» » একচল্লিশ থেকে পঞ্চাশ পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

দূরবীন

একচল্লিশ

বৈশাখ মাসে কোকাবাবুদের একটা মহাল কিনে নিলেন রাজেন মোক্তার। তাঁর বৈষয়িক অবস্থাটা বেশ ভালর দিকে। শচীন এখন বেশ পসার জমিয়ে ফেলেছে। সেজো ছেলে রথীন মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের খুবই মেধাবী ছাত্র। মাস্টারমশাইদের ধারণা সে ম্যাট্রিকে স্ট্যাণ্ড করবেই। মেজো ছেলে সতীন বা সতীন্দ্র লেখাপড়ায় সুবিধে করতে না পারলেও সে কাটা কাপড়ের একটা কারবার খুলেছে। দোকানটা বেশ চলছে এখন। রাজেনবাবু সুতরাং তাঁর দারিদ্র্যের গ্লানি সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠে এখন বিশিষ্ট একজন নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছেন। সুখের বিষয়, তাঁর নিজের পসারও এখন যথেষ্ট। তবু তিনি কানাঘুষো শুনেছেন যে, হেমবাবুর ছোটো মেয়েটি নাকি গরীব বলেই তাঁর পরিবারে বউ হয়ে আসতে স্বীকার হচ্ছে না।

রাজেনবাবু জেদী লোক। বৈষয়িক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আত্মমর্যাদাবোধটিও বেড়েছে। এই জেলার কোন জমিদারের অবস্থা কেমন তা তিনি ভালই জানেন। হেমকান্ত চৌধুরির অবস্থাও তাঁর অজানা নয়। তবু এই পরিবারটির প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতাবোধ খুবই গভীর। এক সময়ে এঁরা তাঁর দুঃখের দিনে অযাচিত সাহায্য বড় কম করেননি। তাই হেমবাবুর মেয়েটিকে বউ করে আনতে তিনি এক কথাতেই রাজি হয়ে যান। মেয়েটিও সুন্দরী।

কিন্তু তাঁর মেজো মেয়ে সুফলার কাছে তিনি বিশাখার স্বভাবের যে পরিচয় পেয়েছেন তা মোটেই ভাল নয়। তাঁর স্ত্রী স্বর্ণপ্রভাও এই বিয়েতে বেঁকে বসেছেন। তবু এখনো যে বিয়েটি ভেঙে যায়নি তার কারণ, রাজেনবাবু নিজে থেকে বিয়েটা ভাঙতে চান না। তাতে হেমবাবুকে অপমান করা হবে। তবে তিনি ছেলের জন্য ভাল পাত্রীর সন্ধানে আছেন। দু-একটা ভাল সম্বন্ধ এসেছেও। তার মধ্যে দুটি জমিদারকন্যা। শ্রীকান্ত রায়ের মেজো মেয়েটিকে তাঁরা একরকম পছন্দ কৱেই ফেলেছেন। বিশাখার মতো অতটা না হলেও মেয়েটি সুন্দরীই। উপরন্তু শ্রীকান্ত রায় মুখ ফুটে নিজেই বলেছেন, আমার ছেলে জ্যোতিপ্রকাশের সঙ্গে আপনার মেজো মেয়েটিরও বিয়ে হতে পারে।

পাল্টি বিয়েতে একটু আপত্তি আছে স্বর্ণপ্রভার। তবে তিনি এখনো পরিষ্কার মতামত জানাননি। যদি আপত্তিটুকু শেষ অবধি না থাকে তবে আষাঢ়েই জোড়া বিয়ে লেগে যেতে পারে। শ্রীকান্ত রায় একটু কৃপণ মানুষ। তার ওপর নিজে ল পাশ। বিষয়বুদ্ধিও চমৎকার। তাই জমিদারদের মধ্যে তাঁর অবস্থাই সবচেয়ে স্থিতিশীল।

সবদিক বিবেচনা করে দেখেছেন রাজেনবাবু। শ্রীকান্ত রায়ের প্রস্তাবটিই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। এখন অপেক্ষা শুধু হেমকান্তর দিক থেকে একটি অস্তিবাচক বা নেতিবাচক কথা শোনবার। যদি শেষ পর্যন্ত হেমবার মেয়েটি বিয়েতে রাজিও হয় তবে দেনা-পাওনার প্রশ্ন তুলে প্রস্তাবটি কাটিয়ে দেওয়া যাবে। হেমকান্তর সাধ্য নেই মেয়ের বিয়েতে খুব বেশী নগদ টাকা খরচ করার। শচীনের কাছ থেকে হেমবাবুর এসটেটের অবস্থা তিনি মোটামুটি জেনে নিয়েছেন।

নতুন কেনা মহালটা দেখতে গিয়েছিলেন রাজেনবাবু। ফিরলেন দুপুরে। ঘেমেচুমে একশেষ। নৌকো থেকে নেমে একটা ছ্যাকরা গাড়িতে বাড়ি ফিরে স্নান করে যখন খেতে বসেছেন তখন স্বর্ণপ্রভা বললেন, হেমবাবু লোক পাঠিয়েছিলেন।

ভ্রূ তুলে রাজেনবাবু একটু বিরক্তির সঙ্গেই বললেন, কেন?

বিয়ের ব্যাপারে এগোতে আরো মাস দুই সময় চেয়েছেন।

কে এসেছিল?

মনু। আমার যেন কেমন-কেমন মনে হচ্ছে।

কেমন-কেমন মানে?

ওরা শচীনের মাথাটা খাওয়ার মতলব করছে। ভাল চাও তো শচীনকে বলো, যেন হেমবাবুর এসটেটের কাজ ছেড়ে দেয়।

মাথাটা কী করে চিবিয়ে খাবে?

মেয়েরা সব পারে।

এই তো শুনি মেয়েটি নাকি এ বিয়েতে রাজি নয়। তারপর আবার মাথা চিবোনোর প্রশ্ন উঠছে কি করে?

কী জানি। শচীনের জন্য আমরা অন্য পাত্রী দেখছি সেটা বোধহয় ওদের কানে গেছে। তাছাড়া আরো কথা আছে।

আবার কী কথা?

কোকাবাবুর নাতি শরৎ সেই যে ডাকাতিয়া ছেলেটা, বিশাখা নাকি তাকে বিয়ে করার জন্য পাগল।

রাজেনবাবু এবার গম্ভীর হলেন। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, তাই নাকি? এতদূর!

সেই জন্যই বলছি ছেলেকে এখন থেকেই একটু সাবধান করে দিও। যদি এ মেয়ের ফাঁদে পড়ে যায় তবে সারা জীবন নানা জ্বালা পোহাতে হবে।

একটা অতৃপ্ত উদ্‌গার তুলে রাজেনবাবু উঠে পড়লেন।

স্বর্ণপ্রভা পিছন থেকে বললেন, সময় চাইবেই বা কেন! ধিঙ্গি মেয়েকে ঘরে বসিয়ে রেখে নষ্ট করছে, তার জন্য আমরা কেন সময় দেবো? তুমি সোজা গিয়ে না করে দিয়ে এসো।

রাজেনবাবু মাথা নেড়ে বলেন, কাজটা ওভাবে করতে চাই না। হেমবাবু লোক খারাপ নন।

লোক ভালই বা কিসের? কানাঘুষো তো কিছু কম শুনিনি। মনু আজও বিয়ে বসেনি। লোকের কথা কি আর সব মিথ্যে হয়। এ বিয়ে ভেঙে দেওয়াই তো উচিত। আমি বলি দু-চারটে স্পষ্ট কথা মুখের ওপর বলে ভেঙে দেওয়াই ভাল। আমরা পাত্রপক্ষ, অত যো-হুজুর হয়ে থাকব কেন?

রাজেনবাবু টের পান, স্বর্ণপ্রভা ঠিক আগের মতো নেই। এক সময়ে সংসার চালানোর জন্য কিশোরী বয়স থেকে এই স্বর্ণপ্রভা কাঁথা সেলাই ইত্যাদি কত কী করেছেন। হেমবাবুর স্ত্রীর আঁতুর ঘরে কাজ পর্যন্ত করেছেন। তার বদলে ধারকর্জ সাহায্য অনেক কিছু পাওয়া গেছে। সুনয়নীর সঙ্গে স্বর্ণপ্রভার একটা সখিত্বও গড়ে উঠেছিল। তবে সেটা সমানে সমানে নয়। বড়লোকের যেমন পারিষদ থাকে স্বর্ণপ্রভাও তাই ছিলেন সুনয়নীর। প্রায়ই এসে বলতেন, বাবা গো, একগলা মিথ্যে কথা বলে এলাম কত্রীর মন রাখতে।

সে সব দুঃখের দিন গিয়ে আজ স্বর্ণপ্রভার জীবনে এক স্বর্ণযুগ এসেছে। স্বামী আর ছেলেরা দু হাতে রোজগার করছে। তিনি নিজে গোপনে বন্ধকী কারবার করছেন। তাঁর মনোভাব বুঝতে রাজেনবাবুর দেরী হয় না।

কিন্তু রাজেনবাবু এখনো সুনয়নীর মানসিকতা অর্জন করতে পারেননি। অবস্থার পরিবর্তনে মানুষের মনের পরিবর্তন হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু তার মধ্যে একটা বিকৃতিও আছে। অতীতকে বিস্মৃত হওয়া বা ভবিষ্যতের চিন্তা না করাটাই মানুষের স্বভাব। তার চিন্তা শুধু বর্তমান নিয়ে। কিন্তু রাজেনবাবু সব সময়েই এরকম অবিমৃষ্যকারিতা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে চান। অকৃতজ্ঞতা তাঁর স্বভাবে নেই। তিনি জেদী, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ বলেই আজ ছুটকো বড়লোকের মতো ভাবভঙ্গি করতে লজ্জা পান।

স্বর্ণপ্রভার প্রস্তাবে রাজেনবাবু সায় দিলেন না। গম্ভীর মুখ করে বললেন, যা স্থির করার আমিই করব। তোমার আর এ নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। সম্বন্ধটা ভেঙে যাচ্ছেই। কিন্তু সেটা আমাদের তরফ থেকে হওয়া উচিত নয়। কেন নয় সেটা তুমি বুঝবে না।

ছেলেকে তো কিছু বলবে! সে ওবাড়িতে যায়-আসে এটা আমার পছন্দ নয়। আবার একটা কানাকানি শুরু হবে।

আচ্ছা, সেটা ভেবে দেখছি।

রাজেনবাবু তাঁর ঘরে এসে ইজিচেয়ারে বসে নিঃশব্দে তামাক খেতে লাগলেন। বাইরে গ্রীষ্মের খা খা দুপুরে একটা ঘুঘু ডাকছিল। চালের টিনে পাতা খসার শব্দ। পায়রার গাঢ় বকবকম স্বর এক-আধবার শোনা গেল। রাজেনবাবু নিজের বর্তমান বৈষয়িক সম্পন্নতাটা খুব টের পান। কিন্তু ভাবেন, আমার মনে কোনো হীনতা জন্ম নিচ্ছে না! কোনো দেমাকী ভাব! আমি মানুষকে যথাযথ মূল্য দিতে পারছি তো! যথেষ্ট বিনয়ী আছি কি এখনো?

ভাবতে ভাবতে তিনি চোখ বুজলেন। একটু তন্দ্রা এল।

কুঞ্জবনে আজ ধানীরঙের রোদ এক সুন্দর আবহ রচনা করেছে। ভারী নির্জন। ভারী। নিরিবিলি। রোদের আলপনা আর আঁকিবুকি ছড়িয়ে আছে সবুজ ঘাসে। গ্রীষ্মের প্রখরতায় বিবর্ণ গাছপালা কালবৈশাখীর ঝাপটায় আবার সতেজ।

কাছারি ঘরের আড়াল থেকে লতানে গাছে আচ্ছন্ন একটি শুঁড়িপথ বেয়ে কুঞ্জবনে ঢুকল চপলা। তার হাতে ধরা বিশাখার লাজুক হাত।

বিশাখা একটা ঝাপটা দিয়ে বলল, আঃ, ছাড়ো না।

না, তুই পালাবি।

পালাবো কেন? বাঘ না ভালুক?

তার চেয়েও সাঙ্ঘাতিক। বিয়ে হলে বুঝবি বরের চেয়ে সাঙ্ঘাতিক জন্তু আর নেই।

হলে তো!

হওয়াচ্ছি, পালাবি কোথায়!

ছাড়ো বউদি, পায়ে পড়ি। তেমন গরজ তো দেখছি না ছাড়া পাওয়ার। আয় বলছি।

তোমার মাথায় কেন্নো আছে বউদি। আজ সন্ধেবেলায় তো জলসা হচ্ছেই।

জলসায় কী কথা হয় রে বোকা! কথার জন্য জলসা নয়।

দেখা করে লাভ কি?

যদি এল ও ভি ই হয়ে যায়?

যাঃ।

দুজনে কুঞ্জবনে এসে চারদিকটা তাকিয়ে দেখল। চপলা একটা বেগুনী রঙের ছোটো ফুল ছিঁড়ে খোঁপায় গুজে ঘোমটাটা আবার তুলে দিয়ে বলল, এ জায়গাটা যে এত সুন্দর জানা ছিল না! কেন সুন্দর বল তো!

এটা তো বাজে জায়গা। সুন্দর আবার কী? জঙ্গল, আগাছা, বিছুটিবন।

তোর চোখ নেই।

তা হয়তো নেই।

ঠিকই নেই! তোর জন্য আমার ভাবনা হয়। এ জায়গাটা সুন্দর কেন জানিস! সাজানো নয় বলে।

তুমি কলকাতায় থাকো বলে গাছপালা দেখলেই ভাল লাগে। আমাদের তো তা নয়। গাছপালা দেখতে দেখতে চোখ পড়ে গেছে।

তোর চোখ পচে গেছে, মন পচে গেছে, হৃদয় বলে কিছু নেই।

বেশ তো বেশ। পচে গেছে তো গেছে।

আর এখানে বসি।

ওমা! ওই ভাঙা গাড়ির পাদানীতে!

তাতে কী! বেশ পরিষ্কার তো!

বিশাখা একটু হাসল। ভারী সুন্দর দেখাল তাকে। আজ তাকে একটু সাজিয়েছে চপলা। চমৎকার একটা বুটিদার নলি বেনাবসা তার পরনে। বাজতে অনন্ত, কজিতে বালা আর চুড়ি, গলায় মোটা একটা মটরদান হার। চুল ফাঁপিয়ে আঁচড়ানো। কিন্তু সাজগোজ বড় কথা নয়। বিশাখা সাজগোজকে উপেক্ষা করেই তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য বিকিরণ করছে।

দুজনে ভাঙা গাড়ির পাদানীতে বসে নিচুস্বরে কথা বলতে লাগল।

চপলা জিজ্ঞেস করল ভয় করছে না তো রে?

বিশাখা মাথা নেড়ে বলল, না। তবে তোমাৰ এতটা করার দরকার ছিল না। বাবা শুনলে তোমার ওপর চটে যাবে।

সে আমি বুঝব। তোর কেমন লাগছে বল!

কিছুই লাগছে না।

বুক কাঁপছে না?

না তো!

ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছে না?

একটুও না, এই দেখ না ঠোঁট।

উঃ, তুই পাষাণী বটে। তোর কিছু হচ্ছে না, কিন্তু আমারই তো বুক কাঁপছে।

দেখো আবার, তুমিই শচীনের প্রেমে মজে যেও না।

দূর মুখপুড়ী, বলে একটা চিমটি কাটে চপলা।

উঃ! ভীষণ লেগেছে কিন্তু।

তোর কিছু হচ্ছে না কেন?

হবেই বা কেন?

পুরুষমানুষকে লজ্জা হয় না তোর?

তা হয়। কিন্তু পুরুষমানুষকেই হয়। শচীনকে নয়।

তার মানে কি শচীন পুরুষ নয়?

তা বলিনি।

তাই বলেছিস। কেন রে, সে কি মেয়েমানুষের মতো?

বিশাখা মাথা নীচু করে একটু ভাবল। তারপর বলল, বড় হিসেবী, নরমসরম।

সেটা কি খারাপ?

পুরুষের স্বভাব হবে দামাল।

তুই কাউকে দেখেছিস ওরকম? সত্যি কথা বল তো, কাউকে পছন্দ?

না, তা নয়।

আমার মনে হয়, তুই একটা গণ্ডগোল পাকিয়ে রেখেছিস মনে মনে। ভয়ে বা লজ্জায় বলছিস না।

বিশাখা তার জেদী মুখ নত করে রইলো।

চপলা নীচু হয়ে উঁকি মেরে মুখটা দেখার চেষ্টা করে বলল, লুকোচ্ছিস না তো!

বিশাখা মাথা নেড়ে বলল, না।

ঠিক সেই সময় গরম দু ফোঁটা জল পড়ল বিশাখার হাঁটুতে রাখা চপলার হাতে। চপলা চমকে উঠে বলল, কাঁদছিস? ওমা! কেন রে!

বিশাখা জবাব দিল না। গোঁজ হয়ে রইল।

চপলা বিশাখার কাঁধে হাত রেখে একটু কাছে টেনে নিয়ে বলল, চোখ মুছে নে। শচীন দেখলে কী ভাববে?

আমি চলে যাই বউদি? বড় কাতর শোনাল বিশাখার গলার স্বর।

চলে যাবি? আমি শচীনকে তাহলে কী বলব?

যা হয় একটা কিছু বলো।

তা হয় না। বোস। তুই তো বললি বাঘ ভালুক নয়, তবে যাবি কেন?

সব কথা বোঝানো যায় না। আমি অত কথা জানি না।

আচমকাই শচীনকে দেখতে পেল চপলা। মন্দিরের দিকটায় একটা ভাঙা বাড়ির স্তূপ আর আগাছার হাঁটুভর জঙ্গল পার হয়ে আসছে। পরনে কাঁচি ধুতি, গরদের পাঞ্জাবি। ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে।

আসুন। বলে চপলা উঠে দাঁড়ায়।

শচীন এক ঝলক বিশাখার দিকে চেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে থমথমে মুখে বলে, আপনি খুবই দুঃসাহসী।

চপলা মৃদু স্বরে বলে, আপনিও কম নন।।

শচীন মাথা নেড়ে বলে, এ জায়গায় ডেকে আপনি ঠিক কাজ করেননি। ঘটনাটা জানাজানি হয়ে যাবে।

হোক না।

না বউঠান, এটা কলকাতা নয়। জানাজানি হলে সকলেরই অসুবিধে, বিশেষ করে বিশাখার।

নিজের নাম শচীনের মুখে শুনে বিশাখা একবার চোখ তুলেই নামিয়ে নিল।

চপলা মুখ টিপে একটু হেসে বলল, কিন্তু আপনি তো এসেছেন। না এসে তো পারেননি।

এলাম। বলে শচীন একটু উদাসভাবে ওপরের দিকে চেয়ে থাকে। তারপর হতাশার ভঙ্গিতে মাথাটা একটু নেড়ে বলে, কয়েকটা কথা বলতে আসা।

কী কথা?

এ বিয়ে যে হবে না সেটা আপনি ধরে নিতে পারেন।

হবে না?

না। কিছুতেই না।

আপনার বাড়ির কোনো অমত আছে?

অমত ছিল না। কিন্তু বিশাখার মনোভাব জানাজানি হওয়ার পর অমত হয়েছে।

চপলা হঠাৎ ভারী বিষণ্ণ হয়ে গেল। বলল, ইস? আমাদের দুভাগ্য।

না। দুভাগ্য কেন! বিশাখা তো এই বিয়ে চায়নি।

ও কী চায় তা ও নিজেই জানে না। বলে চপলা বিশাখার দিকে তাকাল।

বিশাখা অনড় এক পুতুলের মতো যেমন বসে ছিল তেমনি বসে রইল।

শচীন বলল, সেটা আপনি আর বিশাখা বুঝবেন।

শুনুন শচীনবাবু, আপনি নিজে যদি বিশাখার সঙ্গে একটু কথা বলেন, তাহলে বোধহয় ওর একটা ভুল ধারণা কেটে যাবে।

শচীন একটু হাসল। তারপর ধীর স্বরে বলল, ওকে তো আমি এইটুকু বেলা থেকে দেখছি। কথাও বলেছি অনেক। নতুন করে কী আর বলার আছে বলুন। ও বড় হওয়ার পর তো বলেননি।

বলার দরকারও দেখছি না।

চপলা হঠাৎ একটু ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, আপনার কিন্তু বেশ অহংকার।

শচীন বিষন্ন মুখে মাথা নেড়ে বলল, তা নয়। অহংকাব থাকলে একটি মেয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে জেনেও আজ এখানে আসতাম না। অহংকার নয় বউঠান। বরং আত্মগ্লানি।

ওর বয়স কম। একটু তো বিবেচনা করবেন।

আপনারা ধরে বেধে ওপর ওপর অযথা একটা অত্যাচার করে যাচ্ছেন বউঠান। হেমবাবু করেছেন, মনুদি করেছেন, এখন আপনিও করছেন। আমি বলি কি, বেচারাকে ছেড়ে দিন। বেচারা এত লোকের মতামতের চাপে পড়ে দিশাহারা হয়ে যাচ্ছে।

চপলার মুখে কথা জোগাল না। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, চলুন, তাহলে ঘরে গিয়ে বসি।

চলুন। ঘর বরং ভাল। অনেক সেফ। এই সব বাগান-টাগানে দেখা সাক্ষাৎ করা ঠিক নয়।

বিশাখা উঠল না। বসে রইল।

চপলা বলল, আয়।

তোমরা যাও। আমি একটু পরে আসছি।

ওমা? জলসা আছে যে একটু পরেই।

যাও না। বিশাখা বিরক্তির গলায় বলে, আমি ঠিক আসব।

চপলা আর শচীন পাশাপাশি হেঁটে ভিতর বাড়ির দিকে চলে গেল। বিশাখা বিষাক্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তাদের গমনপথের দিকে।

বিশাখার শ্বাস ক্রমশ প্রলয়ংকর এবং উষ্ণ হয়ে উঠল। ভিতরে এক তীব্র জ্বালা। সে টের পায়। সে অনেক কিছু টের পায়।

দাঁতে দাঁত পিষে বিশাখা বলল, তলে তলে মকরধ্বজ! দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা।