» » এগার থেকে বিশ পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

দূরবীন

এগার

পিতার বাৎসরিক কাজটি হেমকান্ত প্রতিবছর বেশ ঘটা করেই করেন। শ’খানেক ব্রাহ্মণকে ভোজন করানো হয় এবং ভালরকম দক্ষিণা ও অন্যান্য দানসামগ্রী দেওয়া হয়। ব্রাহ্মণ ছাড়াও আমন্ত্রিতের সংখ্যা বড় কম হয় না।

এ বছর হেমকান্ত একটু দ্বিধায় পড়লেন। আয় ভাল নয়। হিসেবপত্র করে যা দেখছেন তাতে এসটেট চালানোই যথেষ্ট কষ্টকর। এর ওপর বাড়তি কোনো খরচের বোঝা বইতে গেলে উপরি আয় চাই। প্রচলিত ও প্রথাসিদ্ধ অনুষ্ঠানে কাটছাঁট করার ইচ্ছে হেমকান্তর নেই। বিশেষ করে বাবার বাৎসরিকের প্রশ্ন যেখানে। অগত্যা তিনি রঙ্গময়ীকে ডেকে পাঠালেন।

শোনো মনু, সুনয়নীর বেশ কিছু গয়নাগাটি আছে। সেগুলো কোথায় আছে আমি সঠিক জানি না। মেয়েদের মহলে গিয়ে খোঁজ খবরও করা যাবে না। খবরটা আমাকে এনে দিতে পারবে? গোপনে?

কেন, সুনয়নীর গয়নার খোঁজ করছ কেন?

দরকারেই করছি।

দরকারটা শুনি।

আহা, অত দারোগাগিরির কী আছে। গয়নাগুলোয় তো আমারও খানিকটা অধিকার আছে, না কি?

ওমা, তোমার নেই তো আছে কার? কিন্তু সুনয়নী এতকাল মরেছে, এ খোঁজটা এতদিন পরে করছো কেন?

বললাম তো দরকার আছে।

গয়না কোথায় আছে জানি। কিন্তু কী অবশিষ্ট আছে তা বলতে পারব না।

তার মানে? অবশিষ্ট কথাটা বললে কেন? চুরি-টুরি গেছে নাকি?

চুরি নয়। সুনয়নীই কিছু গয়না মেয়েদের আর বউদের ভাগ করে দিয়ে গিয়েছিল। আর যা ছিল তাও সব নেই। মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি থেকে আসে, এটা ওটা নিয়ে যায়। বউরাও নিয়েছে।

হেমকান্ত বিরক্তিতে ভ্রূ কুঁচকে বলেন, গয়নার একটা হিসেব থাকা উচিত ছিল।

সুনয়নী অত হিসেবী মেয়ে ছিল না।

তোমার তো নিশ্চয়ই মনে আছে।

রঙ্গময়ী হেসে ফেলে বলে, গয়না তোমার বউয়ের আর তার হিসেব রাখতে হবে আমাকে?

হিসেব কি সত্যিই নেই?

রঙ্গময়ী মাথা নেড়ে বলে, না। তবে সুনয়নী আমাকে একজোড়া বালা আর একটা হার দিয়েছিল।

তোমাকে দেওয়া গয়নার কথা আসছে কেন?

আসছে তার কারণ আছে। সুনয়নী কাউকে সাক্ষী রেখে গয়না দুটো আমাকে দেয়নি। আমি পরিও না। পরলে চোর-দায়ে ধরা পড়তে পারি। সেগুলো পড়ে আছে বাক্সে। তোমার গয়নার দরকার থাকলে নিতে পারো।

দূর, কী যে বলো।

রঙ্গময়ী একটু হাসল। প্রশান্ত গলাতেই বলল, তোমার মতো মানুষ বউয়ের গয়নার খোঁজ করছে এটা ভাবাই যায় না। ইদানীং কি খুব হিসেবী হয়েছে?

হলে দোষ কী?

দোষ তো নয়ই। বরং তুমি হিসেবী হলে আমি বাঁচি। কী দরকার বলো তো? বেচবে নাকি?

হেমকান্ত অস্বস্তি বোধ করেন। প্রসঙ্গটা খুবই লজ্জাজনক। হেমকান্ত ঘরের সোনা বেচতে চান এটা পাঁচকান হলে গোটা পরিবারটারই মর্যাদার হানি। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, আরে না। হঠাৎ মনে হল, গয়নাগুলো গেল কোথায়?

সুনয়নীর ঘরে দেয়ালের সিন্দুকে সব পাবে। তার চাবি আছে তোমার পড়ার ডেসকের ড্রয়ারে।

ঠিক আছে।

এ কথাতে রঙ্গময়ী চলে গেল না। চুপ করে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে গলাটা সামান্য নামিয়ে বলল, গয়না দিয়ে তুমি কী করবে জানি না। তবে আমি বলি, ও গয়না থেকে একটাও এদিক ওদিক করাই ভাল। তোমার হিসেব না থাক, তোমার মেয়ে আর বউদের আছে। কিছু সরালেই তারা টের পাবে।

হেমকান্ত বিস্মিত হয়ে বলেন, তারা টের পাবে? তা পাক না।

রঙ্গময়ী একটু বিব্রত হয়। একটু অপ্রতিভ হাসে। মৃদুস্বরে বলে, তুমি ভাবছো, তোমার বউয়ের গয়না, সুতরাং ওর ওপর তোমারই অধিকার।

তাই তো হওয়া উচিত মনু।

উচিত তো অনেক কিছুই। কিন্তু ও গয়নায় হাত পড়লেই কুরুক্ষেত্র লেগে যাবে। তোমার মেয়ে আর বউরা বনবেড়ালের মতো থাবা পেতে বসে আছে। পূজোর সময় কী কান্ড হয়েছিল তা তো জানো না।

কী কান্ড?

সে তোমার শুনে কাজ নেই। অন্দরমহলে অনেক কিছু হয়, সবটাই পুরুষের কানে না যাওয়া ভাল।

নিশ্চয়ই ঝগড়া?

হ্যাঁ, ভীষণ ঝগড়া। আর সেটা সুনয়নীর গয়না নিয়েই। তাই বলছিলাম হট করে গয়নায় হাত দিও না।

হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মুখখানায় বিমর্ষতার ছায়াপাত ঘটল। হেমকান্ত বসেছিলেন নিজের শোওয়ার ঘরখানায় পূর্বাস্য হয়ে। মেঝের ওপর পুরু উলের গালিচা, তার ওপর একটা ছোট্টো ডেসকে প্যাড ও লেখার সরঞ্জাম সাজানো। সকালের রোদ এসে পড়েছে গালিচার ওপর। সেই আলোয় গালিচার অপরূপ রং ও নকশা ক্ষুরধার হয়ে উঠেছে।

হেমকান্ত গালিচার নকশার দিকে চেয়ে থেকে বললেন, কত ভরি গয়না আছে জানো?

না। তবে শুধু সুনয়নীরই বোধহয় হাজার ভরির মতো সোনা ছিল। এখন বোধহয় অত নেই।

ওরা কতটা নিয়েছে তা বোধহয় জানো না?

না। ওরা যখন সিন্দুক খোলে তখন আমি কাছে থাকি না।

তবে জানলে কী করে যে, নিয়েছে?

মেয়েমানুষ হচ্ছে হান জীব।

হেমকান্ত হাঁ করে চেয়ে থেকে বললেন, এ কথাটার মানে বুঝলাম না।

রঙ্গময়ী হেসে বলে, মানে কি ছাই আমিই জানি। মেয়েমানুষের লেখাপড়া নেই, চিন্তাভাবনা নেই, তাদের মন আর চোখ সবসময়েই সংসারের আস্তাকুঁড় খুঁটছে। তাই তারা খবর রাখে।

তুমি কি সেইরকম মেয়েমানুষ?

তবে আর কীরকম?

হেমকান্তর একবার ইচ্ছে হল সচ্চিদানন্দর চিঠিটা রঙ্গময়ীকে দেখান। কিন্তু সেই চিঠিতে তো শুধু রঙ্গময়ীর প্রশংসাই নেই, তাঁকে এবং রঙ্গময়ীকে জড়িয়ে এমন সব ইঙ্গিত আছে যা পড়লে রঙ্গময়ী হয়তো বা গলায় দড়ি দেবে। হেমকান্ত রঙ্গময়ীর দিকে এই সকালের আলোয় চেয়ে দেখলেন ভাল করে।

সচ্চিদানন্দ মিছে বলেনি। ধারালো এক ব্যক্তিত্ব রঙ্গময়ীকে এই ভরা যৌবনে ভারী বিশিষ্ট করে তুলেছে। ব্যক্তিত্বটা কী ধরনের তা অবশ্য জানেন না হেমকান্ত। কারণ রঙ্গময়ী তাঁর প্রতিদিনকার দেখা ও জানা একটি মানুষ। এত কাছের মানুষের মধ্যে ধরাছোঁয়ার বাইরের কোনো গুণ আছে কিনা তা টের পাওয়া কঠিন। তবু সচ্চিদানন্দর চিঠিটা পাওয়ায় পর থেকে রঙ্গময়ীকে নতুন দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করছেন হেমকান্ত। কিন্তু পুরোনো চোখ সব গন্ডগোল করে দিচ্ছে। হেমকান্ত বললেন, নিজের সম্পর্কে তুমি যাই বলল, লোকে কিন্তু অন্য কথা বলে।

লোকে কী বলে?

বলে, তুমি নাকি অসাধারণ।

লোকের আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই। কে তোমাকে আবার এসব বলল?

সচ্চিদানন্দকে তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই?

থাকবে না কেন? পাজি লোকদের আমার মনে থাকে।

পাজি লোক! হেমকান্ত চোখ বড় বড় করে বলেন, কে পাজি? আমার বন্ধু সচ্চিদানন্দ?

তার কথাই তো হচ্ছে।

সে পাজি হবে কেন?

কেন হবে তা অত বলতে পারি না। তবে লোক চিনি।

কীরকম চেনো?

ভালই চিনি। ললিতার বিয়ের সময় যা একখানা কান্ড করেছিল।

কী কান্ড?

সবই কি তোমাকে শুনতে হবে?

হবে।

শুনে তোমার ভাল লাগবে না।

তুমি সবসময়ে আমার মন রেখে কথা বলো?

তা অবশ্য বলি না। কিন্তু শুনলে যদি তোমার বন্ধুপ্রীতি চটে যায়?

হেমকান্ত মৃদু ও ম্লান একটু হেসে বললেন, তবু শোনা যাক। একটা মানুষকে নানাভাবেই জানতে হয়।

স্নিগ্ধ ও স্মিত মুখে রঙ্গময়ী কিছুক্ষণ হেমকান্তর মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলে, ললিতার বিয়ের সময় সচ্চিদানন্দবাবু আমাকে ছাদে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছিল, রঙ্গময়ী, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।

বলো কী? হেমকান্ত ভারী বিব্রত বোধ করতে থাকেন।

অবশ্য উনি আমার অবস্থা দেখে দুঃখিত হয়েই প্রস্তাবটা করেন। বলেছিলেন, তোমার তো গতি হচ্ছে না। ভবিষ্যৎ বলতে তো একটা কথা আছে।

তুমি কী বললে?

আমি কী বলতে পারি বলে তোমার মনে হয়?

হেমকান্ত হাঁ করে চেয়ে থেকে বলেন, কী জানি।

আমি বললাম, আপনার স্ত্রী তো একজন আছেন। উনি বললেন, থাক না। পুরুষমানুষের কি একজনকে নিয়ে থাকলে হয়?

তুমি তখন কী করলে?

একটা কথা বলেছিলাম। তাইতে উনি খুব ঘাবড়ে গিয়ে প্রস্তাবটা ফিরিয়ে নিলেন।

কথাটা কী?

সেটা বলতে পারব না।

কিছুতেই না?

কিছুতেই না।

হেমকান্ত আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, থাকগে, শুনতে চাই না।

রঙ্গময়ী কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে বলে, যে ছেলেটাকে কাছারি বাড়িতে থাকতে দিয়েছো তার খুব জ্বর। জানো?

শুনেছিলাম।

তার বাড়িতে একটা খবর দেওয়া দরকার।

ঠিকানাটা জেনে নিয়ে একটা চিঠি দিয়ে দাও।

রঙ্গময়ী মৃদু হেসে বলে, তোমার যা বুদ্ধি!

কেন, বুদ্ধির আবার কী দোষ হল?

ছেলেটা পুলিসের তাড়া খেয়ে পালিয়ে এসেছে তা তো জানো।

হ্যাঁ, বলছিল বটে।

তাহলে চিঠি লেখাটা কি ঠিক হবে? পুলিস হয়তো চিঠির খোঁজ করবে।

হেমকান্ত একটু বিরক্ত হয়ে বলেন, তাহলে কী করব?

বরিশালে কাউকে পাঠাও। সে গিয়ে ওর বাবাকে খবরটা গোপনে দিয়ে আসবে।

ডাক্তার কী বলছে? অবস্থা খুব খারাপ?

বেশ খারাপ। মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরছে, আবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। জ্বরটাও ছাড়ছে না।

হাসপাতালে দিলে কেমন হয়?

ভাল হয় না। সেখানে ওর কথা সবাই জানতে পারবে। পুলিসের খাতায় নাম থাকলে হাঙ্গামা হবে।

সে তো এখানেও হতে পারে।

পারেই তো। মুহুরি গোমস্তারা দেখছে। তারাও বাইরে বলাবলি করবে। স্বদেশী-করা ছেলেদের দেখলেই চেনা যায়।

ছেলেটা কি স্বদেশী বলে তোমার মনে হয়?

হয়। আমি লোক চিনি।

তাহলে তো বিপদ হল মনু।

একটু হল। কিন্তু তুমি ও নিয়ে ভেবো না। ছেলেটা যদি নাই বাঁচে তাহলে আর কী হবে?

বাঁচবে না?

বাঁচতে পারে যদি ভাগ্যে থাকে। তেমন সেবাযত্ন তো হচ্ছে না। দিনের মধ্যে পাঁচ সাতবার মাথায় জল দেবে কে? আইসব্যাগ ধরে থাকবে কে?

কেন, তুমি!

ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো।

ছাইও তো কাউকে না কাউকে ফেলতে হবে মনু।

রঙ্গময়ী একটা কপট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আমি যেটুকু পারি করছি। কিন্তু তবু ওর বাড়ির লোককে খবর দেওয়া দরকার। যদি শেষ পর্যন্ত না বাঁচে তাহলে তাঁরা চোখের দেখাটাও দেখতে পাবেন না।

ঠিক আছে। নগেন মুহুরীর বাড়ি বরিশালে। ওকে যেতে বলো।

রঙ্গময়ী চলে গেলে হেমকান্ত অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন নিজের জায়গাটিতে। সচ্চিদানন্দর চিঠিটার জবাব দেওয়া দরকার। কিন্তু লিখতে ইচ্ছে করছে না। আর দিন দশেক বাদে তাঁর বাবার বাৎসরিক শ্রাদ্ধ। যথেষ্ট টাকার জোগাড় নেই। তার ওপর দুটি ঘটনা তার মনটাকে আরো খারাপ করে দিল। এক হল, রঙ্গময়ীকে সচ্চিদানন্দ বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। দুই, শশিভূষণ ছেলেটির অসুস্থতা।

হেমকান্ত উঠে নিজের পড়ার ঘরে এসে ডেসকের দেরাজ থেকে চাবি বের করলেন।

সুনয়নীর একটা আলাদা ঘর ছিল। সেটা এখন তালাবন্ধ থাকে। ঝাড়পোঁছও বড় একটা হয়। না

তালা খুলে হেমকান্ত ভিতরে ঢুকলেন। জানালা দরজা বন্ধ থাকায় ভিতরটায় প্রদোষের আলো-আঁধারি আর ভ্যাপসা গন্ধ।

ঘরের সোনা বিক্রি করার মতো দুরবস্থা হেমকান্তর নয়। ইচ্ছে করলেই তিনি ধার পেতে পারেন। কিন্তু ধার জিনিসটাকে বড়ই অপছন্দ তাঁর। বাজারে নগদ টাকার বেশ একটা অভাব চলছে। লোকের হাতে টাকা নেই। আদায় উশুলও কম।

হেমকান্ত দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। তারপর গিয়ে সিন্দুকটায় চাবি ঢোকালেন।

জীবনে এই কাজ এই প্রথম করছেন হেমকান্ত। সুনয়নীর গয়নার খোঁজ তিনি কোনোকালে করেননি। কত গয়না বা সোনা আছে তা জানার আগ্রহও তাঁর ছিল না। কাজেই বুকটা কেমন দুর-দুর করছিল। মনে হচ্ছিল যেন চুরি করছেন।

এটা চুরিই কিনা তা নিয়ে মনে একটু দ্বন্দ্বও এল হেমকান্তর। গয়নাগুলির বেশীর ভাগই সুনয়নী পেয়েছিল উপহার হিসেবে। তার বাপের বাড়ির যৌতুক আছে, হেমকান্তর মায়ের দেওয়া গয়না। আর মোহর আছে, আত্মীয়-স্বজনরাও কিছু কম দেয়নি। হেমকান্তও দিয়েছেন। সুনয়নীর সেই সব সম্পদ হয়তো আইনের বলে তাঁতেই অর্শায়। তবু হেমকান্ত কিছুতেই সুনয়নীর সম্পদকে নিজের বলে মনে করতে পারছেন না।

আচমকাই একটা অনুভূতি হল তাঁর। তিনি চকিতে ফিরে তাকালেন। খাটের ওই বিছানায় জীবনের শেষ কয়েকটা বছর দুরারোগ্য ব্যাধিতে শুয়ে কাটিয়েছে সুনয়নী। প্রচন্ড কষ্ট পেত। ওখানে শুয়ে আজও যেন সুনয়নী চেয়ে দেখছে। দেখছে তার আদরের সব গয়নাগাটি আর মোহর চুরি করতে ঢুকেছেন হেমকান্ত।

হেমকান্তর সৌজন্যবোধ অসীম।

তিনি সিন্দুকের চাবি ঘুরিয়ে ফেলেও পাল্লাটা খুললেন না। ধীরে ধীরে এসে ফাঁকা খাটটার কাছে দাঁড়ালেন। তাঁর মনে হল সুনয়নী এখন না থাকলেও এক সময়ে সে এই ঘরে বাস করেছে। তার সত্তার, তার অস্তিত্বের স্পন্দন বা স্মৃতি কিংবা রেশ কিছু এখনো রয়ে গেছে এইখানে। হয়তো সুনয়নী বাস্তবিকই তাঁকে দেখছে না, কিন্তু তিনি যে এ ঘরে ঢুকেছেন তার স্পন্দন সুনয়নীর সেই অদৃশ্য উপস্থিতিতে গিয়ে পৌছোচ্ছে।

হেমকান্ত মৃদু স্বরে বললেন, তুমি কী রেখে গেছ তা তো জানি না। একটু দেখছি, যদি অনুমতি দাও।

বলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন হেমকান্ত। কোনো জবাব আশা করেননি। পেলেনও না। তবু হেমকান্ত একবার বিছানাটা স্পর্শ করলেন। সুনয়নী যখন অসুস্থ তখন হেমকান্ত খুব একটা তার কাছে আসতেন না। অসুস্থতা বা রোগ ভোগ জিনিসটা তিনি সইতে পারেন না। সুনয়নীকে সেবা করার অবশ্য অনেক লোক ছিল, ফিরিঙ্গি একটি নার্স পর্যন্ত। অক্লেশে তার গু-মুত ঘাঁটত রঙ্গময়ী। হয়তো সেই সময়েই সুনয়নী রঙ্গময়ীকে গয়না দিয়েছিল।

হেমকান্ত বিছানাটায় বসলেন। এখান থেকে দেয়ালে গাঁথা সিন্দুকটা মুখোমুখি দেখা যায়। সুনয়নী কি নিজের গয়নাগাটির ওপর নজর রাখত শুয়ে শুয়ে? নইলে দক্ষিণে পা করে শুতো কেন?

ভেবে আবার চিন্তান্বিত হলেন হেমকান্ত। আস্তে আস্তে বিছানার জাজিমে হাতটা ঘষতে ঘষতে বললেন, কেন পার্থিব সম্পদের এত পিপাসা ছিল তোমার? কিছুই তো সঙ্গে যায় না। সব ফেলে যেতে হয়।

সুনয়নীর স্তিমিত কণ্ঠ নিজের অন্তরে শুনতে পেলেন হেমকান্ত, সবই জানি। তবু বড় মায়া। তোমার মতো জাগ্রত বিবেক, কজনের থাকে? তার ওপর আমি মেয়েমানুষ।

হেমকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, সুনয়নী, তুমি মেয়েমানুষ ছিলে, কিন্তু আজ দেহ অবসানের পর আর তাও নও। আত্মা তো পুরুষ বা মেয়ে নয়। আজ বলো সুনয়নী, এই সম্পদ এই দেহ এই আত্মজন এ সবের দাম কী?

দাম নেই? তাহলে সব সৃষ্টি হল কেন?

দাম মানুষ দেয়, সৃষ্টিকর্তা তো দেন না। সোনাকে মহার্ঘ্য বানাল কে? দেহকে এত মূল্য দিল কে? আত্মজনকে পৃথিবীর মানুষের থেকে আলাদা করে চেনাল, কে? মানুষই তো? সভ্য মানুষ। নইলে সেই প্রাগৈতিহাসিক কালে মানুষ তো সোনার দাম কত তা জানত না। দেহের বিলাস সে শেখেনি তখননা। আত্মজন বলতে কেউ ছিল না তার। মানুষ তার পিতৃপরিচয় পর্যন্ত জানত না।

সে সব জঙ্গলের কথা। মানুষ কি আর তখন মানুষ ছিল? জন্তুর মতোই তো ছিল।

এখনো কি তাই নেই সুনয়নী? পৃথিবীকে তো আমার এখন আরো ভয়ংকর জঙ্গলের জায়গা বলে মনে হয়।

তুমি চিরকালই একটু কেমন যেন! না বৈরাগী, না সংসারী। এরকম কেন বলো তো? তোমার কি বেঁচে থাকতে ভাল লাগে না? একটু পরমায়ুর জন্য আমি কত ছটফট করেছি।

বেঁচেও তো থাকতে চাই সুনয়নী। জীবন্মৃত হয়ে থাকতে চাই না। জরা আসছে, মৃত্যু আসছে, সেই সঙ্গে আসছে নানা প্রশ্ন।

কিসের প্রশ্ন?

তুমি কি জাননা সুনয়নী, তুমি আর আমি মিলে যাদের জন্ম দিয়েছি, আমাদের সেইসব ছেলেমেয়েরা কেমন?

ওরা খুব ভাল।

ভাল? তবে কেন তোমার মৃত্যুর পরই মেয়েরা এসে গয়না চুরি করে নিয়ে যায়? কেন বউরা এসে তাতে ভাগ বসায়? যেন ওরা তোমার মৃত্যুর অপেক্ষাতেই ছিল।

ওসব তো ওদেরই।

ওদেরই? হেমকান্ত প্রেতের মতো একটু হাসলেন, মাথা নেড়ে বললেন, ওদের নয়, কারো নয়। পৃথিবীর ধ্বংসের দিনে পৃথিবী আবার সব ফিরিয়ে নেবে। সুনয়নী, এমন কি তোমার আমার ছেলেমেয়ে বলে যাদের জানি তারাও আমাদের নয়। আমরা নিমিত্তমাত্র। আমরা স্রষ্টা নই, জন্মের উপকরণ মাত্র। কাস্টোডিয়ান। কেন এত আমার-আমার বলে হয়রান হয় মানুষ?

তোমার মতো জাগ্রত বিবেক তো সকলের নেই।

হেমকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, জাগ্রত বিবেক নয় সুনয়নী। যা জাগ্রত তা হল যন্ত্রণা। বড় যন্ত্রণা।

তুমি মরতে ভয় পাও?

না। মরতে ভয় পাই না। কিন্তু মৃত্যুর মধ্যে যে রহস্যময়তা আছে তা আমাকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। তোমার মৃত্যুর কথা আমাকে বলবে?

সুনয়নী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে, আমি কি অত সুন্দর করে বলতে পারবো? লেখাপড়া শিখিনি, ভাষার ব্যবহারও ভাল জানি না।

বোবাও তো ভাব প্রকাশ করে। তুমি পারবে না?

পারব কিনা কে জানে। তবে মনে হয়েছিল, গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছি। তারপর মনে হল, অনেক দূরে চলে এলাম। এত দূরে কখনো আসিনি। খুব কষ্ট হচ্ছিল।

কিরকম কষ্ট?

দোটানার কষ্ট। দুদিকেই টান। গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে নেওয়া হয় তখন ফুলের যেমন লাগে।

বোঝা গেল না সুনয়নী।

বোঝানো যায়ও না গো। অপেক্ষা করো, একদিন তোমারও তো ওরকম হবে।

হ্যাঁ। তার বড় একটা দেরীও নেই।

কেন ওকথা বলছ? সেই বালতিটা হাত থেকে পড়ে গেল বলে? ওটা কিছু নয়।

কী করে বুঝলে কিছু নয়?

কিছু নিশ্চয়ই। তবে ওটা বয়সের জন্য নয়।

তবে কিসের জন্য?

তোমার সব কাজই একটা নিয়ম শৃংখলায় বাঁধা। নিজেকে তুমি কতগুলি নিগড়ে বেঁধে রেখেছো। গভীর বাইরে কখনো যাও না। তুমি কখনো অস্বাভাবিক কোনো আচরণ করো না। কিন্তু তোমার ভিতরে, খুব গভীরে একটা নিয়ম ভাঙার ইচ্ছে জেগেছে।

সেটা কীরকম?

তুমি আর নিয়ম শৃংখলায় থাকতে চাইছে না। কিন্তু সেই পাগল ইচ্ছেকে জোর করে চাপা দিয়ে রেখেছে। তোমার হাত থেকে বালতি পড়ে যায়নি।

তাহলে?

তুমি ইচ্ছে করেই বালতিটাকে ছেড়ে দিয়েছিলে।