তাওহীদে আকীদার ব্যাখ্যা
তাওহীদের মাদ্দাহ বা মূল হল ‘وحد’ এবং এই মাসদার বা উৎস থেকে ‘وحد’ ও ‘وحدة’ সবচেয়ে প্রসিদ্ধ যার অর্থ হল এক ও অদ্বিতীয় হওয়া। ‘وحيد’ বা ‘وحد’ এমন ব্যক্তিকে বলা হয় যিনি স্বীয় সত্তা ও গুণাবলীতে একক ও অতুলনীয়। ‘وحد’-এর ওয়াও-কে হামজায় পরিবর্তন করে ‘احد’ শব্দের সৃষ্টি হয়েছে। এই শব্দটি সুরা ইখলাসে আল্লাহ তা’য়ালার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তা’য়ালা স্বীয় সত্তা ও গুণাবলীতে এক ও অদ্বিতীয় এবং আর কেউ নেই যিনি তাঁর সত্তা ও গুণাবলীতে অংশীদার হতে পারে।
তাওহীদ তিন প্রকার। ১. সত্তাগত তাওহীদ, ২. ইবাদতের তাওহীদ ও ৩. গুণগত তাওহীদ। নিম্নে প্রত্যেক প্রকার তাওহীদের ব্যাখ্যা উপস্থাপন করছি।
সত্তাগত তাওহীদ
সত্তাগত তাওহীদ এই যে আল্লাহ তা’য়ালাকে তাঁর সত্তায় এক, অদ্বিতীয় ও শরীক বিহীন মেনে নেওয়া। তাঁর স্ত্রী নেই, সন্তান নেই, মাতা-পিতা নেই, কেউ তাঁর অংশ নয়, এবং তিনিও কারও অংশ নন।
ইয়াহুদীরা উজাইর আলাইহিস সালামকে আল্লাহর পুত্র মনে করত এবং খৃষ্টানেরা ঈসা আলাহিস সালামকে আল্লাহর পুত্র মনে করত—আল্লাহ তা’য়ালা উভয় সম্প্রদায়ের বাতিল বিশ্বাস খণ্ডন করে পবিত্র কুরআনে বলেন—
( وَقَالَتِ ٱلْيَهُودُ عُزَيْرٌ ٱبْنُ ٱللَّهِ وَقَالَتِ ٱلنَّصَـٰرَى ٱلْمَسِيحُ ٱبْنُ ٱللَّهِ ۖ ذَٰلِكَ قَوْلُهُم بِأَفْوَٰهِهِمْ ۖ يُضَـٰهِـُٔونَ قَوْلَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ مِن قَبْلُ ۚ قَـٰتَلَهُمُ ٱللَّهُ ۚ أَنَّىٰ يُؤْفَكُونَ ) ٣٠
“ইয়াহূদীরা বলে, ‘উযায়র আল্লাহর পুত্র।’ আর নাসারারা বলে, ‘মাসীহ আল্লাহর পুত্র।’ এসব তাদের মুখের কথা। এতে তারা তাদের পূর্বেকার কাফিরদের কথারই অনুকরণ করে। আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন! কেমন ভাবে তারা সত্য পথ থেকে দূরে ছিটকে পড়েছে।”— সূরা তাওবাহ, আয়াত ৩০।
মক্কার মুশরিকেরা ফিরিশতাদের আল্লাহর কন্যা মনে করত। আল্লাহ তা’য়ালা কুরআন মাজীদে তাদের এই বাতিল আক়ীদা খণ্ডন করে বলেছেন—
( وَجَعَلُوا۟ لِلَّهِ شُرَكَآءَ ٱلْجِنَّ وَخَلَقَهُمْ ۖ وَخَرَقُوا۟ لَهُۥ بَنِينَ وَبَنَـٰتٍۭ بِغَيْرِ عِلْمٍۢ ۚ سُبْحَـٰنَهُۥ وَتَعَـٰلَىٰ عَمَّا يَصِفُونَ ) ١٠٠
“তারা জ্বীনকে আল্লাহর অংশীদার স্থির করে অথচ তাদেরকে তিনিই সৃষ্টি করেছেন, তারা না জেনে না বুঝে আল্লাহর জন্য পুত্র-কন্যা স্থির করে, তাদের এসব কথা হতে তিনি পবিত্র ও মহান।” —সূরা আন’আম, আয়াত ১০০।
কোন কোন মুশরিক আল্লাহর সৃষ্টি যেমন— ফিরিশতা, জ়িন অথবা মানুষদের মধ্যে আল্লাহর সত্তাকে বিদ্যমান মনে করে, (এমন আক়ীদাকে আক়ীদায়ে হুলুল1 বলা হয়)। কোন কোন মুশরিক সৃষ্টজগতের সকল কিছুর মধ্যে আল্লাহকে বিদ্যমান মনে করে (এমন আক়ীদাকে বলা হয় ওহাদাতুল ওজুদ বা সর্বেশ্বরবাদ)। আল্লাহ তা’য়ালা এই সকল ভ্রান্ত আক়ীদাকে খণ্ডন করে বলেছেন—
( وَجَعَلُوا۟ لَهُۥ مِنْ عِبَادِهِۦ جُزْءًا ۚ إِنَّ ٱلْإِنسَـٰنَ لَكَفُورٌۭ مُّبِينٌ ) ١٥
“আর তারা আল্লাহর বান্দাদের মধ্য হতে কতককে আল্লাহর অংশ মনে করে নিয়েছে (যেমন ‘ঈসা (আঃ)-কে তারা আল্লাহর পুত্র মনে করে)। মানুষ অবশ্যই স্পষ্টতঃ অকৃতজ্ঞ।”—সুরা যুখরুফ, আয়াত ১৫।
এই সকল আয়াত থেকে এই কথা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা’য়ালার কোন খান্দান নেই। তাঁর স্ত্রী নেই, কোন সন্তান নেই, নেই মাতা-পিতাও। আল্লাহর সত্তা সৃষ্টির কোন (প্রাণী-অপ্রাণী) কিছুতেও বিদ্যমান নয়। তিনি কোন (জীব বা জড়) বস্তুর অংশও নন। সৃষ্টিজগতের কোন বস্তুও আল্লাহর মধ্যে বিদ্যমান নয় কিংবা আল্লাহর অংশ নয়। আল্লাহর নূর দ্বারা কাউকে সৃষ্টি করা হয়নি বা কেউ তাঁর নূরের অংশও নয়। রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম মক্কার মুশরিকদের যখন এক, অদ্বিতীয় সত্তার প্রতি আহ্বান করলেন, তখন তারা জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি যে সত্তার প্রতি আহ্বান করেছেন তাঁর বংশ পরিচয় কী? তিনি কী উপাদান দিয়ে সৃষ্টি? তিনি কী খান? কী পান করেন? তিনি কার নিকট থেকে উত্তরাধিকার পেলেন? তাঁর উত্তরাধিকারী কে?’ এই সকল প্রশ্নের জবাবে মহান আল্লাহ তা’য়ালা সূরা ইখলাস অবতীর্ণ করেন—
قُلْ هُوَ ٱللَّهُ أَحَدٌ ١ ٱللَّهُ ٱلصَّمَدُ ٢ لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ ٣ وَلَمْ يَكُن لَّهُۥ كُفُوًا أَحَدٌۢ ٤
১. বলুন, তিনি আল্লাহ, এক অদ্বিতীয়; ২. আল্লাহ কোন কিছুর মুখাপেক্ষী নন, সবই তাঁর মুখাপেক্ষী; ৩. তিনি কাউকে জন্ম দেন না, আর তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি। ৪. তাঁর সমকক্ষ কেউ নয়। —সুরা ইখলাস।
সত্তাগত তাওহীদ সম্পর্কে এটাও মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ তা’য়ালার সত্তা আরশ মুআ’ল্লাতে বিদ্যমান রয়েছে। এটাই কুরআন ও হাদীসসূহ দ্বারা প্রমাণিত2। অবশ্যই তাঁর জ্ঞান ও ক্ষমতা সবকিছুকে ঘিরে রেখেছে। এই আক়ীদার বিপরীতে, কাউকে আল্লাহর ছেলে বা মেয়ে মনে করা অথবা কোন সৃষ্টিকে আল্লাহর সত্তার অংশ বলা বা মনে করা এবং আল্লাহ সত্তাকে সর্বত্র ও সর্ববস্তুতে বিরাজমান মনে করা শিরক ফি জাত অর্থাৎ সত্তাগত শিরক।
তাওহীদে ইবাদত
তাওহীদে ইবাদতের অর্থ হল এই যে, প্রত্যেক প্রকার ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করা এবং অন্য কাউকে তাতে শরিক না করা। পবিত্র কুরআন মাজীদে ইবাদত শব্দটি দুটি পৃথক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথমতঃ উপাসনা এবং প্রার্থনা; যার অর্থ হচ্ছে এমন যা নিচের আয়াতে বর্ণিত হয়েছে—
( لَا تَسْجُدُوا۟ لِلشَّمْسِ وَلَا لِلْقَمَرِ وَٱسْجُدُوا۟ لِلَّهِ ٱلَّذِى خَلَقَهُنَّ إِن كُنتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ ) ٣٧
“সূর্যকে সিজদা করো না, চন্দ্রকেও না। সিজদা করো আল্লাহকে যিনি ওগুলোকে সৃষ্টি করেছেন যদি সত্যিকারভাবে একমাত্র তাঁরই তোমরা ইবাদাত করতে চাও।” —সূরা ফুসসিলাত (হামীমসিজদা), আয়াত ৩৭।
দ্বিতীয়তঃ আনুগত্য, বাধ্যতা এবং অনুসরণ; যার অর্থ হচ্ছে এমন যা নিচের আয়াতে বর্ণিত হয়েছে—
( ۞ أَلَمْ أَعْهَدْ إِلَيْكُمْ يَـٰبَنِىٓ ءَادَمَ أَن لَّا تَعْبُدُوا۟ ٱلشَّيْطَـٰنَ ۖ إِنَّهُۥ لَكُمْ عَدُوٌّۭ مُّبِينٌۭ ) ٦٠
“হে বনী আদম! আমি কি তোমাদেরকে নির্দেশ দেইনি যে, তোমরা শয়তানের ইবাদত করো না, কারণ সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু?” —সূরা ইয়াসীন, আয়াত ৬০।
প্রথম অর্থ, অর্থাৎ উপাসনা ও প্রার্থনার বিবেচনায় তাওহীদে ইবাদত হচ্ছে প্রত্যেক ইবাদত যেমন— সালাত, সালাতে অনুরূপ দণ্ডায়মান হওয়া, রুকু, সাজদা, নজর ও নিয়াজ (প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে ব্রত বা মান্নত), সাদাকাহ, খয়রাত, কুরবানী, তাওয়াফ, ই’তিকাফ, দুয়া, অদৃশ্যকে ডাকা, ফরিয়াদ, সাহায্য প্রার্থনা, আশ্রয় প্রার্থনা, সন্তুষ্টি কামনা, ভরসা, ভয় ও ভালবাসা3 ইত্যাদি সকল কিছুকে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য খালেস করে দেওয়া। ইবাদতের এই সকল বিষয়ে তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক না করা। এই গুলোর কোন একটিও যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও জন্যে করা হয় তবে তা শিরক ফিল ইবাদত হবে অর্থাৎ ইবাদতের মধ্যে শিরক করা হবে।
দ্বিতীয় অর্থ, অর্থাৎ আনুগত্য ও অনুসরণের বিবেচনায়, তাওহীদে ইবাদত অর্থ হল জীবনের সকল বিষয়ে শুধুমাত্র আল্লাহর তা’য়ালার আদেশ ও বিধানাবলীরই আনুগত্য করা। আল্লাহর আদেশ ও বিধানাবলী ছেড়ে অন্য কারও আনুগত্য করা, যেমন—নিজের খেয়ালখুশি, বাপদাদা, ধর্মীয়নেতা, রাজনৈতিক নেতা, শয়তান ও তাগুত ইত্যাদির আনুগত্য করাকে শিরক ফিল ইবাদত বলা হয়। যেমন আল্লাহ ইবাদতের ক্ষেত্রে অন্য কাউকে শরীক করা শিরক। সূরা ফুরকানে আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন,—
( أَرَءَيْتَ مَنِ ٱتَّخَذَ إِلَـٰهَهُۥ هَوَىٰهُ أَفَأَنتَ تَكُونُ عَلَيْهِ وَكِيلًا ) ٤٣
“তুমি কি তাকে দেখ না যে তার খেয়াল খুশিকে ইলাহ র়ূপে গ্রহণ করেছে? এরপরেও কি তুমি তার কাজের জিম্মাদার হতে চাও?” —সূরা ফুরকান, আয়াত ৪৩।
এ আয়াতে স্পষ্টভাবে নফসের অনুসরণ করাকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করা বলা হয়েছে যা হল শিরক।4
সূরা আন’আমের এক আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,—
( وَإِنَّ ٱلشَّيَـٰطِينَ لَيُوحُونَ إِلَىٰٓ أَوْلِيَآئِهِمْ لِيُجَـٰدِلُوكُمْ ۖ وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ ) ١٢١
“নিশ্চয়ই শয়ত়ানেরা তাদের বন্ধুদেরকে তোমাদের সাথে বিবাদ করতে প্ররোচিত করে; আর যদি তোমারা তাদের অনুগত্য কর, তবে তোমরা অবশ্যই মুশরিক হয়ে যাবে।” —সূরা আন’আম, আয়াত ১২১।
এই আয়াতে শয়ত়ানের আনুগত্য ও অনুসরণকে স্পষ্ট ভাষায় শিরক বলা হয়েছে। সূরা মায়েদায় আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,—
( وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْكَـٰفِرُونَ ) ٤٤
“আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, সে অনুযায়ী যারা বিচার ফায়সালা করে না তারাই কাফির।” —সূরা মায়েদা, আয়াত ৪৪।
সূরা মায়েদার ৪৫ ও ৪৬ সংখ্যক আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালার আইন মুতাবেক যারা ফয়সালা করে না তাদের জালিম ও ফাসিক বলা হয়েছে। আল্লাহ তা’য়ালার আদেশ ও আইন অনুসরণের বিপরীতে অন্যকারও আইন অনুসরণকারী ব্যক্তি যেমন মুশরিক এবং কাফির, তেমনি ফাসিক এবং জালিমও।
ইবাদতের উভয় অর্থ সামনে রাখলে তাওহীদে ইবাদতের অর্থ দাঁড়ায়, প্রত্যেক প্রকার ইবাদতের আচার-অনুষ্ঠান অর্থাৎ সালাত, সিয়াম, হজ়, যাকাত, সাদাকা, রুকু ও সিজদা, নজর ও নেওয়াজ, তাওয়াফ় ও ইতিক়াফ়, দুআ ও সাহায্য কামনা, আনুগত্য ও দাসত্ব, অনুসরণ ও তাক়ওয়া ইত্যাদি সমস্ত জিনিস আল্লাহর জন্য এবং এই সবের মধ্যে অন্য কাউকে আল্লাহর সাথে শরীক করা হচ্ছে শিরক ফিল ইবাদত বা ইবাদতে শিরক।
তাওহীদে সিফ়াত
তাওহীদে সিফ়াত অর্থাৎ গুণাবলীর একত্ববাদ হল, কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত আল্লাহর গুণাবলী সমূহকে স্বীকার করা এবং সেগুলোতে তাকে একক ও শরীক বিহীন মনে করা। আল্লাহ তা’য়ালার গুণাবলী এত অধিক যে, কোন মানুষের পক্ষে তা গণনা করা দূরের কথা কল্পনা করাও সম্ভব নয়। সূরা কাহফ়ে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,—
( قُل لَّوْ كَانَ ٱلْبَحْرُ مِدَادًۭا لِّكَلِمَـٰتِ رَبِّى لَنَفِدَ ٱلْبَحْرُ قَبْلَ أَن تَنفَدَ كَلِمَـٰتُ رَبِّى وَلَوْ جِئْنَا بِمِثْلِهِۦ مَدَدًۭا ) ١٠٩
“বল, ‘সমুদ্রগুলো যদি আমার প্রতিপালকের কথা লেখার জন্য কালি হয়ে যায়, তবে আমার প্রতিপালকের কথা লেখা শেষ হওয়ার আগেই সমুদ্র অবশ্যই নিঃশেষ হয়ে যাবে, আমি যদি এর সাহায্যের জন্য আরও অনুরূপ পরিমাণ সমুদ্র নিয়ে আসি তবুও।’” —সূরা কাহফ়, আয়াত ১০৯।
সূরা লুকমানে বলা হয়েছে,—
( وَلَوْ أَنَّمَا فِى ٱلْأَرْضِ مِن شَجَرَةٍ أَقْلَـٰمٌۭ وَٱلْبَحْرُ يَمُدُّهُۥ مِنۢ بَعْدِهِۦ سَبْعَةُ أَبْحُرٍۢ مَّا نَفِدَتْ كَلِمَـٰتُ ٱللَّهِ ۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌۭ ) ٢٧
“দুনিয়ার সব গাছ যদি কলম হয় আর সমুদ্র (কালি হয়) আর তার সাথে আরও সাত সমুদ্র যুক্ত হয়, তবুও আল্লাহর (প্রশংসার) কথা (লেখা) শেষ হবে না। আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, মহাপ্রজ্ঞার অধিকারী।” —সূরা লুকমান,আয়াত ২৭।
আলোচিত আয়াত দুটিতে ‘কালিমাত’ শব্দ দ্বারা আল্লাহ তা’য়ালার গুণাবলী বোঝানো হয়েছে। এই আয়াতগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, সত্যি কি আল্লাহ তা’য়ালার গুণাবলী এতটাই অসীম হতে পারে যে তা পৃথিবীর সকল বৃক্ষকে কলম আর সমুদ্রকে কালি বানানোর পরও লেখা সম্ভব নয়।
উদাহরণ হিসেবে আমরা এখানে একটি গুণের কথা উল্লেখ করছি, এর থেকে অন্যান্য গুণাবলী সম্পর্কে অনুমান করা যাবে যে পবিত্র কুরআনের বক্তব্য কতটুকু সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ তা’য়ালার একটি গুণ হল, ‘سَمِيْعٌ’ (সামীউন5) বা সর্বশ্রোতা। যার অর্থ সর্বদা শ্রবণকারী। গভীরভাবে বিবেচনা করুন যে, আল্লাহ তা’য়ালা কেবল কয়েক দিন, কয়েক মাস, কয়েক বছর ধরে যে শুনতে পাচ্ছেন তা নয় বরং সহস্র বছর ধরে একই সময়ে হাজার, লক্ষ, কোটি নয়, অগণিত মানুষের প্রার্থনা, ফরিয়াদ, মুনাজাত ও কথোপকথন শুনছেন। বান্দাদের দুয়া ও প্রার্থনা শোনা এবং প্রত্যেকের জন্য ভিন্ন ভিন্ন মীমাংসা দেওয়ার কারণে আল্লাহ তা’য়ালাকে কখনও কোনরকমের অসুবিধায় পড়তে হয়নি, কোনরকম ক্লেশ বা ক্লান্তিও ভোগ করতে হয়নি। শুধু হজ়ের সময়ের আরাফার ময়দানের দৃশ্য কল্পনা করুন— যেখানে প্রতিনিয়ত পনের থেকে বিশ লক্ষ মানুষ স্বীয় সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা, ফরিয়াদ, কান্না ও আহাজারীতে নিমগ্ন থাকেন, এবং আল্লাহ তা’য়ালা প্রত্যেকের ফরিয়াদ শোনেন, উদ্দেশ্য ও প্রয়োজন সম্পর্কে পূর্ব থেকে জ্ঞাত থাকেন এবং প্রত্যেকের অন্তরের গোপন কথাটিও জানেন। তারপর স্বীয় প্রজ্ঞা ও ইচ্ছানুসারে প্রত্যেকের বিষয়ে পৃথক পৃথক মীমাংসা দিয়ে থাকেন। এতে কোন প্রকার ত্রুটি-বিচ্যূতি হয় না বা কারও প্রতি অন্যায়-অবিচারও হয় না এবং কোনপ্রকার অসুবিধা বা অসাধ্য পরিস্থিতির সম্মুখীনও হতে হয় না। আবার, একই সাথে মহান আল্লাহ তা’য়ালা আরাফার ময়দানে অবস্থানরত হাজ়ী ব্যতীত সমস্ত পৃথিবীর সর্বস্থানের অগণিত মানুষের প্রার্থনা ও আকুতি শুনতে থাকেন।
এই তো শুধু মানুষের কথা বললাম, অনুরূপ অবস্থা জ়ীনদের ক্ষেত্রেও হয়। কেননা, জ়ীনেরাও মানুষের মত আল্লাহর ইবাদতের জন্য আদিষ্ট। না জানি কত জ়ীন একই সাথে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদে রত থাকেন, যাদের সকলের ফরিয়াদ আল্লাহ তা’য়ালা শোনেন ও তাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ করেন। মানুষ ও জ়ীন ভিন্ন আল্লাহর আরেকটি সৃষ্টি হল ‘মালায়িকা’ বা ফেরেশতা। তাঁরা সদা সর্বদা আল্লাহর তসবিহ, তাহমিদ ও পবিত্রতা বর্ণনায় নিয়োজিত থাকেন; এইসবও আল্লাহ তা’য়ালা শুনছেন।
জ়ীন, মানুষ ও মালায়িকা ছাড়াও ভূপৃষ্ঠে বসবাসকারী এমন অগণিত মাখলুক় রয়েছে যার সঠিক সংখ্যা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না।6 তারা সকলেই আল্লাহ তা’য়ালার হামদ ও সানা তাহমীদ ও তাকদীসে নিমগ্ন থাকে। এই সবই তিনি শুনতে থাকেন। অনুরূপ সমুদ্রবাসী ও আসমানবাসী অগণিত মাখলুক় সদা সর্বদা তাঁর প্রশংসায় মশগুল থাকে। আল্লাহ তাবারাক ও তা’য়ালার বরকতময় সত্তা তাদের সকলের মধ্য থেকে এক এক করে প্রার্থনা ও মনের কথা শুনতে থাকেন।
জীবিত প্রাণী ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য সকল জড়বস্তু যেমন পাথর, গাছ, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, জমিন, আসমান এবং পাহাড়-পর্বত, এমনকী অণুপরমাণু পর্যন্ত আল্লাহ তা’য়ালার তাসবীহ ও তাহমীদে নিমগ্ন থাকে।7 তার সবই আল্লাহ তা’য়ালা শুনে থাকেন। বলা হয় যে, আমাদের এই পৃথিবী ছাড়াও মহাবিশ্বে আরও অনেক পৃথিবী আছে, সেগুলোতেও বাস করে আল্লাহর অগণিত সৃষ্টি। এই কথা সত্য হলে, আল্লাহ তা’য়ালা নিঃসন্দেহে তাদের কথা-বার্তাও শুনেছেন। চিন্তা করুন, এত অসংখ্য জীব ও জড় সৃষ্টের প্রার্থনা ও আকুতি, তাসবীহ, তাহমীদ ও তাকদীস আল্লাহ তা’য়ালা একই সাথে শ্রবণ করছেন, এবং এই শ্রবণ আল্লাহ তা’য়ালাকে ক্লান্ত করতে পারে না, অন্যান্য কাজ থেকেও বেখেয়াল করতে পারে না যার জন্য মহাবিশ্ব পরিচালনায় কোনরূপ ব্যঘাত ঘটতে পারে। ( سُبْحَـانَ اللّٰهِ وَبِحَمْدِهِ سُبْحَـانَ اللّٰهِ الْعَظِيْـمُ ) — সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল ‘আজীম।8
বাস্তবতা হচ্ছে, আল্লাহ তা’য়ালার একটি গুণ “সামিউন” বা সর্বশ্রোতার অবস্থা এমন যে, তাকে অনুধাবন করা তো দূরের কথা, তার সম্পর্কে কল্পনা করাও সম্ভবপর নয়। এভাবে এক গুণ থেকে আল্লাহ তা’য়ালার অগণিত গুণাবলী, যেমন— ‘মালিকুলমুল্ক’, ‘খ়ালিক়’, ‘রাজ্জাক়’, ‘মুসাওয়ির’, ‘আজীজ’, ‘মুতাকাব্বির’, ‘বাসীর’, ‘খ়াবীর’, ‘আলীম’, ‘হ়াকীম’, ‘রাহীম’, ‘কারীম’, ‘আজীম’, ‘ক়াইয়ূম’, ‘গাফ়ুর’, ‘রাহমান’, ‘কাবীর’, ‘ক়াওয়ী’, ‘মুজীব’, ‘রাক়ীব’, ‘হ়ামীদ’, ‘সামাদ’, ‘ক়াদীর’, ‘আউয়াল’, ‘আখ়ির’, ‘তাওয়াব’, ‘রাউফ’, ‘গানী’, ‘জুলজ়ালালি ওয়াল ইক়রাম’ ইত্যাদির উপর অনুমান করা যাবে। এবার সূরা কাহাফ ও সুরা লুকমানের আলোচিত আয়াত দুটি সম্পর্কে চিন্তা করুন—আল্লাহ রাব্বুল কারীম কী সত্য বলেছেন! আল্লাহ তা’য়ালার এই সমস্ত গুণাবলী বা এর মধ্যে কোন একটির সাথে অন্য কাউকে শরীক করাকে শিরক ফি সিফ়াত বলা হয়।
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
- হুলুল শব্দের অর্থ প্রবেশ করা। একটা বস্তু অন্য আরেকটির মাঝে প্রবেশ করার পর যদি উভয় বস্তু তাদের নিজ সত্তা অবশিষ্ট রেখে বিদ্যমান থাকে তাহলে তাকে হুলুল বলে। অর্থাৎ যে বস্তু কোন কিছুর মাঝে প্রবেশ করেছে সেটিও তার নিজ সত্তা ঠিক রাখবে আবার যার মাঝে প্রবেশ করছে, সেটিও তার নিজ সত্তা অবশিষ্ট রাখবে। বিষয়টিকে আরবীতে হুলুল বলে। আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে হুলুলের আক়ীদা সম্পূর্ণ কুফুরী। যেমন, কেউ যদি বিশ্বাস করে যে আল্লাহ তায়ালা স্থানগতভাবে আসমানে রয়েছেন তাহলে এটি হুলুল হবে। কারণ আসমান একটি মাখলুক বা সৃষ্টি। কোন সৃষ্টির মাঝে আল্লাহর সত্তা প্রবেশ করেছেন বা আছেন এজাতীয় বিশ্বাসই মূলতঃ হুলুল। বাস্তব ক্ষেত্রে হুলুলের একটি উদাহরণ হলো, চিনি ও বালির মিশ্রণ। এ মিশ্রনে চিনি ও বালি নিজ সত্তা অবশিষ্ট রেখে অবস্থান করে থাকে। রসায়নের ভাষায় এধরনের মিশ্রণকে অসমসত্ত্ব মিশ্রণ বা Heterogeneous mix বলে। খ্রিষ্টানরা হযরত ইসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বিশ্বাস রাখে যে, আল্লাহর সত্তা ঈসা আলাইহিস সালামের মাঝে প্রবেশ করেছে। এটিও মূলতঃ হুলুলের আক়ীদা থেকে এসেছে। মোট কথা, কোন সৃষ্টির মাঝে আল্লাহর সত্বা প্রবেশ করেছে, এজাতীয় বিশ্বাস রাখা হলো হুলুল। এই আকিদা নিঃসন্দেহে কুফুরী।
- দেখুন, সত্তাগত তাওহীদ অধ্যায়, মাসয়ালা ৩২।
- আল্লাহ তা’য়ালার ভালবাসা ব্যতীত অন্তরে অন্য অনেক কিছুর ভালবাসা থাকা স্বাভাবিক। যেমন— পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন, ধন-সম্পদ, পদ-মর্যাদা ইত্যাদি। এখানে উদ্দেশ্য হল, এই সকল বস্তুর ভালবাসা যেন আল্লাহর প্রতি ভালবাসার চেয়ে বেশি না হয়। অনুরূপ, আল্লাহর ভয় ব্যতীত অন্তরে অন্য আরও অনেক ভয়ের সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। যেমন—রোগ, মৃত্যু, কাজকারবার, শত্রু ইত্যাদি। কিন্তু যেহেতু এই সকল ভয়ের কারণ বাহ্যিক তাই এতে পতিত হলে শিরক হবে না। তবে বাহ্যিক কোন কারণ ব্যতীত আল্লাহর পরিবর্তে কোন দেব-দেবী, ভূত-প্রেত, জ়ীন বা মৃত বুজুর্গের ভয় মানুষকে মুশরিকে পরিণত করে।
- স্মর্তব্য, মানব চাহিদার বশবর্তী হয়ে পাপ করাকে শিরক বলা হয় না বরং ‘ফিসক’ বলা হয়। যা সৎকর্ম কিংবা তাওবা করার কারণে ক্ষমার্হ হয়ে যায়।
- আসমাউল হুসনা বা সুন্দরতম নাম সমূহের একটি হল, আস-সামী‘ তথা সর্বশ্রোতা, যিনি ভাষার বিভিন্নতা সত্ত্বেও সকলের ভাষা ও তাদের অভাব বুঝতে পারেন। তাঁর কাছে গোপন হল প্রকাশ্যের মতই, যেমনিভাবে দূরত্ব তাঁর কাছে নিকটবর্তীর মত।
- ( وَمَا يَعْلَمُ جُنُودَ رَبِّكَ إِلَّا هُوَ ) ٣١ — তোমার প্রতিপালকের বাহিনী (কারা এবং এর স্যখ্যা কত সে) সম্পর্কে তিনি ছাড়া কেউ জানে না।— সূরা মুদাস্সির, আয়াত ৩১।
- تُسَبِّحُ لَهُ ٱلسَّمَـٰوَٰتُ ٱلسَّبْعُ وَٱلْأَرْضُ وَمَن فِيهِنَّ ۚ وَإِن مِّن شَىْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِۦ وَلَـٰكِن لَّا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ ۗ إِنَّهُۥ كَانَ حَلِيمًا غَفُورًۭا ٤٤ — সাত আসমান, জমীন আর এগুলোর মাঝে যা আছে সব কিছুই তাঁর মহিমা ঘোষণা করে। এমন কোন জিনিসই নেই যা তাঁর প্রশংসাসহ পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না। কিন্তু তোমরা বুঝতে পার না কিভাবে তারা তাঁর মহিমা ঘোষণা করে। তিনি পরম সহিষ্ণু, বড়ই ক্ষমাপরায়ণ। — সূরা আল-ইসরা (বনী ইসরাইল), আয়াত ৪৪।
- এক মুহূর্তের জন্য ভাবুন, মানুষের শ্রবণশক্তি বিষয়ে জানা আছে যে, কোন মানুষ একই সাথে দুই জনের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে সক্ষম নয়। যে ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় একসাথে দুই জনের কথা শুনতে সক্ষম নন, মৃত্যুর পরে তিনি কী করে শতসহস্র মানুষের আর্তনাদ শুনতে পাবেন?