জাহানারা এখনো এলো না। একদল ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলছে সে। ওদের কথা যেন ফুরোবে না কোনদিন।

মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো কাসেদ।

এ কী বলছেন আপনি? জাহানারা অবাক চোখে তাকালো ওর দিকে।

মৃদু গলায় বললো, আপনাকে ভালবাসার কথা কোনদিন ভুলেও ভাবিনি আমি।

কোনদিনও না জাহানারা? কাতর কণ্ঠে শুধালো সে।

কিন্তু কেন, কেন বলতে পারে? সহসা তার কণ্ঠস্বর দৃঢ় শোনালো। সামনে ঝুঁকে পড়ে কাসেদ বললো, যাকে এত কাছে ঠাঁই দিয়েছ, তাকে আরো কাছে টেনে নিতে এত ভয় কিসের?

ভয়? আমি তো ভয়ের কথা বলি নি।

তবে কেন তুমি ভালবাসবে না আমায়?

ভালো লাগে না বলে।

সহসা সুরেলা কণ্ঠে হেসে উঠল জাহানারা।

না জাহানারা নয়, শিউলী। শিউলী হাসছে এখনো, আপনি মনে মনে এতক্ষণ কার সঙ্গে কথা বলছিলেন কাসেদ সাহেব? শিউলী শুধালো।

কাসেদ অপ্ৰস্তুত গলায় বললো, কই, নাতো। আপনি কী করে বুঝলেন কথা বলছি।

আমি সব বুঝি। আস্তে করে বললো সে। বলে অন্য একটা টেবিলে সরে গেল সে।

মিলি তার ব্যাগ থেকে কাঁটা আর উল বের করে আপন মনে মোজা বুনছে। কাসেদের চোখে চোখ পড়তে মৃদু গলায় বললো, মেয়ের জন্য।

আপনার মেয়ে আছে বুঝি? বোকার মত প্রশ্ন করে বসলো কাসেদ।

মিলির মুখখানা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো, হ্যাঁ বড্ড দুষ্ট। খালি পায়ে হেঁটে কেবল ঠাণ্ডা লাগায়।

আবার মোজা বোনায় মন দিলো মিলি।

কাসেদ নীরব।

এই একা বসে থাকতে বড় বিরক্তি লাগছে ওর।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো কাসেদ।

ওর দিকে চোখ পড়তে জাহানারা দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো সামনে।

একি, আপনি চলে যাচ্ছেন নাকি?

বসে বসে আর কী করবো বলুন। জাহানারাকে চুপ থাকতে দেখে কাসেদ আবার বললো, কেন ডেকেছিলেন বললেন না তো?

ও হ্যাঁ, জাহানারা মুদু হেসে বললো, আমি সেতার শিখবো ঠিক করেছি। একজন মাষ্টার দেখে দিতে পারেন?

কাসেদ বোকার মত ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।

এই বুঝি জাহানারার একান্ত প্রয়োজনীয় কথা? এরই জন্যে বাসায় যাওয়া আর অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকা।

কাসেদ হতাশ হলো।

জাহানারা বললো, চুপ করে রইলেন যে।

কাসেদ বললো, না ভাবছিলাম আপনার হঠাৎ সেতার শেখার সখ হলো কেন?

জাহানারা বললো, এমনি।

কাসেদ বললো, বেশ মাষ্টার না হয় আপনাকে ঠিক করে দেবো, কিন্তু–কিন্তু কি?

কিছুদিন পরে আবার ছেড়ে দেবেন না তো?

দেখুন, সারা দেহে দৃঢ়তা এনে জাহানারা বললো, আমি এক কথার মেয়ে।

কাসেদ মৃদু হেসে বললো, বেশ শুনে সুখী হলাম। এখন চলি তা হলে। আবার দেখা হবে।

জাহানারা বললো, যাবেন? আচ্ছা বলে আবার সেই ছেলেমেয়েদের জটলার দিকে এগিয়ে গেল সে।

কাসেদ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। চারপাশে তাকিয়ে দেখলো, জন্মদিনের আসরে আগত ছেলেদের, মেয়েদের, বুড়ো বুড়ীদের। তারপর যখন সে বাইরে বেরুতে যাবে এমনি শিউলী পেছন থেকে ডাকলো। চলে যাচ্ছেন বুঝি?

কাসেদ ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, হ্যাঁ।

শিউলী ঠোঁট কেটে বললো, যাবার আগে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়া উচিত ছিলো। তাই নয় কি?

কাসেদ লজ্জা পেলো। ইতস্ততঃ করে বললো, বড় ভুল হয়ে গেছে, আর আপনারাও সবাই কথা বলছিলেন কিনা, তাই। আচ্ছা এখন চলি।

দাঁড়ান। কাসেদকে অবাক করে দিয়ে শিউলী পরক্ষণে বললো, আমিও বাসায় ফিরবো ভাবছি। চলুন। এক সঙ্গে যাওয়া যাবে। দুহাতে পরনের শাড়িটা আলতো করে গুটিয়ে নিলো শিউলী। খোপাটা দেখলো ঠিক আছে কিনা, তারপর কাসেদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো সে। কিছুদূর পথ ওরা নীরবে হেঁটে এলো পাশাপাশি। শিউলী কোথায় যাবে কাসেদ জানে না। কোথায় বাসা ওদের সে প্রশ্নও করে নি সে। শুধু জানে, জাহানারার কাজিন শিউলী।

শিউলী আজ বিকেলে ওর সঙ্গে পথ হাঁটছে।

আরো অনেক পথ পেরিয়ে এসে সহসা কাসেদ শুধালো, আপনি কোন দিকে যাবেন?

কেন, যেদিকে আপনি যাচ্ছেন। শিউলী নির্লিপ্ত।

কাসেদ ঢোক গিলে বললো, আমি এখন বাসায় যাবো।

বেশ তো চলুন না। দু’চোখে হাসি ছড়িয়ে শিউলী বললো, আমাকেও বাসায় ফিরতে হবে। একটুকাল থেমে সে আবার যোগ করলো, আপনাদের খুব কাছাকাছি থাকি।

কাসেদ অবাক হলো, তাই নাকি? কই, বলেন নি তো?

এইতো পরিচয় হলো, বলবার সুযোগ দিলেন কোথায়? শিউলে মুখ তুলে তাকালো ওর দিকে।

কাসেদ কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেলো।

ওরা তখন ষ্টোডিয়ামের কাছাকাছি এসে গেছে।

রাত নামছে ধীরে ধীরে।

বিজলী বাতিগুলো জ্বলছে মিটিমিটি।

চারপাশের দোকানগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় বাড়ছে।

খেলার মাঠের সামনেকার গোল চত্বরটিতে লোকজন বসে বসে গল্প করছে। খেলার গল্প। সিনেমার গল্প। আর মাঝে মাঝে চিনেবাদাম কিনে খাচ্ছে ওরা।

সহসা হেসে বললো শিউলী, আচ্ছা আমরা এভাবে হাঁটছি কেন বলুন তো? একটা রিক্সা নিয়ে চলে গেলেই তো পারি।

একটু পরে একখানা রিক্সায় চড়ে বসলো ওরা।

একটি অপরিচিত মেয়ের সঙ্গে রিক্সায় চড়ার অভিজ্ঞতা ওর এই প্ৰথম। তাই বারবার অস্বস্তি বোধ করছিলো কাসেদ। কপালে মৃদু ঘাম জন্মছিলো এসে; বারবার ওর কাছ থেকে সরে বসার চেষ্টা করছিলো সে। ওর অবস্থা লক্ষ্য করে শিউলী ঠোঁট টিপে হাসলো, আপনি ভয় পাচ্ছেন বুঝি?

কাসেদ অপ্ৰস্তুত গলায় বললো, কই, নাতো?

তাহলে অমন করছেন কেন?

না, এমনি। লজ্জা কাটিয়ে ওর সঙ্গে সহজ হবার চেষ্টা করলো কাসেদ।

আপনার বাবা বেঁচে আছেন?

আছেন।

মা?

আছেন।

বাবা কী করেন?

সহসা শব্দ করে হেসে উঠলো শিউলী। অতসব জানতে চাইছেন কেন বলুন তো? বিয়ের সম্বন্ধ পাঠাবার চিন্তা করছেন বুঝি? শিউলী ঝুঁকে তাকালো ওর মুখের দিকে।

ওর কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক হলো কাসেদ।

হঠাৎ সে ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেলো।

শিউলী আস্তে করে বললো, রাগ করলেন তো? করুন। এমনি সবাই আমার ওপর রাগ করে। আপনি অবশ্য ওদের সবার মত কিনা জানি না। ক্ষণকাল থেমে শিউলী আবার বললো, জানেন, আমি অনেক লোকের সঙ্গে মিশেছি। ওরা অনেকেই আপনার বয়েসি। কেউবা ছোট। কেউ আরো বড়ো। ওদের সঙ্গে বন্ধু হিসেবেই মিশতাম আমি। আপনি হয়তো বলবেন, এ দেশে পুরুষে মেয়েতে বন্ধুত্ব চলতে পারে না। আমি বলবো, ওটা ভুল। ওটা আপনাদের মনের সংস্কার ছাড়া আর কিছু নয়। এই যে আমরা দু’জন এক রিক্সায় চড়ে বাসায় ফিরছি। লোকে দেখে কত কিছুই না ভাবতে পারে। কিন্তু আমি জানি, আমাদের মনে কোন দুর্বলতা নেই।

কাসেদ নড়েচড়ে বসলো।

শান্ত শিশুর মত নীরবে শিউলীর কথাগুলো শুনছে সে। গাল বেয়ে মুদু ঘাম ঝরছে তার।

বড় রাস্তা পেরিয়ে রিক্সাটা গলির মধ্যে ঢুকলো।

শিউলী বললো, জানেন? ওরা কেউ আমার বন্ধুত্বের মূল্য দিতে পারে নি। কিছুদিন মেলামেশার পরেই ওদের ব্যবহার যেন কেমন পাল্টে যেতো। আমার চোখেমুখে চেহারায় কী যেন খুঁজে বেড়াতো ওরা। আমি দেখে ঠিক বুঝতে পারতাম না। তারপর–। বলতে গিয়ে আবার হেসে উঠলো শিউলী। তারপর যা আশঙ্কা করতাম তাই হতো। ওরা প্ৰেম নিবেদন করে বসতো আমায়। কী বিশ্ৰী ব্যাপার দেখুন তো। কাসেদের মুখের দিকে তাকালো শিউলী। ওর চেহারায় কী প্রতিক্রিয়া হলো তাই হয়তো লক্ষ্য করছিলো সে।

কাসেদ নীরব।

হঠাৎ সে প্রশ্ন করলো, আপনার বয়স কত?

মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই। ওরা বিব্রত বোধ করে। কিন্তু শিউলীর চোখেমুখে কোন ভাবান্তর দেখা গেলো না। যেন এমনি প্রশ্নের সঙ্গে সে বহুদিন থেকে পরিচিত। বহুবার তাকে এর জবাব দিতে হয়েছে। তাই পরক্ষণে শিউলী বললো, অত্যন্ত সহজভাবেই বললো, বয়স জানতে চাইছেন কেন, ভাবছেন বুঝি আমি অল্প বয়সে পেকে গেছি?

কাসেদ বললো না, ঠিক তার উল্টো। বয়স হলে কী হবে। আপনি আসলে এখনও বাচ্চা রয়ে গেছেন।

শিউলী মুহুর্ত কয়েক স্থির চোখে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। যেন এর আগে এমনি উত্তর সে শোনে নি কোনদিন।

ওকে চুপ থাকতে দেখে কাসেদ জিজ্ঞেস করলো, চুপ করে গেলেন যে? কী ব্যাপার, রাগ করেন নি তো?

রাগ? অপূর্ব ভঙ্গি করে শিউলী জবাব দিলো, আপনি আমার কে যে আপনার উপর রাগ করবো?

কাসেদ বেশ বুঝতে পারলো, এ মেয়ের সঙ্গে কথা বলায় সে পেরে উঠবে না। তবু শিউলীকে ভাল লাগলো ওর।

বেশ মেয়ে।

Leave a Reply