» » কান্নার সুর

বর্ণাকার

জায়গাটার কাছ বরাবর আসতেই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠতে লাগল আমার সর্বাঙ্গ।

মোটর চলছে। খাড়াইয়ের পর খাড়াইয়ে উঠছে। গাছপালা ভরা সবুজ পাহাড়ের গা কেটে কেটে আঁকা-বাঁকা উঁচু-নীচু রাস্তা করা হয়েছে গাড়ি যাবার। সেই পথ ধরেই এগুচ্ছে আমাদের গাড়ি। যত এগুচ্ছে, বুকের ভিতর ঢিপঢিপও করছে তত আমার। দু’জনের উষ্ণ নিশ্বাস পড়ছে আমার দু’দিকে। ডাইনে-বাঁয়ে। ডানদিকে বসে আছে তরুণীটি, বাঁদিকে তরুণ। ওদের দুজনের মাঝখানে আমি।

মেয়েটি বলছে যখন, ছেলেটি থেমে যাচ্ছে। চুপচাপ একেবারে। আবার ছেলেটি যখন মুখ খুলতে শুরু করছে, মেয়েটি নির্বাক হয়ে যাচ্ছে তক্ষুণি। পালা করে বলছে দু’জনে। আমি নিবিষ্ট মনে শুনছি ওদের কথা। শুনছি আর ভাবছি!

আমার ভাবনার সঙ্গে এক একবার এক একটা দৃশ্য ভেসে উঠছে যেন চোখের সামনে স্পষ্ট। আমি দেখছি, একটা গাড়ি পাহাড়ী ঘোরানো পথ বেয়ে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে ক্রমে। গাড়িটার ভিতর শিরাণে। কি নিদারুণ অবস্থা ওর। কি করুণ চাউনি ওর দু’টি নীল চোখের। ও চোখ জোড়া আর্তনাদ করছে। ডাকছে সকলকে তাকে বাঁচাবার জন্য। ইয়াসোর খপ্পর থেকে মুক্ত করবার জন্য।

শিরাণের হাত-পা নাড়বার উপায় নেই একটুও। ইয়াসো পিছমোড়া করে বেঁধে রেখেছে তাকে। শক্ত দড়ি কেটে কেটে বসে গেছে হাতে-পায়ে। মুখ বেঁধেছে রুমালে, যাতে একটা শব্দও উচ্চারণ করতে না পারে। কেন কে জানে, শুধু চোখ-নাকের ওপর হামলা করেনি।

নাকটা বন্ধ করে দিলে হয়তো দম আটকে মরে যাবে, তাই খোলা রেখেছে। তার কর্মফলের সাজা পাক অন্তত খানিকটা, দগ্ধে দগ্ধে মরুক। দু’চোখ খুলে মেলে দেখুক, কি অবস্থা হতে চলেছে তার! আতঙ্কে আতঙ্কে অস্থির হয়ে পড়ুক।

অস্থির হয়ে পড়ছে শিরাণে। ভীতি বিহ্বল চোখে তাকাচ্ছে চতুর্দিকে। ড্রাইভারের পাশের লোকটার দু’চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে। এই দিকেই মুখ ফিরিয়ে রয়েছে। পলকহীন চোখে তাকে দেখছে। একটু নড়বার চেষ্টা করলে লোকটার উঁচিয়ে ধরা ছোরাটাও নড়ে উঠছে। পালাবার চেষ্টা করেছ কি, নির্ঘাৎ মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাবে না জেনো, হুঁশিয়ার!

এক পাশে ইয়াসো একপাশে তার বন্ধু। ওদের দুজনের ছুরির ফলার মতো সতর্ক দৃষ্টি ওর দু’চোখে বিঁধে বিঁধে ক্ষতবিক্ষত করছে। এদের তিনজনের একজনের কাছ থেকেও উদ্ধার হবার—বাঁচবার কোন সাহায্যই পাওয়া যাবে না।

তবুও চোখের অসহায় আবেদন জানাচ্ছে এদেরই তিনজনের চোখে সুন্দরী শিরাণে। শিরাণের চোখের মোহে বুঝি ইয়াসোর মন টনছিল, গলছিল। তাই বন্ধুর পকেটে খপ করে হাত পুরে দিয়ে রুমালটা টেনে বার করে নিল। মোটা রুমালটা আরো পুরু করল দু’পাট করে। শিরাণের দু’চোখ ঢেকে দিয়ে, কোণা দু’টো পিছনের দিকে টেনে নিয়ে জোর করে গিঁট বাঁধল।

নিশ্চিন্ত হল ইয়াসো। কোন রকমের দুর্বলতা আর আসতে পারবে না কারো শিরাণের ওপর। সমস্ত কার্য সমাধা করতে পারবে ইয়াসো নির্বিঘ্নে।

নির্বিঘ্নেই সব কিছু করতে পারত যদি না সুরজিত সিং গাড়ি নিয়ে অনুসরণন করত তাদের গাড়ির। এ-পথে এ-সময় সুরজিত সিংয়ের আসবার কথা নয়। সব জেনেশুনে ভালোভাবে বিচার আচার করা হয়েছে ক’দিন ধরে। তারপর এই ভোরের দিকে শিরাণেকে গাড়িতে তোলা হয়েছে। একথা সুরজিত সিংকে বলবার—জানাবার কেউ নেই ত্রিভুবনে একজন ছাড়া। সে বলতে পারে না জীবন থাকতে। একাজের সে-ই প্রধান হোতা। তারই স্বার্থ বেশী। শিরাণেকে নিয়ে ব্যথা বেদনা তারই বেশী। ধরা পড়লে যেন সুরজিত সিংয়ের হাতে শিরাণেকে ছেড়ে দেওয়া না হয় কিছুতেই। ওর প্রাণ থাকতে নয়। এ কড়া নির্দেশ দিয়েছে সে-ই।

তবে বলল কে?

শিরাণে নিজে? না, তার হাত-পা-মুখ বাঁধার আগের মুহূর্তেও জানতে পারে নি সে এসব ষড়যন্ত্রের কোন ব্যাপারে। ঘুমন্ত অবস্থাতেই হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়া হয়েছে তার ওপর। ঘুম ভেঙেছে। একটু ধস্তাধস্তি করাই সার হয়েছে তার। মুখ দিয়ে কথা ফুটতে দেওয়া হয় নি একটাও। আগে থেকেই হাত দিয়ে মুখ চেপে রাখা হয়েছিল।

তিনজনের সঙ্গে কোন রকমেই পেরে ওঠে নি সে। তবু প্রাণপণে যুঝেছিল। দু’চোখের কোণ দিয়ে বড় বড় জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়েছিল টসটস করে। যারা কাছে ছিল, মমতা জাগে নি তাদের অন্তরে। জেগেছিল ভয়। প্রাণের নয়, কাজ পণ্ড হয়ে যাবার। দেরী হলে, কেউ এসে পড়লে, কেউ জানতে পারলে সমূহ বিপদ তাদের। যে টাকা খেয়েছে, সে তো খেয়েছেই। যে টাকা পেয়েছে ফেরৎ দিতে হবে। যা পাবার কথা, তা আর পাবে না। সুতরাং ওদের ভয় পাওয়া স্বাভাবিক, তাড়াহুড়ো করা স্বাভাবিক।

এই দলের ইয়াসোও। তার পাথর-কঠিন মনের আর দুর্দান্ত প্রকৃতির খ্যাতি চতুর্দিকে। তার কাছে আইন-কানুনের কোন বালাই নেই। নেই কোন ধর্মাধর্মের জ্ঞান বিচার। তাকে দেখলে একশো হাত দূর থেকে সরে পড়ে মানুষ, সামনে আসা তো দূরের কথা। তার অপরাধের সাক্ষী দেয় না কেউ। তাকে বাঁধবার কেউ নেই। আটকাবার কেউ নেই।

ইয়াসো নির্মম-নির্দয়।

ইয়াসো নামটা ছুটে বেড়ায় বাতাসে বাতাসে অহর্নিশি। বুক কাঁপানো ত্রাস ধরায় ছেলে-বুড়ো, সকলের মনে। এতে ইয়াসোর গর্ব বাড়েই যেন। সময় সময় একান্তে বসে ভাবে ইয়াসো, তার জুড়ি নেই কেউ। তার মতো হতে অনুগতদের এখনো অনেক-অনেক দেরী।

ইয়াসো লোকের নির্যাতন দেখলে, আনন্দে ফেটে পড়ে। বিশাল শরীর নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নাচতে থাকে। রক্ত জল করা এক অদ্ভুত আওয়াজ বেরুতে থাকে মুখ দিয়ে সে-সময়। কারো কান্না দেখলে হেসে গড়িয়ে পড়ে একেবারে। থামতে বেশ সময় লাগে।

এহেন ইয়াসো থেকে থেকে যেন কেমন হয়ে যাচ্ছিল শিরাণের চোখের জল দেখে। নিষ্ক্রিয় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। শিরাণেকে গাড়িতে তোলা পর্যন্ত এ অবস্থার পরিবর্তন হয়নি কোন। ওর গুণমুগ্ধ বন্ধু আর অনুগত, দু’জনেই ওকে দেখে অবাক হয়েছে। তারা নাচতে দেখল না হাসতে দেখল না এই প্রথম ইয়াসোকে। বরং ইয়াসোর দু’চোখ চিকচিক করে উঠতেই দেখল যেন। ওস্তাদের মুখের ওপর কোন কথা বলার কোন সাহস নেই ওদের। তাই নির্বাক মুখে ওস্তাদের পূর্বের নির্দেশ পালন করল ওরা। ইয়াসোর সঙ্গে গাড়িতে উঠে বসল।

গাড়ি চলছে, সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই ইয়াসোর। লক্ষ্য কেবল শিরাণের দিকে। শিরাণের চোখের জলের ক্ষীণধারা বোধহয় ওর পাথুরে বুকের মাঝখানে খাঁজ কেটে কেটে বয়ে চলেছে। শিরাণেকে মুক্তি দেবার একটা প্রবল ইচ্ছে পেয়ে বসছে মাঝে মাঝে। নিজেকে সংযত করে নিচ্ছে তখুনি। টাকা খেয়েছে জান কবুল করেছে। কাম বরবাদ হতে দিতে পারবে না ইয়াসো কখনো। খুনে রক্ত মাথার ভিতর টগবগ করে ফুটে উঠছে নতুন করে আবার। শিরাণেকে উদ্ধার করতে আসে যদি কেউ, ধড়ে মাথা থাকবে না তার আর। এ-ভাবটা ধরে রাখবার চেষ্টা করেও পারছিল না। কাল হয়েছিল শিরাণের মায়াবী চোখ।

চোখ বেঁধে দিয়ে ভেবেছিল নিশ্চিন্ত হল। কিন্তু পারল না। পিছন থেকে গাড়ির আওয়াজ কানে আসতেই চমকে উঠল। মুখ ফিরিয়ে গাড়ি আসতে দেখে রাগে সর্বশরীর রি-রি করে উঠল। শিরাণের ওপর থেকে মোহ-মমতা চলে গেল নিমেষে। মনে হল চেনা গাড়িই অনুসরণ করছে। সুরজিত সিংয়ের গাড়ি।

চিঠি দিয়ে বা লোক পাঠিয়ে কোন খবরই যে দিতে পারে না সুরজিত সিংকে শিরাণে, এটা ভালো ভাবে জেনেও, ইয়াসোর সমস্ত আক্রোশ গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল শিরাণের ওপর। মনে হল মেয়েটাকে শেষ করে দেয় এখুনি। ডান দিকের খাদে দিফু নদীর বুকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিষ্কৃতি পায়। সুরজিতের চোখের সামনেই এই কাজ করবে সে। এক ঢিলে দুই পাখী মারবে। একজন মরবে, আর একজন মরে বেঁচে থাকবে।

পিছনের মোটরটা এগিয়ে আসছে। গতি বাড়িয়ে দিয়েছে সুরজিত। ইয়াসোদের গাড়ির গতিও বাড়িয়ে দেওয়া হল। দুটো গাড়ির দূরত্বের ব্যবধান রইল খুব সামান্যই। নিঃসন্দেহ হবার জন্য পিছনের কাচে চোখ রেখে ভালো করে দেখে নিল ইয়াসো, সত্যিই সুরজিত গাড়িতে আছে না চোখের ভ্রম। কোন মানুষই আজ পর্যন্ত তার সামনা-সামনি হতে দুঃসাহস দেখায় নি—সুরজিত তো নগণ্য লোক।

দারুণ ধাক্কা খেল যেন একটা ইয়াসো। সত্যিই সুরজিত। সঙ্গে নেই কেউ। একলাই গাড়ি চালিয়ে আসছে। ভয়-ডর নেই প্রাণে। ইয়াসোর শক্তির মর্যাদাকে অপমান করার জন্য, অবহেলা করার জন্য দুঃসাহস দেখাতে আসছে একলা। ঠিক আছে। উচিত মতো শিক্ষা পাবে ও। মর্মান্তিক শিক্ষা দিয়ে দেবে ওকে ইয়াসোই। বিদ্যুৎ চমকের মতো শিক্ষা দেবার মতলব খেলে গেল মাথার ভিতর চকিতে। ঘনঘন উষ্ণ নিশ্বাস পড়ছে ইয়াসোর। বুকখানা ফুলে উঠছে। মাথায় খুন চেপেছে বুঝি ওর। মাথার রক্ত চোখেও নেমেছে। রক্তজবা চোখদুটো চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে বার বার শিরাণের আপাদমস্তকে।

এগিয়ে আসছে সুরজিতের গাড়ি। আগের দ্বিগুণ গতি বাড়িয়েছে এবার সুরজিত।

মস্ত সুযোগ এসে গেছে ইয়াসের কাছে। পাহাড ফাটানো পৈশাচিক অট্টহাসি হাসল ও। হাসি থামল। রাস্তার বাঁ দিকটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিল একবার। চোখের ইশারায় ড্রাইভারকে কি যেন নির্দেশ দিল। মন্থর গতি হয়ে এল গাড়ির। ইয়াসোর চোয়াড়ে মুখখানা বীভৎস হয়ে উঠল। দু’ধারের চোয়ালের হাড় উঁচু হয়ে উঠল আরো। সুরজিতের গাড়িখানা হুমড়ি খেয়ে পড়বেই এ-গাড়িটার ওপর। রুখতে রুখতেই ঘটে যাবে এই কাণ্ড। চক্ষের নিমেষে ঘটে যাবে অপ্রতিরোধ্য দুর্ঘটনা।

শিরাণেকে গাড়িতে রেখে দিয়ে বাঁদিক ঘেঁষে লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে পড়ল ইয়াসোর সঙ্গে সকলে।

চালকবিহীন গাড়িটা নিয়ে চলেছে অসহায় শিরাণেকে। শিরাণে বুঝতে পারল না, জানতে পারল না কোথায় গাড়িখানা নিয়ে যাচ্ছে তাকে। যাচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যুগহ্বরের দিকে—এটাও না।

প্রথম থেকেই অসম্ভব ভয়ে ভয়ে সমস্ত স্নায়ু তার অবসন্ন। অর্ধ-অচেতন অবস্থায় পড়েছিল। মৃত্যুর চিন্তা ছিল না মোটে। বাঁচবার আকাঙ্ক্ষাই ছিল প্রবল। তাই মৃত্যুর চিন্তাটা মাথার মধ্যে আসে নি একদম। নিজের অজ্ঞাতেই যে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষাকষি করতে চলেছে, তা-ও তার অনুভূতিতে জেগে উঠছে না একবারের জন্য।

কারো ভাবা না-ভাবার ওপর নির্ভর করে অপেক্ষা করে না কোনদিন দুর্ঘটনা। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম দেখা গেল না। দুর্ঘটনা ঘটল! ভয়ানক ভাবেই ঘটল।

পিছন থেকে এ-গাড়িটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল সুরজিতের গাড়ি।

প্রথম গাড়িটা ধাক্কা খেয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে উল্টেপাল্টে গড়াতে গড়াতে দিফু নদীর বুকে গিয়ে পড়ল। আর দ্বিতীয়টা ঘুরে গিয়ে ধারের গামাড়ি গাছটায় ধাক্কা খেতেই দরজা খুলে গেল আপনা থেকেই। বাঁদিকে ছিটকে পড়ল সুরজিত।

গাছ-গাছালির আড়াল থেকে হাসতে হাসতেই বেড়িয়ে এল ইয়াসো। মনস্কামনা সিদ্ধ হয়েছে তার। ব্যর্থ হয় না তার কোন চেষ্টা। তার কোন মতলব ভুল করেও বিশ্বাসঘাতকতা করে নি আজ অবধি তার সঙ্গে।

এক ঢিলে দুটো পাখি মরেছে। নিজেকে নিঃসন্দেহ করার জন্য দু’জনকে দেখার স্পৃহা জেগে উঠল। শিরাণেকে সুরজিতকে। শিরাণে তো বেঁচে নেই নিশ্চয়ই। সুরজিত? যেভাবে আঘাত লেগেছে, ছিটকে পড়েছে, তাতে দেহে প্রাণ না থাকারই কথা। থাকলে ওর মুমূর্ষ অবস্থাতেই ধড় থেকে শির নামিয়ে শেষ করে দেবে একেবারে নিজে হাতেই ইয়াসো।

ইয়াসো এগিয়ে এসে সুরজিতের শিয়রে দাঁড়াল। দেখে মনে হচ্ছে মৃত। অভ্রান্ত দৃষ্টি তার। বাঁ দিকের বুকের ওপরটা কাঁপছে না একটুও। হৃৎপিণ্ডটা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে।

সুরজিতকে ঘিরেই শিরাণের মায়ের চিন্তার অন্ত ছিল না।

নিজের জীবনে নিদারুণ ঘা খেয়েছিল মা। সে ক্ষত শুকোয় নি তার। ক্ষতের যন্ত্রণা ভোগ করছে সর্বক্ষণ। মেয়ের মুখের দিকে তাকালে যন্ত্রণাটা চতুর্গুণ বেড়ে যায়। একান্ত মনে চায় নি মা—সারাজীবন ধরে তার নিজের মতো যন্ত্রণা ভোগ করুক মেয়ে। তার মতো অভিশপ্ত জীবন যেন মেয়ের না হয় কখনো। এইটাই চেয়েছিল। তাই সুরজিতের চোখের বাইরে মনের বাইরে সরিয়ে রাখতে বলেছি ইয়াসোকে। মেয়েকে সরানোর মূলে মা নিজেই। কোহিমায় নিয়ে যেতে মতলবও দিয়েছিল ইয়াসোকে। মেয়ের সুখের জন্য যা করতে চেয়েছিল—তাতে কৃতকার্য হতে না পারলে—মা হয়েও বলেছিল—ভবিষ্যতে দুষ্টক্ষতের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য ওকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে কোন দ্বিধা বোধ করা যেন না হয়।

মিটেছে শিরাণের মায়ের আশা। সরেছে শিরাণে, সরেছে সুরজিত। দ্বিগুণ ইনাম পাবে ইয়াসো শিরাণের মায়ের কাছ থেকে।

ইয়াসোর মনের আনন্দ মুখের হাসিতে উপচে পড়ছে। পাশের সঙ্গীরা ওর হাসি দেখে ওর মনোভাব আঁচ করে তারাও হাসছে।

হাসবে সব শুনে শিরাণের মা-ও। তার ভিতরের আগুন-জ্বলা ক্ষত ঠাণ্ডা হবে এবারে কিছুটা। ইয়াসোকে তারিফ করবে ওর কাজ হাসিল করার পন্থা শুনে, গৃঢ় রহস্য জেনে। মেয়েটার মুখ আর দেখতে হবে না তাকে কোন দিন।

মেয়ের মুখ দেখলেই বেশী করে মনে পড়ত বিদেশী সেনাবিভাগের অফিসারের কথা। মুখ-চোখ অবিকল তারই মতো তারই সঙ্গে অবাধ মেলামেশার ফসল মেয়েটা।

অফিসার এসেছিল এক সন্ধ্যেয় দেশী মদ মধু কিনতে। সন্ধ্যের সেই বিকিকিনির সময় আলাপ হল তার সরল ক্রীশ্চান নাগা যুবতীর সঙ্গে। যুবতী মধু বিক্রি করছিল কাঠের ঘরটায় বসে। যুবতীর মিষ্টি আচার-ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছিল অফিসার। এরপর থেকে আসতে শুরু করেছিল রোজ সন্ধ্যেয়। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েই মেলামেশা আরম্ভ করেছিল। মেয়ে কোলে আসতে আনন্দে করেছিল ওর নামকরণ—শিরাণে।

বড় হয়ে উঠতে লাগল শিরাণে দিন দিন। কিন্তু শত অনুরোধ উপরোধ সত্ত্বেও এগিয়ে আসে নি আর শিরাণের মায়ের কুমারী নাম খণ্ডন করতে। নিজের প্রতিশ্রুতি পালন করে নি। শেষ পর্যন্ত শিরাণের মাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল একদিন বিশ্বাসঘাতক। সেই থেকে কোন খোঁজ খবর নেয় নি আমরা-মেয়ের।

মা বেশ বুঝতে পেরেছিল, মেয়ের জীবন তার দুর্ভোগের খাতেই বইতে শুরু করেছে। বুঝতে পারছে না মেয়ে। প্রত্যেক সন্ধ্যেয় আসছে সুরজিত। শিরাণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠছে। শিরাণেকে বিয়ে করবেও নাকি বলেছে ছেলেটা। সুরজিতের মধ্যে দেখেছে অফিসারকে মা। দেখতে পেয়েছে মেয়ের মধ্যে নিজেকে। তাই আঁতকে উঠেছে ভয়ে মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে।

নিজের জীবন কাহিনী শুনিয়েছে, বাপের কীর্তিকলাপের কথাও জানিয়েছে। তবু সুরজিতের দিক থেকে প্রেমের উজান ঘোরাতে পারে নি মেয়ের মনের। সেনাবিভাগের অফিসার নয় সুরজিত। ব্যবসায়ী। মেয়ের এই বক্তব্য যুক্তি মেনে নেয় নি মা। সুরজিতের ভিতর অফিসারকে দেখার অভ্যাস ছাড়ে নি। তলায় তলায় সুরজিতের কাছ থেকে শিরাণেকে বিচ্ছিন্ন করার পথ বার করতে চষ্টা চলেছিল প্রাণপণে। পথের নিশানা পেয়েছিল। জানিয়ে দিয়েছিল ইয়াসোকে।

মায়ের কথামত কার্য সমাধা করেছে ইয়াসো। সুরজিতের দেহটাকে ফেলে রেখেই সঙ্গীদের নিয়ে চলল অদম্য কৌতূহলে শিরাণের মৃতদেহ দেখে মাকে খবর দিতে।

শিরাণের গাড়ির কাছে এসে বিস্মিত হতবাক হয়ে গেল ইয়াসো। চোখকে অবিশ্বাস করতে, ইচ্ছে করছে। যা দেখছে সত্যি নয়। সত্যি হতে পারে না।

বার চারেক দু’চোখ রগড়ে নিয়ে দেখছে তো দেখছেই। দু’চোখের পাতা নড়ছে শিরাণের। আস্তে আস্তে চোখ খুলছে। গাড়িটার সীটে যে ভাবে ফেলে রাখা হয়েছিল, ঠিক সেইভাবেই পড়ে আছে শিরাণে। তারতম্য হয় নি একটুও।

শিরাণে দেখেছে তোবড়ানো গাড়িটার ভিতর থেকে ইয়াসোকে। ওর উদভ্রান্ত দৃষ্টি। কি হয়েছে ওর ও দু’চোখে জানে না। বোঝে নি।

অগভীর নদীর জলে একটা বিরাট পাথর খণ্ড গাড়িটার চাকা চারটেকে আটকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। আর সেই গাড়ীটার ভিতর অক্ষত দেহে বেঁচে পড়ে রয়েছে শিরাণে।

এ কেমন করে হল?

ইয়াসোর অস্থি থেকে, মজ্জা থেকে, দেহের প্রতিটি রোমকূপ থেকে এই একই প্রশ্ন উঠতে লাগল বারবার। কোন লোক এসে পড়ার আগেই সঙ্গী বন্ধু শিরাণেকে নিঃশেষ করে ফেলবার জন্য এগুচ্ছিল তাড়াতাড়ি, বাধা দিল ইয়াসো। ধারালো চকচকে ছোরাটা কেড়ে নিল হাত থেকে। মরণের মুখে পড়েও যে মরল না তাকে কেউ মারতে গেলে বাধা দেওয়াই উচিত ইয়াসোর।

ইয়াসো যেন কিরকম হয়ে যাচ্ছে। ওর পাথুরে বুকে ভাঙন ধরছে। ভেঙে টুকরো হয়ে যাচ্ছে। উদ্ধার করল শিরাণেকে। নিজে কঠিন বাঁধন খুলে দিল শিরাণের। সঙ্গীরা অবাক চোখে দেখল ওকে। দেখল ও নতুন মানুষ। নতুন কাজ করল।

এরপর সুরজিতের দেহটার কাছে আসতে বিস্ময়ের পর বিস্ময় ঘিরে ধরেছে ইয়াসোকে। যাকে মৃত ভেবেছিল, সে মৃত নয়, অচেতন। আগে যা দেখেছিল ভুল। বাঁ দিকের বুকের কাছটায় মৃদু কম্পন দেখতে পাচ্ছে স্পষ্ট। ইয়াসোর প্রথমের দৃষ্টিভ্রমই ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

‘অনেক চেষ্টা করে জ্ঞান ফিরিয়ে এনেছিল ইয়াসো সুরজিতের’ স্টিয়ারিং ধরে ঘাড় ফিরিয়ে হাসতে হাসতে কথা বলল ইয়াসো এতক্ষণ বাদে। জানাল সুরজিতের তাদের পিছনে আসার অদ্ভুত ব্যাপারটাও।

শিরাণেকে ইয়াসো সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে একথা সুরজিত শোনে নি কারো মুখে। এ সম্বন্ধে সে কোন কিছুই জানে না। রেডিওর প্রভাতী অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়েছে তখন। চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে। কাপটা ঠোঁটে ঠেকিয়েছে সবে। এমন সময় রেডিওর গানটায় যেন শিরাণের কান্নার সুর শুনতে পেল। পরে কান্নার সুরটা যেন বাইরের দিক থেকে ভেসে আসতে লাগল। বাইরে বেরিয়ে কান্নাটা আবার আরো দূর থেকে আসছে মনে হল। মোটরে উঠে বসল ও-কান্নার সুরের অনুসন্ধান করবে বলে। শিরাণের কান্নার সুর শুনে শুনেই সে এগুচ্ছিল।

শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছিল ইয়াসো। তাদের গাড়িতে মুখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে রয়েছে তখন শিরাণে। অথচ কান্নার সুর শুনতে পাচ্ছিল সুরজিত।

আমি তাকালুম আমার ডান পাশে শিরাণের মুখের দিকে। মৃদু মৃদু হাসছে ও। এবারে বাঁ পাশে চোখ ফিরল। সুরজিতের চোখ-মুখও হাসছে।

গাড়ি চলছে আমাদের। দুর্ঘটনার জায়গাটা অতিক্রম করল ধীরে ধীরে।

গাড়ির গতি বাড়ছে আবার একটু একটু করে। আমাদের চারজনেরই মুখ বন্ধ এখন। শিরাণে সুরজিতের পর ইয়াসোও বলেছে। সম্পূর্ণ হয়ে গেছে কাহিনী।

ওরা মনে মনে কোন কথা কইছে কি না তা আমি জানিনে। দেখে বুঝতে পারছিনে কিছু। আমি কিন্তু মনে মনে কথা কইতে লাগলুম। ভালো লাগছিল খুব আমার। সেদিনের ঘাতক আজ দেহরক্ষী চালক। সেদিনের মরণ পথের যাত্রী দু’জন আজ স্বামী-স্ত্রী।