চার

এগার বৎসর পরে দুর্গামণি হরিপালে বাপের ভিটায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন শরতের সন্ধ্যা এমনই একটা অস্বাস্থ্যকর ঝাপসা ধুঁয়া লইয়া সমস্ত গ্রামখানার উপর হুমড়ি খাইয়া বসিয়াছিল যে, তাহার ভিতরে প্রবেশ করিবামাত্রই দুর্গামণির বুকের ভিতরটা ছাঁৎ করিয়া উঠিল। বাড়িতে বাপ-মা নাই—বড়ভাই আছেন। শম্ভু চাটুয্যের সেদিন ছিল বৈকালিক পালাজ্বরের দিন। অতএব সূর্যাস্তের পরই তিনি প্রস্তুত হইয়া বিছানা গ্রহণ করিয়াছিলেন। খবর পাইয়া সুপ্রাচীন বালাপোশে মাথা এবং দুই কান ঢাকিয়া খড়ম পায়ে খটখট শব্দে বাহিরে আসিয়া চিনিতে পারিলেন।

কে, ও দুর্গা এলি নাকি? তা আয় আয়।

দুর্গা কাঁদিতে কাঁদিতে অগ্রসর হইয়া দাদার পদমূলে প্রণাম করিলেন।

জ্ঞানদা প্রণাম করিলে, কহিলেন, এটি বুঝি মেয়ে? তা বিয়ে দিলি কোথায়?

দুর্গা কুণ্ঠিত-স্বরে কহিলেন, বিয়ে এখনও দিতে পারিনি দাদা—যেখানে হোক শিগগিরই—

অ্যাঁ—বিয়ে দিসনি? এ যে একটা সোমত্ত মাগী রে দুর্গা? বহুকাল অদর্শনের পর ভগিনীর প্রতি তাঁহার ঈষৎ করুণ কণ্ঠস্বর এক মুহূর্তেই জমিয়া একেবারে কাঠ হইয়া গেল; বলিলেন, তাই ত, এখানকার আবার যে-সব বজ্জাত লোক—তা জানতে পেলে—তা আমি বলি কি, ওকে হেঁসেল-টেসেল ঠাকুরঘরদোরে ঢুকতে দিয়ে কাজ নেই—জানিস ত এদেশের সমাজ! বিশেষ হরিপাল—এমন পাজী জায়গা কি ভূ-ভারতে আছে? তা আয়, বাড়ির ভিতরে আয়। এতবড় মেয়ে—ওর কাকার কাছে রেখে এলে স্বচ্ছন্দে তুই দু’দিন জুড়িয়ে যেতে পারতিস। এখানে থাকলে ত আর—বুঝলি নে দুর্গা—তা যা, এখন হাত-পা ধু গে—ওগো, কৈ গো,—বলিতে বলিতে শম্ভু চাটুয্যে পুনরায় খটখট করিয়া অন্দরে প্রবেশ করিলেন। দুর্গা এবং তাঁহার কন্যা যেমন করিয়া তাঁহার অনুসরণ করিয়া বাড়ি ঢুকিল সে শুধু ভগবানই দেখিলেন।

শম্ভুর এটি দ্বিতীয় পক্ষ। প্রথম পক্ষের বৌকে দুর্গা দেখিয়াছিলেন, কিন্তু ইহাকে দেখেন নাই। উপস্থিত ইনি যেমনই কাল, তেমনই রোগা এবং লম্বা। ম্যালেরিয়া জ্বরে রঙটা যেন পোড়াকাঠের মত। তিনদিনের গোবর উঠানের মাঝখানে জমা করা ছিল, তাহা এইমাত্র নিঃশেষ করিয়া ঘুঁটে দিয়া, হাত-পা ধুইয়া প্রদীপের জো করিতেছিলেন; স্বামীর আহ্বানে সম্মুখে আসিয়া ব্যাপার দেখিয়া থমকিয়া দাঁড়াইলেন। শম্ভুর জ্বর আসিতেছিল, আগন্তুকদিগের অভ্যর্থনার জন্য স্ত্রীর কাছে সংক্ষেপে ইহাদের পরিচয় দিয়া ঘরে গিয়া ঢুকিলেন। বৌয়ের নাম ভামিনী। মেদিনীপুর জেলার মেয়ে। কথাগুলো একটু বাঁকা-বাঁকা। সে হাসিয়া উপরের এবং নীচের সমস্ত মাড়ীটা অনাবৃত করিয়া ননদের হাত ধরিয়া রান্নাঘরের দাওয়ায় লইয়া গিয়া পিঁড়ি পাতিয়া বসাইলেন। তাঁহার হাসি এবং কথার শ্রী দেখিয়া দুর্গার বুকের ভিতর পর্যন্ত শুকাইয়া উঠিল। আসিবার সময় দুর্গা একহাঁড়ি রসগোল্লা আনাইয়াছিলেন, সেটা নামাইতে না নামাইতে এক পাল ছেলে-মেয়ে কোথা হইতে যেন পঙ্গপালের মত ছুটিয়া আসিয়া ছেঁকিয়া ধরিল। চেঁচাচেচি ঠ্যালাঠেলি—সে যেন একটা হাট বসিয়া গেল। তাহাদের মা ইহাকে আধখানি, উহাকে সিকিখানি, আর দু’জনকে দু’টুকরা বাঁটিয়া দিয়া হাঁড়িটা ছোঁ মারিয়া তুলিয়া লইয়া গিয়া শোবার ঘরের শিকায় টাঙ্গাইয়া রাখিলেন। ছেলেগুলো যে যাহা পাইয়াছিল, অমৃতবৎ গিলিয়া ফেলিয়া, হাতের রস চাটিতে চাটিতে প্রস্থান করিল।

দুর্গা এখানকার রীতিনীতি কতক জানিতেন, কারণ তিনি এই গ্রামের মেয়ে। কিন্তু জ্ঞানদা আট-দশ বছরের ছেলেগুলাকে পর্যন্ত সম্পূর্ণ দিগম্বর দেখিয়া লজ্জায় মাথা হেঁট করিয়া রহিল। মেয়েগুলারও প্রায় ঐ দশা। ইতরবিশেষ যাহা আছে, তাহা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। তাহাদের নিজেদের গ্রামটাও শহর নয় বটে কিন্তু সেখানে রাস্তাঘাট আছে; এমন আম, কাঁঠাল ও বাঁশঝাড়ে মাথার উপর অন্ধকার করিয়া নাই। এরূপ গোবর ও পাট-পচা গন্ধ চতুর্দিক হইতে আসিয়া শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়াকে ভারাক্রান্ত, ব্যাকুল করিয়া দেয় না। তখনও অন্ধকার হয় নাই, একটা শৃগাল উঠানের উপর আসিয়া দাঁড়াইতেই বড়ছেলেটা তাড়া করিয়া গেল। চারিদিকে অসংখ্য ঝিঁঝিঁ পোকা বিকট শব্দ শুরু করিয়া দিল। দেয়ালের গায়ে একটা শুকনা ডালে হঠাৎ অশ্রুতপূর্ব একপ্রকার বিশ্রী শব্দ শুনিয়া জ্ঞানদা সভয়ে চুপি চুপি কহিল, ও কি ডাকে মা? মামী শুনিতে পাইয়া কহিলেন, ও যে তোক্ষোপ।

জ্ঞানদা শিহরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, তোক্ষোপ কি? তক্ষক সাপ?

মামী বলিলেন, হাঁ মা, তাই। ঐ যে কোন্‌ রাজাকে কামড়েছিল বলে। —গাছে গাছে একেবারে ভরা!

জবাব শুনিয়া জ্ঞানদা মায়ের মুখের প্রতি একবার চাহিল। ইতিপূর্বে কান্নায় তাহার সমস্ত বক্ষ পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। এইবার সে জননীর কোলের উপর লুটাইয়া পড়িয়া একেবারে ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল, কহিল, এখান থেকে চল মা—এখানে আমি একদণ্ডও বাঁচব না।

মামী আশ্চর্য হইলেন। বলিলেন, ভয় কি গো, ওরা যে দেবতা। কখ্‌খনো কারুর অপকার করে না। আর সাপখোপের কামড়ে কটা লোক মরে বাছা? বরঞ্চ, ভয় যা তা ঐ ম্যালোয়ারীর। একবার ধরলে, আর তাতে বস্তু রেখে ছাড়ে না। এ-বছর দিন-কুড়ি হ’ল তোমার মামাকে ধরেচে—এরই মধ্যে যেন শতজীর্ণ করে ফেলেচে, আর দিনকতক পরে কে কার মুখে জল দেবে মা, এ-গাঁয়ে তার ঠিক থাকবে না।

জ্ঞানদা মনে মনে অতুলের শেষ কথাগুলো মিলাইয়া লইয়া নীরবে পড়িয়া রহিল। সে-রাত্রে সে একবারও ঘুমাইতে পারিল না। মায়ের বুকের কাছে মুখ রাখিয়া বারংবার চমকাইয়া উঠিতে লাগিল। এমনি করিয়া প্রভাত হইল; নূতন স্থানে নূতন আলো চোখে পড়ায় বিন্দুমাত্রও তাহার আনন্দোদয় হইল না—বরঞ্চ সমস্ত আবহাওয়া, আলো, বাতাস যেন কালকের চেয়েও বেশি করিয়া তাহাকে চাপিয়া ধরিল।

এতবড় আইবুড়ো মেয়ে দেখিয়া পাড়ার লোক ভয়ানক আশ্চর্য হইয়া গেল। আমাদের বাঙ্গালাদেশে মেয়ের বয়স ঠিক করিয়া বলার রীতি নাই। সবাই জানে, বাপ-মাকে দু-এক বছর হাতে রাখিয়া বলিতে হয়। সুতরাং দুর্গা যখন বলিলেন, তের, তখন সবাই বুঝিল পনর। তা ছাড়া একমাত্র সন্তান বলিয়া, নিজেরা না খাইয়া মেয়েকে খাওয়াইয়াছিলেন, পরাইয়াছিলেন—সেই নিটোল স্বাস্থ্যই এখন আরও কাল হইল—জ্ঞানদার যথার্থ বয়সের বিরুদ্ধে ইহাই বেশি করিয়া সাক্ষ্য দিতে লাগিল।

দুই দিন না যাইতেই শম্ভু কথাপ্রসঙ্গে ভগিনীকে কহিলেন, মেয়েটার জন্য ত পাড়ায় মুখ দেখানো ভার হয়েছে। একটি ভারী সুপাত্র হাতে আছে, দিবি?

দুর্গা বলিলেন, জামাই আমার স্থির হয়ে আছে—আর কোথাও হতে পারে না। শম্ভু বলিলেন, তা হলে ত কথাই নেই। কিন্তু এমন সুপাত্র বড় ভাগ্যে মেলে, তা বলে দিচ্চি। কুড়ি-পঁচিশ বিঘে ব্রহ্মত্র, পুকুর, বাগান, ধানের গোলা—লেখাপড়াতেও—

দুর্গা কথাটা শেষ করিতে না দিয়াই বলিলেন, না দাদা, আর কোথাও হবার জো নেই—এই বছরটা বাদে সেখানেই আমাকে মেয়ে দিতে হবে।

শম্ভু বলিলেন, কিন্তু, আমার বিবেচনায়—এই সামনের অঘ্রানেই মেয়ে উচ্ছুগ্যু করা কর্তব্য হয়েছে। দুর্গা আর নিরর্থক প্রতিবাদ না করিয়া—কাজ আছে, বলিয়া উঠিয়া গেলেন। ক্রমশঃ প্রকাশ পাইল, এই সুপাত্রটি শম্ভুরই এ-পক্ষের বড় শ্যালক। স্ত্রীর মৃত্যু ঘটায়, প্রায় ছয় মাস যাবৎ বেকার অবস্থায় আছেন—আর বেশিদিন থাকা কেহই সঙ্গত মনে করে না। বিশেষতঃ ঘরে অনেকগুলি কাচ্চা-বাচ্চা থাকায় একটি ডাগর মেয়ে নিতান্তই আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে।

সেইজন্যই বোধ করি, দুর্গার বারংবার অস্বীকার করা সত্ত্বেও এই সুপাত্রটি একদিন সহসা আবির্ভূত হইয়া সম্মুখেই জ্ঞানদাকে দেখিতে পাইলেন, এবং বলা বাহুল্য যে, পছন্দ করিয়াই ফিরিয়া গেলেন। অনতিকাল মধ্যেই ভগিনীর প্রতি শম্ভুনাথের স্নেহের অনুরোধ কঠোর নির্যাতনের আকার ধরিয়া দাঁড়াইল। একদিন তিনি স্পষ্টই জানাইয়া দিলেন যে, প্রিয়নাথের অবর্তমানে তিনিই এখন ভাগিনেয়ীর যথার্থ অভিভাবক। সুতরাং আবশ্যক হইলে এই সামনের অঘ্রানেই তিনি জোর করিয়া বিবাহ দিবেন।

দাদার সঙ্গে বাদানুবাদ করিয়া দুর্গা ঘরে ঢুকিয়া মেয়ের পানে চাহিয়াই বুঝিতে পারিলেন, সে সমস্ত শুনিয়াছে। তাহার দুই চক্ষু ফুলিয়া রাঙ্গা হইয়া উঠিয়াছে। তাহাকে বুকে টানিয়া লইয়া বলিলেন, আমি বেঁচে থাকতে ভয় কি মা! মুখে অভয় দিলেন বটে, কিন্তু ভয়ে তাঁহার নিজের বুকের অন্তঃস্থল পর্যন্ত শুকাইয়া কাঠ হইয়া গিয়াছিল। এ-সব দেশে এরূপ জোর করিয়া বিবাহ দেওয়া যে একটা সচরাচর ঘটনা, তাহা তাঁহার অজ্ঞাত ছিল না। মায়ের বুকে মুখ লুকাইয়া মেয়ে উচ্ছ্বসিত হইয়া কাঁদিতে লাগিল। মা তাহার কপালে বুকে হাত দিয়া দেখিলেন, জ্বরে গা ফাটিয়া যাইতেছে। চোখ মুছাইয়া দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কখন জ্বর হল মা?

কাল রাত্তির থেকে।

আমাকে জানাস নি কেন? আজকাল যে ভয়ানক ম্যালেরিয়ার সময়। মেয়ে চুপ করিয়া রহিল, জবাব দিল না।

দাদার বৌয়ের সহিত দুর্গা এ পর্যন্ত কোনপ্রকার ঘনিষ্ঠতার চেষ্টা করেন নাই। শুধু যে তাহার বিকট চেহারা ও ততোধিক বিকট হাসি দেখিলেই তাঁহার গা জ্বলিয়া যাইত তাহা নহে, তাহার অতি কর্কশ কণ্ঠস্বরও তিনি সহ্য করিতে পারিতেন না। পাড়াগাঁয়ের মেয়েরা স্বভাবতঃই একটু উচ্চকণ্ঠে কথা কহে; কিন্তু বৌয়ের কথাবার্তা একটু দূর হইতে শুনিলে ঝগড়া বলিয়া মনে হইত। তাহার উপর সে যেমন মুখরা, তেমনি যুদ্ধবিশারদ। কিন্তু তাহার একটা গুন দুর্গা টের পাইয়াছিল—সে গায়ে পড়িয়া ঝগড়া করিতে চাহিত না। তার গন্তব্য পথ ছাড়িয়া দিলে, সে কাহাকেও কিছু বলিত না—ছেলে-পিলে ঘর-সংসার লইয়াই থাকিত, পরের কথায় কান দিত না।

প্রথমে আসিয়াই দুর্গা একদিন তাহার রান্নাবান্নার সাহায্য করিতে গিয়াছিলেন। তাহাতে সে স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছিল—তুমি দু’দিনের জন্যে এসেচ ঠাকুরঝি, তোমাকে কাজ করতে হবে না। আমি রান্নাঘর, ভাঁড়ারঘর কাউকে দিতে পারব না। সেই অবধি দুর্গা এবিষয়ে একপ্রকার নিশ্চিন্ত হইয়াছিলেন!

আজ বেলা দেখিয়া বৌ দোর-গোড়ায় স্বাভাবিক চিৎকারশব্দে প্রশ্ন করিল, আজ খাওয়া-দাওয়া কি হবে না ঠাকুরঝি? হেঁসেল নিয়ে বসে থাকব?

দুর্গা মুখ তুলিয়া বলিলেন, মেয়েটার ভারী জ্বর হয়েচে বৌ; তোমরা খাও গে, আমরা আজ আর কেউ খাব না। বৌ কহিল, মেয়ের জ্বর, তা তোমার কি হ’ল গো? জ্বর আবার কার না হয়? নাও, উঠে এসো। দুর্গা কাতরকণ্ঠে কহিলেন, না বৌ, আমাকে খেতে বল না—মেয়ে ফেলে আমি মুখে ভাত তুলতে পারব না।

তোমাদের সব আদিখ্যেতা, বলিয়া বৌ চলিয়া গেল। রান্নাঘর হইতে পুনরায় কহিল, জ্বর হয়েচে কবরেজ ডেকে পাঁচন সিদ্ধ করে দাও। ম্যালোয়ারী জ্বরে আবার খায় না কে? আমাদের দেশে ওসব উপোস-তিরেসের পাঠ নেই বাপু! বলিয়া সে নিজের কাজে মন দিল।

অপরাহ্নবেলায় সে নিজেই একবাটি পাঁচন সিদ্ধ করিয়া আনিয়া কহিল, ওলো ও গেনি, উঠে পাঁচন খা! ভাতে জল দিয়ে রেখেছি, চল, খাবি আয়।

মামীকে সে অত্যন্ত ভয় করিত। বিনাবাক্যে উঠিয়া খানিকটা তিক্ত পাঁচন গিলিয়া বমি করিয়া ফেলিয়া পুনরায় শুইয়া পড়িল। দুর্গা ঘরে ছিল না, বমির শব্দে ছুটিয়া আসিয়া ব্যাপার দেখিয়া নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া রহিলেন। মামী রাগ করিয়া উঠানে গিয়া সমস্ত পাড়া শুনাইয়া বলিতে লাগিলেন, এ-সব বাবুমেয়ে নিয়ে আমাদের গরীব, দুঃখীর ঘরে আসা কেন বাপু?

সেই হইতেই জ্ঞানদার অসুখ উত্তরোত্তর বাড়িতেই লাগিল। তাহার ভামিনী-মামী সেই যে প্রথম দিনেই বলিয়াছিল, বাছা! পল্লীগ্রামে সাপের কামড়ে আর ক’টা লোক মরে, মরে যা তা ঐ ম্যালোয়ারীতে। একবার ধরলে আর রক্ষে নেই। তাহার কথাটার সত্যতা সপ্রমাণ হইতে বেশি বিলম্ব ঘটিল না, অনতিকালমধ্যেই জ্ঞানদাকে একেবারে শয্যাগত করিয়া ফেলিল। সেদিন কার্তিকের সংক্রান্তি; দুর্গা ঘরে ঢুকিয়া আশ্চর্য হইয়া দেখিলেন, বৌ জ্ঞানদার শিয়রে বসিয়া তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া দিতেছে। একে ত সংসারের কাজ ছাড়িয়া এইসব বাজে কাজ করিবার তাহার অবসরই নাই, তাহাতে পরের মেয়ের প্রতি এই অযাচিত সেবাটা এমনি একটা প্রকৃতি-বিরুদ্ধ বিসদৃশ কাণ্ড বলিয়া দুর্গার মনে হইল যে, তিনি দাদার প্রস্তাবিত সেই বিবাহ-ব্যাপারটা স্মরণ করিয়া আশঙ্কায় কণ্টকিত হইয়া উঠিলেন। ভামিনীর এই যত্নটা যে সেই জন্যই, তাহাতে আর সংশয়মাত্র রহিল না। কারণ, সে যে নিজের দাদার সহিত জ্ঞানদার বিবাহ ঘটাইবার জন্য স্বামীকে নিয়োজিত করিয়াছে এবং ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত করিতেছে, প্রথম হইতেই এই কথাটা দুর্গা স্বতঃসিদ্ধের মত মানিয়া লইয়াছিলেন। বৌ গলাটা আজ একটু খাটো করিয়াই কহিল, তারকেশ্বরে পাশ-করা ডাক্তার আছে—তোমার দাদাকে আনতে পাঠিয়ে দিয়েচি, ঠাকুরঝি। জ্বর যেন রোজ রোজ বেশিই হচ্চে—এ তো ভালো না। দুর্গা অব্যক্তস্বরে যাহা বলিলেন, তাহা শোনা গেল না, কারণ এই সুসংবাদ শুনিয়াও তিনি অন্তরের ভিতর হইতে প্রসন্ন হইতে পারিলেন না।

বৌ সংসারের কাজে চলিয়া গেল। জ্ঞানদা বালিশের তলা হইতে একখানি চিঠি বাহির করিয়া কহিল, জবাব দিয়েচেন।

কৈ দেখি, দেখি, বলিয়া মা সেখানি যেন কাড়িয়া লইলেন। কিন্তু পরক্ষণেই অসহ্য আগ্রহ দমন করিয়া চিঠিখানা দুই মুঠার মধ্যে লইয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন। একবার মনে করিলেন, খুলিয়া পড়ি। আবার ভাবিলেন, না, উচিত নয়। মেয়ে যেন হাতেই দিয়েছে, কিন্তু মা হইয়া তিনি পরিবেন কি করিয়া! মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, কি লিখেচে অতুল?

জ্ঞানদা ইতিমধ্যে পাশ ফিরিয়া শুইয়াছিল। সংক্ষেপে কহিল, আসা উচিত ছিল না—এই-সব। পত্রের এই দুটি কথা শুনিয়াই মায়ের দুই চক্ষে জল আসিয়া পড়িল। তিনি মনে মনে আবৃত্তি করিলেন, আসা উচিত ছিল না—এই সব। অতুলের মুখখানি স্মরণ করিয়া, তাহাকে অসংখ্য আশীর্বাদ করিয়া দুর্গা মাতৃস্নেহে বিগলিত হইয়া মনে মনে বলিলেন, না জানি, বাছার কতই না অভিমান, কতই না মর্মান্তিক ব্যথা, এই দুটি কথার মধ্যে লুকান আছে। এখানে আসিয়া জ্ঞানদা জ্বরে পড়িয়াছে—তাহাতেই ত বাছা সেদিন রাগ করিয়া বলিয়াছিল—ইহাদের গঙ্গাযাত্রা দেখিতে কলিকাতা হইতে আসিয়াছি। সত্যই ত!—আমি নিজে যাই করি এবং যেখানেই যাই, সে আলাদা কথা। কিন্তু মেয়ে লইয়া আমার যে কোনমতেই আসা উচিত ছিল না। যতই কষ্ট হোক, সব সহ্য করিয়াই ত সেখানে আমাদের পড়িয়া থাকা উচিত ছিল। কাগজখানি অপূর্ব মমতার সহিত মুঠার মধ্যে নাড়াচাড়া করিতে করিতে কত কথাই আজ তাঁহার মনে পড়িতে লাগিল। স্বামীর মৃত্যুশয্যায় অতুলের প্রতিজ্ঞা—সেই চুড়ি দু’গাছি দিবার ছলে মহাপ্রসাদ লইয়া আসা, বিশেষ করিয়া আসিবার দিনটায় মাসির সহিত তাহার কলহ। এ-কথা তাহার মা শুনিয়াছেন, পাড়ার লোকে শুনিয়াছে—এতদিনে সবাই জানিয়াছে কেন সে কলিকাতা হইতে ছুটিয়া আসিয়াছিল। আনন্দে গর্বে তাঁহার মাতৃবক্ষ পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। মনে মনে বলিলেন, কালো মেয়ে! আমার কালো মেয়ের গৌরব দেখুক সবাই! ওরে কোকিলও কালো, ভোমরাও কালো যে! ডাকিলেন—জ্ঞানদা, এখন কেমন আছিস মা?

ভাল আছি মা।

হাঁ রে, আমার কথা অতুল কিছু লিখেচে?

পড়ে দেখ না।

কৌতূহল আর তিনি সামলাইতে পারিলেন না। জানালার কাছে কাগজখানি মেলিয়া ধরিলেন। অতবড় কাগজের মধ্যে মাত্র দুইছত্র লেখা দেখিয়া প্রথমটা তাহার মনে হইল, মেয়ে কি দিতে, হয়ত কি দিয়াছে। পরক্ষণেই ‘শ্রীচরণেষু’ পাঠ দেখিয়া মনে মনে হাসিয়া বলিলেন, তাইতেই পড়তে দিয়েছে—এ যে আমারই চিঠি। লেখা আছে—“সেই সময়েই বলিয়াছিলাম, ও জায়গা ম্যালেরিয়ার ডিপো। জ্ঞানদার জ্বর শুনিয়া দুঃখিত হইলাম—আশা করি, শীঘ্র আরোগ্য হইয়া যাইবে। আমরা ভাল আছি। আমার প্রণাম গ্রহণ করিবেন।” ইতি—

দুর্গার কথাটা জিজ্ঞাসা করিতে একটু বাধিল, কিন্তু মায়ের প্রাণ—না জিজ্ঞাসা করিয়াও থাকিতে পারিলেন না; কাছে বসিয়া মেয়ের রুক্ষ চুলগুলি আঙুল দিয়া নাড়িতে নাড়িতে আস্তে আস্তে বলিলেন, হাঁ মা, তোমার চিঠিটার মধ্যে বুঝি অতুল রাগ করেচে? জ্ঞানদা বিস্মিত হইয়া মুখ ফিরাইয়া কহিল, আমার চিঠি আবার কোথায় মা? তোমাকেই তো লিখেছেন। দুর্গা একটুখানি হাসিয়া বলিলেন, আমি দেখতে চাই না, শুনলেই সুখী। রাগ করেচে, সে ত আমি বুঝতেই পারচি—

না মা, আমাকে তিনি আলাদা চিঠিপত্র কিছুই লেখেন নি। যা লিখেছেন, তা ওই। বলিয়া মেয়ে পুনরায় পাশ ফিরিয়া শুইল।

সবে দু’ছত্র? আর কোন কথা নেই? বলিয়া দুর্গা স্তব্ধ হইয়া গেলেন। তাঁহার যে আঙুলগুলা এতক্ষণ মেয়ের চুলের মধ্যে নানাপ্রকার বিচিত্র গতিতে বিচরণ করিয়া ফিরিতেছিল, সেগুলাও যেন হাড়ের মত শক্ত হইয়া উঠিল; এইভাবে অনেকক্ষণ নিঃশব্দে বসিয়া থাকিয়া তিনি উঠিয়া গেলেন।

আবার দিন কাটিতে লাগিল।