খানিক যেতে না যেতেই ব্রীজমোহন দাঁড়িয়ে পড়ল। পা দুটো আটকে গেছে মাটির সঙ্গে। একটা বিষম বিস্ময়ের ধাক্কা লেগেছে মনে-চোখে। চোখ-মন সজাগ করেও বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে পারছে না কিছুতেই। চোখকে অবিশ্বাস করেও বিশ্বাস করতে হচ্ছে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে এক নারীমূতি। মূর্তি পাথর লোহার নয়, মাটি-কাঠেরও নয়। একেবারে জলজ্যান্ত রক্ত মাংসের।

বিদ্যুতের চমকে দেখতে পাচ্ছে, মূর্তি নিশ্চল নয়। সচল, চলছে। পূর্ব দিকটাই লক্ষ্য যেন ওর। ওধারে ব্রীজমোহনও যাবে। যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল সে আজ দিন তিনেক ধরে। এখন যাচ্ছে। কিন্তু সামনে এই বিপত্তি।

গয়া শেরঘাটি বোড় থেকে ভিতরের দিকে এ জায়গাটায় বড় একটা আসে না কেউ। দিনের বেলায়ই গা ছমছম করে এলে—রাতে তো দূরের কথা। রাত হলেও সন্ধ্যের মুখেতেই নিশুতি রাতের অন্ধকার নেমেছে জায়গাটায়। আকাশ ভরা কালো ঘন মেঘ আর মুষলধারে বৃষ্টি একটা ভয়াবহ সৃষ্টি করেছে। এ সময় এ দুর্যোগে এখানে কোন ছেলের আসাই অসম্ভব যখন, তখন কোন মেয়ের কথাই আসে না। আসে না বললে চলবে না এখন আর। এসেছে একটি স্ত্রীলোক।

বিদ্যুতের আলো অদৃশ্য হলে জমাট অন্ধকার সঙ্গে সঙ্গে ঢেকে ফেলেছে স্ত্রীলোকটিকে। হারিয়ে যাচ্ছে ও নিমেষে। আকাশ-মাটির বুকে বিদ্যুতের লুকোচুরি খেলায় স্ত্রীলোকটি দৃশ্য-অদৃশ্য হচ্ছে বার বার ব্রীজমোহনের চোখে। এ এক বিচিত্র ছবি দেখছে ব্রীজমোহন।

ব্রীজমোহন দেখছে আর ভাবছে। ভাবছে আর দেখছে।

তার কাছ থেকে স্ত্রীলোকটির দূরত্বের ব্যবধান বেড়ে উঠছে ক্রমশ। বেশ বোঝা যাচ্ছে ক্ষণিক আলোর পর জমাট অন্ধকার কোন প্রতিবন্ধক হয়নি ওর পথ চলার। বোধহয় চোখের প্রখর আলোর ফলকে অন্ধকারের বুক খুঁড়ে-ফুঁড়ে পথ করে নিয়ে এগিয়ে চলেছে ও ঠিকই।

যত দূর দৃষ্টি যায়—আলো-আঁধারিতে স্ত্রীলোকটিকে যতটুকু দেখতে পাওয়া যাচ্ছে—তাতে মনে হচ্ছে ও কোন ধনীর ঘরণী। চুমকি বসানো পাতলা ফিনফিনে গোলাপী ওড়নাটা মাথা থেকে বুক অবধি ঢাকা। বৃষ্টির জলে ভিজে সপসপে হয়ে গেছে। গায়ের সঙ্গে লেপটে রয়েছে। আকাশ থেকে আলোর রেখা ওই দেহে ছিটকে পড়লেই চুমকিগুলো ঝকমক করে উঠছে। যেন আসমান থেকে খসে পড়া একটা তারা ওর মাথায় পিঠে বুকে হাতে ফুটে উঠেছে। হাতের নাকের গলার গয়নাগুলো জ্বল জ্বল করে মাথা তুলেছে ওড়নার তলা থেকে।

স্ত্রীলোকটির কোন লক্ষ্যই নেই কে তাকে দেখছে না দেখছে। আপন মনেই চলেছে ও।

ব্রীজমোহনের আটকে পড়া দু-পা হঠাৎ আলগা হয়ে গেল যেন একটা অমোঘ আকর্ষণে। আকর্ষণটা আসছে স্ত্রীলোকটির দিক থেকেই। ওকে অনুসরণ করার দুরন্ত বাসনা জেগে উঠছে ভিতরে। পা বাড়াল ব্রীজমোহন, অনুসরণ করবে। যতই এগুচ্ছে ততই স্ত্রীলোকটি তার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠল ব্রীজমোহন ওকে আটকাবার জন্য। সঙ্গে কেউ সঙ্গী নেই নিশ্চয়। থাকলে এতক্ষণ নজরে পড়ত। পথ হারিয়ে ফেলে হয়তো এসে পড়েছে এপথে। বেরুবার জন্য দ্রুত পায়ে চলছে তাই। জোরে পা চালিয়ে ধরে ফেলতে না পারলে মস্ত ক্ষতি হয়ে যাবে তার।

স্ত্রীলোকটিকে প্রথম নজরে পড়তে মনে হয়েছিল একটা বিপত্তি এসে খাড়া হল বুঝি এ সময় তার চলাচলের সামনে। সে ভুল ভেঙেছে এখন। ওর গা ভর্তি গয়না। অজস্র ধন্যবাদ ঈশ্বরকে। এ সুযোগ গ্রহণ না করলে দুঃখকষ্ট জীবনেও ঘুচবে না তার।

ভগবানের করুণা কত তার ওপর। তিন দিনের অভুক্ত আর্তের ডাক কানে পৌঁছেছে তার। রাতারাতি আমীর বনে যাবে ব্রীজমোহন। ব্রীজমোহন নিজে আর স্ত্রীলোকটি ছাড়া এই পাণ্ডব বর্জিত নির্জন জায়গায় আর তৃতীয় ব্যক্তি কেউ নেই। এখানে ওর করুণ আর্তনাদে দৌড়ে সাহায্য করতে আসবে না ওকে কেউ। কার্যসিদ্ধি হবে তার অনায়াসে। উদ্ধত শাণিত ছোরার সামনে হৃৎকম্প হবে রমণীর। ত্রাসে বেহুশ হয়ে ঢলে পড়ার আগেই কোন ইতস্ততঃ না করে এক একখানি গয়না নিজের দেহ থেকে খুলে খুলে কাঁপা হাতে তুলে দেবে ব্রীজমোহনের বজ্রকঠিন হাতে।

চলছে তাড়াতাড়ি ব্রীজমোহন। স্ত্রীলোকটিও হনহনিয়ে চলছে। হনহনিয়ে চললেও কিছুতেই নিস্তার পাবে না ও ব্রীজমোহনের কাছ থেকে। আর কিছুক্ষণ বাদেই চলা থেমে যাবে। ব্রীজমোহন কত শক্তি ধরে বুঝবে তখন। ছোরার বাঁটটা চেপে ধরল শক্ত মুঠোয়। হাসছে মনে মনে। পয়সাঅলারই স্তুতি সর্বত্র। এবারে মামা-মামী বাড়ী থেকে দূর করে বার করে দেবে না আর তাকে। তাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে ঘরের দরজায় খিলতালা লাগাবে না আর দাদা-বৌদিও।

বৌদির কথাগুলো এ সময়ে মাথার মধ্যে কিলবিল করে উঠছে কেন আচমকা! রোজই তো বল তুমি এবার রোজগার করে টাকা এনে দেবেই। মিথ্যে, সব মিথ্যে—

না, না, না। মিথ্যে নয়। স্বগতোক্তি করে ওঠে ব্রীজমোহন। ছোরা ধরা মুঠোটা শিথিল হয়ে আসে আপনা থেকেই। প্রাণপণে চেপে ধরে আবার গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে। এটাই শেষ সম্বল তার জীবিকা উপার্জনের, এটাই তাকে ফকির থেকে আমীর করে তুলতে পারে এক মুহূর্তে। কিন্তু নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে ব্রীজমোহন। ভাগ্যদেবী বহু ছলনা করেছে তার সঙ্গে। তাকে অনেক রকমের মিথ্যে আশা দিয়ে নিরাশ করেছে স্রেফ। অতীতের সেই সব নির্মম খেলা নতুন করে কি খেলতে শুরু করেছে আবার ভাগ্যদেবী?

স্ত্রীলোকের গয়নার মোহজাল বিস্তার করে তাকে ডাকছে। রমণীটি কি আলেয়ার আলো না মরুভূমির মরীচিকা? কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। ভিতর থেকে ঠিক বেঠিক কোন উত্তর পাচ্ছে না। একটু আগের বড়লোক হবার আশা-আকাঙ্ক্ষা ধূলিসাৎ হতে বসেছে। মাথাটা কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে।

মাথা গুলোনো শুরু হয় তার দশ বছর বয়েসে প্রথম। মায়ের মৃত্যুর পর। উচ্ছৃঙ্খল পিতার হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন মা দিনের পর দিন। আহার জোটেনি অর্ধেক দিন। তার নিজের না জুটলেও ব্রীজমোহনের জুটিয়েছেন তিনি। যত্ন-আত্তির কোন ত্রুটি হয়নি তার মা চলে যাবার আগে পর্যন্ত।

মা বেঁচে থাকতেই দাদা বৌদিকে নিয়ে বাড়ী ত্যাগ করে অন্য জায়গায় চলে গেল মায়ের নির্যাতন সহ্য করতে পারেনি বলে।

মায়ের আত্মমর্যাদা বোধ ছিল খুব বেশী। অভাব-অনটনে বিপর্যস্ত হয়েও ডাকাডাকি সত্বেও কোন আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে আশ্রয় নিতে যাননি কোন দিন। কোন সাহায্যও চাননি কারো কাছ থেকে কখনো। ব্রীজমোহনকে বাড়ী নিয়ে গিয়ে মানুষ করে তোলার জন্য মামার অনুরোধ নাকচ করে দিয়েছেন মা অনেকবার।

মা যা নাকচ করেছিলেন, বাবা তা বহাল করলেন মায়ের মৃত্যুর পরই। অর্থাৎ মামার বাড়ী রেখে এলেন ব্রীজমোহনকে।

বছর আষ্টেক ছিল ব্রীজমোহন সেখানে। আট বছরে আট হাল হয়েহে তার। মামার অসাক্ষাতে মামীর দুর্দান্ত দাপট সময় সময় এত অসহ্য হয়ে উঠেছে তার যে, যেখানে দুচোখ যায়, চলে যেতে ইচ্ছে করেছে। মামা বাড়ী ফিরলে কেঁদে কেটে অনুযোগ করেও কোন ফল ফলেনি। মামীর রক্তচক্ষুর কাছে মামার ম্লান চোখ নত হয়েছে। নির্বাক মুখে সেখান থেকে সরে গেছে মামা তখুনি।

মামাতো ভায়েদের রাজার হালে থাকতে দেখেছে ব্রীজমোহন। দেখেছে তাদের বই বগলদাবা করে স্কুলে যেতে। দেখেছে বাড়ীতে এসে পড়াতেও মাস্টারকে। সমবয়সী ভায়েদের মত নিজেও হতে চেয়েছে। পারেনি। নিজের মনের কথা-ব্যথা জানিয়েও সহানুভূতি আকর্ষণ করতে পারেনি কারও। নিজে ওপর কারও করুণা-মমতা জাগিয়ে তুলতে পারেনি অন্যের অন্তরকে নাড়া দিয়েও।

বড় থেকে ছোট পর্যন্ত—সকলেই এক বাক্যে রায় দিয়েছে—তার নাকি মাথা মোটা ভয়ানক। শত চেষ্টা করলেও কস্মিনকালে কিছু হবে না। চাকরবৃত্তি করার জন্যই জন্ম তার। প্রকৃতি-বুদ্ধিতে পরিষ্কারই বোঝা যাচ্ছে তাই। চাকরদের সঙ্গে শোওয়া-বসা নাওয়া-খাওয়ার অভ্যেস করতে করতে ওদের মত বাজার দোকান করাটাও মগজে যদি কিছু ঢোকে, তাহলে এখানে না থাকতে পারলেও ভবিষ্যৎ দিন গুজরানের ব্যবস্থা অন্য জায়গায় থেকে করতে পারবে তবু।

এরপর আর কথা চলে না। অনুরোধ-উপরোধও না। চাকরদের টালিখোলার ছাদের ঘরে গিয়ে দড়ি ছেড়া খাটিয়ায় তেল চিটচিটে কাঁথার ওপর আছড়ে পড়েছে। হাপুসনয়নে কেঁদে কেঁদে বুক ভিজিয়েছে। মনে মনে মাকে ডেকেছে শুধু তুমি এসো! যেখানে আছে, নিয়ে যাও আমায়। মাকে ডাকতে ডাকতে ঘুমিয়ে পড়েছে। স্বপ্নে দেখেছে মাকে শাড়ীর আঁচলে চোখ মুছিয়ে দিতে। মাথাটা বুকে চেপে ধরেছে। বুকের ধুক পুকুনি শুনেছে চাপা কানটায় স্পষ্ট। ঘুমের ঘোরে ‘মা তুমি যেও না’ বলে চীৎকার করে উঠেছে।

জেগে উঠে মাকে দেখতে না পেয়ে আরো কেঁদেছে। কেঁদে কেঁদে সারা হয়েছে সর্বক্ষণ। কাছে কেউ আসেনি সান্ত্বনা দিতে।

এই ভাবে বছরের পর বছর কাটতে লাগল ব্রীজমোহনের। শেষে মামীর ক্রোধ চরমে উঠল একদিন। লঘু পাপে গুরু দণ্ড হল তার। অপরাধ—জ্বরের জন্য মামাত ভায়ের স্কুলে বই বয়ে নিয়ে যেতে নারাজ হয়েছিল সে সেদিন। মামী হিংসুটে কুঁড়েপাথরকে বসিয়ে খাওয়াতে রাজী হল না একাতলও। আশ্রয় দেওয়াও আর চলবে না তার পক্ষে একদম।

মুখ দিয়ে কথা খসবার সঙ্গে সঙ্গে কথা মাফিক কাজও করল মামী। গলা ধাক্কা দিয়ে বাড়ী থেকে বার করে দিতে নির্দেশ করল চাকরদের! গলা ধাক্কা খাবার আগেই বাড়ী থেকে ম্রিয়মাণ মুখে বেরিয়ে গেছে ব্রীজমোহন।

…দাদার কাছে এসে উঠেছে। দাদা-এক মায়ের পেটের ভাই। দাদা কখনও এরকম করতে পারবে না তার সঙ্গে। আরও আগেই আসা উচিত ছিল। এলে এত হেনস্থা হতে হত না তাকে। দাদার আশ্রয় নিশ্চয় অনেক—অনেক নিরাপদ। বরাত সঙ্গে সঙ্গে ফেরে।

দাদার বাড়ীতে দু’বছরে আরো দুরবস্থা হল ব্রীজমোহনের। মামীকে হার মানাল বৌদি। মামী তাকে গোলাম বানাতে চেয়েছিলেন, বৌদি তাকে গুণ্ডা বানাতে চাইলেন। শুধু গুণ্ডা বানাতে চাইলে তবু রক্ষে ছিল, কিন্তু তা নয়, খুনী ডাকাত তৈরী করতে চাইলেন।

অবিশ্যি বৌদির এটা অন্তরের কথা না ঘাড় থেকে বোঝা নামানোর জন্য মুখের কথা—বুঝতে পারেনি ব্রজমোহন তখন।

ব্রীজমোহনকে সরোষে বলেছেন বৌদি—অপদার্থ কোথাকার! কাজ না পেলে—চুরি ডাকাতি করে উপায় করতে পারো তো! খুন-খারাপি করেও যে উপায় করে, তাকেও মানুষ বলা যায়। তুমি একটা আস্ত জন্তু। জন্তুকে পোষা হয়েছে অনেক দিন। আর একদণ্ডও না।

বৌদির কথাগুলো বর্শার ফলার মতো বিঁধেছে মাথার ভিতর। বিঁধেছে বুকের ভিতর। বোবা যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পড়েছে ব্রীজমোহন। দ্বিরুক্তি না করে স্থান ত্যাগ করেছে তখুনি। অনির্দিষ্ট পথে পা বাড়িয়েছে।

…হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছেছে শেরঘাটি রোডের ওদিকে কুখ্যাত অঞ্চলে। জেনেই এসে পড়েছে সে। কতকগুলো তরুণকে একসঙ্গে বসে জটলা করতে দেখে এসেছে। যদি এদের কাছ থেকে কোনো কাজের সন্ধান পায়।

উপস্থিত হতেই, ওরা দাঁড়িয়ে উঠে, ছোরা উচিয়ে গোল হয়ে ঘিরে ধরেছে। সকলে সমস্বরে বলে উঠেছে—ক্যা হয় নিকালো।

কাছে কিছু নেই—বিশ্বাস করেনি ওরা। একদম নগ্ন করেই দেখেছে তাকে—সত্যি বলেছে, না মিথ্যে বলেছে।

সমস্ত প্রমাণ নেবার পর, শুনেছে ওরা ব্রীজমোহনের মামীর কথা, বৌদির কথা। জেনেছে ব্ৰীজমোহনের মনোগত ইচ্ছে। সে মানুষ হতে চায়। চুরি-ডাকাতি ধুনখারাপি করেও। বৌদির মুখে প্রথম এসব কথা শুনে সে ব্যথা পেয়েছিল খুব। কিন্তু এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছে, তার ভর্ৎসনা ব্রীজমোহনের বাঁচবার পক্ষে মহামূল্য উপদেশ। বৌদির কথাগুলোই মনে মনে জপ করছে সে।

দলের সর্দার আগন্তুক বিশ্বাসী কি অবিশ্বাসী—মনের এই সংশয় ঘোচাবার জন্য তার আপাদমস্তকে ভয় ধরানো তীক্ষ্ণদৃষ্টি ছুঁড়ে ছুঁড়ে মেরেছিস বার চারেক। তারপর মৃদু হেসে হাত বাড়িয়ে, হাত চেপে ধরে ঝাঁকুনি দিয়েছিল দু’বার।

এরপর চুরি-ডাকাতি-খুন খারাপিতে হাত পাকাবার জন্য তালিম দিয়েছিল মাসছয়েক। মাস ছয়েক এমনি ছেড়ে রেখে পরীক্ষা করেছিল—ঠিক মতো শিকার ধরতে পারে কি না সে।

পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। দুর্বৃত্তপনায় পারঙ্গম হয়ে উঠেছে এত কম সময়ে—দেখেই সর্দারের পুরনো চেলাচামুণ্ডাদের সর্বশরীর জ্বলে গেছে হিংসেয়। সর্দারের বেশী প্রিয় হয়ে ওঠবার আগেই তাকে দল থেকে সরাবার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত তাদের ষড়যন্ত্র সফল হয়েছে। দলের সকলেই একবাক্যে বলেছে সর্দারের কাছে—ব্রীজমোহন কোন কাজেরই নয়। উপায় করে তারা। ও বসে বসে তাদের বখরায় খায় শুধু। এতদিন সর্দারের কাছে ওর কাজের মিথ্যে প্রশংসা করেছে তারা ওর চেতনা আনবার জন্য—মানুষ যদি হয়ে উঠতে পারে এর মধ্যে। কিন্তু মানুষ ও হবে না। ওকে দলচ্যুত করাই যুক্তিসঙ্গত।

সবার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে সর্দার। ব্রজমোহন দলচ্যুত হয়েছে। দলচ্যুত হবার দিনে সর্দারের কর্কশ কণ্ঠের শাসানি শুনেছে—দলের কথা কারো কাছে প্রকাশ হলে দুনিয়া থেকে সরে যেতে হবে তাকে।

দল থেকে সরে এসে পোড়োবাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছে সে। তিন দিন উপোসী—দলে ঢোকবার উপায় নেই আর। মামীর কাছে, বৌদির কাছে ফেরারও উপায় নেই। কোন কাজই জানে না সে। সুতরাং কাজ পাবার কথাই ওঠে না। কাজ পাবে না—এ অভিজ্ঞতা অনেক আগে থেকেই হয়ে আছে তার।

সব দিক দিয়ে চিন্তা করে দেখেছে। বেঁচে থাকবার পথ খুঁজে পায়নি একটাও। পেয়েছে যেটা, সেটা আত্মরক্ষার নয়। আত্মঘাতীর।

আত্মঘাতী হতেই মনস্থ করেছে সে। তার জন্য কাঁদবার কেউ নেই। তাকে খোঁজবার কেউ নেই। এত বড় পৃথিবীতে সে একা। সে নিজেই নিজের। সে মরলে তারই শান্তি, তারই নিষ্কৃতি।

…মরতে যাচ্ছিল ব্রীজমোহন। মরতে গিয়েও বাঁচার পথ পেয়ে গেছে। মরার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে স্ত্রীলোকটিকে দেখার পর। ওর গয়না নজরে আসার পর। এ গয়নার বখরা পেত সর্দার। কিন্তু পাবে না আর। তাকে তাড়িয়ে ভালই করেছে। অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন। অতগুলো গয়নার মালিক সে।

উন্মত্ত উল্লাস ব্রীজমোহনের ভিতর দাপাদাপি করছে। পৈশাচিক হাসি চাপতে পারছে না আর। মেঘ গর্জনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বিকৃত গলায় হা-হা করে অট্টহাসি হেসে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে সংশয়ের দোলায় দুলেও উঠল মন। এত আনন্দ করাটা কি ঠিক হচ্ছে। স্ত্রীলোক দেখা চোখের ভুল নয়তো?

ব্রীজমোহনের হাসির শব্দে বাজ পড়ল যেন দু’কানের পাশে স্ত্রীলোকটির। চমকে উঠে ফিরে তাকাল। ফিরে তাকানো আর থমকানোর ধরণ দেখে ব্রীজমোহনের আত্মপ্রত্যয় দৃঢ় হয়ে উঠল। স্ত্রীলোকটি মরীচিকা নয়, আলেয়ার আলো নয়। ভাগ্যিলক্ষ্মী ছলনা করছে না তাকে। ওকে নিয়ে অনেক আশা বুকের তলায় বাসা বাঁধলেও বারে বারে ভাগ্য বিপর্যয়ের জন্য সংশয়েরও অন্ত ছিল তার—সত্যি আসলে ও কি। সংশয়ের বীজ নির্মূল হয়ে গেছে একেবারে তার হাসির সময়। মানুষেরই মত ওর ভয়ার্ত স্বর বেরিয়ে এসেছে গলা থেকে–কে?

দেখছে ব্রীজমোহন।

ভীত-চকিত স্ত্রীলোকটি উর্ধশ্বাসে ছুটে চলেছে দিকবিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে। কালবিলম্ব না করে ব্রীজমোহনও দৌড়াতে লাগল পিছু পিছু।

পিছনে যাত্রীবোঝাই বাসটা এগিয়ে আসছে খুব দ্রুতগতিতে। সত্যবতীদের বাসকে ছাড়িয়ে যাবে। এবাসের ড্রাইভারও পিছনের ড্রাইভারের ঔদ্ধত্য মানবার পাত্র নয় গাড়ীর গতি বাড়িয়ে দিল আরো দ্বিগুণ।

দুটো বাসই নড়বড়ে ঝরঝরে। দু’গাড়ীর ভয়ে তটস্থ। অনিবার্য বিপদের হাত থেকে আজ আর রেহাই কেউ পাবে না বুঝি। কি কুক্ষণেই বাড়ীর বাইরে পা বাড়িয়ে ছিল তারা আজ। আকাশটা তো ভেল্কি খেলছে। মাঝে মাঝে ফুটো হয়ে যাচ্ছে। এই দুর্যোগে ড্রাইভারদেরও দুর্মতিতে পেয়ে বসেছে। দুটো গাড়ীতে পাল্লা দেওয়া-দিয়ি বন্ধ করতে বলেও কিছু হচ্ছে না। নিজেদের জিদ বজায় রাখতে ওরা অচল অটল। কার শক্তি কত বেশী—এই ঠুনকো ইজ্জত রাখতে গিয়ে এতগুলো লোকের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে বসেছে ওরা। অনেকে নেমে যেতে চাইল। গাড়ী থামাল না ড্রাইভাররা ইচ্ছে করেই। নামতে দেবে না কাউকে।

ওরা না থামতে চাইলে কি হবে—গাড়ী থামল। প্রথমটি আপনা হতেই আর দ্বিতীয়টি প্রথমটির পথ আটকে রেখেছে বলে। অবিশ্য এ গাড়ীটা আপনা হতে না থামলে ও ড্রাইভার থামাতে বাধ্য হয়েছে উপায়ান্তর না দেখে।

যেখানে গাড়ী দুটো থেমেছে, তার আশপাশে জনবসতি নেই। কেবল খেজুর শাল শিরীষ গাছগুলো ছাড়া ছাড়া ভাবে দূরে দূরে দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। অন্য যাত্রীদের সঙ্গে বাস থেকে নেমে পড়ল সত্যবতীও।

সকলেই প্রমাদ গণল। গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারলে বাঁচে। ড্রাইভারের ইঞ্জিন সারানো হলে বাঁচে। একসঙ্গে বিপদে পড়লে বোধহয় শত্রুও মিত্ত হয়ে ওঠে অন্ততঃ সে-সময়ের জন্য। এ ক্ষেত্রেও ঘটল তাই। অপর গাড়ীর প্রতি ড্রাইভারটি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই এ গাড়ীর ইঞ্জিনে হাত লাগিয়েছে। তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে। ইঞ্জিনকে ঘিরে ইঞ্জিন সারানো দেখছে যাত্রীরা। কিছুক্ষণ বাদে বৃষ্টি আসতে সাত-তাড়াতাড়ি গাড়ীতে উঠে পড়তে লাগল যাত্রীরা। এই অবসরে তাদের পাশ কাটিয়ে অপর দিকটায় চলতে লাগল সত্যবতী। নজরে পড়ল না সে-কারো। সত্যবতী চলেছে তো চলেছেই।

পোড়ো বাড়ীর কাছ বরাবর এসে থামল। এইখানে এসেছে বার দুয়েক সে ধরমলালের সঙ্গে। শেরঘাটি শহরে তার বাপের বাড়ী। যাবার সময় ঘরের গাড়ী করে নিয়ে গেছে কতবার তাকে ধরমলাল এদিক দিয়ে।

জায়গাটা কেমন—দেখবার ইচ্ছে হয়েছিল তার একবার। তারই অনুরোধে নামিয়ে চতুর্দিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল ধরমলাল সেবারে। আর একবার কিছু না বলতেই এমনি নামিয়েছিল। এ জায়গাটা সত্যবতীর পরিচিত। হঠাৎ এ জায়গায় আসতে মন চাইল কেন সত্যবতীর? চাইবার কারণ আছে যথেষ্ট।

বাড়ী থেকে বেরিয়েছিল সত্যবতী সবার অজ্ঞাতে। ধরমলালেরও। বাপের বাড়ীতে যাওয়াই স্থির ছিল গাড়ীটা থেমে যাওয়ার আগে পর্যন্ত। কিন্তু গাড়ীটা আকস্মিকভাবে থেমে যেতে মনের ও মতের পরিবর্তন হয়েছিল। অদম্য প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে উঠেছিল ভিতরে ভিতরে। ধরমলালকে জব্দ করতে হবে। সত্যবতী জব্দ করবে। করবে, করবে।

অভিমানিনী সত্যবতীকে ঠিক চিনতে পারেনি ধরমলাল। বিয়ের বাইশ বছর পরেও না। প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতিশ্রুতি ভেঙেছে বার বার। সব ছাড়েনি।

দাদাশ্বশুর সরাবের তরল আগুনে জ্বলে পুড়ে মরেছে। শ্বশুরেরও দাদাশ্বশুরের অবস্থা হয়েছে শেষ অবধি। বিয়ের দু’বছর পরেই শ্বশুরের মৃত্যু স্বচক্ষে দেখেছে সত্যবতী। স্বামীকে শত অনুরোধ উপরোধ করা সত্বেও শ্বশুরেরই পথ অনুসরণ করে চলতে দেখেছে। পূর্বপুরুষদের মতো অকালমৃত্যু বরণ করে নিতে হবে স্বামীকে এটা দিব্যচক্ষে দেখতে পেয়েছে। তাই এ বংশের এ অকাল মৃত্যুর অভিশাপ থেকে স্বামীকে বাঁচাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। শেষে সরাব ছাড়াবার জন্য সরেষে বলেছে, সরাব ছাড়তে হবে, নয় আমাকে ভুলতে হবে।

চমকে উঠেছে ধরমলাল, হাত ধরে বলেছে, সরাব ছাড়ব। তোমাকে ছাড়তে পারবো না। প্রতিজ্ঞা করছি তোমার হাত ধরে—আজ থেকে ছোঁবো না আর। কথা রাখেনি ধরমলাল। বরং বাড়িয়েছে আরো। স্বামীর দিকে চেয়ে চেয়ে দেখেছে সত্যবতী নির্বাক মুখে দিনের পর দিন। আর কিছু বলেনি। প্রতিজ্ঞা কথাও তোলেনি। তোলার প্রয়োজন বোধ করেনি। কিন্তু একদিন প্রয়োজন বোধ করতে হল তাকে ডাক্তারের কথা শুনে। নেশা না ছাড়ায়ে বাঁচানো দায়। লিভারটা যেতে বসেছে।

সত্যবতী ঘরে ঢুকে প্রতিজ্ঞার কথা ধরমলালকে স্মরণ করিয়েছে নতুন করে। আর নতুন করে আরো দু-একটা কথা শুনিয়েছে। গেলাসে হাত ঠেকাতে সত্যিই সে এবাড়ী ছেড়ে চলে যাবে।

কাজ হয়নি সত্যবতীর কথায়। গেলাসে হাত ঠেকায়নি শুধু ধরমলাল, ঠোঁটও ঠেকিয়েছে। ভিতরের উগ্র পানীয় গলায় ঢেলেছে। দেখেছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সত্যবতী। তারপর সবার অগোচরে বেরিয়ে গেছে বাড়ী থেকে।…বাসে গিয়ে উঠেবে…বাসটা থেমে পড়তে দেখে পরিচিত জায়গায় এসে পৌঁছেছে।

এখানে পরিচিত ইঁদারার কথাটা কেবল মনে পড়েছে সত্যবতীর। ওর তলায় কেউ তাকে খুঁজতে আসবে না কোনদিন এখানে। জব্দ হবে ধরমলাল। চিরদিনের মতো হারাতে হবে সত্যবতীকে। প্রতিশ্রুতি না রাখার ফল, সত্যবতীর কথা না শোনার ফল টের পাবে, এবার।

ইঁদারার দিকেই এগোচ্ছিল হঠাৎ পিছন থেকে ব্রীজমোহনের হাসির শব্দে চমকে উঠে থমকে গেছে একটু। কাউকে না দেখতে পেলেও ভেবেছিল, ধরমলালের কোনো খোশামুদে গাছের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে। হয়তো বাড়ী থেকে বেরুবার মুখে দেখতে পেয়ে অনুসরণ করে আসছে তাকে। ধরে ফেলার ব্যঙ্গহাসির শব্দ এটা তারই। লোকটা কাছে এসে পড়ার আগে, ধরে ফেলার আগে সব শেষ হয়ে যাক তার।

ইঁদারা লক্ষ্য করে প্রাণপণে ছুটেছে সত্যবতী।

ছুটেছে ব্রীজমোহনও। ইঁদারাটা দেখতে পাচ্ছে সে-ও। কি সর্বনাশ। তার হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে ইঁদারার মধ্যে পড়ে যাবে যে এখুনি। ব্রীজমোহনের মাথায় ভিতর ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে সব। সে যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। একি দেখছে! মা! মা ইঁদারায় ঝাঁপিয়ে পড়বে এখুনি। অস্ফুট আর্তনাদ করে ওঠে ব্রীজমোহন। সে বেঁচে থাকতে মাকে এভাবে মরতে দেবে না কিছুতেই। কিছুতেই না। মুঠো থেকে খসে পড়ে গেল ছোরাটা মাটিতে।

তিনদিনের অনাহারী মানুষটার শরীরে আচমকা কি করে যে অত শক্তি এলো কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না। এক লাফে সত্যবতীর সামনে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে টেনে নিয়ে এলো ইঁদারা থেকে খানিক তফাতে।

সত্যবতী বেঁহুশ। মাথাটা লুটিয়ে পড়েছে ব্রীজমোহনের বুকের ওপর।

জ্ঞান ফিরিয়ে আনার জন্য সেবাশুশ্রুষা করার সময় বার বার ভেবেছে ব্রীজমোহন, দশ বছর বয়সে মা তার আত্মঘাতী হয়েছেন। বটগাছ তলার ইঁদারাটায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন নিশুতিরাতে। দারিদ্রের জ্বালা থেকে, বাবার নির্যাতন থেকে রেহাই পেয়েছেন মা। সেই মাকে আবার দেখল সে। স্পষ্ট দেখল।

জ্ঞান হতে সমস্ত ঘটনা শুনে, পরিচয় জেনে, সত্যবতীকে বাড়ী ফিরিয়ে এনেছে ব্রীজমোহন।

চায়ের নেমন্তন্নে এসে এতক্ষণ ধরে গল্পের মতো ব্রীজমোহন আর সত্যবতীর জীবন কথা শুনছিলুম আমি ধরমলালের মুখে ওদের বৈঠকখানায় বসে বসে। টেবিলে রাখা চায়ের কাপগুলোর ধোঁয়া ওঠা কখন যে বন্ধ হয়ে গেছে সে খেয়াল নেই আমাদের কারো। খেয়াল হল গোলাপী নেটের পরদা সরিয়ে, গরম চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে সত্যবতীকে ঘরে ঢুকতে দেখে।

একগাল হেসে টেবিলের ওপর ট্রেটা রাখল সত্যবতী। গরম চায়ের পেয়ালা দুটো এগিয়ে দিল আমাদের। আমাকে আর বন্ধুকে। ধরমলালের মুখের দিকে তাকিয়ে, তার পাশের চেয়ারে ব্রীজমোহনের দিকে চেয়ে দেখলুম। আমার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে ওরা দুজনেই হাসল। প্রথম বারে চা দেবার সময় ওদের দিকে ফিরতে এই ভাবেই হেসেছিল দুজনে। তবে তখন ধরমলাল মুখে আঙুল চেপে চুপ থাকতে ইশারা করেছিল। এবারে আর তা করল না। একবার সত্যবতীর মুখের ওপর আর একবার ব্রীজমোহনের মুখের ওপর থেকে দু’চোখ ঘুরে এলো শুধু তার। তারপর নিঃসন্তান ধরমলাল মৃদু গলায় বলল, স্ত্রীকে আর ধর্মছেলেকে কাছে পাবার পর থেকেই সব নেশায়ই অরুচি আমার।

ব্রীজমোহনের দিকে নজর পড়তে দেখলুম, অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে সে। সত্যবতীর মুখের ওপর স্থির দৃষ্টি তার। কিন্তু সে যেন সত্যবতীকে দেখছে না। এই মুখে তার নিজের মায়ের মুখই দেখছে বুঝি।