প্রাসাদপুরীর আনাচে কানাচে থেকে শুরু করে রাস্তা অবধি লোকে লোকারণ্য। এত লোকের চোখের সামনে দিয়েই কাউকে ভ্রুক্ষেপ না করে চলে গেল চন্দ্রশেখর। অগন্তুক বৃদ্ধের দু’চোখে যেন কি ছিল। বৃদ্ধের চোখে চোখ রেখেই খানিক দাঁড়িয়ে ছিল চুপচাপ। চন্দ্রশেখরের চেহারাটা একেবারে নিষ্পন্দ পাথরমূর্তির মত দেখাচ্ছিল।
ওর চোখ থেকে চোখ ঘোরালেন বৃদ্ধ নিজেই। পিছু ফিরলেন। বিজয়ী বীরের মতো এগুতে লাগলেন সামনের দিকে। অন্ধের মতো অনুসরণ করে চলতে লাগল তাঁকে চন্দ্রশেখর। চন্দ্রশেখর যেন সম্মোহিত মানুষ। ওর সঙ্গে বোধ হয় আমরাও সম্মোহিত হয়ে গেছলুম সেই সময়টায়।
কোন বাধা দেবার ক্ষমতা ছিল না কারো। বৃদ্ধকে কিছু বলবার সাহস ছিল না কারো। নির্বাক সকলে। চন্দ্রশেখরের মা-বাবা পর্যন্ত। আগন্তুককে দেখা মাত্র তাঁরা কেমন হয়ে গেছলেন। দু’জনেরই মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছল। রাজ্যের ত্রাস ঘিরে ধরেছিল তাঁদের চোখে।
আলোর মালায় সাজানো প্রাসাদকে যেন অন্ধকার দেখাচ্ছিল। হয়ত আমাদের মনের চোখে অন্ধকার নেমে এসেছিল বলেই। চন্দ্রশেখরের ব্যাপারটায় স্নায়ুগুলো শিথিল হয়ে পড়েছিল। সবল অবস্থায় ফিরে আসতে সময় লেগেছিল বেশ খানিকটা।
যখন আমাদের আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেল, যখন আমরা সম্পূর্ণ সচেতন হয়ে উঠলুম, তখন চন্দ্রশেখর নাগালের বাইরে চলে গেছে একেবারে। আর তাছাড়া ওর বিষয় পরে যা শুনলুম—তাতে আমাদের পক্ষে ওকে ফিরিয়ে আনাও অসম্ভব হত। অন্তত বৃদ্ধের হাত থেকে ছিনিয়ে আনবার মত কোন ন্যায্য যুক্তি নীতি খাড়া করতে পারতুম না আমরা তার কাছে।
চন্দ্রশেখরের মা-বাবার কাছ থেকেই শুনেছিলুম আমি ওর জীবন রহস্যের কথা। মা-বাবা গোপন করেই রেখেছিলেন সে কাহিনী সবার কাছে। জ্ঞাতি স্বজনের কাছে তো বটেই, তাছাড়া ছেলের কাছেও।
তেহেড়ীগাড়োয়াল রাজ্যের রাজবংশের রক্ত বয়ে চলেছে চন্দ্রশেখরের ধমনীশিরায়। চন্দ্রশেখরকে নির্ভীক শিকারী যোদ্ধা আর রাজনীতিজ্ঞ করে গড়ে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন মা-বাবা। কোন বিষয়ে কোন ত্রুটি রাখেন নি জ্ঞাতসারে। তবুও ছেলে মনোমত হয় নি তাঁদের। এর জন্য আপসোসের অন্ত ছিল না। একমাত্র ছেলের ভবিষ্যৎ ভেবে হতাশায় বুক ভেঙে যেত তাঁদের মাঝে মাঝে। তখন নির্লিপ্ত দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকত না আর।
ছেলের জীবনে ভাঙাচোরা খেলার মূলে একটি মাত্র লোকেরই ছায়া এসে পড়ত বার বার। সে ঐ বৃদ্ধের। কোন কিছু না পারার জন্য অনেক সময় ছেলের ওপর রাগ করতে গিয়েও পারেন নি মা-বাবা। দয়া এসেছে, মায়া এসেছে। ওর ছলছলে চোখের দিকে তাকিয়ে ওকে নির্দোষই মনে হয়েছে। বৃদ্ধ কি নির্দয়! ছেলেটার ওপর—তাঁদের ওপর নির্মম আঘাত হানতে এত চেষ্টা করছে কেন? ছেলেটাকে কি ভুলতে পারে না? ভুলতে পারবে না কখনো?
ভুলতে যদি চেষ্টা করত—তাহলে এত আসত না। একবার নয় দু’বার নয়—বার বার এসেছে। সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অবিশ্যি চন্দ্রশেখরকে বাঁচিয়েছে বার তিনেক। সেটা মহতের মতো কাজ করেছে। মেনে নিয়েছে মা-বাবা। তার জন্য চিরকৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞতার বন্ধনে বেঁধেছে বলে মা-বাবার স্নেহভরা বুক থেকে সবে ধন নীলমণি—তাঁদের চোখের মণিকে ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করবে—এ কেমন কথা।
মনে মনে কত অনুরোধ জানিয়েছে মা-বাবা–তুমি তো সব বোঝ—আমাদের মনের কথা রাখো! ছেলেটাকে ভিক্ষে দাও শুধু! তার বিনিময়ে যা চাও—নাও!
বধির কখনো শোনে না। শুনল না ঐ বৃদ্ধও। অনুরোধে দুর্বলতা বুঝল। বিরোধ বাধাল আরো এসে এসে। তখন থেকেই অজানা আশঙ্কায় দুরু দুরু কেঁপে উঠেছিল মা-বাবার বুক। একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। বৃদ্ধের প্রভাব থেকে ছেলেকে মুক্ত করবার জন্য অন্যমনস্ক করতে চেষ্টা করেছেন। অন্যদিকে মন টানতে চেষ্টা করেছেন।
বৃদ্ধকে দেখার কথা শুনেছে যখুনি, তখুনি আগুন জ্বলে উঠেছে মাথায়। বৃদ্ধকে কাছে পেলে—তাঁর দেহটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে—ভস্ম নিয়ে নরেন্দ্রনগরের পাহাড়ী ঝরণার জলে ভাসিয়ে দিয়ে নিষ্কৃতি পেতে হবে। আপনাদের শাস্তি হবে চিরকালের জন্য। ছেলেকে ধমকের সুরে বলেছেন—ওসব বাজে চিন্তা তোমার সাজে না। যাকে তুমি দ্যাখো—সে তোমার কল্পনার মানুষ ছাড়া আর কিছু নয়।
মা-বাবার কথা শুনে বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে যেত চন্দ্রশেখর। অল্প সময়ের জন্য হলেও, যাকে চাক্ষুষ দেখেছে, যার উপস্থিতি অনুভব করেছে স্পষ্ট, মৃত্যুগব্বর থেকে টেনে বার করেছে যে এক একবার—সে কল্পনার মানুষ? চন্দ্রশেখরের মন সায় দিত না একটুও এ কথায়। একথা মেনে নিতে পারবে না কিছুতেই সে। কিছুতেই না।
ছেলের মুখচোখের ভাবগতিক দেখে বুঝতে আর বাকী থাকত না—মাবাবার কথা একটুও দাগ কাটে নি। ছেলের মনে।
প্রমাদ গণলেন বাবা-মা।
চন্দ্রশেখরকে নিয়ে কোথায় যাবেন তারা? লুকিয়ে রাখবেন এই ছেলেকে কোনখানে? ভেবে কুলকিনারা পেলেন না কোন। আগেকার কথা মনে পড়তে আরো নিরাশ হয়ে পড়লেন। অন্ধকার দেখলেন চতুর্দিকে। একেবারে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। একটুও ফাঁক নেই কোথাও। আলোর রেখা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না কোন দিক থেকেই। নিরুপায় তাঁরা।
তাঁদের নিরুপায় অবস্থাটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বেনারস পালিয়ে যাবার সময় বেশী করে। বৃদ্ধের যে দু’চোখ সদাসর্বদা পাহারা দিয়ে রেখেছে—ঘিরে রেখেছে ছেলেকে—তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে।
নিশুতি রাতে চলন্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে মাঝে মাঝে উঁকি মেরে দেখেছে ছেলেকে ঐ বৃদ্ধ। জানালা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ওর হাত থেকে নিস্তার পাবার জন্য। নিস্তার পাওয়া যায়নি। কোথা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করেছিল সকলের অজ্ঞাতসারে কে জানে। সবার চোখের সামনে ছেলের কাছে উপস্থিত হয়েই, কাউকে পলক ফেলবার অবসর না দিয়েই, আত্মগোপন করেছিল আবার আশ্চর্যভাবে। বৃদ্ধ যাদু জানে নিশ্চয়। তাঁর যাদুর মায়া দেখিয়ে জানিয়ে দিয়েছিল সবাইকে-বন্ধ জানলা দরজা আটকাতে পারে না তাঁকে। তাঁর দৃষ্টির আওতা থেকে পালিয়ে যাবে কে কোথায়। অবারিত যাতায়াত তার সর্বত্র।
নিজের অগোচরেই ছেলেটাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিল হয়তো বৃদ্ধ। এতটা ভালোবাসা উচিত হয়নি তাঁর পক্ষে। অন্যের ছেলেকে তার মা-বাবার চেয়ে বেশী ভালোবাসাটা নাকি ডাইনীর ভালোবাসা। কথাগুলো মনে পড়লে ভয় ধরত!
ভালোবাসার নমুনা দেখাতে গিয়ে দারুণ ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল একদিন বৃদ্ধ। বেনারসে পালিয়ে আসবার কিছুদিন পরেই ঘটনাটা ঘটেছিল। সেদিন অকারণ একটা জিদ পেয়ে বসল হঠাৎ চন্দ্রশেখরকে। ওর অবুঝপনা বেড়ে উঠতেই লাগল। বেড়াতে যাবে গঙ্গার ধারে। কারো কথা শুনবে না।
বোঝানো হল—বয়েস বাড়ছে বই কমছে না তো আর। পাঁচ-ছ বছরের ছেলের বায়না পনের-ষোল বছরে সাজে নাকি?
সাজে। বড়মানুষের মতো গম্ভীর গলায় উত্তর দিল চন্দ্রশেখর। আরো জানাল, বৃদ্ধ এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে গঙ্গার ধারে। হাত নেড়ে ডাকছে তাঁকে। সে নাকি বাড়ী থেকে বসে বসেই দেখছে সব!
শুনে, মা বাবা স্তম্ভিত, হতবাক।
হাড় জিরজিরে চেহারার বৃদ্ধের ক্ষমতার কথা অজানা নয় তাঁদের কাছে। ট্রেনের ব্যাপারটা ভোলার নয়। স্বপ্নের মতো হলেও কখনো মন থেকে মুছে যাবার মতো নয়। বুড়োর ডাকে বাধা দিলে রেগে গিয়ে শেষে অনর্থ না কিছু করে বসে।
বুড়োর ডাক মেনে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত মনে হল বাবা-মার।
গঙ্গার কাছাকাছি এসে থামল টাঙা। টাঙা থেকে নামলেন মা-বাবা। নামল চন্দ্রশেখর। বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে ডানদিকে। তাঁর পায়ের তলা দিয়ে গঙ্গা বইছে। শীতের ক্ষীণকায়া গঙ্গা বিশাল রূপে ধরেছে! ফুলে ফুলে উঠছে। অত নীচে থেকে রাস্তা অবধি উঠে এসেছে। সিঁড়ির মন্দিরগুলো জলের তলায় ডুবেছে। ওপারের বালির চরের চিহ্নমাত্র দেখা যাচ্ছে না। কেবল জল আর জল। অথৈ জল। কি দুর্বার স্রোত। সর্বশক্তিই নিমেষে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে গঙ্গার এই ভয়ঙ্করী প্রকৃতি।
ভয়ঙ্করেরও একটা সৌন্দর্য আছে। একটা প্রবল আকর্ষণ আছে। এসেছে অনেক মানুষ। দূরে দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে গঙ্গার এই রূপ। ভীত সন্ত্রস্ত চিত্তে দেখছে সকলে। খানিক পা বাড়ালেই অনিবার্য মৃত্যু। মুহূর্তে কোন অতলে তলিয়ে যাবে—খুঁজে পাবে না কেউ কখনো আর। তবু তাঁরা দেখতে এসেছে।
দেখছেন চন্দ্রশেখরের মা-বাবাও। ছেলের দু’হাত ধরে দুপাশে দাঁড়িয়ে আছেন। খেয়ালী ছেলে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে বুড়োর কাছে যাবার জন্য জলের ওপর দিয়েই দৌড়াদোড়ি আরম্ভ করে দেয় শেষে।
যা ভয় করেছিলেন, তাই হল।
আচমকা ঝটকায় দুজনের হাত থেকে নিজেকে ছিনিয়ে নিয়ে দৌড়াল চন্দ্রশেখর। হাতের ইশারায় ডাকছে বৃদ্ধ। আছড়ে পড়ল চন্দ্রশেখর জলের ওপর। চতুর্দিক থেকে গেল গেল আর্তনাদ উঠল সমবেত কণ্ঠের। মুহূর্তে কি যে ঘটে গেল—কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না বাবা-মা। ছেলেটা যেন হারিয়ে গেল জলের তলায়। জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলেন ওঁরা দুজনেই, বৃদ্ধ ঝাঁপিয়ে পড়ল। হাত ধরে টেনে তুলল চন্দ্রশেখরকে। মায়ের কাছে নিয়ে এলো।
হারানিধি নয়নের মণি ছেলেকে ফিরে পেয়ে বুকে টেনে নিলেন মা। হাপুস নয়নে কেঁদে বুক ভাসালেন নিজের। তখন বৃদ্ধকে মনে হয়ে ছিল অতি আপন জন। এরকম হিতাকাঙ্খী বুঝি দ্বিতীয়টি আর কেউ নেই তাঁদের। বৃদ্ধকে কৃতজ্ঞতা জানাতে মুখ তুলে তাকালেন। জলভরা চোখের ঝাপসা ভাবটা কেটে যেতে পরিস্কার দেখলেন, বৃদ্ধ নেই। আত্মগোপন করেছে তাঁর স্বভাব অনুযায়ী। এক এক সময় বৃদ্ধকে পরম মিত্র মনে হলেও, শত্রু মনে হতেও খুব বেশী সময় দেরী লাগত না তাঁদের। বৃদ্ধ যেন বাহাদুরী নেবার জন্য দুর্বল মনের ছেলেটাকে বিপদের মাঝে টেনে নিয়ে গিয়ে তুলে আনে আবার। এ যেন ঠেলে দিয়ে টেনে ধরা গোছের। অবিশ্যি বৃদ্ধের ওপর এ ধারণাটা এসে গেছল এর পরের অন্য ঘটনা দেখে।
মিথ্যে এদেশ-ওদেশ পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানো! বৃদ্ধের কাছ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে রাখা যাবে না নিজেদের। লুকিয়ে রাখা যাবে না ছেলেকে।
দেশে-তেহেরী গাডোয়ালে ফিরে এলেন আবার মা-বাবা চন্দ্রশেখরকে নিয়ে।
এরপর বছর ঘুরেছে। শিবচতুর্দ্দশী। শিবমন্দিরে যাচ্ছেন মা-বাবা। চন্দ্রশেখরকে সঙ্গে নিয়েই চলেছেন। পূর্বপুরুষদের শিবমন্দিরে শিবপূজা দেখবে। পাহাড়ী রাস্তায় এঁকে বেঁকে, উঁচুনীচু পথ মাড়িয়ে চলেছে ওদের গাড়ী। ঝুরিনামা বটগাছের তলায় শিবমন্দিরটা দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। খানিক গেলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে। একটা বাকের মুখ ঘুরতে গিয়ে কারটা দুলে উঠল। একটু লাফিয়ে উঠল।
চন্দ্রশেখরের দিকের দরজাটা হয়ত ঠিক মত বন্ধ করা হয় নি আগে থেকেই, গাড়ীটা প্রবল ঝাঁকুনি খাওয়ায় খুলে গেছে—নয়ত এমনিও খুলে যেতে পারে—কেন খুলল তার হদিস কিছু পাওয়া যায় নি। আচমকা দরজাটা খুলে যেতেই কার থেকে ছিটকে বেরিয়ে পড়ল বাইরে চন্দ্রশেখর। ঠিক সেই মুহুর্তেই বৃদ্ধ বাইরে থেকে সজোরে ঠেলে দিল গাড়ীর ভিতর চন্দ্রশেখরকে। অবাক চোখে দেখল চন্দ্রশেখর বৃদ্ধকে। দেখলেন তার মা-বাবাও। এখানে এসময়েও এই লোক। চন্দ্রশেখরের চিন্তা ছাড়া ওর আর অন্য কোনোও চিন্তা নেই কি। এভাবে ভগবানের চিন্তা করলে, তাঁর ওপর দিনরাত নজর রাখলে সত্যিই মানুষটা ভগবান পেয়ে যেত বোধ হয় এত দিনে। মতিচ্ছন্ন। মানুষের চিন্তা! অন্যের ছেলের চিন্তা! পরের জন্য মাথা ব্যথায় অস্থির মানুষটা। বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠেছিল স্বামী-স্ত্রীর ঠোঁটের ফাঁকে ফাঁকে।
সে রাতে ঘরে ফেরার সময় সেই বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন আবার বৃদ্ধকে ওঁরা। নিজেদের মনেরই প্রতিচ্ছবি দেখলেন কিনা বৃদ্ধের মুখে চোখে-বুঝে উঠতে পারেন নি। বৃদ্ধের সমস্ত মুখখানায় বিদ্রুপের হাসির প্রলেপ পড়েছে।
মা-বাবার বুকের রক্ত জল হয়ে গেছে ভয়ে। বুড়োর অসাধ্য কিছু নেই। প্রত্যেক বারে মরণ ফাঁদ থেকে চন্দ্রশেখরকে উদ্ধার করছে যেমন, তেমনি একদিন মরণ ফাঁদে ফেলেই কেড়ে নিতে পারে ছেলেটাকে ওঁদের কাছ থেকে। সব কিছু পারে বুড়ো। বুড়ো অচেনা নয়। অজানা নয়। কিন্তু ছেলের কাছে বুড়োর বিষয় গোপন করা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই ওঁদের।
বারে বারে মিথ্যে বলতে হয়েছে ছেলের কাছে। বৃদ্ধকে চেনেন না ওরা। ওরকম চেহারার কোনো লোকের সংগে দেখাসাক্ষাৎ হয়নি কখনো। ওটা কোনো দুষ্ট প্রেতাত্মা। ওরা মায়াবী। মানুষকে আকর্ষণ করে। তারা সুখের ঘরে ভাঙন ধরায়। রক্ষার ভান করে মেরে ফেলে মানুষকে।
স্বামী স্ত্রীতে বিচ্ছেদ ঘটায়। পিতাপুত্রে পৃথক করায়। অপরের সুখে গাত্রদাহ ওদের। চিন্তা করা উচিত নয় কারো। চিন্তায় ওরা কাছে এসে হাজির হয় বেশী করে। প্রশ্রয় পায়। ওদের ডাকে কাছে যাওয়া উচিত নয়।
চন্দ্রশেখরের ভয়ের কারণ কিছু নেই। শিবের বরপুত্র সে। যে-সে শিবের নয় আবার। একেবারে দাক্ষিণাত্যের সেরা—সব চেয়ে বড় শিব—তাঞ্জোরের বৃহদীশ্বর লিঙ্গদেবের দোর ধরা সন্তান! বুড়ো প্রেত চন্দ্রশেখরকে বিপদে ফেলতে চেষ্টা করছে বারবার। বৃহদীশ্বরই বুড়োর ঘাড় ধরে, জোর করে বিপদ মুক্ত করিয়ে নিচ্ছেন। ভূতনাথ হাতে থাকলে ভূতের তোয়াক্কা করে কে! আর করা উচিতও না কারো।
কথাগুলো ছেলেকে বোঝাবার পর শেল বিঁধতে থাকে যেন বুকে মা-বাবার। হৃৎপিণ্ড ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেতে থাকে দু’জনার। তাঁদের মতো এত বড় মিথুক বোধ হয় দুনিয়ায় তৃতীয়টি নেই আর। নিজের স্বার্থের খাতিরে ছেলের কাছে এত বড় ধাপ্পা দিতে পারে না নিশ্চয় তাঁদের মতো আর কোনো মা-বাপ। অনুশোচনার আগুন জ্বলতে থাকে স্বামী স্ত্রীর বুকে মাথায়। জ্বলে দিনেরাতে। প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে।
কেউ জানুক না জানুক—তারা জানে বৃদ্ধ কে—বৃদ্ধ কি।
ছোট বেলা থেকেই চন্দ্রশেখরকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় দুশ্চিন্তায় আকাশ ভেঙে পড়ত মা বাবার মাথার ওপর।
তখন বছর আষ্টেক বয়েস চন্দ্রশেখরের। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে নামলেই কেমন একটা আচ্ছন্ন আচ্ছন্ন ভাব আসত যেন। তন্দ্রা নয়, ঘুম নয়। এ অবস্থাটা ওদুটোর একটাতেও পড়ে না। অথচ একটা বিশেষ ধরণের অবস্থা। ঠিক বলে বোঝানো যায় না। ওর শরীরটা থাকত এখানে মন চলে যেত অন্য রাজ্যে। সে সময়টায় বাড়ীর কথা কিছু কানে যেত না। কিছু মনে থাকত না। অন্য রাজ্যের কথা মনে থাকত ওর। অন্য রাজ্য বলতে পৃথিবী ছাড়া নয়। বাড়ী ছাড়া অন্য কোনোখানে।
সে জায়গার সমস্ত নিখুত বর্ণনা দিত চন্দ্রশেখর। গাছপালা ঘরবাড়ী নদী পাহাড়—সবেরই কথা বলত বড় মানুষের মতো বেশ বুঝিয়ে বুঝিয়ে। যেন স্বচক্ষে ও সব দেখে এসেছে। খানিক থেকে এসেছে। সবচেয়ে আশ্চর্য হয়ে যেত বেশী মা বাবা—যখন আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে যাবার পর বলে উঠত—মা। কি সুন্দর ফুলের গন্ধ! কি সুন্দর ধূপের গন্ধ। পাচ্ছ? পাচ্ছ না?
ছেলের এধরণের কথা শুনে, বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে যেতেন মা। কি বলবেন, কি উত্তর দেবেন। কোনো কিছুরই গন্ধসন্ধ পাচ্ছেন না তিনি। নির্বাক মুখে ফ্যাল ফ্যাল করে দেখতেন শুধু ছেলেকে। দেখতেন ওর ভিতর এবং বার। ছেলের কিন্তু মায়ের দেখাদেখির ওপর লক্ষ্য থাকত না কোন। নিজের মনেই বলে যেত চারদিকে ফুল আর ফুল। রঙ বেরঙের ফুলের ছড়াছড়ি। উঁচু একটা মাটির বেদির ওপর সাদা ফুলের আসন পাতা। মাটির বেদিটা আর সিঁড়িগুলো পেঁড়ি মাটির রঙে রাঙানো।
আমি যেতে কত লোক এসে ঘিরে ধরল আমায়। বয়সী লোকেরা ধরে ধরে বেদীতে ওঠাল। বসিয়ে দিয়ে পুষ্প বৃষ্টি করতে লাগল মাথার ওপর। রাশি রাশি ফুলের মালা এসে পড়তে লাগল আমার গলায়। ফুলে ফুলে ডুবে যেতে লাগলুম আমি। ধূপ জ্বলছে আমার সামনে। অনেক ধুপ। খুব ভালো লাগছিল। সুগন্ধে ঘুম আসছিল। ঘুমিয়ে পড়ছিলুম আমি ফুলের ওপর—ফুলের স্তুপে মাথা রেখে।
ছেলের এ স্বর্গীয় আনন্দে আনন্দ পেতেন না মা। এ আনন্দে অশুভের কালো ছায়া দেখতেন যেন। অজানা ত্রাস ঘিরে ধরত তাকে। কথা শুনতে শুনতে সর্ব শরীর কেঁপে উঠত। শোনা যায় শিব সন্ন্যাসীর দেবতা। শিব নিজেও সন্ন্যাসী তবে কি…না, না। তার ধারণা যেন মিথ্যে হয়। মিথ্যে হয়।
তাঞ্জোরে বৃহদীশ্বর লিঙ্গদেবের একপাশে স্ত্রী পার্বতী আর এক-পাশে পুত্র সুব্রহ্মনিয়ামের—কার্তিকের মন্দির! শিব স্ত্রী-পুত্র নিয়ে তো ঘর করছেন। তার আশীর্বাদ নিশ্চয় রয়েছে চন্দ্রশেখরের ওপর। হতেই পারে না চন্দ্রশেখর সন্ন্যাসী হয়ে যাবে সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে। হতে পারে না চন্দ্রশেখরের কল্পনার রাজ্যে ভেসে বেড়ানোটাই ওর ভবিষ্যৎ জীবনের আভাস।
চন্দ্রশেখরের বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আট বছরের ছেলের মুখের কথা ক’টাকে যুক্তিতর্কের কাঁচিতে মনের পাতা থেকে কেটেছেটে বাদ দিতে চেষ্টা করেছেন অনেকবার মা। কিন্তু পারেন নি। ভিতরে এমন একটা দুর্বলতা চেপে বসেছিল তাঁর—তাকে নড়ানোসরানো খুব শক্তব্যাপার। তাই বিশে পড়তেই চন্দ্রশেখরের বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন খুব তিনি।
ছেলে অমত করেছিল প্রথমে বিয়ে করতে। বাপও ছেলের পক্ষই নিয়েছিলেন। আর কিছু দিন যাক না। দেরী হলে ক্ষতি কি? করবে না যে বলছে—তা তো নয়। করবে। আর দিন কতক বাদে।
মায়ের মুখ থেকে সমস্ত রক্ত যেন সরে গেছল। ফ্যাঁকাশে দেখাচ্ছিল। ভেবেছিলেন বাপ-ছেলের অমতটা না কাল হয়ে দাঁড়ায় শেষে। অমতটাই না স্থায়ী হয়ে পড়ে ছেলের জীবনে! উনি সব বুঝে সুজেও অবুঝের মতো কেন যে বেঁফাস কথা কয়ে, নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মেরে বসেন—তা জানেন না তিনি। একে তো বিয়ের নামে মনসা হয়েই আছে ছেলে। তার ওপর কর্তা আবার ওর পক্ষ নিয়ে ধুনোর গন্ধ ছড়ালেন।
অনেক বলেকয়ে কেঁদেকেটে তবে বিয়ে করতে রাজী করিয়েছিলেন ছেলেকে। যে রকম দিনের পর দিন বুকের যন্ত্রণাটা বাড়ছে—তাতে কখন কি হয় কে বলতে পারে। বৌ দেখে যাবার সাধটা অপূর্ণ না থেকে যায় শেষ অবধি। মায়ের চোখের কোণ চিকচিক করে উঠতে হাত দুটো ধরে বলেছিল চন্দ্রশেখর—ব্যবস্থা কর। বিয়ে করবো আমি।
মায়ের চোখের জল টস টস করে ঝরে পড়েছিল চন্দ্রশেখরের হাতের ওপর। মা-কে হাসাবার জন্য বলেছিল, তোমার মনের মতো মন হওয়া চাই কিন্তু বৌয়ের। বিয়ের মতটাকে বাবার কাছ থেকেও পাকাপাকি করে নেবার জন্য চেষ্টা করলেন মা। বাবাকে অনুরোধ করলেন—শেখরের জন্য আমার মনের মতো মেয়ে খুঁজতে গেলে এমনিতেই দেরী হয়ে যাবে যখন, তখন দেরীতে বিয়ে হবার কথা এখন না তোলাই ভালো।
এরপর। মা পাত্রীপর্ব নিয়ে মেনে থাকতে লাগলেন। তাঁর মনের নিরিখে মেয়েদের যাচাই-বাছাই চলতে লাগল। ছেলে না দেখতে চাইলেও মনোনীতদের ছেলের কাছে পছন্দের জন্য পাঠিয়ে দিতেন। গররাজী থেকেও মায়ের নির্দেশ অমান্য করতে পারত না চন্দ্রশেখর। মেয়েদের মনে-চোখে মায়ের স্নেহমাখা চোখ আর ব্যথা বোঝা মন খুঁজে খুঁজে দিশেহারা হয়ে পড়তে লাগল। ব্যর্থতার ক্লান্তি পেয়ে বসতে লাগল ওকে।
মেয়ে দেখাদেখির ব্যাপারে একটা অদ্ভুত পরিস্থিতিতেও পড়তে হত এক এক সময়ে। যখুনি কোন মেয়েকে পছন্দ হবার উপক্রম হয়েছে চন্দ্রশেখরের—তখুনি বৃদ্ধ এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। মা শুনেছেন ছেলের মুখে। মনের সংশয় ঘোচাতে আড়াল থেকে লক্ষ্য রেখেছেন। মিথ্যে বলে নি শেখর। একটা বুকভাঙা নিশ্বাস ফেলে স্বগতোক্তি করেছেন মা—অলক্ষুণে বুড়োটা শুভকাজেও বাধা দিতে আসে নিশ্চয়। মরণ কি নেই ওঁর।
বুড়োর উপদ্রব থেকে নিশ্চিন্ত হতে হলে, খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেওয়া দরকার চন্দ্রশেখরের। মনস্থির করলেন মা-ছেলেকে দিয়ে আর কোন পাত্রী পছন্দ করানোর দরকার নেই। ছেলে তো তার মনের কথা বলেই দিয়েছে। মনোমত ব্যবস্থা মা নিজেই করবে এখন।
দূর সম্পর্কের জ্ঞাতির একমাত্র মেয়ে।
— ষোড়শী সুন্দরী তন্বী বেদবতীর সঙ্গে চন্দ্রশেখরের বিয়ের পাকাপাকি ব্যবস্থা করে ফেললেন মা।
বিয়ের দিন।
নতুন রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে প্রাসাদ পুরী আবার। আসছে আপনজন বন্ধুবান্ধব। আসছে জানাশোনারা। আসছে অনাহুতেরাও। বসন্তরাগ বেজে উঠছে নহবতের বাজনায়। হাসিখুশিতে মশগুল হয়ে উঠেছে মেয়ে মহল ছেলেদের বারবাড়া। আঙিনায় আনন্দের ঢেউ বয়ে চলেছে পরস্পরের প্রীতি বিনিময়ের মধ্যে। ভিতরের আনন্দের ঢেউ গেটের বাইরে দর্শকদের অন্তর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দুলে উঠছে।
সূর্য ডুবু ডুবু হয়েছে। লালচে আভা দেখা দিছে আকাশে। পণ্ডিত জানালেন বাবার কানে কানে—সকলকে শুভযাত্রার জন্যে প্রস্তুত হয়ে থাকতে হবে এবার। কনের বাড়ী যাবার যাত্রালগ্নের সময় হয়ে আসছে। বাবার পাশে দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রশেখর। সুঠাম অঙ্গের সুপুরুষ চন্দ্রশেখরকে বিয়ের পোষাকে মানিয়েছে ভালো। ওর হাসি হাসি মুখখানা বড় সুন্দর দেখাচ্ছে। বন্ধুদের সঙ্গে কথা কইতে কইতে গোলাপী সিল্কের রুমালটায় মুখ মুছছে থেকে থেকে।
ছেলের আশপাশের সমবেতরা শুভযাত্রার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে। তাড়াড়ি বৃহদীশ্বর লিঙ্গদেবের আশীর্বাদী ফুল নিয়ে আসতে ভিতরে দৌড়লেন মা। সংগে দেবেন।
একুশ বছর আগে তাঞ্জোর থেকে এনেছিলেন খুব যত্ন করে। সোনার কৌটোয় পুরে ঠাকুর ঘরে রেখে দিয়েছিলেন। কৌটোটাকে নিত্য সকাল সন্ধ্যায় পূজো করতেন বৃহদীশ্বর লিঙ্গদেবতার উদ্দেশে। তাঞ্জোরে এসে মায়ের অনেক দিনের সাধ মিটেছিল। মনের কথা শুনেছিলেন তাঁর বৃহদীশ্বর।
কৌটোটায় মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন মা। ছেলেকে দেবেন বলে রূপোর সিংহাসন থেকে তুলে নিলেন। দেখছেন কৌটোর দিকে মা। চোখের সামনে ভেসে উঠেছে বৃহদীশ্বরের আড়াইশো ফিট উঁচু পাথরের মন্দিরটা। মন্দিরের ভিতরের গ্ৰেনাইট পাথরের বারোফুট উঁচু বৃহদীশ্বরশিবলিঙ্গ।
একতারার সুর ভেসে আসছে কানে। একটি ভিখিরী মেয়ে নাট মন্দিরের সিঁড়িতে পা ঝুলিয়ে বসে, সুমিষ্ট সুরেলা কণ্ঠে চোখ বুজে গাইছে—’গলে ভুজঙ্গ ভস্মলিঙ্গ শঙ্কর অনুরাগে’—
গান শেষ না হওয়া পর্যন্ত তন্ময় হয়ে শুনলেন মা-বাবা। পাণ্ডা কাছে এসে মন্দিরের ইতিহাস শোনালেন।—বিখ্যাত চোল রাজাদের অক্ষয়কীর্তি এটা। এক হাজার তেইশ খৃষ্টাব্দ থেকে এক হাজার চৌষট্টি খৃষ্টাব্দ—এই দীর্ঘ এক চল্লিশ বছর ধরে মন্দির তৈরী করিয়েছেন রাজা রাজেন্দ্ৰ চোল, রাজেন্দ্র চোল ভারতগৌরব। তিনি ব্রহ্মদেশের কতকটা জয় করেছিলেন। আন্দামান নিকোবর অবধি রাজ্য বিস্তার করেছিলেন।
উপযুক্ত বাপ-মার উপযুক্ত সন্তান।
পাণ্ডার কথায় মায়ের ভিতরটায় বোবাকান্না দাপাদাপি করতে লাগল। ছেলের মতো ছেলে। এরকম ছেলের মা কত ভাগ্যবতী। তাঁর কি একটা এরকম ছেলে হওয়া অসম্ভব। জমাব্যথা গলে গলে মায়ের দু’চোখের কোণ ঠেলে বেরিয়ে আসতে লাগল। অঝোরে ঝরে ঝরে পড়ছে চোখের জল। চোখের জলেই মনে মনে পূজো করলেন মন্দিরে দেবতাকে। পুরোহিত এসে মায়ের হাতে দেবতার নির্মাল্য তুলে দিয়ে গেলেন।
নির্মাল্য মাথায় ঠেকিয়ে কর্তার মাথায় ঠেকাবেন বলে পিছন ফিরতেই দেখলেন, এক পরিব্রাজক সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে রয়েছেন কর্তার পাশে। হাসছেন তিনি। চোখে মুখে হাসি উপচে পড়ছে। অবাক লাগল। কান্না দেখে এত হাসি। সন্ন্যাসীর কি কারো মর্মব্যথা বুঝতে নেই।
মনের কথা তার মনের কানে নিশ্চয় শুনতে পেয়েছিলেন। সন্ন্যাসী হাসতে হাসতেই বলেছিলেন, এরকম মায়ের একটা ভালো ছেলে দরকার। আমারই ইচ্ছে করছে আদর্শ মায়ের আদর খাবার জন্য মরে গিয়ে তোমাদের কাছে আসি আর একবার।
মা দেখছেন একদৃষ্টে। সন্ন্যাসী বলে কি মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এইভাবে খোঁচা দিয়ে কথা কইতে হবে।
খোঁচা আমি দিই নি মা। সন্ন্যাসীর গম্ভীর গলা। গম্ভীর মুখ। সত্যি কথাই বলেছি। একটু চুপ করে থেকে কিছু একটা ভেবে নিলেন যেন। চোখ দুটো বড় বড় করে মায়ের দু’চোখ দেখলেন। তারপর বললেন, ছেলে হবে। নিশ্চয়ই হবে। তবে একটা শর্ত-
অফুরন্ত আনন্দের অনুভূতি শিহরণ জাগিয়ে তুলছে মায়ের সর্বশরীরে। মুখ দিয়ে কষ বেরুচ্ছে না। চোখ দিয়ে জল ঝরছে শুধু! ছেলে হবে। যে কোন শর্তই থাকুক না কেন—মেনে নিতে প্রস্তুত মা ছেলের বদলে।
শর্ত শোনবার জন্য মা উদ্গ্রীব। সন্ন্যাসীর মুখের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছেন।
শর্ত শোনালেন সন্ন্যাসী। যে ছেলে আসবে সে সংসারের জন্য নয়। রাজী? কড়া জিজ্ঞাসা সন্ন্যাসীর।
যে জন্যই আসুক—তবু আসবে তো। ঘাড় নাড়লেন মা। রাজী। জবাবটা শোনবার জন্যই যেন অপেক্ষা করেছিলেন সন্ন্যাসী। জবাব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দ্রুত পায়ে চলে গেলেন সেখান থেকে।
জোড়হাত করে সন্ন্যাসীর উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাতে গিয়ে, কৌটো পড়ার আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেলেন মা। নিজের অগোচরেই হাতের মুঠোটা খুলে ফেলেছিলেন তিনি। বুকের ভিতর ধড়াস করে উঠল মেঝের দিকে তাকিয়ে। কৌটোর ঢাকনি খোলা। শ্বেতপাথরের মেঝেয় পড়ে আছে বৃহদীশ্বরের নির্মাল্য—শুকনো বেলপাতা—ফুল।
সযত্নে কুড়িয়ে নিয়ে কৌটোয় পুরলেন আবার। চোখের জলে প্রার্থনা জানালেন মা।—ঠাকুর ক্ষমা কর! শেখরকে সুখী কর।
তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলেন ঠাকুর ঘর থেকে। কৌটোটা বুকে আঁকড়ে ধরে রয়েছেন। পাছে পড়ে যায়। চন্দ্রশেখরের কাছে এলেন। ছেলের কপালে ঠেকিয়ে, আচকানের পকেটে রেখে দিলেন কৌটোটা। ছেলেকে হুঁশিয়ার করে দিলেন—দেখো যেন হারায় না!
শুভলগ্ন উপস্থিত।
বর বেরুবে এবার। উৎসবমুখর প্রাসাদে আচমকা বাজ পড়ল যেন। পড়ল মা-বাপের মাথায়ও। চোখকে অবিশ্বাস করতে ইছে করছে ওদের। মনে বলছেন, না, না—এ হতে পারে না কখনো। এ হতে পরে না কখনো। সশরীরে আসতে পারে না। এতদিন আসতেন রক্ত মাংসের দেহ নিয়ে নয়। আসতেন সূক্ষ্মশরীরে। এ সময়েও বা তার ব্যতিক্রম ঘটবে কেন?
কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটছে। প্রকৃতই এগিয়ে আসছে বৃদ্ধ—তাঞ্জোরের সেই পরিব্রাজক সন্ন্যাসী। যাকে এতদিন গোপন করে রেখেছিলেন মা চন্দ্রশেখরের কাছে। এগিয়ে এলেন তিনি। চন্দ্রশেখরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। চোখাচোখি হল দু’জনের।
মায়ের ভীরুমন অনুনয় করতে লাগল সন্ন্যাসীকে মনে মনে।
ওর শুভলগ্নে বাধা দেবেন না দয়া করে। আশীৰ্বাদ করুন-শেখর সুখী হোক।
পিছু ফিরলেন সন্ন্যাসী।
এগুতে লাগলেন সামনের দিকে। অনুসরণ করে চলল চন্দ্রশেখর।
মায়ের ভিতরে ঘূর্ণিঝড় বইতে লাগল। ঝড়ের মধ্যে থেকেই সন্ন্যাসীর অনেক আগের বলা কথার প্রতিধ্বনি শুনতে লাগলেন মা। …সংসারের জন্য নয়।
অস্ফুটে মায়ের মুখ দিয়েও বেরিয়ে এলো—সংসারের জন্য নয় শেখর।