জাফরি ঘেরা বারান্দার ভিতর থেকেই দেখল মানুষটাকে উর্মিলা।
মানুষটার অপলক চোখের চাউনি দোতলার বারান্দায় নয় কেবল, পুরনো ঝরঝরে বাড়ীটার হাড়-পাঁজরা ভেদ করে যেন কোথায় গিয়ে আটকে পড়ছে মাঝে মাঝে। জাফরির এক ফাঁকে চোখ সরিয়ে সরিয়ে দেখেছে।
ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছে না। এ কে—কেন এখানে? কেন অনুসরণ করে চলেছে তাকে? এ বাড়ীতে তো আর ক’টা দিন আছে মাত্র ঊর্মিলারা। এরকম সময় এমন লোকের হঠাৎ আবির্ভাবে কেমন অস্বস্তি বোধ করছে।
অবাক হয়ে যাচ্ছে। রাস্তা পেরুবার চেষ্টা করছে লোকটা। ডাইনে বাঁয়ে ঘাড় ফিরিয়ে গাড়ীগুলোর গতিপথ দেখে নিল ভালো করে। এগুচ্ছে সামনের দিকে। ঊর্মিলাদের বাড়ীর দিকে।
বারান্দা থেকে চলে এলো উর্মিলা ঘরের ভিতর।
পা ঝুলিয়ে বসল চারপাই-এর ওপর। জাফরির দিকে চোখ ফেরাল। লোকটা আসবে সদর দরজা পর্যন্ত। বন্ধ দরজা দেখে ফিরে যায়, না কড়া নেড়ে কাছে ডাকে বাসিন্দাদের—সেটাই দেখবার বিষয়। ডাকলে নীচে নামবে। দুঃসাহসী লোকটার মোকাবিলা করতে পিছপা হবে না একটুও।
উর্মিলার ভিতরে সংশয়ের দানা বাঁধছে লোকটাকে ঘিরে। যদি সত্যিই কোন কাজ থাকত তার কাছে ওর, তাহলে অনেক সময়ই পেয়েছিল জানাবার। জানায় নি। যখুনি সুযোগ পেয়েছে তখুনি বোকা বোকা মুখ করে তাকিয়ে থেকেছে স্রেফ তার দিকে আর পিছু পিছু ঘুরেছে বাড়ী না আসা অবধি।
এই দেখা আর ঘোরা পর্ব চলছে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক ধরে। বাড়ী থেকে বেরুবার একটু পরেই। মাকে নিয়ে উর্মিলা টাঙায় চেপে চলেছিল গঙ্গা-যমুনা সঙ্গমে। বোশেখী পূর্ণিমায় মুণ্ডন করবে মা। পথে সামনাসামনি টাঙায় দেখা লোকটার সঙ্গে। ওর টাঙা আসছিল, ঊর্মিলাদের যাচ্ছিল।
উর্মিলাকে দেখেই চেয়ে রইল। চোখ আর ফেরায় না। পলক আর পড়ে না। এ এক বিড়ম্বনা। পাশ কাটিয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে আদেশ করল ঊর্মিলা সইসকে। লোকটাও তার সইসকে গাড়ীর মুখ ঘোরাতে বলল।
উর্মিলাদের সঙ্গম মুখো গাড়ীটা ছুটছে। নাগাল পাচ্ছে না পিছনের টাঙাটা। পাল্লা দিয়ে চালাবার জন্য সইসকে উত্তেজিত করে তুলল লোকটা।
— বুড্ডে ঘোড়ে, বাচ্চে সইস, টুট হুয়ি গাড়ী। জো হোনেক হ্যাঁয় উয় হোতা।
সইস সওয়ারীর বিদ্রুপ সইতে না পেরে ঘোডার পেটে সজোরে একটা লাথি মেরে বসল। দ্বিগুণ বেগে ছুটতে লাগল ঘোড়াটা। এলোমেলো চলছে টাঙা। সাইকেলরিক্সাটা তড়িঘড়ি পাশের রাস্তা না ধরে ফেললে সংঘর্ষ ঘটতে দেরী হত না একটুও।
পথচারী সওয়ার আর অন্য সইসদের বাক্যবাণের বর্ষণ চলতে লাগল ছোট সইসের ওপর।
প্রাণপণে আলগা লাগাম টেনে ধরল সে। মন্থর হল গাড়ির গতি। উর্মিলাদের গাড়ীর বরাবর চলছে এবার। উর্মিলা শুনতে পাচ্ছে সওয়ারীর গলা।—ঠিকসে চলো! নহী তো খোপরী তোড় দুঙ্গা।
ফিরে তাকাল ঊর্মিলা। চোখাচোখি হ’ল সওয়ারির সঙ্গে। মুখে বকছে সইসকে। সইসের মাথা ভাঙছে বটে, কিন্তু তার দিক থেকে দু’চোখের নড়চড় দেখতে পাচ্ছে না একচুলও।
ভালো লাগছে না মানুষটাকে। কেবলি মনে হচ্ছে একটা আপদ বুঝি পিছু নিয়েছে, বিষম অনর্থ ঘটবে বলে দুর্ভাগ্য আসে না একা। অনেক সঙ্গী-সাথী নিয়ে আসে।
উর্মিলা এক নিদারুণ বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে চলছে। পিতৃভিটে ছাড়তে হবে মনে হ’লে, হৃৎপিণ্ডটাকে যেন পিষে ফিলতে থাকে কে। কিন্তু তবুও ছাড়তে হবেই। এই ভিটের মাটির সঙ্গে প্রাণ মন মিশে আছে তার। ভাঙা নড়বড়ে বলে পাথরের বাড়ীটা মায়ের মতোই দু’হাত বাড়িয়ে বুকে আঁকড়ে ধরেছিল এতদিন। সে-ও একদিন গেছে, আবারো আর একটা ভয়ঙ্কর দিন এগিয়ে আসছে তার সামনে। পথে দাঁড়ানোর দিন!
‘শিল্পায়ন’ করতে নেমে, অনেক ঝড়ঝাপটা সহ্য করতে হয়েছে তাকে। অনেক রকম মনের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে হয়েছে। দেখেছে যেমন, চিনেছেও তেমন অনেককে।
এসেছে অশুভ বুদ্ধির মানুষ। লালসার শ্যেনদৃষ্টি দিয়ে দেখেছে তাকে। তার রূপযৌবনের মহিমা কীর্তন করেছে পঞ্চমুখে। উপদেশ দিয়েছে কারো ঘরনী হ’তে, ভিক্ষুনী হ’তে নয়। ভিক্ষে-দুঃখু করে ‘শিল্পায়ন’ চালাবার ব্যর্থ আশা মনে পুষে না রাখাই ভালো।
উর্মিলা দেখেছে উপদেষ্টাকে বড় বড় চোখ করে। শুনেছে তার কথা নির্বাক মুখে। তারপর দু’চোখের আগুন আগন্তুকের সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে দিয়ে উঠে চলে গেছে।
অপমান-অগ্রাহ্যের আগুনের জ্বালায় ছটপট করে উঠেছে আগন্তুক। জ্বালা উপশমের জন্য ঊর্মিলার সুনামে দুর্নামের কালি ছিটতে বিবেকে বাধেনি একবারের জন্যও।
এরকম ঘটনা একটা আধটা নয়—ঊর্মিলার এই তিরিশ একতিরিশ বছর বয়েসের ভিতর বহু ঘটেছে। কোন প্ররোচনাই তাকে টলাতে পারে নি। তার ‘শিল্পায়ন’কেও নড়াতে পারেনি।
অতি বড় শত্রুকেও অনেক সময় বলতে শোনা গেছে—উর্মিলা সাঙ্ঘাতিক শক্ত মনের মেয়ে। মন দেখার চোখ থাকলে দেখা যেত, ইস্পাত দিয়ে তৈরী ওর মন। এ অপবাদটা উর্মিলার পক্ষে আশীর্বাদ। অবিশ্যি আপনজনের কাছে তাই বলে হেসে কুটি কুটি হত। তবু কাছে কেউ আসবে না আর মন নরম করতে।
‘শিল্পায়নে’ কেউ উৎসাহ দেয় নি, কেউ সহায়তা করে নি বললে সত্যের অপলাপ করাই হবে। উৎসাহ দিয়েছে অনেক বাড়ির গিন্নীরা। সহায়তা করেছে অনেক কর্তা-গিন্নী—দু’জনে মিলে মেয়েদের ছুঁচের কাজ শেখাতে পাঠিয়ে দিয়েছে উর্মিলার কাছে মাসের পর মাস। অভিভাবক-অভিভাবিকাদের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেছে ঊর্মিলা, পরিশ্রমের বিনিময়ে মাইনেটাই মস্তবড় সাহায্য। এতেই ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠবে তার শিশু প্রতিষ্ঠান একদিন না একদিন।
বড় হয়ে উঠছিল বেশ। হঠাৎ ভেঙে গেল মাঝ পথে ঊর্মিলার স্বপ্নের সৌধ। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল উর্মিলা।
উর্মিলার সীমার মধ্যে যারা ধরা ছিল, তাদের সকলেরই হৃদয়ে শ্রদ্ধার আসন করে নিয়েছিল। তার স্বপ্ন ভেঙে যেতে, অন্য বিয়ের সাহায্য করতে পারে নি অনেকে নিজেদের অক্ষমতার দরুণ। তবুও চোখের জলের অর্ঘ দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে কৃপণতা করে নি কেউ।
এটাও হয়তো চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে অতীতের মত-বিরোধী আকাঙ্ক্ষিতদের ভিতর কারো কারো। হয়তো এদেরই মধ্যে থেকেই কেউ না কেউ লোকটাকে এই ভাবে অনুসরণ করে চলতে নির্দেশ দিয়েছে। চোখে চোখে রেখো ঊর্মিলাকে। একেবারে নজরবন্দী। লোকচক্ষে হেয় প্রতিপন্ন হবে উর্মিলা তা হলে। এতদিনের অবহেলা আর অসম্মান করার ফল বুঝতে পারবে মর্মে মর্মে।
লোকটার হাবভাবে সেই ইঙ্গিতই পাচ্ছে যেন। রাগে ফুঁসছে উর্মিলা। মনে হচ্ছে সইসের হাত থেকে চাবুকটা কেড়ে নিয়ে লোকটার পিঠের ছাল-চামড়া তুলে দেয় একেবারে। চাবুকের বাঁটের খোঁচায় দু’চোখ গেলে দিয়ে দেখার আশা মেটায়।
ঊর্মিলার মুখখানা ভয়ানক গম্ভীর হয়ে উঠল। লোকটার দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাল। ঘৃণাবিদ্বেষ তোলপাড় করছে ভিতরে। আত্ম-সম্ভ্রম বজায় রাখতে জানে সে ভালো করে। মর্যাদার ভিতে ফাটল ধরাতে দেবে না কাউকে জীবন থাকতে।
মর্যাদার লড়াইয়ে হার মানতে চায় নি বলেই শ্বশুর বাড়ীর সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয়েছিল এক সময়। শাশুড়ী দেওর অনেক অনুরোধ উপরোধ করেছিল থাকতে। থাকে নি উর্মিলা। রাতদুপুরে স্বামীর হাত ধরে বেরিয়ে এসেছিল বাড়ী থেকে।
মদের নেশায় মত্ত অবস্থা তখন স্বামীর। কথা এড়িয়ে যাচ্ছে। সর্বশরীর টলছে। দেহের অনেক জায়গায় ক্ষত হয়ে গিয়ে রক্ত ঝরছে। মেরেছে দেওর, মেরেছে শ্বশুর। মায় দারোয়ান পর্যন্ত বাদ যায়নি ওর গায়ে হাত তুলতে। একটা বিবেক-মৃত অবস্থার লোকের ওপর কি অমানুষিক অত্যাচার না করল সেদিন বিবেকবানেরা।
এতটা দাঁড়াবে ধারণার বাইরে ছিল তার। কিছুটাও আভাস যদি পেত আগে, তা হলে সবার বারণ সত্ত্বেও, নিজের জিদ বজায় রাখবার জন্য লখিয়াবাই-এর বাড়ীতে গিয়ে উপস্থিত হত না কখনো।
শ্বশুর বারণ করেছিল, দরকার নেই বৌমা। জাহান্নামে যাক ও। ও নোংরা পাড়ায় যাওয়া তোমার উচিত হবে না। এ ঘরের বৌ হয়ে বিশেষ করে ওখানে…মান ইজ্জতের ব্যাপার এটাই।
মান ইজ্জতের ব্যাপার এটাই—ওকে ওখান থেকে সরিয়ে আনা বেলেল্লাপনা করতে আর না দেওয়া। শ্বশুরের মুখের ওপর বলেছিল উর্মিলা।
উর্মিলার মাথায় একটা পাগল জিদ চেপে গেছল সে সময়। জিদটা দিনে দিনে পরিপুষ্টি লাভ করেছে। আর সেটা হয়েছে শ্বশুরের বিমর্ষ মুখ দেখে দেখে।
শ্বশুর ঘরে এনেছিল তাকে অনেক আশায় বুক বেঁধে। শ্বশুরের মুখের দিকে তাকালেই মনে পড়ত কেবল আগেকার কথাগুলো।
কনে দেখতে এসেছে শ্বশুর। উর্মিলাকে দেখে সাক্ষাৎ মেনকার মেয়ে গৌরীকেই দেখল একেবারে! আনন্দে সকলের সামনেই বলে উঠল—এই মেয়েই ফেরাতে পারবে আমার কুন্দনলালকে। তবে হ্যাঁ, কুন্দনলাল মহাদেব নয়। মহাপাতক সে। দুটো ছেলে মরে যাবার পর ও। তাই শতসহস্র দোষ ওর চোখ বুঝে উপেক্ষা করেছে গিন্নী। বলেছে, দস্যি দুষ্ট হয়ে বাঁচে যদি বাঁচুক কুন্দন।
গিন্নীর প্রশ্রয়ে প্রশ্রয়ে পাষণ্ড হয়ে উঠেছে কুন্দন। বেপরোয়া বেহায়া বড় হলে স্বভাব শোধরাবে ভেবেছিল হিতাকাঙ্ক্ষীরা। কিন্তু ফল দেখা গেল উল্টো, স্বভাব তো শুধরোয়নি-ই বরং বেড়েছে আরো। নানা উপসর্গও দেখা দিয়েছে। বাইজী আর মদের নেশায় বিবেক পর্যন্ত হারিয়েছে। গিন্নী সব জেনে শুনেও, ছেলেকে মৃত্যুমুখ থেকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য নাকি লুকিয়ে চুরিয়ে, টাকা দিয়ে দিয়ে ওর অপকর্মের ইন্ধন যুগিয়ে আসছে। প্রতিবাদ করলে একেবারে মোক্ষম যুক্তি। ওকে যদি সবাই ঘেন্না করে, তাহলে স্বয়ং যমও দু’চক্ষে দেখতে পারবে না। গা ঘিন ঘিন করে সে নিজেই মরবে। ও আমাদের ঘরজোড়া করে বেঁচে থাকবে।
মাকে ছেলের গুণকাহিনী শুনিয়ে, জিজ্ঞেস করেছিল শ্বশুর—নিছক মেয়ের ভাগ্য পরীক্ষা করার জন্য এই ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজী আছে কি না।
জবাব দিয়েছিল মা। এরকম সরল বাপের ছেলে কি খারাপ হতে পারে কখনো? খারাপ হলেও, বেশীদিন থাকে না। সাবিত্রী যদি বুদ্ধির জোরে মরা স্বামীকে যমের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসতে পারে, ঊর্মিলা একটা উচ্ছৃঙ্খল স্বামীকে বশে আনতে পারবে না নিজের বুদ্ধির জোরে?
এক মুখ হেসে বলেছিল শ্বশুর। সেই আশায় তো আসা। উর্মিলার চিবুক ধরে, আদর করে প্রশ্ন করেছিল, কি গো মা পারবে না?
কথা না কয়ে মুখ টিপে হেসেছিল শুধু অষ্টাদশী সুন্দরী উর্মিলা।
ছেলেকে ঘরমুখো করার জন্য সব বিষয়েই স্বাধীনতা দিয়েছিল শ্বশুর উর্মিলাকে।
স্বাধীনতার অপব্যবহার করেনি একটুও উর্মিলা। স্বামীকে অনুনয় বিনয় করেছে রাতে বাড়ী থাকতে। রুখতে পারে নি। ব্যর্থ হয়েছে চেষ্টা। আহার নিদ্রা ত্যাগ করে প্রতিদিন জানলার ধারে বসে বসে দু’চোখের জলে বুক ভাসিয়েছে কেবল নিজেরই। স্বামীর অন্তর গলাতে পারে নি এক মুহূর্তের জন্যও। পাষাণ মনকে টেনে আনতে পারেনি তার দিকে। বুঝেছে এ মানুষকে এসবে আটকানো যাবে না। এতদিন ধরে পণ্ডশ্রম হয়েছে শুধু তার। অন্যপন্থা অবলম্বন করেছে।
বেরুবার সময় সামনে দাঁড়িয়েছে। পথ আটকেছে। যেতে দেবে না। ঠেলে সরিয়ে দিয়ে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেছে কুন্দন। এই ভাবে রোজ পথরোধ করায় হাতাহাতি পর্যন্ত হয়ে গেছে দু’জনের ভিতর। তবু কুন্দনকে বশে আনতে পারে নি উর্মিলা।
শ্বশুরের মুখের হাসি শুকিয়েছে। ঊর্মিলার সঙ্গে দেখা হলে মলিন মুখ আরো মলিন হয়ে ওঠে। বুকভাঙা দীর্ঘনিশ্বাস ঝরে পড়ে। ঊর্মিলার ভিতরে হাহাকার করে ওঠে।
আপসোস করে বহুবার বলেছে শ্বশুর, নিজের ছেলেকে ফেরাতে গিয়ে, একটা মায়ের মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিলুম নিজে হাতে। এর প্রায়শ্চিত্ত কি করে হবে আমার!
সান্ত্বনার শান্তিবারি ছিটতে চেষ্টা করেছে উর্মিলা শ্বশুরের মাথায়। বাবুজী প্রায়শ্চিত্ত করতেই বা যাবে কেন অকারণে। অপরাধী উর্মিলা। যদি কাউকে প্রায়শ্চিত্ত করতেই হয়, তা ঊর্মিলাকেই করতে হবে। সাবিত্রীর মতো বুদ্ধির জোর কোথায় তার? মনে পড়ে যেত মায়ের কথা। সাবিত্রী যদি বুদ্ধির জোরে মরা স্বামীকে…নিয়ে আসতে পারে। উচ্ছৃঙ্খল স্বামীকে বশে নিজের বুদ্ধির জোরে? শ্বশুরের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের কথাও কানে ভেসে আসত। কি গো মা পারবে না?
উর্মিলার ঘা খাওয়া মন কেমন যেন চনমনে হয়ে উঠত। হতাশায় ঝিমিয়ে পড়া মন যে হঠাৎ এত জোরাল হয়ে উঠত কোথা থেকে বুঝতে পারত না। মাথার মধ্যে একটা কথাই খালি ঘুরপাক খেত। পারবে। নিশ্চয়ই পারবে।
শেষ চেষ্টা ঊর্মিলার। মন্ত্র সাধন কি শরীর পতন। সব হয়ে গেছে তার। লখিয়াবাই-এর বাড়ী যাওয়াটাই বাকি শুধু।
লখিয়াবাই-এর বাড়ী থেকে তুলে আনবে তার স্বামীকে। না পারলে আত্মঘাতী হবে সে। আপত্তি সত্বেও জিদে অচল অটল দেখে, মত দিয়েছিল শ্বশুর বাধ্য হয়ে।
গেছল লখিয়াবাই-এর বাড়ীতে ঊর্মিলা।
লাল ফরাশের ওপর তাকিয়া ঠেসান দিয়ে বসে আছে লখিয়াবাই-এর গুণমুগ্ধরা। সারেঙ্গীর সুরে গলা মিলিয়ে গাইছে লখিয়াবাই। কিধার হ্যাঁয় তেরে দিল, কিধার জা রহে হ্যাঁয়… কোথা থেকে আসে অন্তর তোমার ফিরে যায় কোথায় আবার, যেথা থেকে আসে লাঞ্ছনা সয়ে—ফিরে যেতে চায় সেথা আবার। শ্রোতার দল মাথা দোলাতে দোলাতে বাহবা দিচ্ছে জড়ানো কথায়। কুন্দন চোখ বুজে মুখ বুজে দুলছে খুব। এও এক ধরনের গানের তারিফ করা হয়তো।
সাদা সিল্কের ওড়নায় আপাদমস্তক ঢাকা উর্মিলার। দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে সব। পাতলা ওড়নার ভিতর দিয়ে দেখছে লখিয়াবাইকে। দেখছে কুন্দনকে। নিজের ভাবে এত বিভোর ওরা, উর্মিলার দিকে কোনো লক্ষ্য নেই। লক্ষ্য পড়ল সামনের দিকে মুখ ফেরাতে লখিয়াবাই-এর।
ঝাড়লণ্ঠনের আলোয় লখিয়াবাই-এর হীরের নাকছাবিটা ঝকমক করে উঠল। নানা রঙের আলো ঠিকরে ঠিকরে পড়তে লাগল উর্মিলার ওড়না ঢাকা মুখে।
এগিয়ে এলো লখিয়াবাই-এর সামনে উর্মিলা। আত্মপরিচয় দিয়ে, দৃঢ়কণ্ঠে জানাল, সে তার স্বামীকে নিয়ে যাবে এখনি থেকে এখুনি। সুরের রাজ্য থেকে অসুরের রাজ্য নেমে পড়ল লখিয়াবাই সঙ্গে সঙ্গে। যে মেয়ে এসে তার সুরের ছন্দ কেটে দিয়েছে মাঝপথে, সে ক্ষমার অযোগ্য লখিয়াবাই-এর কাছে। তাকে আর দেরী না করে গলা ধাক্কা দিয়ে ঘরের বাইরে, বাড়ীর বাইরে বার করে দেওয়া উচিত।
মুখ থেকে কথা খসবার সঙ্গে সঙ্গে লখিয়াবাই-এর অনুচররা এগিয়ে এলো উর্মিলার কাছে। অনেক কটুকাটব্য করল তারা উর্মিলাকে। রাতে যে মেয়ে এখানে আসে, সে কেমন ধারা তা আর বুঝতে বাকি আছে নাকি কারো। বেশ তো মুখের ওড়নাটা সরিয়ে দেখলেই সব ঝামেলা চুকে যায়। সুন্দরী হলে থাক। নইলে দূর করে দেওয়া হোক। রাগে ঠক ঠক করে কাঁপছে উর্মিলা। তীব্র তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল –ওড়না খুলতে হয় ওই ভদ্রলোককে বলুন না। ওর দু’চোখে জলের ছিটে দিয়ে ঝিমুনিটা কাটিয়ে দিন না।
পাশ থেকে একজন টিপ্পনী কাটল–ওরে বাব্বা! গলার জোর আছে বেশ। রোখ দেখ না! কুন্দনকেই চায় ও। ভালো ভালো। পছন্দসই মানুষ বটে কুন্দন। তাছাড়া আমীরওমরহ লোকও তো বটে।
ওড়নাঢাকার ভিতরে দু’হাত নিশপিশ করে উঠছে উর্মিলার। লোকটার গালে কষে চড় বসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।
কুন্দনকে আসতে দেখে, সংযত করে নিল নিজেকে। একজন টেনে নিয়ে আসছে ওকে।
কাছে এসে মুখের ওড়না খুলে দিয়েই হতভম্ব হয়ে গেল কুন্দন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল খানিক। ভালো করে চোখ রগড়ে রগড়ে দেখল। ভুল দেখছে কি ঠিক দেখছে। তারপর উর্মিলার ডান হাতখানা সজোরে চেপে টেনে নিয়ে চলল বাইরে।
বাড়ী এসে তুলকালাম করেছে বাবার সঙ্গে, ভায়ের সঙ্গে, উর্মিলার সঙ্গে। কেন ঘরের বৌ বাইরে যাবে। সবাইকে দেখে নেবে সে। বাপ-ভাই বৌকে ভোরে উঠে আর দেখতে পাবে না কেউ।
শাসানিটা যদি স্রেফ মুখের কথাতেই আটকে থাকত তাহলে কোন গণ্ডগোলই বাধত না আর। দুহাতে উর্মিলার গলা চেপে ধরল কুন্দন। শেষ না করে ছাড়বে না। এগিয়ে এলো ছাড়াতে শ্বশুর। এগিয়ে এলে দেওর। উর্মিলাকে ছাড়াবার জন্য, বাঁচাবার জন্য একটুও ইতস্তত করে নি যেখানে সেখানে আঘাত করতে কুন্দনকে। কুন্দন ছেড়েছে উর্মিলাকে। দারোয়ান দিয়ে বার করে দিয়েছে শ্বশুর ছেলেকে।
এক এক করে শ্বশুরের দেওয়া সমস্ত গয়না খুলে ফেলেছে ঊর্মিলা। তারপর খোলা গয়না আর তোলা গয়নার বাক্সটা সুদ্ধ, শ্বশুরের পায়ের কাছে ধরে দিয়ে প্রণাম করে এক কাপড়ে বেরিয়ে গেছে বাড়ী থেকে। স্বামীর হাত ধরে লক্ষ্ণৌ থেকে এলাহাবাদে মায়ের কাছে এসে উঠেছে।
ছেলেকে ছাড়তে চেয়েছিল শ্বশুর চিরকালের জন্য। কিন্তু ছেলের বৌকে ধরে রাখতে চেয়েছিল বরাবরের জন্য। বলেছিল, বৌমা! ও যাক! তুমি আমায় ছেড়ে যেও না।
কান্নাভেজা গলায় বলেছে উর্মিলা, যেখানে দরোয়ান দিয়ে মারতে মারতে বার করে দেওয়া হয়েছে ওকে—সেখানে তাকেও ওই সঙ্গে ওই ভাবে বার করে দেওয়া হয়ে গেছেই।
শ্বশুর বাড়ী ছেড়ে চলে এলেও, ঊর্মিলার সাধনা যে সার্থক হয়েছে একথা বলতেই হবে। স্বামীকে কাছে চেয়েছিল, পেয়েছে। স্বামীর মন-আত্মা ওর মন-আত্মীয় বাঁধা পড়েছে। সুরা ছেড়েছে স্বামী ছেড়েছে লখিয়াবাই-এর সুখ স্বপ্নের নেশাও। ঊর্মিলাকে না দেখতে পেলেই দিশেহারা হয়ে পড়ে।
উর্মিলা কিন্তু স্বামীকে দেখেই দিশেহারা হয়ে পড়েছিল একদিন হঠাৎ। স্বামীর দিকে ভালো করে লক্ষ্য করতে বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল। কষ্টিপাথরের মতো কালো মানুষটা সাদাটে হয়ে গেছে যেন। ধার কর্জ করে ডাক্তার বৈদ্য দেখিয়েছে। রক্ত শূন্যতা অসুখ সারাতে পারেনি। বাবাকে জানাবার জন্য বলেছে কুন্দনকে। রাজী হয়নি ও। বরং রেগে গিয়ে দু’কথা শুনিয়ে দিয়েছে। তুমি দেখতে পারো দেখবে। না পারলে স্পষ্ট বলে দেবে। যেখানে দু’চোখ যায় চলে যাবো।
চলে যেতে দেয়নি কোথাও ঊর্মিলা কুন্দনকে। সেবা যত্ন চিকিৎসায় ক্রটি করেনি কোনদিন ওর! বাপের কোন সাহায্য নেবে না ছেলে মরে গেলেও—শুনে এগিয়ে এসেছে জামাই-এর জন্য মা-ও। নিজের একমাত্র সম্বল ভাঙা বাড়ীটাও বন্ধক দিয়ে টাকা যোগাড় করেছে জামাই-এর চিকিৎসা পথ্যের জন্য। ছুঁচসুতোর যাদুতে জামা কাপড়ের ওপর রঙ বেরঙের বিচিত্র নক্সা তুলে মেয়েদের নক্সার কাজ শিখিয়ে যা পেয়েছে মা-মেয়ে, নিজেরা পেটে না খেয়ে সব ঢেলেছে কুন্দনকে বাঁচতে।
বাপের বাড়ী আসা থেকেই মাঝে মাঝে শ্বশুর খরাখবর নিত। ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছে ছেলে-বৌকে। ওদের না যাবার ধনুকভাঙা পণ থেকে একপাও সরাতে পারে নি। অসুখ বাড়াবাড়ি হতে, মা-বাবা-ভাই এসেছে। ওদের দেখে মুখ ফিরিয়ে শুয়েছে কুন্দন।
এই ভাবেই সবার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে উর্মিলার চোখে চোখ রেখে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল কুন্দন একদিন। দু’বছরে মধ্যেই বিধিলিপির নির্মম কশাঘাতে স্বামী সোহাগিনীর সোহাগন-এয়োতীর চিহ্ন মুছে গেল।
শ্বশুর-শাশুড়ীর অনেক অনুরোধ উপরোধ সত্ত্বেও, এরপর আর ফিরে যেতে চায়নি উর্মিলা। জোড় হাত করে, বিনয়ের সুরে বলেছে, এখানে ও গেছে। এ ভিটে ছেড়ে কোথাও যাবো না আমি।
বিব্রত বোধ করেছে শ্বশুর! ভেবেছে, যেতে বলে ঊর্মিলার মর্মস্থানে আঘাত দিয়ে ফেলেছে। ধরা গলায় বলেছে, ঠিক আছে বেটী। ঠিক আছে। ভিটে ছেড়ে যেতে হয়নি উর্মিলাকে। ছেলে থাকতে যেমন আসত শ্বশুর, ছেলে চলে যাবার পরও সে ভাবটা বজায় রেখেছিল মাঝে মাঝে এসে। মেয়েদের শেখানো দেখেছে কতদিন ঊর্মিলার পাশে বসে বসে। খুশী হয়েছে খুব। শ্বশুরের খুশীর ছায়া তারও মুখে ফুটে উঠেছে। মন বুঝে কথা তুলেছে শশুর। যখের ধন আগলে আর বসে থাকতে পারছে না। কেবলি মনে হচ্ছে, বেশীদিন বাঁচবে না বুঝি। উর্মিলাকে দেওয়া গয়না উর্মিলারই প্রাপ্য। আর কারো নয়।
হাসতে হাসতে বলেছে উর্মিলা, বাবুজী, কিছু চাইনে আমি। তোমার আশীর্বাদই আমার গয়না ঐশ্বর্য সব কিছু।
শিল্পায়নের নাম করেও অর্থ সাহাৰ্য্য করতে চাইলে, উর্মিলার মুখে ওই একই কথা শুনতে পেত শ্বশুর। কোন বাদ প্রতিবাদ না করে, ম্লান মুখে ঊর্মিলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিত শুধু শ্বশুর।
শ্বশুরও আজ নেই। তবে কেন মনে হচ্ছে পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে? হয়ত দুর্দিনে অতীতের স্নেহস্মৃতিকে আগোচরেই সামনে টেনে এনে সান্ত্বনার অবলম্বন খুঁজেছে সে।
শ্বশুরের জন্য ভিতরে যে রকম আকুলিবিকুলি করছে এখন—ঠিক তার মৃত্যুর সময়ও হয়েছিল। তখন মেয়েদের হাতের কাজ শেখাচ্ছে উর্মিলা। শেখানোয় মন বসাতে পারছে না কিছুতেই, শ্বশুরের ছল ছলে দুচোখ আর বিমর্ষ মুখখানাকে চোখের সামনে থেকে সরাতে পারছিল না শত চেষ্টা করেও। মেঘলা আকাশের দিকে চেয়েছে মন ঘোরাতে—আরো বেশী উতলা হয়ে পড়েছে। তারপর কি যে হয়েছে, কেমন করে ঘর ছাড়া হয়ে স্টেশনে এসে ট্রেন ধরে লক্ষ্ণৌতে পৌঁছেছে—আজো চিন্তা করেও কোন হদিস পায়নি তার।
…শ্বশুরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে হতবাক হয়ে গেছে। শশুর যাবার পথে। দু’চোখের দৃষ্টি আটকে পড়েছে ঊর্মিলার মুখেব ওপর। মনে হল ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল একবার। কিছু বলতে চেষ্টা করল বুঝি। পারল না। অবোল হয়ে গেছে। দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল শ্বশুরের।
ঊর্মিলার চোখের কোণ জ্বালা করে উঠছে। তিন বছরের আগের লোকটা নতুন করে যন্ত্রণা দিতে সুরু করছে আবার।
পাশাপাশি দুটো টাঙা চলছে। উর্মিলার তাকাতে ইচ্ছে করছে না আর ও টাঙার সওয়ারীটার দিকে। না তাকিয়েই বেশ অনুমান করতে পারছে লোকটা একদৃষ্টে দেখছে তাকে এখনো।
গন্তব্যস্থলে এসে টাঙা দুটো থামল একসঙ্গেই। মা আর উর্মিলা দু’জনে নেমে পড়ল তাড়াতাড়ি। লোকটা কিন্তু নামল না। বসেই রইল টাঙায়। হয়তো অনেক লোক দেখে এই ব্যবস্থা।
মায়ের মুণ্ডন সারা হলে, এক গোছা চুল নিয়ে গঙ্গাযমুনার মিলনের জলে ডুবিয়ে দিল। ইচ্ছেটা ছিল মায়ের অনেক দিন ধরে। বাড়ী ছেড়ে কোন অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিতে হবে কোথায় কে জানে। আগে থেকেই তাই সেরে নেওয়া হল মুণ্ডনটা।
গাড়ীতে এসে বসেছে মা-মেয়ে। অনিচ্ছা সত্বেও, পাশের টাঙার লোকটার চোখে চোখ পড়েছে আবার। একই ভাবে বসে আছে। নির্জীব পাথরমূর্তি একেবারে। কিন্তু চোখ দুটো সজীব-সচল। ওপর-নীচে করছে কেবল। ঊর্মিলার পায়ের নখ থেকে মাথার চুল অবধি দেখছে বারবার। দেখে দেখেও দেখার সাধ যেন মিটতে চাইছে না আর।
পশ্চিমের খেয়ালী বাতাসে উর্মিলার কালো কুচকুচে কোঁকড়ানো এলোচুল গাল-কপাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ছে। হাত দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে ঊর্মিলা। পাশের টাঙার পাথরমূর্তিটা নড়ল এবার। বেহায়া নির্লজ্জের মতো ঝুঁকে পড়ে চুল সরানো দৃশ্যটা দু’চোখ দিয়ে গিলতে লাগল যেন। ঊর্মিলার নিজের ওপরেই বিরক্ত এলো। মায়ের মতো মাথা মুড়িয়ে চুলগুলো সঙ্গমের জলে ফেলে দিয়ে এলো না কেন সে।
আমি বেঁচে থাকতে এদৃশ্য দেখতে পারবো না রে। মরলে যা হয় করিস। মায়ের এসব কথা না শুনলেই ভাল করত সে।
টাঙাগাড়ী চলছে। গতি বাড়ছে ধীরে ধীরে। লোকটার গাড়ীও তালে তাল মিলিয়ে চলছে উর্মিলাদের গাড়ীর সঙ্গে।
বাড়ীর কাছ বরাবর অসতেই গাড়ীটা রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে পড়ল হঠাৎ। নিশ্চয়ই সওয়ারীর ইঙ্গিতেই দাঁড়াল গাড়িটা। লোকটা নামল। এপারের গাড়িটার ওপর চোখ রেখে ওপার ধরেই এগুচ্ছে।
লোকটা গাড়ী ছেড়েছে। সঙ্গ ছাড়েনি। এটা অদ্ভুত ঠেকছে উর্মিলার কাছে। হয়ত গাড়ীসুদ্ধ, ধরা পড়লে পালানো অসুবিধে—তাই এই নীতির আশ্রয়।
বাড়ীর সামনে এসে টাঙা থেমেছে ঊর্মিলাদের। তাড়াতাড়ি নেমে পড়েছে মা-মেয়ে। ভিতরে ঢুকেই দরজায় খিল এটে দিয়েছে উর্মিলা। ওপরে উঠেছে এরপরে। জাফরি ঘেরা বারান্দা থেকে দেখেছে লোকটাকে। ওপারে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ীর দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি।
বারান্দা থেকে ঘরে এসেছে। চারপাই-এ বসে চোখ ফিরিয়েছে জাফরির চারকোণা ফাঁকে। লোকটা এগিয়ে আসছে বাড়ীর দিকে। উৎকর্ণ হয়ে প্রতীক্ষা করছে উর্মিলা সদর দরজায় কড়াটা নড়ে উঠছে কিনা।
প্রতীক্ষার তাবসান হতে বেশী লাগল না ঊর্মিলার। কড়ানাড়ার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে।
রাগে সর্বশরীর জ্বলে উঠল। লোকটাকে উচিত মতো শিক্ষা দিতে হবে। উঠে পড়ল চারপাই থেকে। দরজা খুলে মা-ই লোকটার সঙ্গে কথা কইতে চেয়েছিল। উর্মিলাকে নীচে যেতে বারণ করেছিল। মায়ের নিষেধ না শুনেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে উর্মিলা। তরতরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে, দরজা খুলে দিয়েছে। লোকটার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে সোজা হয়ে। ইতর অভদ্র বাড়ী থেকে বেরিয়ে যান—অনেক কিছু বলবার জন্য অনেক ভাষাই মুখে যুগিয়েছিল। কিন্তু একটা কথাও বেরয় নি। কথার আদি অক্ষরটা পর্যন্ত না।
ওর ওপরে ঊর্মিলার ধারণা বুঝতে পেরেছিল যেন লোকটা। উর্মিলার মুখের ওপর থাপ্পড় মেরেছিল একটি মাত্র শব্দে-বহিন! বহিন! বিশেষ জরুরী কাজে এসেছি আপনার কাছে। ক্ষমা করবেন অসময়ে বিরক্ত করার জন্য।
মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল উর্মিলার একেবারে। উর্মিলা বিস্মিত চোখে দেখছিল ওর দু’চোখ। দুঃসময়ে মতিবিভ্রম হয় মানুষের। অকারণ এতক্ষণ ধরে একটা অত বড় ভদ্রকে কত ভুল না ঠাউরেছে! বিস্ময়ের সীমা পরিসীমা রইল না উর্মিলার—যখন আগন্তুক দেবীপ্রসাদ তার সমস্ত কথা শোনাল।
দেবীপ্রসাদ দেশে ছিল না এতদিন। আমেরিকায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে গেছল। শিকাগোর গ্র্যাণ্ডপার্কে বাকিংহাম ফোয়ারা দেখছিল যখন—আলো আর ফোয়ারার জলের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে একটা তন্ময়তা এসে গেছল দেবীপ্রসাদের—ঠিক সেই সময় উর্মিলাকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে স্পষ্ট।
দেখাটার কোন গুরুত্বই দেয় নি প্রথমে। দ্বিতীয়বার ইলিনয়স রাজ্যের প্রাচীন পাখী জন্তু আকারের ঢিবি গুলো দেখে অতীতে ফিরে যাচ্ছিল। যেতে যেতে এমন জায়গায় পৌঁছল, যেখানে কেমন যেন হয়ে গেল। আশ্চর্য! এবারেও উর্মিলাকে দেখল। তবে ঊর্মিলার মুখখনায় ঘন বিপদের ছায়া নেমেছে এবার। একই মেয়েকে অদ্ভুত ভাবে দু’বার দেখল। দেখল তার কায়া নয়। সপ্নের মূর্তির মতো। এরকম চেহারার কোন মেয়েকে আজ পর্যন্ত দেখে নি। অথচ দেখছে। কেন?
বন্ধুবান্ধবকে জানিয়ে ছিল। তারা হেসেছে। বিদ্রুপ করে নানা কথা বলেছে। অনেকে মাথা খারাপের লক্ষণও দেখেছে নাকি তার ভিতর।
হঠাৎ বাবা মারা যাবার পর স্বপ্নে উর্মিলাকে দেখতে লাগল প্রায় রোজই। লক্ষ্ণৌতে এসে আবার বাবার সঙ্গে উর্মিলাকে দেখতে পেত স্বপ্নে। তিনচারদিন আগে সারারাত ধরে দেখেছে একই স্বপ্ন। শেষের দিনে দেখল একটা নতুন জিনিস। বাবা আর উর্মিলার মাঝখানে একটা কাজ করা গয়নার বাক্স। দেখে, ঘুমুতে পারে নি একদম, চোখের পাতা এক করতে পারে নি এক বারের জন্যও। শেষে উঠে পড়েছে বিছানা থেকে। ভিতরটায় অস্থির অস্থির করছিল বড়। ঘরময় পায়চারি করছিল ঘন ঘন। কেন করছিল, কেন তার অমন হচ্ছিল—কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না।
স্ত্রী সব শুয়ে শুয়ে লক্ষ্য করেছে। দেবীপ্রসাদের মুখে স্বপ্নকথা শুনে চমকে উঠেছে। মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে স্বীকার করেছিল নিজের দোষের কথা। গোপন ব্যাপারের কথা। দেবীপ্রসাদের বাবার শরীরটা একটু খারাপ মনে হতে, স্ত্রীকে ডেকে বলেছিল, বাল্যবন্ধুর পূত্রবধূ ঊর্মিলার গয়নার বাক্স জমা রেখে গেছে বন্ধু মরবার ক’দিন আগে। যদি কখনো বিপদে পড়ে উর্মিলা, যদি তার প্রয়োজন হয়, তখন তারই প্রাপ্য জিনিস যেন দিয়ে দেওয়া হয় তাকে। বুঝিয়ে বলা হয় যেন, শ্বশুরের শেষ অনুরোধ নাকচ না করে যেন বৌমা।
একথাও অকপটে জানিয়েছিল স্ত্রী, বাবার কাছ থেকে গয়নার বাক্সটা পেতে, সত্যিই লোভ হয়েছিল খুব। ভেবেছিল, কেই বা জানতে পারবে চেপে গেলে। কিন্তু চেপে রাখবার চেষ্টা করেও পারে নি। স্বপ্ন দেখার কথা শোনা মাত্র, বুক ঠেলে ঠেলে আপনা হতেই বেরিয়ে আসছিল কথাগুলো।
স্ত্রীর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে দৌঁড়ে এসেছে দেবীপ্রসাদ। দেখেছে উর্মিলাকে। একবার নয়। বহুবার। দেখে দেখে স্বপ্নের মেয়ের চেহারার সঙ্গে প্রতিটি অঙ্গ মিলিয়েছে ঊর্মিলার। নিখুঁত ভাবে মিলে গেছে। এখন বহিনের গচ্ছিত জিনিস ফেরত আনবে বলে জানাতে এসেছে।
বিস্ময়ের ঘোর কাটছে উর্মিলার। মনে হচ্ছে শশুর একবার বলেছিল… উর্মিলাকে দেওয়া গয়না ঊর্মিলারই প্রাপ্য। আর কারো নয়। মনে পড়ছে, স্বামী মারা যাবার পর ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল শ্বশুর। উর্মিলা বলেছিল, এখানে ও গেছে, এভিটে ছেড়ে কোথাও যাবো না আমি। শশুর বলেছিল, ঠিক আছে।
সুদে আসলের দায়ে বাড়ীটা বিক্রি হয়ে যাবে আর দিন সাতেক বাদে। এমন সময় —
ছেলেমানুষের মতো মুখে কাপড় চাপা দিয়ে ফোঁপাতে লাগল ঊর্মিলা। উর্মিলা বেশ অনুভব করছে, শ্বশুর যেন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আস্তে আস্তে।
উর্মিলার মুখে তার জীবনের অভাবনীয় ঘটনা শুনে আমি স্থাণুর মতো বসেছিলুম চুপচাপ!