আকাশের রঙ বুঝি বারবার বদলায়। কখনো নীল। কখনো হলুদ। কখনো আবার টকটকে লাল। মাঝে মাঝে যখন সাদা-কালো মেঘগুলো ইতি-উতি ছড়িয়ে থাকে আর সোনালী সূর্যের আভা ঈষৎ বাঁকা হয়ে সহস্ৰ মেঘের গায়ে লুটিয়ে পড়ে তখন মনে হয়, এর রঙ একটি নয়, অনেক।

এখন আকাশের কোন রঙ নেই।

আছে বৃষ্টি।

একটানা বর্ষণ।

সেই সকাল থেকে শুরু হয়েছে। তবু থামবার কোন লক্ষণ নেই। রাস্তায় এক হাঁটু পানি জমে গেছে। অতি সাবধানে হাঁটতে গিয়েও ডুবন্ত পাথরনুড়ির সঙ্গে বার-কয়েক ধাক্কা খেয়েছে কাসেদ। আরেকটু হলে একটা সরুনর্দমায় পিছলে পড়তো সে। গায়ের কাপড়টা ভিজে চুপসে গেছে। মাথার চুলগুলো বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরছে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে যখন বাসায় এসে পৌঁছলো কাসেদ, তখন জোরে বাতাস বইতে শুরু করেছে।

বোধ হয় ঝড় উঠবে আজ।

প্ৰচণ্ড ঝড়।

ভেজান দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে কাসেদ দেখলো, ছোট্ট একখানা পিঁড়ির ওপরে বসে চুলোয় আঁচ দিচ্ছে নাহার, মা তসবিহ হাতে পাশে দাঁড়িয়ে কী নিয়ে যেন আলাপ করছেন ওর সঙ্গে।

ভেতরে আসতে অনুযোগ ভরা কণ্ঠে মা বললেন, দেখো, ভিজে কী অবস্থা হয়েছে দেখো। কী দরকার ছিলো। এই বৃষ্টিতে বেরুবার?

কাসেদ কোন উত্তর দেবার আগেই মা আবার বললেন, ঠাণ্ডা লেগে তুমি একদিন মারা যাবে। এই বলে দিলাম দেখো, তুমি একদিন বৃষ্টিতে ভিজেই মারা যাবে।

কেন মিছেমিছি চিন্তা করছে মা। ভেজাটা আমার গা সওয়া হয়ে গেছে। দেখো কিছু হবে না।

না হবে না। যেদিন অসুখ করবে। সেদিন টের পাবে। সহসা কী মনে পড়তে খানিকক্ষণ চুপ থেকে মা শুধোলেন, ছাতাটা করেছ কী শুনি? তাইতো মা, ছাতাটা! ইতস্ততঃ গলায় জবাব দিল, ওটা সেদিন অফিস থেকে এক ভদ্রলোক নিয়ে গেছেন, তার কাছ থেকে আর আনা হয় নি।

যা ভেবেছিলাম, নাহারের দিকে এক নজর তাকিয়ে নিয়ে মা বিরক্তির সঙ্গে বললেন, তোর দিন যাবে কী করে আমায় বলতো? আজ এটা, কাল সেটা তুই শুধু মানুষকে বিলোতে থাকবি। রাজত্বি থাকতো না হয় বুঝতাম। টানাটানির সংসার।

নিজের ঘরে এসে ভেজা কাপড়গুলো দড়ির ওপর ঝুলিয়ে রাখলো কাসেদ। আলনা থেকে একটা গেঞ্জি টেনে নিয়ে পরলো। তারপর উনুনের পাশে এসে বললো, বিলোচ্ছি কে বললো মা, ছাতাটা ভদ্রলোক কিছুক্ষণের জন্য চাইলেন। তাই দিলাম। ওটা তো চিরকালের জন্য দেই নি, কাল আবার চেয়ে নিয়ে আসব।

মা এই অবসরে তসবিহ গুণছিলেন আর মনে মনে কী যেন পড়ছিলেন তিনি। থেমে বললেন, আনবি যে তা আমি জানি। ক’দিন ক’টা জিনিসি দিয়ে তুই ফেরত এনেছিস শুনি? এইতো, গেলো শীতে তোর বাবার কম্বলটা যে নিয়ে কোন এক বন্ধুকে দিলি, আর কী হলো?

কী আর হবে মা। একদিন সে নিজেই এসে ফেরত দিয়ে যাবে।

হ্যাঁ, দিয়ে যেতে ওর বয়ে গেছে। অমন জিনিস কেউ পেলে আর হাতছাড়া করে? লোকটাকে তুমি শুধু শুধু সন্দেহ করছে মা। ও বড় ভালো লোক। হাতজোড়া উনুনের উপর ছড়িয়ে দিলো কাসেদ। একটু গরম হয়ে নিতে চায় সে। মা বললেন, তুই তো দুনিয়া শুদ্ধ লোককে ভালো বলিস। আজ পর্যন্ত একটা লোককে খারাপ বলতে শুনলাম না। সেদিন মুদী এসে যাচ্ছেতা গালাগাল দিয়ে গেলো, তাকে একটা কথা বলেছিলি তুই?

মা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন ছেলের দিকে।

কাসেদ নীরবে আগুন পোহাতে লাগলো।

নাহার এতক্ষণে একটা কথাও বলে নি। চুপচাপ মা ছেলের ঝগড়া দেখছিলো। সহসা উনুন থেকে মুখখানা তুলে আস্তে করে বললো, তোমার নামাজের সময় হয়ে গেলো মা। মা বললেন, তাইতো! বলে তাড়াতাড়ি চলেন গেলেন তিনি। চুলোর ওপরে চালগুলো ততক্ষণে ফুটতে শুরু করেছে। ঢাকনিটা তুলে পানির পরিমাণটা দেখে নিলো নাহার।

কাসেদ তখনও চুপ করে আছে।

নীরবে কী যেন ভাবছে সে।

নাহার এক সময় বললো, জাহানারা এসে আজ অনেকক্ষণ বসেছিলেন।

কখন এসেছিল সে? গলাটা যেন সহসা কেঁপে উঠলো তার। নাহার মৃদু গলায় বললো, সকাল বেলা।

কিছু কি বলে গেছে তোমায়? কাসেদের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।

নাহার বললো, না, একখানা চিঠি রেখে গেছে।

চিঠিটা কোথায়?

আপনার টেবিলের ওপর রাখা আছে। ঘাড় নিচু করে আবার আপন কাজে মন দিল নাহার। চোখ জোড়া তুলে এক নজর কাসেদের দিকে তাকালে সে হয়তো দেখতে পেতো সারা মুখ তার লাল হয়ে গেছে।

উনুনের উপর থেকে হাতখানা সরিয়ে এনে পরক্ষণে উঠে দাঁড়ালো কাসেদ। দ্রুতপায়ে নিজের কামরায় এসে টেবিলের দিকে তাকালো সে। চিঠিখানা একটা বইয়ের নিচে চাপা দিয়ে রাখা। মুহুর্তে অনেকগুলো প্রশ্ন এসে ভিড় জমালো। চিঠিতে কী লিখেছে জাহানারা? আর কেনই বা এসে এতক্ষণ বসেছিলো সে? কাল বিকেলে নবাবপুরে দেখা হয়েছিলো ওর সঙ্গে। অনেকক্ষণ কথাও বলেছিলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। ভোর না হতে আবার সে বাসায় আসলো কেন? বাসায় অবশ্য প্ৰায় আসে জাহানারা। কাসেদ না থাকলে মায়ের সাথে বসে বসে গল্প করে। কথা বলে। খামের ভিতর থেকে কাগজের টুকরোটা বের করে নিয়ে আগ্রহের সঙ্গে পড়লো কাসেদ।

জাহানারা লিখেছে–

অনেকক্ষণ বসেও আপনাকে না পেয়ে অবশেষে চলে যাচ্ছি। বিশেষ প্রয়োজন ছিলো।

সময় করে একবার বাসায় আসবেন কিন্তু। আপনাকে আমার বড় দরকার।

চিঠিটা বার-কয়েক পড়লো কাসেদ। বিশেষ করে শেষের লাইনটা। সেখানে যেন একটু অন্তরঙ্গতার ছোয়া রয়েছে। আন্তরিকতার স্পর্শ। কাগজটা আবার ভাঁজ করে বইয়ের মধ্যে রেখে দিল সে। তারপর নীরবে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো।

বাইরে এখনো টুপটুপ বৃষ্টি পড়ছে।

সরু গলিটায় একটা মানুষও নেই।

সবাই ঘরে খিল এঁটে ঘুমোবার আয়োজন করছে এখন। কিম্বা, বিছানায় বসে বসে গল্প করছে, রূপকথার গল্প।

কাসেদ ভাবলো আকাশটা পরিষ্কার হয়ে গেলে এখনই সে জাহানারাদের ওখানে যেতে পারতো। প্রয়োজনটা জেনে নেয়া যেতো ওর কাছ থেকে। নইলে রাতটা বড় উৎকণ্ঠায় কাটবে।

কেন যেতে লিখেছে জাহানারা?

জানালার পাশ থেকে সরে এসে বিছানায় বসলো কাসেদ।

ওর মনে এখন রঙের ছোয়া লেগেছে। দু’চোখে স্বপ্নের আবীর ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে।

একদিন জাহানারাকে বিয়ে করবে কাসেদ।

অর্থের প্রতি তার লোভ নেই। একগাদা টাকা আর অনেকগুলো দাসীবাদীর স্বপ্নও সে দেখে না।

ছোট্ট একটা বাড়ি থাকবে তার, শহর নয়, শহরতলীতে, যেখানে লাল কাঁকরের রাস্তা আছে আর আছে নীল সবুজের সমারোহ। মাঝে মাঝে দু’পায়ে কাঁকর মাড়িয়ে বেড়াতে বেরুবে ওরা।

সকাল কিম্বা সন্ধ্যায়। রাস্তায় লোকজনের ভিড় থাকবে না। নিরালা পথে মন খুলে গল্প করবে ওরা, কথা বলবে।

আজকের বিকালটা বড় সুন্দর, তাই না?

কালও এমনটি ছিলো।

চিরকাল যদি এমনটি থাকে?

তাহলে বড় একঘেয়ে লাগবে। সহসা শব্দ করে হেসে উঠবে জাহানারা। হয়তো বলবে, একটানা সুখ আমি চাই না, মাঝে মাঝে দুঃখেরও প্রয়োজন আছে; নইলে সুখের মূল্য বুঝবো কেমন করে?

ওরা কথা বলবে।

আরো অনেক কথা।

কখনো কানে কানে, কখনো মনে মনে, কখনো নীরবে।

তারপর রাত নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাসায় ফিরে আসবে ওরা।

সামনের বাঁকানো বারান্দায় বেতের টেবিলের ওপর দু’কাপ চা রাখা। গরম চায়ের উত্তাপ যেন বার বার দেহকে স্পর্শ করছে এসে।

বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দেবে ওরা। কী ভাবছো?

কিছু না।

আমার কি মনে হচ্ছে জানো?

কী?

তোমার কপালে যদি একটা তারার টিপ পরিয়ে দিতে পারতাম।

কাসেদ লক্ষ্যও করে নি কখন নাহার এসে বিছানার পাশে দাঁড়িয়েছে।

ওর হাতের চুড়ির শব্দে সহসা যেন সন্বিত ফিরে পেলো সে।

নাহার বললো, উঠুন চাদরটা ভালো করে বিছিয়ে দিই।

ও। সরে এসে টেবিলের সামনে বসলো কাসেদ।

এলোমেলো চাদরটা তুলে নিয়ে ভালো করে বিছিয়ে দিচ্ছে নাহার। ছিপছিপে দেহ ময়লা রঙ আর মিষ্টি চেহারার নাতিদীর্ঘ মেয়েটি বড় কম কথা বলে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি কথাও কোন সময় মুখ দিয়ে বেরুবে না তার। আচ্ছা নাহার, ও এখানে কতক্ষণ বসেছিল?

কে? নাহার অবাক চোখে তাকালো।

কাসেদ অপ্ৰস্তুত স্বরে বললো, জাহানারার কথা বলছি।

নাহার অস্পষ্ট গলায় বললো, অনেকক্ষণ!

অনেকক্ষণ? কাসেদ চুপ করে গেলো!

Leave a Reply