মুরলীধর পাঁচ মাথা তালগাছটার তলা দিয়ে আসছে পাথরখনির দিকে। লাল লাল শক্ত মাটির ডেলাগুলো জুতোর ডগায় ঠোক্কর খেয়ে ঠিকরে পড়ছে, ছড়িয়ে পড়ছে। পাহাড়ী নদীটার কাঠের পুলের কাছে এসে থমকে দাঁড়াল। বিছানো এক একটা কাঠ থেকে অন্যটা অনেক তফাতে। চলার একটু উনিশ-বিশ হলে, বেতালে পা পড়লে, ফাঁক দিয়ে গলে একেবারে নদীর বুকে পড়তে হবে।
দেখল খানিক নীচের দিকে তাকিয়ে মুরলীধর। কাকচোখ জল বয়ে চলেছে ঝিরঝির করে। পড়লে ডুববে না তবে খণ্ড খণ্ড পাথরের ঘায়ে দেহ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাবে, আর হাড় ক’খানাও যে গুড়ো হয়ে যাবে এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ। আর তাছাড়া এত উঁচু থেকে নীচে পড়ে গেলে, অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকেও রেহাই পাবে না সে কিছুতেই।
এই পুল দিয়েই প্রতিদিন পেরোয়, এরকম চিন্তা-ভাবনা আসেনি মাথায় কোনসময়। কিন্তু আজ আসছে। কেন আসছে, কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। একটু ভেবে স্থির করল, দোনামনা ভাব নিয়ে পুলে ওঠা যুক্তিযুক্ত নয়। ঘোরাপথ দিয়ে যাবার মনস্থ করল। দেরী হবে না হয় একটু।
রাস্তায় ভয় ধরেছে দারুণ। চলতে চলতে কেবলই মনে হয়েছে, কতকগুলো লোকের নিঃশ্বাস তার গায়ে পড়ছে, অথচ তার আসে-পাশে নেই কেউ। দূরে দূরে মানুষ যেতে দেখেছে, তবুও ভয় কাটেনি তার।
মনে ভয় পুষে আর বিকেলের পড়ন্ত রোদ মাথায় করে পাথরখনিতে এসে পৌঁছল মুরলীধর।
মুখ থেকে তখন ব্লাস্টিংয়ের অর্থাৎ পাহাড় ফাটানোর তোড়জোড় প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। পাহাড়ের বুকে গর্ত করে করে বারুদ ঠাসা হয়ে গেছে, গর্তের বার করা নারকোল দড়িটা খানিক দূর অবধি টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওর শেষ প্রান্তে আগুন ধরাবার জন্য নিকষ কালো এক মজবুত দেহের মানুষ মোমবাতি জ্বেলে অপেক্ষা করছে। ঘণ্টাধ্বনি করে লোকদের সরে যাবার নির্দেশ দেওয়া হবে এবার। মাটির তলায় চারতলা সমান পাথরখনির নীচের তলা থেকে কুলিকামিনরা উঠে আসবে ওপরে—ওপর থেকে পাহাড় কেটে যে রাস্তা করা হয়েছে নীচ অবধি—সেই রাস্তা ধরে।
যতখানি পর্যন্ত পাহাড় ফাটাবে, পাথরের টুকরো ছিটকাবে তীরবেগে—ততখানি জায়গা লাল নিশান পুতে পুতে বিপজ্জনক এলাকার চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। তার বাইরে চওড়া চার দেয়ালের ওপর কুশঘাসের ছাউনি দেওয়া মাটির কুড়েঘরখানার দাওয়ায় এসে দাঁড়াল মুরলীধর। পাহাড় ফাটানো দেখবে। ফাটানোর সময় প্রায়ই দেখে সে। খানির মালিক সে-ই।
কিন্তু বুকটা দুরদুর করছে তার মৃত্যু ত্রাসে। এখানকার লোকজন, যাদের আপনজন ভাবত, তাদের দুশমন ভাবছে। এদের ভিতরের অনেকেরই জোড়া জোড়া চোখ মুরলীধরকে কড়া নজরবন্দী করে রেখেছে যেন। ওরা যেন তাকে মেরে ফেলার একটা ফন্দী এঁটেছে। পাহাড় ফাটার সঙ্গে সঙ্গে শেষ করে ফেলবে। অশেপাশে কেউ নেই সত্যি, তবুও মনে হচ্ছে ক’টা লোক ঘোরাফেরা করছে চতুর্দিকে। এরা খুব চেনা চেনা। কে এরা বুঝতে পারছে না কিন্তু।
মনের কথা মুখ ফুটে বলতে পারছে না কাউকে। সাহায্যের জন্য, এরকম পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করার জন্য সাহস করে ডাকতে পারছে না কাউকে। সে যে ভীরু নয় সাহসী—জানে সবাই। দেশ বিভাগের পর চলে এসেছে এখানে। সিন্ধু থেকে পাকুড়ে। জীবনে অনেক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে দু’পায়ে দাঁড়িয়েছে। দুঃখ-কষ্টে ভেঙে পড়েনি কখনো, শোকে তাপে মুষড়ে পড়েনি। সকলে জানে, মুরলীধর সিন্ধী অতি সাহসী।
নিজের কাছে নিজেরই লজ্জা আসছে মুরলীধরের। লজ্জা এলেও নিস্তার নেই। সাহসের স্মৃতি টেনে এনে, সামনে তুলে ধরেও সাহস ফিরে পাচ্ছে না। মৃত্যুভয় হটাতে পারছে না। মনটা যেন আরো ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। মেরুদণ্ডের ওপর থেকে নীচে পর্যন্ত একটা কনকনে ঠাণ্ডা স্রোত বইছে। স্নায়ুগুলো শিথিল হয়ে আসছে।
ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পাচ্ছে মুরলীধর। চরম মুহূর্ত আসছে বুঝি, এল বুঝি। বাতাসে শত্রুরা হয়ত কিছু বিষাক্ত বস্তু মিশিয়ে দিয়েছে। বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। মুরলীধরের দম নিতে কষ্ট হচ্ছে।
ঘণ্টাধ্বনি থামল। হুইশল বেজে উঠল। তীব্র আওয়াজটা কানের পরদা ছিড়েখুঁড়ে দিল যেন। আগুন জ্বলল বারুদের দড়িতে। দড়ি ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে আগুন এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল বারুদঠাসা এক একটা গর্তের ওপর। কয়েক মুহূর্ত নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতা। তারপর আকাশ ফাটানো আর্তনাদ করে পাহাড় ফাটল। সঙ্গে সঙ্গে কুঁড়েঘরের দাওয়াটা ভূমিকম্পের মত কেঁপে উঠে ধসে পড়ল।
কোথায় ছিটকে পড়ল মুরলীধর বুঝতে পারল না। মুরলীধর বেঁচে আছে কি মরে গেছে তা-ও না।
এ-সব স্বপ্ন দেখেছে মুরলীধর।
মুরলীধরের গোঁ গোঁ আওয়াজে স্ত্রীর ঘুম ভেঙেছে। স্বামীকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তুলেছে। জেগেও কিছুক্ষণ সময় গেছে সামলাতে মুরলীধরের। স্বপ্নকে স্বপ্ন বলে মেনে নিতে মন চায়নি প্রথমে। নিজে বেঁচে আছে কি মরেছে, সন্দেহ কাটতে বেশ সময় লেগেছে।
অনেক দিন পরেও দুঃস্বপ্নের ছবি ভুলতে পারেনি এটা প্রমাণ হয়ে যেত মাঝে মাঝে। ব্লাস্টিংয়ের সময় এক একদিন হঠাৎ মনে হয়েছে, এইবার বুঝি ষড়যন্ত্রকারীরা তাকে দুনিয়া থেকে নিশ্চয় সরিয়ে ফেলবে।
এতখানি বলে একটু চুপ করে রইল পাথরখনির ম্যানেজার। চতুর্দিকে দু’চোখ চক্কর দিয়ে এল তার একবার। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে জানাল, ব্লাস্টিং হতে দেরী নেই আর।
কুঁড়েঘরের মাটির দাওয়ায় দু’খানা মুখোমুখি বেতের চেয়ারে আমরা বসে দুজনে। আমি আর ম্যানেজার। অন্য জগতে বিচরণ করতে করতে বলছিল সব ম্যানেজার। আমি শুনছিলুম।
আমাকে চমকে দিয়ে বলা শুরু করল ম্যানেজার আবার—
মুরলীধরকে দুঃস্বপ্ন থেকে থেকে বড় বেশী যন্ত্রণা দেয়—এটা ডাক্তার-বৈদ্য -মনস্তত্ববিদদের জানিয়ে ছিল সে। অনেক ওষুধ খেয়েছে ওঁদের, অনেক উপদেশও শুনেছে। ফল হয়নি। ফল হল, দুঃস্বপ্ন যখন সত্যি হল। অবিশ্যি সত্যি হল একটু অন্যভাবেই।
এই খনিতেই অন্যদের সঙ্গে কাজ করত দুজনে। একজন বড়কা সর্দার আর অন্যজন ঝুমনা মজুরনী। বড়কা পাথরের বড় চাঁই ভাঙত ভারী হাতুড়ির ঘা বসিয়ে বসিয়ে। ঝুমনা ছোট পাথর ভেঙে আরো ছোট ছোট করত। টুকরি ভর্তি করে মাথায় চাপিয়ে ওপরে নিয়ে আসত।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে দুজনের হাসিমস্করা চলত। ওরা নাকি একজন অন্যকে না দেখতে পেলে পাগল হয়ে ওঠে, অস্থির হয়ে ওঠে। কাজে মন টেকে না। ঘরে বাইরে স্বস্তি-সুখ পায় না।
এসব শুনে কোন স্বামীর না মেজাজ চড়ে, মাথায় রক্ত টগবগ করে ফুটে না ওঠে? ঝুমনার আদমীর মেজাজ চড়ল, খুন চাপল মাথায়। কিন্তু কিল খেয়ে কিল চুরিই করতে হল তাকে। বড়কা সর্দারের চেয়ে সে কমজোর তো বটেই, তাছাড়া ওর তুলনায় লোকবলও অনেক কম তার। নেই বললেই চলে।
শেষ পর্যন্ত একটা মীমাংসা করে নিল আদমী বড়কার সঙ্গে। কিছু টাকা নিয়ে বৌকে ছেড়ে দিল। এটা সঁওতাল সমাজের রীতির মধ্যেই পড়ে। দোষ দিল না কেউ আদমীর, দোষ দিল না বড়কার। বছর চারেকের ছেলে সোমের ভার কিন্তু নিল না কেউ। না নিল আদমী, যার নিজের ছেলে। না নিল সৎবাপ বড়কা। আদমীর ঠিক দোষ দিলে চলবে না। প্রথমে নিতে চেয়েছিল লোকটা। ছেলেটাই বাধ সাধল। মাকে জড়িয়ে ধরে কি চিৎকার, কি কান্না। যাবে না বাপের কাছে। আর সত্যি কথা বলতে কি, মায়েরও ছাড়বার ইচ্ছে ছিল না একদম।
ঝুমনার খুব আশা ছিল, অন্ততঃ তার মুখ চেয়ে বড়কা ছেলেটাকে ভালবাসবে, দেখবে। বড়কার দিন দিন আচার ব্যবহার দেখে ধারণা ধুলিসাৎ হয়ে গেছিল। বড়কার দু’চক্ষের বিষ ছেলেটা। বিয়ের পর থেকে বড়কা খালি বলতে শুরু করেছে, আপদটাকে এখান থেকে বিদায় করাই ভাল। ওর বাপ একটা আস্ত শয়তান। বড় হলে ছেলেটা কি আর না হবে বাপের মত। বিষবৃক্ষ চারা অবস্থায় মূল থেকে তুলে ফেলাই উচিত।
বড়কার দিকে খরখরে দু’চোখে তাকাত শুধু ঝুমনা। মুখে কিছু বলত না। মানুষটার চোখের দিকে চাইলে, একটা বিপদের আঁচ পেত যেন। বুক কেঁপে উঠত। কে জানে ছেলেটার না কোন অমঙ্গল করে বসে লোকটা।
যতটা পারল, বড়কার চোখের বাইরে সরিয়ে রাখতে লাগল সোমকে ঝুমনা।
এটা বুঝতে পারল বড়কা। রাগে আগুন হয়ে উঠল।
ছেলেটাকে নিয়েই ঝুমনা ব্যতিব্যস্ত দিনরাত। কাজে আসা ছেড়েছে, তার ঘরে যাওয়া ছেড়েছে। কোথায় থাকে কে জানে! ছেলেই ওর সর্বস্ব, বড়কা কেউ নয়। ছেলেটাকে সরাতে না পারলে ঝুমনাকে কাছে পাবে না বড়কা।
পাকুড়ের অন্ধিসন্ধি খুঁজে খুঁজে ঝুমনার মাসির কাছ থেকে ঝুমনাকে আর সোমকে বার করল বড়কা। ঝুমনাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কাজ করতে রাজী করাল আবার। সোম কত আদরের। ওকে সে-ই দেখবে। সোমকে না দেখতে পেয়ে মনঃকষ্টে দিন যাচ্ছে তার। সরল মনের মেয়ে ঝুমনা বড়কার কথা বিশ্বাস করল।
সেদিন একটু বাদেই ব্লাস্টিং হবে—এমন সময় সোম উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে এই কুড়েঘরটার দিকে আসতে লাগল। বাচ্চাটার মুখে-চোখে দারুণ ভয়। পিছু পিছু ছুটে আসছে বড়কা সর্দার আর জনাচারেক লোক। বাচ্চাটা যাতে কোন দিকে না গিয়ে এই দিকেই আসে—সেই ভাবেই ওরা তাড়িয়ে নিয়ে আসছে।
মুরলীধর বিপদমুক্ত এলাকায় নীল আকাশের নীচে চেয়ারে বসে বসে দুঃস্বপ্নের বাস্তবরূপ দেখছে যেন। তার মনে হচ্ছে, সে সোম। তাকেই মারবার জন্য ওরা দৌড়ে আসছে।
মুরলীধরের হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। দেহটাও। মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ। তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মৃত্যু বোধহয় এসে দাঁড়িয়ে আছে পিছনে।
ঘরের মধ্যে সোমকে জোর করে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল বড়কা। চোখ রাঙিয়ে চেরাগলায় শাসিয়ে দিল ওদের সাঁওতালী ভাষায়, বেরুবি না এক পা-ও। এখানে ওখানে ঘুরঘুর করলে, পাথর ফেটে ঠিকরে এসে মাথায় লাগলে বাঁচাতে হবে না আর।
মুরলীধরের ভিতর বলছে, বড়কা সর্বনেশে লোক। তলায় তলায় তাকে মেরে ফেলার বন্দোবস্ত করে বাঁচাবার চেষ্টা দেখাচ্ছে। তার নমুনা টের পাওয়া যাবে এখুনি।
মুরলীধর যেন জড়বস্তু হয়ে যাচ্ছে এবার। নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। দম আটকে আসছে তার।
ঘণ্টা বাজছে। যে যেদিকে পারল, ছুটে পালাল। সতর্কধ্বনি থামতেই বেজে উঠল হুইশল।…দড়াম দড়াম শব্দে পাহাড় ফাটল। সঙ্গে সঙ্গে কুঁড়েঘরটা ধসে পড়ল।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে মুরলীধরের বুকের ওপর ছিটকে এসে পড়ল সোম। সচেতন হয়ে উঠল মুরলীধর। তার মনে হল, সে মরেছিল, প্রাণ ফিরে পেল যেন আবার। ভীতসন্ত্রস্ত সোমকে দু’হাতের বেষ্টনী দিয়ে চেপে ধরে রইল।
খানিক বাদে সোমকে যত্ন করে নিয়ে গেল মুরলীধর নিজের বাড়িতে।
পরে বিপদমুক্ত এলাকায় বিপদ ঘটার ইতিবৃত্ত জানতে পারা গেল অনুসন্ধান করে। বড়কাই সোমকে শেষ করার জন্য সব ব্যবস্থা করে রেখে দিয়েছিল। কুড়েঘরের বাইরে পিছনের গর্তটায় সবার অলক্ষ্যে প্রচুর বারুদ ঠেসে রেখেছিল। গর্তের মুখ থেকে ঘাসের তলা দিয়ে লম্বা দড়িটা নিয়ে গেছিল অনেক দূর অবধি। দড়ির শেষের দিকটায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল সে নিজেই।
…এবার স্নাস্টিং হবে। নিরাপদ জায়গায় সরে গেল সকলে। নতুন কুড়েঘরটার দাওয়ায় আমরা। আমার ভয় ধরছে, এ ঘরটা না উড়ে যায় আবার আমাদের নিয়ে। ম্যানেজারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি একদৃষ্টে। মুখখানায় ভয়ডরের লেশমাত্র নেই ওর। চোখে চোখ পড়তে হাসির রেখা ফুটে উঠল ঠোটের ফাঁকে। অভয় দিল যেন আমায়।
আমি দেখছি ম্যানেজারকে। দেখতে চেষ্টা করছি শিশু সোম সাঁওতালকে মুরলীধরের স্নেহপুষ্ট তরুণ ম্যানেজার সোম সাহেবের মধ্যে।