আক়ীদা তাওহীদ মানবজাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ রহমত
ক়ুরআন মাজীদে আল্লাহ তা’য়ালা ‘কালিমায়ে ত়াইয়্যেবা’কে এমন একটি বৃক্ষ হিসেবে উদাহরণ দিয়েছেন, যার শিকড় মাটির গহীনে আর শাখা-প্রশাখা আকাশের উচ্চতায় পৌঁছেছে এবং যা ক্রমাগত উৎকৃষ্ট ফল ও ফুল দিচ্ছে। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,—
( أَلَمْ تَرَ كَيْفَ ضَرَبَ ٱللَّهُ مَثَلًۭا كَلِمَةًۭ طَيِّبَةًۭ كَشَجَرَةٍۢ طَيِّبَةٍ أَصْلُهَا ثَابِتٌۭ وَفَرْعُهَا فِى ٱلسَّمَآءِ ٢٤ تُؤْتِىٓ أُكُلَهَا كُلَّ حِينٍۭ بِإِذْنِ رَبِّهَا ۗ وَيَضْرِبُ ٱللَّهُ ٱلْأَمْثَالَ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ ٢٥ )
“(২৪) আপনি কি লক্ষ্য করেন না আল্লাহ্ কিভাবে উপমা দিয়ে থাকেন? সৎবাক্যের (কালিমা তাইয়েবা) তুলনা উৎকৃষ্ট গাছ যার মূল সুদৃঢ় ও যার শাখা-প্রশাখা উপরে বিস্তৃত; (২৫) তার প্রতিপালকের হুকুমে তা সব সময় ফল দান করে। মানুষদের জন্য আল্লাহ দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন যাতে তারা শিক্ষা গ্রহণ করে।” —সূরা ইবরাহীম, আয়াত ২৪-২৫।
কালিমা তাইয়্যেবার এই উদাহরণ থেকে নিন্মোক্ত তিনটি বিষয় স্পষ্ট হয়—
এক. এই বৃক্ষের ভিত্তি অত্যন্ত মজবুত, এমনকি কালের প্রচণ্ড ঝড়, ঝঞ্ঝা ও ভূকম্পও এই বৃক্ষকে উপড়ে ফেলতে পারে না।
দুই. কালিমা তাইয়্যেবা বৃক্ষ বৃদ্ধির দিক থেকেও অতুলনীয়। এটি এমন একটি সার্বজনীন সত্য যা মহাবিশ্বের প্রতিটি অণু পরমাণু দ্বারা সমর্থিত, এর পথে কোন বাধা নেই, তাই এটির দৈহিক বৃদ্ধি আকাশ ছুঁয়েছে। এক হাদীসে রাসুল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম এই বিষয়টি স্পষ্ট করে বলেছেন,—‘যখন কোন মানুষ একাগ্রচিত্তে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ—আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই বলে স্বীকার করেন, তখন তার জন্য আসমানের দরজা সমূহ খুলে দেওয়া হয় যতক্ষণ না তিনি আল্লাহর আরশের দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু এর জন্য শর্ত হল কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হবে। (তিরমিজী)।
তিন. কালিমা তাইয়্যেবার বৃক্ষ তার ফল ও ফলাফলের দিক থেকে এতটাই বিশ্বাসযোগ্য বরকতময় ও বহুবিধ উপকারী যে, এতে কখনও বসন্ত আসে না। এর বরকতের ধারাবাহিকতা কখনও বিঘ্নিত হয় না। বরং যে জমিতে (অন্তরে) তা শিকড় গেড়েছে তাকে সর্বদা সর্বোত্তম ফুলে-ফলে ভরে দেয়। নিঃসন্দেহে, ‘কালিমা তাওহীদে’ মানুষের ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক জীবনের জন্য অপরিসীম ফল ও উপকারিতা রয়েছে এবং এই আক়ীদা— বিশ্বাস মানবজাতির জন্য মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ রহমত। নিচে আমরা আক়ীদায়ে তাওহীদের কিছু নেয়ামত উল্লেখ করছি।
দৃঢ়তা ও অটল থাকা
তাগুতশক্তির মুক়াবেলায় ঈমানদারদের দৃঢ়তা, স্থিরতা ও অটল থাকার কতিপয় কাহিনী শুনুন—
ক) বিলাল রাদি আল্লাহু তা’য়ালা আনহু ছিলেন উমাইয়া ইবনু খালাফ় জুমাহীর ক্রীতদাস। দ্বিপ্রহরের রোদ যখন উত্তপ্ত হত, তখন মক্কার কাফিরেরা পাথর ও কঙ্করময় ভূমিতে তাঁকে চিৎকরে শুইয়ে তাঁর বুকের উপর ভারী পাথর চাপা দিয়ে বলত, ‘আল্লাহর কসম, তুমি মৃত্যু পর্যন্ত এখানে পড়ে থাকবে অথবা মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের) সাথে কুফুরি করবে।’ বিলাল এমতাবস্থায় থেকেও বলতেন, ‘আহাদ, আহাদ’—আল্লাহ এক, আল্লাহ এক।
খ) খাব্বাব ইবনু আরত রাদি আল্লাহু তা’য়ালা আনহু খুযাআ গোত্রের উম্মি আনমার নাম্নী এক মহিলার ক্রীতদাস ছিলেন। অনেক সময় তাঁকে জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর শুইয়ে বুকে পাথর চাপা দেওয়া হত যাতে তিনি উঠতে না পারেন। কিন্তু ইসলামের প্রতি স্বীকৃতি ও সন্তুষ্টির পর এমন নিষ্ঠুরতা ও নিপীড়ন সত্ত্বেও তিনি তাঁর ধর্ম ও বিশ্বাসে অটল ছিলেন।
গ) সুমাইয়া বিনতে খাব্বাব রাদি আল্লাহু আনহা ছিলেন দুর্বল ও বৃদ্ধা। তাঁকে লোহার বর্ম পরিয়ে উত্তপ্ত রোদে পাথুরে ভূমিতে শুইয়ে দেওয়া হত এবং বলা হত, ‘মুহাম্মদের ধর্মকে অস্বীকার করো।’ সুমাইয়া রাদি আল্লাহু আনহা এমন অত্যাচারের ফলে স্বীয় প্রভূর নিকট নিজের প্রাণ সঁপে দিলেন কিন্তু সত্যপথ থেকে ক্ষণিকের জন্যও টলেননি।
ঘ) হাবীব ইবনু যায়িদ রাদি আল্লাহু তা’য়ালা আনহু সফরের সময় মিথ্যা নবুওয়াতের দাবিদার মুসায়লামা কাজ্জাবের হাতে ধরা পড়েন। মুসায়লামা কাজ্জাব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের সাহাবী হাবীব রাদি আল্লাহু তা’য়ালা আনহুর দেহের একটি একটি জোড়া কাটছিল আর বলছিল, ‘আমাকে রাসূল স্বীকার করো।’ তবু হাবীব রাদি আল্লাহু তা’য়ালা আনহু তাকে অস্বীকার করছিলেন। এভাবে তার দেহকে টুকরো টুকরো করা হল, কিন্তু ধৈর্য ও স্থিতিশীল তার মর্দে মুজাহিদ পাহাড়ের মত দৃঢ়তার সহিত স্বীয় ঈমানের প্রতি অটল ছিলেন।
ইসলামের ইতিহাসের এই কয়েকটি ঘটনা উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করা হল। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, ইসলামের ইতিহাসের কোন যুগই এই ধরনের নিষ্ঠুর ঘটনা থেকে মুক্ত নয়। ইতিহাসের শিক্ষার্থীদের জন্য এই প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, ঈমানদারেরা এইরূপ বর্ণনাতীত ও ধারণাতীত অত্যাচারের মুকাবেলায় যে আশ্চর্য স্থিরতা ও দৃঢ়তার প্রমাণ উপস্থান করতে পেরেছেন, তার আসল রহস্য কী ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালা কুরআন মাজীদে দিয়েছেন—
( يُثَبِّتُ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ بِٱلْقَوْلِ ٱلثَّابِتِ فِى ٱلْحَيَوٰةِ ٱلدُّنْيَا وَفِى ٱلْـَٔاخِرَةِ ۖ وَيُضِلُّ ٱللَّهُ ٱلظَّـٰلِمِينَ ۚ وَيَفْعَلُ ٱللَّهُ مَا يَشَآءُ ) ٢٧
“যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে আল্লাহ সুদৃঢ় বাণী (কালিমা তাইয়্যেবা)-র অবলম্বন দ্বারা দুনিয়ার জীবনে ও আখেরাতে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবেন আর যালিমদেরকে আল্লাহ বিভ্রান্তিতে রাখবেন। এবং আল্লাহ যা করতে চান তাই করেন।” —সূরা ইবরাহীম, আয়াত ২৭।
এই যেন আক়ীদায়ে তাওহীদেরই ফজিলত। ভ্রান্ত বিশ্বাস ও চিন্তার ঝড় হোক বা দুঃখ-বেদনার আক্রমণ হোক; স্বৈরাচার ও অত্যাচারী শাসকের নিপীড়ন হোক বা তাগুতের অত্যাচার; কোন কিছুই আহলে তাওহীদের দৃঢ়তা হতে পদস্খলিত করতে পারে না।
আলোচিত আয়াতে দুনিয়ার পাশাপাশি আখিরাতেও আহলে তাওহীদকে দৃঢ়তার সুখবর দেওয়া হয়েছে। এই স্থলে আখিরাত অর্থ কবর। যেমনটি বুখারী শরীফের একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেছেন,— ‘যখন মু’মিনকে কবরে বসানো হবে, তখন (প্রশ্নোত্তরের জন্য) তাদের কাছে ফেরেশতা পাঠানো হবে। তখন মু’মিন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র সাক্ষ্য প্রদান করবেন। এটাই আল্লাহর কালাম ( يُثَبِّتُ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ … … … ) এর উদ্দেশ্য। —(বুখারী)।
মোদ্দাকথা, কবরে মুনকার নকীরের প্রশ্নের উত্তরে দৃঢ়তাও এই তাওহীদি আক়ীদার বরকতেই হাসিল হবে।