেখছিলেন তাকে। আর ফিরে তাকাচ্ছিলেন কাসেদের দিকে।
মা কী চান আর এ মুহুর্তে তিনি মনে মনে কী ভাবছেন তা ভালো করে জানে কাসেদ।
যাঁরা ধর্মপ্রাণ, খোদা নাকি তাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে থাকেন, তবে কি মায়ের বাসনা বাস্তবে রূপ পাবে?
কাসেদ কি বিয়ে করতে পারবে জাহানারাকে?
ওহ! এসব কি ভাবছে সে।
মা আর জাহানারার সামনে থেকে সরে নিজের ঘরে চলে এলো কাসেদ। একটা বিষয় সে এখনো বুঝতে পারছে না। আজ আসার পরে থেকে কাসেদের সঙ্গে এখনো একটা কথাও বলে নি জাহানারা। বললে নিশ্চয় ওর সম্মান হানি হতো না।
সেতারের মাষ্টারকে যদি ও বিয়ে করতে চায় করুক না, তাতে কাসেদের কোন বক্তব্য থাকবে না। ব্যথা যদি সহ্য করতে হয় নীরবে সহ্য করবে সে। পাশের ঘরে মা আর জাহানারা কী আলাপ করছে, সব এ ঘর থেকে শুনতে পাচ্ছে কাসেদ।
মা এখন নাহারের বিয়ের কথা শোনাচ্ছে তাকে।
ওর বিয়ের পাকা কথা দিয়ে দিলাম মা! দিন তারিখ আসছে হপ্তায় ঠিক হবে। ছেলেটি বড় ভালো।
জাহানারা শুধালো, ছেলে কি ঢাকাতেই আছে?
মা বললেন, হ্যাঁ। ঢাকায় বাসা আছে ওর।
জাহানারা বললো, তাহলে ভালোই হলো, সব সময় আমাদের কাছে কাছে থাকবে।
তা মা আমি যত দিন বেঁচে আছি। ওকে চোখের আড়াল করছি নে। বিয়ের পরেও ও আমার কাছে থাকবে। মা ভাঙ্গা গলায় বলছেন, ও আমার ডান হাত। ও কাছে না থাকলে আমি চোখে দেখিনে মা। বড় ভালো মেয়ে। লক্ষ্মী মেয়ে। অমনটি আর হয় না। বলতে গিয়ে একটা
দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন তিনি। কিন্তু থামলেন না। আবার বললেন, মেয়েদের পাঁচ দশটা স্বাদ আহ্লাদ থাকে। ওর তাও নেই। কোনদিন মুখ ফুটে কিছুই চায় নি সে আমার কাছে। বলতে গিয়ে একবার কেঁদে ফেললেন তিনি। কান্নায় বন্ধ হয়ে এলো তাঁর কণ্ঠস্বর।
নাহার ডাকলো, মা।
জাহানারা নীরব। কী বলবে হয়তো সে বুঝে উঠতে পাচ্ছিলো না। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে মা বললেন, যাও, তুমি এবার ও ঘরে গিয়ে বসো। নাহার, মা আমার ওদের জন্যে দু’কাপ চা বানিয়ে দে। কাসেদ বিছানায় বসে বসে এতক্ষণ ওদের আলাপ শুনছিলো।
উঠে দাঁড়িয়ে জানালার পাশে সরে গেলো সে।
দরজার দিকে পেছন ফিরে থাকায় সেদিককার কিছুই এখন সে দেখতে পাচ্ছে না। দেখছে বাইরের আকাশ। যদিও সজাগ মন তার পেছনেই পড়ে আছে। জাহানারার পায়ের শব্দ শোনা গেলো। এ ঘরে।
জানালার ওপর আরো ঝুঁকে এলো সে।
শব্দ থেমে গেছে।
কাসেদ আড়চোখে একবার তাকালো পেছনে।
ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে জাহানারা। দেখছে ওকে।
ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালো কাসেদ। ও, আপনি!
ও কখন এসেছে যেন জানে না সে।
জাহানারা মৃদু গলায় শুধালো, অমন তন্ময় হয়ে কী দেখছিলেন বাইরে?
কিছু না। এমনি দাঁড়িয়েছিলাম। সরে এসে বিছানায় বসলো কাসেদ, বসুন। চেয়ারটা টেনে জাহানারা বসলো। গত রোববার দিন আসবো বলেছিলাম। হঠাৎ একটা কাজ পড়ে যাওয়ায় আসতে পারি নি।
যেন কৈফিয়ত দিচ্ছে সে।
কাসেদ বললো, অবশ্য আমিও বাসায় ছিলাম না। একটা কাজে সারাদিন বাইরে থাকতে হয়েছিলো। মিথ্যে কথাই বললো সে, কেন যে বললো হঠাৎ তার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নিজেও খুঁজে পেলো না।
জাহানারা হেসে বললো, তাহলে না এসে ভালোই করেছি। কি বলেন?
কাসেদ হাসতে চেষ্টা করলো, পারলো না। টেবিলের ওপর থেকে একখানা বই তুলে নিয়ে তার পাতা ওল্টাতে লাগলো জাহানারা। কিছু বলবে সে। কিন্তু, কোত্থেকে যে শুরু করবে। তাই ভেবে উঠতে পারছে না। বার দুয়েক ব্যর্থ হয়ে অবশেষ জাহানারা বললো, আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিলো আমার।
কাসেদ ঢোক গিলে বললো, বলুন।
বুকটা আবার অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে তার। হাত-পাগুলো ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। বইটা বন্ধ করে জাহানারা বললো, আপনি হয়তো জানেন না যে শিউলী একটি ছেলেকে ভালবাসতো।
না, নাতো। কাসেদ অবাক হয়ে তাকালো জাহানারার দিকে। সে বুঝতে পারলো না জাহানারা হঠাৎ শিউলীর প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলছে কেন। স্বল্প বিরতি নিয়ে জাহানারা আবার বললো, ছেলেটি এখন ইটালিতে আছে। ফাইন আর্টসের ছাত্র সে।
কিন্তু— কিছু বলতে গেলো কাসেদ।
ওকে থামিয়ে দিয়ে জাহানারা আবার বললো, দু’বছরের ট্রেনিং-এ গেছে সে। ফিরে এসে ওদের বিয়ে হবে।
কিন্তু সেতো কোনদিন বলে নি আমায়। ঈষৎ বিস্মিত স্বরে কাসেদ বললো। আজ আপনার কাছ থেকেই প্ৰথম শুনছি।