শিউলী আড়চোখে এক পলক দেখে নিয়ে মৃদু হাসলো। হেসে বললো, আপনারা পুরুষ মানুষগুলো এত সহজে বদলে যেতে পারেন যে কী বলবো!
কাসেদ চুপ করে থাকবে ভেবেছিলো, কিন্তু জবাব না দিয়ে পারলো না। অন্য পুরুষের কথা আমি বলতে পারবো না। নিজে আমি সহসা বদলাই নে। আমি যা ছিলাম। তাই আছি, তাই থাকবো।
তাই নাকি? চোখজোড়া বড় বড় করে ওর দিকে তাকালো শিউলী। শুনে বড় খুশি হলাম। কিন্তু জনাব, একটা কথা যদি জিজ্ঞেস করি তাহলে রাগ করবেন না তো? মুখ টিপে হাসছে শিউলী।
কাসেদ বললো, বলুন।
ক্ষণকাল চুপ করে থেকে শিউলী ধীরে ধীরে বললো, সেদিন বিকেলে সেই একসঙ্গে রিক্সায় চড়ে হাতে হাত রেখে বেড়ানো আর মাঝে মাঝে একটা কী দুটো কথা বলা এর সবটুকুই কি মিথ্যা। মুখখানা নুইয়ে ওর চোখে চোখে তাকাতে চেষ্টা করলো শিউলী।
সহসা কোন উত্তর দিতে পারলো না সে।
একটু পরে কী ভেবে বললো, আপনি যা ভাবছেন সে অর্থে মিথ্যে।
আমি কী ভেবেছি তা আপনি বুঝলেন কী করে?
কারণ আমি শুনেছি সব। কাসেদ বিরক্তির সঙ্গে বললো: জাহানারা এসেছিলো বাসায়, কাল বিকেলে।
শিউলী হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলো।
অনেকক্ষণ চুপচাপ কী যেন ভাবলো সে।
রিক্সাটা কাসেদের অফিসের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে।
শিউলী আস্তে করে বললো, সেদিন আপনি একটা অনুরোধ করেছিলেন, আমি রেখেছিলাম। আজ আমার একটা কথা। আপনি রাখবেন? ওর কণ্ঠস্বরে আশ্চৰ্য আবেগ।
নড়েচড়ে বসে কাসেদ শুধালো, কী কথা বলুন?
শিউলী ধীর গলায় বললো, আজ বিকেলে আমি নিউ মার্কেটের মোড়ে আপনার জন্যে অপেক্ষা করবো, আপনি আসবেন, কিছু কথা আছে আপনার সঙ্গে। আসবেন তো?
রিক্সা থেকে নেমে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো কাসেদ।
তারপর মৃদুস্বরে বললো, চেষ্টা করবো।
চেষ্টা করবো নয়, অবশ্যই আসবেন।
ততক্ষণে অফিসের দৌড়গোড়ায় পা দিয়েছে কাসেদ।
শিউলী রিক্সা নিয়ে তখনো দাঁড়িয়ে রইলো, না চলে গেলো, একবার ফিরেও দেখলো না সে।
অফিসে এখন আর সে উত্তেজনা নেই।
সব শান্ত।
মকবুল সাহেব পক্ষাঘাত রোগে এখনও বিছানায় পড়ে আছেন। ভালো হবার কোন সম্ভাবনা নেই।
পরস্পরের কাছ থেকে শোনা যায়। আজকাল আর আগের সে আর্থিক অনটন নেই তাঁর। বড় সাহেবের শ্বশুর এখন, বেশ সুখেই আছেন। বড় সাহেবও বেশ সুখী।
রোজ দুপুরে মকবুল সাহেবের মেয়ে বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসে তাঁর জন্যে। পরনে সুন্দর একখানা শাড়ি, মাথায় ছোট একটা ঘোমটা, হাতে একটা টিফিন ক্যারিয়ার, পায়ে পাতলা স্যাণ্ডেল। নিঃশব্দে মেয়েটি উঠে আসে ওপরে। হাল্কা পায়ে সে এগিয়ে যায় বড় সাহেবের কামরার দিকে। তারপর দু’জনে একসঙ্গে খায়। খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে নীরবে। আবার বাড়ি ফিরে যায় মেয়েটি।
প্রথম প্রথম অফিসের সবাই মুখ টিপে হাসতো। চাপা ঘরে আলোচনা চলতো ওদের।
আজকাল তাও বন্ধ।
শুধু মেয়েটি যখন আসে আর সামনে দিয়ে হেঁটে বড় সাহেবের ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। তখন কী একটা অস্বস্তিতে ভোগে কাসেদ।
ইচ্ছে করে মেয়েটিকে দেখতে।
কিন্তু ও যখন আসে তখন ওর মুখের দিকে তাকাতে গিয়েও পারে না সে। কোথা থেকে একটা জড়তা এসে সারা দেহ গ্ৰাস করে নেয় ওর। মেয়েটি ওর বউ হতে পারতো।
ইচ্ছে করলে ওকে বিয়ে করতে পারতো কাসেদ।
হয়তো ওকে নিয়ে বেশ সুখী হতে পারতো সে। আজ বড় সাহেবের জন্যে খাবার নিয়ে আসে, সেদিন কাসেদের জন্যে আসতো মেয়েটি।
দু’জনে এক সঙ্গে খেত ওরা।
কথা বলতো।
গল্প করতো।
কত না আলাপ করতো খেতে বসে।
কিন্তু জাহানারা।
জাহানারা, একি করলে তুমি?
অফিসের কাজ করতে বসে একটুও মন বসল না ওর। গতদিন বিকেলের ছবিটা বার বার ভেসে উঠছে চোখে। জাহানারার প্রতিটি কথা আবার নতুন করে কানে বাজছে এখন। টাইপরাইটারটা একবার কাছে টেনে নিয়ে আবার দূরে ঠেলে দিলো সে। হঠাৎ সামনে টেবিলের উপর বিছানো কাগজের দিকে চোখ পড়তে চমকে উঠল কাসেদ।
জাহানারার নাম লিখে সম্পূর্ণ কাগজটা ভরিয়ে তুলেছে সে।
চারপাশে দ্রুত তাকিয়ে নিয়ে একটা কলম দিয়ে ধীরে ধীরে নামগুলো কেটে ফেললো সে।
কাটতে গিয়ে একটুখানি ম্লান হাসলো সে।
ওর জীবনে থেকেও জাহানারার নামটাকে হয়তো এমনি করে কেটে ফেলতে হবে একদিন।
অফিস থেকে বেরুবার আগে মন স্থির করে নিয়েছিলো কাসেদ। বিকেলে যাবে জাহানারার ওখানে। কাল যে ভুল বুঝাবুঝির মধ্য দিয়ে সে চলে এসেছে তা দূর করে আসবে আজ।
যে কথাটা এতদিন বলে নি, বলতে গিয়েও পিছিয়ে এসেছে। আজ সে কথাটা ওকে খুলে বলবে সে। হয়তো শুনে হাসবে জাহানারা। শব্দ করে হেসে উঠবে, তবু বলবে কাসেদ।
যা হবার হোক।
জীবনে একটা চরম সিদ্ধান্ত নিতে চায় সে।
জাহানারাদের বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওর মনে হলো কে জানে হয়তো আজ এখানে এই শেষ আসা।
বুড়িটা বাচ্চা কোলে নিয়ে বারান্দায় বসেছিলো। ডেকে এনে ওকে বসালো ভেতরে। বললো, বয়েন, উনি উপরে আছেন, খবর দিই গিয়া। বলে সে চলে গেলো ভেতরে। সেই যে গেলো অনেকক্ষণ আর তার দেখা নেই, একা ঘরে বসে বসে ক্লান্তিবোধ করলো সে। উঠে দাঁড়িয়ে বার-কয়েক পায়চারী করলো। বসলো, আবার উঠে দাঁড়ালো।
জাহানারা এলো না, এলো সেই বুড়ি। ওর মুখের দিকে সন্ধানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শুধালো, আপনার নাম কী?
কাসেদ নাম বলতে আবার ভেতরে চলে গেলো বুড়ি।
আবার সব চুপ।
অনেকক্ষণ হলো কারো আসার লক্ষণ দেখা গেলো না।
চোখ মেলে প্রতিনিয়ত দেখা দেয়াল আর কড়িকাঠগুলো দেখতে লাগলো কাসেদ।
কিভাবে জাহানারার সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে, মনে মনে একবার তার মহড়া করে নিলো।
তবু কেউ আসে না।
অবশেষে এল।
জাহানারা নয়। বুড়িটিও নয়। ওদের বাচ্চা চাকরটা।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো কাসেদ।
চাকরটা মৃদু হেসে বলল, আপাজানের শরীর খারাপ, আজ দেখা হবে না। অন্যদিন আসতে বলেছে।
শরীর খারাপ বলে নিচে নেমে এসে একবার কাসেদের সঙ্গে দেখাও করতে পারলো না জাহানারা? এর আগে জ্বর নিয়েও ওর সঙ্গে বাইরে বেরিয়েছে সে, কাসেদ নিষেধ করলেও আমল দেয় নি।
আর আজ!
কথাটা সহসা বিশ্বাস হতে চাইলো না ওর।
চাকরটা মৃদু হেসে চলে গেলো ভিতরে।
হাসলো না, যেন বিদ্রুপ করে গেলো ওকে।
আবার একা।
ঘরের মধ্যে বার-কয়েক পায়চারি করলো কাসেদ। ভালো লাগছে না, বারবার করে মনে হলো, জাহানারা আজ ইচ্ছে করে অপমান করলো তাকে। সে কোন অপরাধ করে নি। তবু তাকে শাস্তি দিলো জাহানারা। কাসেদের মনে হলো পুরো দেহটা জ্বলছে ওর।
অপমান আর অনুশোচনার তীব্ৰ জ্বালা যেন পাগল করে তুলেছে তাকে। কেন ওকে ভালবাসতে গেল সে!
সামান্য ভদ্রতা আর সহজ মানবিক বৃত্তিগুলোও হারিয়ে ফেলেছে জাহানারা। অতি নিচে নেমে গেছে সে।
ওর তুলনায় সালমা অনেক বড়ো। অনেক উদার মনের মেয়ে সে। দেখতে শুনতেও সে খারাপ নয়। প্রাণভরে কাসেদকে ভালবাসতো সালমা। মুহুর্তের জন্যে কাসেদের মনে হলো সালমার ডাকে সেদিন সাড়া না দিয়ে মস্ত বড় ভুল করেছে সে।
আর শিউলী?
শিউলীর কথা মনে হতে কাসেদের মনে পড়লো, সন্ধ্যার আগে আগে শিউলী ওর জন্যে অপেক্ষা করবে বলেছে নিউমার্কেটের মোড়ে।
শিউলীর পাশে জাহানারাকে আজ অনেক ছোট মনে হলো কাসেদের। শিউলীর হাসি। কথা। আলাপের ভঙ্গী আর বাচ্চা মেয়ের মতো ব্যবহার সব সুন্দর। অন্তত জাহানারার চেয়ে।