ঘরটা যে কখন অন্ধকার হয়ে গেছে সে খেয়াল নেই হীরাবতীর। শুধু মনে আছে, জানলার ধারে এসে দাঁড়িয়েছিল সে। তখন সূর্যের এক টুকরো আলোও নেই আকাশে। অন্ধকার নামছে একটু একটু করে। ঘরে কেউ ছিল না। একলাই ছিল হীরাবতী। কেবলি তার মনে হচ্ছে, ঘুট ঘুটে অন্ধকার তার চোখে ধুলো দিয়ে ঘরের ভিতর ঝাঁপিয়ে পড়েছে একেবারে হঠাৎই।
এই ঝাঁপানোটা বুঝতে পেরেছে ঘরের আলোটা তাড়াতাড়ি জ্বালতে গিয়ে বুকের আলো জ্বলে উঠতে দেখে।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকেছে কিছুক্ষণ নিজের বুকের দিকে। পাথরটা জ্বলছে। ঠিক আগেরই মতো। দিনের বেলায় নিবে থাকে একদম। মন প্রাণ স্নিগ্ধ করা চাঁদের আলো রাতে যে কোথা থেকে পায় বুঝে উঠতে পারে না। এই বুকে প্রতিবাত জ্বলেছে এক সময়। জ্বলেছে সোনার সরু চেনটার লকেট হয়ে।
এখন? এখন আলমারীর ড্রয়ারবন্দী। বছরের একটি দিন মাত্র মুক্তি পায় শুধু। কার্তিকী অমাবস্যার সন্ধ্যেয় ব্যতিক্রম হয়েছে এই প্রথম—এবারে। সন্ধ্যের একটু আগেই মুক্তি পেয়েছে। আগে মুক্তি দিয়ে ফেলল কেন—হীরাবতী নিজেও জানে না। প্রত্যেক কার্তিকী অমাবস্যায় সন্ধ্যে থেকে সারা রাত চেন হারটা হীরাবতীর গলায় জড়িয়ে থাকত আর লকেটটা বুকের মাঝখানে আটকে থাকত। হারটা দিয়েছিল জয়কান্ত। পাথরটার অন্য একটা ইতিহাস আছে। ইতিহাস আছে বলেই বুঝি সমস্ত রাত চোখে-পাতায় এক করত না একবারের জন্যও হীরাবতী। দেখত যেন কত কি এই পাথরটির মধ্যে দিয়ে। ভোরের আলো ঘরে পৌঁছবার আগে চোখে লাগবার আগেই তুলে রাখত আবার। পাথরটা তখনো জ্বলত—তোলবার সময়ে।
বুকের দিকে তাকিয়ে পাথরটায় ভিতর কি যেন দেখছিল, কি যেন দেখতে চেষ্টা করছিল। হঠাৎ চমকে উঠল কার জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ায়। ঘরের মধ্যে রয়েছে কেউ। তার আনমনার সুযোগ নিয়ে প্রবেশ করেছে কেউ। এতক্ষণ রুদ্ধনিশ্বাসে নিশ্চয় লক্ষ্য করছিল তাকে বেশ ভালো ভাবেই। নিশ্বাস বন্ধ করে রাখতে পারেনি আর। হয়তো নিজের অগোচরেই জোরে জোরে নিশ্বাস পড়তে সুরু করেছে ওর, নয়তো ইচ্ছে করেই ওর অস্তিত্ব জানাচ্ছে এই ভাবে।
বুকের ভিতর কেঁপে উঠল। লকেটটা কেউ ছিনিয়ে নিতে এসেছে নাকি? হাত চাপা দিল লকেটের উপর। ঘরটা আরো জমাট অন্ধকার হয়ে উঠল। আলো জ্বালবার জন্য দ্রুত পায়ে সুইচবোর্ডের দিকে এগুল…আলো জ্বলল। আলমারীর পাশে দাঁড়িয়ে আছে বংশীমোহন। ওর দুচোখ জ্বলছে। বেশ জোরে স্পষ্ট করে বলল বংশীমোহন—পাথরটা ঢাকলে কেন? হাত সরাও! সরাও বলছি!
কথায় আদেশের সুর। আদেশ অমান্য হলে যে একটা কাণ্ড হবে তা মুখচোখ দেখেই বুঝতে পারা যাচ্ছে। চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরোচ্ছে, মুখখানা লাল হয়ে উঠছে। জিদ বাড়ছে, মাথায় উষ্ণ রক্ত বইতে শুরু করেছে।
লকেট থেকে হাত সরাল হীরাবতী। বংশীমোহনের দু’চোখের শ্যেনদৃষ্টি পাথরটার ওপর। ও দু’চোখ দিয়েই পাথরটাকে গিলে খেয়ে ফেলবে বুঝি এখুনি। হারটা দাও আমাকে। দাও বলছি শীগ্গির।
ওর হাতে তুলে দিতে হবে রাত আলো করা পাথরটাকে। ভাবছে আর দেখছে, দেখছে আর ভাবছে হীরাবতী। এচোখ দেখেছে আগে, এ ধরণের কথা শুনেছে আগে।
জয়কান্তর চাউনিতে দেখেছিল এই চাউনি। জয়কান্তর মুখে শুনেছিল প্রায় এই রকমেরই কথা দেখা-বলার বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই দুজনের মধ্যে। পার্থক্য আছে শুধু একটা বিষয়ের। সেটা পরিস্থিতির। তখন আর এখন একেবারে বিপরীত পরিস্থিতি দু’টো। তখন হারটা গলায় ঝোলে নি আর পাথরটা বুকের মাঝে জ্বলে নি। বলতে গেলে হারটা-পাথরটা ছিল না-ই তার কাছে। বলতে গেলে কেন—সত্যিই। কত বড় সত্যি এটা—সে সব জানত জয়কান্ত।
হারটা-পাথরটা কিভাবে চলে গেল তার কাছ থেকে—সেটা স্বচক্ষে দেখেছে। তবু পাগলের মতো ক্ষেপে উঠেছিল যেন মানুষটা। আশ্চর্য! এর আগে জয়কান্তকে এরকম উত্তেজিত হতে দেখেনি কখনো হীরাবতী। রাগে অগ্নিশর্মা হতে দেখেছিল সেই প্রথম আর সেই শেষ।
সাত চড়ে মুখে রা বেরোয় না, মাটির মানুষ জয়কান্ত। সংসারে সবার কাছে আর বন্ধুমহলে এই খ্যাতির ভিত সুদৃঢ় ছিল তার। সে ভিতে ফাটল ধরল, ধসে পড়ল। চীৎকার করে বিকৃত স্বরে বলে উঠল—সরে যাও আমার সামনে থেকে এখুনি! তোমার মুখ দেখতে চাই নে জীবনে আর! কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে যা কোনদিন করে নি, করতে সাহস করে নি—তাই করে বসল। সী-বীচে হীরাবতাকে একলা রেখেই হনহনিয়ে চলে গেল বাড়ীর দিকে।
জয়কান্তর মুখ থেকে এসব কথা শুনবে, এমন ব্যবহার পাবে বাস্তবিকই এটা কল্পনাতীত ছিল হীরাবতীর কাছে। হীরাবতী স্তব্ধ বিস্ময়ে মানুষটার চলা পথের দিকে তাকিয়েছিল কেবল। ডাকতে গিয়েও ডাকতে পারে নি। মুখে কথা সরে নি। হতবাক হয়ে গেছল একদম সে।
একলা ছেড়ে যেতে চাইত না মানুষটা। আশপাশের মানুষদের চলাফেরা তাকানো সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে দেখত। বলত—এরকমও বেহায়া নির্লজ্জ হতে পারে লোক। এখানে এসে যে দু’টো কথা কইব প্রাণখুলে দু’জনে—সে উপায়ও নেই। কেবল ঘুর ঘুর করছে তোমার চারপাশে ওরা। আর তোমাকেই দেখছে শুধু। দেখে দেখে আশ আর মিটছে না কিছুতেই ওদের!
হীরাবতী নিরীহ জয়কান্তর সন্দেহ বাতিকে খোঁচা দিয়ে মজা পেতে ছাড়ত না। খিল খিল করে হেসে উঠে বলত—তা মিটবে আর কি করে বল। হীরাবতীর মতো ক’জনই বা রূপসী আছে পুরীতে! তোমার অসহ্য হয়, যেতে পারো। বাড়ী তো বেশী দূর নয়। পরে যাব’খন।
এই যে রেখে যাচ্ছি—বলে, হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে যেত জয়কান্ত।
সেই মানুষই হীরাবতীকে একলা ফেলে চলে গেল আর বলে গেল, মুখ দেখতে চাই না…।
জয়কান্ত বলল যা, করলও তাই।
বুকের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা দাপাদাপি করছে হীরাবতীর। চোখের কোণ টনটন করছে। এখনো চোখের সামনে ভেসে বেড়ায় অহর্নিশ দু’জনের সী-বীচে বেড়ানোর দৃশ্য।
জয়কান্তর সঙ্গে হাত ধরাধরি করে বেড়াচ্ছে হীরাবতী সী-বীচে। মাঝে মাঝে জয়কান্তর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। ভিতরে হাহাকার করে উঠছে। সমুদ্রের ঢেউ ভাঙার মতো তার আশা ভরসা ভবিষ্যৎ ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছে। বেশ বুঝতে পারছে জয়কান্তকে ধরে রাখা যাবে না কোনো রকমে। রোগ ধরতে পারেন নি ডাক্তার বৈদ্যরা, দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে লোকটা। সমুদ্রের ধারে বেড়ানোই একমাত্র ওষুধ এখন। কিন্ত ও ওষুধও কোনো কাজ করছে না। করবেও না। এটা জানে হীরাবতী।
জয়কান্তর মন ভাঙছে দেহ ভাঙার চেয়ে বেশী করে। ডাক্তাররা নিজের ব্যাপারে সদা-সচেতন রুগীকে বাজে মিথ্যে বলে সান্ত্বনা দিতে ইতস্ততঃ করেছেন তাই। তবু ও ওর মনের জোর বজায় রাখতে, ‘সমুদ্রের ধারে বেড়ালে নিশ্চয়ই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন’ মনগড়া প্রবোধ বাক্য শুনিয়ে ছিলেন। এতে ফল হয়েছিল খানিকটা।
যে মানুষ শুয়ে পড়ছিল, সে উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে সুরু করলও ধীরে ধীরে। তারপর সী-বীচে নিয়ম করে আসাও হতে লাগল রোজ সন্ধ্যেয়।
এ সব সত্ত্বেও হীরাবতী কোনো বাঁচার লক্ষণই দেখতে পায় নি জয়কান্তর শরীরে। বরং মনে হয়েছে আগের চেয়ে আরো খারাপের দিকেই যাচ্ছে ও। আগে যা-ও বা একটু আধটু খেতে পারত, এখন সেটাও বন্ধ হয়ে আসছে।
বেড়াতে বেড়াতে জয়কান্ত জিজ্ঞেস করে—হীরা! এখন ভালো দেখছ না? এবারে বেঁচে উঠলুম তা হলে—
হীরাবতীর বুকের তলায় বোবা কান্না ডুকরে ওঠে। মুখ ফিরিয়ে ছোট্ট হুঁ বলে, একটু দূরে সরে যায় নিজেকে সামলে নিতে।
তেত্রিশ কোটি দেবতাকে মানত করেছে হীরাবতী স্বামীকে বাঁচাবার জন্য। সব নিষ্ফল। দেবতারা বধির। নির্দয়। দেবতার ওপর বিশ্বাস হারিয়েছে হীরাবতী। হারিয়েছে সবার ওপর। নিজের ওপরেও।
ম্লান মুখে হাসির মুখোশ পরে স্বামীর কথায় অনিচ্ছা সত্বেও সায় দিয়ে দিয়ে বেড়াত হীরাবতী।
জয়কান্তকে মিথ্যে আশ্বাস দেওয়ার ফল ভোগ করতে হত দারুণ ভাবে হীরাবতীকে। অনুশোচনার যন্ত্রণায় প্রতি রাতে বারান্দায় পায়চারি করে বেড়িয়েছে। হীরাবতীর অনুশোচনার যন্ত্রণা শেষ হল একদিন। হাসির মুখোশ খুলে পড়ল মুখ থেকে। মুখের মলিনতা মিলিয়ে গেল নিমেষে। প্রকৃত খুশির ঢল নামল।
কার্তিকী অমাবস্যা। সন্ধ্যে হয়েছে সবে। অন্ধকার অন্ধকার। সমুদ্রের ঢেউ আর সমুদ্র অন্ধকারে মিশে গেছে যেন। চোখে দেখা যাচ্ছে না কিছু। চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে যেন সমুদ্র ইচ্ছে করেই। হীরাবতীর প্রথমে মনে হয়েছিল, এই অলক্ষুণে অমাবস্যা আর সমুদ্র বুঝি তাদের দু’জনকে গ্রাস করবে বলে এই ষড়যন্ত্র করেছে। অদৃশ্যলোক থেকে ভীষণ গর্জন তুলে তুলে মৃত্যুত্রাস সৃষ্টি করছে স্রেফ। শুনে সাদা চকচকে চওড়া এক একটা বিরাট করাত দু-পাশ থেকে এগিয়ে এসে মিলছে। আবার ভেঙে দু’টুকরো হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। ওপাশ দিয়ে আবার একটা করাত আসছে। চলে যাচ্ছে। আবার —আবার আসছে।
অসহ্য হয়ে উঠছে এ দৃশ্য দেখা। হীরাবতী জানে, অন্ধকারে সমুদ্রে ঢেউ ভাঙার দৃশ্যটা এরকমই দেখায়। সব জেনেশুনেও ঢেউ ভাঙার ফেনাকে করাত ভাবছে তবু। ভয় ধরছে খুব। তন্ময় হয়ে দেখছে ওই ভয়ংকর দৃশ্য কেমন করে জয়কান্ত। জয়কান্তকে তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরতে তাগাদা দিতে লাগল হীরাবতী।
ফিরে যেতে রাজী হল না জয়কান্ত। প্রকৃতির অপূর্ব বিচিত্র লীলা দেখছে সে। বড় ভালো লাগছে। সাদা ফেনাটা যেন সমুদ্র থেকে স্বতন্ত্র মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সমুদ্র নেই। অথচ সমুদ্রের ঢেউ ভাঙা থেকেই ওর উৎপত্তি। এখানে মানুষের প্রাণের সঙ্গেই অন্ধকারের সমুদ্রের তুলনা চলে। প্রাণকে দেখতে পাওয়া যায় না। যায় দেহটাকে। দেহটা যেন সাদা ফেনা। মনের ভাব প্রকাশ করল হীরাবতীর কাছে জয়কান্ত।
জয়কান্তর এ দার্শনিক তত্ত্ব মেনে নিতে পারল না হীরাবতীর মন। নিজের অজান্তেই মৃত্যুকে যে ভালোবেসে ফেলে মৃত্যুর মোহ আকর্ষণে—তার কাছে এ ধরণের বক্তব্য ছাড়া আর কি-ই বা আশা করা যেতে পারে! বুকভাঙা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল হীরাবতী। অশুভ আশঙ্কায় দুরু দুরু করছে ভিতর।। তো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, অপ্রতিরোধ্য সর্বগ্রাসী কালের কালো অন্ধকার ঘিরে ধরেছে জয়কান্তকে। অনুনয় করে জয়কান্তকে ফিরে যেতে রাজী করল। শরীরটা ভালো মনে হচ্ছে না হীরাবতীর। জয়কান্তর তাড়াতাড়ি বাড়ী ফেরাই ভালো আজ।
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল জয়কান্ত। ফিরছে। হঠাৎ ডান পায়ে একটা পাথর এসে আছড়ে পড়তে চমকে ঘুরে দাঁড়াল। পায়ের কাছে পাথরটা জ্বলছে যেন। চাঁদের আলো ওর ভিতর দিয়ে ফুটে বেরুচ্ছে বুঝি। পাথরটাকে তুলে নিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। দেখছে হীরাবতীও। মাঝে মাঝে স্বামীর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। মৃত্যুর কালোছায়া ছোপ ধরাটা যেন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ক্রমে জয়কান্তর মুখ থেকে। আশ্চর্য! অদৃশ্য হয়ে গেল সম্পূর্ণ একেবারে।
এর পরের ঘটনা আরো আশ্চর্য। পাথরটা পাবার পর থেকে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগল জয়কান্ত। একটা বদ্ধমূল ধারণা জন্মাল ওর—পাথরটাই তার নতুন জীবন দিয়েছে। পাথরটাকে চোখের আড়াল করতে চাইত না কোন সময়ের জন্য। হীরাবতীর চেন হারের লকেট করে দিয়েছিল। হীরাবতী চোখের সামনে থাকে সর্বক্ষণ। পাথরটাও চোখে চোখে থাকবে জয়কান্তর।
পাথর পেয়ে সমুদ্র বেড়ান বাড়ল আরও। হীরাবতীও আপত্তি করে না আর। সত্যি শরীর খারাপ থাকলেও না। নিজের দুর্বলতার দরুন নিজেই লজ্জিত। সমুদ্রের মধ্যে মৃত্যুর বিভীষিকা দেখেছিল। মস্ত ভুল সেটা তার। এখন প্রতি সন্ধ্যেয় স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে এসে সমুদ্রের কাছে ক্ষমা চায় পূর্বের ধারণার জন্য। ভাবে সমুদ্র থেকে অমৃতও যে ওঠে—এটা কেন আসেনি তার মাথার মধ্যে আগে। সমুদ্র থেকে যে বিষও উঠতে পারে—এটা ভাবেনি কেন আগে—এটাও ভাবতে হল একদিন হীরাবতীকে নতুন করে—মাস ছয়েক পরে।
স্বামী-স্ত্রী হাসিখুশিতে ডগমগ। সমুদ্র সৈকতের স্নিগ্ধতা লাগছে দুজনের চোখেমুখে। বালুভূমিতে পায়ের পাতা ডুবিয়ে হাঁটছে ওরা। ঢেউ-এর শেষ ছোঁয়া লাগছে ওদের পায়ে। আকাশ-সমুদ্র এক হয়ে যাচ্ছে ওদের চোখে। সন্ধ্যে নামছে সমুদ্রের বুকে। নামল। আচমকা কি যে হয়ে গেল—কিছু বুঝে উঠতে পারল না ওরা। একটা দমকা বাতাস এসে আছড়ে পড়ল ওদের দুজনের ওপর। ওরা ছিটকে পড়ল দুজনে দুধারে। অশান্ত সমুদ্রের-অশান্ত ঢেউ ওদের আপাদ-মস্তক ভিজিয়ে দিয়ে গেল।
নিজেদের সামলে নিয়ে উঠে একজন আর একজনের কাছে এসে দাঁড়াল যখন, জয়কান্ত হীরাবতীর কাছে এলো যখন, তখন একটা অন্তর্ভেদী আর্তনাদ করে উঠল হীরাবতীর বুকের দিকে তাকিয়ে। আর হীরাবতীও স্বামীর গলায় গলা মিলিয়ে সমস্বরে করুণ আর্তনাদ করে উঠল নিজের গলায় হাত বুলিয়ে। হার নেই পাথর নেই।
অনেকদিন অনেক করে হীরাবতীকে বলেছিল জয়কান্ত-দেখ! পাথরটা যেন হারায় না কখনো! হারালে আমায় পাবে না আর। আমিও শেষ। অতি যত্নে রাখত তাই গলার হারটাকে হীরাবতী। কিন্তু একি হল? অতর্কিতে সমুদ্র এ চাতুরী খেলল কেন তার সঙ্গে? পূর্বের ভয়ঙ্কর ভাবার প্রতিশোধ নিল কি?
স্বামীর মুখখানা দেখছে আর দু’চোখে জল ভরে উঠছে হীরাবতীর। পাথর খোয়া যেতে সঙ্গে সঙ্গে মানুষটাও কেমন হয়ে যাচ্ছে যেন। মুখের ভাবটা বদলাচ্ছে। রুগ্ন অবস্থার আদলে ফিরে আসছে। ফিরে এলো।
হীরাবতীর বুকের তলায় হিমশীতল ঠাণ্ডা রক্তের স্রোত জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। জয়কান্তকে বাঁচাতে পারা যাবে না হয়তো এবারে আর। মনটা ভেঙে পড়েছে বড়।
সর্বনেশে সমুদ্র বিষের জলে ডুবিয়ে সর্বহারা করতে বসেছে তাকে। সমুদ্র থেকে যে বিষও উঠতে পারে এটা ভাবেনি কেন আগে। কেন সমুদ্রের সামনে থেকে জয়কান্তকে আড়াল করে রাখে নি, সরিয়ে রাখেনি। ঝরঝর করে ঝরে পড়েছিল দু’চোখের জল হীরাবতীর।
স্ত্রীর কান্না দেখে ক্ষেপে উঠেছিল জয়কান্ত। হার ফেরৎ চেয়েছিল। তার মুখ দেখবে না বলে স্থানত্যাগ করেছিল তখুনি।
নুলিয়াদের দিয়ে সমুদ্র তোলপাড় করিয়েছে হীরাবতী। হার খুজে পাওয়া যায়নি, পাথরও মেলেনি। ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে হীরাবতীকে নুলিয়ারা বুঝিয়েসুঝিয়ে। সমুদ্রের ওপর পুরো বিশ্বাস রাখতে বলেছে ওরা হীরাবতীকে। পুরীর সমুদ্র কখনো কারো কিছু আত্মসাৎ করেনি আজ পর্যন্ত। ফিরেয়ে দিয়েছে সবার সব কিছু। হারানো জিনিস পাওয়া গেছে এদিকে না হয় অন্য দিকে।
দু’দিন ধরে খোঁজাখুজি চলেও এদিক ওদিকে—কোনদিক থেকেই হারপাথর পাওয়া গেল না। হতাশ হয়ে পড়ল হীরাবতী। এদিকে জয়কান্তও তার জিদ ছাড়ছে না কিছুইে। সে মুখ দেখবে না বলেছে। হীরাবতীই তার মৃত্যুর কারণ। তার নিয়তি। তাহলে পাথর—সেখানে তার জীবন বাঁধা—সে বিষয়ে অত সাবধান করা সত্বেও এমন বেহুশ যে ঢেউ-এর ধাক্কায় হার বেরিয়ে গেল গলা থেকে। নিশ্চয় হার কেটে আসছিল, লক্ষ্য ছিল না কোন! বিশ্বাসঘাতিনীর হাতে ভুল করে পাথর সঁপে দিয়ে নিজের অজান্তেই ডেকে এনেছিল সে তখন মৃত্যুকে।
মুখ বুজে সয়েছে হীরাবতী স্বামীর ভর্ৎসনা। মানুষটা বলে কয়ে যদি বাঁচে বাঁচুক। একটুও অযত্ন করেনি হারটাকে—পাথরটাকে। ভালো করে লক্ষ্য রাখত রোজ। চেনে ক্ষয় ধরেনি। কাটবার মতো অবস্থাও হয়নি। কিন্তু এ নিয়ে বোঝালে বুঝবে না। উত্তেজনা বাড়বে বই কমবে না। তা ছাড়া বলবেই বা কাকে, বোঝাবেই বা কাকে। মানুষটার দুদিনের হাল দেখেই, বিপদ যে ঘনিয়ে আসছে—বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না একটুও।
মানুষটা যে ছ’মাস ভালো ছিল সেই ছ’মাস অসুস্থ থাকলে যে হারে শরীর ভাঙত, মুখচোখের চেহারা হতো—দু’দিনে তাই হয়েছে ওর অসম্ভবভাবে। পাথরের সঙ্গে কি এমন জীবনের যোগসূত্র থাকতে পারে তা চিন্তা করেও কোন হদিস বার করতে পারে না হীরাবতী।
অবিশ্বাসও করতে পারে না ঘটনাকে। যা ঘটেছে, যা ঘটতে যাচ্ছে তার প্রত্যক্ষদর্শী সে। মরণ পথের যাত্রীকে পাথরটাই বাঁচবার আশা জাগিয়ে তুলেছিল প্রবল। সুস্থও হয়ে উঠেছিল। আবার পাথরটার অবর্তমানে মানুষটা ছ’মাস পরেও পূর্বের অবস্থা ফিরে পেয়েছে। মৃত্যুর দিন গুণে চলেছে। সবই অদ্ভুত লাগছে হীরাবতীর কাছে। আরও অদ্ভুত লাগছে পাথরটাকে পাওয়া যাচ্ছে না দু’দিন ধরে—পাওয়া উচিত ছিল যেখানে।
দুদিনের দিন পাওয়া যায় নি বটে কিন্তু হারানোর চতুর্থ দিনের দিনে পাওয়া গেছল। এবারে পায়নি জয়কান্ত। পেয়েছিল হীরাবতী।
তিন দিনের দিন শেষ রাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল জয়কান্ত। মৃত্যু পর্যন্ত স্ত্রীর দিকে তাকায় নি। কাছে এলে খোলা চোখ বুজেছে। স্বামীর মৃত্যুতে হীরাবতী অনুশোচনার আগুনে জ্বলেছে। হারটা খুলে রেখে গেলে এ মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটত না হয়ত। অনুশোচনার জ্বালা একদিন মাত্র ভোগ করে আর সহ্য করতে চায় নি সে। মরে নিষ্কৃতি পেতে চেয়েছিল। তাই জয়কান্তর মৃত্যুর পরের দিনের শেষ রাতে চুপি চুপি বেরিয়ে গেছল বাড়ীর বাইরে। সমুদ্র ফেরত দেয় না কিছু। লোকে মিথ্যে রটায়। পাথর ফেরত দেয়নি। তাকেও ফিরিয়ে দেবে না এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ। এখানে তার আশা পূরণ হবে। তার যে মুখ স্বামী দেখেনি—অন্য কেউও দেখতে পাবে না সে মুখ আর।
…সমুদ্রের সামনে এগিয়ে আসছে। যেখানে বসত দু’জনে, বেড়াত দু’জনে যেদিকে-সেস্থানে-সেখানে এসে দাঁড়াল একটু পরে। এগিয়ে যাচ্ছে আবার সামনের দিকে। হঠাৎ হারশুদ্ধ পাথরটা এসে আছড়ে পড়ল হীরাবতীর পায়ের কাছে ঢেউয়ের জলের জলে। জ্বলে উঠল পাথরটা। উপুড় হয়ে পড়তে পড়তে টাল সামলে নিয়ে হারটা তুলে নিল হীরাবতী। মুগ্ধচোখে দেখল খানিক একদৃষ্টে। তারপর অজান্তেই নিজের গলায় গলিয়ে দিল চেন হারটা। মনে হল, বেঁচে আছে জয়কান্ত। যে জন্য যা করবার জন্য এসেছিল হীরাবতী সে পথ থেকে সরে গেল। আত্মঘাতী হতে ভুলে গেল একদল। আশ্চর্য! একবারের জন্যও মনে হল না তার—হারটা আগে পেলে জয়কান্ত বাঁচতে পারত।
বাড়ী ফিরে গেল হীরাবতী।
বছরের পর বছর ঘুরেছে। এই করে কেটেছে পাঁচটি বছর। এর মধ্যে একদিনের জন্যও স্বামীহারা মনে হয়নি হীরাবতীর। সময় সময় ভেবেছে, মাথাটা কি তার খারাপ হয়েছে? তা না হলে এরকম অবাস্তব কথা মাথার ভিতর জেকে বসে থাকতে পারে কেমন করে!
তখুনি অজ্ঞাতসারে চলে গেছে আলমারীর কাছে। ড্রয়ারটা খুলতেই পাথরটা নজরে পড়েছে। বাস্তব-অবাস্তবের কথা মাথা থেকে চলে গেছে তখুনি। কেবলি ভাবতে ইচ্ছে করেছে, বেঁচে আছে জয়কান্ত। পরম তৃপ্তিতে ভরে গেছে মনপ্রাণ ভাবার সঙ্গে সঙ্গে।
গলায় আর হারটা পরে না হীরাবতী রোজ। ড্রয়ার খুলে সকাল সন্ধ্যেয় দেখে কেবল। পরে মাত্র বছরের একটা দিন। কার্তিকী অমাবস্যার সন্ধ্যেয়। এই দিনে এই সময়ে প্রথম পেয়েছিল। পাথরটার সঙ্গে নতুন জীবনও পেয়েছিল। প্রতি বছর একটা রাত প্রাণভরে পাথরের আলোয় নিজেকে ডুবিয়ে দেয় হীরবতী। ওই আলোর ভিতর যেন জয়কান্তকেও দেখে সে চোখের সাধ মনের সাধ মিটিয়ে।
জয়কান্ত পাথর পেয়ে যেমন নতুন জীবন পেয়েছিল, তেমনি হীরাবতীর পাথর পাবার বছরখানেক পর ভাশুরের ঘরে একটি নতুন জীবন এসেছিল।
এই নতুন জীবন এল ভাশুরের প্রৌঢ় বয়সে। ঘর আলো করা প্রথম ছেলে। বংশীমোহন। বছর চারেকে পড়েছে বংশীমোহন। মায়ের কাছে থাকতে চায় না। চায় কাকীর কাছে সব সময়েই থাকতে। দু’মাস বয়েস থেকেই এই রকমের ও। মাসখানেক মামার বাড়ী গিয়ে অর্ধেক হয়ে এসেছে। খেত না, ঘুমুত না। বাড়ীর সকলকে জ্বালিয়ে মারত কাকীর কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য।
ফিরে এসেছে কার্তিকী অমাবস্যার সন্ধ্যেয়। ঘরে এসেছে কখন জানে না। এ দিনে এ ঘরে এ সময় কেউ আসে না। বংশী আসতে চাইলেও কান্নাকাটি করে রসাতল-তলাতল করলেও ওকে জোর করে আটকে রাখা হয়। আর তাছাড়া হীরাবতী এ দিনটায় সন্ধ্যে থেকে দরজা বন্ধ রাখে। শেষ রাতে হার তুলে রেখে তবে খোলে। হার পরা অবস্থায় বেরোয় নি কারো সামনে। দেখেনি এ হার কেউ।
দেখল বংশীমোহন। দরজা দিতে কেন ভুল করেছিল হীরাবতী। তা নিজেও জানে না। অবাক হয়ে যাচ্ছে বংশীমোহনের হার চাওয়ার ধরনে। অবাক হয়ে যাচ্ছে ওর চাউনি। হার-পাথর খোয়া যাবার পর এই ভাবের কথা শুনেছিল, এই ভাবের তাকানো দেখেছিল জয়কান্তর।
এগিয়ে আসছে ছেলেটা। হীরাবতী দেখছে বাচ্চা নয় ও। বড়—অনেক বড়। কি বিচ্ছিরি চেহারা! জরাজীর্ণ রোগা-লিকলিকে! বুকের ভিতর একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা তোলপাড় করছে হীরাবতীর।
না দিলে, মুখ দেখব না তোর আর।
বিদ্যুৎপৃষ্ঠ হয়ে পড়ল যেন হীরাবতী। কেঁপে উঠল ভিতর-বার। একি শুনল সে। স্পষ্ট বড় মানুষের কথা একেবারে। প্রথম থেকেই বাচ্চার আধ আধো কথা শুনতে পাচ্ছে না মোটে।
পিছু ফিরল বংশীমোহন। দ্রুত পায়ে দরজার দিকে যাচ্ছে। বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর থেকে।
কান্নাভেজা কাঁপা গলায় বলে উঠল হীরাবতী—যেও না। তোমার পাথর তোমায় ফিরিয়ে দিচ্ছি আমি এখুনি। কথাগুলো যে কি করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো—তা-ও জানতে পারে নি হীরাবতী।
ফিরে এলো বংশীমোহন হীরাবতার কাছে। সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে মিটিমিটি। হারটা খুলে হাতে দিল ইরাবতী।
হাতে নিয়ে দেখছে বংশীমোহন পাথরটাকে। জ্বলছে পাথরটা। আনন্দে জ্বল জ্বল করে উঠছে দু’চোখ ওর। পরিবর্তন মুখের রুগ্ন ভাবের। পরিবর্তন হচ্ছে লিকলিকে শরীরের।
হারটা ফিরিয়ে দিল হীরাবতীর হাতে বংশীমোহন। গম্ভীর ভাবে বলল, পাথরটা হারায় না যেন, সাবধানে রেখো।
হারটা হাতে নিয়ে দেখাতে দেখাতে পাথরটার গোপন রহস্য কাহিনী জানিয়েছিল আমায় হীরাবতী নিজেই।