সন্ধ্যার স্বল্প আলোয় শিউলীকে ছায়ার মত মনে হলো।

রাস্তার পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে সে।

উচ্ছাস নেই। উচ্ছলতা নেই।

মৃদু হেসে শুধু শুধালো, এলেন তাহলে? ভেবেছিলাম হয়তো আর আসবেন না।

কাসেদ বললো, আমি তো না করিনি।

ওর এলোমেলো চুল, ছন্নছাড়া দৃষ্টি আর ক্লান্ত মুখের দিকে সন্ধানী চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো শিউলী।

কাসেদ ম্লান গলায় জিজ্ঞেস করলো, অমন করে কী দেখছেন? হাতের ব্যাগটা এ হাত থেকে অন্য হাতে সরিয়ে নিতে নিতে শিউলী বললো, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন এইমাত্র লড়াইয়ের ময়দান থেকে পালিয়ে এসেছেন।

কাসেদ বললো, অনেকটা তাই।

শিউলী বললো, তার মানে?

কাসেদ বললো, লড়াই শুধু রাজার সঙ্গে রাজার, এক জাতের সঙ্গে অন্য জাতের আর এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশেরই হয় না। একটি মনের সঙ্গে অন্য একটি মনেরও লড়াই হয়।

শিউলী মুখ টিপে হাসলো, তার মানে আপনি এতক্ষণ অন্য একটি মনের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিলেন, তাই না? শিউলী থামলো। থেমে আবার বললো, সে মনটি কার জানতে পারি কি?

কাসেদ নীরবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বললো, সে মনও আমার। আমার নিজের। একজন চায় স্বার্থপরের মত শুধু পেতে। অন্যজন পেতে জানে না, জানে শুধু দিতে। বিলিয়ে দেয়ার মধ্যেই তার আনন্দ।

শেষেরটাকেই আমার ভালো লাগে। কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে শিউলী বললো, আমার আপনার মধ্যে কোথায় যেন একটা মস্ত বড় মিল আছে।

কোথায়? আস্তে করে শুধালো কাসেদ।

শিউলী মিষ্টি করে বললো, তা তো জানি না।

ওর শান্ত মুখখানার দিকে তাকিয়ে বড় ভালো লাগলো কাসেদের। মৃদু গলায় সে বললো, একটা কথা বলবো মনের সঙ্গে অনেক লড়াই করেছি।

কী কথা? শিউলী চোখ তুলে তাকালো ওর দিকে।

কাসেদ কী ভেবে শুধালো, আপনি কেন ডেকেছিলেন তাতো বললেন না। কেন ডেকেছি তাতো আমি নিজেও জানি না। শুধু জানি ডাকতে ইচ্ছে করছিলো। হয়তো কিছু বলবো ভেবেছিলাম, কিন্তু- সহসা চুপ করে গেলো শিউলী।

কাসেদ বললো, আমি কিন্তু বলবো বলেই এসেছি।

বলুন।

চলুন আমরা দু’জনে বিয়ে করি। এক নিঃশ্বাসে কথাটা বলে ফেললো কাসেদ। সে কথাটা জাহানারাকে বলার জন্যে দীর্ঘ দিন ধরে মনের সঙ্গে লড়াই করছিলো, সে কথাটা শিউলীকে মুহুর্তেই বলে দিলো সে।

শিউলী চমকে উঠলো।

দু’জনে নীরব।

কারো মুখে কথা নেই।

কাছে, দূরে অনেক লোক। হাঁটছে। হাসছে। কথা বলছে। চিৎকার করে ডাকছে একে অন্যকে। তবু মনে হলো গোরস্তানের নির্জনতা যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছে চারপাশের মুখরতাকে।

শিউলীর ঠোঁটের একটি কোণে এক সুতো হাসি জেগে উঠলো সহসা। সে হাসি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়লো। তার পুরো ঠোঁটে, চিবুকে, চোয়ালে, চোখে, সারা মুখে।

মুহুর্তে শব্দ করে হেসে উঠলো শিউলী। আপনি কি আজ অসুস্থ?

না, মোটেই না।

তাহলে এসব কী বলছেন?

যা তুমি চাও, আজ সকালেও চেয়েছিলে, আমি তাই বলছি শিউলী।

শিউলী আবার হাসলো, মনে হচ্ছে আমার চাওয়া না চাওয়া সবটুকুই আপনি জানেন।

আজকের সকালটা যদি মিথ্যে না হয়ে থাকে, তাহলে বলবো জানি এবং সবটুকুই জানি।

আর আমি বলি আপনি কিছুই জানেন না। শিউলী গম্ভীর হয়ে এলো। মুখে এখন হাসির চিহ্নটুকুও নেই। ম্লান গলায় সে বললো, আমাকে আজ পর্যন্ত কেউ চিনতে পারলো না।

কেন জানি না, সবাই ভুল বোঝে আমায়। হয়তো এই আমার ভাগ্যে লেখা ছিলো।

এসব কী বলছে শিউলী?

কাসেদ অবাক হলো, কথা বলতে গিয়ে গলাটা কেঁপে উঠলো ওর।

শিউলী বললো, আপনাকে অন্য আর পাঁচজনের চেয়ে ভিন্ন মনে করতাম বলেই হয়তো এতো সহজভাবে মিশতাম। কিন্তু–বলতে গিয়ে থামলো সে। কপালে ভাজ ফেলে কী যেন ভাবলো, ভেবে বললো, আপনিও শেষে ওদের মতো হয়ে যাবেন এ আমি ভাবি নি কোন দিন।

কাসেদের বুঝতে আর বিলম্ব হলো না সন্ধেবেলার এই শিউলীর সঙ্গে সকালের সেই শিউলীর কোন মিল নেই। এরা যেন দুটি ভিন্ন মেয়ে। সম্পূর্ণ আলাদা।

কিন্তু কেন?

কেন এমন হলো?

শিউলী!

বলুন।

একটি দিনের মধ্যেই কি মানুষ এত বদলে যেতে পারে?

আমিও তাই ভাবছি। সকালের সঙ্গে বিকেলের আপনার যেন কোন মিল নেই।

আর তুমি? তুমি কি সেই সকালের মেয়েটি আছো?

আমি? আমার কথা বাদ দিন। আমি যে কখন কী অবস্থায় থাকি, সে আমি নিজেও জানি না।

বাহ্‌ চমৎকার।

কাসেদের দিকে চমকে তাকালো শিউলী। অনেকক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে। তারপর ধীরে ধীরে বললো, আমার দিক থেকে যদি

কোন অন্যায় হয়ে থাকে তাহলে তার জন্যে আমি মাফ চাইছি কাসেদ সাহেব।

সত্যি আমি অপারগ, নইলে–।

কথাটা শেষ করলো না সে।

কাসেদের মনে হলো শিউলী হাসছে।

তীক্ষ্ণ বিদ্রুপে ঠোঁটের কোণজোড়া জ্বলছে ওর।

কাসেদ হেরে গেলো।

প্রথম পরাজয়ের গ্লানি মুছে যাবার আগেই দ্বিতীয় বার পরাজিত হলো সে। নিজের বোকামীর জন্যে নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হলো ওর। আগুনে হাত বাড়ালে পুড়বে জানতো।

তবু কেন সে এমন করলো?

রাত বাড়ছে।

রাস্তাঘাট নির্জন হয়ে আসছে ধীরে ধীরে।

আরো অনেক ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেছে শিউলী।

শিউলী আর জাহানারা, ওরা দুই নয়, এক।

একের এপিঠ আর ওপিঠ।

বাসায় ফিরতে অনেক রাত হলো ওর।

খালু এসে দরজা খুলে দিলেন।

এত রাতে তাকে দেখে অবাক হলো কাসেদ। মুখখানি ক্লান্ত আর বিমর্ষ।

কোন প্রশ্ন করার আগে খালু চাপাস্বরে বললেন, তুমি এসেছে? এসো, শব্দ করো না।

খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে ঘরের সবটুকু দেখতে পেলো কাসেদ। মা বিছানায় শুয়ে। মাথার একপাশে নাহার বসে। অন্য পাশে খালাম্মা। চাপাস্বরে মাকে কী যেন বলছেন খালা।

খালু বললেন, বড়বু’র শরীরটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেছে। ভাগ্যিস আমরা এসেছিলাম, নইলে কী যে হতো, কথা বলতে বলতে বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালো ওরা।

মা এতক্ষণে চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন। ধীরে ধীরে তাকালেন এবার। বেশ কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন। ইশারায় তাকে কাছে ডাকলেন। নাহার উঠে দাঁড়িয়ে কাসেদকে বসবার জায়গা করে দিলো। মায়ের পাশে এসে বসলো কাসেদ।
রুগ্ণ হাতখানা ওর দিকে বাড়িয়ে আস্তে করে বললেন, এসেছিস বাবা। শীর্ণ ঠোঁটে ম্লান হাসলেন তিনি। ফিসফিস করে আবার বললেন, এত রাত হলো কেন তোর? অনিয়ম করে শরীরটাকে তো শেষ করলি বাবা। মায়ের কপালে হাত বুলাতে বুলাতে কাসেদ বললো, তুমি এখন ঘুমোও মা।

মা চুপ করে গেলেন।

খালা একটা শিশি থেকে ওষুধ ঢেলে খাওয়ালেন তাঁকে।

কাসেদ উঠতে যাচ্ছিলো, শার্টে টান পড়ায় আবার বসে পড়লো।

মা বললেন, যাচ্ছিস কোথায়? আমার পাশে বোস।

আর কোন কথা বললেন না মা। নীরবে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলেন ওকে।

রাত বেড়ে চললো।

আরো, রাত হলে পরে, মাকে দেখাশোনার ব্যাপারে প্রচুর উপদেশ দিয়ে খালা খালু বিদায় নিলেন।

নিজের ঘরে এসে নীরবে অনেকক্ষণ বসে রইলো কাসেদ।

বইপত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করলো কিছুক্ষণ।

আকাশ-পাতল অনেক ভাবলো। কী যে ভাবলো সে নিজেও বলতে পারে না।

মাঝে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো সে।

নাহার এসে দাড়ালো দরজায়।

মা ডাকছেন আপনাকে।

হুঁ। কাসেদ উঠে দাঁড়ালো।

Leave a Reply