ইসলামী বিপ্লব ও আক়ীদায়ে তাওহীদ
‘বিপ্লব’ শব্দের মধ্যে একটা প্রচণ্ড আবেদন ও আকর্ষণ আছে, এ কারণেই বিশ্বের যেখানেই ইসলামী বিপ্লবের স্লোগান শোনা যায়, ইসলাম প্রেমীদের উৎসুক দৃষ্টি তৎক্ষণাৎ সে দিকে ফিরে যায়। বর্তমানে প্রিয় মাতৃভূমির সর্বত্র ‘ইসলামী বিপ্লব’, ‘মুহাম্মদী বিপ্লব’, ‘নিজামে মোস্তফা’, ‘শরীয়াহ আইন ও খিলাফত ব্যবস্থা বাস্তবায়নে’র মত দাবী ও শ্লোগান নিয়ে বিভিন্ন মত ও বিশ্বাসের অগণিত দল, উপদল ও গোষ্ঠী কাজ করছে। তাই কিতাব ও সুন্নাহর আলোকে দেখা একান্ত প্রয়োজন যে, ‘ইসলামী বিপ্লব কী ও তার প্রধান বিষয়গুলো কী কী?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম নবুয়ত প্রাপ্তির পর তের বছর মক্কা মুকার্রমায় অবস্থান করেছিলেন, এই পুরো সময়ে তাঁর সমস্ত দাওয়াত শুধু এক কালিমার উপরই সীমাবদ্ধ ছিল— قُوْلُـوْا لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللّٰهُ تُفْلِحُوا অর্থাৎ, ‘লোক সকল, লা ইলাহা ইল্লাহ বল এবং সফলকাম হও’। এর ব্যতিরেক, না ছিল সালাত সিয়ামের মাসায়েল, না ছিল হজ় যাকাতের হুকুম, না ছিল জীবনের অন্যান্য বিষয়ের বিস্তারিত নির্দেশনা। কেবলমাত্র এই তাওহীদি আক়ীদার দাওয়াতই ছিল যাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম ঘরে ঘরে, অলিতে-গলিতে, মহল্লায় মহল্লায় পৌঁছাতে ব্রতী ছিলেন। একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম হাত়ীম বা বায়তুল্লাহর ছাদবিহীন অংশে সালাত আদায় করছিলেন, উকবা ইবনে আবী মুঈত এসে তাঁর গলায় কাপড় পেচিয়ে প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে তাঁকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করার চেষ্টা করতে লাগল। তা দেখে আবু বাকার রাদি আল্লাহু তা’য়ালা আনহু ছুটে আসেন এবং উকবাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন এবং জিজ্ঞাসাকরলেন,— اَتَقْتُلُوْنَ رَجُلاً أَن يَّقُوْلُ رَبِّيَ اللهُ অর্থাৎ, ‘তোমরা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে কি এই জন্য হত্যা করতে চাও যে, তিনি বলেন, আল্লাহ আমার প্রভূ?’ আবু বকর সিদ্দিক রাদি আল্লাহু তা’য়ালা আনহুর কথা থেকে এটা খুবই স্পষ্ট যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের দাওয়াতের ফলে যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছিল তার মূল কারণ ছিল তাওহীদে বিশ্বাস।
একবার মক্কার কুরাইশরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের কাছে বোঝাপড়া ও সমঝোতার উদ্দেশ্যে একটি প্রস্তাব দেয় যে, আমরা এক বছর আপনার মাবুদের ইবাদত করব এবং আপনি এক বছর আমাদের মাবুদদের ইবাদত করবেন। এই প্রস্তাবের জবাবে আল্লাহ পুরো সূরা কাফরুন নাযিল করলেন।
( قُلْ يَـٰٓأَيُّهَا ٱلْكَـٰفِرُونَ ١ لَآ أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ ٢ وَلَآ أَنتُمْ عَـٰبِدُونَ مَآ أَعْبُدُ ٣ وَلَآ أَنَا۠ عَابِدٌۭ مَّا عَبَدتُّمْ ٤ وَلَآ أَنتُمْ عَـٰبِدُونَ مَآ أَعْبُدُ ٥ لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِىَ دِينِ ٦ )
“১. (হে নবী, আপনি) বলুন, ‘হে কাফিররা! ২. তোমরা যার ‘ইবাদাত কর, আমি তার ‘ইবাদাত করি না; ৩. আর আমি যাঁর ‘ইবাদাত করি তোমরা তাঁর ‘ইবাদাতকারী নও; ৪. আর আমি তার ‘ইবাদাতকারী নই তোমরা যার ‘ইবাদাত করে থাক; ৫. আর আমি যার ‘ইবাদাত করি তোমরা তার ‘ইবাদাতকারী নও; ৬. তোমাদের দীন তোমাদের, আর আমার দ্বীন আমার।” —সূরা কাফ়িরূন।
মক্কার কাফেরদের উপস্থাপনা এবং তার জবাব উভয়ই স্পষ্ট প্রমাণ যে, উভয় পক্ষের মধ্যে পার্থক্যের মূল বিষয় ছিল কেবল তাওহীদের বিশ্বাস, যার উপর স্পষ্টভাবে তাদের বুঝাপড়া এবং সমঝোতাকে অস্বীকার করা হয়েছিল।
আরেক দিন মক্কার কুরাইশদের একটি প্রতিনিধি দল জনাব আবু তালিবের নিকট এসেছিল; তারা বলল, ‘আপনি আপনার ভাতিজাকে বলুন যে, তিনি আমাদেরকে আমাদের ধর্মের উপর ছেড়ে দিন, আমরাও তাকে তার ধর্মের উপর ছেড়ে দিব।’ রাসুল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম এই কথা শুনে বললেন, ‘আমি যদি আপনাদের সামনে এমন কিছু উপস্থাপন করি যা দেখে আপনারা বিশ্বাসী হবেন, তারপর আপনারা আরবের বাদশাহ হয়ে যাবেন এবং অন্যান্য জাতিগুলো আপনাদের শাসনাধীনে চলে আসবে, তাহলে আপনাদের মতামত কী হবে?’ আবু জাহিল বললেন, ‘আচ্ছা, বলুন, এমন কী কথা আছে? আপনার পিতার কসম! এমন একটি কেন, দশটি কথা বললেও আমরা মেনে নিতে প্রস্তুত আছি।’ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বললেন, ‘আপনারা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলুন এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে যার ইবাদত করছেন তার সবাইকে ত্যাগ করুন।’ অতঃপর মুশরিকেরা বলল, ‘হে মুহাম্মদ! আপনি তো চাচ্ছেন সকল মাবুদগণের স্থলে এক মাবুদ প্রতিষ্ঠা করতে, সত্যিই, আপনার উদ্দেশ্য বড়ই অদ্ভূত।’
চিন্তা করুন! কুরাইশ সর্দারদের সাথে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের পরামর্শে যে কথা প্রমাণিত হয়, তা হল, কেবল এক মাবুদের স্বীকৃতি এবং বাকী সকল মাবুদকে অস্বীকার করা। এই জন্য কুরাইশ সর্দারগণ প্রস্তুত ছিলেন না, ফলে পারস্পরিক বৈরিতা ও সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে।
নিঃসন্দেহে, মক্কার জীবনে সালাত, সিয়াম, হজ়, যাকাত, হালাল ও হারাম, অপরাধের সাজা, পারিবারিক মাসায়েল ও অন্যান্য বিধানাবলী অবতীর্ণ হয়নি। কিন্তু এই সত্য সবার জানা যে, মদিনার জীবনে এই সব বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পরেও দ্বিপাক্ষিক সংঘর্ষের মূল কারণ মাসায়েল ও বিধানাবলী নয় বরং ছিল আক়াইদে তাওহীদ।
ইসলামের ইতিহাসে সর্ব প্রথম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হল, ‘বদরের যুদ্ধ’। যখন তীব্র যুদ্ধ চলছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম আল্লাহ তা’য়ালার সামনে তখন দুই হাত প্রসারিত করে যে দুআ করেছিলেন, তার ভাষা প্রণিধান যোগ্য। ‘হে আল্লাহ! আজ যদি এই দলটি ধ্বংস হয়ে যায় তবে আপনার আর কখনও ইবাদত হবে না।’ এই শব্দগুলোর উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট যে, মক্কার কুরাইশ ও মুসলিমদের এই সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটেছিল কেবলমাত্র এই কারণে যে, ইবাদত ও বন্দেগী একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে হওয়া চাই।
মুশরিক ও মুসলমানদের মধ্যে আরেকটি বড় সশস্ত্র সংঘর্ষ, ‘উহুদের যুদ্ধ’ শেষে আবু সুফিয়ান উহুদ পাহাড়ে উপস্থিত হয়ে উচ্চস্বরে বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে কি মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম) আছেন?’ মুসলমানদের কাছ থেকে কোন উত্তর না পেলে তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কি আবু কাহাফার ছেলে (আবু বকর সিদ্দীক রাদি আল্লাহু তা’য়ালা আনহু) আছেন?’ এরপরও সকলে নীরব থাকায় তিনি বলতে লাগলেন, ‘তোমাদের মধ্যে উমর (রাদি আল্লাহু তা’য়ালা আনহু) আছেন কি?’ রাসুল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম সকল সাহাবায়ে কিরাম রাদি আল্লাহু তা’য়ালা আনহুকে জবাব দিতে নিষেধ করেছিলেন। অতএব, আবু সুফিয়ান বললেন, ‘চল, এই তিন জন থেকে পরিত্রাণ পাওয়া গেল।’ এবং শ্লোগান উচ্চারণ করলেন, ‘أَغْلُ هُبــَـلً’ অর্থাৎ (আমাদের মাবুদ) হুবালের নাম বুলন্দ হোক। নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের নির্দেশে সাহাবায়ে কিরাম জবাব দিলেন, ‘أَللّٰهُ أَغْلَــى وَ أَجَــلٌ’ অর্থাৎ, আল্লাহর নাম সুউচ্চ ও মহিমান্বিত। আবু সুফিয়ান পুনরায় বললেন, ‘لَنَا عُزّى وَلَا عُزّى لَكُمْ’ অর্থাৎ, আমাদের নিকট (দেবী মূর্তি) উজ্জা আছে তোমাদের নিকট উজ্জা নেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের নির্দেশে সাহাবা রিদওয়ানাল্লাহু আলাইহি আজমাইন জবাব দিলেন, ‘أَللّٰهُ مَوْلاَنَـا وَ لاَ مَوْلَـى لَكُمْ’ অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালা আমাদের অভিভাবক এবং আপনার কোন অভিভাবক নেই।
উহুদের যুদ্ধের শেষে দ্বিপাক্ষিক এই সংলাপ স্পষ্ট সাক্ষ্য দেয় যে, ইসলামী দাওয়াতের শুরুতে উপহাস ও অস্বীকারের মাধ্যমে বিরোধিতার মূল কারণ ছিল তাওহীদে বিশ্বাস। এই বিরোধিতা চলতে থাকে এবং নিপীড়নের সর্বাত্মক ঝড়ের রূপ নেয়, তখনও তার কারণ ছিল তাওহীদে বিশ্বাস। আর যখন উভয় দলের মধ্যে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে ময়দান উত্তপ্ত হয়ে ওঠেছিল, তখনও তার আসল কারণ ছিল তাওহীদে বিশ্বাস।
বৈরিতা, ষড়যন্ত্র ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দীর্ঘ সফর কেটে ইতিহাস এক নতুন মোড় নিল। অষ্টম হিজরীতে রাসুল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করলেন। একুশ বছরের নিরন্তর সংগ্রাম ও প্রচেষ্টার পর এই বিপ্লবের ভিত্তি স্থাপনের সুযোগ পেলেন রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম, যার জন্য তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন।
বিবেচ্য বিষয় হল, শাসন ক্ষমতা লাভের পর রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম কোন রূপ সমীচিনতা ও প্রজ্ঞার কথা বিবেচনা না করে অনতিবিলম্বে যে পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছিলেন তা কী ছিল? নিম্নে তার একটি বর্ণনা দেওয়া গেল—
প্রথমত, মসজিদুল হারামে প্রবেশ করে বায়তুল্লাহ শরীফের আশেপাশে এবং ছাদে থাকা তিনশত ষাটটি মূর্তিকে তাঁর বরকতময় হাতে ভেঙ্গে ফেলেন।
দ্বিতীয়ত, বায়তুল্লাহ শরীফের ভিতরে ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ও ইসমাইল আলাইহিস সালামের ছবি আঁকা ছিল। সে গুলো অপসারণের নির্দেশ দিলেন। ভিতরে কাঠের তৈরি একটি কবুতরী ছিল, তিনি স্বহস্তে টুকরো টুকরো করে ফেললেন।
তৃতীয়ত, তিনি বিলাল রাদি আল্লাহু তা’য়ালা আনহুকে বায়তুল্লাহ শরীফের ছাদে উঠে উচ্চস্বরে আল্লাহর তাকবীর ও তাওহীদের দাওয়াত (আযান) ঘোষণার নির্দেশ দেন।
স্মর্তব্য যে, বায়তুল্লাহ শরীফের ছাদবিহীন অংশ, হাতিমের প্রাচীরটি এক মিটারেরও বেশি উঁচু, মসজিদুল-হারামের অভ্যন্তরে উপস্থিত জনসাধারণকে শোনানোর জন্য এতটুকু উঁচু প্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে আযান দেওয়াই যথেষ্ট ছিল, তবু বায়তুল্লাহ শরীফের আনুমানিক ১৬ মিটার উঁচু ভবনের ছাদ (যাতে আরোহণের বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছিল) থেকে তাওহীদের ধ্বনি উচ্চারণের নির্দেশ ছিল সত্যিই একটি স্পষ্ট ও বাস্তব সিদ্ধান্ত। তাতে দীর্ঘ একুশ বছর যাবৎ উভয় পক্ষের মধ্যে বিদ্যমান মুকদ্দমার মীমাংসা হয়ে গেল। আর এখন থেকে সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত হয়ে গেল যে, মহাবিশ্বের উপর সার্বভৌমত্ব এবং শাসনের অধিকার একমাত্র আল্লাহর; গৌরব ও মহিমা একমাত্র তাঁরই; আনুগত্য ও দাসত্ব একমাত্র তাঁরই জন্যে; তিনিই একমাত্র ইবাদত ও প্রার্থনার যোগ্য, তিনিই একমাত্র স্রষ্টা এবং অসুবিধা দূরকারী; কোন দেব বা দেবী, ফেরেশতা বা জ়ীন, নবী বা ওলী— তাঁর গুণাবলী, তাঁর ক্ষমতা ও অধিকারে পরমাণু পরিমাণ অধিকার রাখে না।
চতুর্থত, মক্কায় অবস্থানকালে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছিলেন যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন তার ঘরে কোনও মূর্তি না রাখে, বরং তা ভেঙে দেয়।
পঞ্চমত, মক্কা বিজয়ের পর অধিকাংশ আরব গোত্র আত্মসমর্পণ করেছিল, আরব উপদ্বীপের নেতৃত্ব রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামে হাতে চলে এসেছিল, তাই সেখানে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনি ইবাদত, বিবাহ ও তালাক, হালাল ও হারাম, মৃত্যুপণ ও শাস্তির বিধানাবলী প্রয়োগ করেছিলেন। সমগ্র আরব উপদ্বীপের যেখানেই শিরকের কেন্দ্র স্থাপিত ছিল, রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম তাঁর সাহাবায়ে কেরাম রিদওয়ানাল্লাহু আলাইহিম আজমাইনকে বিভিন্ন দলে সেগুলো ধ্বংস করার জন্য প্রেরণ করেছিলেন।
- মক্কার কুরাইশ ও কেননা গোত্রের মূর্তি ‘উজ্জা’র আস্তানা ধূলিসাৎ করার জন্যে ত্রিশ জন সঙ্গীসহ খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদি আল্লাহু আনহুমকে নাখলা (স্থানের নাম) পাঠিয়েছিলেন।
- বনু হাজাইল গোত্রের মূর্তি সুওয়ার মন্দির ধ্বংসের জন্য আমর ইবনু আস রাদি আল্লাহু আনুহুকে পাঠিয়েছিলেন।
- আউস, খাযরাজ ও গাস্সাল গোত্রের মূর্তি ‘মানাতে’র মন্দির ধ্বংস করার জন্য তিনি সাআদ ইবনু যাওয়াদ আশহালী রাদি আল্লাহু আনহুকে বিশ জন সঙ্গীসহ ‘কাদাদ’ পাঠিয়েছিলেন।
- ত়াই গোত্রের মূর্তি কুল্লাসের মন্দির ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আলী ইবুন আবি তালিব রাদি আল্লাহু আনহুকে দেড়শত সঙ্গীসহ ইয়েমেন পাঠিয়েছিলেন।
- ইসলাম গ্রহণের উদ্দেশ্যে ত়ায়িফ় থেকে সাকীফ় এলে তাদের মূর্তি লাতকে ধ্বংস করার জন্য প্রতিনিধি দলের সাথে খালিদ ইবনু ওয়ালিদ রাদি আল্লাহু আনহুকে পাঠিয়েছিলেন।
- আলী রাদি আল্লাহু আনহুকে সমগ্র আরব উপদ্বীপে এই নির্দেশ দিয়ে অভিযানে পাঠানো হয়েছিল যে, যেখানে কোন প্রতিমা দেখবে তা মিটিয়ে দিবে এবং যেখানে কোন উঁচু কবর দেখবে তা সমান করে দিবে।
উপরে উল্লিখিত পদক্ষেপগুলি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, মক্কী জীবন বা মাদানী যাই হোক না কেন আপনার সমস্ত সংগ্রামের কেন্দ্র ও অক্ষ ছিল তাওহীদের আক়ীদা বাস্তবায়ন এবং শিরকের মূলোৎপাটন। ইসলামী ইবাদতের দিকে দৃষ্টি দিলে বোঝা যায় যে, সকল ইবাদতের আত্মা হল তাওহীদের আক়ীদা। প্রত্যেক সালাতের আগে দিনে পাঁচবার আযান দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে, যা তাকবীর সুন্দর বাণী এবং তাওহীদের পুনরাবৃত্ত বাণীর অত্যন্ত সুন্দর ও কার্যকরী সঙ্কলন। ওযু শেষে ‘কালিমা তাওহীদ’ পাঠ করলে জান্নাত লাভের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। সালাতের শুরুতে ও মধ্যে বারবার তাকবীর বলা হয়। প্রত্যেক রাকাতের জন্য সূরা আল ফাতিহা পাঠ ফরজ করা হয়েছে, যা একত্ববাদের পূর্ণ দাওয়াত সম্বলিত একটি সূরা। রুকু ও সিজদায় বারবার আল্লাহর মহিমা ও সমুচ্চতা পুনরাবৃত্তি ও স্বীকার করা হয় এবং আক়ীদা তাওহীদের সাক্ষ্য দেওয়া হয়। যেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমগ্র সালাতই তাওহীদের বিশ্বাসের শিক্ষা ও স্মরণ নিয়ে গঠিত।
তাওহীদের কেন্দ্র ‘বায়তুল্লাহ’ শরীফের সাথে সম্পৃক্ত বিশেষ ইবাদত হজ় বা উমরার দিকে দৃষ্টিপ্রদান করুন, ইহরাম বাঁধার সাথে সাথেই আক়ীদায়ে তাওহীদের স্বীকৃতি ও শিরকের অস্বীকৃতি সমৃদ্ধ তালবিয়া— لَبَّيْكَ أَللّٰهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ لاَ شَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكَ إِنَّ الْحَمْدَ وَ النِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لاَ شَرِيْكَ لَكَ — (আমি উপস্থিত হয়েছি, ইয়া আল্লাহ! আমি উপস্থিত হয়েছি; আপনার কোন শরীক নেই, আমি আপনার দরবারে উপস্থিত হয়েছি; সমস্ত প্রশংসা ও সমস্ত অনুগ্রহ আপনার জন্য এবং আপনি সব কিছুর অধিকারী, আপনার কোন শরীক নেই।)—পাঠ করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। মিনা, মুযদালিফা, আরাফাত প্রত্যেক জায়গায় আল্লাহ তা’য়ালার তাওহীদ (একত্ববাদ), তাকবীর, তাহলীল, তাক়দীস ও তাহ়মীদ সমৃদ্ধ কালিমা ক্রমাগত পাঠ করতে থাকাকে হজ়ে মাবরুর বা কবুল হজ় বলা হয়ে থাকে। যেন মুসলমানদের সমস্ত ইবাদতই তাওহীদের বিশ্বাস মজবুত করার এক মহান প্রশিক্ষণ।
রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম স্বীয় উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে উম্মতদের যেভাবে ধাপে ধাপে আক়ীদায়ে তাওহীদ রক্ষার শিক্ষা দিয়েছে তা মাথায় রাখা খুবই জরুরি। কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করছি—
কথোপকথনের সময় একব্যক্তি বললেন,— ‘যা আল্লাহ চান আর যা আপনি চান।’ রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বললেন, — ‘তুমি কি আমাকে আল্লাহ শরীক বানিয়ে ফেললে?’ —মুসনাদে আহমদ।
এক ব্যক্তি রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের নিকট বৃষ্টির জন্য দোয়া করতে বললেন এবং বললেন, ‘আমরা আল্লাহ তা’য়ালাকে আপনার কাছে এবং আপনাকে আল্লাহ তা’য়ালার কাছে সুপারিশকারী করছি।’ এই কথা শুনে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারার রঙ পরিবর্তন হতে লাগল এবং তিনি বললেন, ‘হায়, তুমি জানো না আল্লাহর মহিমা কত উঁচু, তাঁকে কারও সামনে সুপারিশকারী করা যায় না।’ —আবু দাউদ।
মুনাফিকের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য কয়েকজন সাহাবী রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের নিকট ফরিয়াদ করতে আসেন, তখন রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বললেন, ‘আমার কাছে ফরিয়াদ করা ঠিক হবে না। ফরিয়াদ তো শুধুমাত্র আল্লাহরই কাছে করতে হবে।’ —ত়াবরানী।
দশমহিজরীতে রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের পুত্র ইবরাহীম রাদি আল্লাহু আনহুর ইন্তিকাল হয়েছিল। ঘটনাক্রমে সেদিন সূর্য গ্রহণ হয়েছিল। কিছুলোক বলাবলি করছিল, ইবরাহীমের ইন্তিকালের কারণে সূর্যগ্রহণ হয়েছে। তখন রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বললেন, হে লোকসকল! সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর নিদর্শন সমূহের মধ্যে দুটি নিদর্শন মাত্র। সুতরাং কারও জন্ম ও মৃত্যুর কারণে তাদের গ্রহণ লাগে না। অতএব, যখন গ্রহণ হয়, তাহলে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য করো এবং গ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সালাত আদায় করতে থাক।—সহীহ মুসলিম।
এই কথার মাধ্যমে রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বিশ্বব্যবস্থায় কোন নবী, ওলি বা বুজুর্গ ব্যক্তি প্রভাব বিস্তার করতে পারে কিংবা মহাবিশ্ব পরিচালনায় আল্লাহ তা’য়ালা ব্যতীত অন্য কারো হস্তক্ষেপ থাকতে পারে এমন মুশরিকানা আক়ীদার শিকড় কেটে দিলেন।
একদা, রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম তাঁর সাহাবীদের উপদেশ দিয়েছিলেন,— ‘আমার প্রশংসায় এমন বাড়াবাড়ি করো না, যেমন খৃষ্টানেরা ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, আমি একজন বান্দা। তাই, আমাকে আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল বলুন।’ —বুখারী ও মুসলিম। একটি হাদীসে বলা হয়েছে, সর্বোত্তম যিকির হচ্ছে— لَا إِلَٰهَ إِلَّا اللّٰهُ (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ)। সর্বোত্তম যিকিরে مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللّٰهُ (মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ) কথাটা নেই। রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম উম্মতদের শিখিয়েছেন যে, আল্লাহর একত্ববাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বে অন্য কেউ তো দূরের কথা, নবী পর্যন্ত অংশীদার হতে পারেন না।
অবশেষে রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের পবিত্র জীবনের ইন্তেকালের পূর্বের অসুস্থতার দিনগুলোর দিকে লক্ষ্য করুন। অসুস্থতার দিনগুলোতে রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম মুসলমানদেরকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তার গুরুত্ব বোঝানোর অপেক্ষা রাখে না। মৃত্যুর পাঁচদিন পূর্বে জ্বর থেকে একটু স্বস্তি পেয়ে তিনি মসজিদে নববীতে তাশরীফ আনলেন। তাঁর মাথায় একটি কাপড় বাধাছিল। তিনি মিম্বরে উপস্থিত হয়ে বক্তৃতা দিলেন। আল্লাহর প্রশংসা করার পর বললেন, ‘ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের প্রতি আল্লাহর লানত। তারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদ বানিয়ে ফেলেছে।’ —সহীহ বুখারী।
অসুস্থাবস্থায় উম্মতকে আরেকটি উপদেশ দান করেছেন তা হল, তোমরা আমার কবরকে মূর্তিতে পরিণত করো না, যাকে পূজা করা হবে।’ —মুয়াত্তা ইমাম মালিক। ওফ়াতের দিন তাঁর সামনে একটি পানির পাত্র রাখা হল, তিনি দুহাত পানিতে ভিজিয়ে চেহারা মুবারক মুছলেন। এবং বললেন,— ‘لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ إِنَّ لِلْمَوْتِ سَكَراتٌ’ অর্থাৎ, আল্লাহ তা’য়ালা ব্যতীত অন্যকোন ইলাহ নেই, মৃত্যু বড়ই কষ্টকর। —সহীহ বুখারী। এই কথা বলতে বলতে পবিত্র জীবনের শেষকথা — أَللّٰهُـمَّ اغْفِرْلِـىْ وَارْحَمْنِـىْ وَأَلْحِقْنِـىْ بِـالرَّفِيْقِ অর্থাৎ, ‘হে আল্লাহ, আমাকে ক্ষমা করুন, আমায় দয়া করুন এবং আমাকে সুমহান রফীকের সাথে মিলিত করুন।’ তিনবার এই কথাগুলো বলেন এবং রফীকে ’আলার নিকট পৌঁছে যান।1 অর্থাৎ, রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম জীবনের শেষ কথাটিও তাওহীদ সমৃদ্ধ ছিল।
সিরাতে তাইয়্যেবার এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী স্পষ্টভাবে ইসলামী বিপ্লবের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণ করে এবং এই কথাও পরিষ্কার বোঝা যায় যে, রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম আনীত বিপ্লব ছিল মৌলিকভাবে তাওহীদের আক়ীদার বিপ্লব। যার ফলশ্রুতিতে মানবজীবনের অন্যান্য বিষয়াদি, যেমন— অর্থনীতি, সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি, নৈতিকতা ও চরিত্রে বিপ্লব ঘটে। অতএব, সঠিক ইসলামী বিপ্লব হবে একমাত্র যা তাওহীদের বিশুদ্ধ বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত, যে বিপ্লব তাওহীদের বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে নয়, তা যে কোন ধরনের সংস্কার, অর্থনৈতিক, শিল্প, প্রজাতন্ত্রী বা রাজনৈতিক বিপ্লব হতে পারে, ইসলামী বিপ্লব কখনো হতে পারে না।
☆☆☆