কুড়ি
সারদাকে লইয়া রাখাল যখন ব্রজবাবুর শয্যাপার্শ্বে গিয়া পৌঁছিল, রোগের প্রবল প্রকোপ তখন কতকটা সামলাইয়া উঠিলেও তিনি সম্পূর্ণ নিরাময় হ’ন নাই। এই অসুস্থতায় ব্রজবাবু দেহের সহিত মনেও নিরতিশয় দুর্ব্বল হইয়া পড়িয়াছিলেন। রাখালকে দেখিয়া তাঁহার নিমীলিত নেত্র বাহিয়া অশ্রু গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। স্বভাবতঃ কোমলচিত্ত রাখাল তাহার পিতৃতুল্য প্রিয় কাকাবাবুর অসহায় অবস্থা দেখিয়া চোখের জল সংবরণ করিতে পারিল না।
ব্রজবাবু মৃদুস্বরে ধীরে ধীরে বলিলেন, রাজু, তোমাকে আমি ডেকেচি—
বাষ্পাবরুদ্ধ কণ্ঠ পরিষ্কার করিয়া লইয়া কহিলেন, তোমার বোনটিকে দেখবার কেউ নেই বাবা। ওর জন্যেই তোমাকে ডাকা।
রাখাল কথা কহিল না। ব্রজবাবু অতিশয় ক্ষীণস্বরে বলিতে লাগিলেন, রাজু, এখানে এরা আমাকে একঘরে করে রেখেছে। আমার গোবিন্দজী তাঁর নিজের ঘরে ঢুকতে পাননি, তাঁর নিজের বেদীতে উঠতে পাননি। রেণু আমার গোবিন্দজীর ভোগ রাঁধে বলে সকলেরই আপত্তি। আমার অবর্ত্তমানে এখানে কেউ আমার রেণুর ভার নেবে না। ওকে তুমি নিয়ে গিয়ে ওর বিমাতার কাছেই পৌঁছে দিও। হেমন্ত রাগ করবে জানি, কিন্তু আশ্রয় দেবে নিশ্চয়। এ-ছাড়া আর তো কোনও উপায় খুঁজে পাচ্চিনে বাবা।
রাখাল চুপ করিয়াই রহিল। পিতৃহীনা, কপর্দ্দকশূন্যা অনুঢ়া রেণুকে তাহার বিমাতা ও বিমাতার বিষয়-বুদ্ধিসম্পন্ন ভ্রাতা নিজের সংসারে গ্রহণ করিবেন কিনা সেই-সম্বন্ধে সে যথেষ্ট সন্দিহান ছিল। তথাপি মুখে কিছুই বলিল না।
ব্রজবাবু বলিতে লাগিলেন, ওর বিয়েটা দিয়ে যেতে পারলে নিশ্চিন্ত মনে গোবিন্দর পায়ে ঠাঁই নিতে পারতাম। অস্তিম সময়ে একান্তচিত্তে গোবিন্দকে স্মরণ করতেও বাধা পাচ্ছি রাজু। রেণুর জন্য দুশ্চিন্তা আমাকে শান্তিতে মরতে দিচ্ছে না।
রাখাল কহিল, এখন ও-সব কেন ভাবচেন কাকাবাবু? আপনার এমন কিছুই হয়নি যার জন্যে রেণুকে এখনি হেমন্তমামার কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে। আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন, আমি নিজে এবার রেণুর বিয়ের জন্যে উঠে পড়ে লাগচি।
ব্রজবাবু করুণ হাসিয়া কহিলেন, কিন্তু রেণু যে বিয়ে করবে না বলে রাজু?
রাখাল বলিল, ছেলেমানুষ একটা কথা বলেচে বলেই কি সেইটেই চিরদিন মেনে চলতে হবে? যখন আপনার অতবড় সর্ব্বনাশের মধ্যে দুঃখকষ্টের ধাক্কায় সে ও-কথা বলেছিল; কিন্তু আজ আপনার এই অবস্থা দেখে তার বুঝতে কি দেরি হবে যে, তার জীবনে অন্য আশ্রয় গ্রহণের একান্ত প্রয়োজন হয়েছে!
ব্রজবাবু অত্যন্ত মলিন হাসিয়া কহিলেন, রাজু, রেণু তোমার নতুন-মার মেয়ে। সংসারে একমাত্র আমি আর ভগবান ছাড়া আর কেউ জানেন না ওর মায়ের জেদ কেমন ছিল। তাকে নিজের সমস্ত জীবনটাই তছনছ করে বলি দিতে হয়েচে শুধু জেদেরই পায়ে। জেদ যদি তার চড়তো, তা ভাঙার শক্তি অন্যলোকের তো ছিলই না, তার নিজেরও ছিল না। রেণু সেই মায়ের মেয়ে।
রাখাল কহিল, কিন্তু আমার মনে হয় কাকাবাবু, রেণু বোধ হয় নতুন-মার মতো অত বেশি জেদী নয়।
তুমি ওদের চেনো না রাজু। মেয়ে তার মায়ের প্রকৃতি অবিকল পেয়েচে। যে-মাকে জ্ঞান হবার আগেই হারিয়েচে, তার স্বভাব প্রকৃতি অন্তঃকরণ কি করে যে ওর হ’লো আমি ভেবে পাইনে। নতুন-বৌয়ের মত তেজস্বিনী, সৎ-প্রকৃতির ও সৎ- চরিত্রের মেয়ে সংসারে অতি অল্পই হয়। এটা আমি যত ভালো করে জানি, এত আর কেউ জানে না। সেই নতুন-বৌ,—ব্রজবাবুর কণ্ঠ বাষ্পাবরুদ্ধ হইয়া গেল। কণ্ঠ ঝাড়িয়া লইয়া বলিলেন, আমার ভাগ্য ছাড়া এ আর অন্য কিছুই নয় রাজু। তাকে আমি কিছুমাত্র দোষ দিইনে।
ব্রজবাবু এই সকল আলোচনায় উত্তেজিত হইয়া উঠিতেছেন দেখিয়া রাখাল পাখা লইয়া বাতাস দিতে দিতে কহিল, ও-সব কথা এখন থাকুক কাকাবাবু। আপনি আগে সেরে উঠুন, তার পর হবে।
ব্রজবাবু জীবনে কোনদিন সবিতার কথা লইয়া কাহারও সহিত আলোচনা করেন নাই। আজ তাঁহার সন্তানতুল্য রাজুর সহিত সেই বিষয় লইয়া তাঁহাকে আলোচনা করিতে দেখিয়া রাখাল আশ্চৰ্য্য হইয়া গেল। রোগে মানুষকে এত দুর্ব্বল করিয়া ফেলে যে তখন তাহার চিন্তার পর্য্যন্ত সংযম থাকে না। বোধ হয় ব্রজবাবুর এখন আর আপন মনের গোপন গভীর চিন্তাগুলি একাকী বহন করিবার সামর্থ্য ছিল না।
সারদা ঘরে আসিয়া ব্রজবাবুকে প্রণাম করিল। সচকিতে রাখালের দিকে চাহিয়া ব্রজবাবু কহিলেন, তোমার নতুন-মাও এসেছেন নাকি রাজু?
রাখাল বলিল, না। তিনি তো কলকাতার নেই। বৰ্দ্ধমানে তারকের কাছে গেছেন। সারদা আপনার অসুখের খবর শুনে আসবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো। বললে, কাকাবাবু আমাকে জানেন, আমার সেবা গ্রহণ করতে তিনি আপত্তি করবেন না।
ব্রজবাবু ক্লান্তিভরে বালিশে মাথা এলাইয়া বলিলেন, কারুরই সেবা নেবার দরকার হবে না রাজু, আমার রেণু-মা যতক্ষণ আছে। তবে সারদা-মা এসেচেন ভালই করেচেন, আমার রেণুকে একটু উনি দেখাশুনা করতে পারবেন। ওকে যত্ন করবার কেউ নেই। সংসারের কাজ, ঠাকুর-সেবা, তার উপরে রোগীর সেবার চাপে দিনরাত্রে একদণ্ড ওর ছুটি নেই!
রাখাল বলিল, নতুন-মাকে আপনার অসুখের খবর দেবো কি কাকাবাবু?
ব্রজবাবু ত্রস্ত-স্বরে বলিয়া উঠিলেন, না না—তোমরা পাগল হয়েছো? অমন কাজও ক’রো না, আমার অসুখ যদি তিনি শোনেন, তার পর তাঁকে আর কোন-কিছুতেই কোথাও আটকে রাখা যাবে না। সেই দণ্ডেই এখানে চলে আসবেন।
রাধাল কথা কহিল না।
মাথার রক্তের চাপ অত্যধিক বৃদ্ধির ফলে ব্রজবাবুর বাম অঙ্গে পক্ষাঘাতের লক্ষণ সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। প্রাণহানির আশঙ্কা বর্ত্তমান। গ্রামের ডাক্তার বলিতেছেন এ-রকম সঙ্কটাপন্ন রোগী নিজের হাতে রাখিতে তিনি ভরসা করেন না। উপযুক্ত ঔষধ পথ্য ইনজেকশন প্রভৃতি গ্রামে পাওয়া যায় না। এমন কি, রক্তের চাপ পরিমাপের উৎকৃষ্ট যন্ত্রেরও এখানে অভাব। কলিকাতায় লইয়া গিয়া চিকিৎসা করাইলে উপকার হইতে পারে। কিন্তু এখন এই অবস্থায় রোগীকে নাড়াচাড়া করা সম্ভবপর নয়। হার্ট অত্যন্ত দুর্ব্বল, নাড়ির গতি অতি দ্রুত। সুতরাং কলিকাতা হইতে বিচক্ষণ কোনো চিকিৎসক লইয়া আসা সম্ভব হইলে সত্বর তাহার ব্যবস্থা করা উচিত।
রাখাল বিপদে পড়িল। কলিকাতার বড় বড় ডাক্তার অনেকেরই নাম তাহার জানা আছে, কিন্তু সাক্ষাৎ আলাপ-পরিচয় কাহারও সাথে নাই। তা ছাড়া, এই-রকম রোগীর জন্য কাহাকে আনা সমীচীন হইবে সেও এক সমস্যা। উপরন্তু অর্থেরও একান্ত অভাব। তাহার যাহা-কিছু যৎসামান্য পুঁজি ছিল তাহা রেণুর অসুখের সময় ব্যয় হইয়া গিয়াছে। ব্রজবাবুর চিকিৎসার জন্য এখন যথেষ্ট অর্থের প্রয়োজন। অথচ তাহাদের কিছুমাত্র সঙ্গতি নাই। এ অবস্থায় নতুন-মাকে সংবাদ দেওয়া ছাড়া গত্যগুর কোথায়? এ সংবাদ পাইলে নতুন-মা না আসিয়া থাকিতে পারিবেন না নিশ্চিত; কিন্তু দেশের এই বাস্তুভিটার আর তাঁহার পদার্পণ করা কোনদিক দিয়াই বাঞ্ছনীয় নয়। ইহার পরিণাম রোগীর পক্ষেও অশুভকর হইতে পারে। রাখাল দুর্ভাবনার আর কূলকিনারা পাইল না। অথচ শীঘ্রই একটা কিছু ব্যবস্থা করিয়া ফেলা বিশেষ প্রয়োজন।
এমন সময়ে আসিল রাখালের কাছে বিমলবাবুর পত্র।
ব্রজবাবুর স্বাস্থ্য সম্বন্ধে প্রশ্ন করিয়া শেষে লিখিয়াছেন— আমার একান্ত অনুরোধ, ব্রজবাবুর জন্য উপযুক্ত চিকিৎসক, নার্স, ঔষধ, পথ্য ও অর্থ যাহা কিছু প্রয়োজন, অতি অবশ্য আমাকে তার-যোগে জানাইবে। আমি তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা করিতে পারিব।
রাখাল পত্রখানি হাতে লইয়া চিন্তিত-মুখে বসিয়া ছিল। সারদা আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ও-কার চিঠি দেব্তা?
বিমলবাবুর।
সারদা বলিল, কলকাতা থেকে ডাক্তার আনবার জন্য আপনি এত ভাবচেন দেব্তা—অথচ বিমলবাবুকে একটু লিখে দিলেই তিনি তখুনি ভাল ডাক্তার পাঠাতে পারতেন।
রাখাল বলিল, হু।
সারদা বলিল, আমি বুঝেছি আপনি সংশয়ে পড়েছেন। তাঁর সাহায্য নিতে আপনার বাধচে।
রাখাল কথা কহিল না।
সারদাও কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া আবার ধীরে ধীরে কহিল, কাকাবাবুর অবস্থা যা দাঁড়িয়েচে কখন কি ঘটে বলা কঠিন। যা করবেন শীগগিরই স্থির করে ফেলুন। না হয় অন্য কিছু প্রয়োজন জানিয়ে নতুন-মাকেই লিখুন টাকার জন্য।
রাখাল তথাপি চুপ করিয়াই রহিল।
সারদা কহিল, যদি মনে না করেন তো একটা কথা মনে করিয়ে দিই।
রাখাল সপ্রশ্ন-চোখে তাকাইল।
তুচ্ছ মান-অপমান, উচিত-অনুচিতের ওজন হিসাব করে চলার চেয়ে এখন কাকাবাবুর প্রাণরক্ষার চেষ্টাটাই কি সবচেয়ে বেশি দরকারী নয়? আপনার নিজের কর্ত্তব্যের দিক থেকে একটু ভেবে দেখবার চেষ্টা করুন না!
কি করতে বলচো তুমি?
এ অবস্থায় বিমলবাবুর কিংবা নতুন-মার সাহায্য নেওয়া উচিত আমাদের। নতুন-মার সাহায্য নিতে রেণু কুণ্ঠাবোধ করলে সেটা তার পক্ষে অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আপনার তো বাধা নেই।
তুমি ঠিকই বলেচো সারদা। কাকাবাবুর এই জীবন-সঙ্কট অবস্থায় উচিত অনুচিতের প্রশ্ন অন্ততঃ আমার দিক দিয়ে ওঠা কখনই উচিত নয় ৷ তা হ’লে নতুন-মা আর বিমলবাবু দুইজনকেই এখানকার সমস্ত অবস্থা জানিয়ে দুখানা চিঠি লিখে দিই।
কিন্তু মাকে জানাতে যে কাকাবাবু সেদিন বিশেষ করে আপনাকে নিষেধ করে দিয়েছেন?
তাও তো বটে! তা হ’লে শুধু বিমলবাবুকেই—আচ্ছা—বিমলবাবু তো কাকাবাবুর পরিচিত? কাকাবাবুকে জানিয়েই ব্যবস্থা করা যাক না—
এটা মন্দ যুক্তি নয়। তবে রোগীর এ অবস্থায় তাঁকে এ-সব প্রস্তাবে বিচলিত করা হবে না তো?
রাখাল অত্যন্ত কাতরভাবে বলিল, তবে কি করবো সারদা? ওঁদের কিছু না জানিয়েই কি বিমলবাবুকে খবর দেবো?
একটু চিন্তা করিয়া বলিল, তাই করুন দেব্তা।
গোবিন্দজীর ভোগ রাঁধিতেছিল রেণু। সারদা দূরে বসিয়া তরকারী কুটিতে কুটিতে গল্প করিতেছিল। রেণু কাজ করিতে করিতে ‘হাঁ’ ‘না’ ‘তার পর’ এইরূপ সংক্ষিপ্ত দু-একটি কথা কহিতেছিল।
সর্ব্বদা এইরূপই ঘটে। রেণু থাকে নির্ব্বাক শ্রোতা, সারদা গ্রহণ করে বক্তার আসন। কত যে গল্প করে ঠিক-ঠিকানা নাই। হয়তো নিজের অজ্ঞাতসারেই সারদা সবচেয়ে বেশি গল্প করে তার দেব্তার। নতুন-মায়ের গল্পও অনেক বলে, ভাড়াটিয়াদের গল্প তো আছেই। বলে না কিছু রমণীবাবু সম্বন্ধে এবং নিজের অতীত সম্বন্ধে। রেণু কখনও কোন প্রশ্ন করে না, বিন্দুমাত্র কৌতূহল প্রকাশ করে না কোনো বিষয়েই। টানা টানা শান্ত চোখ দুটি মেলিয়া নীরবে গল্প শুনিয়া যায়। নিপুণ হাত দুখানি ব্যাপৃত থাকে একটা-না-একটা প্রয়োজনীয় কাজে। বেশী কথা কোনদিনই তার মুখে শোনা যায় না।
সারদা তরকারী কুটিতে কুটিতে বলিতেছিল বিমলবাবুকে দেব্তা আজ টেলিগ্রাম করতে গিয়েছেন, কলকাতা থেকে ভাল ডাক্তার নিয়ে এখানে আসবার জন্য। বোধ করি কালকের মধ্যেই তিনি ডাক্তার নিয়ে এসে পড়বেন।
রেণুর দৃষ্টিতে বিস্ময় প্রকাশিত হলেও মুখে কোনও প্রশ্ন নিঃসৃত হইল না।
সারদা বলিতে লাগিল, বিমলবাবু এসে পড়লে অনেকটা ভরসা পাওয়া যাবে। উপযুক্ত চিকিৎসা, ওষুধ, পথ্য সমস্ত ব্যবস্থা হবে। কাকাবাবু এইবারে শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবেন।
রেণু এইবার জিজ্ঞাসুনয়নে সারদার পানে তাকাইল।
সারদার তখন আপনমনে বকিয়া চলিয়াছে— অমন মানুষ কিন্তু সংসারে দুটি দেখলাম না রেণু! যেমন সদাশয় তেমনি অমায়িক। শুনেচি তিনি কোটীপতি, লক্ষ লক্ষ টাকা খাটছে তাঁর দেশ-বিদেশের ব্যবসায়ে, কিন্তু এমন নিরহঙ্কার সহজ-বিনয়ী মানুষ কোথাও দেখিনি এর আগে। যথার্থ যাকে শিবতুল্য বলে। এমন না হলে বিধাতা এত ঐশ্বৰ্য্য দেবেনই বা কেন? কথায় বলে—মনের গুণে ধন! বিমলবাবুর ধনও যেমন, মনও তেমনি।
নির্ব্বাক রেণু তখন গোবিন্দজীর ভোগ রন্ধন শেষ করিয়া পিতার পথ্য প্রস্তুত করিতেছিল। মৌন থাকিলেও সে যে মনোযোগ সহকারেই সারদার মন্তব্যগুলি শুনিতেছিল তাহা স্পষ্ট বুঝা যায়।
সারদার বাক্যস্রোতে উচ্ছ্বাস আসিয়াছে। সে বলিতে লাগিল, বিমলবাবু সেদিন আমাদের সকলকে রক্ষা করেছিলেন পথে দাঁড়ানোর লজ্জা থেকে। সে-দুর্দ্দিনের কথা মনে পড়লে আজও আমার চোখে অন্ধকার ঠেকে। যিনি বাড়ি-শুদ্ধ লোকের আশ্রয় বলো, বল-ভরসাই বলো, যা কিছু, সেই মা আমাদের যখন নিরাশ্রয় হতে বসলেন, তখন আমাদের যে ভয় ভাবনা ও উৎকণ্ঠা ঘনিয়ে এসেছিল সে শুধু জানেন ঈশ্বর নিজে। বিশেষ করে আমার তো পায়ের নীচে থেকে পৃথিবী সরে যাওয়ার যোগাড় হয়েছিল। মা ছাড়া তখন আমার ইহজগতে অন্য আশ্রয় বা অবলম্বন কিছুই ছিল না।
রেণু তেমনই বিস্মিত নয়নে সারদার পানে তাকাইয়া প্রশ্ন করিল, কেন?
সারদা বলিল, তোমাকে সবই বলেচি ভাই। তুমি কি সে-সব কথা ভুলে গেছো? আমার চরম দুর্দ্দিনে মা আমাকে তাঁর স্নেহের আশ্রয় দিয়েছিলেন বলেই না আজ দাঁড়িয়ে আছি!
রেণু আত্মবিস্মৃতভাবে বলিল, তার পর?
তার পরের কাহিনীও তো তুমি শুনেছো ভাই আমার মুখে। আমার পুনর্জন্ম ঘটালেন মা আর এই দেব্তা। মাঝে মাঝে এখন ভাবি রেণু, ভাগ্যে সেদিন মরে যাইনি।
রেণু হাসিয়া কহিল, কেন সারদাদিদি, সেদিন মরে গেলেই বা আজ তোমার কিসের ক্ষতি হ’তো ভাই?
অনেক ক্ষতি হ’তো। সে যে কত বড় ক্ষতি, ছেলেমানুষ বুঝতে পারবে না বোন।
রেণু চুপ করিয়া আপনার কাজ করিতে লাগিল। সারদার তরকারি কাটা শেষ হইলে, বাকী আনাজগুলি ঝুড়িতে গুছাইয়া রাখিতে রাখিতে বলিল, সংসারে যথার্থ খাঁটি জিনিস কিছু পেতে হলে বড় করে তার দাম দিতে হয়। দুর্লভের মূল্য অনেক। আমাদের জীবনেও এ নীতি মেনে চলতে হয়। নকল ও ভেজালের সমস্যা মানুষের মধ্যে এত বেশি বেড়ে উঠেচে যে, এখন কোন্টা খাঁটি কোন্টা মেকি চেনা কঠিন। জীবনে যতবড় সঞ্চয় যে পেয়েচে বোন, তাকে তত বেশি মূল্যও দিতে হয়েচে গভীর দুঃখের মধ্য দিয়ে। অন্ততঃ এটা ঠিক বুঝেচি যে, দুঃখের কষ্টিপাথরে না পড়লে জীবনের যাচাই হয় না।
রেণু কোনদিনই কিছু বিশেষ করিয়া জানিবার জন্য সারদাকে প্রশ্ন করিত না। আজ কিন্তু সে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিয়া বসিল, সারদাদিদি, তোমার নিজের জীবনে তো অনেক দুঃখই পেয়েচো ভাই, তাতে খাঁটি সামগ্রী কি কিছু সঞ্চয় করতে পেরেছো?
সারদা চমকিয়া উঠিল। রেণু যে এরূপ প্রশ্ন করিতে পারে সে সম্ভাবনা তাহার একবারও মনে হয় নাই। একটু বিব্রত হইয়াই বলিল, কি করে বলবো দিদি?
কেন? যেমন করে এই সমস্ত কথা বলচো।
সারদা সহসা অনাবশ্যক গম্ভীর হইয়া বলিল, কিছু করতে পেরেচি কিনা জানিনে, তবে সম্বল যে পেয়েচি, আর সে যে ষোলো আনাই খাঁটি, তাতে আমার আর সংশয় নেই।
সরলমতি রেণু মমতায় বিগলিত হইয়া কহিল, সারদাদিদি, যে স্বামী তোমাকে একলা অসহায় ফেলে রেখে পালিয়ে রইলেন, তাঁকে এখনও এত ভক্তি কর তুমি?
সারদা জবাব দিল না। মুখে তার বেদনার চিহ্ন সুষ্পষ্ট হইয়া উঠিল। আনাজের ঝুড়ি ও বঁটি লইয়া অন্য ঘরে রাখিতে উঠিয়া গেল।
রাখাল আসিয়া ডাকিল, রেণু!
রাজুদা?
কাকাবাবুর রান্নাটা হয়েচে কি বোন?
হয়েচে। এইবার গিয়ে বাবাকে চান করিয়ে দেবো।
কাকাবাবু ঘুমুচ্চেন। তোর যদি রান্না সারা হয়ে থাকে তো একটু ও-ঘরে আয় না, গোটা-কতক কথা আছে।
এই যে, আমাদের ভাতটা চড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছি ভাই, চলো।
অল্পক্ষণ পরে রেণু যখন হাত-পা ধুইয়া রাখালের নিকট আসিয়া দাঁড়াইল, রাখাল ঘরের মেঝেয় বসিয়া খবরের কাগজ পড়িতেছিল। মুখ তুলিয়া রেণুকে বলিল, আয়, বোস।
রেণু বসিল। বলিল, ডাক্তারবাবু আজ তোমার কাছে কি বলে গেছেন রাজুদা?
ভালোই বলে গেছেন।
তবে কেন তুমি কলকাতার টেলিগ্রাম করে এলে বড় ডাক্তার নিয়ে আসবার জন্য?
তুই পাগল। গোড়া থেকেই তো শুনচিস্ এখানকার ডাক্তারবাবু বলেচেন, একজন ভাল ডাক্তার আনিয়ে দেখানো দরকার। ঐ রোগের চিকিৎসা গায়ের ডাক্তারের কৰ্ম্ম নয়। হ’তো ম্যালেরিয়া, পিলে, কি পালাজ্বর, ওরা চতুর্ভুজ হয়ে চার হাতে করতো কত চিকিৎসা। কাউকে ডাকতে দিত না, কিন্তু ওকথা থাক। তোকে ডাকলাম একটা দরকারি পরামর্শের জন্য।
রেণু নীরবে রাখালের দিকে মুখ তুলিয়া চাহিয়া রহিল।
বার-দুই গলাটা ঝাড়িয়া লইয়া খবরের কাগজখানি ভাঁজ করিতে করিতে রাখাল বলিল, বলছিলুম কি, কাকাবাবু একটু সামলে উঠলেই তো এখান থেকে ডেরাডাণ্ডা তুলতে হবে। আপাততঃ কলকাতায় গিয়ে কাকাবাবু সম্পূর্ণ সেরে না ওঠা পৰ্যন্ত আগের মতো একটা ছোট বাসা ভাড়া করে না হয় থাকা যাবে। কিন্তু তার পরে —
রাখাল বলিতে বলিতে চুপ করিল। তাহার কণ্ঠস্বর দ্বিধাজড়িত।
রেণু তেমনই জিজ্ঞাসু-দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল।
চিন্তিতমুখে রাখাল কহিল, তার পরে যে কি ব্যবস্থা হতে পারে সেই কথাই ভাবচি। এখানে তো আর ফিরে আসা চলবে না!
রেণু শান্ত গলায় বলিল, কেন?
রাখাল বিস্মিত হইয়া কহিল, তাও কি বুঝতে পারিস্নি রেণু, এতদিন এখানে বাস করে? দেখচিস্ তো জ্ঞাতিদের আচার-ব্যবহার! কাকাবাবুর এতবড় অসুখ, একটা উঁকি মেরে খোঁজ নেয় না কেউ।
রেণু অল্পক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, কিন্তু তুমি তো জানো রাজুদা, কলকাতায় বারোমাস থাকা আমাদের অবস্থায় কুলোবে না। এখানে বাসা ভাড়া লাগে না, ঝিয়ের মাইনে মাত্র এক টাকা ৷ আনাজ-তরকারি কিনে খেতে হয় না। খরচ কত অল্প।
রাখাল বলিল, কিন্তু কাকাবাবুর যা শরীরের অবস্থা, ওঁর ’পরে তো নির্ভর করা চলে না বোন! একটু ভেবে দেখ ওঁর অবর্ত্তমানে তোর আশ্রয় কোথায়? এখানে জ্ঞাতিরা তো তোদের সম্পর্কই ত্যাগ করেছেন। সৎমা আগেই পৃথক হয়ে নিজের পিতৃকুলে সরে পড়েছেন। কলকাতায় ফিরে যে-কদিনই থাকা হোক, তার মধ্যে তোর একটা বিয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেলে কাকাবাবু তখন আমার কাছে নিশ্চিত হয়ে থাকতে পারবেন। তাঁর যা সামান্য আয় আছে, আমার সঙ্গে একত্রে থাকলে স্বচ্ছন্দে স্বচ্ছল ভাবেই চলে যাবে। কারুর সাহায্য নিতে হবে না আমি থাকতে।
রেণু চুপ করিয়া শুনিতেছিল। তাহার মৌনতায় উৎসাহিত হইয়া রাখাল বলিতে লাগিল, আমি অনেক ভেবে-চিন্তে দেখেচি বোন, এছাড়া অন্য সুব্যবস্থা আর কিছু হতে পারে না। মেয়ের ভবিষ্যতের দুর্ভাবনাই কাকাবাবুকে সবচেয়ে বেশী বিব্রত করে তুলেছিল। তোমাকে সৎপাত্রে সম্প্রদান করতে পারলে তাঁর মনের গুরুতর দুশ্চিন্তা কেটে যাবে। তখন তিনি সহজেই সুস্থ হয়ে উঠবেন আশা করি।
রেণু মৃদুকণ্ঠে বলিল, বাবাকে ফেলে আমি কোথাও যেতে পারবো না রাজুদা।
কিন্তু না গিয়েও যে কোন উপায় নেই দিদি। তুমি যদি ছেলে হতে, ফেলে যাওয়ার কথাই উঠতো না। কিন্তু মেয়েদের যে আশ্রয় ছাড়া উপায় নেই।
অল্পবয়সী বিধবা মেয়েরা তো সারাজীবন বাপের বাড়িতে থাকে দেখেচি।
রাখাল শুল্ক হাসিয়া জবাব দিল, থাকে সত্যি, কিন্তু তাদের যদি পিতৃকুলে দাঁড়াবার মতো আশ্রয় না থাকে কোনও সময়ে, তখন তারা শ্বশুরকুলেই গিয়ে আশ্রয় নেয়, এও দেখেচো নিশ্চয়। স্বামী না থাকলেও তাদের শ্বশুরকূল তো থাকে।
রেণু নতমুখে কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিল রাজুদা, আমি বাবাকে নিজের মুখে জানিয়েচি, বিয়েতে আমার একটুও রুচি নেই। আমি বিয়ে করতে পারবো না।
রাজু হাসিয়া উঠিল। বলিল, তোকে বুদ্ধিমতি ঠাওরাতাম, এখন দেখচি তুই একেবারে পাগল রেণু। আরে, সেদিন তুই ও-কথা না বললে কাকাবাবু কি বেঁচে থাকতে পারতেন? হঠাৎ কারবার ফেল হয়ে সৰ্ব্বস্ব গেল। বসতবাড়ি-শুদ্ধ নিলামে ওঠায় একেবারে পথে দাঁড়ালেন। সেই দুঃসময়ে তোর বিয়ে বন্ধ হওয়ার ছুতো নিয়ে ঝগড়া করে হেমন্তমামা তাঁর বোন আর ভাগ্নীর পাওনা কড়ায় গণ্ডায় আঠারো আনা বুঝে নিয়ে সরে দাঁড়ালেন, পাছে কাকাবাবুর দেনার দায়ে তাদেরও পথে দাঁড়াতে হয়! সংসার এমনই স্বার্থপর বোন!
রাখাল একবার থামিয়া একটি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিল। তার পরে আবার বলিতে লাগিল, স্বামীর অতবড় দুঃসময়ে স্ত্রী নিজের ভাইয়ের সঙ্গে একজোট হয়ে আপনার আর্থিক ভালোমন্দের দিকটাই কেবলমাত্র বিবেচনা করলে, স্বামীর পানে তাকালেও না। তুই যদি সেদিন তাঁকে অমন করে ভরসা দিয়ে না বলতিস্ রেণু, তোমাকে একা ফেলে রেখে আমি কখনো কোথাও যাবো না বাবা— তা হলে কাকাবাবু সংসারে দাঁড়াতেন কাকে অবলম্বন করে?
রেণু অত্যন্ত মৃদুস্বরে বলিল, কিন্তু রাজুদা, আমি তো বাবাকে সান্ত্বনা বা সাহস দিতে ও কথা বলিনি। আমি যে সত্যি কথাই বলেচি।
রেণুর কথা বলার ভঙ্গিতে রাখাল মনে মনে প্রমাদ গনিলেও মুখে হাসি টানিয়া আনিয়া বলিল, সত্যি কথা নয়তো কি মিথ্যে কথা বলেচিস্ বলচি আমি? কিন্তু কি জানিস্ বোন, সংসারে বেশীর ভাগ সত্যিই—সাময়িক সত্যি। চিরকালের সত্যি বলে যদি কিছু থাকে তা সংসারের বাইরের বস্তু। তুমি সেদিনকার সেই মুখের কথাটি রক্ষা করবার জন্য আজ যদি বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠো, জেনো, তার ফলে হয়তো তোমাদের জীবনে অকল্যাণই দেখা দেবে— যা কল্যাণ বহন করে আনে, তাকেই বলে সত্য। অশুভকর যা তা সত্য নয়। সেদিন তোমার মুখের যে কথাটি কাকাবাবুকে সবচেয়ে সান্ত্বনা ও শান্তি দিয়েছিল—আজ সেই কথাটিকে রক্ষা করার জন্য তুমি যদি জিদ ধরে বসো, তা হলে জেনো, সেই অবাঞ্ছিত ব্যাপারই কাকাবাবুর সবচেয়ে দুঃখ-দুর্ভাবনার হেতু হবে। এমন কি, হয়তো সেটা তার মৃত্যুর কারণ পর্য্যন্ত হতে পারে। একটা কথা ভুলো না রেণু, যে উগ্র বিষ ধাতছাড়া রোগীকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনে জীবন দান করে, সেই বিষ পান করেই আবার সুস্থ মানুষ আত্মহত্যা করে। স্থান কাল ও অবস্থা-অনুসারে একই ব্যবস্থা কোনও সময় যেমন মঙ্গলকর, আবার অন্য এক সময়ে তেমনি অমঙ্গলকরও। বড় হয়েচো, সবদিক সুস্পষ্ট করে ভেবে দেখো। বিশেষ প্রয়োজনে একবার একটা কথা বলেচো বলেই সেই মুখের কথাটাকেই জীবনের সকল মঙ্গলামঙ্গল প্রয়োজন অপ্রয়োজনের চেয়ে বড় করে তুলতে গিয়ে অকল্যাণ ডেকো এনো না।
রেণু নত-চক্ষে চুপ করিয়া রহিল।