চারদেয়াল এগিয়ে আসছে ক্রমশ চারদিক থেকে। শুয়ে আছে বনমালা মাঝখানে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে যাবে একদম আর একটু পরেই। বেশ বুঝতে পারছে, মৃত্যু শিয়রে উপস্থিত। এই ভাবেই তার মতো মৃত্যু-যন্ত্রণা ভোগ করে গেছে বোধহয় নবাবী আমলের এক একজন সুন্দরী। জীবন্ত সমাধি দেওয়া হত সেখানে চার দেয়াল গেঁথে। এখানে দেয়াল গাঁথা হয়নি, বনমালার নিজের ঘরেরই দেয়াল চেপে-পিষে মারবার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে।
বুকের ওপর কোন একটা ভারী বস্তু চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তার। বস্তুটা কি বুঝে উঠতে পারছে না। তবে ভীষণ ভারী হয়ে উঠছে। হাড় পাঁজরাগুলো মটমট করে ভেঙে গুড়িয়ে যাবে বুঝি এখুনি। অসহায় অবস্থা। সাহায্যের জন্য যে কাউকে ডাকবে সে ক্ষমতাও নেই। জিভটা টানছে ভিতর দিকে। গলা থেকে বুক অবধি শুকিয়ে কাঠ। চেষ্টা করেও মুখ দিয়ে একটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে না। বনমালা মনে মনে ডাকছে নাগরাজকে। তুমি এস! রাক্ষুসে দেয়াল চারটের মারাত্মক খপ্পর থেকে আমাকে উদ্ধার কর। আমাকে বাঁচাও। বুকের ওপর থেকে বোঝাটাকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে দাও এখুনি। সইতে পারছি নে আমি আর একতিলও।
কেউ এল না। নাগরাজ তো নয়ই। বনমালার মনের ডাক, আকুতি কারো কানে পৌঁছবার কথা নয়। পৌঁছয়নি। মনের কানেও পৌঁছতে পারেনি কারো। মাঝ রাতে ঘুমে অচেতন প্রায় সবার মন।
বুকের তলায় একটা অসহ্য-অজানা ব্যথার খোঁচায় বনমালার ঘুম ভেঙে গেছিল আচমকা। চোখ খুলে চতুর্দিকে তাকাতেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে সর্বশরীর শিউরে উঠল। দেখল, দেয়াল চারটে জীবন্ত হয়ে উঠেছে…চোখ চেয়ে থাকতে পারেনি বেশীক্ষণ। বুজে ফেলেছে।
উঠতে পারছে না। নড়তে পারছে না। সমস্ত দেহটা অবসন্ন-অবশ।
প্রাণের চেয়ে বড় আর কিছু নেই দুনিয়ায়। ভিতরের বাঁচার তাগিদে অসাড় অঙ্গে সাড় এসে গেল যেন হঠাৎ। নেভবার আগে প্রদীপ জ্বলে উঠল যেন। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে জোর করে দু’চোখ খুলতে চেষ্টা করল। পালাবার যদি কোন সুবিধে পায়, পালাবে। জানালা দরজা খুলতে পারলে, বাইরে লাফিয়ে পড়েও প্রাণ বাঁচাবে।
চোখ খুলে তাকাতেই ভয়ানক ভাবে একটা ধাক্কা খেল বনমালা। বুকের মাঝখানে পান্না বসানো লকেটটার ওপর একটা মুখ! স্পষ্ট দেখছে ডিমলাইটের ফিকে সবুজ আলোয়। মুখখানা অজানা কোন বৃদ্ধার। এরকম চামড়া কোঁচকানো মাকড়সার জাল আঁকা মুখ এর আগে কখনো কোথাও দেখেনি। বৃদ্ধার তীক্ষ্ণ স্থির দৃষ্টি আটকে পড়েছে তার মুখের ওপর। কোটরগত চোখের আগুনের হলকায় বনমালার সমস্ত মুখ ঝলসে যাচ্ছে। এভাবে ঝলসাতে থাকলে মুখ বিকৃত হয়ে যাবে। দু’চোখ অন্ধ হয়ে যাবে জন্মের মতো।
বনমালার চোখ মুখ গলা বুক জ্বলছে। ভীষণ জ্বলুনি। অসহ্য হয়ে উঠছে। তাকিয়ে থাকতে পারল না আর। আপনা হতেই দু’চোখের পাতা নেমে এল। বেঁহুশ হয়ে পড়ল বনমালা।
জ্ঞান যখন ফিরল, তখন সকাল হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। পুবের জানালা দিয়ে আকাশের রোদ এসেছে ঘরে। প্রথম চোখ চাইতে আঁতকে উঠল বনমালা। নাগরাজের মুখে রাতে দেখা বৃদ্ধার মুখটাই দেখল যেন আবার দিনের আলোয়। অচৈতন্য হয়ে পড়ল এবারেও।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় নাগরাজ স্ত্রীকে নিয়ে মহা ফাঁপরে পড়ল। স্ত্রী তাকে দেখলেই চমকে উঠছে, চোখ বুজছে, জ্ঞান হারাচ্ছে।
এই অবস্থা চলল দিন তিনেক। ডাক্তার বৈদের কোন ওষুধই কাজে লাগল না। কি রোগ ধরতে পারল না কেউ অনেক চিন্তা গবেষণা করেও।
রুগীর মুখ থেকেও কোন কথা শুনতে পেল না যাতে রোগের কারণ খুঁজে বার করা যায়।
বনমালার অবস্থা শোচনীয়। শুধু স্বামীর মুখ কেন, সম্বিৎ ফিরলে যে কোন লোকের মুখ চোখের সামনে পড়েছে, আত্মীয় স্বজন মায় ডাক্তার-বৈদের মুখেও ওই ভয় ধরানো জ্ঞান হারানো একটা মুখই দেখছে কেবল। বৃদ্ধার—অন্য কারো নয়।
বৃদ্ধার মুখ দেখার সঙ্গে সঙ্গে নিজের মুখ বন্ধ হয়েছে। যন্ত্রণার কথা বলতে গিয়ে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছে। কোথায় কোন অজ্ঞাত দেশের কোন গহন অন্ধকারে অতল তলে তলিয়ে গেছে নিমেষে।
বরাবরের সুস্থ নীরোগ বনমালার ক্ষণে ক্ষণে অজ্ঞান হয়ে পড়া ব্যামোর কথা চতুর্দিকে আপনজনদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। সকলেই দেখতে এল। বাড়ি ভর্তি লোকে লোক। রোগ সম্বন্ধে হিতাকাঙ্খীদের ধারণা এক এক জনের এক এক রকম। নিরাময় করে তোলবার উপদেশও ভিন্ন ভিন্ন। পরস্পরে মতপার্থক্যও যথেষ্ট।
তবুও অন্ধকারে আলোর দিশারা ভেবে নিয়েছে নাগরাজ প্রত্যেকের মতকে। সাধ্যমত তাদের কথা রাখতে চেষ্টা করেছে। উপকার হয়নি কিছু বনমালার। সুস্থ হয়ে ওঠেনি।
সুস্থ হয়ে উঠল তিনদিন পরে। হঠাৎ যেমন বনমালা দেখতে শুরু করেছিল বৃদ্ধার মুখ, তেমনি হঠাৎই চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছিল একেবারে সে-মুখ আশ্চর্য ভাবে। বনমালা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল আগের মতো।
স্বাভাবিক হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অন্য বিপদ এসে উপস্থিত হল আবার বাড়িতে। বনমালার ছোট বোন যেন কেমন হয়ে যেতে লাগল থেকে থেকে। ভালো করে নজর করতে দেখা গেল, বনমালার মতোই ও চোখ চাইতে পারছে না। বেঁহুশ হয়ে থাকছে বেশীর ভাগ সময়।
নতুন রোগটা সংক্রামক মনে হল বাড়ি সুদ্ধ, সকলের। অনেকেই ভাবল বনমালার মতো আপনা হতেই সেরে যাবে হয়ত তিন দিন পরে। কিন্তু তিন দিন ছেড়ে চার দিন পাঁচ দিন হয়ে গেল, তবু একটুও সুরাহা হল না ছোট বোনের। বরং আরো বাড়ের মুখে এগুতে লাগল।
ছ’দিনের দিন না জেনেই যে কাজ করে ফেলেছিল বনমালা, তাতেই ভালো হয়ে উঠেছিল ছোট বোন।
অবাক লেগেছিল বনমালার কাছে সমস্ত ব্যাপারটা। তার অজ্ঞান অবস্থায় হারিয়ে যাবার ভয়ে সবুজ হীরে বসানো লকেটের হারটা গলা থেকে খুলে নিয়েছিল বোন। পরেছিল নিজের গলায়। বনমালাও বোনের অচৈতন্য ভাব দেখে দেখে তার সখের দামী হারটা চুরি যেতে পারে ভেবেছিল। খুলে নিয়েছিল হারটা তাই। খোলার কিছুক্ষণ পরই অভাবনীয় ঘটনা ঘটতে দেখেছিল। বোনের অসুস্থতা কোথায় যেন চলে গেছিল মুহূর্তে।
সকলেই নতুন রোগের উৎপত্তি-উপশমের রহস্য জানতে পেরেছিল। হারটাই যত অনাসৃষ্টির মূল। পরলে ভয়াবহ মৃত্যুযন্ত্রণা, খুললে স্বর্গের শান্তি।
হার রহস্যের দুটো দিক মেনে নিতে পারল না আবার কেউ কেউ। সন্দিগ্ধ মনের লোকেরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার জন্য তৎপর হয়ে উঠল। এদের দলে নাগরাজও যোগ দিয়েছিল।
মেয়ে-পুরুষ পালা করে এক একজন হারটা গলায় দিয়েছিল। একদিনের বেশী দু’দিন রাখতে পারেনি কেউ কাছে। বনমালার মতোই দেখেছে প্রত্যেকে বৃদ্ধার শুকনা মুখ চোখের আগুন। দেখেছে জীবন্ত চারটে দেয়াল জানালা-দরজা সুদ্ধ এগিয়ে আসছে। অনুভব করেছে বুকের ওপর পাথর বোকার অসহ্য যন্ত্রণা। শক্ত সমর্থদের বেঁহুশ হয়ে পড়তে দেরী লাগেনি বেশীক্ষণ।
একবাক্যে স্বীকার করেছে সবাই-এ সর্বনেশে হার ঘরে রাখা উচিত নয়, কাছেও রাখা উচিত নয়। এ হার কাছে থাকলে দুর্বল মানুষের জীবন সংশয় হয়ে যেতে পারে চোখের পলকে।
সখের হার ত্রাসের বাতাস ছড়াচ্ছে বাড়িময়। জহুরীকে ফিরিয়ে দিতে স্বামীর মতেই মত দিল তাড়াতাড়ি বনমালা।
স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে এল জহুরীর দোকানে।
হারটা ফেরৎ নিতে চাইল না জহুরী। পরিষ্কার জানিয়ে দিল, কেনার আগে বলে দেওয়া হয়েছে তো ফেরত নেওয়া হবে না আর। রাজী হয়েই তো মিস্টার-মিসেস নিয়েছেন।
হারের রহস্য শুনে মুখখানা খুব গম্ভীর হয়ে গেল জহুরীর। একটু চুপ করে থেকে সে বলল, এই একই কথা শুনে শুনে অনেকের কাছ থেকে ওই হার ফেরৎ নেওয়া হয়েছে। সেই জন্যই প্রথমে বলে দেওয়া হয়েছিল—এ হার কারো সয় না। তা সত্বেও জোর করে কিনেছিলেন মিসেস। বলেছিলেন, সওয়া-না-সওয়া ক্রেতা বুঝবে। দোকানীর মাথাব্যথার কোন প্রয়োজন নেই। তিনি ফেরৎ দিতে আসবেন না কোনদিন।
দোকানীর সব কথাই সত্যি। সয় না কথার ভিতর যে এত রহস্য লুকানো আছে, কেমন করে জানবে বনমালা? হারের সবুজ পাথরটাকে খুব পছন্দ হয়েছিল বলেই লোভ সামলাতে পারেনি।
এখন মনে হচ্ছে, তখন যেন দোকানী আরো কিছু বলতে চেয়েছিল। উত্তেজিত হয়ে বনমালা বলতে দেয়নি। ভেবেছিল, তার পছন্দের সুযোগ নিতে চাইছে বুঝি দোকানী। আর তা ছাড়াও বাঙ্গালোরের নামীদামী ঘরের বৌ জেনে, হারটার দাম বাড়াবার ফিকির আঁটছে ভয় ধরিয়ে।
সে ভুল ভাঙল, কিন্তু হারের কোন গতি করা গেল না। মহা সমস্যায় পড়ল স্বামী-স্ত্রী। হার নিয়েই ম্লান মুখে বাড়ি ফিরতে হল ওদের দুজনকে।
এরপর সাত দিন ধরে স্বামী-স্ত্রীতে চিন্তা করেছে অনবরত। কি ভাবে কার কাছে বিদায় করা যায় হারটাকে। পথ খুঁজে পায়নি। অজানা লোককে না জানিয়ে গছালে, শেষ পর্যন্ত কারো না কারো মৃত্যুর জন্য দায়ী হতে হবে তাদের। এ কাজ তাদের বিবেক বুদ্ধি থাকতে কিছুতেই করতে পারবে না। অথচ হারটাকে বেশীদিন সিন্দুকজাত করে রাখাও মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়। কে জানে, সিন্দুকের ভিতর থেকেও কখন কি মূর্তি ধরে বসে আবার।
চিন্তায় সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যায়। চাপা স্মৃতির দরজা খুলে যায়। পথ খুঁজে পেল বনমালা। মনে পড়েছে নন্দীগ্রামের ভোগনন্দীশ্বর দেবতাকে। এ হার দেবতার গলায়ই দেওয়া ভালো। দেবতার ইষ্ট-অনিষ্টের বালাই নেই। অশুভ মৃত্যুরও আশঙ্কা নেই। মনের কথা স্বামীকে জানাল বনমালা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল স্বামী-স্ত্রী।
আটদিনের দিন ভোরে স্বামীর সঙ্গে সঙ্গে নন্দীগ্রামে এল বনমালা। হারের সঙ্গে পুজোর ডালা ধরে দিল পুরোহিতের হাতে। সবুজ হীরের হার উঠল ভোগ নন্দীশ্বরের গলায়।
নিশ্চন্ত হয়ে ঘরে ফিরল স্বামী-স্ত্রী দুজনে।
নির্বিঘ্ন-নিশ্চিন্তে দেবতার পুজো-পাঠ করে আসছেন এতদিন ধরে ভোগনন্দীশ্বরের পুরোহিত ঠাকুর। পুজো-পাঠে বাধা পড়তে শুরু হল এবার। সন্ধ্যে-আরতির পর ধ্যানের সময় লক্ষ্য করলেন তিনি দেবতার বুকের সবুজ হীরেটায় একটা বৃদ্ধার মুখ ফুটে উঠছে ধীরে ধীরে। মুখখানা স্পষ্ট হয়ে উঠল। চোখ বোজা অবস্থায় এ দৃশ্য দেখলেন তিনি। তাকালেন। মনের চোখে দেখাটা বাইরের চোখ আরো পরিষ্কার দেখলেন। হতভম্ব হয়ে গেলেন।
ষাটের কোঠায় পড়েছেন তিনি। ধ্যানের সময় বাধা—ওরকম একটা নতুন-বিস্ময় উপস্থিত হয়নি কোনদিন তাঁর মনের চোখে, বাইরের চোখে। মনের ভুল কি চোখের ভুল—বার বার চোখ বুজে আর তাকিয়ে ঠিক করতে চেষ্টা করলেন। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল—কোন দেখাই তাঁর ভুল নয়। ভিতরের বাইরের —দুটোই নির্ভুল।
একটা বিস্ময়ের ধাক্কার রেশ থাকতে থাকতে আর একটা এসে হাজির হল। কারণ চোখে দেখছে বৃদ্ধা পুরোহিতকে। পুরোহিতও তার দৃষ্টির আওতা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলেন না। বৃদ্ধার মুখখানা খুব চেনা চেনা মনে হতে লাগল। স্মৃতির ভাণ্ডার হাতড়ে হাতড়ে দশ বছর আগের একটা ছবি খুঁজে পেলেন পুরোহিত।
উত্তর প্রদেশের মির্জাপুর অঞ্চল থেকে স্বামী-পুত্র সঙ্গে নিয়ে এসেছিল একটি প্রৌঢ়া স্ত্রীলোক একদিন। মন্দিরের সুন্দর কারুকার্য দেখে পুরোহিতের সঙ্গে বসে বসে এক একদিন অনেক কিছুই আলোচনা করেছে। কবে তৈরী হয়েছে, কারা করেছে ইত্যাদি। পুরোহিত যেটুকু জানেন, জানিয়েছেন। একসঙ্গে এতগুলো মন্দির তৈরী দীর্ঘ ইতিহাস। ছোল-রাজাদের আমলে শুরু, বিজয়নগরের রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের সময় শেষ।
স্ত্রীলোকটি যে ক’দিন ছিল, আরতি দেখত প্রতিদিন। ধ্যানের সময় তন্ময় হয়ে যেত মূর্তির সামনে বসে। পুরোহিতকে ভক্তিশ্রদ্ধা করত খুব। দেশে ফিরে যাবার সময় পুরোহিতের খাতায় নাম-ঠিকানা লিখিয়ে দিয়ে গেছিল। অনুরোধ কৃরেছিল, ওদিকে গেলে যেন তাদের বাড়িতে পায়ের ধুলো দিতে না ভোলন পুরোহিত মশাই।
সেদিনকার প্রৌঢ়া আজ বৃদ্ধা। কিন্তু চোখের ভাব সেই রকমই। কেবল চামড়া কোঁচকানো ছাড়া মুখের আদল বদলায়নি বিশেষ। বেশ মনে পড়ছে, এই রকমই হার যেন তার গলায় দেখেছিলেন পুরোহিত মশাই। দেখেছিলেন এই সবুজ হীরের লকেট।
ঘটনাটা বলতে বলতে থেমে গেল ত্রিবেণীশঙ্কর। ঘরের চতুর্দিকে চোখ বুলিয়ে নিল একবার। জোরে নিঃশ্বাস ফেলল একটা। ছেলের নিঃশ্বাসের সঙ্গে কমলা দেবীরও দীর্ঘ নিঃশ্বাস ঝরে পড়ল। আমি রুদ্ধনিঃশ্বাসে বসে আছি। পরের ঘটনা শোনার প্রতীক্ষা।
দু’চোখ জলে ভরে উঠল, তবু ভেজা গলায়ই বলতে শুরু করল আবার ত্রিবেণীশঙ্কর। তখন আমার কতই বা বয়েস—বছর দশেক। ওই বয়েসে যা দেখলুম চোখের সামনে—এই বাইশ বছর বয়েসেও মনে পড়লে বুকের তলার রক্ত হিম হয়ে আসে। সে কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য!
বাবা মা সে রাতে বাড়ি ছিলেন না। দিদিমার অসুখ দেখতে গেছিলেন বেনারসে। বাড়িতে ঠাকুমা আর আমি। ঠাকুমারও ক’দিন ধরে শরীর ভালো যাচ্ছিল না মোটে। ঘুষ ঘুষে জ্বর হচ্ছিল বোজ সন্ধ্যেয়। সন্ধ্যে থেকেই বিছানা নিতেন উনি। আমি পড়াশোনা সেরে রাত আটটা-নটা নাগাদ ওঁর কাছে শুতুম। সে রাতেও শুয়েছিলুম।
মাঝরাতে খুটখুট-খস্খস্ আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। ঠাকুমার দিকে তাকাতেই, মুখে আঙুল দিয়ে ইশারায় চুপ করে থাকতে বললেন। ঘরের পূর্ব কোণে কাঠের পিলসুজের ওপর পিতলের প্রদীপটা জ্বলছিল তখন। ও কোণটায়, একটা জলচৌকির ওপর একটা বিষ্ণুর ছবি আছে। সন্ধ্যে হবার মুখে ধূপ-প্রদীপ জ্বেলে দেন নিজেই ঠাকুমা।
প্রদীপের আলোয়ই দেখছি আমি। ঝড় নেই বৃষ্টি নেই, অথচ দরজাটা থেকে থেকে কেঁপে কেঁপে উঠছে। বাইরের থেকে কেউ খোলবার চেষ্টা করছে। হাতুড়ি-বাটালি দিয়ে দরজায় ঘা মেরে মেরে, দরজার কোন্ জায়গাটা যেন কাটছে। একটু পরেই ভিতরের ছিট্কিনি আটকাবার জায়গা থেকে একটা কাঠের টুকরো ঠক করে খসে পড়ে গেল মেঝেয়। সঙ্গে সঙ্গে বাইরে থেকে আঙুল গলিয়ে কে একজন ছিটকিনি খুলে ফেলল। বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করছে আমার ভয়ে। জড়িয়ে ধরলুম ঠাকুমাকে। ঠাকুমা ধীর-স্থির নির্বাক। দেখছেন আমাকে। দেখছেন, দেখছেন। কালো পোশাকে আপাদমস্তক ঢেকে যে এক দঙ্গল লোকহুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ল, তাদের দিকে কোন লক্ষ্যই নেই ওর।
লোকগুলো প্রত্যেকে চকচকে ছোরা উঁচিয়ে আমাদের চারপাশ ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়াল, ওদের মধ্যে থেকে একজন ঠাকুমার মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ে তীব্র কর্কশ স্বরে বলল, হারটা নিজে হাতে খুলে না দিলে, তোকে আর তোর নাতিকে শেষ করে দেব এখুনি।
ঠাকুমা নিরুত্তর। লোকটার কথায় কর্ণপাত করলেন না। আমায় আর একটু চেপে ধরলেন বুকের কাছে।
এরপর চলল ওদের তাণ্ডব। ঠাকুমার বুক থেকে জোর করে ছিনিয়ে নিলে ওরা আমায়। দেয়ালে ঠেসে চেপে ধরেছে দু’জনে। আমি ঠাকুমার কাছে যাবার জন্য ধস্তাধস্তি করছি দু’জনের সঙ্গে। সেই মুহূর্তে ভয়-ডর চলে গেছিল একেবারে আমার মন থেকে।
ঠাকুমার অবস্থা দেখছি। উনি উঠে বসেছেন। সরোষে বলছেন, ইয়ে হার নহী দুঙ্গী, নহী দুঙ্গী…। আমি কিছুতেই দেব না হার, কিছুতেই না।
যত ঠাকুমার কাছে যাবার জন্য ছটফট করছি, হাত-পা ছুঁড়ছি চিৎকার করছি, তত দু’জনে আরো জোর করে ধরে রাখছে আমায়। একসঙ্গে অতগুলো লোক আর ঠাকুমা একা। অসুস্থ-দুর্বল ঠাকুমা দু’হাত দিয়ে প্রাণপণে বুকে চেপে রেখেছেন সবুজ হীরের লকেটটা।
শেষ অবধি হারটা রাখতে পারেননি ঠাকুমা। বাঁচাতে পারেননি লকেটটাকে। হারটা নেবার পর নিস্তব্ধ নিঝুম রাতে বুক কাঁপানো অট্টহাসি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছিল সকালে।
হার চলে যাবার পর থেকে ঠাকুমা প্রাণে বেঁচেও মরে রইলেন যেন। মুখে অহর্নিশি হার আর হার। রাতে ঘুমুতেন না। ঘরময় পায়চারি করে বেড়াতেন। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে বলতেন,…বহুরাণী, ইয়ে হার রাজলছমী…। শাশুড়ী বলে গেছিলেন, বৌ! এ হার রাজলক্ষ্মী…।
হারটার এক বিচিত্র, ইতিহাস শুনেছি ঠাকুমার মুখে। এ বংশে ক’পুরুষ থেকে হারটা বড় বৌয়েদেরই গলায় উঠে আসছে পর পর। শাশুড়ীরা মারা যাবার সময় নিজে হাতে গলা থেকে খুলে বড়বৌকে পরিয়ে দিয়ে গেছেন এক একজন। যিনি পরাবার সময় পাননি, চলে গেছেন হঠাৎ—তার হয়ে কুলগুরু মৃতের গলা থেকে ওই হার খুলে রীতি অনুযায়ী বড় বৌয়ের গলায় পরিয়ে দিয়েছেন। ঠাকুমাকেও তার শাশুড়ী পরিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এ হার বংশের প্রথম গরীব পুরুষকে বহু ঐশ্বর্য দিয়েছিল। এর দৌলতেই এখন সব…রাজলক্ষ্মী।
ঠাকুমা আপসোস করতেন, কোন বড় বৌ খোয়ায়নি এ হার। বংশের নিয়ম রক্ষে করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। কিন্তু তার জীবনে এ কি হল। বংশের রীতি ভঙ্গ। সর্বনাশ করে গেলেন তিনি বংশের!
কখনো কখনো আমাকে ডেকে বলতেন, খুঁজে দেখ দিকিনি হারটা! নিশ্চয় পাবি। কোথাও না কোথাও পড়ে রয়েছে নিশ্চয়। আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি সবুজ হীরে জ্বল জ্বল করছে আমার চোখের সামনে যেন।
কথা শুনে সকলেই ভাবল সত্যি ওঁর মাথাটা বিগড়েছে। হারটা ওঁর মনে সংস্কারের শক্ত পাঁচিল হয়ে খাড়া ছিল। সেই হার হারিয়ে যাওয়াতে সেটা ভেঙে গেছে। সে ব্যথা সামলে উঠতে আর পারলেন না উনি।
হার চলে যাবার বছর খানেকের মধ্যে ঠাকুমার মরমর অসুখ হল বার তিনেক। ডাক্তার কবিরাজরা জবাব দিয়ে গেলেন। কিন্তু তিনি মরলেন না। যেন পুনর্জীবন পেয়ে বেঁচে উঠতে লাগলেন। কাছে পেলেই বলতেন, দাদুভাই! হারটা খোঁজো! তোমার মাকে না পরিয়ে যেতে পারছি নে আমি।
আশ্চর্যভাবে হারটা নিজেই বাড়ি খুঁজে এল যেন একদিন। তখনো ঠাকুমা শয্যাশায়ী। হারটাকে নিয়ে এলেন ভোগনন্দীশ্বর মন্দিরের পুরোহিত। তিনি ঠাকুমার চোখের ডাকে থাকতে পারেননি। লকেটের ওপর ঠাকুমার ভেসে ওঠা মুখখানা এই বাড়ির দিকেই ঠেলে দিত তাকে যেন বার বার। কেবলই মনে হত ঠাকুমার দু’চোখ ডাকছে তাঁকে এই বাড়ি থেকেই বুঝি। হারটাকে নিয়ে আসতে বলছে তাঁকে তাড়াতাড়ি।
ঠাকুমার গলায় হার পরিয়ে দিলেন পুরোহিত। লকেটের সবুজ হীরের মতো ঠাকুমার দু’চোখও জ্বল জ্বল করে উঠল। চোখের ইশারায় মাকে ডেকে কাঁপা হাতে হারটা নিজের গলা থেকে খুলে মায়ের গলায় পরিয়ে দিলেন। ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, বহুরাণী ইয়ে…রাজলছমী। কথা জড়িয়ে গেল ঠাকুমার। আস্তে আস্তে দু’চোখ বুজে এল।