আত্মসম্মান ও স্বকীয়তা রক্ষা

শিরক মানুষকে অগণিত কাল্পনিক ও অলীক শক্তির আশঙ্কায় ভীত করে তোলে; দেব-দেবীর ভয়, অপ্রকাশ্য শক্তির ভয়, ভূত-প্রেত ও জ়ীনদের ভয়, জীবিত ও মৃতদের আস্তানার ভয়, অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর শাসকদের ভয়, এই সব ভয়ের ফলে মানুষ এমন নৈতিক ও ধর্মীয় অবক্ষয়ে পতিত হয় যে, মনুষ্যত্ব ও মানবতা তাদের মুখ লুকাতে শুরু করে। অপরদিকে, তাওহীদের বিশ্বাস মানুষকে এই ধরণের যাবতীয় অলীক ও কাল্পনিক শক্তির ভয় থেকে মুক্ত করে, আত্মা ও দেহকে স্বাধীনতা প্রদান করে, মানুষকে আত্মমর্যাদা ও মানবতার প্রতি শ্রদ্ধার অনুভূতি প্রদান করে। প্রতি মুহূর্তে তাকে وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِىٓ ءَادَمَ  (আর অবশ্যই আমরা আদম-সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি) এবং لَقَدْ خَلَقْنَا ٱلْإِنسَـٰنَ فِىٓ أَحْسَنِ تَقْوِيمٍۢ (আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সর্বোত্তম গঠনে) আল্লাহর ফরমান স্মরণ করিয়ে দেয়। তাওহীদের আক়ীদা মানুষকে আত্মসম্মানবোধের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে দেয়। হাকীমুল উম্মত আল্লামা ইকবাল তাঁর কবিতায় এই কথার সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন—

خُودی کا سرِّ نہاں لا اله الا الله

خُودی ہے تیغ فساں لا اله الا الله

আত্মবোধের গোপন ভেদ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ

আত্মবোধের খোলা খড়্গ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ

সাম্য ও সামষ্টিক ন্যায়বিচার

আক়ীদা তাওহীদ এই ধারণা প্রদান করে যে, সমস্ত সৃষ্টিকূলের একমাত্র স্রষ্টা, রিযিকদাতা ও মালিক আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তিনি আদমকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং সমস্ত মানুষকে আদম আলাইহিস সালাম থেকে পয়দা করেছেন। প্রাচ্যে বা পাশ্চাত্যে, আমেরিকায় বা আফ্রিকায়, কালো বা ফর্সা, সাদা বা লাল, আরব বা অনারব সকলেই এক আদমের সন্তান। সবার সমান অধিকার, সবার সমান মর্যাদা ও সম্মান। কেউ যেন কাউকে নিজের অধীনস্থ মনে না করে, কেউ যেন কাউকে নিজের দাস না করে, কেউ যেন কাউকে তুচ্ছ ও হীন মনে না করে, কেউ যেন কারও উপর জুলম-নির্যাতন না করে, কেউ যেন কাউকে ছোট মনে না করে, কেউ যেন কারও অধিকার হরণ না করে, সমস্ত সৃষ্টিজগতে সকল মানুষ সমান। কাজেই সকল মানুষ একই মাবুদের কাছে মাথা নত করবে, একই সত্তার আদেশ ও আইনের নিকট নতি স্বীকার করবে, শুধু একই সত্তার গোলাম ও বান্দা হয়ে থাকবে। ইসলামী সমাজে তাওহীদ বিশ্বাসের এই শিক্ষা জাতপাত, দাসত্ব ও পরাধীনতা, নিপীড়ন ও শোষণ, অবজ্ঞা ও ঘৃণার মত নেতিবাচক মূল্যবোধকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্ব, আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা, শান্তি ও নিরাপত্তা এবং সাম্য ও ন্যায় ইত্যাদির মত উচ্চতর মূল্যবোধের প্রচার করেছে। এবং মুসলিম সমাজে সমষ্টিগত ন্যায়বিচার প্রচলন করেছে।

আত্মার প্রশান্তি

শিরক মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় মিথ্যা। মানব সত্তা ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশে এমন হাজারো নয় লাখো স্পষ্ট নিদর্শন ও যুক্তি রয়েছে যা শিরককে খণ্ডন করে। একজন মুশরিকের আদর্শিক ও ব্যবহারিক জীবনে পূর্ব ও পাশ্চাত্যের বৈপরীত্য রয়েছে, তার আত্মা সর্বদা অস্থির থাকে এবং তার হৃদয় ও মন বিচলিত থাকে। তিনি প্রতিনিয়ত সংশয়, অনিশ্চয়তা ও বিচ্ছিন্নতায় ভুগতে থাকেন। পক্ষান্তরে তাওহীদ এই মহাবিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বজনীন সত্য। তাওহীদের সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য মানুষের স্বীয় সত্তার মধ্যে শত শত নয় লক্ষ লক্ষ নিদর্শন রয়েছে, মহাবিশ্বের প্রতিটি অণুপরমাণু আক়ীদায়ে তাওহীদের সত্যতা স্বীকার ও সমর্থন করে।

তাওহীদে বিশ্বাস মানুষের প্রকৃতি এবং প্রবৃত্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, অন্যকথায় বলা চলে যে, জন্মগত ভাবেই মানুষকে একত্ববাদের উপর সৃষ্টি করা হয়েছে। কুরআনুল মাজীদে মহাপবিত্র আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন,—

( فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًۭا ۚ فِطْرَتَ ٱللَّهِ ٱلَّتِى فَطَرَ ٱلنَّاسَ عَلَيْهَا ) ٣٠

“কাজেই আপনি একনিষ্ঠ হয়ে নিজ মুখমণ্ডলকে দীনে প্রতিষ্ঠিত রাখুন। আল্লাহর ফিতরাত (স্বাভাবিক রীতি বা দীন ইসলাম), যার উপর (চলার যোগ্য করে) তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন।” —সূরা রূম, আয়াত ৩০।

তাই যে ব্যক্তি তাওহীদের প্রতি বিশ্বাস রাখে তিনি তাঁর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জীবনে কখনই দ্বন্দ্ব ও সন্দেহের শিকার হবেন না, তাঁর অন্তর ও মন কখনই অনিশ্চয়তা ও দুশ্চিন্তায় ভুগতে পারে না, তিনি তাঁর জীবনের পরিস্থিতি ও বিষয় যাই হোক না কেন নিজের মধ্যে শান্তি, আত্মবিশ্বাস, আত্মসমর্পন ও গ্রহণযোগ্যতার তৃপ্তি অনুভব করেন।

প্রকৃতপক্ষে, আক়ীদায়ে তাওহীদের বরকত ও সুফল এত বেশি যে তা গণনা করা সম্ভব নয়। সংক্ষেপে বলা যায় যে, পৃথিবীর সকল কল্যাণ ও পূণ্যের ধারা বাস্তবিক তাওহীদের ঝর্ণা থেকে প্রবাহিত হয়। এভাবে তাওহীদে বিশ্বাস মানবজাতির উপর মহান আল্লাহ তায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ অনুগ্রহ ও অফুরন্ত আশীর্বাদ, যারা এর দ্বারা ধন্য তারা ইহকাল ও পরকালে সফলকাম আর যারা বঞ্চিত তারা ব্যর্থ ও অসফলকাম।

আক়ীদায়ে শিরক মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় অভিশাপ

আক়ীদায়ে তাওহীদ আল্লাহ তা’য়ালার পক্ষ থেকে দেওয়া আক়ীদা, যা আল্লাহ তাঁর নবী ও রাসূলগণের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। এই আক়ীদার শিক্ষা প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত একই আছে, এর মধ্যে কখনও কোন পরিবর্তন ও হেরফের করা হয়নি। শিরকবাদের বিশ্বাস হল শয়তানের পরিকল্পিত একটি বিশ্বাস, যা সে তার শিষ্যদের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন অঞ্চল ও বিভিন্ন জাতির জন্য বিভিন্ন দর্শনের সাথে প্রণয়ন করে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। এটিকে সে কোথাও মূর্তি পূজার রূপে, কোথাও কবর পূজার রূপে, কোথাও আত্ম পূজা রূপে, কোথাও তাগুতি শক্তি রূপে, কোথাও পীরত্বের রূপে, কোথাও ইমামতের রূপে, কোথাও জাতীয়তাবাদের রূপে, কোথাও দেশ, রঙ, জাতপাতের রূপে চালু করেছে। মূলত, এই সকল কিছু একটি মন্দ বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা ও পত্র-পল্লব যার ভিত্তি শয়ত়ানি চিন্তা ও বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। শয়ত়ান স্বীয় দর্শন ও বিশ্বাসকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কখনও হিন্দু ধর্মের রূপ ধারণ করে, কখনও সে বৌদ্ধ ধর্মের পোশাক পরে, কখনও সে ইহুদি ধর্মের চাদর পরে, কখনও খৃষ্টবাদের রূপে, কখনও সে পুঁজিবাদের আড়ালে বিভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতার মাধ্যমে, কখনও পূঁজিবাদের আড়ালে, কখনও সাম্যবাদের আড়ালে, কখনও সমাজতন্ত্রের প্রচারক হয়ে, কখনও ইসলামী সমাজতন্ত্রের প্রচারক হয়ে, কখনও গণতন্ত্রের ধারক-বাহক হয়ে, আর কোথাও ইসলামী গণতন্ত্রের1 সেবক হয়ে, কোথাও তাসাউফ2 নামে, কোথাও শিয়াবাদের নামে প্রচার করে থাকে। মূলত, এগুলো সবই ফাঁদ যা আল্লাহর সৃষ্টিকে ‘সিরাতুল মুস্তাকিম’ থেকে বিভ্রান্ত করার জন্য শয়ত়ান ছড়িয়ে দিয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা আক়ীদায়ে শিরককে এমন একটি মন্দ গাছের সাথে তুলনা করেছেন যার শিরড় স্থির নয় এবং যার কোনও স্থায়িত্ব নেই। তিনি বলেন,—

( وَمَثَلُ كَلِمَةٍ خَبِيثَةٍۢ كَشَجَرَةٍ خَبِيثَةٍ ٱجْتُثَّتْ مِن فَوْقِ ٱلْأَرْضِ مَا لَهَا مِن قَرَارٍۢ ) ٢٦

“মন্দবাক্য (শিরক) মন্দবৃক্ষের সঙ্গে তুলনীয়, ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগেই যাকে মূল থেকে উপড়ে ফেলা হয়েছে, যার কোন স্থায়িত্ব নেই।”— সূরা ইবরাহীম, আয়াত ২৬।

আলোচিত পবিত্র আয়াতে নিম্নলিখিত তিনটি বিষয় স্পষ্ট—

(ক) যেহেতু মহাবিশ্বের কোন কিছুই বহুঈশ্বরবাদের বিশ্বাসকে সমর্থন করে না, তাই এই অশুভ বৃক্ষটি কোথাও শিকড় ধারণ করতে পারে না এবং এটি বৃদ্ধির জন্য অনুকূল পরিবেশও খুঁজে পায় না।

(খ) যদি কখনও এই বৃক্ষগুলি তাগুতী বাহিনীর আশ্রয়ে আসে, তবে সেগুলোর শিকড় পৃথিবীর উপরিভাগ পর্যন্ত থাকে, যা উত্তমবৃক্ষের সামান্য হাওয়ায় সহজেই উপড়ে যায়। কাজেই মন্দবৃক্ষ কোথাও স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে না।

(গ) যেহেতু শিরক স্বয়ং একটি মন্দ ও বজ্জাত বৃক্ষের মত, সেহেতু এর ফল-ফলাদিও মন্দ ও বজ্জাত এবং প্রতিনিয়ত সমাজের সর্বত্র তাদের বিষ ও দুর্গন্ধ ছড়ায়।

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, পৃথিবীতে যত রকমের মন্দ ও দুর্নীতি আছে, যেমন—হত্যা ও ডাকাতি, রক্তপাত, সন্ত্রাস, গণহত্যা, অহঙ্কার, লুণ্ঠন, অধিকারহরণ, প্রতারণা, নিপীড়ন ও নির্যাতন, অর্থনৈতিক শোষণ, অশান্তি ইত্যাদি সব কিছুর মূল কারণ এই শাজারা খাবাইসা বা শিরকে বিশ্বাস। আমরা যদি প্রিয় দেশের দিকে তাকাই তাহলে বলতে দ্বিধা নেই যে, আমাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয়, নৈতিক, সামাজিক, সরকারী ও বেসরকারী সকল ক্ষেত্রেই অবনতির মূল কারণ এই বদবৃক্ষ, শিরকের বিশ্বাস। তাই আমাদের মতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের শিরক বিশ্বাসের সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত দেশে কোনো সংস্কার বা বিপ্লবী সংগ্রাম সফল হতে পারে না।

রোগীর চিকিৎসার পূর্বে রোগের কারণ গুলো খুঁজে বের করতে হয়, যাতে তার সঠিক চিকিৎসা করা সম্ভব হয়। অতএব, এই গ্রন্থে আমার স্বল্প জ্ঞানের ভিত্তিতে একটি পরিশিষ্ট যুক্ত করেছি যাতে আমি শিরকের সে সকল মৌলিক কারণ বর্ণনার চেষ্টা করেছি যা আমাদের দেশে শিরক প্রসারের কারণ হয়ে আছে।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. যদি একটি কুফুরী নীতি ‘সমাজতন্ত্রে’র সাথে ইসলাম শব্দ লাগানোর পর তা কুফুরী নীতিই থেকে যায়, তাহলে অন্য একটি কুফুরী নীতি ‘গণতন্ত্রে’র সাথে ইসলাম শব্দ লাগালে তা কী করে ইসলাম হতে পারে? এই দর্শন আমাদের দুর্বল জ্ঞানের বাইরে। আমাদের মতে, ইসলামী গণতন্ত্রের অনৈসলামিক হওয়ার  কারণগুলি শতভাগ ইসলামী সমাজতন্ত্রের অনৈসলামিক হওয়ার কারণগুলোর মত একই। অদূর ভবিষ্যতে, যদি কোন চালাক ব্যক্তি ইসলামী পূঁজিবাদ, ইসলামী ইহুদীবাদ, ইসলামী খৃষ্টবাদ ইত্যাদি আবিষ্কার করে বসে, তাহলে সেগুলোও কি গ্রহণ করে নেওয়া হবে? সর্বোপরি, ইসলামী ইতিহাসে শুরু থেকেই ব্যবহৃত কিতাব ও সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত পরিভাষা ‘খিলাফত ব্যবস্থা, বা শুরায়েত ব্যবস্থা’ থেকে বিমুখ হওয়ার কারণ কী? আমাদের মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদেরা এই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবেন কি?
  2. তাসাউফ বা সুফিবাদ বিষয়ে বিস্তারিত টীকা পরবর্তী পাতা গুলো দেখুন।