বাইশ
শীতের সন্ধ্যা। কলিকাতার সরু গলির মধ্যে একখানি একতলা বাড়ির দুয়ার-ভেজানো ঘরে রেণু হ্যারিকেন-লণ্ঠনের সামনে বসিয়া পশমের ছোট টুপি বুনিতেছিল। দুয়ারের বাহির হইতে সারদার অনুচ্চ কণ্ঠ শোনা গেল, দিদি—
রেণু সাড়া দিল,—এসো—
সারদা দরজা ঠেলিয়া ঘরে প্রবেশ করিল। তাহার পিছনে প্রকাণ্ড ধামা লইয়া দাসী।
রেণু তাহাকে দেখিয়া সারদার দিকে চাহিতেই সারদা বলিল, গোবিন্দজীর জন্য মা কিছু ফল-মূল তরি-তরকারি আর তাল মাখন পাঠিয়েছেন।
রেণুর চোখের দৃষ্টি প্রখর হইয়া উঠিল। অল্পক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া ধীর-কণ্ঠে কহিল, সারদাদিদি, ও তো আমরা নিতে পারবো না।
সারদা কুণ্ঠিত-কণ্ঠে কৈফিয়তের সুরে কহিল, সে কি দিদি, এ তো তোমাদের জন্য নয়। এ যে গোবিন্দজীর—
রেণু সারদার কথা শেষ হইতে না দিয়া শান্ত-গলায় কহিল, গোবিন্দজীকে উপলক্ষ করে মা সব আমাদেরই পাঠিয়েচেন। এ তুমিও জানো, আমিও জানি সারদাদিদি— কিন্তু এ নেওয়ার উপায় নেই, মাকে বলো তিনি যেন আমাদের ক্ষমা করেন।
শান্ত কণ্ঠের এই সহজ কথা কয়টির পিছনে কতখানি সুনিশ্চিত অটলতা আছে তাহা সারদার বুঝিতে ভুল হইল না। দাসীকে ইঙ্গিতে ঘরের বাহিরে অপেক্ষা করিতে বলিয়া সারদা রেণুর কাছে আসিয়া বসিল। জিজ্ঞাসা করিল, কাকাবাবু ভাল আছেন তো?
রেণু হাতের পশমের কাজটা শেষ করিতে করিতে জবাব দিল, হাঁ।
অনেকক্ষণ স্তব্ধতার মধ্য দিয়া উত্তীর্ণ হইয়া গেল, কহিবার মতো কোনও কথা খুঁজিয়া না পাইয়া সারদা মনে মনে সঙ্কোচ অনুভব করিতেছিল। তাই উঠি উঠি ভাবিতেছে, এমন সময়ে রেণুই কথা কহিল। উলের টুপি বুনিতে বুনিতে মৃদু-কণ্ঠে কহিল, সারদাদিদি, মাকে বুঝিয়ে ব’লো তিনি যেন মনে কষ্ট না পান। আমার জন্য তাঁকে মনের মধ্যে দুঃখ-দুর্ভাবনা রাখতে মানা ক’রো। যা হবার নয় তা যে হয় না, তিনি আমার চেয়ে ভালই জানেন। দুঃখ-মোচনের চেষ্টায় উভয় পক্ষেরই দঃখের বোঝা ভারী হয়ে উঠবে মাত্র।
সারদা নির্ব্বাক হইয়া রহিল। মনে হইতে লাগিল ঐ কৰ্ম্মনিবিষ্টা নতনেত্রা মেয়েটি তাহার অত্যন্ত নিকটে থাকিয়াও অতিশয় সুদূর হইতে শান্ত কথা কয়টি যেন বলিয়া পাঠাইল।
আরও কতক্ষণ সময় কাটিয়া গেলে সারদা একটু ইতস্ততঃ করিয়া কহিল, আমি তা হলে আজ যাই ভাই?
মাথা হেলাইয়া ইসারায় রেণু সম্মতি জানাইল।
রেণু একইভাবে অখণ্ড মনযোগের সহিত উলের ক্ষুদ্র টুপিটি ক্ষিপ্র হস্তে বুনিতে লাগিল। রাত্রের মধ্যেই এটি শেষ করিয়া ফেলিয়া একজোড়া ছোট মোজা ধরিতে হইবে।
প্রায় সাত-আট মাস হইল ব্রজবাবু গ্রামের বাড়ি ছাড়িয়া কলিকাতার আসিয়া বাস করিতেছেন। বিমলবাবুর ভাড়া করা ভালো বাসায় রেণু কিছুতেই যাইতে চাহে নাই। ব্রজবাবু অনেকটা সুস্থ হইয়া ওঠাতে রেণু জেদ করিয়া অল্প ভাড়ায় ছোট একটি একতলা বাসায় আসিয়াছে। পিতার অনুরোধে অসহায় অবস্থায় বাধ্য হইয়া অপরের সাহায্য গ্রহণ করিতে হইয়াছে বলিয়া বরাবর অন্যের মুখাপেক্ষী হইয়া থাকিতে সে অসম্মত। এই নীরব-প্রকৃতি সুশীলা মেয়েটির সম্মতি-অসম্মতি যে কত সুদৃঢ় হল এই ঘটনার পর তাহা সকলেই বুঝিতে সমর্থ হইয়াছে।
রেণু অল্প মাহিনার একটা ঠিকা ঝি রাখিয়াছে। সংসারের কাজকর্ম্ম ও দেবসেবার অবকাশে সে নিজে ছোট শিশুদের জন্য জাঙিয়া, পেনি, ফ্রক, প্রভৃতি সেলাই করে। উলের মোজা, টুপি, সোয়েটার বোনে। আচার, জেলি ও বড়ি তৈয়ারী করিয়া ঠিকা ঝির সাহায্যে দোকানে বিক্রয়ের জন্য পাঠাইয়া দেয়।
খোলা ছাদের উপরে করোগেট টিনের ছাদযুক্ত একটি সিঁড়ির ঘর আছে; সে ঘরখানি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করিয়া ঠাকুর-ঘর করা হইয়াছে। ব্রজবাবু স্নানাহার ও নিদ্রার সময় ব্যতীত সর্বক্ষণ এই পূজা-ঘরেই যাপন করেন। সংসার কি করিয়া চলিতেছিল, কোথা হইতে খরচ আসিতেছে সংবাদ জানিতে চান না, জানিতে ভয় পান। রেণু ছাড়া আর কাহারও সহিত বড় কথাবার্ত্তা বা দেখা-সাক্ষাৎও করেন না। সারদা আশঙ্কা করিয়াছিল দ্রব্যসামগ্রী ফেরত আসায় সবিতার অত্যন্ত আঘাত লাগিবে। তাই বাড়ি পৌঁছিয়া দ্রব্যসামগ্রীপূর্ণ ধামাটি নিঃশব্দে একতলায় ভাঁড়ার ঘরে তুলিয়া রাখিয়া উপরে উঠিয়া গেল।
সবিতা নিজের ঘরে বসিয়া পঞ্জিকার পাতা উল্টাইতেছিলেন। সারদাকে দেখিয়া সপ্রশ্ন-চক্ষে তাকাইলেন।
ঘরের মেঝেতে সবিতার নিকট বসিয়া পড়িয়া সারদা বলিল, কাকাবাবু ভাল আছেন মা।
রেণু?
রেণুও ভালো আছে।
সবিতা আর কোন প্রশ্ন না করিয়া পঞ্জিকার পাতায় পুনরায় মনসংযোগ করিলেন।
সারদা বিস্মিত হইল। অন্যদিন রেণুর সহিত দেখা করিয়া বাড়ি ফিরিলে দেখিতে পায় সবিতা উৎকন্ঠিত প্রতীক্ষায় তাহার পথ চাহিয়া আছেন। তার পরে কতই না সতৃষ্ণ আগ্রহে একটির পর একটি প্রশ্ন করিয়া সমস্ত খুঁটিয়া খুঁটিয়া জানিতে চাহেন। রেণু কি করিতেছিল, কি কি কথা কহিল, তার চুল বাধা হইয়াছিল কি-না, কাপড় কাচা হইয়াছিল কি-না, রেণু আগের চেয়ে রোগা হইয়া গিয়াছে, না তেমনই আছে, ইত্যাদি। ব্রজবাবু অপেক্ষা রেণুর সম্বন্ধেই সবিতা অনেক কিছু জানিতে চাহেন, ইহাও সারদা লক্ষ্য করিয়াছে।
কতক্ষণ চুপচাপ কাটিয়া গেল। সারদা আপনা আপনিই বলিতে লাগিল, ওদের অভাব এমন কিছু বেশি নয় মা, যার জন্য আপনি এত বেশি ভাবচেন। দুটি মাত্র প্রাণী। খরচই বা কি, কাজই বা কি? ইচ্ছে করেই তাই রেণু রাঁধুনি রাখেনি। সংসারে অনটন তো কিছুই দেখলাম না।
সবিতা পঞ্জিকার একটি পাতার কোন মুড়িয়া চিহ্ন রাখিয়া বইখানি বন্ধ করিলেন। সারদার মুখের পানে পূর্ণদৃষ্টিতে চাহিয়া মৃদুহাস্যে বলিলেন, তা যেন ওদের না-ই রইল। কিন্তু তুমি জিনিসের ধামাটা কোথায় লুকিয়ে রেখে এলে সারদা?
সারদা থতমত খাইয়া গেল। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে লক্ষ্য করিয়া দেখিল সবিতার মুখে বেদনার চিহ্নমাত্র নাই। বরং ঠোঁটের প্রান্তে চাপা হাসির রেখা।
সবিতা বলিলেন, তুমি বুঝি এই ভেবে ভয় পেয়েচো সারদা যে, জিনিস ফেরত এসেচে শুনে তোমাদের মা দুঃখে ক্ষোভে শয্যাশায়ী হয়ে পড়বেন, নয়?
সারদা লজ্জিত হইয়া বলিল, না তা ঠিক ভাবিনি। তবে—হয়তো মনে খুবই আঘাত পাবেন ভয় হয়েছিল।
সবিতা সস্নেহে সারদার পিঠে মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিলেন, বোকা মেয়ে! তোমার মতন করে মায়ের হৃদয়টার দিকেই কেবলমাত্র তাকিয়ে মাকে ভালবাসতে সবাই কি শিখেচে? এ নিয়ে তো রেণুর উপরে রাগ করতে পারিনে মা, তার দোষ নেই কিছু।
সে কথা আর আপনাকে বলতে হবে না। রেণু যে আপনারই মেয়ে, আজ যেন তা সবচেয়ে স্পষ্ট করে দেখে এলাম মা।
সবিতা সে কথা এড়াইয়া গিয়া সহজ সুরে কহিলেন, কি বলে তোমায় ফেরালে সে আজ?
সারদা আনুপূর্ব্বিক বিবরণ জানাইয়া শেষে বলিল, আচ্ছা মা, একটা কথা জিজ্ঞেস করি, আপনি কি ফেরত আসবে জেনেই জিনিস পাঠিয়েছিলেন?
সবিতা মাথা নাড়িয়া ইঙ্গিতে জানাইলেন, না। তার পর জিজ্ঞাসা করিলেন, সারদা ঠিক করে বলো তো মা, সত্যিই কি ওদের কোনও অভাব-অনটন নেই দেখে এলে?
ভিতরের কথা কি করে জানবো মা?
দেখে কি মনে হ’লো?
সারদা নতশিরে নিরুত্তর রহিল।
সবিতা আর প্রশ্ন করিলেন না। তাঁহার প্রশান্ত মুখমণ্ডলে চিন্তার কালো ছায়া ঘনাইয়া উঠিল ৷
কিছুক্ষণ পরে সবিতা প্রশ্ন করিলেন, আজ যখন তুমি গেলে, সে তখন কি করছিলো?
উলের টুপি বুনছিলো।
সবিতার মুখে বেদনার চিহ্ন সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল। ক্লিষ্ট-কণ্ঠে কহিলেন, আমি চেষ্টা করেছিলাম রাজুকে দিয়ে ওর ঐ উলের সামগ্রী কেনবার। সে রাজুকে বেচতে চায়নি।
কেন মা?
রাজু যে-দামে ওকে বেচে দিতে চেয়েছিল, সে-দাম নিতে রাজি হয়নি। বলেছিল, এ তোমাদের সাহায্য করার ফন্দি।
সারদা স্তব্ধ হইয়া রহিল। সবিতার শান্ত-গম্ভীর মূর্ত্তির পানে তাকাইয়া মনে মনে ভাবিতে লাগিল, ঐ স্থির প্রশান্তির অন্তরালে কি বিক্ষুব্ধ ঝটিকাই না বহিয়া চলিয়াছে সংসারে কেহই তাহার সন্ধান জানে না।
সারদা বলিল, মা, শুনেছিলাম রেণুর জন্য একটি ভাল ডাক্তার পাত্রের সন্ধান এনেছিলেন দেব্তা। সে সম্বন্ধের কি—
উদ্গত দীর্ঘশ্বাস চাপিয়া সবিতা বলিলেন, সে হ’লো না। মেয়ে বিয়ে করবে না পণ করেচে।
সারদা আস্তে আস্তে বলিল, এমন বুদ্ধিমতী মেয়ে হয়েও সে—
তাহার কথা শেষ হইবার পূর্ব্বেই সবিতা বলিলেন, সে নাকি বলেচে, হিঁদুর মেয়ের দু’বার গায়ে হলুদ হয় না। বাগ্দত্তা মেয়েও বিবাহিতার সামিল। আমার বিবাহের ব্যাপার বাগ্দানের পর অনেকদূর পর্য্যন্ত এগিয়েছিল। এখন আবার দু’বার করে সে ব্যাপারগুলো হোক এটা আমি চাইনে। তোমরা আমার বিয়ের চেষ্টা ক’রো না রাজুদা, ওতে আমার মঙ্গল হবে না আমি জেনেচি।
সবিতা চুপ করিলে সারদা ব্যাকুল-কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, তাই যদি মেয়ের মত, তা হলে না হয় সেই পাত্রেই রেণুর বিয়ের চেষ্টা করুন না, যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে ওর গায়ে-হলুদ পর্য্যন্ত শেষ হয়েছিল। ভাগ্যে থাকলে স্বামী হয়তো পাগল না-ও হতে পারে।
সবিতা ম্লান হাসিয়া বলিলেন, সেই পাত্রেরই সঙ্গে সাত-আটমাস আগে রেণুর বৈমাত্র-বোন রাণীর বিয়ে হয়ে গেছে।
শুনিয়া সারদা স্তম্ভিত হইয়া গেল।
একটা মৰ্ম্মভেদী দীর্ঘশ্বাসের সহিত সবিতা বলিলেন, আমার ভুলেই এমনটা হ’লো।
সারদা নিষ্পলক-নেত্রে সবিতার মুখের পানে চাহিয়া রহিল।
সবিতা মৃদুস্বরে স্বগতভাবেই বলিতে লাগিলেন, এত শীঘ্র গৃহহীন হয়ে হয়তো বা ওদের পথে দাঁড়াতেও হ’তো না, আমি যদি না অমন জেদ করে রেণুর বিয়ে বন্ধ করতাম। অবশ্য পথে ওদের একদিন-না-একদিন নামতে হতোই, আমি সেটা এগিয়ে দিয়েছি মাত্র। অন্ততঃ রেণুর বিমাতা এত সহজেই চট করে সম্পত্তির অংশ ভাগ করে নিয়ে পৃথক হয়ে যাওয়ার অছিলা পেতেন না।
শিবুর মা আসিয়া ডাকিল, মা, দাদাবাবু ভিতর-বাড়িতে এসেচেন, তাঁর খাবার দেবেন চলুন। রাত হয়ে যাচ্চে।
সারদা ত্বরিতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আপনাকে যেতে হবে না মা, আমিই তারকবাবুর খাবার দিচ্চি গিয়ে, আপনি বরং একটু বিশ্রাম করুন।
না সারদা, চলো আমিও যাই। সে ব্যস্ত হবে, খাওয়ার কাছে আমাকে দেখতে না পেলে।
সারদার সহিত সবিতাও নীচে নামিয়া গেলেন।
হরিণপুর হইতে ফিরিয়া আসিয়া সবিতা বাসা বদলাইয়াছেন। রমনীবাবুর সেই পুরাতন বাড়িতে প্রবেশ করিতে আর প্রবৃত্তি হয় নাই। নিয়মিত দুর্লঙ্ঘ্য বিধানে সুদীর্ঘ বারো বৎসরের অধিককাল যেখানে প্রতি পদে আত্মহত্যার দুৰ্ব্বিসহ যন্ত্রণা ভোগ করিয়াও, আচ্ছন্নতার মধ্যে অর্দ্ধ অচেতনবৎ কাটাইতে হইয়াছে, আজ সেই বাড়িখানির দিকে তাকাইতেও আতঙ্কে শরীর শিহরিয়া ওঠে। অথচ ঐ বাড়ি হইতেই আশ্রয়-চ্যুতির সম্ভাবনায় এই সেদিনও তো তাঁহাকে ভাবনায় দিশাহারা হইতে হইয়াছিল। দীর্ঘকাল নিজের রুচিকে নিষ্ঠুরভাবে নিষ্পেষিত করিয়া, স্বভাবের বিপরীত স্রোতে অগ্রসর হওয়ার ফলে যে অপরিসীম শ্রান্তিতে তিনি অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছিলেন, সে ভার ক্রমেই দিনের পর দিন দুঃসহ হইয়া উঠিতেছিল।
বিমলবাবু যে বাড়িখানি ব্রজবাবু ও রেণুর জন্য ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলেন, সবিতা সেই বাড়িটিতে উঠিয়াছেন। বিমলবাবু কলিকাতায় নাই। ব্যবসায়-সংক্রান্ত জরুরী টেলিগ্রাম আসায় সিঙ্গাপুরে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়াছেন। সবিতার দেখাশুনার ভার লইয়া রাখালকে এই নূতন বাসায় থাকিবার জন্য বিমলবাবু অনুরোধ করিয়াছিলেন। নতুন-মার তত্ত্বাবধান-ভার লইতে সম্মত হইলেও তাঁহার বাসায় বসবাস করিতে রাখাল অক্ষমতা জানাইয়াছিল। বিমলবাবুর নিকট এ সংবাদ শুনিয়া তারক স্বেচ্ছায় নতুন-মার বাসায় থাকিয়া তাঁহার তত্ত্বাবধানের ভার গ্রহণ করিয়াছে।
সবিতার আনুকূল্যে তারক বর্দ্ধমানের স্কুল মাস্টারি ছাড়িয়া দিয়া হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করিয়াছে। একতলায় বহির্ব্বাটীতে তাহার বসিবার ঘর আইনজীবীর প্রয়োজনীয় উপযুক্ত আসবাবপত্রে নিখুঁতভাবে সাজাইয়া দেওয়া হইয়াছে। বিমলবাবু নিজে ব্যবস্থা করিয়া তাহাকে হাইকোর্টের একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ উকীলের জুনিয়র করিয়া দিয়াছেন। বিমলবাবুরই ছোট মোটর গাড়িখানিতেই সে আদালতে যাতায়াত করে। তারকের আবশ্যকীয় পোষাক-পরিচ্ছদ গাউন প্রভৃতি সরঞ্জাম সমস্তই সবিতা কিনিয়া দিয়াছেন।
তারকের আহার শেষ হইলে সবিতা উপরে উঠিয়া আসিয়াছিলেন। অনেকক্ষ পরে সারদা উপরে আসিয়া বলিল, মা, আজও আপনি কিছুই মুখে দেবেন না?
না সারদা। আমার গলা দিয়ে কিছু গলবে না। তবে যদি আমার জন্য না খেয়ে উপোস করতে চাও, তা হলে আমাকে খেতেই হবে, কিন্তু আমি জানি তুমি তোমার মায়ের ’পরে এমন জুলুম করবে না।
সারদা মলিন-মুখে দাঁড়াইয়া রহিল।
সবিতা বলিলেন, যাও মা তুমি খেয়ে এসো।
সারদা তবুও নত-মুখে দাঁড়াইয়া শাড়ির আঁচলের একটা কোণ দুই হাতে অনাবশ্যক পাকাইতে লাগিল।
সবিতা বলিলেন, মানুষ একবেলা না খেয়ে মরে না সারদা। কিন্তু খাওয়া অনেক সময়ে তার পক্ষে মরণাধিক যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে। তবুও যদি তুমি আমাকে আজ খাওয়াবার জন্য পীড়াপীড়ি করতে চাও, চলো না হয় যাচ্চি।
সারদা একবার মুখ তুলিয়া মৃদুকণ্ঠে কহিল, না, থাক্ মা। আমি একাই যাচ্চি।
শুন্য কক্ষে আলো নিভাইয়া দরজায় খিল দিয়া সবিতা অনাবৃত মেঝের ’পরে এলাইয়া শুইয়া পড়িলেন।
দুপুরে আজ রাখাল আসিয়াছিল। সবিতা বিপন্ন স্বামী ও কন্যার সকল সংবাদই জানিতে পারিয়াছেন। সমস্ত দিনটা যেন অসাড়তার মধ্য দিয়া ছায়ার মত কাটিয়া গিয়াছে, রাত্রির স্তব্ধ নির্জ্জন অবকাশে বেদনা-ভারাতুর অন্তরতলে কতকটা যেন সাড় ফিরিয়া আসিতেছে। নিমীলিত নয়নদ্বয়ের অবিরল বিগলিত অঙ্গধারার কঠিন কক্ষতল, অযত্নবদ্ধ কোমল চুলের রাশি ভিজিয়া উঠিতে লাগিল। কোনও শব্দ নাই, চাঞ্চল্য নাই, নিস্পন্দদেহে প্রসারিত বাহুর ’পরে মাথা রাখিয়া, মাটিতে এক পার্শ্ব হইয়া পড়িয়া আছেন। উপায়হীন ক্ষতির ক্ষোভে তাঁহার সমস্ত হৃদয় মন আজ কাতর ও বিকল। কোনও সান্ত্বনাই আর খুঁজিয়া পাইতেছে না। আপনার সন্তানের এত দুঃখ ও কৃচ্ছ্রসাধন তাঁহাকে অহরহ যে অগ্নিকণার আঘাতে জর্জ্জরিত করিয়া তুলিতেছে। সমস্ত অন্তর ক্ষতবিক্ষত হইয়া গেলেও বেদনায় আর্ত্তনাদ করিবার উপায় কই? বলির পশুর মতো রক্তাক্ত দেহে ধূলায় পড়িয়া ধড়ফড় করা ছাড়া গতি নাই!
আজ তাঁহার তৃষিত মাতৃহৃদয় দুই বাহু বাড়াইয়া যাহাকে বুকের মধ্যে টানিয়া লইবার জন্য ব্যাকুল, হৃদয়-নিড়ানো অফুরন্ত স্নেহরসে যাহাকে অভিসিঞ্চিত করিয়াও তৃপ্তি নাই, সংসারে সেই আজ তাঁহার সবার বাড়া পর, সবার বেশি দূরের মানুষ হইয়া গিয়াছে।
পরিপূর্ণ যৌবনের উচ্ছ্বসিত বসন্তদিনে যখন জীবন স্বতঃই আনন্দপিপাসাতুর, তাঁহাকে সেদিন উহা সম্পূর্ণ একাকী নিঃসঙ্গ বহন করিতে হইয়াছে। না মিলিয়াছে অন্তরের অন্তরঙ্গ সাথী, না পাইয়াছেন যৌবনের প্রাণবন্ত সহচর। সেই একান্ত একাকীত্বের মাঝে হঠাৎ একদিন কোথা হইতে কি যে আকস্মিক বিপ্লব হইয়া গেল তাহা নিজেও স্পষ্ট বুঝিতে পারেন নাই। যখন চৈতন্য হইল, আশে-পাশে চাহিয়া দেখিতে পাইলেন, সমগ্র বিশ্বসংসারে তাঁহার কেহ নাই, কিছু নাই। স্বামী, সন্তান, গৃহ-পরিজন, সংসার-প্রতিষ্ঠা, মানমর্য্যাদা সমস্তই ঐন্দ্রজালিকের ভোজবাজির ন্যায় অন্তর্হিত হইয়া গিয়াছে। ভয়চকিত-চিত্তে সহসা অনুভব করিলেন, সংসার ও সমাজের বাহিরে নির্ব্বান্ধব নিরবলম্বন তিনি, একা শূন্যের মধ্যে দুলিতেছেন! পা রাখিয়া দাঁড়াইবার মতো মাটিটুকুও পায়ের নীচে আশ্রয় আর নাই।
জীবনের এই আকস্মিক সর্ব্বনাশের ক্ষণে যে অতিপঙ্কিল আশ্রয়ভূমির সঙ্কীর্ণতম পরিধির মধ্যে নিজেকে দাঁড় করাইয়াছেন, তাহা সামাজিক জ্ঞানবুদ্ধি বিবেচনার সম্পূর্ণ অগোচরে। কেবলমাত্র জৈব প্রকৃতির স্বাভাবিক আত্মরক্ষার প্রবৃত্তিবশেই জীবন-ধারণের অনিবার্য্য প্রয়োজন; কিন্তু দিন যাইবার সঙ্গে সঙ্গে সেই কলুষিত আশ্রয়ের ক্লেদ ও কদর্য্যতায় তাঁহার দেহ মন প্রতিদিন ঘৃণায় সঙ্কুচিত হইয়া উঠিয়াছে, জাগ্রত আত্মচেতনা প্রতিমূহূর্ত্তে অনুতাপের মর্ম্মান্তিক আঘাতে আহত ও জর্জ্জরিত হইয়াছে। তবুও এই অসহ ও অবাঞ্ছিত সঙ্কীর্ণ আশ্রয়টুকু ত্যাগ করিয়া আরও অনিশ্চিতের মধ্যে ঝাঁপ দিতেও ভরসা পান নাই। নিজের একান্ত নিরুপায় অবস্থা বুঝিতে পারিয়া অন্তরে অন্তরে শিহরিয়া উঠিয়াছেন। এমনি করিয়াই তাঁহার দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর নিয়ত-অস্বস্তির মধ্যে কাটিয়া গিয়াছে।
জীবনের প্রারম্ভক্ষণে বলিষ্ঠ প্রাণবন্ত পুরুষ কেহ যদি তাঁহার জীবনের পথে আসিয়া দাঁড়াইতেন, আজ তাঁহার উজ্জ্বল নারীজীবনের দীপ্তিতে সংসার ও সমাজ আলোকিত হইয়া উঠিত না কি? প্রসন্ন দেহ-মনের, আনন্দিত হৃদয়ের অনুকুল আবেষ্টন প্রভাবে তিনি কি আজ লক্ষ্মীস্বরূপিণী পত্নী, আদর্শ জননী, মমতা মাধুৰ্য্যময়ী নারী হইয়া উঠিতে পারিতেন না? কিসের জন্য তাঁহার জীবনের উদয়-উষা এমন অকাল কুজ্ঝটিকায় বিলীন হইয়া গেল? মুহূর্ত্তের অবকাশে এতবড় প্রলয় কেমন করিয়া সংঘটিত হইল, যাহা তাঁহার নিজেরই স্বপ্নের অগোচর।
সবিতার এই অবাধ অশ্রুনিষিক্ত চিন্তাধারায় সহসা বাধা পড়িল। দ্বারে ঘন ঘন করাঘাতের সহিত তারকের কণ্ঠস্বর শোনা গেল—নতুন-মা—নতুন-মা—একবার দোরটা খুলুন—
সবিতা উঠিয়া বসিয়া নিজেকে একটু সম্বৃত করিতে-না-করিতে দ্বারে পুনঃ পুনঃ আঘাত ও উপর্য্যুপরি ব্যগ্র ডাক শোনা যাইতে লাগিল।
সত্ত্বর মুখ চোখ মুছিয়া ক্ষিপ্রহস্তে গায়ে মাথায় বসন সুসংযত করিয়া সবিতা দ্বার খুলিলেন। তারকের এই অধীর ব্যস্ততায় তিনি বাড়িতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে অনুমান করিয়া শঙ্কিত হইয়া উঠিয়াছিলেন। দরজা খুলিয়া বাহির হইবামাত্র তারক বলিল, আপনি নাকি রোজই রাত্রে অনাহারে কাটাচ্ছেন শুনলাম। আজও কিছুই মুখে দেননি। শরীর কি খারাপ হয়েচে?
তারকের প্রশ্ন শুনিয়া সবিতা বিস্ময়ে ও বিরক্তিতে স্তব্ধ হইয়া গেলেন, কোনও উত্তর দিলেন না।
তারক পুনরায় প্রশ্ন করিল।
না, আমি ভালোই আছি – সবিতা শান্ত গলায় জবাব দিলেন।
তবে কেন রোজ এমন করে উপোস করে থাকেন? না না, সে আমি শুনবো না। কিছু-না-কিছু খাওয়া দরকার। কালই আমি ডাক্তার নিয়ে আসবো। তারকের কণ্ঠে যথেষ্ট উদ্বিগ্নতা প্রকাশ পাইল।
ও-সব হাঙ্গামা ক’রো না তারক। আমি নিষেধ করচি।
তা হলে বলুন, কেন অকারণে উপোস দিয়ে শরীরের উপর এমন অত্যাচার করচেন?
রাত হয়েচে, শোও গে তারক। সবিতার কণ্ঠে নিরতিশয় ক্লান্তি ফুটিয়া উঠিল।
তারক ইহাতে ক্ষুণ্ণ হইয়া পড়িল। বলিল, বেশ, আপনার যা খুশি করুন, আমি সিঙ্গাপুরে সমস্ত ব্যাপার লিখে জানাই। তিনি এসে শেষে যদি বলেন, তারক, তোমাকে দেখাশুনার দায়িত্ব দিয়ে রেখে গিয়েছিলাম, আমাকে জানাওনি কেন—তখন কি জবাব দেবো তাঁকে?
সবিতার অন্তর জ্বলিয়া উঠিল। কিন্তু ধীরভাবেই বলিলেন, আমি কেন দু’দিন খাইনি কিংবা তিনদিন ঘুমোইনি এর জন্য কারো কাছেই তিনি কৈফিয়ৎ চাইবেন না।
তা হলে এখানে আমার থাকার কি দরকার নতুন মা? তারকের স্বরে অভিমান প্ৰকাশ পাইল।
সবিতা অবসন্ন-কণ্ঠে বলিলেন, আজ আমি বড় ক্লান্ত তারক। তর্ক করবার শক্তি নেই। শুতে চললাম।
সবিতা আস্তে আস্তে আবার দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন।
সারদা সিঁড়ির মুখেই দাঁড়াইয়াছিল! তারক ফিরিবার পথে তাহাকে দেখিতে পাইয়া তীব্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, নতুন-মা যে প্রতিদিন রাতে উপোসী থাকচেন, এ-কথা আমাকে কেন জানাননি? আজ শিবুর মার মুখে জানতে পারলাম।
আপনি তো তাঁর সম্বন্ধে কিছু জানতে চাননি!
সারদার কণ্ঠে নির্লিপ্ততায় তারক গর্জ্জিয়া উঠিল—–কি, এতবড় মিথ্যে অপবাদ! আমি নূতন-মার খবর রাখি না? দেখাশোনার ত্রুটি করি?
অকারণ চেঁচাবেন না। আমি ও-সব কিছুই বলিনি।
নিশ্চয়ই বলেচেন। আমি বুঝতে পারচি, আমার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র চলচে। আজ রাত্রেই আমি সব লিখে দিচ্ছি বিমলবাবুকে।
লিখতে আপনি পারেন; কিন্তু নতুন-মা তাতে বিরক্ত হবেন।
আমার কর্ত্তব্য আমি করবোই। সমস্ত দায়িত্ব তিনি আমার উপরে দিয়ে গিয়েচেন, এ কথা ভুললে তো আমার চলবে না!
নতুন-মার রুচি-অরুচির উপরে জুলুম করতে তিনি কাউকেই বলে যাননি। বলবেনই বা কেন? সে অধিকার কারো নেই।
বিদ্রূপপূর্ণ কণ্ঠে তারক বলিল, তা হলে সে অধিকারটা কার আছে শুনি? রাখালবাবুর নয় আশা করি?
সারদার দৃষ্টি কঠোর হইয়া উঠিল। নিজেকে প্রাণপণে দমন করিয়া মৃদুকণ্ঠেই বলিল, নতুন মার উপর জোর করবার অধিকার যদি আজ কারো থাকে তো রাখালবাবুরই আছে, আর কারো নেই।
মৃদু-স্বরে কথিত কথাগুলি তীক্ষ্ণাগ্র সূচের ন্যায় তারককে বিদ্ধ করিল।
গূঢ় ক্রোধ সংযত করিতে না পারিয়া তারক বলিয়া উঠিল, তা তো বটে। সেই জন্য তিনি নতুন-মার অসহায় অবস্থায় দেখা-শোনা করার ভারটুকু পৰ্য্যন্ত নিতে পারলেন না? নতুন-মার বাড়িতে এসে থাকলে পাছে তাঁর সুনামে কালি লাগে।
শান্ত-গলায় সারদা কহিল, যারা স্বার্থের প্রয়োজনে সব কিছুই করতে প্রস্তুত, রাখালবাবু তাদের দলের লোক ন’ন। নতুন-মাকে দেখা-শোনার ভার নেওয়ার চেয়ে নতুন-মারই পক্ষ থেকে ঢের বড় কর্ত্তব্যভার তিনি নিয়ে রয়েচেন? আপনি তো জানেন না, কাজেই বুঝতে পারবেন না।
উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া সারদা সিঁড়ি বাহিয়া নামিয়া চলিয়া গেল!
দুপুরবেলায় সদ্যঃস্নাতা সবিতা সিক্ত কেশের ঘন পুঞ্জ পিঠের পরে ছড়াইয়া রৌদ্রে পিঠ রাখিয়া নিবিষ্টচিত্তে পত্র লিখিতেছিলেন। পরিধেয় শাড়ির কালো পাড়টি শঙ্খের মত সুন্দর গ্রীবার একপাশ দিয়া লতাইয়া গিয়া পিঠের ’পরে বাঁকিয়া পড়িয়া আছে, উচ্ছ্বাস বিষণ্ণ ছায়াশীর্ণ শুভ্র মুখে সকরুণ শ্রী বিকশিত করিয়া তুলিয়াছে।
সারদা সেইখানেই বারান্দার একধারে বসিয়া নিজের জন্য একটি সেমিজ সেলাই করিতেছিল। পথের দিকে চাহিতে দেখিতে পাইল রাখাল আসিতেছে। সেলাইটা হাতে নিয়াই সে নীচে নামিয়া গেল সদয়-দরজা খুলিয়া দিতে।
কড়া নাড়িয়া ডাকিবার প্রয়োজন হইল না। খোলা দ্বারে সারদা তাহার জন্য অপেক্ষা করিতে দেখিয়া রাখাল মনের ভিতর ঈষৎ খুশী হইয়া উঠিল। সেটা প্রকাশ না করিয়া বলিল, ঠিক দুপুরবেলায় সদর দরজায় দাড়িয়ে কেন সারদা?
একজনের জন্য অপেক্ষা করচি।
কে সে? ফেরিওয়ালা নিশ্চয়ই!
উঁহু, চিনতে পারবেন না।
তুমিই না হয় চিনিয়ে দিলে—
নিজে থেকে চিনে নিতে না চাইলে অন্যে তাকে চিনিয়ে দিতে পারে না যে দেব্তা।
কথাটা হেঁয়ালি ঠেকছে—
খেয়ালীমানুষের কাছে সব কথাই হেঁয়ালী ঠেকে শুনেচি। সরুন, দরজা বন্ধ করি।
সারদা দরজায় খিল দিয়া রাখালের সঙ্গে ভিতরের দালানে আসিল।
রাখাল মৃদু হাসিয়া বলিল, অন্যদিনেও এমনি করে নিস্তব্ধ দুপুরে কারো জন্যে দুয়ারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে থাকো নাকি সারদা? কণ্ঠে তাহার স্বচ্ছ পরিহাসের লঘু সুর।
সারদা মুহূৰ্ত্তমাত্র রাখালের মুখের পানে চাহিয়া দেখিল এ বক্রোক্তি কি-না। তারপর সেও হাসিয়া জবাব দিল, হ্যাঁ, সব দিনই থাকতে হয়। যেদিন প্রথম আপনি আমাকে দেখেছিলেন, সেদিনও তো একজনের পথ চেয়ে এমনি করে দুয়ার খুলে অপেক্ষা করছিলাম।
তাই নাকি! কে তিনি বলো তো?
সারদা হাসিয়া বলিল, আমার পরমবন্ধু মরণ-দেব্তা। তাঁর আসার দুয়ার তো সেদিন এমনি করে নিজের হাতে খুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই খোলা দুয়ার-পথে মরণ-দেব্তার বদলে এলেন মর্ত্যের দেব্তা।
রাখালের কর্ণমূল আরক্তিম হইয়া উঠিল। কথাটা হালকা করিবার জন্য সে বলিল, যাক অপদেবতা যে কেউ এসে পড়েনি এই যথেষ্ট। চলো, উপরে যাই। নতুন-মা কি এখন বিশ্রাম করচেন?
না। চিঠি লিখচেন। এইমাত্র তাঁর খাওয়া হ’লো।
সে কি! এত বেলা?
প্রতিদিনই তো এমনি হয়। সংসারের সমস্ত কাজকর্ম্ম নিজের হাতে শেষ করে—স্নান-আহ্নিক সেরে খেতে বসেন যখন, তিনটে বেজে যায়। আজ বরং একটু আগে হয়েছে।
এর মানে কি? নিজের হাতে ও-সকল কাজ করা তো নতুন-মার অভ্যাস নেই, এমন করলে যে একটা কঠিন অসুখে পড়ে যাবেন! লোকজন, ঝি, রাধুনি এ সব কি আর নেই? একলা মানুষ উনিই, এমনিই কি ওঁর অভাব—
অভাবের জন্য নয় দেব্তা।
তবে?
এ তাঁর কঠিন আত্মনিগ্রহ।
রাখাল নিরুত্তর রহিল।
সারদা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া কহিল, বসবেন চলুন।
সারদার মুখের পানে তাকাইয়া রাখাল কহিল, আমি দুপুরবেলায় আসি, নতুন-মার বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটাইনে তো সারদা?
তা যদি মনে হয় আপনার, এ-সময়ে না এলেই পারেন।
রাখাল একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, কিন্তু এই সময় ছাড়া এখানে আসার যে আমার অবসর নেই সারদা!
মুখ টিপিয়া হাসিয়া সারদা জবাব দিল, সে আমি জানি।
রাখাল সন্দিগ্ধসুরে বলিল, তার মানে? তুমি এর কি জানো?
জানি বই কি! এই সময়ে এ-বাড়ির নতুন উকীলবাবু কোর্টে থাকেন। অতএব, আপনার বন্ধু-সঙ্কট—থুড়ি,বন্ধু-সম্মিলন ঘটবার সম্ভাবনা নেই।
হুঁ, খড়ি পেতে গুনতে শিখেচ। এখন চলো, উপরে উঠবে, না নীচেই দাঁড় করিয়ে রেখে দেবে?
সারদা বলিল, ওধারের বেঞ্চিটার ওপরে একটু বসবেন; চলুন না দেব্তা ৷ মায়ের চিঠি লেখা শেষ হতে এখনও একটু দেরি হবে। সেই অবকাশে আপনাকে আমি গোটা-কয়েক কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই।
চল, উপরে গিয়েই শুনবো।
মার সামনে বলতে পারবো না, আমার বাঁধবে।
সারদা রাখালকে একতলায় দালানের উত্তরদিকে লইয়া গেল। একপাশে পিঠ-ওয়ালা কাঠের মোটা একখানি বেঞ্চি পাতা আছে। নিজের আঁচল দিয়া বেঞ্চির উপরের ধুলা ঝাড়িয়া সারদা বলিল, বসুন।
রাখাল বসিয়া পড়িয়া বলিল, অতঃপর? তোমার আসন কৈ?
না। আমি বেশ আছি। আমার কথা অল্পই। বেশিক্ষণ আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে না।
তথাস্তু। অথ কথারম্ভ হোক।
আপনি এমন করে ঠাট্টা-তামাশা করলে বলবো কি করে?
আচ্ছা, ঠাট্টা তামাসা দুই-ই প্রত্যাহার করলাম। বলো।
সারদা রাখালের নিকট হইতে একটু দূরে দেওয়ালে ঠেস দিয়া দাঁড়াইয়াছিল। হাতের অসমাপ্ত সেলাইয়ের কাজটা নতচক্ষে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করিতে করিতে একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, আমি ঠিক জানি না, এসব জিজ্ঞাসা করা আমার উচিত কিনা। তারপর অল্প থামিয়া বলিল, আচ্ছা, রেণুর বোন রাণী বিয়ের পরে কেমন আছে জানেন আপনি?
রাখাল সারদার কাছে এ প্রশ্ন আশা করে নাই। তাই বেশ একটু বিস্মিত হইয়া বলিল, কেন বলো তো? আমি তো বিশেষ কিছুই জানিনে। তবে সে ভালো ঘরে-বরেই পড়েচে এবং বিয়ের পরে সুখে-স্বাচ্ছন্দে আছে শুনেছিলাম। কিন্তু তুমি এ কথা হঠাৎ জিজ্ঞেসা করচো কেন সারদা?
পরে বলবো। আচ্ছা, রাণী নাকি সন্তান সম্ভাবনা হয়েচে, ওরা চিঠি লিখে কাকাবাবুকে এই সুসংবাদ জানিয়েচে?
হয়তো হবে, কিন্তু আমাদের এ-সব খবরের দরকার কি সারদা? এই সুসংবাদ জানাবার জন্যই কি তুমি ঘটা করে আমাকে এখানে এনে বসিয়েছো?
না। সারদার কণ্ঠস্বর একটু ভারি হইয়া উঠিল। বলিল, আপনি কি জানেন রাণীর বিয়ে হয়েচে সেই পাত্রেই যে পাত্রের সঙ্গে রেণুর বিয়ে ঠিক হয়ে গায়ে হলুদ পৰ্য্যন্ত হয়ে গিয়েছিল?
রাখাল অতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিল, তাই নাকি? তা তো কৈ জানতাম না! রাখালের মুখে চোখে চিন্তার ছায়া সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল।
হা তাই।
অল্প পরে সারদা আবার প্রশ্ন করিল, কাকাবাবু নাকি বৃন্দাবন বাস করবেন মনস্থ করেছেন?
হ্যাঁ।
রেণুও সঙ্গে যাবে?
নইলে কোথায় আর থাকবে সে?
সারদা ক্ষণকাল চুপ করিয়া রহিল। পরে ধীরে ধীরে কতকটা আপন মনেই বলিল, কিন্তু সেখানে এই বয়সে কুমারী মেয়ে—
রাখাল বলিল, সবই তো বুঝচি। কিন্তু এ-ছাড়া অন্য পথই বা কোথায় দেখিয়ে দিতে পারো সারদা? একটু থামিয়া আবার বলিতে লাগিল, যার যা অদৃষ্টে ঘটবার তার তাই ঘটে থাকে। এই দুনিয়ার নিয়ম। এ মেনে নিতে না পারলে খালি জটিলতা আর দুঃখ বেড়ে ওঠে মাত্র।
তার মানে, আপনি বলতে চাইচেন, রেণুর অদৃষ্টে যা আছে তা হবেই? আমাদের দুশ্চিন্তা নিরর্থক।
নয় তো কি? ওর ভাগ্যবিড়ম্বনা তো শৈশবেই শুরু হয়েছে ওর জীবনে। তুমি আমি কেন, দেশ-শুদ্ধ লোক এখন ওকে সুখে রাখবার চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থ হবে।
এই কি আপনার অন্তরের যথার্থ বিশ্বাস দেব্তা?
হ্যাঁ। অনেক হোঁচট খেয়ে এই-ই এখন আমি শেষ বুঝেছি।
সারদা স্তব্ধ হইয়া রহিল। বহুক্ষণ পরে দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিল, মা কিন্তু এটা সহ্য করতে পারবে বলে মনে হয় না।
তার মানে?
আপনি যাই বলুন দেব্তা, সারদাকে ভোলাতে পারবেন না। জোর করে নিষ্ঠুর সাজতে যাওয়া আপনার মতো মানুষের সাধ্য নয়। সমস্তই আপনি জানেন, বোঝেন। আপনার জ্ঞানের কাছে আমার জ্ঞান-বুদ্ধি তুচ্ছ। রেণুর আজকের অবস্থার জন্য তার নিজের মা-ই দায়ী; কিন্তু যা এই সংসারে বহু মানুষেরই জীবনে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ঘটে যায়—তার কি কোনও জবাবদিহি আছে? নিজেই সে কি খুঁজে পায় তার অর্থ?
রাখাল ভাবহীন শূন্য দৃষ্টিতে সারদার পানে তাকাইয়া রহিল।
সারদা ধীরে ধীরে বলিতে লাগিল, তবুও ভেবে দেখুন, সেদিনের মা আর আজকের মা এক মানুষ ন’ন। উভয়ের মধ্যে অনেক প্রভেদ। আর যে-কেউ যাই বুঝুক না কেন দেব্তা, মায়ের নতুন-মা পরিচয়টা আপনার চেয়ে ভাল, আপনার চেয়ে বেশী আর কে জানে।
নিরুত্তরে রাখালের মুখে চোখে নিগূঢ় বেদনার বিষণ্ণতা নামিয়া আসিয়াছিল। সারদা অত্যন্ত মৃদু-কণ্ঠে বলিল, মার পানে আর চাওয়া যায় না আজকাল। কি মানুষ কি হয়ে যাচ্চেন দিনের পর দিন। ভিতরে ভিতরে অহরহ তুষের আগুনে পুড়ে পুড়ে দেহ-মন তার খাক হয়ে গেল। খাওয়া ছেড়ে, পরা ছেড়ে, সংসারের অনাবশ্যক কাজে দাসী-রাঁধুনীর বাড়া খাটুনি খেটে—মেয়ের ভাবনা ভেবে ভেবে দেহপাত করে ফেলেচেন, তবুও একবিন্দুও শান্তি পাচ্ছেন না একদণ্ডও।
রাখাল উদাস নেত্রে উঠানের দিকে তাকাইয়া রহিল, কথা কহিল না।
সারদা বলিল, মায়ের উপর আপনি অবিচার করবেন না। আপনিও যদি অভিমানে মাকে ভুল বোঝেন তা হলে পৃথিবীতে সত্যের ’পরে যে আর নির্ভর করাই চলবে না। মানুষ বাঁচে কিসে?
রাখাল দৃষ্টি নত করিল। কি বলিবে খুঁজিয়া পাইল না। জবাব দিবার ছিলও না কিছু।
দেব্তা, তা আপনি চলুন একটু মার কাছে। আজকের দিনে তাঁর মনের এই মর্ম্মান্তিক জ্বালা এতটুকু জুড়োতে পারে এমন কেউ নেই আপনি ছাড়া।
এবার থেকে তোমারই কথামত চলতে চেষ্টা করবো সারদা।
গাঢ় কণ্ঠে সারদা বলিল, আপনি শুধু আমার জীবনদাতা দেব্তা ন’ন, আমার গুরুও। অন্ধ ছিলাম, দৃষ্টি দান করেছেন আপনিই। অজ্ঞান ছিলাম, জ্ঞান দিয়েচেন আপনি! আপনার দৃষ্টিভঙ্গীর স্বচ্ছতার আমার দৃষ্টি বদলেচে। এ-কথাও একটুও বাড়ানো নয়, অন্তর্যামী জানেন।