দিনের বেলায়ও রাতের অন্ধকার নেমে রয়েছে জায়গাটায়। বাইরে থেকে বুঝতে পারা যায় নি অত। অন্য গাঁয়ের ভিতর দিয়ে এখানে আসবার সময় অনেকেই গাড়োয়াল হিমালয়ের এই সিনচুরি বনভূমির অনেক কথাই শুনিয়েছে। এটা রাক্ষুসে অরণ্য। এখানকার রডোডেনড্রন, পাইন আর চীর গাছগুলো একেবারে মানুষখেকো দানবদের বংশধর। গাছ সেজে ঘন জঙ্গলের ফাঁদ পেতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সব। এখনো কত নর-কঙ্কাল এখানে ওখানে পড়ে রয়েছে ভিতরে।
গ্রামবাসীরা আমাদের—আমি আর আমার সঙ্গী তিনজন বন্ধুর হাত ধরে ধরে অনুরোধ করেছে—দূর পথের ব্যবধান ঘোচাতে এ-জায়গাটা বেছে নেওয়া যেন না হয় মোটে। নিলে বাবুসাবদের বিপদ অনিবার্য। এ বনটা আশ্চর্যভাবে সবুজের নেশা ধরায় পথিকের দু’চোখে। ভিতরে আসবার অদম্য বাসনা উন্মত্ত করে তোলে তাকে। সংযত করে রাখতে পারে না কিছুতেই নিজেকে। নিজের অজান্তেই অরণ্যের ভিতরে চলে আসে পথিক। তারপর চোখের সামনে দেখতে থাকে বেরোবার শত-সহস্র পথ। যে পথেই পা বাড়াক, সেই পথই টেনে নিয়ে যায় ভিতরে—অনেক ভিতরে। অরণ্যের গহন থেকে আরো গহনে।
গাঁয়ের লোকদের ভীতু ভেবে ওদের কোন কথাই বিশ্বাস করি নি। বরং উপেক্ষা করেছিলুম আমরা। ওদের কথাতেই জায়গাটা দেখবার কৌতূহল জেগে উঠেছিল আরো আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে।
আমরা এসেছি গ্রামবাসীদের সেই রাক্ষুসে জায়গাটায়। গাছের ফাঁক দিয়ে দিয়ে প্রবেশ করেছিল ভিতরে। চতুর্দিকে সবুজের সমারোহ দেখে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি সকলে। এখানে না এলে, প্রকৃতি শিল্পীর নিপুণ হাতে গাছগাছালি সাজানোর সুন্দর ছবি দেখার একটা অনাস্বাদিত আনন্দ উপভোগ করতে পারতুম না আমরা। যত চারদিক দেখছি তত যেন নিজেদেরই ভুলে যাচ্ছি। দাঁড়িয়ে আছি তত দাঁড়িয়েই আছি সবাই।
আচমকা চমক ভাঙল আমাদের রেফারীর হুইসিলের মত তীব্র আওয়াজ কানে এসে বাজতে। একটানা আওয়াজটা সকলের কানের পাশে পাশে ঘুরছে। কিসের আওয়াজ এ বনভূমির নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান করে দিল, বুঝে উঠতে পারলুম না কেউ।
বেরোবার জন্য প্রস্তুত হয়ে, বেরোবার পথে পা বাড়ালুম সবাই। চলছি ত চলছিই। হঠাৎ খেয়াল হল, অরণ্যের অন্ধকার রাজ্যের গহনে তলাতে শুরু করেছি যেন আমরা ধীরে ধীরে।
টর্চের আলো ফেললুম, বেরুবার অগুণতি পথ দেখতে পেলুম চোখের সামনে। বেছে নিলুম অন্য পথ। এখানেও আগের ভুলই করলুম। টর্চ নিবোতে ঘন অন্ধকারই দেখলুম শুধু। বাইরের আলো নজরে পড়ল না কারো। ছেড়ে ছিলুম এপথও। ধরলুম আর একটা পথ আবার।
এইভাবে এক এক করে বেশ খানিকক্ষণ পথ পরিবর্তনের পালা চলল আমাদের। এপথ ওপথ সেপথ ধরে বেরুবার বৃথা চেষ্টায় ক্লান্ত হয়ে শেষে বসে পড়লুম চীরগাছ তলায়।
অরণ্যের অন্ধকূপে বসে আছি চার জনে বেশ বুঝতে পারছি। গ্রামবাসীদের কথা মনে পড়ছে এবার। ওদের সাবধানবাণী বেজে উঠছে আমাদের নিশ্বাসেপ্রশ্বাসে।
খানিক থেমে থাকার পর হুইসিলের মত আওয়াজটা কানের পরদা ফাটিয়ে তুলতে লাগল আবার।
কিছুক্ষণ আগের দেখা বনভূমির সৌন্দর্যের নেশা কেটে গেছে আমাদের চোখ থেকে। তার বদলে বনভূমির বিভীষিকার রূপটাই ফুটে উঠছে কেবল চোখের সুমুখে। বেরুবার ব্যর্থ চেষ্টাটাই হতাশা এনে দিয়েছে বেশী করে। হতাশার বোবা যন্ত্রণা স্নায়ুগুলোকে নিস্তেজ করে ফেলছে ক্রমে। মনোবল হারিয়ে ফেলছি আমরা। একটা অজানা আশঙ্কা পেয়ে বসছে সকলকে।
বসে বসে ভাবছি আমি। অনন্তকাল ধরে এখানে—এই গাছতলায় বসে বসে ভাবলে, কেউ আসবে না। উদ্ধার করে পথ দেখিয়ে নিয়েও যাবে না কেউ। সঙ্গের খাবার ফুরিয়ে যাবে ক’দিন বাদে। নতুন করে খাবার যোগান দিতে আসতে দেখতে পাব না এখানে কাউকে।
এইভাবে আত্মীয়-স্বজন থেকে চিরবিচ্ছিন্ন হয়েই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হবে হয়তো আমাদের একদিন। প্রিয়জনরা নিরুদ্দেশের ডায়েরীতে আমাদের নাম ক’টা লিখে রাখবে শুধু।
গ্রামের লোকের কথাগুলো মনে-কানে ঘা মারছে থেকে থেকে। মনের ভয় চোখে ছেঁকে ধরেছে কিনা—জানিনে। তবে মনে হচ্ছে সত্যিই যে দেখছি চারপাশের গাছগুলো এক একটা নর-কঙ্কাল। ওদের হাড়ের হাতগুলো উঁচু থেকে আমাদের গলার দিকে এগিয়ে আসছে আস্তে আস্তে।
রুদ্ধনিশ্বাসে দেখছি আমি—আমি কেন—আমরা চারজনেই এই দৃশ্য দেখছি একসঙ্গে। অসহায় মনে অসহ্য মৃত্যুযন্ত্রণা অনুভব করছি আমরা প্রত্যেকে। এমনই অবস্থা আমাদের যে, হাতের কাছে টর্চ থাকা সত্ত্বেও জ্বালতে পারলুম চারজনের একজনও। অবশ হাত নড়াচড়া করতে পারল না একটুও।
চার বন্ধুর ঠিকুজি-কুষ্ঠিতে নাকি জাতকের নির্ভীক-দুঃসাহসী প্রকৃতির বর্ণনা করা হয়েছে প্রতি ছত্রে ছত্রে। তবে এ ভয় এ দুর্বলতা কেন? নিজের কাছে নিজেকেও বিস্ময় ঠেকছে। আলো জ্বালবার শেষ চেষ্টা করেও পাথরভারী হাত দু’খান তুলতে পাবলুম না একটুও আমি।
টর্চের আলো জ্বলল না বটে, কিন্তু সেই মুহূর্তে দূরে লণ্ঠনের আলো চোখে পড়ল আমাদের। অবাক চোখে দেখছি আমরা লণ্ঠনটা এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। মাঝে মাঝে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, আবার দৃষ্টিপথে ভেসে উঠছে। লণ্ঠনটা যেন উঁচুনীচু হয়ে দুলতে দুলতে এগিয়ে আসছে।
অদ্ভুত কাণ্ড! শূন্যে ভাসতে ভাসতে লণ্ঠন আসছে। এল। একেবারে সামনা-সামনি এসে থামল। ছাইরঙের সালোর-মির্জাই পরী পাহাড়ী লোকটা লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে আমাদের দিকে চেয়ে। এতক্ষণ লোকটার পরনের পোশাকের রঙ অন্ধকারে মিশে ওকে আমাদের চোখে অদৃশ্য করে রেখেছিল।
এসময় এই ভাবে এই নিরালা জায়গায় আগন্তুক এল কি করে, কেন এল? প্রশ্ন দুটো জিবের ডগায় এসে থমকে গেল আগন্তুকের স্পর্শে। প্রত্যেককে হাত ধরে ধরে সযত্নে তুলে দাঁড় করিয়ে দিয়ে হাতের ইঙ্গিতে তাকে অনুসরণ করতে বলল।
আগন্তুককে অনুসরণ করে চলেছি আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত।
মানুষটাকে প্রথমে দেখে কেমন একটা সংশয় জেগে উঠেছিল মনে। শরীরী, অশরীরী? ওর উষ্ণ স্পর্শে সংশয়ের মেঘ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছল নিমেষে। রক্তমাংসের মানুষকেই কাছে পেয়েছিলুম। মনে সাহস এসেছিল। কিন্তু মানুষটাকে দেবতা-প্রেরিত ভাবতে গিয়েও, ভাবতে পারি নি। বিশ্বাস করতে পারি নি ঠিক মত। কেবলি মনে হতে লাগল, এক বিপদ থেকে উদ্ধার হতে গিয়ে আর এক বিপদের ফাঁদে পা দিতে যাচ্ছি না তো আমরা শেষে! লোকটা হয়তো বনে ঢোকার আগে দেখে থাকবে আমাদের। কাছে কিছু লামসাম আছে ভেবে নিজের খপ্পরে নিয়ে গিয়ে ফেলছে বুঝি। বনের মধ্যে সুযোগ পেয়েও কোন হামলা করতে সাহস করে নি। ঢোকবার মুখে ওকেও নিশ্চয় দেখেছে কেউ—সেই ভয়ে।
অবিশ্বাসের ওপর অবিশ্বাস আর নানা রকমের অকাট্য যুক্তি তোলপাড় করছে ভিতরে আমার। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি, লোকটার এমনই একটা প্রবল আকর্ষণ যে, মনের মধ্যে যাই হোক না কেন—ওকে অনুসরণ করে আমরা ঠিকই এগিয়ে চলেছি। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে পড়তে পারছি নে, থামতে পারছি নে। আমরা থামতে না পারলে কি হবে—লোকটা নিজেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল হঠাৎ চলতে চলতে। লণ্ঠনটা পাশে ঘোরাল। মৌন মুখ খুলল, বলল, এরকম কঙ্কাল এপাশ ওপাশ খুঁজলে পাওয়া যাবে আরো।
সর্বশরীর শিউরে উঠল আমার। বন্ধুদেরও অবস্থা আমারই মত। লোকটার বিশেষ করে কঙ্কাল দেখানোর উদ্দেশ্য কি—বুঝলুম না। সন্দিগ্ধ মন আমার আরো সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল। মনে হল, স্নায়ু গুলো সতেজ হয়ে উঠেছিল— নিস্তেজ করে দেবার জন্য—মনোবল ফিরে পাচ্ছিলুম—ভেঙে দেবার জন্য নিশ্চয়ই এই পন্থা অবলম্বন। শিকারকে দুর্বল করে রাখলে শিকার করা সহজসাধ্য চতুর শিকারীর।
চলতে শুরু করল আবার আগন্তুক।
এবারে পা চলার সঙ্গে মুখ চলাও আরম্ভ হল তার।
—জায়গাটা ভয়ানক। অনেকেই এখানে এসে ফিরে যেতে পারে নি আর। এসব জানত না শঙ্করলাল। সরল প্রাণেই এসেছিল এলাহাবাদ থেকে পূর্বপুরুষদের গাড়োয়ালের জন্মভিটে দেখতে।
বাধা দিয়েছিলেন তার বাবা। মা-হারা ছেলেকে মায়ের কথা তুলে বাঁধতে চেষ্টা করেছিলেন। তিমলিগাঁও দেখতে যাবার জিদ থেকে সরাতে চেষ্টা করেছিলেন। মৃত মা-ঠাকুমার ফটোর সামনে ছেলেকে দাঁড় করিয়ে অতীত কাহিনী শুনিয়েছিলেন নতুন করে।
ঠাকুর্দার রক্তের কণায় কণায় অজানাকে জানবার আহ্বান ছুটোছুটি করে বেড়াত। বাঁধা-ধরার মত ঘরে বেশীদিন স্থির হয়ে থাকতে পারতেন না একদম। সবার অজান্তেই একা নতুন পাহাড় নতুন বনভূমি দেখবার জন্য নিশুতি রাতে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেতেন।
এই ভাবেই একদিন অজানা পথে পাড়ি দিয়ে নিরুদ্দেশ হলেন তিনি। বছরের পর বছর ঘুরল, তবু কোন খোঁজ-খবর পাওয়া গেল না। দেখা মিলল না তাঁর আজ অবধি।
হয়তো আর এ জগতে নেই তিনি—একথা মৃত্যু অবধি মেনে নেন নি ঠাকুমা। বেঁচে আছেন—এই ধারণা মনে পুষে, এয়োতির চিহ্ন ছিন্ন না করে সধবার সাজেই সেজে থাকতেন তিনি দিনরাত। ওই সাজেই চলে গেলেন।
বাবাকেও বাইরে বেরুবার নেশা থেকে নিবৃত্ত করেছিল শঙ্করলালের মা। মরণের সময় প্রতিশ্রুতি করিয়ে নিয়েছিলেন তিনি স্বামীকে ছেলেকে বাইরে যেতে দেওয়া যেন না হয়। শ্বশুরের কথা মনে করেই এটা করিয়েছিলেন তিনি।
মাথা নীচু করে বাবার কথা গুলো শুনল শঙ্করলাল। সংসারের এসব ইতিহাস আগে থেকেই জানা। দশ বছর বয়সে শুনেছে ঠাকুমার কাছে, তারপর মায়ের কাছে। তারপর পূর্ণ যৌবনে এই বাইশ বছর বয়সে শুনল আবার বাবার মুখে।
বাবার ছলছলে চোখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল বার কয়েক। মন ট লল না, গলল না। জাগল না কোন মমতা। নির্ভীক গলায় জানাল, এটা তো নিছক অ্যাডভেঞ্চার নয়—এটা আদি পুরুষদের জন্ম-ভিটে দেখা। দুটোকে এক করে দেখা ঠিক নয়।
শঙ্করলালের কাছে বাবার সিদ্ধান্তটা ঠিক নয় মনে হতেই, রাত-দুপুরে চুপিসারে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল ঠাকুর্দার মতই পথে।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে, একটু থামল আগন্তুক। দম নিল বোধহয়। এবারে আমাদের দিকে মাঝে মাঝে তাকাতে লাগল বলতে বলতে। আগন্তুক বলছে আর চলছে।
আমরা চলছি আর শুনছি। শুনতে ইচ্ছা করছে না। তবুও কথাগুলো কানে যাচ্ছে আপনা হতেই। মনে হচ্ছে, এসব অপ্রাসঙ্গিক। স্রেফ ভয় ধরানোর জন্যই বানিয়ে বানিয়ে কাহিনীর মালা গাঁথছে লোকটা।
উত্তেজনায় কেঁপে কেঁপে উঠছে আগন্তুকের কণ্ঠস্বর।
—সামনের এই নদীটা তখনো বয়ে চলেছিল এইভাবে। তখনো এর বুকের ওপর ওই রকমেরই বড় বড় গাছ দুটো লম্বালম্বি ভাবে পড়েছিল। গাছের সাঁকোর ওপর দিয়ে পা টিপে টিপে বনভূমিতে এসে পৌঁছেছিল শঙ্করলাল।
ঘুরতে ঘুরতে এ-জায়গাটার কাছ বরাবর আসতেই যে উদ্দেশ্যে আসা ভুলে গেছল একেবারে। তার বদলে এই জায়গাটার মোহই পেয়ে বসেছিল তাকে।
বনের ভিতর প্রবেশ করে, শোভা দেখতে দেখতে আত্মহারা হয়ে গেছল। হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি শুরু হতে সচেতন হয়ে উঠল, প্রমাদ গণল। গাছের পাতা বেয়ে বেয়ে বৃষ্টির বরফজলের বড় বড় ফোঁটা পড়ছে মাথায় গায়ে। বাতাস বইছে শন শন করে, থরথরিয়ে কেঁপে উঠছে বনভূমি। মনে হচ্ছে মহাকালের কবলে পড়ে নাকানি-চুবানি খাচ্ছে। নাভিশ্বাস উঠছে।
স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না কোন গাছের তলাতেই শঙ্করলাল। কেবলি এটা ছেড়ে ওটা, ওটা ছেড়ে সেটার তলায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। আকাশের তলায় গাছের ছাদ নড়ছে বড় বেশি। গাছ গুলোর মাথা ভেঙে ভেঙে ছাদের জোড় খুলে গিয়ে শঙ্করলালের মাথায় পড়ে বুঝি এখুনি।
মৃত্যুত্রাসে বুদ্ধিভ্রম হল শঙ্করলালের। দিশেহারা হয়ে ছুটতে লাগল চতুর্দিকে। বনভূমি থেকে বেরিয়ে যাবে প্রাণ বাঁচাতে। নদীর ধারে এসে দাঁড়াল। খরস্রোতা নদী তখন ভীষণ মূর্তি ধরেছে। ওর দুর্দান্ত বেগ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে কোথায় গাছদুটোকে। উধাও হয়েছে গাছের সাঁকো। বিচ্ছিন্ন হয়েছে দুপারের সংযোগ। ছুটল বিপরীত দিকে। বিস্মিত চোখে দেখল, বিরাট ধস নেমেছে। যাবার পথ বন্ধ।
ছুটল অন্যদিকে। এবারে বনভূমির মায়াজাল-বিছানো ভয়ঙ্কর পথে পা বাড়াল। পথের পর পথ পরিবর্তন করে করে ভুলের পর ভুলই করতে লাগল শঙ্করলাল। বাইরে বেরুতে গিয়ে ভিতরের দিকেই এগুতে লাগল। অন্ধকারের মৃত্যুগহ্বরে এসে হাজির হল শেষে।
পা টলছে, মাথা ঘুরছে। বসে পড়ল ঘাসের ওপর। সাইরেন পোকাগুলো হুইসিলের মত তীব্র তীক্ষ্ণ আওয়াজ তুলতে লাগল।
সপসপে ভিজে পোশাক পরে বসে বসে বৃষ্টির জলে ভিজছে শঙ্করলাল। কাঁপুনি ধরছে সর্বশরীরে। এইভাবে যন্ত্রণাভোগ চলল ঘণ্টাখানেক—বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত। এক যন্ত্রণাভোগ শেষ হতে না হতে নতুন যন্ত্রণাভোগ শুরু হল আবার। বুকে হাঁটু গুজে জড়সড় হয়ে বসেছিল। বসতে পারল না আর এক মুহূর্তও। ঘাসের ওপরই শুয়ে পড়তে বাধ্য হল প্রবল জ্বরের আক্রমণে। দুদিন ধরে চলল এই জ্বরের দাপট শঙ্করলালের ওপর। জোটেনি ওষুধ, জোটেনি সেবা, জোটেনি কোন পথ্য। অর্ধচেতন অবস্থায় শঙ্করলাল দুচোখ বুজে-বুজেই দেখেছে অতীত, শুনেছে অতীতের কথা।
ছোটবেলায় একবার এই রকম জ্বর হয়েছিল তার। তখন মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে দেবতার কাছে প্রার্থনা করতেন মা—শঙ্করলাল তাঁই বাঁচাই দেঁও।—ঠাকুর, শঙ্করলালকে রক্ষে কর। বাঁচিয়ে তোল। এ ধরনের প্রার্থনা ঠাকুমাকেও করতে শুনেছে। বাবাকেও করতে শুনেছে।
জনমানবহীন জায়গায় আজও যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে শঙ্করলাল ওদের তিনজনের মিলিত কণ্ঠস্বরের প্রার্থনা। তিনজনের দুজন নেই—মা-ঠাকুমা! আছেন কেবল বাবা। কিন্তু মৃত জীবিত-সকলেরই কথা কানে বাজছে থেকে থেকে—বাঁচাই দেঁও।
যে দুজন নেই পৃথিবীতে, তাঁদের কথা শুনছে কেমন করে! যিনি রয়েছেন তিনিও ত এখান থেকে অনেক দূরে। তবে? হয়তো তার বাঁচবার প্রবল ইচ্ছে’ই অতীতের প্রার্থনার সুরে কথা কয়ে উঠছে। প্রার্থনায় কথা কয়ে উঠলেও কে শুনবে, কে-বাঁচাবে তাকে এ-যাত্রা? বাঁচাবার কেউ নেই। শোনবার কেউ নেই।
শঙ্করলাল যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। মনের চোখে দেখছে শুধু মৃত্যুর উদ্যত খড়্গ। এগিয়ে আসছে তার দিকে ধীরে ধীরে। এই সময়টায় তার পরমায়ু শেষের কথা নিশ্চয় লেখা আছে বিধির বিধানে। অসাড় হয়ে আসছে সমস্ত দেহটা শঙ্করলালের। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে বুঝি এখুনি। দু’চোখ খুলতে শেষ চেষ্টা করছে। পারছে না। ভিতরে অন্ধকার, বাইরে অন্ধকার। ডুবছে অন্ধকারের অতল তলে শঙ্করলাল। ডুবছে ডুবছে ডুবছে—
বলদেওরামের দরজায় কে যেন ধাক্কা দিল জোরে। চারপাইয়ে শুয়েছে কিছুক্ষণ বলদেওরাম। আধ-ঘুমন্ত অবস্থা তখন। ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ল। দরজার কাছে এল। খুলল। দেখল একটা লোক চলে যাচ্ছে পিছু ফিরে তাকাতে তাকাতে।
লোকটার যন্ত্রণাকাতর দুচোখ ডাকছে তাকে। চলতে চলতে ও দুমড়ে পড়ছে। কুঁকড়ে যাচ্ছে। একটু থেমে ওই অবস্থাতেই আবার চলছে আর চোখের ইশারায় বলদেওরামকে ডাকছে। যে দিকটায় যাচ্ছে সেটা বনভূমির পথ। চকিতের মধ্যে ঘরে গিয়ে লণ্ঠন নিয়ে এল বলদেওরাম। তার মনে হতে লাগল, নিশ্চয় বনভূমির ভিতর কিছু একটা ঘটেছে। লোকটার সঙ্গীর কোন বিপদ আপদ হয়ে থাকবে হয়তো। ওর চলনের ধরন-ধারণ দেখে মনে হয় অসুস্থ। অসুস্থ হয়েও তাকে ডাকতে এসেছে সঙ্গীর জন্যই। কথা কইবার দাঁড়াবার একটুও অবকাশ নেই তাই। দ্রুত পায়ে এগিয়েই যাচ্ছে।
অনুসরণ করে চলেছে বলদেওরাম।
বনভূমির মধ্যে প্রবেশ করল লোকটা। প্রবেশ করল বলদেওরামও। বেশ খানিক এগুবার পর লণ্ঠনের আলোয় পরিষ্কার দেখতে পেল, সামনের মানুষটা হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল একটু দূরে। ছুটে এল কাছে সে। দেখল পড়ে রয়েছে ঘাসে মুখ গুঁজে। গায়ে হাত দিয়েই চমকে উঠল। পুড়ে যাচ্ছে গা জ্বরে।
সেবা-শুশ্রুষায় ওকে সুস্থ-সচেতন করে তোলবার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। কিছুক্ষণ বাদে ঘাড় উঁচু করে মুখ তুলতে দেখল। দেখল চোখ খুলে তাকাতে। দু’চোখের কাতর আকুতি দেখে বলদেওরাম জানতে চাইল, কার জন্য ডেকে এনেছে তাকে এখানে। বিস্মিত ক্ষীণ কণ্ঠের জবাব শুনল—উত্থানশক্তিরহিত আজ ওর দুদিন ধরে।
আশ্চর্য হয়ে গেল বলদেওরাম। এই চোখ-জোড়াই ডেকেছে তাকে বার বার…এটা অতি সত্যি। অথচ মানুষটা কিছুই জানে না। এ এক অজ্ঞাত রহস্য।
বলদেওরাম উদ্ধার করে নিয়ে এল লোকটাকে নিজের শ্লেটপাথরের ঘরে। যাকে নিয়ে এল ঘরে—সে-ই শঙ্করলাল।
পরিষ্কার হিন্দীতে শঙ্করলাল-কাহিনী শোনাতে শোনাতে শ্লেটপাথরের ডেরায় এনে চারপাইয়ের ওপর বিশ্রাম করতে বলল আমাদের চারবন্ধুকে আগন্তুক। মৃদু হেসে জানাল—এটাই বলদেওরামের ডেরা। নিজের পরিচয় দিয়ে অবাক করে দিল আমাদের—সে-ই বলদেওরাম।
এরপর বনে আটকে পড়া মানুষের উদ্ধার করার বাকি কাহিনীটুকু শোনাতে লাগল বলদেওরাম আমাদের সামনে কাঠের বড় বাক্সটার ওপর পা ঝুলিয়ে বসে।
আগে অনেকেই বনের ভিতর আটকে পড়ে মরেছে। তাদের কঙ্কাল এখনো দেখতে পাওয়া যায়। আগে যেত না কোনদিন কাউকে উদ্ধার করতে বলদেওরাম বনভূমিতে। শঙ্করলালের ব্যাপার নিয়েই বনের মধ্যে যাওয়া শুরু তার।
শঙ্করলালের পর থেকে আজ অবধি যে-কেউ বনের ভিতর আটকে পড়েছে—দেখেনি সে কাউকে শঙ্করলালের মত আগে। দেখেনি কোন বিপন্ন লোকের করুণ চোখের আহ্বান। শুধু একটা দারুণ অস্বস্তি অনুভব করেছে ভিতরে। বনভূমি প্রবল আকর্ষণ করেছে যেন তাকে। ঘরের বার করে ছুটিয়ে নিয়ে গেছে যেখানে গভীর অরণ্যে আটকে পড়েছে পথহারা কোন হতভাগ্য মানুষ।