উনিশ

তারকের সুনিপুন সেবায় যত্নে ও সুন্দর ব্যবহারে সবিতার পরিশ্রান্ত মন অনেকখানি স্নিগ্ধ হইয়াছিল। উচ্ছ্বসিত বাৎসল্যরসে অভিষিক্ত অন্তর লইয়া সবিতা তারকের প্রতি ব্যবহার, প্রতি কর্ম্ম, প্রতি কথাবার্ত্তার মধ্যে আশ্চৰ্য্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করিয়া মুগ্ধ হইতেছিলেন। তারকও সবিতাকে নিজের মায়ের মতই শুধু নয়, দেবতাকে যেমন নিরঙ্কুশ ত্রুটিহীনতায় সেবা করে তেমনই ভাবে সেবা-যত্ন সমাদরের বিন্দুমাত্র অবহেলা করে নাই।

কথাপ্রসঙ্গে সবিতা একদিন তারককে প্রশ্ন করিলেন, তারক, তুমি আমাকে যে হরিণপুরে নিয়ে এলে বাবা, রাজুকে কি জানাওনি?

একটু কুণ্ঠিতভাবে তারক উত্তর দিল, না মা।

বিস্মিত হইয়া সবিতা বলিলেন, কিন্তু তাকেই তো তোমার সবার আগে জানানো উচিত ছিল তারক!

তারক কহিল, কেন জানাইনি সে-কথা আপনাকে একদিন বলবো মা।

সবিতা অতিমাত্রায় বিস্মিত হইয়া বলিলেন, দুই বন্ধুর ভিতরে তোমাদের এমন ব্যাপার এরই মধ্যে ঘটে গেল যা মাকেও জানাতে কুণ্ঠিত হতে হচ্চে বাবা!

নতমুখে তারক কহিল, রাখাল হয়তো সে অভিযোগ আপনাকে জানিয়েচে, কিংবা না জানিয়ে থাকলে শীঘ্রই একদিন জানাবেই। সেজন্য আমিও আপনাকে সমস্ত বলবো ঠিক করেচি মা।

তারকের মুখের দিকে ক্ষণকাল তীক্ষ্ণ-দৃষ্টিতে চাহিয়া থাকিয়া সবিতা বলিলেন, রাজুর তুমি ঘনিষ্ঠ বন্ধু শুনেচি। আমি জানতাম তাকে তুমি চেনো। এখন বুঝতে পারচি, তুমি আমার রাজুকে চেননি বাবা!

তারক চঞ্চল হইয়া বলিল, কেন মা?

সবিতা বলিলেন, যত বড় অন্যায়ই যে-কেউ তার উপর করুক না, রাজু দুনিয়ার কারো কাছে কারো নামে কখনো অভিযোগ করেনি, করবেও না। অভিযোগ করার শিক্ষা জীবনে সে পায়নি তারক, সহ্য করার শিক্ষাই পেয়েচে।

তারক আরো কুণ্ঠিত হইয়া পড়িল, বলিল, আমাকে মাফ করুন মা, আমার বলবার দোষে ভুল বুঝবেন না। বলতে চেয়েছিলাম, রাখালের কাছে আপনি আমার সম্বন্ধে যে ঘটনা শুনেচেন, কিংবা শুনবেন, সেটা বাহ্যতঃ সত্য হলেও সমস্ত সত্য নয়।

সবিতা হাসিয়া কহিলেন, আমি রাজুর কাছে কিছুই শুনিনি বাবা, কোনও দিন শুনতে পাবোও না, সে-সম্বন্ধে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার।

তারক অকস্মাৎ ঈষৎ উত্তেজিত হইয়া বক্তৃতার ভঙ্গিতে হাত-মুখ নাড়িয়া বলিতে লাগিল, কিন্তু এটা আমি কিছুতেই মানতে পারবো না মা, আপনার কাছেও আমাদের বিচ্ছেদের কারণ গোপন করা তার উচিত হয়েচে! আপনি শুধু তাকে স্নেহরসে ও অন্নরসেই পৃষ্ট করে তোলেন নি, আপনার কাছেই পেয়েচে সে শিক্ষা দীক্ষা যা-কিছু সমস্ত! আজ সে যে পৃথিবীতে বেঁচে আছে এবং ভদ্রলোকের মতোই বেঁচে আছে, এর জন্য বিপুল ঋণ তার কার কাছে? কার আশ্চর্য্য অসাধারণ মন, অসাধারণ জীবন রাখালের দৃষ্টি ও মনকে এতখানি প্রসারিত করে তুলেচে? কার অপার স্নেহ, অন্তরাল হতে বিধাতার মতোই তার জীবনকে সতর্কভাবে রক্ষা করে আসচে? সেই মায়ের কাছে সত্য গোপন করা আমি যায় বলে মানতে পারবো না মা। আপনি বললেও না।

এক নিশ্বাসে এতখানি বক্তৃতা করিয়া তারক দম লইতে লাগিল।

সবিতা স্থির-দৃষ্টিতে তারকের পানে তাকাইয়া শুনিতেছিলেন। ধীর-কণ্ঠে কহিলেন, তারক, তোমাদের কি হয়েচে বাবা?

বলি শুনুন তা হলে মা। রাখাল আমার কাছে আপনার পরিচয় যা দিয়েছিল, যদি আপনাকে সত্যিই সে নিজের মা বলে জ্ঞান করতো, তাহলে সে-পরিচয় দিতে কখনই পারতো না।

সবিতা কোনও কথা কহিলেন না এবং তাঁর সম্মিত মুখভাবেরও কোন পরিবর্ত্তন দেখা গেল না।

তারক পুনরায় সোৎসাহে বলিতে প্রবৃত্ত হইল, আপনি বলেছিলেন মা, কারো সম্বন্ধে কোনও কথা উপযাচক হয়ে বলা তার প্রকৃতি নয়। কিন্তু আমিই তো তার বিপরীত প্রমাণ পেয়েচি। সে উপযাচক হয়েই আমার কাছে তার নতুন-মার এমন পরিচয় দিয়েছিল যা আমার জানবার কোনও প্রয়োজনই ছিল না। কিন্তু নির্ব্বোধ বোঝেনি, আগুনকে ছাই বলে নির্দ্দেশ করলে প্রথমে হয়তো মানুষ ভুল করতে পারে, কিন্তু সে ভুল বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। অগ্নি নিজের পরিচয় নিজেই প্রকাশ করে।

সবিতা এবারও জবাব দিলেন না। পূর্ব্ববৎ সপ্রশ্ন দৃষ্টি মেলিয়া মৌনই রহিলেন।

তারক বলিতে লাগিল, অবশ্য আমি স্বীকার করি মা, সে যখন অনেক-কিছু অতিরঞ্জিত কাহিনী শুনিয়ে আমাকে প্রশ্ন করেছিল—এ সকল শুনে আমার ঘৃণা হচ্ছে কি না? আমি জবাব দিয়েছিলাম —ঘৃণা, হওয়াই তো স্বাভাবিক রাখাল। তখন তো জানতাম না তার উদ্দেশ্যই ছিল আপনার ’পরে অশ্রদ্ধা জাগিয়ে দেওয়া! তা না হলে এ-সব কথা বলার তার কোন প্রয়োজনই ছিল না।

সবিতা এইবার কথা কহিলেন, শান্ত-কণ্ঠে বলিলেন, রাজু মিথ্যা কথা বলে না তারক। সে যা-কিছু তোমাকে বলেচে সমস্তই সত্যি।

তারকের মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। আমতা আমতা করিয়া শুষ্ককণ্ঠে কহিল, আপনি জানেন না, সে যে কি ভয়ানক কথা—

সবিতা কহিলেন, জানি। তুমি যাই কেন শুনে থাকো না তারক, রাজুর মুখের কোন কথাই মিথ্যা নয়।

তারকের কণ্ঠনালী কে যেন শক্ত মুঠোর চাপিয়া স্বররোধ করিয়া ফেলিল। চেষ্টা সত্ত্বেও আর একটি শব্দও কণ্ঠ হইতে নির্গত হইল না।

সবিতা ধীরে ধীরে বলিতে লাগিলেন, তুমি রাজুর প্রতি শুধু ভুলই করোনি তারক, অবিচার করেচ। সে তোমাকে ভুল বোঝাতে চায়নি, বরং তুমিই পাছে কিছু ভুল বোঝো সেই ভয়ে গোড়াতেই সমস্ত ঘটনা খোলাখুলিভাবে তোমাকে সে জানিয়েচে। যদি মনে করে থাকো তার কথা মিথ্যে, তাহলে খুবই ভুল করেচে।

তারক শুষ্ক-স্বরে কহিল, কিন্তু মা, আমি তো কিছুই জানতে চাইনি, সে উপযাচক হয়ে কেন—

সবিতা মলিন হাসিয়া কহিলেন, তুমি উচ্চশিক্ষিত, বুদ্ধিমান। সমস্ত দিকে মন মেলে চিন্তা করে ভাল-মন্দ বিচারের শক্তি তোমার থাকাই সম্ভব। সংসারে দৃশ্যতঃ অনেক জিনিসই হয়তো আমরা একরকম দেখতে পাই, কিন্তু সাদৃশ্য থাকলেও তারা সমস্তই বস্তুতঃ এক নয়। তা ছাড়া, এটা তো জানো— বাহির দিয়ে ভিতরের বিচার কোনও সময়েই করা চলে না। এ-সকল বিষয়ে সাধারণ লোকে বোঝে না এবং বুঝতে চায়ও না। কিন্তু তুমি তাদের দলের নও; রাজু তা জানতো বলেই সে তার নতুন-মায়ের দুর্ভাগ্যের কাহিনী তোমার কাছে খুলে জানিয়েছিল।

তারক অনেকক্ষণ নতমুখে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। পরে মুখে তুলিয়া কহিল, রাখাল আমাকে বলেছিল মা একদিন, সংসারে হাজারের মধ্যে ন’শো নিরানব্বুইজন সাধারণ মেয়ে, ক্বচিৎ কখনও একটি অসাধারণ মেয়ে দেখতে পাওয়া যায়—নতুন-মা সেই ন’শো নিরানব্বুইয়ের পর ক্বচিৎ মেলা একটি মেয়ে। এঁকে কেউ ইচ্ছা করলেও অবজ্ঞা বা অবহেলা করতে পারে না। সে সত্যি কথাই বলেছিল।

সবিতা কথা কহিলেন না, অন্যমনস্কে অন্যদিকে চাহিয়া রহিলেন। তারক একটু নড়িয়া-চড়িয়া বসিয়া কণ্ঠস্বরে আবেগ আনিয়া বলিতে লাগিল, শিশু বয়সে মাকে হারিয়েচি জ্ঞান হবার আগেই, চিনতাম কেবলমাত্র বাবাকে। বাবাই আমাকে নিজ হাতে মানুষ করেছিলেন, বড় করেছিলেন। সেই বাবা যখন আত্মস্থ লোভে এনে দিলেন মাতৃহারা সন্তানকে এক বিমাতা, সেইদিনই দুঃখে অভিমানে ঘৃণার চলে এসেছিলাম দেশত্যাগী হয়ে। বাপের মুখ আর দেখিনি, দেশেরও নয়। আপনাকে পেয়ে মা, জীবনে নতুন করে পেলাম পিতৃ-মাতৃস্নেহের আস্বাদ। আমার কাছে আপনি মা ছাড়া অন্য আর কিছুই নয়। আপনার জীবনে যে ঝড়, যে আঘাত, যে গুরুতর পরীক্ষাই এসে থাক না, আপনার হৃদয়ের অপরিমের মাতৃস্নেহকে তা বিন্দুমাত্র শোষণ করতে পারেনি। সন্তানের পক্ষে এইটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া।

সবিতা বলিলেন, তোমার বাবা এখনও জীবিত? তবে যে তুমি একদিক আমাকে বলেছিলে তুমি পিতৃমাতৃহীন?

তারক হাসিয়া কহিল, ঠিক বলেচি মা। আমার জন্মদাতা হয়তো আজও জীবিত থাকতে পারেন, আমার বাবা কিন্তু জীবিত নেই। পিতার মৃত্যু না ঘটলে মাতৃহারা অভাগা সন্তানের জীবনে বিমাতার আবির্ভাব ঘটে না, এই-ই আমার বিশ্বাস।

সবিতা বিস্মিত-নেত্রে তারকের পানে তাকাইয়া রহিলেন।

তারক বলিতে লাগিল, জীবনে আমার বৃহৎ আশা ও উচ্চ আকাঙ্ক্ষা অনেক। শুয়ে খেয়ে-পরে কোনরকমে জীবনধারণ করে বেঁচে থাকতে চাইনে। আমি চাই প্রাচুর্য্যের মধ্যে ঐশ্বর্য্যের মধ্যে সার্থক সুন্দর জীবন নিয়ে বাঁচতে। হাজার জনের মাঝখানে আমার প্রতি সবার দৃষ্টি পড়বে, হাজার নামের মাঝখানে আমার নামটি চিনতে পারবে সকলেই। কর্ম্মজীবনের সার্থকতায়, যশে গৌরবে, সম্মানে প্রতিপত্তিতে উন্নত বৃহৎ জীবন নিয়ে বাঁচবো এই আমি চাই। শুধু অর্থ উপার্জ্জনই জীবনের একান্ত কামনা নয়, শুধু স্বাচ্ছন্দ্য-জীবিকানির্ব্বাহই আমার চরম লক্ষ্য নয়!

সবিতা স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিলেন, এ তো খুব ভালো বাবা! পুরুষমানুষের জীবনে এমনিতরই উচ্চ-আকাঙ্ক্ষার প্রয়োজন। লক্ষ্য থাকবে যত উঁচু, যত বিস্তৃত—জীবনও হবে তত প্রসারিত।

তারক উৎসাহিত হইয়া বলিল, আপনাকে তো জানিয়েচি মা, কত দুঃখে-কষ্টে, কত বাধায়, নিজে আত্মনির্ভর হয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাপগুলো উত্তীর্ণ হয়েচি। আমি বড় জেদী মা। যা করবো বলে সঙ্কল্প করি–বিশ্রাম থাকে না আমার, যে পর্য্যন্ত না তা সিদ্ধ হয়।

সবিতা স্মিত-মুখে তারকের যৌবনোচিত আশা-আকাঙ্ক্ষায় উৎসাহদীপ্ত মুখখানির পানে তাকাইয়া অন্য-মনে কি ভাবিতে লাগিলেন।

তারক বলিতে লাগিল, আমার জীবনের সমস্ত কাহিনী একমাত্র আপনাকে খুলে বলেচি মা। কি জানি কেন এক এক সময়ে মনে হয়, জীবনে বুঝি কিছুই পাইনি, কিছুই পেলাম না। মনে হয় যদি কোনদিন লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জ্জন করি, তাতে আর কি লাভ হবে? যশেও যদি দেশদেশান্তর ভরে যায়, তাতেই বা কি? সম্মান-প্রতিপত্তির সবচেয়ে উঁচু চূড়াতে উঠলেও কি আমার আশৈশবের অতৃপ্ত তৃষ্ণা মিটবে? চিরদিন যে-অভিমান যে-দুঃখ নিজের গোপন অন্তরের মধ্যেই একাকী বহন করলাম, বিধাতার কাছে পৰ্য্যন্ত জানালাম না অভিযোগ, সে-বেদনা কি কোনদিন দূর হবে আমার অর্থ মান যশ বা কৰ্ম্মজীবনের চরিতার্থতা দিয়ে? সমস্ত প্রাণ যেন হা হা করে ওঠে, মূশড়ে পড়ে যা-কিছু কর্ম্মের উৎসাহ আকাঙ্ক্ষার উদ্দীপনা। মনে হয়েচে, অদৃষ্ট দেবতা যে মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে শৈশবেই করেচেন মাতৃস্নেহে বঞ্চিত, সে যে কতবড় দুর্ভাগ্য নিয়ে মানুষের হাটে এসেচে, সে-কথা কাউকে বুঝিয়ে বলবার অপেক্ষা করে না। জীবজগতের স্রষ্টার সর্ব্বশ্রেষ্ঠ দান মাতৃস্নেহ, সেই স্নেহেই যে আজীবন বঞ্চিত, তার আর বেদনার আবেগে তারকের কণ্ঠ অবরুদ্ধ হইয়া আসিল।

সবিতার চোখের কোণ সজল হইয়া উঠিয়াছিল। তিনি কিছুই বলিলেন না, সান্ত্বনাও দিলেন না। মুখে সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল সহানুভূতির ছায়া। যে নিবিড় বেদনা তিনি নিঃশব্দে অতি সঙ্গোপনে অন্তরের নিভৃতে একাকী বহন করিয়া আসিতেছেন, সুদীর্ঘকাল ব্যাপিয়া তাহার সেই বেদনাস্থানই তারক করিয়াছে আজ অজ্ঞাতে স্পর্শ। তারকের শেষের কথা কয়টি সবিতার সমগ্র অন্তর আলোড়িত করিয়া তুলিয়াছিল। নিঃশব্দে নত-নয়নে তিনি নিজের অশান্ত হৃদয়াবেগ সংযত করিতে লাগিলেন।

সদর দরজায় পিওন হাঁকিল– চিঠি –

তারক বাহিরে গিয়া পত্ৰ লইয়া আসিল।

সবিতার নামে চিঠি। সারদা লিখিয়াছে। সংবাদ দিয়াছে, বিমলবাবুর সহিত রাজুর দেখা হইয়াছিল রাস্তায়। তাঁহার মুখে বিমলবাবু সংবাদ পাইয়াছেন— দেশে কন্যাসহ ব্রজবাবু কুশলেই আছেন।

সবিতা পত্র পাঠ করিয়া হাসিয়া বলিলেন, রাজু বোধহয় সারদার সঙ্গে দেখা করতে আসে না। আসবেই বা কি করে, সে হয়তো জানেই না সারদা হরিণপুরে আসেনি।

তারক কথা কহিল না।

সবিতা আবার বলিলেন, দেখি, আমিই না হয় তাকে একখানা চিঠি লিখে দিই। এক কাজ করো না তারক, তুমি তাকে এখানে আসবার নিমন্ত্রণ করে চিঠি লেখো, আমিও তার সঙ্গে লিখে দেবো এখানে আসতে। এখানে সে এলে তোমাদের দুই বন্ধুর মান-অভিমানের মীমাংসা হয়ে যাবে।

তারক বলিল, বেশ তো। আমি লিখে দিচ্চি আজই।

সবিতা স্নেহস্নিগ্ধ-কণ্ঠে কহিলেন, রাজু আমার বড় অভিমানী ছেলে। কিন্তু তার অন্তরের তুলনা কোথাও দেখলাম না।

কথাটা সবিতা বলিলেন এমনই সহজভাবেই, কিন্তু তারকের চিত্তে ইহা অন্য অর্থে আঘাত করিল। তাহার মনে হইতে লাগিল নতুন মা বোধহয় তাহারই অন্তঃকরণের সহিত তুলনা করিয়া রাজুর সম্বন্ধে এই কথা বলিলেন। তাহার মুখ হইয়া উঠিল অন্ধকার, বাক্য হইয়া গেল নিস্তব্ধ।

সবিতা তাহা লক্ষ্য না করিয়াই বিগলিতকণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, রাজুর কথা যখন ভাবি তারক, তখন মনে হয়, আমার রাজু বেশি স্নেহের ধন, না রেণু? রাজু আর রেণু ওদের দুজনের মধ্যে কে বেশি আর কে কম আমি ঠিক করে উঠতে পারিনে।

তারক বলিয়া উঠিল, নিজের অন্তর তা হলে এখনও আপনি চেনেননি মা। রেণুর সঙ্গে রাজুর কোন তুলনাই হতে পারে না।

সবিতা বলিলেন, কেন বলো তো?

রাজুকে আপনি যতই আপন সন্তানের তুল্য ভাবুন না কেন, তবু সেটা আপন সন্তানের তুল্যই থেকে যাবে। তুল্য বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ আপন সন্তান হয়ে উঠবে না, উঠতে পারেও না।

সবিতা বলিলেন, সকল ক্ষেত্রে সব ব্যাপার একরকম হয় না তারক।

তা জানি মা। তবু বলি শুনুন। আপনি নিজেই বিচার করে দেখুন, আপনার অন্তরের স্নেহাধিকারে রেণু আর রাজুর সমান দাবি যতই থাক্ না, পার্থক্য যে কত বেশি তা দেখিয়ে দিচ্চি। ধরুন, আপনার এই হরিণপুরে আসা। রওনা হবার আগের রাত্রে শুনলাম, রাখাল আপনাকে নিষেধ করেছিল হরিণপুরে আসতে। আপনি নাকি বলেছিলেন— ছেলে বড় হলে তার সম্মতি নেওয়া দরকার। তাই শুনে সে অসম্মতিই জানিয়েছিল, আপনি তা ঠেলে এলেন আমার এখানে। কিন্তু মা, রেণু যদি আপনার এখানে আসার এতটুকু অনিচ্ছার আভাসমাত্র জানাতো, আপনি হরিণপুরে আসা তখনই বন্ধ করে দিতেন নিশ্চয়।

সবিতা একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, আমি জানতাম তারক, রাজু কেবল মাত্র অভিমান বশে রাগ করেই আমাকে আসতে নিষেধ করেছিল। ওটা তার তর্ক বা জেদ মাত্র। সত্যি-সত্যিই যদি আমাকে এখানে পাঠাবার তার অনিচ্ছা থাকতো, তা হলে আমি কখনই আসতে পারতাম না বাবা।

কিন্তু ধরুন, রেণু যদি কেবলমাত্র জেদ কিংবা তর্ক করেই আপনাকে কোনখানে যেতে নিষেধ করতো, আপনি তার সেই তর্ক ও জেদের খাতির না রেখে পারতেন কি মা?

সবিতা মৌন হইয়া রহিলেন। বহুক্ষণ পরে ধীরে ধীরে বলিলেন, তুমি ঠিকই বলেচ তারক। মানুষ নিজের অন্তরকেই বোধ হয় সবচেয়ে কম চেনে।

তবে একটা কথা। রাজু আমার কাছে রেণুর বাড়া না হতে পারে, আমি কিন্তু রাজুর কাছে মায়ের বাড়া। আমার দিক দিয়ে না হোক, রাজুর নিজের দিক দিয়ে কিন্তু ও আমার রেণুরও বাড়া। এখানে আমার ভুল হয়নি।

তারক চুপ করিয়া রহিল। ক্ষণকাল পরে প্রসঙ্গান্তর উত্থাপন করিয়া কহিল, বিমলবাবুর চিঠি তো কই এলো না মা আজও।

সবিতা বলিলেন, তুমি কি তাঁকে সম্প্রতি চিঠি লিখেচ।

লিখেচি বৈ কি! আপনাকে তিনি চিঠি দেননি বোধ হয় আট-দশদিন হবে। তাই নয় কি?

হাঁ। কিন্তু আমি তার আগের চিঠির জবাব এখনও পৰ্য্যন্ত দিইনি। সেইজন্যই বোধ হয় আমাকে চিঠি লেখেননি। কারণ, তিনি কুশলে আছেন, সারদার পত্রে তো তা জানতেই পাচ্চি।

তারক উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে কহিল, ঐ একটি মানুষ দেখলাম মা, যার পায়ের কাছে আপনিই মাথা নীচু হয়ে আসে।

সবিতা জবাব দিলেন না।

তারক আপনা-আপনিই বলিতে লাগিল, কি মহৎ মন, উদার চরিত্র, সুন্দর মানুষ। প্রকৃত কর্মবীর। জীবনে এমন সার্থককাম পুরুষ অল্পই চোখে পড়ে।

সবিতা মৃদু হাসিয়া বলিলেন, ও-কথা কি হিসাবে বলচো তারক? একমাত্র আর্থিক উন্নতি ভিন্ন সংসারে আর কোন চরিতার্থতা লাভ করেচেন? কি-ই বা বড়ো আনন্দ সঞ্চয় করতে পেরেচেন সারা জীবনে?

তারক উচ্ছ্বাসের ঝোঁকে বলিয়া ফেলিল, যে পুরুষ নিজেরই সামর্থ্যে অমন বিপুল অর্থ অনায়াসে উপার্জ্জন করতে পারেন, এমন প্রকাণ্ড ব্যবসায় গড়ে তুলতে পারেন, তাঁর জীবনে অন্য ছোটখাটো সার্থকতা কিছু ঘটুক বা না ঘটুক তা নিয়ে আক্ষেপ নেই মা। পুরুষমানুষের কর্ম্মময় জীবনের এইরকম বিরাট সার্থকতার চেয়ে আর অন্য কি কাম্য থাকতে পারে বলুন?

সবিতা হাসিলেন, জবাব দিলেন না। তারকের মুখে পুরুষমানুষের জীবনে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও উচ্চ আদর্শ সম্বন্ধে এ-পর্য্যন্ত তিনি অনেক বড় বড় কথা ও বৃহত্তর কল্পনাই শুনিয়া আসিতেছিলেন; কিন্তু তাহার নিজের ব্যক্তিগত জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষার সার্থকতার লক্ষ্য কোন্ পথে, তা সে কোনদিনও স্পষ্ট করিয়া নির্দ্দেশ করিতে পারে নাই বা করে নাই।

সবিতা তারকের জীবনের প্রধান লক্ষ্য এবং আশা-আকাঙ্ক্ষার স্বরূপের ঈষৎ আভাস এইবার যেন দেখিতে পাইলেন। তাঁহার চিন্তাধারা কেমন এক অনির্দ্দিষ্ট শূন্যতার মধ্যে হারাইয়া গেল।

শিবুর মা আসিয়া ডাকিল, মা, বেলা হয়ে যাচ্চে, রান্না চড়াবেন চলুন।

তারক বলিল, অনেকদিনই তো মায়ের হাতে অমৃত প্রসাদ পেলাম। এইবার রাঁধুনিটাকে হাঁড়ি ধরতে অনুমতি দিন! এই দারুণ গরমে আগুন-তাতে আপনার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়বে।

সবিতা হাসিয়া বলিলেন, আগুন তাতে রান্না করলে বাঙালী মেয়েদের স্বাস্থ্য ভাঙে না তারক, উন্নতি হয়।

সে সাধারণ বাঙালী মেয়েদের হতে পারে মা, আপনি তাদের দলে ন’ন আমি জানি।

তুমি কিচ্ছু জানো না বাছা।

না মা, আমি শুনবো না, কলকাতার বাসায় আপনার রাঁধুনি-বামুন ছিল দেখেচি। এখানে কেন আপনি রাঁধুনির হাতে খাবেন না বলুন তো? রাঁধুনীর হাতে প্রবৃত্তি হয় না এটা আপনার বাজে ওজর। আসল কথা, নিজে পরিশ্রম করতে চান।

তাই যদি হয় তারক; তাতে আপত্তি কেন বাবা?

অকৃত্রিম আন্তরিকতায় প্রবলবেগে মাথা নাড়িয়া তারক কহিল, না তা হয় না; আমার রাজরাজেশ্বরী মাকে আমি প্রতিদিন রাঁধতে, বাটনা বাটতে, কাপড় কাচতে দিতে পারবো না। এ সত্যিই আপনার কাজ নয় যে মা!

সবিতার চক্ষুদ্বয় সজল হইয়া উঠিল। একান্ত অন্যমনস্কচিত্তে কি যেন ভাবিতে লাগিলেন, কিছুই বলিলেন না।

তারক বলিল, আজ থেকে ঝি আর রাঁধুনি আপনার কাজ করবে, আমি বলে দিচ্চি ওদের। আর আপনার এ-সব অত্যাচার চলবে না কিন্তু।

সবিতা সকরুণ হাসিয়া কহিলেন, তারক, আমার ’পরেই অত্যাচার হবে বাবা, যদি আমাকে এইটুকু কাজকর্ম্মও করতে না দাও। আমি তোমাকে স্পষ্ট বলচি, রাঁধুনীর রান্না আর আমায় গলা দিয়ে নামবে না। দাসী-চাকরের সেবা গায়ে আমার বিছুটির চাবুক মারবে। এ জেনেও যদি তুমি আমার নিজের কাজের জন্য চাকর-চাকরানী বহাল করতে চাও, আমি নিরুপায়!

তারক বিশ্বাভিভূত হইয়া কহিল, আপনি কি চিরদিনই এমনিভাবে নিজের সমস্ত কাজ নিজেই করবেন মা?

সবিতা কহিলেন, চিরদিন করবো কি-না জানিনে বাবা। তবে আজকে আমি পারচিনে সইতে দাসদাসীর সেবা, এইটুকুমাত্র বলতে পারি। ঈশ্বর যদি কখনও মুখ তুলে চান, তোমারই কাছে আবার এক সময় এসে খাটে পালঙ্কে বসে চাকর-দাসীর সেবা নেবো বাবা।

তারক সবিতার কথার রহস্যভেদ করিতে পারিল না, দুঃখিত-চিত্তে নিৰ্ব্বাক্ হইয়া রহিল।

অনেকক্ষণ পরে ধীরে ধীরে কহিল, মা, মানুষকে মানুষ ছোট ভাবে কি করে, তাই ভাবি। আমি কিন্তু মানুষের পরিচয় একমাত্র মানুষ ছাড়া জাত-গোত্র-কুল-শীল দিয়ে আলাদা করে ভাবতে পারিনে। সেইজন্য আমার কাছে মুসলমান, খ্ৰীষ্টান, ব্ৰাহ্মণ, বৌদ্ধ, বৈষ্ণব, শাক্ত সমস্তই সমান।

সবিতার বিষাদ-গম্ভীর মুখে আনন্দের আভা ফুটিয়া উঠিল। তিনি বলিলেন, আমি তা জানি তারক। তোমার অন্তঃকরণ কত যে উঁচু ও উদার, তোমার সঙ্গে পরিচিত হবার পূর্ব্বেই তা জেনেচি। তোমাকে আমি স্নেহ করি, বিশ্বাস করি বাবা।

তারক বিস্ময় ও কৌতূহলমিশ্রিত কণ্ঠে কহিল, আমাকে দেখার আগে থেকেই আমার পরিচয় জেনেছিলেন মা? কই, এতদিন তো বলেননি।

সবিতা সন্নেহে হাসিলেন।

তারক কহিল, কিন্তু যার কাছে আমার কথা শুনে থাকুন না কেন, আমি যে বিশ্বাসের উপযুক্ত তা কি করে জানলেন বলুন তো?

মমতাকোমল-কণ্ঠে সবিতা বলিলেন, কি করে যে জানলাম, তা নাইবা শুনলে বাবা! তবে জেনেচি বলেই তোমার স্নেহের আহ্বান রাখতে রাজুরও মনে ব্যথা দিয়ে এখানে এসেচি, এতে কোনও ভুল নেই।

তারক অভিভূত-স্বরে কহিল, আমাকে এত স্নেহ এত বিশ্বাস করেন মা?

সবিতা গম্ভীরকণ্ঠে বলিলেন, শুধু বিশ্বাস নয় বাবা, তারও চেয়ে বড় কথা, তোমার উপরে নির্ভর করার সাহস আমি পেয়েচি। তুমি তো জানো তারক, আমার ছেলে নেই। রাজু আমার ছেলের অভাব পূর্ণ করলেও এখনও কিছু অপূর্ণ আছে। তোমাকে সে শূন্যতা পূর্ণ করতে হবে বাবা।

তারক বিস্ময়-বিমুঢ়-চিত্তে অভিভূতের মত চাহিয়া রহিল।