» » একাশি থেকে নব্বই পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

দূরবীন

একাশি থেকে নব্বই পরিচ্ছেদ

তখন সন্ধের কুয়াশামাখা অন্ধকার ধীরে ধীরে গড়িয়ে আসছে চারদিক থেকে। জল-স্থল-অন্তরীক্ষের সব বাস্তবতা হারিয়ে যাচ্ছে এক রহস্যময় কুহেলিকায়। ব্রহ্মপুত্রের বুক থেকে আঁশটে গন্ধ বয়ে নিয়ে হু-হু করে উত্তুরে হাওয়া এল। কাছেপিঠে ডেকে উঠল একশ শেয়াল।

বিকেল থেকেই শশিভূষণ টের পাচ্ছিল, জ্বর আসবে। কিন্তু পরের বাড়িতে অচেনা লোকজনের কাছে সে কথাটা বলতে পারেনি। একটা ঘর আর একটা বিছানা পেয়ে সে বর্তে গিয়েছিল। শেষ বেলায় এক পেট খেয়ে অঘোরে লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছিল। ঘুম ভাঙল মাথার ব্যথা আর শরীরের কম্পে। কাউকে ডাকবে কিনা বুঝতে পারছিল না সে। এরা রাজা জমিদার মানুষ। এসব লোক কেমন হয় তা তার ভাল জানা নেই। আশ্রয়টুকু দিয়েছে সেই ঢের। এরপর আবার অসুখ-বিসুখের কথা শুনলে হয়তো বিরক্ত হবে। শশিভূষণের অবশ্য জ্বরের সঙ্গে চেনাজানা বহু দিনের। এ হল ম্যালেরিয়া। খুব বেশীক্ষণ থাকে না। কিন্তু যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ অস্তিত্বকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। ঘরে কেউ আলো জ্বেলে দিয়ে যায়নি। অবশ্য আলোর বাবস্থা আছে। জ্বেলে নিলেই হয়। কিন্তু শশিভূষণ ভয়ে আলো জ্বালল না। ঘরে যে লোক আছে সেটা পাঁচজনকে জানান দেওয়ার কী দরকার?

লেপমুড়ি দিয়ে শশিভূষণ ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। তারপর ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যেতে লাগল চেতনা। চোখের তারা উল্টে গেল। কিছুক্ষণ ঘোরের মধ্যে সে ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা আর শেকসপীয়রের নাটক থেকে মুখস্থ বলতে লাগল। মাঝে মাঝে “ভূত! ভূত!” বলে চেঁচিয়ে উঠতে লাগল।

ঘরেব দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছিল সে। উঠে সেটা আর খুলে দিতে পারেনি। জানালার একটা পাল্লা ভাঙা। তা দিয়ে ভয়ংকর ঠাণ্ডা হাওয়া আসছিল ঘরে। অন্ধকারে একটা দুটো জোনাকি পোকা ঘুরে ঘুরে ওড়ে। গাছের ডালে রহস্যময় সব শব্দ হয়। শেয়াল ডাকে। জ্বরের ঘোরে এই সব আবহ এক বিচিত্র পরপারের ছবি রচনা করে শশিভূষণের চারপাশে!

বিকেল পেরিয়ে সন্ধে নামার পরও কৃষ্ণকান্ত বারবাড়ির মাঠে একটা টাট্টু ঘোড়া চালাচ্ছিল। ঘোড়া চালাতে সে সদ্যই শিখেছে। রোমাঞ্চকর এই অভিজ্ঞতার প্রথম স্বাদ সে যতক্ষণ পারে উপভোগ করে নেয়। সারা বিকেল ঘোড়া চালিয়েও সে ক্লান্ত হয়নি। আর অনেকক্ষণ চালাতে পারে। কিন্তু উপায় নেই। একটু বাদেই প্রতুল মাস্টারমশাই আসবেন। হরি এসে তাকে ডেকে নিয়ে যাবে।

তার এই ঘোড়া দাবড়ানোর দৃশ্যটা দেখছিল মাত্র একজন। সে হল হর কমপাউণ্ডার। এই বিশ্ব-সংসারে তার আপনজন আর কেউ অবশিষ্ট নেই। বছর দুই আগে কৃমি বিকারে তার মেয়েটা মরার পরই সব মায়ামোহের বাঁধন একদম কেটে গেল তার। কিন্তু সেই সঙ্গেই দেখা দিল মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ। পাঁচ টাকা বেতনে সে জ্ঞানদা দাতব্য চিকিৎসালয়ে চাকরি করত। কৃষ্ণকান্ত তখন প্রায়ই গিয়ে ডাক্তারখানার পেছন দিককার ওষুধের ঘরে বসে থাকত। অবাক হয়ে দেখত হব কমপাউণ্ডার কেমন ওষুধের সঙ্গে ওষুধ মেশায়, শিশির গায়ে নকশাকাটা কাগজের দাগ সাঁটে আঠা দিয়ে। মাঝে মাঝে মেজার গ্লাসে কৃষ্ণকান্তকে মিষ্টি ও সুগন্ধী সিরাপ খাওয়াত সে। বিস্তর ভূত-প্রেতের গল্প শোনাত।

মাথা খারাপের লক্ষণ দেখা দেওয়ায় হর কমপাউণ্ডারের চাকরিটি গেছে। কিন্তু হেমকান্ত তাকে তাড়িয়ে দেননি। হর কমপাউণ্ডারকে চাকরি দিয়েছিলেন তাঁর বাবা শ্যামকান্ত। বাপের আমলের পুরোনো ও বিশ্বাসী লোকটিকে তাই এখনও নিজের আশ্রয়ে রেখেছেন।

মায়ামোহ মানুষের জন্মগত অভিশাপ। সহজে কাটে না। আপন না পেলে পরকে আঁকড়ে ধরে। এমন কি বেড়ালটা, কুকুরটা, গাছটা পর্যন্ত মায়াবশে মানুষের আপন হয়। হর কমপাউণ্ডারেরও হয়েছে তাই। এ বাড়ির চৌহদ্দিতে তার একটা অদৃশ্য খোঁটা পোঁতা আছে। সেই খোঁটায় বাঁধা মায়ার দড়ি। কে যেন টানে। হর কমপাউণ্ডার তাই আর কোথাও যেতে পারেনি শেষ পর্যন্ত।

এই যে কৃষ্ণকান্ত, দশ-এগারো বছরের তেজী সুন্দর ছেলেটা, এ হল মনিবের ছেলে। আত্মীয়তা নেই, অবস্থা বয়স ইত্যাদির ফারাকও যথেষ্ট। তবু এ ছেলেটাকে দেখলেই বুকটার মধ্যে কেমন উথলে-ওঠা ভাব হয় তার। ছেলেটার যা দেখে তাই তার ভাল লাগে। এই যে আবছায়া মতো আলোয় সাদা টাট্টু ঘোড়ায় চেপে চারদিকে ঢেউ তুলে দাবড়ে বেড়াচ্ছে কৃষ্ণকান্ত, এই দৃশটাকে তার পার্থিব কিছু বলে মনে হয় না। এ যেন এক স্বপ্ন-দৃশ্য। বিলিতি ছবির বইতে এরকম সব ছবি আছে। তা থেকেই যেন বেরিয়ে এসেছে ছেলেটা, আবার ছবির মধ্যে ফিরে যাবে।

কাছারির মাঠের চারধারে ঋজু পাম গাছের মিছিল। তারই ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে কৃষ্ণকান্ত। ঘোড়ার খুরের শব্দ ধরিত্রীর হৃদস্পন্দনের মতো ধুকপুক ধুকপুক করে বেজে যাচ্ছে অবিরল।

মস্ত একটা চক্কর দিয়ে কৃষ্ণকান্ত ঘোড়া ছুটিয়ে কাছে আসে। আবার দূরে চলে যায়। হর কমপাউণ্ডার কাছারির সিঁড়ির শেষ ধাপটায় বসে একটা নস্যি রঙের আলোয়ানে সারা গা ঢেকে চুপচাপ দেখতে থাকে। তার মুখে একটু হাসি লেগে আছে সেই কখন থেকে।

পৃথিবী জায়গাটা ভাল না খারাপ তা আজকাল আর বুঝতে পারে না হরনাথ। তবে সে বোঝে যে, এখানে তার আর কোনো কাজ নেই। কাজ শুধু চেয়ে থাকা, শুধু বসে থাকা, শুধু বেঁচে থাকা। আর কিছু নয়।

কৃষ্ণকান্ত গল্প শুনতে বড় ভালবাসে। আগে তাকে অনেক গল্প শোনাত হরনাথ। আজকাল আর গল্প মনে পড়ে না। একটা গল্প শুরু করে অন্য গল্পে চলে যায়। মাথাটা ঠিক নেই কিনা। আজ তার বদরুদ্দিনের গল্পটা মনে পড়েছে। সবটা নয়, তবে কিছুটা। কৃষ্ণকান্ত ঘোড়া চালানো শেষ করে তার লাশটিতে এসে বসবে। তখন গল্পটা শোনাবে হরনাথ। তাই প্রাণপণে সে গল্পটা মাথার মধ্যে ধরে রাখার চেষ্টা করছে। আজকাল বেশীক্ষণ কিছুই নে মাথায় রাখতে পারে না।

বদরুদ্দিনের ঘোড়াটার বয়স হয়েছিল। তার ওপর চোখে ছানি পড়তে লাগল। বদরুদ্দিনও বুড়ো মানুষ। চোখের নজর তারও তখন কমে এসেছে। তবু সওয়ারির জন্য কানা ঘোড়ায় ছ্যাকরা গাড়ি তে বদরুদ্দিন রোজ বেরোতো। তবে গণ্ডগোল হত খুব। প্রথম প্রথম আন্দাজে রাস্তা ঠাহর করত। পরে ভুল রাস্তায় নিয়ে গিয়ে সওয়ারির ধমক খেত। বদরুদ্দিন রেগে গিয়ে চাবুক চালাত শপাশপ। কিন্তু ঘোড়াটাই বা কী করে! মার খেয়ে বেচারা চিহিঁহিঁ করে কেঁদে উঠত শুধু। তারপর একদিন গাঙ্গিনার পাড়ে রাস্তা ছেড়ে ঘোড়াটা গিয়ে পড়ল একটা মাদার গাছের ওপর। গলায় ফাঁস লেগে ঘোড়াটা আর ঘাড় ভেঙে বদরুদ্দিন নিজেও সেইখানেই মরে গেল। তা বলে গল্পটা শেষ হল না কিন্তু। শরীর ছেড়ে উঠে দাঁড়াল বদরুদ্দিন। গা ঝাড়া দিয়ে উঠল তার ঘোড়াও। দুজনেই তখন চোখে বেশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ভাঙা গাড়িটায় আবার ঘোড়া যুতে নিল বদরুদ্দিন। তারপর পংক্ষিরাজের মতো উড়ে বেড়াতে লাগল শহরময়। মাঝরাতে না জেনে কেউ কেউ এখনো বদরুদ্দিনের ছ্যাকরা গাড়ির সওয়ার হয়। আর রাস্তা ভুল হয় না।

বুড়ো সহিস লণ্ঠন হাতে এসে দাঁড়িয়ে আছে মাঠের মধ্যিখানে। ঘোড়ার পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে।

ও ছোটোকর্তা, এবার নামো। ঘোড়ার মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে। আর না।

কৃষ্ণকান্ত ঘোড়া থামায়। হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বসে হরনাথের পাশে। বলে, ওফ, দারুণ চালিয়েছি আজ। না, হরদা?

খুব।

দুজনেই চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকে। কুয়াশা এবং অন্ধকার ঘনিয়ে ওঠে। মন্দির থেকে শঙ্খধ্বনি আসে।

কৃষ্ণকান্তর সত্যিকারের কোনো অভিভাবক নেই। হেমকান্ত তার প্রতি নজর দেন না। কেউই দেয় না। মাঝে মাঝে রঙ্গময়ী একটু-আধটু ডাক খোঁজ করে মাত্র। কৃষ্ণকান্ত বেড়ে উঠছে নিজের মতো করেই। সময় মতো লেখাপড়া করা আর ইসকুলে যাওয়া ছাড়া বাদবাকি সময়টা সে কী করে বেড়ায় তার খোঁজ কেউ নেয় না। সুতরাং নানা সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড করে সে। তিনতলার চোর কুঠুরিতে পুরোনো আমলের কিছু অস্ত্রশস্ত্র আছে। সেই ঘর থেকে একদিন একটা তরোয়াল বের করে এনেছিল কৃষ্ণকান্ত। সারাদিন খোলা তরোয়াল হাতে করে ঘুরে বেড়াল। কযেকজন অবশ্য বারণ করেছিল, সে শানেনি। বস্তুত হেমকান্ত ছাড়া আর কারও কথা শোনে না সে। ফয়জলের গোটা দুই ছাগল আর ছানাপোনারা রোজই ঘাস খেতে আসে বারবাড়ির পশ্চিম দিককার গোচর ভূমিটায়। কখন যে কৃষ্ণকান্ত সেখানে হাজির হয়েছে তা কেউ জানে না। হঠাৎ তার আর্তনাদ শুনে লোকজন ছুটে গিয়ে দেখল ধারি ছাগলটার মুণ্ডু খসে পড়ে আছে মাটিতে, ধরটা ছটফট করছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে জায়গাটা। কৃষ্ণকান্ত রক্তমাখা তরোয়াল হাতে দৃশ্যটার দিকে সম্মোহিতের মতো চেয়ে হরহর করে কাঁপছে।

কৃষ্ণকান্ত চমৎকার সাঁতার কাটতে পারে। বিশেষ করে ডুবসাঁতার। একদিন তার ইচ্ছে হল, অন্দরমহলের দিকে যে অথৈ পুকুরটা আছে তার তলা থেকে মাটি খামচে আনবে। যেই কথা, সেই কাজ। একদিন ডুব দিল তো দিলই। আর ওঠে না। হরি বিপদ বুঝে লোকজন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে। যখন কৃষ্ণকান্তকে তোলা হল তখন মৃত্যুর ঘণ্টা প্রায় বেজে গেছে।

হেমকান্ত অন্যান্য ছেলেরা যেমন শান্ত ও সুশীল কৃষ্ণকান্ত তেমন নয়। ঘরের চেয়ে বাইরের আকর্ষণ তার ঢের বেশী। বাড়ির পিছন দিকে পগারের ওপারে হেমকান্তর কিছু প্রজা বাস করে। তারা গরীব ও অসংস্কৃত। কৃষ্ণকান্ত নিয়মিত সেই পাড়ায় যায়। সেখানে তার একদঙ্গল অনুচরও জুট গেছে। কৃষ্ণকান্ত তাদের সঙ্গী করে মাঝে মাঝে মারপিট লাগায় অন্য পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে। এর ওর তার বাড়ি থেকে ফুল বা ফল চুরি করে। তাদের সঙ্গে ফুটবলও খেলে।

ব্রহ্মপুত্রের ধারে যেসব ডিঙ্গি নৌকো থাকে সুযোগ পেলেই কৃষ্ণকান্ত দড়ি খুলে সেগুলো স্রোতের মুখে ঠেলে দিয়ে আসে। বুড়ো রামভজুয়া দারোয়ানের কানে সে একবার গোকুলপিঠের গরম রস ঢেলে দিয়েছিল। রামভজুয়ার সেই কান একদম গেছে।

হেমকান্তর কাছে অবশ্য এসব খবর বড় একটা পোঁছায় না। প্রথম কথা, কৃষ্ণকান্ত যে হেমকান্তর আদরের ছেলে এটা সবাই জানে। দ্বিতীয় কথা, মা-মরা ছেলে বলে সকলেরই একটু মায়া আছে। তাই কেউ নালিশ করতে যায় না। হেমকান্তর বড় ছেলে কণককান্তি কলকাতায় তাঁদের কালীঘাটের বাড়িতে থাকে। শ্বশুরের সঙ্গে সে একটা ব্যবসায় নেমেছে। ব্যবসা কিসের তা খোঁজ করেননি হেমকান্ত । তবে আয় বোধহয় ভালই হচ্ছে। কণককান্তি টাকার জনা বাপকে চিঠি লেখে না। সম্প্রতি সে একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছে। সে কৃষ্ণকান্তকে নিজের কাছে রেখে মানুষ করতে চায়। হেমকান্ত না বা হ্যাঁ কোনোটাই জানাননি। কৃষ্ণকান্তকে ছেড়ে থাকতে তাঁর কষ্ট হবে। তবু তাকে যে কলকাতায় পাঠানোই উচিত তাও তাঁর মনে হয়। এখানে কৃষ্ণকে দেখার কেউ তেমন নেই। কণককান্তিও আগ্রহের সঙ্গেই চাইছে।

কিন্তু কলকাতায় যাওয়ার প্রস্তাবে কৃষ্ণকান্ত কেঁদে ভাসিয়েছে। বাবা তাকে এখনো কিছু বলেনি ঠিকই, কিন্তু যদি বলে? বাবার কথার ওপর তো আর কথা চলে না। মনু পিসি বা রঙ্গময়ীই হচ্ছে তার একমাত্র ভরসা। বড়দা তাকে কলকাতায় নিয়ে যেতে চায় শুনে সে গিয়ে মনু পিসির ওপর হামলে পড়ল, আমি কিন্তু কিছুতেই যাবো না, বলে দিচ্ছি। তুমি বাবাকে রাজি করাও।

কৃষ্ণ কোথাও চলে যাবে এটা রঙ্গময়ীও ভাবতে পারে না। সুনয়নী চলে যাওয়ার পর এই দুধের বাচ্চাটিকে সে বুকে আগলে এত বড়টি করেছে। তবু সে বলল, যাবি না তো কী করবি? এখানে কে তোকে অত চোখে চোখে রাখবে? কখন পুকুরে ডুবে মরিস, কার সঙ্গে মারামারি করে মাথা ফাটিয়ে আসিস তার তো ঠিক নেই। কলকাতায় ধরাবাঁধা জীবন, সেখানেই গিয়ে থাকা ভাল।

এরপর কৃষ্ণকান্ত রেগে রঙ্গময়ীকে আঁচড়ে কামড়ে চুল ছিঁড়ে একাকার কাণ্ড করল। রঙ্গময়ী ভরসা দিল, আচ্ছা যা, তোর বাবাকে রাজি করানোর চেষ্টা করব।

কৃষ্ণকান্ত ভরসা পেল বটে, কিন্তু ভয়টা আজও কাটেনি। কণককান্তি সামনের মাসে আসছে। সেই সময়, আবার তাকে কলকাতা নিয়ে যাওয়ার কথা উঠবে। সেখানে এমন অবারিত মাঠঘাট নেই. ঘোড়া নেই, বন্ধু নেই, ধারেকাছে নেই নদী বা পুকুর। বড়দা লোকটা ভারী গোমরামুখো। বউদিও ভীষণ রাগী।

কৃষ্ণকান্ত হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, হরদা, কখনো কলকাতায় গেছ?

গেছি। অনেকদিন আগে।

তোমার ভাল লাগে?

না।

তোমার এ জায়গাটিই বেশী ভাল লাগে, না হরদা?

হ্যাঁ।

আমারও। তবু বড়দা আমাকে কলকাতায় নিয়ে যেতে চাইছে।

হরনাথ উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, সে কী? তুমি যেও না।

কিন্তু জোর করে নিয়ে গেলে কী করব?

তুমি জোর করেই এখানে থেকে যাবে।

কৃষ্ণকান্ত এ কথায় হেসে উঠে বলল, হরদা, তুমি সত্যিই পাগলা। বাবা যদি বলে, ওরে কৃষ্ণ, কণকের সঙ্গে কলকাতায় যা তা হলে কী হবে?

তুমি লুকিয়ে থেকো। আমি তোমাকে একটা জায়গা দেখিয়ে দেবো। কেউ খুঁজে পাবে না তোমাকে।

কৃষ্ণকান্ত সঙ্গে সঙ্গে কৌতূহলী হয়ে বলে, আছে সেরকম জায়গা?

অনেক আছে। কেউ খুঁজে পাবে না।

জায়গাটা দেখাবে আমাকে?

হরনাথ মুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখছিল কৃষ্ণকান্তকে। এ ছেলে ভবিষ্যতে খুব বড় কেউ একজন হবে। চোখের দৃষ্টি এই বয়সেই কী গভীর! কেমন ধারালো চেহারা। সে বলল, দেখাতে পারি। তবে একটু ভয়ের জায়গা।

ভয়! কিসের ভয়?

ওখানে আরও একজন থাকে কিনা।

সে কে?

তোমার কাকা। নলিনীকান্ত।

কী যে বলো! কাকা তো বেঁচে নেই।

তা না থাক, মরে তো আছে।

তার মানে?

হরনাথ নির্বিকার গলায় বলে, নলিনীবাবুর ঘরে এখনো নলিনীবাবু থাকেন।

কৃষ্ণকান্তর গায়ে একটু কাঁটা দিল। হরনাথের কাছ ঘেঁষে বসে সে বলল, সত্যি বলছ?

তিন সত্যি। মাঝরাতে সাইকেল চালিয়ে আসেন। ঘরে ঢোকেন। সব টের পাই।

কখনো দেখেছো?

দু-একবার। আমি তাঁর সাড়া পেলেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। রোজ দেখতে পাই না অবশ্য। তবে দু’বার দেখেছি। একবার আমাকে ইশারায় কাছেও ডাকেন।

তুমি কাছে গেলে?

গিয়েছিলাম। কিন্তু তারপর আর কিছু দেখতে পেলাম না।

ও বাবা! ও ঘরে আমাকে লুকিয়ে থাকতে বলছ?

ভয় পেও না। উনি তোমার কাকা হতেন। তোমার কোনো ক্ষতি করবেন না। বরং, ভালই করবেন। ওদের ভয় পেতে নেই। আমাদের যেমন একটা জগৎ আছে, ওদেরও তেমনি একটা আলাদা জগৎ আছে।

তুমি ভূত দেখতে পাও?

খুব দেখতে পাই। তোমার মাকে মাঝে মাঝে দেখি, ভিতরের দরদালানের জানালায় দাঁড়িয়ে দুপুরবেলা চুল শুকোচ্ছেন। কাল যখন বিকেলে তুমি ঘোড়া চালাচ্ছিলে তখন উনি এসে সামনের গাড়িবারান্দার ছাদে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে দেখছিলেন তোমাকে।

কৃষ্ণকান্ত খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল হরনাথের সঙ্গে। বলল, মা আমাকে কেন দেখছিল?

দেখবে না? ছেলে বলে কথা! তোমাকে একটুখানি দেখে চলে গেছেন, এখন তুমি কত বড়টি হয়েছো! ঘোড়া চালাও, ইসকুলে যাও, ফুটবল খেল। মা তাই দেখতে আসেন।

ভয় ভয় করলেও কৃষ্ণকান্ত ঘটনাটা খারাপ লাগল না। মার কথা তার মনেই নেই। তবু মা যে চাখের আড়ালে এখনো আছে সেটা ভাবতে ভালই লাগে।

হরনাথ অস্ফুট গলায় বলে, দুলিকেও দেখি। জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে শাক তোলে। আঁচলে মাছ ধরে। কখন ঘরেও আসে। আমার মাথার কাছটিতে চুপ করে বসে থেকে আবার চলে যায়।

তবে যে প্রতুল মাস্টারমশাই বলে, ভূত বলে কিছু নেই।

কী জানি। আমি তো সব স্পষ্ট দেখি। এই যেমন তোমাকে দেখছি। তবে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা হয় না।

আমার মাকে দেখাবে। আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে।

দেখা কি আর না যায়? চেষ্টা থাকলে, ইচ্ছে থাকলে দেখা যায়ই। দুলি মরার পর আমি কেবল দিনরাত তাকে ভাবতাম আর কাঁদতাম। ভাবতে ভাবতে আর কাঁদতে কাঁদতে মাথাটা কেমন গণ্ডগোল হয়ে গেল। তারপর থেকে সব দেখতে পাই। কোকাবাবু যেদিন মারা গেলেন—

সেদিন কী?

সেদিন তাঁকেও দেখেছি। সন্ধেবেলা ব্রহ্মপুত্রের জলে নেমে স্নান করলেন। সুন্দর একটা পিনিশ এল। তাইতে উঠে কোথায় চলে গেলেন।

কুষ্ণকান্ত একটু কাঠ কাঠ হয়ে গেল ভয়ে।

চারদিকে অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে। শেয়াল ডেকে উঠল। উত্তরের হাওয়া এল অদ্ভুত এক হাহাকারের শব্দ নিয়ে।

হরনাথ উঠে বলল, চলো, লুকিয়ে থাকার জায়গাটা তোমাকে দেখিয়ে দিই।

কৃষ্ণকান্ত ভয় পায় বটে, কিন্তু ভয়ে কুঁকড়ে যায় না, ভেঙেও পড়ে না। তার ভিতরে এক অফুরন্তু কৌতুহলই তাকে ভয়ের মুখেও এক ধরনের সাহস দেয়। সে উঠে বলল, কোথায় যাবে? কাকার ঘরে?

কাকার ঘরেই। তবে তার মধ্যেও একটু ব্যাপার আছে। চলো দেখাচ্ছি।

দুজনে আবছা অন্ধকার টানা বারান্দা ধরে কাছারিঘর ছাড়িয়ে ভিতর দিকে হাঁটতে থাকে।

সারি সারি ঘর। এত ঘর কোনো কাজে লাগে না। এক সময়ে এই কাছারি বাড়িতে বিস্তর লোক কাজ করত। আজকাল জমিদারির আয় কমেছে। লোকজনও কমে গেছে। গোটা চারেক বড় বড় মোকদ্দমায় হেরে গেছেন হেমকান্ত, কেবল তদবিরের অভাবে। এখন শোনা যাচ্ছে, বড় ভাই বরদাকান্তর স্ত্রীও সম্পত্তির অংশ চেয়ে মামলা করবে। হেমকান্ত এসব বৈষয়িক ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামান না। তাঁর কর্মচারীরাও তাঁর কানে সব কথা তোলে না। কিন্তু এই মন্ত্র জমিদারিতে যে অলক্ষ্মীর সঞ্চার ঘটেছে তাতে সন্দেহ নেই। এই শূন্য ঘরগুলো তারই আগাম ইঙ্গিত বহন করছে।

নলিনীর বন্ধ দরজার সামনে এসে হরনাথ দাঁড়ায়। দরজায় কান পেতে কী একটু শোনে। তারপর ফিসফিস করে বলে, ওই শোনো। নলিনীবাবুর গলা!

আচমকা কৃষ্ণকান্তও শুনতে পেল, ঘরের মধ্যে একটা গলা বিকট স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ভূত! ভূত।

কুয়াশামাখা অন্ধকারে ভূতুড়ে ছায়া ধীরে ধীরে গড়িয়ে আসছে চারদিক থেকে। বাস্তব হারিয়ে যাচ্ছে এক রহস্যময় কুহেলিকায়। ব্রহ্মপুত্রের বুক থেকে আঁশটে গন্ধ বয়ে নিয়ে হু হু করে উত্তুরে হাওয়া এল। কাছেপিঠে ডেকে উঠল একশ শেয়াল।

ভয় পাওয়ারই কথা। শশিভূষণকে যখন ধরে আনা হয় তখন কৃষ্ণকান্ত ইসকুলে। তাই ঘটনাটার কথা সে জানে না। কৃষ্ণকান্ত একবার ভাবল, দৌড় দেবে। কিন্তু জানার কৌতূহলও তার অসীম। সে দরজায় দমাদম ঘা দিয়ে বলল, কে? কে ভিতরে?

তোমার কাকা। ফিসফিস করে হরনাথ বলে।

কিন্তু কৃষ্ণকান্ত লক্ষ্য করেছে, দরজাটায় তালা দেওয়া নেই। এ ঘরটায় সর্বদাই তালা দেওয়া থাকে। ভিতরের কণ্ঠস্বর যদি নলিনীকান্তর প্রেতাত্মারই হয় তবে দরজার তালাটা খোলার দরকারই হত না। নিশ্চয়ই কেউ আছে।

আবার সে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল।

সেই শব্দে লোক জড়ো হতে দেরী হল না। গগন মুহুরি বলল, ও ঘরে একজন অতিথি আজ দুপুর থেকে আছে। কর্তাবাবু তার ওপর নজর রাখতে বলেছেন।

কৃষ্ণকান্ত একটু রাগের গলায় বলল, লোকটা দরজা খুলছে না কেন? কে লোকটা?

গগন মাথা চুলকে বলল, আমরা চিনি না। তবে পাগলের মতো চেহারা।

কৃষ্ণকান্ত আরো কয়েকবার দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল, লোকটার বোধহয় অসুখ করছে। দরজাটা ভাঙতে হবে।

খবর পেয়ে হেমকান্তও দরজা ভাঙার হুকুম দিলেন। ভিতরে ঢুকে দেখা গেল, শশিভূষণের জ্ঞান নেই। গায়ে প্রবল জ্বর।

রঙ্গময়ীকে কিছু বলতে হয় না। সে চট করে পুকুর থেকে এক বালতি জল নিয়ে এসে সযত্নে মাথা ধুইয়ে দিয়ে জলপটি দিতে লাগল কপালে। কুমুদ ডাক্তার এসে ওষুধ দিয়ে বলে গেল, খারাপ ধরনের ম্যালেরিয়া। মাথায় রক্তের চাপ প্রবল।

কৃষ্ণকান্ত জনে জনে জিজ্ঞেস করেও লোকটার নাম ছাড়া আর কিছুই জানতে পারল না। শশিভূষণের বয়স প্রতুল মাস্টারমশাইয়ের সমান। কিন্তু চেহারাটা একদম মড়ার মতো শুঁটকো, সাদা। গালে দাড়ি। লম্বা লম্বা চুল।

মনু পিসি, লোকটা কি পাগল? সে রঙ্গময়ীকে জিজ্ঞেস করল।

না রে, দু দিন আমবাগানে লুকিয়ে ছিল। খায়দায়নি। তাই ওরকম দেখাচ্ছে।

লুকিয়ে ছিল কেন?

শুনছি তো, পুলিসে নাকি তাড়া করেছিল।

কেন তাড়া করেছিল?

স্বদেশী করত যে!

এটা আর বুঝিয়ে বলার দরকার হয় না কৃষ্ণকান্তকে। স্বদেশীদের সে খানিকটা চেনে। তবে ভাল চোখে দেখে না। সে বলল, তা হলে পুলিশে খবর দিচ্ছো না কেন?

ওরে চুপ, চুপ! পুলিস এলে তোর বাপেরও রেহাই নেই। ওসব বলিস না। তোকে বলাই ভুল হয়েছে দেখছি।

কৃষ্ণকান্ত জিজ্ঞেস করল, কোন আমবাগানে? বাড়ির পিছনেরটা?

তাই তো শুনছি।

ওখানে ছিল লোকটা? দু দিন?

হ্যাঁ।

মশা কামড়ায়নি?

তা আর কামড়ায়নি! সারা গায়ে তো দেখছি দানা দানা হয়ে আছে।

কিছু খায়ওনি?

কী খাবে? শীতকালে কি আর আমবাগানে আম পাওয়া যায়?

লোকটার দিকে আর একবার ভাল করে চেয়ে দেখল কৃষ্ণকান্ত। চেহারাটা তার পছন্দ হল না ঠিকই। তবে যে-লোক দুদিন না খেয়ে আমবাগানে লুকিয়ে থাকতে পারে তাকে একটু শ্ৰদ্ধা না করে উপায় কী?