বড় সরল মেয়ে শিউলী।
কিছুক্ষণের পরিচয়ে বড় সহজ হয়ে এসেছে সে। যে কথাগুলো সকলকে বলা যায় না, তাও সে বলেছে ওকে।
জাহানারা যদি শিউলীর মত হতো? কাসেদ ভাবলো নীরবে।
শিউলী বললো, আমার আর সব বন্ধুরা যদি আপনার মতো হতো তাহলে বড় ভালো হতো, তাই না কাসেদ সাহেব?
কাসেদ বললো, আমি আপনার বন্ধুদের কোনদিন দেখিনি সুতরাং তাদের সম্পর্কে কোন মন্তব্য করতে পারছিনে। তবে, আমাকে কেন যে আপনি আদর্শ বন্ধু বলে ভাবছেন তাও ঠিক বুঝতে পারলাম না। একি আপনার উচিত হচ্ছে?
নিশ্চয়ই হচ্ছে। অত্যন্ত জোরের সঙ্গে জবাব দিলো শিউলী। আজকাল আর মানুষ চিনতে আমার ভুল হয় না। আপনাদের মত পুরুষের চোখের দিকে তাকালেই মনের ভাষা পড়ে নিতে পারি আমি। বুঝতে পারি, লোকটা কেমন।
শিউলী থামালো।
কাসেদ মৃদু হেসে বললো, অল্প বয়সে দেখছি অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে আপনার।
অভিজ্ঞতা কম বেশি সবারই হয়। শিউলী গম্ভীর গলায় জবাব দিলো। তবে কেউ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়, কেউ নেয় না।
আপনি কোন দলে?
শিউলী বলল, প্রথমোক্ত।
কাসেদ বলল, তাহলে নতুন কোন পুরুষের সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব না করাই উচিত।
তারপর বন্ধু বানানো উচিত।
আমাকে যাচাই করেছেন কি?
অবশ্যই।
কখন করলেন?
আপনার অজান্তে। মুখ টিপে হাসল শিউলী। আমার বাসা এসে গেছে। এখানে নামতে হবে আমায়।
রিক্সাটা থামিয়ে ছাই রঙের একটা দোতলা বাড়ির সামনে নেমে পড়লো শিউলী। বাড়ির বারান্দায় উঠে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকালো সে। বললো, আবার দেখা হবে। সময় করে একবার আসুন আমাদের বাসায়। কাল কিম্বা পরশু।
কাসেদ সংক্ষেপে বলল, আসবো।
রিক্সা থেকে মুখ বের করে ওদের বাসাটা ভালো করে দেখে নিলো সে। দেখলো একটা বুড়ো দোতলার বারান্দায় নীরবে দেখছে ওদের।
বাসায় এসে একবার জাহানারা ও শিউলীর কথা ভাবলো কাসেদ। দুটি মেয়েতে কী আশ্চৰ্য ব্যতিক্রম।
জাহানারাকে সে আজ অনেক দিন ধরে চেনে।
কতদিন সে গেছে ওদের বাসায়।
সেও এসেছে এখানে।
সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেছে ওরা, তর্ক করেছে ইকবালের দর্শন নিয়ে। রবি ঠাকুরের কবিতা নিয়ে।
মাঝে মাঝে ব্যক্তিগত আলোচনার আশেপাশে এলেও গভীরে যায়নি কোনদিন। ইচ্ছে করেই যেন এড়িয়ে গেছে জাহানারা।
হ্যারিকেনের আলোটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে টেবিলের উপর থেকে একটা খাতা টেনে নিয়ে বসলো কাসেদ। কবিতা লিখবো। বহুদিন কিছু লেখা হয় নি।
পাশের ঘরে ছোট খালুর সঙ্গে কথা বলছেন মা।
তাদের কথাগুলো এখান থেকে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে কাসেদ।
মা বললেন, ওদের দু’জনকে নিয়েই তো আমার যত দুশ্চিন্তা। নিজের জন্যে ভাবিনে। বুড়ো হয়ে গেছি। কাল বাদে পরশু একদিন কবরে যেতে হবে।
খালু বললেন, ‘সব বুড়ো-বুড়িদেরই ওই এক চিন্তা বড়বু’, ছেলেমেয়েদের একটা কিছু হিল্লে হোক। দু’পয়সা রুজি-রোজগার করে নিজের পায়ে দাঁড়াক ওরা। আরো কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন তিনি।
মা কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে হঠাৎ বললেন, নাহারের জন্যে একটা ছেলে দেখে দাও না। বয়স তো ওর কম হলো না।
খালু বললেন, ‘আজকাল ছেলে পাওয়া বড় ঝকমারি বড়বু’। ম্যাট্রিক পাশ করা ছেলে, সেও আবার ম্যাট্রিক পাশ মেয়ে চায়, বুঝলেন না?
মা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর অস্পষ্ট গলায় বললেন, মেয়ে আমার ম্যাট্রিক পাশ নয় সত্যি, কিন্তু ঘরকন্নায় ওকে কেউই হার মানাতে পারবে না। ক্ষণকাল নীরব থেকে মা আবার বললেন, কী যে হয়েছে আজকাল কিছু বুঝিনে, আমাদের জামানায় লোকে দেখতো মেয়ে কেমন রান্নাবান্না করতে পারে।
‘সে জামানা পুরোনো হয়ে গেছে বড়বু’। এখন লোকে লেখাপড়া না জানা বউ-এর কথা চিন্তাও করতে পারে না।
খালু থামলেন।
অনেকক্ষণ ওদের কোন কথাবার্তা শোনা গেল না।
হয়তো এখনো মনে মনে নাহারের কথা চিন্তা করছেন মা।