পাশের ঘর থেকে মায়ের কোরান শরীফ পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। টেনে টেনে সুর করে পড়ছেন তিনি। রোজ পড়েন। সকালে, দুপুরে আর রাতে। মাসে একবার করে কোরান শরীফ খতম করা চাই, নাইলে উনি শান্তি পান না। রাতে ভাল করে ঘুমও হয় না তাঁর।
মাঝে মাঝে কাসেদ বলে, মা, এত পুণ্য দিয়ে তুমি করবে কী শুনি?
মা হেসে জবাব দেন, একি শুধু আমার নিজের জন্যেরে—, তোদের জন্যে নয়? বলতে গিয়ে সহসা মায়ের মুখখানা স্নান হয়ে আসে। হয়তো মৃত স্বামীর কথা সে মুহুর্তে মনে পড়ে তাঁর। বাবা ছিলেন একেবারে উল্টো মেরুর মানুষ। ভুলেও কোনদিন ধর্ম-কর্মের ধার ধারতেন না তিনি। একবেলা নামাজ কিম্বা একটা রোজাও কখনো রাখেন নি।
মা কিছু বলতে গেলে উল্টো ধমকে উঠতেন, বলতেন ওসব বাজে কাজে সময় ব্যয় করার ধৈৰ্য আমার নেই।
মা আহত হতেন। কিন্তু সাহস করে আর কিছু বলতেন না।
বাবা মারা গেছেন, আজ কতদিন। আজও রাত জেগে মা বাবার জন্যে প্রার্থনা করেন। কান্নাকাটি করেন। খোদার কাছে বলেন, ওকে তুমি মাফ করে দিও খোদা, ওর সব অপরাধ তুমি ক্ষমা করে দিও।
চারপাশে তাকিয়ে দেখলো, বিছানাটা সুন্দর করে বিছিয়ে দিয়ে নাহার ইতিমধ্যে সরে পড়েছে। রান্নাঘরে বোধ হয় খাওয়ার আয়োজন করছে সে এখন।
বইটা খুলে জাহানারার চিঠিখানা আবার বের করলো কাসেদ।
হাতের লেখাটা বেশ পরিষ্কার আর ঝকঝকে।
জাহানারা, আমি তোমাকে ভালবাসি জাহানারা!
জাহানারা নীরব।
চোখজোড়া মাটিতে নামিয়ে নিয়ে কী যেন গভীরভাবে ভাবছে সে।
সারা মুখে ঈষৎ বিস্ময়।
সারা দেহ উৎকণ্ঠায় কাঁপছে তার। সন্দেহ আর সম্ভাবনার দোলায় দুলছে তার মন!
কাসেদ ভয়ে ভয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি আমায় ভালবাস না জাহানারা?
জাহানারার ঠোঁটের কোণে এতক্ষণে এক টুকরো হাসি জেগে উঠলো।
ধীরে ধীরে সে হাসি চোখে আর চিবুকে ছড়িয়ে পড়লো তার। লজ্জায় মাথাটা নত হয়ে এলো। মুখখানা অন্য দিকে সরিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে সে বললো, তুমি কি কিছুই বোঝ না?
কাসেদ নীরব।
মুহুর্তের আনন্দে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে। দীর্ঘ সময় ধরে সে দিনে রাতে যাকে নিয়ে অশেষ কল্পনার আলপনা বুনতো, সে আজ তার কাছে ধরা দিয়েছে।
জাহানারা! মিষ্টি করে সে ডাকলো।
বলো। চোখ তুলে তাকাতে সঙ্কোচ বোধ করছে মেয়েটি।
কাসেদ বললো, তুমি আমাকে আজ বড় অবাক করলে।
কেন?
আমি ভাবতেও পারি নি তুমি আমাকে ভালবাসতে পারো।
অমন করে ভাবতে গেলে কেন?
জানি না। শুধু জানি এ প্রশ্ন বার বার আমাকে যন্ত্রণা দিতো। আরো কী যেন বলতে যাচ্ছিলো সে। জাহানারা কাছে সরে এসে একখানা হাত রাখলো ওর নরম তুলতুলে চুলের অরণ্যে। তারপর ধীরে ধীরে সিঁথি কাটতে কাটতে মৃদু গলায় সে বললো, থাক। ওসব কথা এখন থাক, অন্য কিছু বলো।
কাসেদ ওর চোখে চোখ রেখে আস্তে করে শুধালো, কী বলবো?
কিরে বিড়বিড় করে কী-সব বকছিস তুই? মায়ের কণ্ঠস্বর তীরের ফলার মত কানে এসে বিঁধলো তার। কাসেদ চমকে উঠে বসলো।
মা ওর মাথার ওপর একখানা হাত রেখে আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আজকাল আমন করে তুই কী ভাবিস বলতো?
কাসেদ ইতস্ততঃ করে বললো, ও কিছু না মা, চলো ভাত দেবে এখন, বড় ক্ষিধে পেয়েছে।
মা ভর্ৎসনা করে বললেন, ক্ষিধে পেয়েছে এতক্ষণ বলিস নি কেন, চল, খাবি চল। ওঠ, মুখহাত ধুয়ে নে। বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
রান্না ঘরে নাহার এখন খাবার সাজাচ্ছে। বাইরে বৃষ্টি এখনো থামে নি।
বাতাস বেড়েছে আরো।
পরদিন বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পথে জাহানারাদের বাসায় গেলো কাসেদ।
বাসাটা ওদের পুরানা পল্টনে। একতলা বাড়ি সদ্য চুনকাম দেয়া।
সামনে বাগান। বসে বিকেলে ওরা চা খায়, গল্প করে।
পথে যেতে যেতে কাসেদ ভাবলো, জাহানারা হয়তো তার অপেক্ষায় এতক্ষণে অধীর হয়ে আছে। ঘর ছেড়ে বারবার বারান্দায় বেরিয়ে আসছে সে। চেয়ে চেয়ে দেখছে লোকটা আসছে কিনা। সে কি আসবে না আজ? পাতলা কপালে সরু সরু রেখা এঁকে শোবার ঘরে সরে গেলো জাহানারা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারাখানা দেখলে সে। বড় স্নান মনে হচ্ছে আজ। কিছুই ভাল লাগছে না। মন বসতে চাইছে না কোন কাজে। বিকেল হয়ে গেলো, কাসেদ এখনো আসছে না কেন? ভাবতে বড় ভালো লাগলো ওর। মনটা খুশীতে ভরে গেলো। জাহানারা কি সত্যি ওকে ভালবাসে?
বাসার কাছে এসে কাসেদ দেখলো সামনের বাগানে অনেক লোকের ভিড়। ছেলেবুড়ো-মেয়ে। দেখে অবাক হলো সে। সবার পরনে সদ্য ধোয়ান কাপড়। হাসছে। কথা বলছে। মাঝে মাঝে চানাচুর আর ডালমুটি খাচ্ছে। একখানা পিরিচ হাতে অনেকগুলো মেয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে জাহানারা। আজ সুন্দর করে সেজেছে সে। পরনে হালকা নীল রঙের শাড়ি। চুলগুলো খোপায় বাধা। চারপাশে তার সাদা ফুলের মালা জড়ানো। কপালে কুমকুমের টিপ। কাসেদকে দেখতে পেয়ে ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এলো জাহানারা।
আপনি এলেন তাহলে?
একমুখ হেসে বললো সে।
হাসলে ওকে আরো সুন্দর দেখায়।
সরু সরু দাঁতগুলো মুক্তোর মত চিকচিক করে ওঠে।
কাসেদ শুধালো, না আসার কোন হেতু ছিলো কি? যাক্গে, বাড়িতে এত অতিথির ভিড় কেন?
জাহানারা জিভ কেটে বললো, ওমা আপনি জানেন না বুঝি, আজ আমার জন্মদিন।
জানবো কী করে বলুন। কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলো কাসেদ।
জাহানারা পরক্ষণে বললো, তাইতো আপনাকে বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম আমি। কিছু মনে করেন নি তো?
না, এতে মনে করার কী আছে? নিজেই যেন লজা পেলো কাসেদ। জাহানারা বললো, আসুন কিছু মুখে দিন, চা খাবেন, না কোন্ড ড্রিঙ্ক? কথাগুলো কাসেদের কানে পৌঁছালো কি-না, বোঝা গেলো না। মুহুর্তে সে বিব্রত বোধ করলো।
চারপাশে তাকিয়ে দেখলো, অনেকগুলো চোখের দৃষ্টির মাঝখানে সে দাঁড়িয়ে।
জাহানারা আবার বললো, দাঁড়িয়ে কেন, আসুন।
কাসেদ ইতস্ততঃ করে শুধালো, আমায় ডেকেছেন কেন বললেন না তো? ভ্রূজোড়া তুলে জাহানারা বললো, ও হ্যাঁ, সে পরে আলাপ করা যাবে। আগে কিছু খেয়ে নিন। অফিস থেকে এসেছেন, চেহারা দেখে মনে হচ্ছে পথে কিছু খান নি, তাই না?
কাসেদের মুখখানা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো, কিছু বলতে চেষ্টা করলে সে, পারলো না। দু’টি মেয়ে দলছাড়া হয়ে জাহানারার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো আর অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখছিলো তাকে।
জাহানারা মৃদু হেসে বললো, আসুন। এদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই আপনার। মিলি চৌধুরী। আমার অনেক কালের বান্ধবী, ইডেনে পড়ে। আর এর নাম শিউলী, আমার কাজিন।
আর ইনি হলেন কাসেদ আহমেদ। নাম হয়তো শুনে থাকবে তোমরা, কবিতা লেখেন।
মিলি আর শিউলী হাত তুলে আদাব জানালো। পরিমিত হাসলো দু’জনে। মিলি জানতে চাইলো, আপনি কী ধরনের কবিতা লেখেন?
কাসেদ বললো, লিখি না, লিখতাম এককালে।
ইতিমধ্যে জাহানারা সরে গেছে সেখান থেকে। অদূরে কয়েকটি ছেলে-মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে সে।
শিউলী শুধালো, আপনার কোন বই বেরিয়েছে?
কাসেদ সংক্ষেপে বললো, না।
মিলি বললো, আসুন বসা যাক।
বাগানের এক কোণে তিনখানা বেতের চেয়ার টেনে গোল হয়ে বসলো ওরা।
কাসেদ নীরব।
মিলি আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছে।
শিউলী মিটমিটি হাসছে।
দোহারা গড়ন। ময়লা রঙ। লম্বা মুখের উপর নাকটা বড় ছোট হলেও বেমানান মনে হয় না। চোখের নিচে সরু একটা কাটা দাগ। ভ্রুতে সুরমা টানা। কাসেদের মুখের ওপরে চঞ্চল চোখজোড়া মেলে ধরে হাসছে সে। অস্বস্তিতে মুখখানা অন্যদিকে সরিয়ে নিলো কাসেদ।
আড়চোখে মেয়েটিকে আরেকবার দেখলো সে।
এখনো তাকিয়ে মেয়েটি।
এখনো।
সহসা মিলি শুধালো, আপনি কোথায় থাকেন, কাসেদ সাহেব?
কাসেদ মৃদু গলায় বললো, কলতাবাজারে।
বাসায় কে আছেন আপনার?
মা আছেন আর এক দূরসম্পৰ্কীয়া বোন।
শিউলী হাসছে, হাসুক।