অন্যদিন।
খালুজী তখন বরিশালে বদলী হয়ে গেছেন।
সালমা কলেজে পড়ে।
অফিসের কী একটা কাজে বরিশাল যেতে হলো তাকে।
তিন দিন ছিলো।
যেদিন রাতে সে চলে আসবে সেদিন সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়া হলো, কিন্তু সালমাকে আশেপাশে কোথাও খুঁজে পেল না।
খালাম্মাকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, কী জানি কোথায় গেলো। বোধ হয় ছাদে, বলে বার কয়েক ওর নাম ধরে ডাকলেন তিনি।
কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া গেলো না।
কিছুক্ষণ পরে ছাদে এসে কাসেদ দেখলো, সালমা দাঁড়িয়ে। ছাদের এক কোণে, চুপচাপ।
পরনের কালো শাড়িটা গাঢ় অন্ধকারের সঙ্গে মিশে গেছে তার। চুলগুলো এলো খোঁপা করা।
দূরে, ষ্টিমার ঘাটের দিকে তাকিয়ে কি যেন গুনগুন করছে সে।
হয়তো কোনো গানের কলি কিম্বা কোনো অপরিচিত সুর।
কাসেদ ডাকলো, সালমা।
সালমা ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকালো ওর দিকে। কিছু বললো না।
কাসেদ বললো, আমি যাচ্ছি সালমা।
সালমা পরক্ষণে বললো, যাবেন বৈ-কি, আপনাকে তো কেউ ধরে রাখে নি।
কাসেদ অপ্ৰস্তুত গলায় বললো, না, তা নয়, তোমার কাছ থেকে বিদায় নিতে এলাম।
সালমা মৃদু গলায় বললো, বেশ বিদায় দিলাম।
কাসেদ চলে যাচ্ছিলো, সালমা পেছন থেকে ডাকলো তাকে, শুনুন, এখুনি কি যাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
এত সকাল সকাল গিয়ে কি হবে।
সকাল কোথায়, ষ্টিমারের সময় হয়ে গেছে।
কে বললো, এখনো দুঘণ্টা বাকি।
বাজে কথা।
চলুন, ঘড়ি দেখবেন।
কাসেদের সঙ্গে নিচে নেমে এলো সালমা।
ড্রয়ার থেকে খালুজীর ঘড়িটা বের করে এনে দেখালো তাকে। বললো, আমার কথা বিশ্বাস করেন নি তো, এই দেখুন, এখন মাত্ৰ নটা বাজে। ষ্টিমার ছাড়বে এগারোটার সময়।
ঘড়ি দেখে অবাক হলো কাসেদ। সেই কখন সন্ধ্যা হয়েছে; এতক্ষণে ন’টা। সালমা কোনো জবাব দিল না। ঘড়িটা আবার ড্রয়ারে রেখে দিলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খোপাটা খুলে চুলে চিরুনি বুলোতে লাগলো সে। সহসা পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে শুধালো, যাবার জন্যে অমন হন্যে হয়ে উঠছেন কেন শুনি।
কাসেদ বললো, চিরকাল থাকবো বলে আসি নি নিশ্চয়। কাজে এসেছিলাম, সারা হলো, চলে যাচ্ছি।
চোখজোড়া বড় বড় করে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সালমা।
তারপর মুখখানা অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে মৃদু গলায় বললো, আপনাকে চিরকাল এখানে থাকতে বলছেই বা কে।
বললেও হয়তো আমি থাকতাম না।
নিজেকে আপনি কী ভাবেন বলুন তো? হঠাৎ ফোঁস ফোঁস করে উঠলো সালমা।
কাসেদ শান্ত স্বরে বললো, একজন অধম কেরানী।
কেরানীর অত দেমাক কেন?
কবি বলে।
সালমা চুপ করে গেলো। চিরুনিটা টেবিলের উপর ছুঁড়ে ফেলে দিলো সে। চুলগুলো আবার খোঁপায় বাঁধলো। বন্ধ জানালাটা খুলে কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে রইলো সে। বাইরে আজ বৃষ্টি নেই। মেঘ নেই। আছে শুধু অন্ধকার। সীমাহীন অন্ধকারে ঢাকা দূরের দিগন্ত।
জানালা থেকে মুখখানা সরিয়ে নিয়ে এলো সালমা। চুপ করে বসে আছেন কেন, আপনার ষ্টিমারের সময় হয়ে গেছে। একটু পরে গিয়ে দেখবেন, ওটা আর ঘাটে নেই।
তা নিয়ে তোমার আর মাথা ঘামাতে হবে না। কাসেদ আস্তে করে বললো, ষ্টিমার ছাড়ার এখনো অনেক দেরি।
সালমা স্নান হাসলো। তারপর ড্রয়ার থেকে ঘড়িটা বের করে এনে মৃদু গলায় বললো, ওটা আমি এক ঘণ্টা স্লো করে দিয়েছিলাম।
কেন?
আমার ইচ্ছে হয়েছিল তাই। বলে সামনে থেকে সরে গেল সালমা।
ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
আর এলো না।