তাওহীদের আক়ীদা
﷽
أَلْحَمْـدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَـالَـمِيْنَ وَ الصَّلاَةُ وَ السَّـلاَمُ عَلـىٰ رَسُـوْلِهِ الاَمِيْـن وَ الْعَاقِبَــةُ لِلْمُتَّقَيْنَ
সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজগতের পালনকর্তা আল্লাহর জন্য, এবং তাঁর বিশ্বস্ত রসূলের উপর সালাত ও শান্তি বর্ষিত হোক এবং মুক্তাকিনদের সর্বোত্তম বিনিময় লাভ হোক। অতঃপর—
ক়িয়ামাতের দিন মানুষের মুক্তি নির্ধারিত হবে দুটি বিষয়ের ভিত্তিতে। এক. ঈমান ও দুই. আমল সালিহ বা সৎকর্ম। ঈমান হচ্ছে আল্লাহর সত্তার প্রতি বিশ্বাস, রিসালাত ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস, ফিরিশতা ও কিতাব সমূহের প্রতি বিশ্বাস, তাক়দীরের ভাল মন্দের উপর বিশ্বাস। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বরকতময় নির্দেশ হচ্ছে— ‘ঈমানের সত্তরটির বেশি শাখা রয়েছে, এর মধ্যে সর্বোত্তম শাখা হল— لآَ إِلٰــهَ إِلاَّ اللهٌ (লা ইলাহা ইল্লালাহু—আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই) বলা। (সহীহ বুখারী)। অর্থাৎ ঈমানের ভিত্তি হল কালিমা তাওহীদ।
আমল সালিহ বা সৎকর্ম হচ্ছে সেই কর্মসমূহ যেগুলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের সুন্নাহ মুতাবিক করা হয়ে থাকে। নিঃসন্দেহে, পারলৌকিক মুক্তির জন্য সৎকর্ম অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তাওহীদের আক়ীদা ও সৎকর্ম—এতদোভয়ের মধ্যে তাওহীদের আক়ীদা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে।
ক়িয়ামাতের দিন তাওহীদের আকীদা থাকলে কর্মের অপূর্ণতা ও ত্রুটি-বিচ্যূতি ক্ষমাযোগ্য হতে পারে, কিন্তু তাওহীদের আকীদায় বিকৃতি (কাফিরানা, মুশরিকানা বা তাওহীদে শির্কের মিশ্রণ) থাকলে জমিন-আসমান সমান সৎকর্মও অকেজো ও অনর্থক সাব্যস্ত হবে। সূরা আলে ইমরানে আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন যে, কাফিরেরা যদি পৃথিবী সমান সোনাও সদকা করে ঈমান বিহীন অবস্থায় এই সৎকর্ম আল্লাহর নিকট ক়বুল হবে না। আল্লাহ বলেছেন—
( إِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ وَمَاتُوا۟ وَهُمْ كُفَّارٌۭ فَلَن يُقْبَلَ مِنْ أَحَدِهِم مِّلْءُ ٱلْأَرْضِ ذَهَبًۭا وَلَوِ ٱفْتَدَىٰ بِهِۦٓ ۗ أُو۟لَـٰٓئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌۭ وَمَا لَهُم مِّن نَّـٰصِرِينَ ) ٩١
‘নিশ্চয়ই যারা কুফরী করে এবং সেই কাফির অবস্থায়ই মারা যায়, তাদের কেউ (নিজেকে শাস্তি থেকে বাঁচানোর জন্য) পৃথিবী-ভরা স্বর্ণও বিনিময় স্বরূপ প্রদান করতে চাইলে তা তার কাছ থেকে কক্ষণও গ্রহণ করা হবে না। এরাই তারা যাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে এবং তাদের কোন সাহায্যকারী নেই। (সূরাহ আলি-ইমরান, আয়াত : ৯১)।
অতএব, শুধু তাদের সৎকর্ম বিনষ্ট হয়ে যাবে তাই নয় বরং কুফুরী আকীদার কারণে তাদেরকে কষ্টদায়ক সাজাও প্রদান করা হবে। এবং কেউ তাদের সাহায্য বা তাদের জন্য কোন সুপারিশও করতে পারবে না। সূরা আনআমে নবীদের পবিত্র জামায়াত ইবরাহীম, ইসহাক, ইয়াকুব, নূহ, দাউদ, সুলাইমান, আইউব, ইউসুফ, মূসা, হারুন, জাকারিয়া, ইয়াহইয়া, ইসমাইল, ইয়াসা, ইউনুস, লূত আলাইহিস সালামের উল্লেখ করে আল্লাহ পাক বলেন,—
( وَلَوْ أَشْرَكُوا۟ لَحَبِطَ عَنْهُم مَّا كَانُوا۟ يَعْمَلُونَ ) ٨٨
‘তারা যদি শিরক করত তবে তাদের সব কৃতকর্ম বিনষ্ট হয়ে যেত।’ (সূরা আন’আম, আয়াত : ৮৮)।
শিরকের নিন্দায় পবিত্র কুরআন মাজীদের আরও কতিপয় আয়াত লক্ষ্য করুন—
( وَلَقَدْ أُوحِىَ إِلَيْكَ وَإِلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ ٱلْخَـٰسِرِينَ ) ٦٥
‘এবং আপনার কাছে আর আপনার পূর্ববর্তীদের কাছে ওয়াহী করা হয়েছে যে, “আপনি যদি (আল্লাহর) শরীক স্থির করেন, তাহলে আপনার কর্ম অবশ্য অবশ্যই নিস্ফল হয়ে যাবে, আর আপনি অবশ্য অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।”’ —সূরা জুমার, আয়াত ৬৫।
( فَلَا تَدْعُ مَعَ ٱللَّهِ إِلَـٰهًا ءَاخَرَ فَتَكُونَ مِنَ ٱلْمُعَذَّبِينَ ) ٢١٣
‘কাজেই আপনি অন্য কোন ইলাহকে আল্লাহর সঙ্গে ডাকবেন না। ডাকলে আপনি শাস্তিপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন।’ —সূরা শূ’আরা, আয়াত ৩১৩।
উল্লিখিত দু’টি আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর প্রিয় নবী সাইয়্যেদুল মুরসালীন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে সম্বোধন করে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন— আপনিও যদি শিরক করেন তাহলে আপনার সকল সৎকর্ম ধ্বংস হয়ে যাবে এবং অন্যদের সাথে আপনাকেও শাস্তি প্রদান করা হবে।
সূরা মায়েদায় ঘোষণা করা হয়েছে—
( إِنَّهُۥ مَن يُشْرِكْ بِٱللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ ٱللَّهُ عَلَيْهِ ٱلْجَنَّةَ وَمَأْوَىٰهُ ٱلنَّارُ ) ٧٢
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে অংশীস্থাপন করে তার জন্য আল্লাহ অবশ্যই জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন আর তার আবাস হল জাহান্নাম।’ — সূরা মা’য়িদাহ, আয়াত ৭২।
সূরা নিসার একটি আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন—
( إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِۦ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَآءُ ) ١١٦
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সঙ্গে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না, এছাড়া অন্য সব যাকে ইচ্ছে মাফ করেন।’ — সুরা নিসা আয়াত ১১৬।
এই দুটি আয়াত দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, আল্লাহ তা’য়ালার সাথে শরীক করা অমার্জনীয় অপরাধ। শিরক ব্যতীত এমন কোন অপরাধ নেই যা আল্লাহ তা’য়ালা অমার্জনীয় বলেছেন বা যা করলে জান্নাত হারাম হবে বলেছেন।
সূরা তাওবায় আল্লাহ তা’য়ালা মুশরিক অবস্থায় মৃত ব্যক্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেও নিষেধ করেছেন—
( مَا كَانَ لِلنَّبِىِّ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓا۟ أَن يَسْتَغْفِرُوا۟ لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوٓا۟ أُو۟لِى قُرْبَىٰ مِنۢ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَـٰبُ ٱلْجَحِيمِ ) ١١٣
‘নবী ও মু’মিনদের জন্য শোভনীয় নয় মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা, তারা আত্মীয়-স্বজন হলেও, যখন এটা তাদের কাছে সুস্পষ্ট যে, তারা জাহান্নামের অধিবাসী।’ — সুরা তওবা, আয়াত ১১৩।
এখন শিরকের নিন্দায় কয়েকটি পবিত্র হাদীস উল্লেখ করছি—
- রাসুল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম মুআ’য রাদি আল্লাহু তা’য়ালা আনহুকে দশটি উপদেশ দিয়েছিলেন, যার মধ্যে শীর্ষ উপদেশ ছিল এই যে, لاَ تُشْرِك بِاللهِ ششَيَّئًا وَ إِنْ قُتَّلْتَ أوْ حُرِّقْتَ অর্থাৎ, আল্লাহর সাথে শিরক করো না যদিও তোমাকে হত্যা করা হয় অথবা পুড়িয়ে ফেলা হয়।— মুসনাদ আহমদ।
- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহিস সালাম বলেন— সাতটি বিধ্বংসী বস্তু থেকে বেঁচে থাক — ১. আল্লাহর সাথে শিরক করা; ২. জাদু করা; ৩. অন্যায় ভাবে কাউকে হত্যা করা; ৪. ইয়াতীমের সম্পদ খাওয়া; ৫. সুদ খাওয়া; ৬. যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা; ও ৭. সহজ সরল নারীর উপর অপবাদ আরোপ করা। —সহীহ মুসলিম।
- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেন, ‘আল্লাহ তা’য়ালা ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার গুনাহ মাফ করতে থাকেন যতক্ষণ না আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে পর্দা তৈরি না হয়।’ সাহাবায়ে কেরাম জানতে চাইলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম, পর্দা তৈরি হওয়ার অর্থ কী?’ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেন, ‘পর্দার মানে হচ্ছে, মৃত্যু পর্যন্ত শিরকে নিমজ্জিত থাকা। —মুসনাদ আহমাদ।
আলোচিত কুরআনের আয়াত ও হাদীস সমূহ থেকে এমন ধারণা করা কঠিন নয় যে শিরক এমন পাপ যার পরিণতিতে মানুষের মৃত্যু ও ধ্বংস সুনিশ্চিত হয়ে যায়।
নিচে কয়েকটি উদাহরণ প্রদান করা হল—
ক়িয়ামতের দিন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম স্বীয় পিতা আজরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহ তা’য়ালার নিকট সুপারিশ করবেন, জবাবে আল্লাহ তা’য়ালা বলবেন,— ‘إِنِّىْ حَرَّمْتُ الْجَنَّةَ عَلَى الْكَافِرِيْنَ’ অর্থাৎ ‘আমি কাফিরদের জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছি’ (সহীহ বুখারী)। এই বলে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সুপারিশ রদ করে দেওয়া হবে।
রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের চাচা জনাব আবু ত়ালিব সম্পর্কে কে না জানেন। তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের নবুওয়াত লাভের পর প্রতিটি মুহূর্তে অত্যন্ত বীরত্ব ও স্থিরতার সাথে রাসুল্লাহকে সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি মক্কার ক়ুরাইশদের নির্যাতন, নিপীড়ন ও অপরিসীম চাপের মুখে লৌহপ্রাচীর হয়ে খাড়া হয়েছিলেন। শিয়াবে আবি ত়ালিব[১] উপত্যাকায় বন্দী থাকার দিনগুলোতে তিনি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে সম্পূর্ণরূপে সহযোগিতা করেছিলেন। আবু জাহল ও অন্যান্যরা যখন রাসুলুল্লাহকে হত্যা করার ইচ্ছা পোষণ করেছিল, তখন তিনি বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিব গোত্রের যুবকদের মসজিদুল হারাম চত্বরে একত্রিত করে প্রকাশ্যে আবু জাহলকে যুদ্ধের হুমকি দিয়েছিলেন। জনাব আবু ত়ালিব সারাজীবন এভাবেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে সহযোগিতা করেছিলেন। যে বছর জনাব আবু ত়ালিবের ইন্তেকাল হয়েছিল, সে বছরকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম দুঃখের বছর (عام الحزن) বলে অভিহিত করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের সাথে রক্তের সম্পর্ক এবং ধর্মীয় বিষয়ে তার পূর্ণ সমর্থন থাকার পরও শুধুমাত্র ঈমান গ্রহণ না করার কারণে জনাব আবু ত়ালিবকে চিরস্থায়ী জাহান্নামে যেতে হবে। —সহীহ মুসলিম।
একব্যক্তি আবদুল্লাহ ইবনে জাদ’আনের বিষয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহিস সালামের নিকট জানতে চেয়েছিলেন যে ‘তিনি তো আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী এবং লোকেদের খাদ্য দানকারী ছিলেন, তার এই সকল নেক আমল কি ক়িয়ামাতের দিন তার কোন উপকারে আসবে?’ উত্তরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহিস সালাম বললেন,— ‘না। কেননা, সে জীবনে একবারও এই কথা বলেনি,— (رَبِّ اغْفِرْلِى خَطِيْئَتِىْ يَوْمَ الدِّيْنَ) — হে আমার রব, ক়িয়ামাতের দিন আমার পাপসমূহ ক্ষমা করে দিন।’ (সহীহ মুসলিম)। অর্থাৎ, তার আল্লাহ তা’য়ালার প্রতি ঈমান ছিল না, ক়িয়ামাত দিবসের প্রতিও ঈমান ছিল না; ফলে তার সকল পূণ্য ও সৎকর্ম বিনষ্ট হয়ে যাবে।
উল্লিখিত সত্য ঘটনাগুলো থেকে একথা সুস্পষ্ট যে, ‘আক়ীদায়ে তাওহীদ’ ব্যতীত কোন পূণ্য ও সৎকর্ম আল্লাহ তা’য়ালার দৃষ্টিতে সামান্যতম সওয়াব ও প্রতিদানের যোগ্য বলে বিবেচিত হবে না।
শিরকের বিপরীতে, তাওহীদের বিশ্বাস ক়িয়ামাতের দিন গুনাহের কাফফারা এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে মাগফিরাতের কারণ হবে। রাসুল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি لآَ إِلٰــهَ إِلاَّ اللهٌ কালিমা স্বীকার করবে এবং এই স্বীকৃতির উপর তার মৃত্যু হবে সে নিশ্চিত জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ সাহাবীগণ জানতে চাইলেন, ‘যদি সে ব্যভিচার করে, যদি সে চুরি করে?’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেন, ‘হ্যাঁ! যদি সে ব্যভিচার করে, যদি সে চুরি করে।’ (সহীহ মুসলিম)। একটি হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,— ‘হে আদম সন্তান! যদি তুমি পৃথিবী সমান পাপও করে আস কিন্তু এমন অবস্থায় আসো যে, আমার সাথে অন্য কাউকে শরীক করোনি, তাহলে আমি তোমার পৃথিবী সমান পাপ ক্ষমা করে দিব। (তিরমিযী)।
ক়িয়ামাতের দিন এক ব্যক্তি আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে, যার নিরানব্বইটি খাতা হবে পাপে পরিপূর্ণ। সে তার পাপের কারণে হতাশ হবে। আল্লাহ তা’য়ালা ঘোষণা করবেন— ‘আজ কারও প্রতি জুলম করা হবে না, আপনাদের একটি সৎকর্ম থাকলেও কর্ম পরিমাপের পাল্লার নিকট চলে যান।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেন,— ‘তার পাপসমূহ পাল্লার এক অংশে ঢেলে দেওয়া হবে এবং অপরাংশে ঢেলে দেওয়া হবে সৎকর্ম সমূহ। সেই একটি সৎকর্ম সমস্ত পাপের চেয়ে ভারী হয়ে যাবে। সেই একটি সৎকর্ম হবে— أَشْهَدُ أَنْ لآَ إَلَهَ إِلاَّ اللهُ وَ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَ رَسُوْلُهُ (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম আল্লাহর রাসুল)’ — (তিরমিযি)।
এক বৃদ্ধ রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের নিকট উপস্থিত হয়ে জানতে চাইলেন,— ‘হে রাসুলুল্লাহ! সারা জীবন পাপে নিমজ্জিত ছিলাম, এমন কোন পাপ নেই যা করিনি; সমস্ত পৃথিবীতে যত প্রাণী রয়েছে সবার মধ্যে আমার পাপ বণ্টন করে দিলেও আমি তাদের সবাইকে নিয়ে জাহান্নামে চলে যা। আমার তাওবার কোন সুযোগ আছে কি?’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বললেন,— ‘ইসলাম গ্রহণ করেছেন কি?’ লোকটি বলল,— ‘أَشْهَدُ أَنْ لآَ إَلَهَ إِلاَّ اللهُ وَ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَ رَسُوْلُهُ (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম আল্লাহর রাসুল)।’ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেন,— ‘আল্লাহ ক্ষমাশীল এবং পাপকর্মকে সৎকর্মে পরিবর্তনকারী।’ লোকটি জানতে চাইলেন,— ‘আমার পাপ ও অপরাধকে ক্ষমা করা হবে কি?’ রাসুল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেন,— ‘হ্যাঁ, আপনার পাপ ক্ষমা করা হবে।’ (ইবনে কাসির)।
একবার ভাবুন তো! একদিকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের আপন চাচা, যিনি আজীবন ধর্মের ব্যাপারে আপন ভাতিজার সাহচর্যের হক আদায় করেছেন, কিন্তু তাওহীদের আক়ীদার উপর ঈমান না আনার কারণে চিরস্থায়ী জাহান্নামের হক়দার হয়ে গেছেন। অপরদিকে, একজন অপরিচিত ব্যক্তি যার সাথে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রক্তের সম্পর্ক ছিল না, এবং তিনি নিজেও তার বিশাল পাপের কথা স্বীকার করছেন, তিনি তাওহীদের আক়ীদায় বিশ্বাস করার কারণে জান্নাতের হক়দার হয়েছিলেন।
এই সমস্ত আলোচনা থেকে উপসংহার এই যে, কেয়ামতের দিন নাজাত লাভ সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তির আক়ীদার উপর নির্ভর করবে। যদি আক়ীদা কিতাব ও সুন্নাহ মোতাবেক বিশুদ্ধ তাওহীদের উপর ভিত্তি করে হয়ে থাকে, তবে সৎকর্মের উত্তম প্রতিদান ও পুরষ্কার দেওয়া হবে এবং পাপসমূহকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। কিন্তু আক়ীদা তাওহীদের উপর না হয়ে শিরকের উপর হলে আসমান-জমিন পরিমাণ সৎকর্মও অগ্রহণযোগ্য এবং প্রত্যাখ্যাত হবে।
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
- ‘শিয়াবে আবি তালিব’ দ্বারা ৬১৬ খ্রিষ্টাব্দে কুরাইশ সম্প্রদায় কর্তৃক বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিব গোত্রকে একঘরে করা বুঝানো হয়। মক্কার কুরাইশ সম্প্রদায় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে হত্যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে আবু তালিব এটাকে প্রত্যাখান করেন। তখন কুরাইশ ও মিত্রেরা কয়েকটি শর্তে একত্র হয়ে একটি চুক্তি সম্পাদন করে। শর্তগুলো হচ্ছে— ‘১. মক্কার কোন ব্যক্তি বনি হাশেম ও বনু মুত্তালিব গোত্রের সাথে আত্মীয়তা করবে না; ২. উক্ত গোত্রদ্বয়ের কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে কোন প্রকার পণ্য সামগ্রী বিক্রয় করবে না; ৩. এমনকি; কোন প্রকার খাদ্য দ্রব্যও পাঠাবে না। সেই সাথে যতদিন পর্যন্ত তারা মুহাম্মদকে হত্যা করার জন্য আমাদের হাতে সমর্পণ না করবে ততদিন পর্যন্ত এ চুক্তি বলবৎ থাকবে।’ এই চুক্তি পত্রটি লিখেছিল বোগাইজ ইবনে আমের ইবনে হাশেম। তবে কেউ কেউ বলেন মনসুর ইবনে ইকরিমা ইবনে আমের ইবনে হাশেম বা নযর ইবনে হারেস লিখেছিল। বাধ্য হয়ে মুহাম্মদের চাচা আবু তালিব বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিব গোত্রের নারী, পুরুষ ও শিশুসহ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ‘শিয়াবে আবি তালিব’ নামক পাহাড়ের মধ্যে স্বনির্বাসিত হলেন। এই সঙ্কীর্ণ গিরি-উপত্যকায় বছর কারারুদ্ধ ছিলেন বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিব গোত্র। অতপর ৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে কাবাগৃহে রক্ষিত চুক্তিপত্রটি পোকায় বিনষ্ট করায় এখান থেকে মুক্তি পান রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম এবং বনু হাশিম ও বনু মু্ত্তালিব গোত্র।