জাহানারা স্থিরদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। তারপর টেনে টেনে বললো, আপনি জানেন না বলেই আপনাকে জানানো প্রয়োজন। নইলে–সে থেমে গেলো হঠাৎ৷
কাসেদ ইতস্তত করে বললো, কিন্তু এসব আপনি কেন বলছেন। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
আপনি অবুঝ নন। জাহানারা পরক্ষণে বললো, কাউকে ভালবাসতে যাওয়ার আগে তার সব কিছু জেনে নেয়া উচিত, নইলে পরের দিকে অশেষ অনুতাপে ভুগতে হয়। বলতে গিয়ে চোখেমুখে রক্ত এসে জমেছে তার। কথাগুলো জড়িয়ে আসতে চাইছে বারবার।
কাসেদ চমকে উঠলো।
কিছু বলতে যাবে এমন সময় চা হাতে নাহার এসে ঢুকলো ঘরে।
দু’জনের দিকে দু’কাপ চা বাড়িয়ে দিতে গিয়ে উভয়ের দিকে তাকালো নাহার। তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো সে।
টেবিলের ওপর চায়ের পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে জাহানারা আবার বললো, অবশ্য শিউলী মেয়ে হিসেবে খারাপ নয়। আমার কাজিন। আমি ওকে ভালো করে জানি।
তাছাড়া আপনার সঙ্গেও মানাবে বেশ। কিন্তু কথাটা শেষ করলো না সে।
বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে, কী ভেবে আবার বসে পড়লো কাসেদ। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে শুধালো, আপনার কথা কি শেষ হয়েছে?
জাহানারা কথার জবাবে বললো, আমার অনধিকার চর্চার জন্যে হয়তো আপনি রাগ করেছেন। তাই ক্ষমা চাইছি।
কাসেদ বললো, ক্ষমা চাওয়ার কোন প্রশ্ন আসে না। কিন্তু কথা কি জানেন, আপনি যে এই এতক্ষণ এত কিছু বললেন আমি তার কোন হদিস খুঁজে পাচ্ছি না। শিউলীকে আমি ভালবাসি এ কথা আপনাকে কে বললো শুনি?
ভয় নেই। জাহানারা মৃদু হেসে বললো, আমি নিশ্চয় এ নিয়ে দশ জায়গায় আলোচনা করবো না।
কাসেদ বিরক্তির সঙ্গে বললো, আপনি ভুল করছেন। শিউলীর সঙ্গে আমার তেমন কোন সম্পর্ক নেই। বিশ্বাস করুন।
সহসা গম্ভীর হয়ে গেল জাহানারা। স্থিরচক্ষে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সে। কী যেন খুঁজতে চেষ্টা করলে ওর দু’চোখের মণিতে। তারপর টেনে টেনে বললো, সেদিন বাসা থেকে ফিরে আসার পথে আপনি কি কিছু বলেন নি ওকে?
কাসেদ ভাবতে চেষ্টা করলো। সেদিন অনেক কথা হয়েছে শিউলীর সঙ্গে। অনেক আলাপ। সঠিক সব কিছু ভাবতে গিয়েও মনে হলো না তার।
ওকে চুপ থাকতে দেখে জাহানারা মৃদু হাসল। উঠে দাঁড়িয়ে বললো, অনেক রাত হয়ে গেলো, এখন উঠি তাহলে।
কাসেদ সঙ্গে সঙ্গে বললো, একটা ভুল ধারণা নিয়ে আপনি চলে যাবেন? বসুন। আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।
জাহানারা বসলো। বসে বললো, বলুন কী কথা।
পাশের ঘরে মা নামাজ শেষে টেনে টেনে সুর করে কোরান শরীফ পড়ছেন। শরীরটা আজ একটু ভালো যাচ্ছে তাঁর। তাই উঠে বসেছেন বিছানায়।
কাসেদ নীরবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো মেঝের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বললো, সেদিন ওর সঙ্গে আমার তেমন কোন কথা হয়নি। যা হয়েছিল তার সবটুকু আমার মনে নেই। তবে যে কথাই হোক না কেন, তা থেকে আপনি যে সিদ্ধান্ত টেনেছেন তা–সত্যি বলতে কী হাসি পাওয়ার মতো।
জাহানারা মৃদু হাসলো। আপনার কাছে কৈফিয়ত চাই নি কাসেদ সাহেব।
আমি কৈফিয়ত দিচ্ছিও না। সহসা রেগে গেলো কাসেদ। আপনি শুনতে চেয়েছিলেন তাই বলছিলাম। না করলে বলবো না। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার দিকে সরে গেলো সে।
দু’জনে নীরব।
পাশের ঘর থেকে শুধু মায়ের সুর করে কোরান পড়ার শব্দ আসছে ভেসে। ধীরে ধীরে রাত বাড়ছে বাইরে।
আকাশে অনেক তারা।
এবার চলি। পেছন থেকে জাহানারার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল কাসেদ। ফিরে তাকালো না।
বললো, আসুন।
ঘরের মাঝখান থেকে জুতোর শব্দ ধীরে ধীরে ঘরের বাইরে চলে গেলো। পাশের ঘরে মায়ের সঙ্গে কথা বলছে জাহানারা।
কাসেদ তখনও জানালার পাশে দাঁড়িয়ে।
মানুষের সঙ্গে সহজভাবে মেলামেশার পরিণাম অবশেষে এই দাঁড়ায়। জাহানারার মাধ্যমে আলাপ হয়েছিলো। তারপর দেখা হলে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতো। আলোচনা করতো। এর উর্ধ্বে অন্য কোন সম্পর্ক ছিলো না।
কে জানে হয়তো এটা জাহানারার একটা মনগড়া ব্যাপার। নিজে থেকে হয়তো একটা সিদ্ধান্ত টেনেছে সে। আর তাই নিয়ে ছুটে এসেছে কাসেদকে বলতে। বলতে নয় ঠিক, বকতে। কিন্তু কেন?
কাসেদ যদি শিউলীকে সত্যি ভালবেসে থাকে তাতে জাহানারার এত মাথাব্যথ্যা কেন। ভাবতে গিয়ে হঠাৎ যেন একটু আলোর সন্ধান পেলো কাসেদ।
জাহানারা ভালবাসে ওকে।
শিউলী যা বলেছে সব মিথ্যে।
এতো অস্থিরতার মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য মনটা ভালো হয়ে গেলো ওর। বেশ হাল্কা বোধ করলে সে।
কাল বিকেলে অফিস থেকে বেরিয়ে জাহানারাদের বাসায় যেতে হবে তাকে। ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে সব। তুমি যা ভেবেছো তার সবটুকু মিথ্যে জাহানারা। শিউলীর সঙ্গে আমার তেমন কোন সম্পর্ক নেই। যদি কিছু থেকে থাকে সেতো তোমার সঙ্গে।
আমি তোমাকে ভালবাসি জাহানারা।
না। তা হয় না। মাষ্টার সাহেবের সঙ্গে আমাদের বিয়ের সব ঠিক হয়ে গেছে।
জাহানারা অটল।
না জাহানারা। একবার চেয়ে দেখো তোমাকে ভালবেসে আমি যে নিঃশেষ হয়ে গেলাম।
আমি একটি মেয়ে, ক’জনকে ভালবাসবো বলুন তো? জাহানারার চোখে মুখে কৌতুক।
শুধু আমাকে। শুধু আমাকে জাহানারা। কাসেদের গলার স্বর কাঁপছে। বুকের নিচে যন্ত্রণা।
বাইরে কাক ডাকছে। বোধ হয় ভোর হয়ে এলো।
বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো কাসেদ।
চোখজোড়া জ্বালা করছে।
মাথা ঘুরছে।
সারা দেহে ঘাম করছে ওর।
মা আর নাহার চাপাস্বরে কথা বলছে পাশের ঘরে।
ভোর হবার অনেক আগে ঘুম থেকে উঠে ওরা। সাংসারিক আলাপ আলোচনাগুলো বিছানায় শুয়ে শুয়ে এ সময়ে সেরে নেয়।
কলতলায় গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে মাথায় জল ঢাললো কাসেদ।
মাথা তুলতে দেখে, নাহার তোয়ালে হাতে পেছনে দাঁড়িয়ে।
হাত বাড়িয়ে তোয়ালেখানা ওকে দিলো নাহার। আস্তে করে বললো, সাবান এনে দেবো?
তোয়ালেখানা হাতে নিয়ে কাসেদ বললো, না।
নাহার আর দাঁড়ালো না, যেমন নিঃশব্দে এসেছিলো তেমনি চলে গেলো সে।
ঘরে এলে মা শুধালেন, কিরে আজ এত সকাল-সকাল উঠলি যে?
কাসেদ সংক্ষেপে বললো, এমনি।
বেলা ন’টার সময় অফিসে যাবার জন্যে বেরুচ্ছে, মা কাছে ডাকলেন, পাশে বসিয়ে গায়ে-মাথায় হাত বুলালেন ওর। বললেন, আজ একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসবি বাবা, আমার কেমন যেন লাগছে।
কাসেদ বললো, ভেবো না মা, তুমি খুব শিঘ্রী ভালো হয়ে যাবে।
মা ম্লান হাসলেন।
বাসা থেকে বেরিয়ে খানিকটা পথ এসেছে, একখানা রিক্সা এসে থামলো সামনে।
শিউলী বসে, মিটমিটি হাসছে সে।
মুহুর্তে বিগত বিকেলের কথা মনে পড়ে গেলো কাসেদের।
বাহ্, বেশ তো! রিক্সা থেকে দ্রুত নেমে এসে শিউলী বললো, আমি এলাম বাসায় আর আপনি চলে যাচ্ছেন?
আপনার কোন বাঁধন নেই, আমাকে অফিসে চাকুরি করে খেতে হয়। – যথাসম্ভব গভীর হবার চেষ্টা করলো কাসেদ।
শিউলী বললো, সে আমি জানি। আর এও জানি আপনি একজন অনুগত কেরানী। কাজ ফেলে বসে থাকেন না। মিষ্টি করে কথাটা বললো সে, বলে হেসে উঠলো তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গীতে।
কাসেদ তেমনি গম্ভীর স্বরে বললো, বাসায় মা আছেন, নাহার আছে, যান না, ওদের সঙ্গে গল্প করে বেশ কিছুটা সময় কাটবে আপনার।
আমি ওদের কাছে আসি নি তা আপনি জানেন, শিউলীর কণ্ঠস্বর সহসা পাল্টে গেলো।
কাসেদ ইতস্তত করে বললো, তাহলে কার কাছে এসেছেন?
তাও আমাকে বলতে হবে? ভ্রূজোড়া বিস্তারিত করে অপূর্ব ভঙ্গীতে হাসলো শিউলী, তাহলে শুনুন, আমি আপনার কাছে এসেছি এবং আপনার কাছেই আসি।
কিন্তু কেন? উত্তেজিত গলায় কাসেদ শুধালো, আপনার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই যার জন্যে আপনি আমার কাছে আসতে পারেন। সারা মুখ কালো হয়ে গেলো শিউলীর।
ঠোঁটের কোণে একসূতো হাসি জেগে উঠলো ধীরে ধীরে, তারপর সে হাসি অতি সুক্ষ্ম ঢেউ তুলে ছড়িয়ে পড়লো তার সম্পূর্ণ ঠোঁটে, চিবুকে, চোখে, সারা মুখে।
শিউলী মৃদু গলায় বললো, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝগড়া না করে, আসুন রিক্সায় উঠুন। ভয় নেই আপনাকে নিয়ে আমি কোথাও পালিয়ে যাবো না, অফিসে নামিয়ে দিয়ে আমার হোষ্টেলে ফিরে যাবো।
কাসেদ বললো, আমি রোজ হেঁটে যাই, আজও যেতে পারবো।
শিউলী বললো, দেখুন মেয়েমানুষের মত রাগ করবেন না, উঠুন, রিক্সায় উঠুন। শিউলীর চোখের দিকে তাকিয়ে এবার আর না করতে পারলো না কাসেদ, নীরবে উঠে বসলো সে।
রিক্সাওয়ালাকে যাবার জন্যে নির্দেশ দিয়ে শিউলীও উঠে বসলো পাশে। আজ একটু ছোট হয়ে বসতে চেষ্টা করলো কাসেদ।
শিউলীর গায়ে গা লাগতে পারে সেই ভয়ে।