» » মিলিণ্ডা

বর্ণাকার

মিলিণ্ডা! মিলিণ্ডা! মিলিণ্ডা! মিলিণ্ডা!

একসঙ্গে নামটা মুখ থেকে মুখে কান থেকে কানে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। অনেকগুলো চাপা গলার ফিস ফিস আওয়াজ সাপের মতো হিসহিস গর্জন করে উঠছে যেন। শুনছি আমরা। আমরা বলতে আমি আর ডেভিড সাহেব।

ডেভিড সাহেব তখন অফিস ঘরে বসে। টেবিলের এদিকে ওর সামনা-সামনি চেয়ারে আমিও বসে আছি। মুক্তো তোলা সম্বন্ধে বেশ আলাপ আলোচনা চলছিল দু’জনের মধ্যে। ছেদ পড়ল হঠাৎ মিলিণ্ডা নামটা কানে আসতে। সাহেব দাঁড়িয়ে পড়ল চেয়ার ছেড়ে। আমিও কিছু না বুঝেই ওর দেখাদেখি উঠে দাড়ালুম।

অবাক বিস্ময়ে দেখলুম সাহেবের লাল মুখখানা সাদাটে হয়ে গেছে নিমেষে। দু’চোখে ভয়ের ছায়া। দুর্দান্ত দু’দে মানুষটা যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। পায়ে পায়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। সঙ্গে সঙ্গে এলুম আমিও। বাইরে পাতায় ছাওয়া দালানটায় দাড়িয়ে উত্তর দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে। আমি ওর দৃষ্টি অনুসরণ করলুম।

মিলিণ্ডা আসছে। মিলিণ্ডার দৃষ্টি সাহেবের ওপরেই। সাহেবের আপাদমস্তক দেখতে দেখতে এই দিকেই এগিয়ে আসছে মন্থরগতিতে। পাশে দাঁড়িয়ে আমি। কোন লক্ষ্য নেই তার আমার ওপর।

আশপাশের মাঝি-ডুবুরিরা যে যেখানে যে অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল, যার মতো সেই অবস্থাতেই সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সন্ত্রাসে একবার সাহেবের দিকে আর একবার মিলিণ্ডার দিকে তাকাচ্ছে ঘন ঘন। আমার চোখ জোড়া সাহেব থেকে শুরু করে উপস্থিত সকলের মুখের ওপর চক্কর দিয়ে আসছে এক একবার।

যত কাছাকাছি এগিয়ে আসছে মিলিণ্ডা তত সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো বুকটা ওঠানামা করছে প্রত্যেকের। মায় সাহেবের পর্যন্ত। দ্রুত থেকে দ্রুত, আরো দ্রুত হয়ে উঠছে ক্রমশ। মানুষগুলোর ভিতরে একটা সর্বনাশের আশঙ্কার ঝড়-তুফানের তাণ্ডব চলছে যেন। ওদের মুখ-চোখ দেখে মনে হচ্ছে তাই। ভিতরের তুফানটা বেরিয়ে আসতে চাইছে বাইরে।

আচমকা তুফানটা যেন থেমে গেল চোখের পলকে। রুদ্ধ নিঃশ্বাস সবার। রুদ্ধবাক সবার। সাহেবের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মিলিণ্ডা।

মিলিণ্ডা সম্বন্ধে অনেক কথাই শুনেছি আমি সাহেবের মুখে আর এই দক্ষিণ ভারতের তুত্তিক্কোডি বন্দরের স্থানীয় লোকদের মুখে। মিলিণ্ডা রহস্যময়ী কুহকিনী ডাইনী। ওর অসাধ্য নেই কিছু। সমুদ্রের রাক্ষুসে হাঙরগুলোর মতো ওরও ভিতরটায় ওই রকম অজস্র হাঙর কিলবিল করে বেড়াচ্ছে অহর্নিশি। তাদের খাদ্য জোগাড় করতে আসে ও এখানে মুক্তো তোলার সময়। ওর পেটের মধ্যে কখন যে কাকে যেতে হবে হাঙরের খোরাক হয়ে তা বিধাতাই বলতে পারেন একমাত্র।

ওর দু’চোখে কি সর্বনেশে যাদু আছে কে জানে। দূরের মানুষকে অজগরের নিঃশ্বাসের আকর্ষণের মতো কাছে টানে। তারপর চোখেরই মায়াজাল বিস্তার করে এমন ভাবে আটকে ফেলবে মানুষকে যে ওর কাছ থেকে দূরে পালানো তো দূরের কথা-নড়াচড়া করবার ক্ষমতা থাকবে না একটুও কারো। বক্তাদের এই বক্তব্যটা অন্তত মিলেছে আমার কাছে। প্রমাণ পাচ্ছি। স্বচক্ষে দেখছি। সত্যিই অতগুলো মানুষ নজরবন্দী মিলিণ্ডার কাছে।

আমি অবশ্য সাহেব ছাড়া একবারের জন্যও মিলিণ্ডাকে অন্য কারো দিকে তাকাতে দেখছি নে। তাকিয়েও অন্যদের বিনা হাতকড়া শেকলে, বিনা লোকলস্করে পুতুলের মত চুপচাপ দাঁড় করিয়ে রাখতে পারে যে মেয়ে, সে মেয়ে যে সে নয়, বেশ বুঝতে পারলুম।

বোঝার সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও একটা অনাগত বিপদের আশঙ্কা ঘিরে ধরল। মিলিণ্ডার বিষয়ে সব কটা শোনা কথা যদি এইভাবে ফলে যায় তাহলে তো ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটবে। বিপদের সীমা-পরিসীমা থাকবে না আর কারো। প্রাণ নিয়েও টানাটানি হতে পারে কারো না কারো। প্রমাদ গণলুম আমি। কি কুক্ষণে না এসে পড়েছি গোঁয়ার্তুমি করে, সমস্ত মিথ্যে ভেবে।

সাহেবের সামনে দাড়িয়ে আছে মিলিণ্ডা। চাউনির ধরন দেখে মনে হচ্ছে, ওর দু’চোখ কোন একটা প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব চাইছে সাহেবের নিষ্পলক নীল চোখ দুটোর কাছে। মিলিণ্ডার কপালে বিরক্তির রেখা ফুটে উঠছে। ভুরু কুচকে বার বার দেখছে সাহেবকে।

সাহেবের দু’চোখে প্রাণের সাড়া নেই যেন। একেবারে পাথুরে চোখ। খরখরে হয়ে উঠছে মিলিণ্ডার দৃষ্টি। ওর তীক্ষ্ণদৃষ্টির ফল বিঁধছে পাথুরে চোখ দুটোয়, ঘা মারছে। ঘা মেরে মেরে খানখান করে ভেঙে ফেলবে বুঝি এখুনি। ভিতরটা দেখতে চাইছে। গোপন রহস্যের সত্যি হদিস পেতে চাইছে। ডুবুরির মতো সাহেবের মনের গহনে নেমে একটা সত্যিকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে বার করে নিয়ে আসতে চাইছে। দেখবে, তাকে বিশ্বাস করতে পেরেছে কিনা সাহেব এতদিনেও।

সেদিনে যা ঘটেছিল, তার সত্যি ব্যাপার সাহেবের না জানার কথা নয়। মিলিণ্ডাই জানিয়ে দিয়েছিল সমস্ত। বোঝবার সুবিধের জন্য বলেছিল ভাঙা ভাঙা হিন্দীতে। তবুও সাহেব বলেছিল, আই ডোণ্ট নো ডোণ্ট বদার মা এগেন। বুট জুতোয় শক্ত পায়ের দুম দুম আওয়াজ তুলে সমুদ্রেব ধার থেকে অফিস ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছিল।

সেদিনও এই দৃষ্টি মেলে ধরেছিল মিলিণ্ডা সাহেবের চলার পথে। ইংরিজী কথা বুঝতে না পারলেও মুখ দেখে ধরতে পেরেছিল, বিরক্ত হয়ে উঠেছে সাহেব তার ওপর, উদ্দেশ্য সফল হয়নি তার।

সাহেবের এই দুর্ব্যবহারে অগ্রাহ্যে মিলিণ্ডার কিন্তু নিজের বদ্ধমূল ধারণা মন থেকে সরেনি এক চুলও। নিজের ধারণাটাকে যথার্থ প্রতিপন্ন করতে পরদিন ভোর না হতেই সাহেবেব অফিসের সামনে এসে দাড়িয়েছিল।

ঘর থেকে বেরুবার মুখে দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিল সাহেবকে, টমাস অন্দয়াল…। টমাসই সেই লোক। সব শুনেও আমাকে এত অবিশ্বাস করছ তুমি কেন?

তামিল কথা সাহেব যে না বোঝে তা নয়, কিন্তু মিলিণ্ডার কোন কথাই কানে নেয়নি। গম্ভীর মুখে গটগট করে বেরিয়ে গেছিল পাশ কাটিয়ে।

ফিরে এসেছিল মিলিণ্ডা নিজের ডেরায়। সে বছরে আর কোন বিপত্তি ঘটেনি বন্দরে, ঘটেনি সমুদ্রের জলে। ঘটেছিল অসম্ভব কাণ্ড বছর ঘুরতে, মুক্তো তোলার সময় আবার ফিরে আসতে।

মিলিণ্ডার অন্য রূপ দেখে চমকে গেছিল সকলে। ভয়ে আঁতকে উঠেছিল। নিকষ কালো মেয়েটার সব কিছুই কালো। সাক্ষাৎ মৃত্যুবিষের একটা ঘড়া যেন ও। সমুদ্র মন্থনে রত্ন উঠেছিল আর বিষ উঠেছিল শোনা যায়। মেয়েটা সমুদ্রতীরে জন্মেও রত্ন হয়ে উঠতে পারে নি। সমুদ্রের অপগুণ, যত বিষ সমুদ্র ছেকে শুষে নিয়েছিল বুঝি ওর সর্বশরীরে। ঘন নীল বিষই ওর রংটাকে কালচে করে দিয়েছে বোধ হয় তাই।

এমন ভয়ঙ্কর মেয়ে এর আগে ভূ-ভারতে দেখেনি কেউ কখনো। এ মেয়ের চোখে আগুনের গুনের ফুলকি। নিশ্বাসে আগুনের হলকা। বেশীক্ষণ দাঁড়ানো যায় না সামনে। ইস্পাত কঠিন মানুষও গলতে থাকে যেন। অসহ্য জ্বালা ধরতে থাকে সমস্ত দেহে।

এহেন মিলিণ্ডার সামনে দাঁড়িয়ে ডেভিড সাহেব।

সাহেবের মুখের ওপর থেকে চোখ ফেরাল মিলিণ্ডা সমুদ্রের দিকে। কি যেন কি ভাবল খানিক। তারপর নিজের মনেই কি সব বিড়বিড় করে বলতে বলতে চলে গেল।

চেতন হয়ে উঠল সকলে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচল। পাথর মূর্তির সাহেবকে আবার রক্তমাংসের মানুষ মনে হতে লাগল। একটু আগের ভীরু সাহেব বরাবরের দুঃসাহসী রাশভারী লোক হয়ে উঠল আবার। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, পাগলীটা দু’বছর ধবে নাস্তানাবুদ করছে আমাদের।

কি নাস্তানাবুদ করছে, তা আমি জানি। মুক্তো তোলা বন্ধ করে দেয় সমুদ্রের জলে একটা বিভীষিকার রাজ্য তৈরি করে। বন্দুক, ডিনামাইট, সেপাই, কোন কিছুই বাগ মানতে পারে না তার নির্মম খেলাকে।

এ খেলার রহস্য ভেদ করতে এসেছে গুণিন। এসেছে যাদুকর জ্ঞানী-বিজ্ঞানী আর সাধু সন্ত ওঝা। আরো কত রকমের কত কিছু জানা লোকের যে আবির্ভাব ঘটেছে সমুদ্রের উপকুলে তার ইয়ত্তা নেই। অনেক রকম করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেও মিলিণ্ডাকে একটা সাধারণ মেয়ে ছাড়া অন্য কিছু বলার সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি আজ পর্যন্ত কেউ। নির্মম খেলার কোন রহস্যই ভেদ করতে পারেনি। সকলেই এই সাধারণ মেয়েটাকে সমুদ্রের উপকূলে এলে কেমন হয়ে যেতে দেখেছে। দেখেছে কি বীভৎস মূর্তি হয়ে ওঠে ওর। দেখা যায় না চোখে। অতি অবিশ্বাসী অতি নির্ভীকের মনেও ভয় ধরে। মেয়েটা যেন সম্পূর্ণ পাল্টে যায় একেবারে। প্রকৃতিতে তো বটেই, আকৃতিতেও মনে হয়। মুখ-দেহ সব যেন অন্য মানুষের। গলার স্বরটাও কি রকম শোনায় কানে। বুকের ভিতরটা কেঁপে ওঠে।

সব চেয়ে বেশী আশর্য লাগে যখন মানুষ-খেকো হাঙরগুলোর ওপরই ঝাপিয়ে পড়ে জলে। আবার হাসতে হাসতেই অক্ষত দেহে উঠে আসে নৌকোয়। এ দৃশ্য দেখে প্রথমে আনেকেই ভেবেছে—এটা নিছক মায়াবিনীর মায়া বিস্তার। জলে হাঙরের ভয় দেখিয়ে মন দুর্বল করে দেয়। সম্মোহিত করে ফেলে সবাইকে। যেটা দেখা যায়—সেটা মনের ভুল চোখের ভুল ছাড়া অন্য কিছু নয়।

কিন্তু এ যুক্তি খাটল না শেষ অবধি। ডেভিড সাহেব ডাইনীর কারচুপি ধরার কম চেষ্টা করেছে নাকি। নাজেহাল হয়ে গেছে সাহেব। তীরে খুঁটি পুঁতে তাতে ছাগলটার দড়ি শক্ত করে বেঁধে রেখে জলে নামিয়ে দিয়েছে। করুণ আর্তনাদের সঙ্গে সঙ্গে দড়ি ধরে টেনে তুলেছে ছাগলটাকে। বিস্ফারিত চোখে দেখেছে সাহেব, শুধু সাহেব কেন অন্য দর্শকেরাও ছাগলটার পিছনের দু’পা কেটে নিয়ে গেছে হাঙর ধারালো দাঁতে।

হো-হো করে হেসে উঠেছে মিলিণ্ডা। সাহেবের দিকে কটমট করে তাকিয়েছে। তবুও হাল ছাড়েনি সাহেব। একবার দু’বার, বারবার, এই ভাবে পরীক্ষা করে শেষে হার মেনেছে।

সাহেব হার মানল বটে, কিন্তু মিলিণ্ডার আক্রোশ বাড়ল সাহেবের ওপর দ্বিগুণ। ও যেন মুক্তো তোলা বন্ধ করার জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে উঠল।

সে আশা পূরণ হয়েছে মিলিণ্ডার। ওর দৌরাত্মে মুক্তো তোলা বন্ধ আজ বছর দুয়েক ধরে। জব্দ হয়েছে সাহেব। অসম্ভব লোকসান হচ্ছে ব্যবসায়। ঠিকাদারদেরও সাহেবের অবস্থা। ডুবুরি মাঝিদের অন্ন জুটছে না পেটে। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে দিন গুজরান করা দায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু মিলিণ্ডার দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে পারছে না কেউ। ওকে দেখার আগে দুর থেকে অনেক বীরপুরুষ হম্বিতম্বি করেছে—তারা এসেই এক মুহূর্তে জব্দ করে দেবে মিলিণ্ডাকে। হাতের পেশী ফুলিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, সে ক্ষমতা রাখে তারা।

দম্ভ-দক্ষতা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে তাদের মিলিণ্ডার চোখে চোখ পড়তে। এগুতে পারে নি, পা পাথর-ভারী। বাড়াতে পারে নি হাত—অবশ। খুলতে পারেনি মুখ-হতবাক। একেবারে নিষ্প্রাণ-নিম্পন্দ হয়ে গিয়েছে তারা। মিলিণ্ডার ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা দুষ্কর। এ অলুক্ষুণে কাণ্ড দেখার কোন সাধ নেই আমার। এরকম কোন সাধ থাকাও উচিত নয়, নিজের মনকে বোঝাতে লাগলুম বার বার। কেন জানিনে বিপরীত ফল হল। অদম্য কৌতুহল জেগে উঠল মিলিণ্ডার এই ব্যাপার দেখার। তবুও বদ ইচ্ছেটাকে শেষবারের মতো মন থেকে সরাবার জন্য সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নেব ঠিক করলুম।

‘গুডবাই’ কথাটা জিভের ডগায় এসে আটকে গেল। সঙ্গ ছাড়তে চাইছি, মুখ দেখে আঁচ করতে পেরেছিল বোধহয় সাহেব। কিন্তু কেন সঙ্গ ছাড়তে চাইছি, সেটা যে বোঝেনি একদম জানা গেল তার কথায়।

সাহেবের মতে ভাগ্য সুপ্রসন্ন এবার। হাওয়া যেন অনুকূলে বইতে শুরু করেছে! মিলিণ্ডা মুক্তো তোলার দিনে এভাবে আসেনি কখনো। এসেছে হঠাৎ সমুদ্রের ধারে ঝড়ের বেগে। এসেছে ঠিক ডুবুরিদের জলে নামবার মুখে। এসে আজ ফিরে গেছে। তাই মনে হচ্ছে সমুদ্রের দিকে যাবার সম্ভাবনা নেই আর ওর। সুতরাং ভয়ের কোন কারণ নেই আমার। মুক্তো তোলা দেখতে এসেছি যখন—সুবর্ণ সুযোগও পাওয়া গেছে যখন, তখন দেখে ফেরাই ভালো, অনুরোধ করল আমায় সাহেব।

সাহেবের সঙ্গে সমুদ্রতীরে এসে হাজির হলুম আমি।

আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। সাহেব আঙুল দেখিয়ে ইঙ্গিত করল মাঝিদের নৌকো ছাড়তে। ডুবুরিদের দিকে চেয়ে হাসল। সাহেবের এ হাসির অর্থ বোঝে তারা। সমুদ্রে নামবার জন্য পাথর, দড়ি, ব্যাগ, সমস্ত সাজসরঞ্জাম গুছিয়ে নিয়ে নৌকোর ওপর উঠে বসল ওরা।

কি যে হল বুঝতে পারলুম না। হঠাৎ যেন একটা আতঙ্ক নেমে এল সবার চোখে মুখে। পিছন ফিরে তাকাতেই চমকে উঠলুম। মিলিণ্ডা! কি ভীষণ মূর্তি! সাক্ষাৎ দানবী যেন। কিছুক্ষণ আগে দেখা মিলিণ্ডার সঙ্গে এ মিলিণ্ডার কিছু মিল নেই।

ত্বড়িৎগতিতে এগিয়ে এল মিলিণ্ডা নৌকোর কাছে। উঠল। সঙ্গে সঙ্গে তড়াক কবে টমাস নৌকো থেকে লাফিয়ে পড়ল তীরে। ছুটে পালাতে যাচ্ছে, ডাকল মিলিণ্ডা। তীব্র তীক্ষ্ণ কণ্ঠ। দাঁডিয়ে পড়ল টমাস। শক্তসমর্থ জোয়ানটার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল টমাস মন্ত্রমুগ্ধের মতো। উঠল নৌকোয়।

সামনে দাঁড়িয়ে আছে মিলিণ্ডা। ওর চোখের আগুন ঠিকরে পড়ছে টমাসের চোখে।

হতভম্ব হয়ে দেখছি সকলে—নৌকোর চারপাশে হাঙর ছেয়ে যাচ্ছে। বাতাস ভারী হয়ে উঠছে মনে হচ্ছে। অচমকা জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল মিলিণ্ডা।

রুদ্ধনিশ্বাসে দেখছি আমরা। দেখলুম অক্ষত দেহে হাসতে হাসতে মিলিণ্ডা নৌকোর ওপর উঠল আবার। একটাও হাঙর দেখা যাচ্ছে না জলে আর।

গম্ভীর গলায় মিলিণ্ডা আদেশ করল টমাসকে—জলে নামো। ঝিনুক তুলে নিয়ে এসো। হাঙরের ভয় নেই। ডিনামাইট বন্দুকের শব্দে হাঙর তাড়াতে হয় নি। ওরা আপনা হতেই চলে গেছে।

ডান হাতে বড় ভারী পাথর বাঁধা দড়িটা ধরল টমাস। ডান পা পাথরটার ওপর রেখে নিশ্বাস টেনে নিল জোর করে। তারপর, পাশের দড়ির বা দিকটায় ঝিনুক তোলবার থলে দুটো ঠিক বাঁধা আছে কিনা, চোখ বুলিয়ে নিল একবার।

নামছে টমাস। নামছে নামছে নামছে। ওকে আর দেখতে পাচ্ছিনে আমরা। জলের অনেক তলায় চলে গেছে মনে হচ্ছে। যেখানে ঝিনুক সেই মাটিতে দাঁড়িয়েছে নিশ্চয়ই। হাতড়ে হাতড়ে ব্যাগ ভর্তি করছে ঝিনুক। দড়ি ধরে ইঙ্গিত করেছে সমুদ্রের অগভীর মাটির বুকে পা ফেলতেই। দড়ি নাড়িয়ে ওপরের লোকের হাতে টান দিয়ে এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। তাই লোকটা পাথর বাধা দড়িটা গুটিয়ে নিয়েছে টেনে টেনে। পাথরটাকে তুলে রেখেছে নৌকোয়।

বা হাতের রিস্টওয়াচটা দেখছে ডেভিড সাহেব। মিনিট গুণছে। এক দুই তিন — আট। অস্থির হয়ে পড়ল সাহেব। এমনি ডুবুরিবা জলের তলায় দম বন্ধ করে দু’মিনিটের বেশী থাকতে পারে না। জন পারত চার মিনিট। টমাস তার দেখাদেখি অভ্যেস করে করে, সাত মিনিট অবধি দম বন্ধ করে থাকতে পারত জলের তলায়।

আট মিনিট হয়ে গেল, অথচ নীচের লোকের কোন সঙ্কেত এসে পৌঁছল না ওপরের লোকের হাতের দড়িতে। মহা ভাবনায় পড়ল সাহেব। জন-টমাসের জলে থাকার নির্দিষ্ট মিনিটের কথা জানাল সাহেব আমায়। আবার রিস্টওয়াচের দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখার সঙ্গে সঙ্গে মুখে উচ্চারণ করতে লাগল জোরে জোরে।—নয় —দশ —এগারো —বারো।

আর গুণতে পারল না সাহেব। গুণতে চাইলও না। যথেষ্ট সময় অপেক্ষা করা গেছে। সাতের জায়গায় বারো মিনিট—পাঁচ মিনিট বেশী। একটা অশুভ আশঙ্কায় সাহেবের গলা কেঁপে উঠল। কাঁপা গলায় নির্দেশ করে দিল অন্য ডুবুরিদের জলে নেমে টমাসকে তুলতে। তাকাল মিলিণ্ডার দিকে। নৌকো থেকে ঝুঁকে নিবিষ্ট মনে মিলিণ্ডা যেন কি দেখতে চেষ্টা করছে। জলের গভীরে ওর প্রখর দৃষ্টি পৌঁছবার চেষ্টা করছে বুঝি। মনে হল, কি যেন দেখতে পেল ও। মুখ তুলতেই মালুম হল। মিলিণ্ডার ভয়ানক রূপটা নেই। সে উগ্রভাব আর দেখা যাচ্ছে না, কমনীয় ভাবটা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। হাসছে মিলিণ্ডা পরিতৃপ্তির হাসি। সাহেবের চোখে চোখ পড়তে নৌকো থেকে নেমে পড়ল। সাহেবেরই পাশে এসে দাঁড়াল চুপচাপ। তোলা হল টমাসকে। আমাদের সামনে এনে রাখল ডুবুরিরা টমাসের প্রাণহীন দেহটাকে। সাহেবের কানের কাছে মুখ এনে মিলিণ্ডা বলল, নম্বীনায়া…বিশ্বাস হল সাহেব তোমার এবার?

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মাখা মাটিতে নোয়াল ডেভিড সাহেব। মৃদুস্বরে মিলিণ্ডার কথারই প্রতিধ্বনি বেরিয়ে এল তার মুখ দিয়ে, নম্বীনায়া। বিশ্বাস হল।

অফিসে এসে বিশ্বাস অবিশ্বাস হওয়ার এক অভিনব কাহিনী শুনলুম সাহেবের কাছে। টমাসের মতো জনেরও মৃত্যু হয় জলের তলায়। টমাস আর জন, দুই বন্ধুতে হাসতে হাসতে নেমেছিল জলের তলায় ঝিনুক কুড়ুতে। মুক্তো পাবে। চার মিনিট হয়ে গেল তবুও উঠল না ওপরে জন। হাতে ধরেছে, পায়ে ধরেছে সাহেবের মিলিণ্ডা। কেঁদে বুক ভাসিয়ে অনুরোধ করেছে, কালবিলম্ব না করে তাড়াতাড়ি তুলে ফেলতে জনকে।

কর্ণপাত করেনি সাহেব ওর কথায়। ভেবেছিল, জন হয়তো মিনিট বাড়ানোর অনুশীলন করছে তলায়। সাত মিনিটের মুখে টমাস উঠে এল একা। সাহেবের প্রশ্নের জবাবে জন সম্বন্ধে কিছু জানে না বলল। আর বলল, ক’দিন ধরে আমার চেয়ে মিনিট বাড়াবার কথা বলছিল জন। মিনিট বাড়লে ঝিনুক তুলতে পারবে বেশী। টাকা পাবে বেশী। তাই দমবন্ধ করে থাকার অভ্যেসটা বাড়াতে হবে। নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত ছিলুম। ও কি করছে না করছে, লক্ষ্য রাখিনি অত।

টমাসের এই ধরনের জবাবদিহি মেনে নেয়নি মিলিণ্ডা। ওর অত কথার একবর্ণও বিশ্বাস করেনি। সাহেবের কাছে গোপন কথা গোপন করেনি সে। টমাস রোজ আসত মিলিণ্ডাদের খুবরিতে। ওকে একলা পেলেই রাণী বানাবার কথা শোনাত। জন দু’মিনিটের জায়গায় চার মিনিট দম বাড়িয়েছে। সে-ও ওর চেয়ে তিন-চার মিনিট বাড়াবে। তখন? তখন জনের চেয়ে তার উপায় হবে বেশী। আর মিলিণ্ডা তো জনকে ছেড়ে আসতে বাধ্য হবে তার কাছে রাণী হবার জন্য।

কথা শুনে পা থেকে মাথা অবধি জ্বলে উঠেছে মিলিণ্ডার। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে ওকে। দাঁত বার করে হাসতে হাসতে চলে গেছে টমাস। আবার এসেছে, আবার গেছে। জনের মৃত্যু হবার আগের দিনেও এসে জানিয়েছে এবার তাড়াতে পারবে না আর ওকে সে। নিজে হতেই ঘরে ডেকে তুলবে।

মিলিণ্ডার জন্যই টমাস উন্মত্তের মধ্যে জনকে পৃথিবী থেকে যে সরাতে চেয়েছিল এটা অবিশ্বাস করেছিল সাহেব। অবিশ্বাস করেছিল, মিলিণ্ডার মুখে শোনা জন-হত্যার কাহিনীটাও। জনের দম বন্ধ রাখার সময় উতরে যাওয়ার পরও ওকে জোর করে জলের তলায় আটকে রেখে মরতে বাধ্য করেছে টমাস। সে-দৃশ্য স্বপ্নে দেখেছে মিলিণ্ডা, জনের কবরের ওপর মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল যখন হঠাৎ জেগে উঠে আবার কান্নায় ভেঙে পড়েছে। সে কান্না থামতে চায়নি তার কিছুতেই। কাঁদতে কাঁদতেই শুনেছে, ভিতরে কে যেন কথা কয়ে উঠছে জোরে জোরে। সাহেব কোন প্রতিকার করতে না পারলে ব্যবসা নষ্ট হবে। জনের মতো টমাকেও মরতে হবে একদিন নিশ্চয়ই। কেউ রক্ষে করতে পারবে না, পারবে না—পারবে না।

পাগলেরই প্রলাপ বটে। মিলিণ্ডা কিছু বলতে এলে শুনত না সাহেব। ওকে দূরে দেখলে পালাতে চেষ্টা করত। পাগলীর উপদ্রব থেকে বাঁচবার জন্য। কিন্তু বাঁচতে পারেনি সাহেব ওর কোপ থেকে। দিন দিন ভীষণ হয়ে উঠতে লাগল মিলিণ্ডা। এই ভীষণ ভাবটা মুক্তো তোলার সময়েই হত ওর। অন্য সময় স্বাভাবিক। স্বাভাবিক অবস্থাতেই ওর ডেরায় গেছে সাহেব ব্যবসায় ক্ষতি না করবার জন্য বোঝাতে। গেছে টমাসের ওপর ভুল ধারণা থেকে অনুরোধ করে নিবৃত্ত করতে। টমাসের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নেই। স্বপ্ন স্বপ্নই। সত্যি নয়। গোড়া থেকে টমাসকে অন্য চোখে দেখার ফলই এই দুঃস্বপ্ন।

ধীর-স্থির হয়ে শুনেছে মিলিণ্ডা সমস্ত। তারপর বলেছে, সাহেব! বিশ্বাস কর! আমি যে কি করি কিছুই জানি না নিজে।

টমাসের মৃত্যুর পরও দেখেছি মিলিণ্ডাকে সমুদ্রের ধারে। ঝিনুক তোলবার সময় এসে দাঁড়িয়েছে রোজ। কপনি পরা হৃষ্টপুষ্ট কালো মানুষগুলোকে জলে নামতে উৎসাহ দিয়েছে হাসি মুখে। জল থেকে রাশি রাশি ঝিনুক তুলে, ব্যাগ ভর্তি করে ওপরে এসে উঠেছে ডুবুরিরা নির্বিঘ্নে। দেখে, আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠেছে মিলিণ্ডার স্নেহস্নিগ্ধ দু’চোখ।