সিঁড়ির ধাপে ধাপে পায়ের শব্দ—একসঙ্গে অনেক লোক উঠছে যেন। ভীতসন্ত্রস্ত চোখে খোলা দরজার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সুদর্শন। একটু আগে আচমকা ঘুম ভেঙে গেছে। চোখ খুলে ঘরের চতুর্দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেছে। রামভকত নেই। দক্ষিণদিকে চারপাইটা খালি। মানুষটা কখন দরজা খুলে নিঃসাড়ে পা টিপে টিপে বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে সুদর্শন টের পায়নি একটুও। মরণ ঘুম ঘুমিয়েছিল যেন। উত্থানশক্তি রহিত সুদর্শন উঠতে চেষ্টা করছে। দু’হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে ব্যর্থ চেষ্টা করল খানিক। চিৎকার করে যে কাউকে ডাকবে, সে উপায়ও নেই। মাস দুয়েক হল গলার স্বর উচ্চগ্রামে ওঠে না আর। কমতে কমতে এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, এখন তো পাশের লোকও একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লে কথা বুঝতে পারে না তার। ফিসফিস করে নিঃশ্বাসের আওয়াজে কথা কয় সে। প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া অন্য কথা কয় না আর। কইতেও পারে না।
গলায় যতটা জোর দেওয়া যায়, ততটা জোর দিয়েই রামভকতকে ডাকল বারতিনেক। শুনল না কেউ, সাড়া দিল না কেউ। সুদর্শন নিজের কানেই শুনল স্রেফ। আর শুনল বোধহয় ঘরের বাঁ কোণের প্রদীপের শিখাটা। ওটা একটু জোরে কেঁপে উঠল বারতিনেক।
ঘরে ঢুকল পরপর ক’জন। ক’জন গোনবার সময় ছিল না তখন সুদর্শনের। দেখেছিল কতকগুলো কালো ছায়া ঘরময় ঘোরাফেরা করছে। ঘোরফেরা করছে তার চারপাশে। বুকের ভেতরটা ঢিপ ঢিপ করছে। মৃত্যুর আগে নিজের মৃত্যু দেখছে। কালোছায়াগুলো তার চারপাইয়ের চতুর্দিকে গোল হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাত না তুলেও তাকে স্পর্শ না করেও যেন একসঙ্গে বহু হাতে তার আপাদমস্তক সজোরে চেপে ধরছে। হিম হয়ে আসছে সর্বশরীর। ক্ষীণ হয়ে আসছে নিঃশ্বাস। দম আটকে যাচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণা।
পিলসুজসুদ্ধ, প্রদীপটা নিয়ে এস এদিকে। বজ্রগম্ভীর স্বরে আদেশ করল একজন অন্যজনকে। ঘরটা কেঁপে উঠল। প্রদীপের শিখাটা কাঁপছে থরথর করে। ছায়ার কথায় কায়ার কণ্ঠস্বর শুনে বুকের ভারবোধ কমল অনেকখানি সুদর্শনের। ঘরটারও ঘন বাতাস পাতলা হয়ে এল। যে ক’টা এসেছে, মানুষ ভিন্ন অন্য কেউ নয় তারা। ভূত-প্রেত অশরীরী নয় কেউ। কঙ্কালসার চেহারায় ভিতরে সাহস ফিরে পাচ্ছে সুদর্শন। মানুষকে ভয় করেনি জীবনে। ভয় করতে শেখেনিও কখনো। একা একটা লোকের মহড়া নিয়েছে এক সময় ভরাযৌবনে। সুদর্শনের লাঠির সামনে সাহস করে এগিয়ে আসতে পারেনি কেউ কোনদিন। দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি এক মুহূর্তও।
যৌবনের সুদর্শন লাঠিয়াল জেগে উঠছে যেন মৃত্যুপথের যাত্রী সুদর্শনের ভিতর। চোখ দুটো জ্বলে উঠছে দপ দপ করে। সাদা ফ্যাকাশে চোখে অত রক্তের লাল এসে গেল হঠাৎ কোত্থেকে কে জানে। সুদর্শন নিজেও জানে না। আগন্তুকদেরই একজন সামনে আনা প্রদীপটা পিলসুজ থেকে তুলে, মুখের কাছে আরতির মতো দু’চারবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কি যেন দেখতে চেষ্টা করল। তারপর সরোষে বলে উঠল, রক্তচক্ষু দেখিয়ে কোন লাভ হবে না। যা করতে এসেছি, তা তোমাকে করাতে হবেই।
প্রদীপের আলোয় চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লোকগুলোর পা থেকে মাথা অবধি একবার করে দেখে নিল সুদর্শন। প্রত্যেকের সর্বাঙ্গ কালো আলখাল্লায় ঢাকা। মুখ কালো মুখোশে ঢাকা। এই মিশমিশে কালো আবরণ ভেদ করে শরীরের কোন অঙ্গ দেখবার উপায় নেই কারো। চেনা-অচেনা নিশানা জানবার উপায় নেই কারো।
হাতের প্রদীপ নামিয়ে রাখল লোকটা পিলসুজের ওপর। মুখ না ফিরিয়েই পাশের লোকের সামনে হাত বাড়াল। ও মানুষটা চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ পাথর মূর্তির মত। এবারে নড়ল একটু। বুকের কাছে, আলখাল্লার নীচে থেকে একখানা কাগজ বার করে হাতে দিল।
বুকের মধ্যে ঝড় বইছে সুদর্শনের। এ কী দেখছে। এ কী দেখল! কাগজ দেবার সময় যার হাত দেখল, যে আঙুল দেখল—অচেনা নয়, অজানা নয়। ফর্সা হাতটায় কালি মাখিয়েও চোখে ধোকা লাগাতে পারেনি সুদর্শনের। আংটিটা আঙুল থেকে খুলতে ভুলে গেছিল হয়তো ও। আংটিই চিনিয়ে দিয়েছে ভালো করে সুদর্শনকে—ও কে।
নামটা উচ্চারণ করতে যাচ্ছিল মুখ দিয়ে—থমকে গেল। ওরা সকলে মিলে উচ্চারণ করতে দিল না তাকে। চারদিক থেকে চোখ ধাঁধানো চকচকে ছোরা উঁচিয়ে ধরেছে। চোখের ওপর, মাথার ওপর বুকের ওপর।
সুদর্শন বিস্মিত ক্রুদ্ধ নির্বাক নিরুপায়।
কাগজটা হাতে পেতে সুদর্শনের দিকে এগিয়ে দিয়ে তীব্র তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, শীগগির সই করে দাও। না দিলে, পরিণতিটা আঁচ করতে পারছ নিশ্চয়। জোর করে সুদর্শনের ডান হাতে কলম ওঁজে দিল লোকটা।
একবার সবার দিকে তাকিয়ে দেখল সুদর্শন। তারপর ব্যর্থ ক্ষোভ ঝরে পড়ল মৃদুনিঃশ্বাসে। দুর্বল হাতে পুরো নামটা সই করে দিল।
কার্যসিদ্ধি হয়ে গেছে। আর এক তিলও দাঁড়াবার প্রয়োজন নেই কারো এ ঘরে। ত্বরিৎগতিতে উধাও হয়ে গেল সকলে ঘর থেকে।
খানিক পরে আবার সিঁড়ির ধাপে ধাপে অনেক গুলো পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে সুদর্শন। যাবার সময় হয়তো ওকে শেষ করে যেতে ভুলে গেছে বলে ফিরে আসছে ওরা।
সুদর্শনের ভুল ধারণা ভাঙল আগন্তুকদের দেখে। যারা এসেছে, তারা রামভকতের লোক। এই রকম যে ঘটবে, এটা রামভকত বুঝতে পেরেছিল বাইরের লোকের কানাঘুষো থেকে। সকালেই বুঝেছিল। তার লোকদের বলাও ছিল এদের প্রতিরোধ করবার জন্য। উচিতমত শিক্ষা দিয়ে শায়েস্তা করবার জন্য। ওদের আসবার আগে রাতে উঠে নিজের লোকদের আনতে গেছিল তাই ও। আপসোসের অন্ত নেই তার। তারা পৌঁছবার আগেই কাজ সমাধা করে সরে পড়েছে ওরা।
রামভকতের কথা শুনে মুখে কিছু বলল না সুদর্শন। কিছুক্ষণ ধরে একদৃষ্টে দেখল শুধু ওকে। দেখল আর ভাবল। কি দেখেছে রামভকতকে এতদিন ধরে? কি ভেবেছে ওর সম্বন্ধে? জয়রাজের সমস্ত কথাই কি ফলবে শেষ পর্যন্ত? যুক্তিতর্কের তলোয়ার দিয়ে কেটে কুচি কুচি করে দিয়েছে জয়রাজের অনেক যুক্তিতর্ক। তবুও হার মানেনি জয়রাজ। হার মেনেছিল সে-ও কি তার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে? না, সেখানে সে অটুট অবিচল।
দৌড়ে কাছে এসে, সুদর্শনের বুকের ওপর বাচ্চা ছেলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল রামভকত। চাচা—ক্ষমা কর! দেরী হয়ে গেছে। এসে যে তোমায় প্রাণে বেঁচে থাকতে দেখেছি—এটাই পরম ভাগ্য আমার।
নির্বাক মুখে রামভকতের মাথায় হাত বুলোতে লাগল সুদর্শন শীর্ণ হাতে। বুকের ওপর থেকে উঠে পড়ল রামভকত। সুরাই থেকে জল গড়িয়ে গেলাস ভর্তি করে নিয়ে এল–চাচা! এতক্ষণে বুকের ভিতর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে নিশ্চয়। ভিতরটা ভিজিয়ে নাও একটু একটু করে।
সুদর্শনের দু’চোখে ভয়। ঘাড় নাড়ল। খাবে না, ঠোঁট টিপে রইল জোর করে। দিনে রাতে যে কোন সময় জল খাওয়াতে গেলে এই রকমই করে সে। ভিতরটা জ্বলে যায় তার হু হু করে।
সব জানে রামভকত। সব শুনেছে সুদর্শনের কাছ থেকে। তবুও রামভকত সব সময় ওকে জল খাওয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। যুক্তি দেখায়, ডাক্তাররা বলেছেন। জোর করে খেতে হবে। পেটের ভিতর বুকের ভিতর ঘায়ের জন্য কষ্ট একটু হবে। শীগগির ভালো হয়ে যাবে। এ কষ্ট থাকবে না তখন আর।
ঠোঁট ফাঁক করে, জোর করে জল ঢেলে দিল গলায় রামভকত। ফেলতে পারল না সুদর্শন। মুখে হাত চেপে ধরল রামভকত। ঢোক গিলল সুদর্শন অতি কষ্টে। মুখখানা যন্ত্রণাকাতর বিবর্ণ হয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। দু’চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল দু’গাল বেয়ে।
এই অবধি পড়ার পর আমার যেন কেমন মনে হতে লাগল। হঠাৎ টওসা নদীর ঠাণ্ডা বাতাস উত্তপ্ত হয়ে উঠল যেন। পশ্চিমের খোলা জানালা দিয়ে ছুটে আসছে ঘরের ভিতর। আছড়ে আছড়ে পড়ছে আমার গায়ে। ভিতর বার জ্বলে যাচ্ছে আমার। দারুণ জ্বলুনি। খাতাটা চারপাইয়ের ওপর রেখে দিয়ে জানালার ধারে এসে দাঁড়ালুম আমি। টওসা নদীর তীরে আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে। কার মৃতদেহ পুড়ছে কে জানে। চিতার আগুনটা আকাশ ছুঁতে চাইছে বুঝি।
সুদর্শনের ভিতরটা জ্বলতে জ্বলতে শেষে দেহটাও জ্বলে উঠেছিল একদিন নিয়তির টানে ওই চিতায়, ওই শ্মশানে। প্রাণহীন দেহটা জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গেছিল। পৃথিবী থেকে নিঃশেষ হয়ে গেছিল চিরদিনের মতো মানুষটা।
সুদর্শনের চিতার আগুন পুরোমাত্রায় জ্বলে ওঠবার সময়, যে মর্মন্তুদ দৃশ্য বিভীষিকা দেখেছিলুম ভুলতে পারিনি। নতুন করে চোখের সামনে সেই সব ভেসে উঠছে আমার। দু’চোখে হাত চাপা দিলুম আমি। সরে এলুম চারপাইয়ের কাছে। বসলুম। তুলে নিলুম খাতাটা আবার হাতে।
সন্ধ্যা নামছে বাইরে। আলো-আঁধারি হয়ে আসছে ঘরের ভিতরটা। আলোর দিকটায় খাতা রেখে সুদর্শনের কাঁপা হাতের টেড়া-বাঁকা লেখাগুলো পড়তে চেষ্টা করছি আমি। কানে বাজছে মর্মভেদী করুণ আর্তনাদ একটা। তবু পড়ার দিকে মনটাকে ধরে রাখবার চেষ্টা করছি আমি। পাতা ওল্টাচ্ছি, লেখা পড়ছি।
এই সোঢরী গাঁওয়ের মানুষ নিরীহও যেমন ভয়ঙ্করও তেমন। অতি বড় মিত্র অতি বড় শত্রু হয়ে ওঠে নিমেষে এক ইঞ্চি জায়গার দখল নিয়ে। একজন আর একজনকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করে না একটু। জমিজমা রক্ষার তাগিদে, দুশমনদের মারাত্মক আক্রমণের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য, প্রত্যেক ঘরের ছেলেকে সুদক্ষ লাঠিয়াল হয়ে ওঠবার চেষ্টা করতে হয় বাচ্চা বয়েস থেকেই—তার সামর্থ্য থাকুক আর না থাকুক।
সুদর্শনের সামর্থ্য ছিল। সুদক্ষ লাঠিয়ালের মর্যাদার আসন লাভ করতে বেশী বেগ পেতে হয়নি তাকে। এর জন্য অনেকের ঈর্ষার পাত্র যে হয়নি সে তা নয়। হয়েছিল। মৌখিক হৃদ্যতা দেখালেও অন্তরে বিষের ছুরি নিয়ে ঘুরত বহু লোক। সুযোগ সুবিধে পেলেই ওর নিপাত হওয়ার মারণাস্ত্র প্রয়োগ করতে কালবিলম্ব করবে না তারা।
বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারল সুদর্শন—পাশের বাড়ির জ্ঞাতি ভাই বিহুলাল ওই দলের প্রধান পাণ্ডা। সুদর্শন জানে বিহুলাল তার কাছে অতি নগণ্য। তার হাতের দুটো আঙুলের ডগায় বিহুলালের প্রাণবায়ু। তাই যতটুকু সম্ভব এড়িয়ে চলত বিহুলালকে। নিজের মনকে সব সময় বিশ্বাস করা অনুচিত। কখন কি কুমন্ত্রণা দিয়ে বসে কে জানে।
সুদর্শনের এড়িয়ে চলাটাকে মহা দুর্বলতা ভেবে নিয়েছিল বিহুলাল। সকল বিষয়ে হাঙ্গামা বাধাবার জন্য ভীষণ তৎপর হয়ে সুদর্শনের পিছু পিছু ঘুরে বেড়াত ছায়ার মতো।
স্বতন্ত্র ছিল বিহুলালের সম্বন্ধী রামভকত। পিতৃ-মাতৃ হারা রামভকত ওই বাড়ির একটা ছেলে যেন। ছোটবেলা থেকে মানুষ ও ওখানে। বিহুলালের স্নেহপুষ্ট হয়েও ও যেন অন্য ধরণের। দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ। ও-বাড়ির চেয়ে এ-বাড়ি পছন্দ তার বেশী। বিহুলালের চেয়ে সুদর্শনকেই তার ভালো লাগে খুব। অনেকটা তার চাচার মতোই দেখতে বলে এই আকর্ষণ। চাচা পৃথিবীতে নেই আজ।
দাদা ডাকা উচিত হলেও সুদর্শনকে চাচা বলেই ডাকত রামভকত। জোয়ান রামভকত অনেক সময় অনেক কিছু এসে বলেছে বিহুলালের বিরুদ্ধে। বলেছে দেওয়ালীর দিনে তার জমি দখলের ষড়যন্ত্রের কথা। বলেছে ওই দিনেই নেশায় মাতোয়ারা করে বরাবরের মত চাচার নিশ্বাস বন্ধ করে দেবার কথা। চাচাকে বাইরে বেরুতে বারণ করছে। হুঁশিয়ার হয়ে চলতে অনুরোধ করেছে পায়ে ধরে বারবার। দু’চোখ ছল ছল করে উঠেছে। মৃত চাচার কথা মনে পড়েছে তার।
দেওয়ালীর দিন সুদর্শনকে আগলে থেকেছে দিনরাত। একবারের জন্যও বাড়ির বাইরে পা বাড়াতে দেয় নি। আঁকা-বাঁকা টওসা নদীর পূর্ব কিনারের জায়গাটাকে কেন্দ্র করে দু’দলের মধ্যে লাঠালাঠি হয়ে গেছে। মাথা ফাটাফাটি হয়েছে। রক্তগঙ্গা বয়েছে। হেরেছে বিহুলালের দল। জিতেছে সুদর্শনরা। জিতলেও এ দলের দু’একজনের যে প্রাণহানি হয় নি, তা নয়। হয়েছে। রামভকত জানিয়েছে, চাচারই বিপদ হবার কথা ছিল। ভুল করেই ও-দু’জনের জীবন নিয়েছে ওরা। ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ। বাড়ি থেকে না বেরুনোয় চাচা রক্ষা পেয়েছে।
রামভকতকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে সুদর্শন। বড় ছেলে পরাশরের হাতে ওর হাতটা টেনে নিয়ে এসে মিলিয়ে দিয়েছে। বলেছে, আজ থেকে জানবে এও তোমার আর এক ভাই।
পরের দিন সকালে রামভকত বাড়ি ফিরতে বিহুলালের ক্রুদ্ধ গর্জন ভেসে এসেছে সুদর্শনের কানে। জানালার কাঠের রেলিং ধরে দেখেছে ও-বাড়ির ঘরের ভিতরের ব্যাপার। রামভকতকে দেওয়ালে চেপে ধরে গলা টিপে ধরেছে বিহুলাল। বাড়িসুদ্ধ, সকলে এসে ছাড়াতে চেষ্টা করেছে। রাগে ফুসছে আর চিৎকার করে বলছে বিহুলাল—নিমকহারাম বিশ্বাসঘাতকদের স্থান হবে না এবাড়িতে একদণ্ডও!
রামভকতকে বার করে দিয়েছে বিহুলাল বাড়ি থেকে। সাদা বালির রাস্তায় বসে বসে হাপুস নয়নে কেঁদেছে রামভকত। এ বাড়িতে আসেনি। পরাশরকে পাঠিয়ে জোর করে সুদর্শন নিয়ে এসেছে ওকে। সেই থেকে রামভকত এ বাড়িতেই রয়েছে। বছর খানেকের ভিতর হর্তাকর্তা বিধাতা হয়ে উঠেছে সে। বিষয় দেখাশোনা থেকে কোন কাজই সে ছাড়া গতি নেই কারো। সুদর্শনের প্রাণের প্রাণ সে। পরাশরের বিশ্বাসী বন্ধু! সুদর্শনের ছোট ছেলে মনোহরের অভিভাবক।
সকলের কাছে ভালো রামভকত কিন্তু একজনের দু’চক্ষের বিষ কেবল। এ-বাড়িতে আসার শুরু থেকে কোন দিন সুনজরে দেখেনি ওকে সে। সুদর্শনের বাল্যবন্ধু বিশেষ অন্তরঙ্গ লোক জয়রাজ। জয়রাজ অনেক কিছু কানে কানে বলে কান ভারী করতে চেয়েছে সুদর্শনের। ফল ফলেনি। সুদর্শন বন্ধুর ওপর বিরক্ত হওয়া ছাড়া সন্তুষ্ট হতে পারেনি। বন্ধু কিন্তু তার পথ থেকে সরেনি একচুলও। রামভকত শত্রুপক্ষের লোক। শত্রু যখন মিত্র হয়ে ঘরে ঢোকে তখন শিয়রে মৃত্যু আসারই সামিল মনে করতে হবে। বিষয়-আশয় নিয়ে রেষারেষি দু’বাড়ির লোকের রক্ত-মজ্জায়। এটা পূর্বপুরুষ থেকেই চলে আসছে। রামভকতকে দিয়ে নানা অভিনয়ের জাল বিস্তার করে, অনেক কৃত্রিম ঘটনা ঘটিয়ে সুদর্শনের মনের কোণে রামভকত সম্বন্ধে দৃঢ়বিশ্বাস আনিয়েছে বিহুলাল। বাইরের শত্রু ঘরে ঢুকেছে। প্রতিশোধ-স্পৃহা চরিতার্থ করবে বিহুলাল শীগগির রামভকতকে দিয়ে।
বন্ধুর সতর্কবাণী হেসে উড়িয়ে দিয়েছে সুদর্শন। সাবধান তো হয়ইনি, বরং বন্ধুর গোপন উপদেশ-পরামর্শ—সমস্ত বলে দিয়েছে রামভকতকে। পিঠে হাত চাপড়ে সস্নেহে বলেছে, তুমি কিছু মনে কর না। জয়রাজটা বদ্ধ পাগল। কাকে বিশ্বাস করতে হয়, কাকে অবিশ্বাস করতে হয় কিছু জানে না।
এরপর থেকে কালরোগ ধরল সুদর্শনের। পেটের ভিতর জ্বালা। ডাক্তার বৈদ্যরা রোগ ধরতে পারল না। রোগ সারাতে পারল না হাজারো চেষ্টা করেও। রোগের ব্যাপার নিয়েও জয়রাজ বলেছে, ওর যত্ন নিতে, ওর হাতে কিছু খেতে কতবার মানা করেছি। নিশ্চয় কিছু জিনিস খাইয়েছে ও তোমায়।
ঘৃণা এসেছে বন্ধুর ওপর। খুব নীচমন জয়রাজ। যে লোকটা নাওয়াখাওয়া ত্যাগ করে দিনরাত জেগে, প্রাণ দিয়ে, সেবা করছে, সুস্থ করে তোলবার চেষ্টা করছে, তার নামে এই দুর্নাম দিতে জিভে বাঁধল না জয়রাজের।
সুদর্শনের কিছু হলে ছেলেটা পথে বসবে। নিজের দুই ছেলের মতো ধর্মছেলে রামভকতকেও বিষয়ের সমান অংশ উইল করে দিয়েছে। উইলের সময়ও বিশ্বাসের ভিত টলেনি সুদর্শনের একবারের জন্য। টলল পরাশর খুন হয়ে যেতে, টওসা নদীর ধারে জমি দখলের ব্যাপার নিয়ে। দখলের সময় পরাশরকে জায়গাটায় যেতে বার বার প্ররোচনা দিয়েছে রামভকত। পরাশরের যাবার প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও। এ সময়ও পরাশরকে পাঠাতে নিষেধ করেছিল জয়রাজ।
বড় ছেলে যাবার পর ছোটকেও তৈরি করবার জন্য অস্থির হয়ে উঠল রামভকত। ভীতু হয়ে ঘরে বসে থাকার কোন মানে হয় না। মনোহরকে যেতেই হবে অন্য জমি দখল করতে। ভাইয়ের খুনের বদলে খুন নিতে হবে তাকে। জয়রাজ সুদর্শনের হাত ধরে অনুনয় বিনয় করে বারণ করল মনোহরকে যেতে দিতে। মনোহর চলে গেলে বংশে বাতি দিতে থাকবে না আর কেউ। কথাটা দাগ কাটল সুদর্শনের মনে। ভিতরটা অব্যক্ত ব্যথায় টনটন করে উঠল। বড় ছেলে যাবার পর থেকে ও-বাড়ির জানালা দিয়ে ভেসে আসে বিহুলালের পৈশাচিক উল্লাসের অট্টহাসি। কি জল খাওয়ায় কে জানে রামভবত। অন্যের হাতে খেলে ভিতর জ্বলে না। ওর হাতে খেলেই ভীষণ জ্বলে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে।
সম্পূর্ণ রামভকতের কজায় চলে গেছে সুদর্শন। ও তার নিয়তি, ও তার মৃত্যু। রেহাই নেই ওর হাত থেকে বেরুবার আর এ-জীবনে। তার শেষ হোক দুঃখু নেই। মনোহর বাঁচুক। বংশ রক্ষা পাক।
গোপনে জয়রাজের সঙ্গে মনোহরকে শহরে পাঠিয়ে দিয়েছে সুদর্শন। মনোহরকে বাড়ির ত্রিসীমানায় না দেখতে পেয়ে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে উঠেছে রামভকতের দু’চোখে। মোহ কেটেছে তাই এ আগুন দেখতে পেয়েছে সুদর্শন। ভয়ে শিউরে উঠেছে। জয়রাজের পরামর্শ মতো আগের উইল ছিড়ে ফেলেছে টুকরো টুকরো করে। এসে পডেছে ঘরে রামভকত। ঘরময় ছেড়া কাগজের টুকরো দেখে চমকে উঠেছে। কাগজ কুড়িয়ে ভালো করে দেখে বুঝতে পেরেছে, উইল ছিঁড়ে বিষয়ের অধিকার থেকে নাকচ করে দিয়েছে তাকে সুদর্শন। রামভকতের মুখখানা রাগে রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে।
এর পরের ঘটনা—সেই রাতেই লোকলস্কর নিয়ে এসে ভয় দেখিয়ে সুদর্শনকে সই করিয়ে নিয়েছে। ওর হাতের আংটিটা দেখে চিনেছিল সুদর্শন ওকে। সমস্ত বিষয়টা নিজের নামে রাখবে বলে যে সই করিয়ে নিয়েছে, এটা বেশ বুঝতে পেরেছিল সে।
নতুন উইলে লিখেছে, আগেকার যত উইল, জ্ঞানে-অজ্ঞানে যেখানে যা সই করেছে, সমস্ত বাতিল, সব সম্পত্তি মনোহরের।
পাতা ওল্টাচ্ছি আমি। খাতার খানতিনেক পাতা একেবারে সাদা। কালির আঁচড় পর্যন্ত পড়েনি। চতুর্থ পাতায় সুদর্শন লিখেছে আবার। খুব ছোট্ট লেখা। এইটাই শেষ লেখা তার।
মনোহর কোনদিন ফিরে এসে যদি রামভকতকে বেঁচে থাকতে দেখে, একটুও দেরী না করে তখুনি যেন শহরে মামার বাড়িতে চলে যায়।
খাতাটা সুদর্শনের বিশ্বস্ত বন্ধু জয়রাজ দিয়েছিল পড়তে।
বাপ মারা যাবার খবর পেয়ে আমার সঙ্গে গাঁওয়ে এসেছিল মনোহর।
…তখন চিতা জ্বলছে। শুনলুম, সুদর্শন না কি দুটো হাত ধরে বিশেষ অনুরোধ করে বলে গেছে রামভকতকে, মারার পর ও ছাড়া অন্য কেউ যেন তার মুখাগ্নি না করে। করলে তার আত্মা তৃপ্তি পাবে না।
আমি আর মনোহর শ্মশানে বসে আছি। কাঁদছে মনোহর। চিতা থেকে একটু দুরে রামভকতও বসে আছে। কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। নজর পড়ল মনোহরের দিকে। ভিজে গলায় রামভকত চিৎকার করে বলে উঠল, চাচাজী চল গ্যয়েরে মনোহর। উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে আসছে মনোহরের দিকে।
আচমকা কি ঘটে গেল, বুঝে উঠতে পারল না শ্মশানসুদ্ধ কেউ। চিতার আগুনটা লাফিয়ে উঠে, সজোরে ঝাঁপিয়ে পড়ল যেন রামভকতের ওপর। মুহূর্তে জ্বলে উঠল রামভকতের সর্বশরীর। বাঁচবার জন্য রামভকতের কি আকুলিবিকুলি! বুক ফাটানো কি করুণ আর্তনাদ! যে দিকেই ছুটে পালাতে যাচ্ছে—আগুনটা যেন সেদিকের পথ আগলে দাঁড়াচ্ছে। টানছে চিতার দিকে। নিয়ে এল চিতার পাশে একেবারে। একজন দু’জন নয়, বহুজন স্বচক্ষে দেখলুম সে নির্মম দৃশ্য। নিমেষে একটা দমকা বাতাস এসে রামভকতকে সজোরে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল জ্বলন্ত চিতার মাঝখানে। লাল গনগনে আগুনটা আকাশ ছোয়া হয়ে উঠল ঠিক সেই সময়।