শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
দূরবীন
একষট্টি থেকে সত্তর পরিচ্ছেদ
“ভাই হেমকান্ত, তোমার পত্রখানি ঠিক তিন দিন আগে পাইয়াছি। তাহার পর হইতে কেবলই ভাবিতেছি, তোমাকে কী লিখিব। ভাবিয়া দেখিলাম, দুইটি পন্থা আছে। তোমার মানসিক বৈকল্যে এলেপ দিতে দু-একটা সান্ত্বনার কথা, স্তোকবাক্য অথবা এই বৈকল্যকে তোমার দার্শনিক চেতনা বলিয়া বর্ণনা করিয়া লেখা যায়। তাহাতে তোমার মানসিক বৈকল্যের কতদূর কী প্রশমন ঘটিবে জানি না, কিন্তু তোমার দুর্বলতাকে প্রকারান্তরে প্রশ্রয় দেওয়া হইবে। দ্বিতীয় পন্থা মোহমুদগর। অথাৎ তোমার মতো কূপমণ্ডুককে দেশকাল ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সচেতন করিয়া তুলিয়া তুমি যে কত বড় অপদার্থ তাহাই তোমার চক্ষুর সম্মুখে তুলিয়া ধরা। আমি দ্বিতীয় পন্থাটিই গ্রহণ করিলাম।
“তোমার পুত্র হইতে যতদূর উদ্ধার করিতে পারিলাম তাহার মোদ্দা কথা হইল, তোমার নবনীনিন্দিত কোমল কর হইতে কুয়ার বালতি স্খলিত হইয়া জলে পড়িয়াছে! ঘটনা তো তবে সাঙ্ঘাতিক। সারা বিশ্বে তো সাম্প্রতিককালে এরূপ বিশাল বিপর্যয় আর ঘটে নাই। ফলে তোমার মনে হইল, তুমি বুড়া হইতেছ, জীবনদীপের শিখা নিস্তেজ হইতেছে ইত্যাদি। ভাল কথা। কিন্তু এই অবিমিশ্র জলীয় মানসিকতার উৎসটি কোথায় তাহা কোনোদিন স্থিরচিত্তে ভাবিয়া দেখিবার অবকাশ পাইয়াছ কি? তোমার হস্তাক্ষর মুক্তার ন্যায় সুন্দর, ভাষাও প্রাঞ্জল। তথাপি বলি, তোমাকে বাল্যকালাবধি গভীরভাবে জানি বলিয়া পত্রটির অন্তর্নিহিত অর্থটি খানিকটা হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিয়াছি। সাধারণ মানুষ এই পত্র পড়িয়া মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝিবে না। বড় জোর ভাবিবে, ইহা বোধ করি কৃপিত বায়ুর প্রভাব।
“তোমার মনে আছে কিনা জানি না, বাল্যকালে আমরা উভয়ে পাঠশালায় যাইতাম। একদা ব্রহ্মপুত্রের তীরে এক বুড়া পাগল আমাদের তাড়া করিয়াছিল। দোষটা আমারই। সে নিরিবিলিতে বসিয়া বিষ্ঠা ত্যাগ করিতেছিল। আমি তাহাকে একটি ঢিল মারি। খানুপাগলা তাহাতে ক্ষেপিয়া গিয়া অঙ্গের একটিমাত্র আবরণ ছেড়া গামছাখানি পরিত্যাগ করিয়া ভীম হহুংকারে আমাদের ধাওয়া করিল। প্রকৃতপক্ষে কে ঢিল মারিয়াছিল তাহা সে জানিত না। প্রভাতসমীরে ব্রহ্মপুত্রের পারে বসিয়া নিবিষ্টমনে সে প্রাকৃতিক ক্রিয়া সারিতেছিল। ঢিল খাইয়া সে চমকিত হইয়া আমাদের দেখি এবং তৎক্ষণাৎ তাড়া করিল। কে অপরাধী তাহা সে জানিত না, তবে তোমার রাঙামূলার মতো চেহারাটিই তাহার পছন্দ হইয়া থাকিবে। সুতরাং আমাকে ছাড়িয়া সে তোমার পিছু লইল। সেই বয়েসের পক্ষে যথেষ্ট নাদুসনুদুস শরীর লইয়া তুমি প্রাণভয়ে বইখাতা ফেলিয়া দৌড়াইতেছ আর দিগম্বর খানুপাগলা তোমাকে তাড়া করিয়া লইয়া যাইতেছে, দৃশ্যটা যথেষ্ট হাস্যোদ্রেককারী। কিন্তু মুস্কিল হইল সেই সময়ে তুমি দৌড়ঝাঁপ ভাল জানিতে না। এমন কি আমাদের মতো হাঁটিয়া পাঠশালায় যাওয়ার অভ্যাসও তোমার ছিল না। তোমার দৌড় দেখিয়া মনে হইতেছিল যেন স্বয়ং জরদ্গব দৌড়াইবার চেষ্টা করিতেছে। কালীবাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাইতেই তোমার দম বাহির হইবার জোগার, আতঙ্কে চোখ ডিম্বাকৃতি ধারণ করিয়াছে, কেমন যেন দিগবিদিগজ্ঞানশূন্য দিশাহারা অবস্থা। জমিদার-নন্দনের সেই দুরবস্থা দেখিয়া পথচারীরা অবশ্য হস্তক্ষেপ করিল এবং খানুপাগলাও নিরস্ত হইল। কিন্তু বহুক্ষণ তোমার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়া আসে নাই। তোমার বাক্য সরিতে ছিল না, আর বারবার শিহরিয়া উঠিতেছিলে, চোখে এক অস্বাভাবিক দৃষ্টি। তোমার অবস্থা দেখিয়া আমি ভয় পাইয়া গিয়াছিলাম, পাগলের তাড়া, কুকুরের কামড়,বা অন্যতর নানাবিধ উৎপাত বাল্যকালের নিত্যসঙ্গী। ইহাতে অতটা আতঙ্কিত হওয়ার কী আছে তাহা আমার শিশু মস্তিষ্কে ঢোকে নাই! তবে বুঝিয়াছিলাম, তোমার মন তেমন শক্তপোক্ত নহে। অথচ তোমারই অগ্রজ বরদাকান্ত অসম সাহসী বালক ছিল। তোমার সহোদর নলিনীর সাহসিকতার খ্যাতি তো ব্যাপক।
“তুমি যুবা বয়সে ফুটবল খেলিয়াছ এবং তেমন মন্দ খেল নাই, তোমার জীবনে একমাত্র ওইটিই যা পুরুষোচিত। সেও খেলিয়াছ আমারই তাড়নায়। নহিলে বাল্যকালে বিদ্যালয়ে তুমি ছিলে বালকদের উপহাস ও লঘুক্রিয়ার উপকরণ। কিন্তু তোমার মধ্যে যে সৎ ও মহৎ একটি মানুষের বাস তাহা অনুভব করিয়া আমি তোমাকে প্রচণ্ড ভালবাসিতাম। তাই তোমাকে লইয়া বিদ্যালয়ে যে লঘু হাস্য-পরিহাস চলিত তাহা আমি পছন্দ করিতাম না। তাই সর্বদা তোমাকে রক্ষা করিয়া চলিতাম। একদিন মনে হইল, তুমি যদি নিজেই নিজেকে রক্ষা করিতে শিক্ষা না কর তবে আমার সাধ্য নাই বহির্বিশ্বের নানাবিধ আক্রমণ হইতে তোমাকে সর্বদা রক্ষা করিতে পারি। ফুটবল একটি উপলক্ষ মাত্র। তবে তাহার বিশেষ উপযোগ শরীর ও মনকে একযোগে গড়িয়া তোলে। বলিতে কী, ফুটবল তোমাকে জীবনের অনেক বাহুল্য বর্জন করিয়া একমুখীন হইতে শিখাইয়াছিল। বিপক্ষের গোলপোস্ট যখন আমাদের লক্ষ্যস্থল তখন ক্রীড়াটিও অর্থপূর্ণ ও লক্ষ্যাভিমুখী সংবেগ লাভ করে। ওই গোলপোস্টটি যদি না থাকে তবে ক্রীড়া অর্থহীন হইয়া যায়। ক্লান্তি আসে ও সমগ্র পরিশ্রমটাই পণ্ডশ্রম হইয়া পড়ে। ভাই হেম, জীবনটাও কি তাহাই নহে?
“তোমার জীবনটা এইরূপ লক্ষ্যহীন হইয়া ওঠার অবশ্য কারণ আছে। বরদাকান্ত সন্ন্যাসী ও নলিনী স্বদেশী হইয়া যাওয়ায় তোমার পিতামাতা তোমার সম্পর্কে বিশেষ সাবধানী হইয়া পড়েন। অত আদর সতর্কতা তোমাকে ঘিরিয়া থাকায় তুমি ছায়াবৃত্ত বৃক্ষের মতো তেমন বাড়িয়া ওঠ নাই। মা-বাবার মুখ চাহিয়া তোমাকে অনেক অনভিপ্রেত গ্রহণ বর্জন করিতে হইয়াছে। ফলে তোমার চরিত্রের স্বাভাবিক বিকাশ ঘটে নাই। উপরন্তু জমিদার-নন্দন হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছ বলিয়া তোমাকে খাওয়াপরার ভাবনাও ভাবিতে হয় নাই। কল্পনাবিলাসী হওয়া তোমার পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু ভাই হেম, কল্পনাবিলাসী হওয়া কি আমাদের সাজে?
“দেশ তথা বিশ্বের পরিস্থিতি যদি কিছুটা অনুধাবন করার চেষ্টা কর তাহা হইলে দেখিবে আমরা কি রকম সংকটের ভিতর দিয়া চলিয়াছি। একটা বিশ্বযুদ্ধ শেষ হইয়াছে তো আফগানিস্তান লইয়া আর এক বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিয়াছে। আমানুল্লাকে সিংহাসন ছাড়িতে হইয়াছে। রুশীরা ফৌজ পাঠাইয়াছে। এদিকে সাইমন কমিশনরূপ এক দুষ্টচক্র এদেশে ব্রিটিশ শাসন কায়েম করিবার ফন্দি আঁটিতেছে। সংবাদপত্রটিও কি পড়িবার মতো আগ্রহ বোধ কর না? এদেশে প্রতি বৎসর ইংরাজ ১১১ কোটি টাকার পণ্য বিক্রয় করে। ভারতবাসীকে লইয়া যে ছেলেখেলা ও দুষ্ট ব্যবসা চলিতেছে সে সম্পর্কে সচেতন হও। কল্পনার ভূমি হইতে দেশ কাল পরিস্থিতির মধ্যে অবতীর্ণ হও। মৃত্যুচিন্তা কর্পূরের মতো উড়িয়া যাইবে।
“তুমি বুড়া হইয়াছ ভাবিলেও হাসি পায়। কে, আমি তো তোমার বয়স্য হইয়াও বুড়া হই নাই! তবে তোমার বার্ধক্যের বোধ কোথা হইতে আসিতেছে? বলিলে হয়তো রাগ করিবে, তবু বলি, তোমার আসল খাঁকতি অন্য জায়গায়। তোমার সেই স্পর্শকাতর ও সযত্নগোপন স্থানটির সন্ধান আমি কতকটা জানি। বলি কি, লোকলজ্জা পরিত্যাগ করিয়া বরং রঙ্গময়ীকে বিবাহ কর। আর কতকাল একতরফা, প্রকাশবিমুখ, গোপন ও মূক প্রণয়ের জ্বালায় পুড়িয়া খাক হইবে? রঙ্গময়ী বাস্তববোধসম্পন্না, বুদ্ধিমতী ও সাহসী। সে সম্পূর্ণভাবে তোমার ভার লইলে এখনো জীবনে অনেক কিছু করার পথ খুলিয়া যাইবে। তোমার দেহ বৃদ্ধ হয় নাই, হইয়াছে তোমার মন। সুনয়নী আজ বাঁচিয়া থাকিলে আমি একথা উচ্চারণ করিবার সাহস পাইতাম না। যদিও জানি সুনয়নীর প্রতি তোমার প্রেম তেমন গভীর ছিল না। কেন ছিল না সে প্রশ্ন করিব না। হৃদয়ের আচরণ চিরকালই বিচিত্র। সুনয়নীর তো সৌন্দর্যের কোনো অভাব ছিল না। তবু সে তোমার মন পায় নাই। তোমার যখন বিবাহ হয় তখন রঙ্গময়ী নিতান্তই শিশু। তবু তাহার সঙ্গে তোমার বিবাহের একটা প্রস্তাব আসিয়াছিল। দরিদ্র পুরোহিত-কন্যাকে শেষ অবধি অবশ্য তোমরা গ্রহণ কর নাই। কিন্তু বর্জনই কি করিতে পারিলে!
“রঙ্গময়ী তোমাদের বিশাল বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরিয়া এবং তোমাদেরই ভুক্তাবশেষ খাইয়া বড় হইয়াছে। তাহাকে লইয়া রটনাও বড় কম হয় নাই। কিন্তু যখন কৈশোর উত্তীর্ণ হইয়া সে যৌবনে পা দিয়াছে তখনই তাহাকে দেখিয়া বুঝিতাম, তাহার আলাদা একটা সত্তা ও ব্যক্তিত্ব দেখা দিতেছে। সে সুনয়নীর মতো সুন্দরী নহে বটে তবে আমাদের বাড়ির মেয়েদের মতো জলভাতও সে নহে। তুমিও রঙ্গময়ীর প্রসঙ্গ উঠিলে লজ্জা পাইতে শুরু করিলে। রোগটা আমি তখনই ধরিয়াছিলাম। কিন্তু তখনো সুনয়নী তোমার ঘর আলো করিয়া বিরাজ করিতেছে। কাজেই বিষয়টি বেশী তলাইয়া দেখি নাই। আমার বিশ্বাস, পুরুষমানুষ একটিমাত্র নারীর দ্বারা সম্পূর্ণ পোষণ পাইতে পারে না। বহু নারীর প্রতি তাহার আকর্ষণ স্বাভাবিক ও প্রকৃতি-অনুমোদিত। কিন্তু বহুবিবাহের হ্যাপাও বড় কম নহে। তাই রঙ্গময়ীর প্রতি তোমার দুর্বলতা আন্দাজ করিয়াও চুপ করিয়া ছিলাম। উপরন্তু এই যুগে ও পরিবেশে স্বাভাবিক বিবেকসম্পন্ন কোনো পুরুষের নারীপ্রেম লইয়া মাথা ঘামানোটা পাপ বলিয়াই মনে করি। প্রেম যদি কোথাও নিবেদন করিতে হয় তবে তাহা দেশমাতৃকার পায়ে। কিন্তু সেই বীরত্ব তোমার নাই। তবে তোমার সংযম আছে, কুণ্ঠা ও সৌজন্যবোধ আছে। প্রেম থাকিলেও তাহা তোমাকে প্রগলভ করিয়া তুলিবে না ইহাও জানিতাম। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ওই প্রেমই তোমাকে খাইবে।
“ভাই হেম, আজ তোমার যে সব মৃত্যুচিন্তা ও অনিত্যের ভাবনা দেখা দিয়াছে, আজ যে তুমি নিবিষ্টমনে জগতে কে আত্মজন ও কে পর তাহা বিচার কবিতে শুরু করিয়াছ তাহা কিন্তু বাস্তবিক কোনো দার্শনিকতা নহে, বোধিও নহে। প্রবৃত্তির ক্ষুধা একটি ক্ষেত্রে নিবৃত্ত না হইলে অন্য দিক দিয়া ফুটিয়া বাহির হয়। জানিও, দুনিয়ার অধিকাংশ সন্ন্যাসী বৈরাগীই নানা অচরিতার্থ প্রবৃত্তির শিকার। তোমার ক্ষেত্রেও মনে হয়, প্রকৃতি প্রতিশোধ লইতেছে মাত্র। ওই বৈরাগ্যের মূলে আছে সেই নারীপ্রেম যাহা চরিতার্থ হয় নাই। গ্রাসটি সম্মুখে লইয়া ক্ষুধার্ত বাঘটি বসিয়া আছে। সংকোচবশে ভোজন করিতেছে না। প্রবৃত্তি চাহিতেছে, কিন্তু সৌজন্য ও সংকোচ বাধা দিতেছে। বিশেষ করিয়া, তোমার কনিষ্ঠ সহোদবকে জড়াইয়া এই রঙ্গময়ীর নামে কলঙ্ক রটিয়াছিল। তদুপরি সে পুরোহিতকন্যা। এর উপর আবার তোমার পুত্রকন্যারা সাবালক হইয়াছে, তোমার নাতি নাতনীও জন্মগ্রহণ করিয়াছে। সংকোচ স্বাভাবিক। কিন্তু ক্ষুধা ছাড়িবে কেন? সে তাই অন্য পন্থা লইয়াছে। তোমার মনের বৈক্লব্য ঘটাইয়া এখন সে তোমাকে লইয়া ছিনিমিনি খেলিবেই।
কুয়ার বালতি লইয়া আর গভীর চিন্তা করিও না। বাইরের ঘটনাগুলি ঘটনাই নয়। আসলে যাহা ঘটে তাহার গভীরে আছে আমাদের মন। সেই মনের সম্মুখীন হও। অকপটে নিজের কাছে নিজেকে প্রকাশ কর। ভাবের ঘরে আর চুরি করিও না।
“প্রিয় হেমকান্ত, তোমাকে এইসব কথা লিখিয়া কিছু ক্লেশও বোধ করিতেছি। হয়তো এতটা কঠোর সমালোচনা না করিলেও পারিতাম। কিন্তু শল্য চিকিৎসারই যদি প্রয়োজন দেখা দেয় তবে সংকটাপন্ন রোগীকে বাঁচাইতে অস্ত্র ধরিতেই হয়।
“শীঘ্র দেশে যাওয়া হইবে না। কলিকাতায় কংগ্রেসের সভায় যোগ দিতে আসিয়াছি। যে বিপুল সমারোহ, উৎসব ও উদ্দীপনা এই সম্মেলনকে উপলক্ষ করিয়া দেখা দিয়াছে তাহা অভাবনীয়। মানুষ যদি এইভাবে জাগিয়া ও জাগরণটুকু ধরিয়া রাখিতে পারে তবে স্বরাজ আসিতে কতদিন লাগিবে?…”
হেমকান্ত সচ্চিদানন্দের দীর্ঘ চিঠিটা বার দুই পড়লেন। তাঁর গা একটু জ্বালা করছিল। রাগ ক্ষোভ তাঁর সহজে হয় না। তবু সচ্চিদানন্দের চিঠি পড়ে হল।
বিশাল ডেকচেয়ারে আধশোয়া হেমকান্ত কাশ্মীরি কারুকাজওলা ছোট্ট ত্রিপয়ের ওপর চিঠিটা রেখে জানালা দিয়ে চেয়ে রইলেন। দক্ষিণের এই জানালা দিয়ে বাড়ির ভিতর দিককার বাগান চোখে পড়ে। দুপুরের কবোষ্ণ রোদ এসে পড়ে গায়ে।
অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ভিতরের অঙ্গন। কুকুর আছে, গাছপালা আছে, লন আছে। নীল উজ্জ্বল আকাশের গায়ে স্পর্ধিত ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে পাম গাছের সারি। সেদিকে চেয়ে রইলেন হেমকান্ত।
সচ্চিদানন্দ দেশকাল পরিস্থিতির মধ্যে নেমে আসার পরামর্শ দিয়েছে। চিরকালই সে এইরকম। তার মাথায় ছেলেবেলা থেকেই দেশ কাল পরিস্থিতির চিন্তা। তা বলে সব ছেড়েছুড়ে স্বদেশী করতে সে নেমে পড়েনি। আইন পাশ করে প্রবল প্রতাপে ওকালতি করছে। কংগ্রেসের সঙ্গে তার সম্পর্ক গভীর বার দুই সে ধরা পড়েছে আবার ছাড়াও পেয়েছে। সচ্চিদানন্দের সবই ভাল, কিন্তু বড় বেশী বাস্তুবাদী এবং ঠোঁটকাটা। সেই কারণেই হেমকান্তর তাকে ভাল লাগে, আবার খারাপও লাগে।
সচ্চিদানন্দের নগ্ন আক্রমণাত্মক চিঠিটার ঝাঁঝ হেমকান্তকে প্রায় ছেয়ে ফেলেছে। বুকে একটা যন্ত্রণার সূত্রপাত হয়েছিল কয়েকদিন আগে। এখন আবার সেরকম যন্ত্রণা হচ্ছে। শ্বাসকষ্টের মতোও লাগছে যেন একটু। মনটা অস্থির।
হেমকান্ত উঠে ভিতর দিককার দরদালানে এসে পায়চারি করতে লাগলেন। দোতলার এই দরদালানটি বিশেষ রকমের নির্জন। হেমকান্ত পায়চারি করতে করতে ভাবতে লাগলেন। কুয়ার দড়ি, রঙ্গময়ী, শৈশবকাল, সচ্চিদানন্দ। ভাবনার কি শেষ আছে! ভাবতে বড় ভাল লাগে তাঁর। কিন্তু তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না, সচ্চিদানন্দের এই বিশ্লেষণ কতদূর সত্য এবং কতটাই বা ভ্রান্ত। কিন্তু তাঁর একটু লজ্জাবোধ হচ্ছে। আপনমনে হাসছেনও। মাঝে মাঝে মাথা নাড়ছেন।
ইদানীং এই রোগটা দেখা দিয়েছে তাঁর। একা হলেই আপনমনে ভাবতে ভাবতে কখনো হাসেন, মাথা নাড়েন, একটু-আধটু বিড়বিড় করেন। সচ্চিদানন্দটা পাগল। রঙ্গময়ীকে বিয়ে করতে উপদেশ দিয়েছে। হেমকান্ত রাগ করতে গিয়ে হেসেই ফেললেন হঠাৎ। কেমন দেখাবে? মাথায় টেপিব পরে ছাঁদনাতলায় যেতে? সিঁথিমৌরে রঙ্গময়ীর রূপই বা কেমন খুলবে? পাগল! সচ্চিদানন্দ একটা পাগল!
“মা গো!” বলে কে চেঁচালো না পুকুরের ধারে?
হেমকান্ত দরদালানের জানালায় গিয়ে নীচের দিকে চেয়ে দেখলেন,পুকুরের ঘাটে বিশাখা আর চুনী। দুজনেই পিছনের দেয়ালের দিকে চেয়ে আছে। চোখে রোদ পড়েছিল বলে হেমকান্ত। প্রথমটায় ভাল দেখতে পেলেন না। তারপর লক্ষ্য করলেন, পাঁচিলের ওপর একটা কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। জেলখানার মতো উঁচু পাঁচিল। ওঠা খুব সহজ নয়। কে ওটা? বাইরের লোক? না, বাড়িরই কেউ?
বিরক্ত হেমকান্ত অনুচ্চ স্বরে ডাকলেন, হরি।
তাঁর খাস চাকর দৌড়ে এল।
হেমকান্ত ভ্রূ কুঁচকে বললেন, দেখ তো কে একটা লোক পিছনের দেয়ালে উঠেছে। ধরে নিয়ে আয়। পালাতে যেন না পারে দেখিস।
হরি চলে গেল।
হেমকান্ত আবার জানালায় এসে দাঁড়ানোর আগে ঘরে গিয়ে কাঠের আলমারি থেকে দূরবীনটা নিয়ে এলেন। বিদেশে তৈরি শক্তিশালী দূরবীন। চোখে তুলে তিনি দেয়ালের ওপরে দাঁড়ানো লোকটাকে দেখলেন।
লোক নয়, নিতান্তই অল্পবয়সী ছেলে একটা। সতেরো আঠারোর বেশী বয়স হবে না। পরনে মালকোঁচা মারা ধুতি, গায়ে হাফ শার্ট। রং বেশ ফর্সা। সদ্য দাড়ি গোঁফ গজিয়েছে। ছেলেটা পিছনের মস্ত আমবাগানের দিক থেকেই দেয়ালে উঠেছে বলে আন্দাজ করলেন হেমকান্ত। তবে ছেলেটার হাবভাব একটু কেমনতরো। মুখটা শুকননা। চুল এলোমেলো। চোখের চাউনিটা যেন লক্ষ্যহীন। চারদিকে টালমালু করে চেয়ে দেখছে।
হেমকান্ত দূরবীনটা নামিয়ে রাখলেন। বরকন্দাজরা দেয়ালের নীচে পৌঁছে গেছে। ছেলেটার পালানোর পথ নেই।
হেমকান্ত সিঁড়ি বেয়ে আস্তে ধীরে নেমে এলেন নীচে। সামনের বৈঠকখানায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই পিছমোড়ায় ধরে বরকন্দাজরা নিয়ে এল ছেলেটিকে। হেমকান্ত লক্ষ্য করলেন, ছেলেটা ল্যাংচাচ্ছে।
হেমকান্ত নিষ্ঠুরতা পছন্দ করেন না। কিন্তু এই ছেলেটার বেয়াদবিও সহ্য করার মতো নয়। অন্দরমহলের দেয়ালে উঠবে বাইরের লোক, এ কেমন কথা? ওখানে মেয়েরা স্নান করে, বেড়ায়।
হেমকান্ত গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে?
ছেলেটা খুবই ঘাবড়ে গেছে। শুকনো ঠোঁট জিভ দিয়ে চেটে বলল, আমার অন্যায় হয়ে গেছে। ওটা যে ভিতরের মহল তা বুঝতে পারিনি।
কথাটা সত্যি হতেও পারে। হেমকান্ত বললেন, তোমার নাম কি? কোথা থেকে আসছো?
আমার নাম শশীভূষণ গঙ্গোপাধ্যায়। বাড়ি বরিশাল জেলা।।
এখানে কী করতে এসেছো?
চাকরি খুঁজতে।
দেয়ালে উঠে কী করছিলে?
ছেলেটা ঠোঁট কামড়ে একটু যেন ভেবে নিয়ে বলল, আমি গত দুদিন ওই আমবাগানটায় আছি।
হেমকান্ত অবাক হয়ে বলেন, আমবাগানে আছো মানে?
কোথাও থাকার জায়গা পাচ্ছিলাম না, তাই আমবাগানে ছিলাম।
এই শীতে?
আজ্ঞে হ্যাঁ। খুব কষ্ট হচ্ছিল।
তাহলে সরাসরি এসে কাছারিবাড়িতে বলোনি কেন? এ বাড়িতে বা যে কোন বাড়িতে গেলে এক আশ্রয় জুটে যেত।
আমার উপায় ছিল না।
কেন?
শশীভূষণ ঘাবড়ে গেছে বটে, কিন্তু ভেঙে পড়েনি। হেমকান্তর চোখের দিকে চেয়ে বলল, সেটা খুব নিরাপদ হত না। আপনার লোকেরা একটু তফাৎ হলে সব কথা বলতে পারি।
হেমকান্ত বিরক্ত হলেন। তবু চোখের ইশারায় সবাইকে সরে যেতে বললে সবাই সরে গেল।
এবার বলো।
আমি দুদিন ধরে কিছু খাইনি। পুলিশের তাড়া খেয়ে এখানে এসে পড়েছি।
কেন, পুলিশ তোমাকে তাড়া করেছে কেন?
তাদের সন্দেহ আমি স্বদেশী করি।
কুঞ্চিত ভ্রূ সটান হল হেমকান্তর। একটু হাসলেন। আগেই তাঁর অনুমান করা উচিত ছিল ব্যাপারটা।
হেমকান্ত বললেন, তাই বলো।
শশীভূষণ ক্ষীণ একটু হেসে বলল, আমবাগানে বড় মশা। আমি ওখানে আর থাকতে পারছি না।
হেমকান্তর হঠাৎ সচ্চিদানন্দের চিঠিটার কথা মনে হল। দেশ কাল পরিস্থিতি নিয়ে ভাবিত হতে তাঁকে বলেছে সচ্চিদানন্দ। তা দেশকালের তো এই অবস্থা। এইটুকু ছেলে লেখাপড়া ছেড়ে, বাড়িঘর ফেলে স্বদেশী করে বেড়াচ্ছে। হয় গুলিটুলি খেয়ে মরবে, নয় তো জেলে পচবে।
হেমকান্ত বললেন, দেয়ালে উঠে কী দেখছিলে?
দেখছিলাম এদিকে কোনো পোডো ঘরটর আছে কিনা।
অন্য কোনো মতলব ছিল না তো?
শশীভূষণ মাথা নেড়ে বলল, না। অন্য মতলব কী থাকবে? চরি?
ধরো তাই।
খাবার পেলে চুরি করতাম। তাছাড়া আর কিছু চুরির মতলব ছিল না।
তোমার বাবা কী করেন?
মাস্টারী। সামান্য মাইনে।
সে জানি। মাস্টারির মাইনে আর আমাকে শেখাতে হবে না। তুমি কতদূর লেখাপড়া করেছে?
বি এ পড়ছিলাম।
এখন পড়ছো না?
না। কলেজ ছেড়ে দিয়েছি।
মা-বাপের প্রতি কর্তব্য নেই?
আছে।
সেটা আগে না করেই দেশসেবায় বেরিয়ে পড়েছো?
দেশসেবা তো নয়। পুলিশের সন্দেহ যে, আমি স্বদেশী। বরিশালে একজন পাদ্রী খুন নিয়ে আমাদের বাড়িতে সার্চ হয়। বাবাই আমাকে পালিয়ে যেতে বলেন।
পাদ্রীকে কারা খুন করেছে?
জানি না। তবে লোকটা পাদ্রী নয়। পুলিশের স্পাই।
সে যাই হোক, তোমাকে আশ্রয় দেওয়া বিপজ্জনক।
তা আমি জানি। আমি দুদিন কিছুই খাইনি।
দুদিন? বলে হেমকান্ত অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন।
খাওয়ার পয়সাও নেই! বেরোতেও ভয় করছিল। আমাকে যদি কিছু খাবার দেন তাহলে আবার রওনা হয়ে যেতে পারি।
কোথায় যাবে?
ঢাকা। সেখানে আমার পিসির বাড়ি।
গাড়িভাড়া আছে?
না। তবে এতটা আসতে পেরেছি, বাকিটাও চলে যেতে পারব।
আর যদি ধরা পড়ো?
পড়ব না।
সচ্চিদানন্দের দেশ কাল পরিস্থিতিই কি শশীভূষণের রূপ ধরে এসে হাজির হল?
হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হরিকে ডেকে বললেন, একে কিছু খেতে দে। তারপর বারবাড়ির নলিনীর ঘরটায় নিয়ে যা।
শশীভূষণ হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে বলে, আমি ঘরেটরে যাবো না।
হেমকান্ত মৃদুস্বরে বললেন, ভয় নেই, ধরিয়ে দেবো না। একটু বিশ্রাম নাও। তারপর চলে যেয়ো।