পঁচিশ

বৎসর ঘুরিয়া নূতন বৎসর আসিয়াছিল; তাহাও আবার শেষ হইতে চলিল। সংসারের অবস্থা পরিবর্ত্তিত হইয়াছে অনেক।

বিমলবাবু শেষবার সিঙ্গাপুরে গিয়া প্রায় দেড় বৎসর আর কলকাতায় ফিরেন নাই। এই বছর দুইয়ের মধ্যে রাখালকে প্রায় বার-সাতেক ছুটিতে হইয়াছে বৃন্দাবনে। ইহাতে তাহার নিজের কাজ-কর্ম্মের ক্ষতি হইয়াছে যথেষ্ট। দিনের দিন সে ঋণজালে জড়াইয়া পড়িতেছে, অথচ উপায় কিছু নাই।

রেণুদের আর্থিক সাহায্য করিবার জন্য সবিতা নানা উপায়ে বহু চেষ্টাই করিয়াছিলেন, সক্ষম হন নাই। প্রায় সওয়া লক্ষ টাকা মূল্যের যে সম্পত্তি মাত্র একষট্টি হাজার টাকায় রমণীবাবুর সাহায্যে তিনি নিজের নামে খরিদ করিয়াছেন তাহা রেণুর উদ্দেশ্যে। ঐ সম্পত্তি খরিদকালে নয় হাজার টাকা রমণীবাবুর নিকট হইতে সবিতা গ্রহণ করিয়াছিলেন এই সর্ত্তে যে, সম্পত্তিরই আয় হইতে উক্ত টাকা পরিশোধ করা হইবে! উচ্চ হারের সুদ সমেত নয় হাজার টাকা রমণীবাবুকে সম্পত্তির আয় হইতে একযোগে পরিশোধ করাও হইয়া গিয়াছে। কিন্তু যাহার জন্য এত আয়োজন, সে-ই যখন সম্পত্তি স্পর্শ করিল না এবং ভবিষ্যতেও কোনদিন যে স্পর্শ করিবে এরূপ আশাও রহিল না, তখন সবিতা একেবারেই ভাঙিয়া পড়িলেন। তিনি নিজের সমস্ত অলঙ্কার, ব্রজবাবুর শিলমোহর করা সেই গহনার বাক্স সমেত ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রাখিয়াছেন রেণুরই নামে; কিন্তু আকাশ-কুসুম রচনার ন্যায় সমস্তই যে তাঁহার বৃথা হইতে চলিয়াছে!

মনে মনে কল্পনা করিয়াছিলেন, উচ্চশিক্ষিত, চরিত্রবান, স্বাস্থ্যসবল যুবকের হতে কন্যা অর্পণের ব্যবস্থা করিয়া, আপনার সমস্ত অর্থ-সম্পদ যৌতুক দান করিবেন। সে তো রেণুরই পিতৃধন। তাহারই পিতৃ-প্রদত্ত ও মাতামহ-প্রদত্ত যে বহুমূল্য অলঙ্কাররাশি দীর্ঘকাল ধরিয়া বাক্সেই আবদ্ধ রহিল, কোনদিন সবিতার অঙ্গে উঠিল না—এতদিন আশা ছিল, তাহা বুঝি সাৰ্থক হইবে নবোঢ়া রেণুকে অলঙ্কৃত করিয়া। বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল, তাঁহার প্রাণাধিক রেণু পরিপূর্ণ দাম্পত্য সৌভাগ্যে সুখী হইয়া সচ্ছলতার মধ্যে পরিতৃপ্ত জীবন যাপন করিবে। দূর হইতে দেখিয়া তাহার অভিশপ্ত মাতৃজীবন চরিতার্থ হইবে! কিন্তু ভাগ্য যার মন্দ, সকল ব্যবস্থাই বুঝি এমন করিয়া তার ব্যর্থ হয়।

এতদিনে সবিতা নিঃসংশয়ে বুঝিতে পারিয়াছেন, স্বামী ও কন্যার জীবনে তাঁহার তিলমাত্রও স্থান নাই—না অন্তরে, না বাহিরে।

আজ যৌবনের অস্তাচলে, দেহকামনা-বিরহিত প্রেম আপনি আসিয়া উপনীত হইয়াছে দুয়ারে। সবিতা জানে ইহার মূল্য, জানে ইহা কত দুর্লভ। ইহাকে উপযুক্ত সম্মান ও সমাদরের সহিত গ্রহণ করিবার মনোবৃত্তি বুঝি আর নাই। আজ তাহার সমস্ত হৃদয়-মন মাতৃত্বের মমতা-রসে সিক্ত হইয়া সন্তানের আনন্দ-তৃষ্ণায় ভূষিত হইয়া উঠিয়াছে।

কিন্তু কোথায় সে স্নেহপাত্র?

অতিরিক্ত মানসিক উদ্বেগ ও বিক্ষোভে সবিতার স্বাস্থ্যে ইদানিং ভাঙন ধরিয়াছিল। তাহার উপরে দেহের প্রতি ঔদাসীন্য ও অযত্নের অন্ত নাই।

সারদা প্রায়ই অনুযোগ করিত। কিন্তু তাহার নিজের হাতে প্রতিকারের উপায় নাই। তারক কিছু বলে না। তাহার প্র্যাক্‌টিস উত্তরোত্তর জমিয়া উঠিতেছে, আপনার উন্নতির একান্ত চেষ্টা লইয়াই সে অহোরাত্র নিমগ্ন।

সেদিন বিকেলবেলায় সবিতা ভাড়ার ঘরে কুট্‌না কুটিতে বসিয়া একখানি ডাকের চিঠি খুলিয়া নীরবে পাঠ করিতেছিলেন। তাঁহার মুখে বিস্ময় ও বেদনাবিমিশ্র সকরুণ হাসির রেখা। বিমলবাবু সিঙ্গাপুর হইতে লিখিয়াছেন—

“সবিতা, সারদা-মায়ের সংক্ষিপ্ত পত্রে জানিলাম তোমার স্বাস্থ্য খুবই খারাপ হইয়াছে। অথচ এ-সম্বন্ধে তুমি নাকি সম্পূর্ণ উদাসীন। সারদা-মা জানাইয়াছেন সময় থাকিতে সাবধান না হইলে সত্ত্বর কঠিন ব্যাধিতে তোমার শয্যাশায়িনী হওয়ার সম্ভাবনা।

তুমি তো জানো, ভগ্নস্বাস্থ্য লইয়া অকৰ্ম্মণ্য জীবন বহন করার দুঃখ মৃত্যুর অধিক। আমার আশঙ্কা হইতেছে, এভাবে চলিলে তুমি হয় তো সেই অতি দুঃখময় জীবন বহন করিতে বাধ্য হইবে।

কাহারও ইচ্ছার উপরে হস্তক্ষেপ করা আমার প্রকৃতি নয়। তোমার ইচ্ছার উপর তাই আমি নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করিতে কুণ্ঠিত হই। হিতার্থী বন্ধু হিসাবে তোমাকে স্মরণ করাইয়া দিতেছি— অতিরিক্ত মানসিক সংঘাতে তুমি এতদূর বিচলিত হইয়াছ যে, জীবিত মনুষ্যের পক্ষে স্বাস্থ্য যে কত বেশি প্রয়োজনীয়, তাহাও বিশ্বত হইয়াছ। অন্তৰ্গূঢ় মৰ্ম্মবেদনায় আত্মসংবিৎ হারাইয়া দেহের উপর অবজ্ঞা করা ঠিক নয়। এ ভুলও ভবিষ্যতে একদিন মানুষ আপনি বুঝিতে পারে; কিন্তু তখন হয়তো এত বিলম্ব হইয়া যায় যে, প্রতিকারের উপায় থাকে না। তাই আমার অনুরোধ, শরীরের অযত্ন করিও না।”

সর্ব্বশেষে লিখিয়াছেন— “তারকের বিবাহের কথা সম্ভবতঃ সে তোমাকে জানাইয়া থাকিবে। এ বিবাহে তোমার মতামত কি জানিতে ইচ্ছা করি। আমার সন্মতি এবং আশীর্ব্বাদ প্রার্থনা করিয়া সে পত্র লিখিয়াছে। পাত্রীটি তারকের সিনিয়র উকিল শিবশঙ্করবাবুর ভ্রাতুষ্পুত্রী। এই বিবাহ তাহার প্র্যাক্‌টিসের উন্নতির অনুকূল হইবে সন্দেহ নাই।” ইত্যাদি।

সবিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া পত্রখানি খামের মধ্যে ভরিয়া রাখিয়া কুট্‌না কুটিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তাঁহার অন্তর অশ্রুসিক্ত হইয়া উঠিয়াছিল।

বৈকালে সারদা মহিলা শিক্ষা-মণ্ডলীর স্কুল হইতে বাটি ফিরিলে সবিতা বলিলেন, একটা সুখবর শুনেচো সারদা?

আগ্রহে উন্মুখ হইয়া সারদা জিজ্ঞাসা করিল, কি সুখবর মা?

আমাদের তারকের বিয়ে।

উৎসুক হইয়া সারদা কহিল, কবে মা? কোথায়? কনেটি কেমন দেখতে?

তা ত কিছু জানিনে মা। শুনলাম হাইকোর্টের মস্ত উকীল শিবশঙ্করবাবু—যাঁর জুনিয়ার হয়ে তারক কাজ শিখচে, পাত্রী তাঁরই ভাইঝি।

সে কি? আপনি এর কিছুই জানেন না? তবে জানে কে মা? সারদার কণ্ঠে বিস্ময় ধ্বনিত হইয়া উঠিল।

সবিতা হাসিয়া বলিলেন, সময় হলেই সকলে জানতে পারে সারদা। আমি সিঙ্গাপুর থেকে খবর পেলাম তারকের বিয়ে।

সারদা মুখ অন্ধকার করিয়া বলিল, উঃ কি অদ্ভুত মানুষ এই তারকবাবু!

সবিতা স্নিগ্ধস্বরে বলিলেন, ও আমার একটু লাজুক ছেলে। তুমি দোষ নিয়ো না সারদা। বরং উদ্যোগে লাগো এখন থেকে।

সারদা নিরুত্তরে মুখ হাঁড়ি করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

বছর দেড়েক হইল সারদাকে একটি নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্কুলে সবিতা ভৰ্ত্তি করিয়া দিয়াছেন। সেখানে সে লেখাপড়া, নানাবিধ অর্থকরী গৃহশিল্প, পশুপালন ও শুশ্রূষা-বিজ্ঞান প্রভৃতি বিভিন্ন বিভাগের কাজ শিখিবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছে। এক একটি বিষয় শিখিবার নির্দ্দিষ্ট কয়েক বৎসর বা কয়েক মাস করিয়া সময় আছে, বর্ত্তমানে লেখাপড়া ও দর্জ্জিকর্ম বিভাগে সারদার দ্বিতীয় বর্ষ চলিতেছে। বেলা নয়টার সময় স্কুলের গাড়ী আসে, ফেরে বেলা পাঁচটায়। অপরাহ্ণে সবিতা তাহার খাবার লইয়া বসিয়া থাকেন। সারদা ফিরিলে দ্রুত তাড়া দিয়া তাহাকে কাপড় বদলাইয়া, হাত-মুখ ধোয়াইয়া, নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করিয়া তবে তাঁহার স্বস্তি। তারকের সম্বন্ধেও তাহাই। কোর্ট হইতে ফিরিবার পূর্ব্বে তাহার বিশ্রামের ও জলযোগের ব্যবস্থা নিজ হাতে করিতে না পারিলে সবিতা তৃপ্তি পান না।

তারক প্রতিবাদ করে, অনুযোগ করে, কিন্তু সবিতা কর্ণপাত করেন না। সারদা বলে, মা, আপনার সেবার ভার নিতে আপনার কাছে এলাম, কিন্তু আপনিই যে শেষে আমার সেবা হাতে তুলে নিলেন। আমি সত্যই এ সইতে পারিনে। আপনার ঘাড়ে পরিশ্রমের ভার চাপিয়ে স্কুলে যেতে আমার বাধে।

সবিতা হাসিয়া বলেন, মা, এই কাজেই আমার বেশি তৃপ্তি। স্কুল তোমার কোনমতেই ছাড়া হবে না, আমি বেঁচে থাকতে! জীবনে তোমার অবলম্বন তো চাই। শিক্ষা না পেলে আত্মনির্ভরতার শক্তি পাবে কোথা থেকে? একদিন হয়তো তোমাকে একলা বেঁচে থাকতে হবে এই পৃথিবীতে। নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে না শিখলে দুঃখের অবধি থাকে না মেয়েদের, এ তো তোমার অজানা নেই সারদা!

সেদিন রাত্রে তারক খাইতে বসিলে, সবিতা নিত্যকার মতো খাওয়ার তদারক করিতে সামনে বসিয়া ছিলেন, সবিতা একসময় বলিলেন, তুমি নাকি বিয়ে করচো বাবা?

তারক চমকিত হইয়া প্রশ্ন করিল, কার কাছে শুনলেন?

সবিতা শান্ত হাসিয়া বলিলেন, সিঙ্গাপুরের চিঠি এসেচে আজ।

সারদা মিষ্টান্ন পরিবেশন করিতেছিল। কহিল, আমাদের বাড়ির বিয়ের খবর আমাদেরই কাছে পৌঁছায় তারকবাবু, সমুদ্র পারের ডাক মারফত।

সারদার বিদ্রূপে হাড়ে হাড়ে চটিয়া উঠিলেও তারক তাহা প্রকাশ করিতে পারিল না। সবিতার পানে তাকাইয়া কৈফিয়তের সুরে কহিল, আমার সিনিয়র উকিল শিবশঙ্করবাবু পীড়াপীড়ি করে ধরেচেন তাঁর ভাইঝিকে বিয়ে করার জন্যে। আমি এখনও মতামত জানাইনি। এ বিয়ে হবে কি না তার কিছুই ঠিক নেই। কাউকেই এখনও বলিনি। কেবলমাত্র বিমলবাবুকে লিখেছিলাম, পরামর্শ চেয়ে।

সবিতা বলিলেন, সম্বন্ধ তো তোমার পক্ষে ভালো বলেই মনে হচ্চে বাবা! তুমি আত্মীয়-বন্ধুহীন, এ রকম মুরুব্বি শ্বশুর পাওয়া ভাগ্যের কথা। পাত্রী যদি তোমার অপছন্দ না হয়, শুভকর্ম্মে দেরী না করাই ভালো।

তারক সঙ্কুচিত হইয়া বলিল, কিন্তু এ বিয়েতে নানা বাধা আছে মা। আমি মনে করেচি, শিববাবুকে জবাব দেবো, এ বিয়ে সম্ভব হবে না।

সবিতা বলিলেন, বাধা কিসের?— আমাকে জানাতে তোমার সঙ্কোচ আছে বাবা?

তারক ব্যস্ত হইয়া কহিল, না না, আপনার কাছে বলতে আবার বাধা কি? আপনি আমার মা। আমি জানাবো-জানাবো ভাবছিলাম, আজই আপনাকে নিজেই এ সকল কথা বলতাম।

সারদার মুখে অবিশ্বাসের হাসি ফুটিয়া উঠিল। বলিল, মা, আমি তা হলে এখন উপরে চললাম।

সারদা চলিয়া গেল।

তারক কণ্ঠস্বর নীচু করিয়া বলিল, আমার সঙ্গে শিবশঙ্করবাবু তাঁর ভাইঝির বিবাহ দিতে ইচ্ছুক হয়েচেন। কিন্তু তাঁর কয়েকটি সর্ত্ত আছে। সেই সৰ্ত্তে আমি এখনও সম্মতি দিতে পারিনি। যদিও শিবশঙ্করবাবুর সাহায্যে আমি এই অল্পদিনের মধ্যেই ‘বারে’ এতটা নাম করতে পেরেচি এবং তিনি সহায় থাকলে আমি যে খুব শীঘ্রই উন্নতির মুখে এগিয়ে যেতে পারবো এও ঠিক, কিন্তু—

তার কথা অসমাপ্ত রাখিয়া চুপ করিল।

সবিতা তারকের পানে জিজ্ঞাসু-নয়নে তাকাইয়া রহিলেন।

অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া তারক আস্তে আস্তে বলিল, শিববাবুর প্রধান ও প্রথম সর্ত্ত বিবাহের কিছুদিন, অন্ততঃ বছরখানেক আমাকে তাঁর কাছে গিয়ে থাকতে হবে।

কেন?

তাঁর ভাইঝিটি পিতৃহীনা। শিববাবুর নিজের মেয়ে নেই, কাজেই—

বুঝেচি, ভাইঝিকে নিজের মেয়ের মতন মানুষ করেচেন। কাছ-ছাড়া করতে চান না বোধ হয়—

হ্যাঁ, নিজের মেয়ের অধিক ভালবাসেন তাকে তাই বলেছিলেন—তুমি আমার বাড়িতে এসে থাকো, তোমার কাজকর্ম্মের অনেক সুবিধা হবে। পরে তোমার পৃথক সংসার পেতে দেওয়ার দায়িত্ব আমার রইলো।

সবিতা বলিল, এতে তোমার অসুবিধা কি আছে?

তারক আমতা আমতা করিয়া ঢোঁক গিলিয়া বলিল, অসুবিধা ঠিক আমার নিজের নেই বটে, বরং সর্ব্বদা তাঁর কাছ থেকে কাজকর্ম্ম শেখা ও পৃথক কেস পাওয়ার দিক দিয়ে সুবিধাই হবে বলে মনে হয়; কিন্তু আমি যাই কি করে মা? ধরুন, আপনার দেখাশোনা—

সবিতা হাসিয়া বলিল, ওঃ, এইজন্য? আমার সম্বন্ধে তুমি কিছু ভেবো না তারক। আমি তো আজই সকালে ভাবছিলাম—কিছুদিন বাইরে কোথায় গেলে হয়। জীবনে এ-পর্য্যন্ত তীর্থ ভ্রমণ ঘটেনি। ভাবছি এবার তীর্থে বেরুবো।

একলা যাবেন?

আমি যদি যাই, সারদাকেও সঙ্গে নেবো, কিংবা ওদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বোর্ডিং-এ ওকে রেখে যাবো!

তারক অল্পক্ষণ চিত্ত। করিয়া বলিল, ফিরবেন কতদিনে?

সবিতা ম্লান হাসিয়া বলিলেন, হয়তো কলকাতায় আর নাও ফিরতে পারি। যদি ও অঞ্চলে কোনও দেশ ভালো লাগে, সেইখানে একখানি ছোটখাটো বাড়ি কিনে বাস করবো ভেবেচি।

তারক চুপ করিয়া রহিল।

সবিতা বলিলেন, ওদের পাকা কথা দিয়ে দিয়ো।

তারকের খাওয়া শেষ হইয়াছিল। আসন হইতে উঠিতে উঠিতে বলিল, ভেবে দেখি।

 

সেদিন রাত্রে সবিতা শয়ন করিলে সারদা যখন তাঁহার মশারীর ধারগুলি বিছানার তলায় গুঁজিয়া দিতেছিল, সবিতা বলিলেন, সারদা, তোমার স্কুলের পরীক্ষা কবে?

সারদা বলিল, আড়াই মাস পরে।

সবিতা একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন, আমি কিছুদিন তীর্থভ্রমণে বেরুবো মনে করচি—তুমি যাবে আমার সঙ্গে?

সারদা উৎসাহিত কণ্ঠে কহিল, হ্যাঁ মা— যাবো। একমাত্র কাশী ছাড়া আমি জীবনে আর কোনও তীর্থে যাইনি। গয়ায় একবার গিয়েছিলাম বটে, সে খুব ছোট্টবেলায়, এগারো-বারো বছর বয়সে। স্বামীর পিণ্ডদান করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন বাবা।

কথাটা শুনিয়া সবিতা যথেষ্ট বিস্মিত হইলেন, কিন্তু কিছু বলিলেন না।

সারদা বলিল, কবে আমাদের যাওয়া হবে মা?

তারকের বিয়েটা চুকে যাক। তার পরে কলকাতার বাসা একেবারে তুলে দিয়ে চলে যাবো ভাবচি।

সারদা বলিয়া উঠিল, আমাকে সঙ্গে রাখবেন তো?

না মা, তোমাকে কলকাতায় আবার ফিরতে হবে।

কেন মা? সারদার কণ্ঠস্বরে উদ্বেগ ধ্বনিত হইয়া উঠিল।

তুমি যে প্রয়োজনে শিক্ষা নিচ্চো সে যে শেষ হয়নি মা! ফিরে এসে বোর্ডিং-এ থেকে শিক্ষা সম্পূর্ণ করে তার পরে আমার কাছে গিয়ে থাকবে।

সারদা স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া ম্লানকণ্ঠে ধীরে ধীরে বলিল, আমার তীর্থভ্রমণে গিয়ে কাজ নেই মা।

সবিতা বলিলেন, কেন? দেশ-দেশান্তরে ঘুরে এলে অনেক-কিছুই জানতে পারবে, শিখতে পারবে।

সারদা মাথা নাড়িয়া বলিল, না মা, যাবো না। তারা যদি আমায় দেখে ফেলে? সবিতা বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, সে কি! সে আবার কারা?

সারদা অত্যন্ত কুণ্ঠিত হইয়া বলিল, আমার বাপের বাড়ির লোকেরা।

সবিতা বুঝিলেন সমস্তই। প্রশ্ন করিলেন না কিছু। দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, তা নাই গেলে তীর্থে। এখানে থেকেই পড়াশুনা ক’রো।

কপট ব্যাকুলতায় সারদা বলিয়া উঠিল, আপনার কাছ ছাড়া হতে আমার একটুও ভরসা হয় না মা। বোর্ডিং-এ একলা থাকতে ভয় করবে না তো?

ভয় কিসের? সেখানে তোমার মতো ক–ত মেয়ে রয়েচে—আমার রাজু কলকাতায় রইলো, তারকও থাকলো, ওদের বলে যাবো তোমার খোঁজ-খবর নেবে। যখন যা দরকার হবে ওদের জানাতে পারবে।

প্রায়ান্ধকার গৃহে সবিতার শয্যাপার্শ্বে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া সারদা নিঃশব্দে চিন্তা করিতে লাগিল। অনেকক্ষণ পরে অস্ফুট স্বরে ডাকিল, মা—

বলো সারদা, আমি জেগেই আছি, বিছানার ভিতর হইতে সবিতা জবাব দিলেন।

আমার নিজের কথা সমস্ত আজ বলতে ইচ্ছে আপনার কাছে।

আজ অনেক রাত হয়ে গেছে মা। তুমি শুয়ে পড়ো গিয়ে।

যাই—আমি বিধবা হয়েছিলাম মা এগারো বৎসর বয়সে। শ্বশুরবাড়ি আর যাই নি। ছোটবেলাতেই মা মারা গিয়েছিলেন। বাপ আবার বিয়ে করে—

সবিতা বাধা দিয়া বলিলেন, তোমাকে কিছুই বলতে হবে না সারদা, আমি সমস্তই শুনেচি।

 

পরদিন সবিতা বিমলবাবুকে পত্র লিখিতেছিলেন— “বহুদূরে কোথাও চলিয়া যাইবার জন্য আমার মন নিরতিশয় ব্যাকুল হইয়াছে। অনেক চিন্তা করিয়া শেষ পর্য্যন্ত তীর্থভ্রমণে বাহির হইব স্থির করিয়াছি। এখানে ফিরিবার আর রুচি নাই। অনিৰ্দ্দিষ্ট ঘুরিতে ঘুরিতে যে দেশ ভালো লাগিবে, সেইখানেই বাস করিব মনে করিতেছি। কলকাতার বাসা আর রাখিবার প্রয়োজন নাই। তারকের ভাবী শ্বশুর তারককে নিজের বাটীতে রাখিতে চাহেন। তাহার আইন ব্যবসায়ের সকলরকম সাহায্য এবং ভবিষ্যতে সংসার পাতিয়া দিবার দায়িত্ব লইতে তিনি প্রস্তুত। আমি তারককে এ ব্যবস্থায় সম্মত হইতে পরামর্শ দিতেছি।

সারদার শিক্ষা যতদিন না সমাপ্ত হয়, সে উহাদের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের বোর্ডিং হাউসেই থাকিবে। শিক্ষা সম্পূর্ণ হইলে, সে যদি ইচ্ছা করে, আমার নিকটে গিয়া বাস করিতে পারে।

ব্যবস্থা কিছুই করিতে পারিলাম না আমার রাজুর। জানিতে পারিয়াছি, সে কিছুদিন হইতে ঋণজালে জড়িত হইয়া পড়িয়াছে। অথচ আমার কিংবা অন্য কাহারও সাহায্য-গ্রহণে সে একেবারেই প্রস্তুত নয়। তাহাকে অনুরোধ করিতেও ভরসা পাই না। প্রত্যাখ্যানের দুঃখ আর সর্ব্বত্র বাড়াইয়া লাভ নেই। রাজুকে যে সঙ্গে লইয়া যাইব তাহারও উপায় নাই, কারণ তাহাকে প্রায়ই বৃন্দাবনে যাইতে হয়। কখন যে বৃন্দাবন হইতে ডাক আসিবে কিছুই ঠিক নাই।

তারকের পক্ষে এ সময় কোর্ট কামাই করা যে অসম্ভব, তুমি জানো। সুতরাং পুরাতন দরওয়ান মহাদেব ও শিবুর মা ঝিকে সঙ্গে লইয়া যাত্রা করিব স্থির করিয়াছি। কিছুদিন তো ঘুরিয়া বেড়াই, তাহার পর যেখানে হোক স্থির হইয়া বসিব।”

 

কি যেন একটা উপলক্ষে সারদাদের স্কুল সেদিন মধ্যাহ্নেই বন্ধ হইয়া যাওয়ায় সারদা বাড়ি ফিরিয়া আসিল বেলা একটায়। সবিতা তখন দক্ষিণেশ্বরে গিয়াছেন। তারক কোর্টে। সারদা একা বাড়িতে বসিয়া ইতিহাসের পড়া তৈয়ারী করিতে লাগিল।

সদর দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজের সঙ্গে ডাক শোনা গেল—নতুন-মা— বই মুড়িয়া দ্রুতপদে নামিয়া আসিয়া সারদা দুয়ার খুলিয়া দিল।

রাখাল বলিল, এ কি? তোমার স্কুল নেই আজ?

সারদা জবাব দিল, ছিল। ছুটি হয়ে গেছে।

রাখাল জিজ্ঞাসা করিল, কিসের জন্য ছুটি?

সারদা দুষ্টুমির হাসি হাসিয়া বলিল, আপনি আজ এখানে আসবেন বলে।

রাখাল গভীর মুখে বলিল, আচ্ছা, এ সব কথা বলতে মুখে কি একটুও বাধে না?

সারদা চপল কণ্ঠে উত্তর দিল, একটুও না।

সারদার পিছনে পিছনে সিঁড়ি দিয়া উঠিতে উঠিতে রাখাল বলিল, নতুন-মা কি করচেন? তাঁর সঙ্গে একটু দরকার আছে।

সারদা বলিল, তা হলে সন্ধ্যে পর্য্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

কেন? তিনি কি বাড়ি নেই?

না, দক্ষিণেশ্বরে গেছেন। আজ উপোস করে আছেন কি-না।

কিসের উপোস?

তা তো বলেন না কিছু। বলেন ব্রত আছে।

এত ব্রতই বা আসে কোথা থেকে? পাজিগুলো পুড়িয়ে না ফেললে আর রক্ষে নেই দেখচি।

আমি জানি দেব্‌তা, আজ মায়ের কিসের উপোস।

কিসের বলো তো?

আজ তাঁর মেয়ের জন্মতিথি।

তাই নাকি? তোমার নতুন-মা বলেছেন বুঝি?

পাগল হয়েচেন! সেই মানুষই বটে! অনেকদিন আগে মাকে বলতে শুনেছিলাম মাঘী পঞ্চমী রেণুর জন্মতিথি।

রাখাল হাসিয়া বলিল, সুতরাং এদিনে নতুন-মার উপবাস অনিবার্য্য!

সারদা বলিল, হ্যাঁ। শুধু তাই নয়— লক্ষ্য করে দেখেচি, এই দিনটিতে মা গরীব দুঃখীদের প্রচুর দান করেন। টাকা-পয়সা, নতুন কাপড়, কম্বল, আলোয়ান, এ-সব তো দেনই, তা ছাড়া পছন্দসই সুন্দর সুন্দর রঙীন শাড়ি, ডুরে শাড়ি, ব্লাউজ, সেমিজ এই-সব কিনে ভিখারী মেয়েদের বিলিয়ে দেন। বাড়ি থেকে এ-সব কিছু করেন না, কোথাও গিয়ে দিয়ে আসেন। যেমন কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর কিংবা গঙ্গার ঘাট এই রকম কোথাও।

রাখাল কিছু বলিল না। গম্ভীর-মুখে কি যেন চিন্তা করিতে লাগিল।

সারদা বলিল, শুনেচেন কি, মা যে কলকাতার বাসা উঠিয়ে দিয়ে চিরদিনের জন্ম অন্যত্র চলে যাচ্চেন?

রাখাল মুখ তুলিয়া বলিল, কোথায় যাচ্ছেন?

সারদা বলিল, আপাততঃ তীর্থভ্রমণে। তার পরে যে কোনও দেশে হোক থাকবেন।

রাখাল প্রশ্ন করিল, কবে যাবেন?

সারদা বলিল, তারকবাবুর বিয়েটা চুকে গেলেই।

রাখাল আশ্চর্য হইয়া বলিল, তারকের বিয়ে নাকি? কোথায়?

সারদা সবিস্তারে তারকের বিবাহ-সংবাদ রাখালকে জানাইল।

রাখাল বলিল, তারক ঘরজামাই থাকতে রাজী হ’লো?

বছর-দুই মাত্র। তার পর শিববাবু ওকে আলাদা একখানি বাড়ি দিয়ে পৃথক সংসার করে দেবেন কথা দিয়েচেন।

রাখাল হাসিয়া বলিল, তা হলে তারক শুধু এক রাজকন্যাই নয়, অর্ধেক রাজত্ব-শুদ্ধ পাচ্ছে বলো?

সারদা পরিহাসের সুরে বলিল, শুনে আপনার নিশ্চয়ই আপশোষ হচ্ছে না দেব্‌তা?

রাখাল সে-পরিহাসের জবাব না দিয়া অন্যমনস্কচিত্তে কি যেন ভাবিতে লাগিল। সারদা হঠাৎ মিনতির সুরে বলিল, দেব্‌তা, আপনিও কেন বিয়ে করুন না?

রাখাল এবার উচ্চ হাসিয়া বলিল, তারকের সঙ্গে টক্কর দিয়ে বিয়ে করবো নাকি?

সারদা বলিল, বাঃ, তা কেন? চিরকাল কি এমন একলা মেসে পড়ে থাকবেন? সংসার পাতাবার কি সাধ হয় না?

রাখাল বলিল, সাধ থাকলেও সকলেই কি সংসার করতে পারে সারদা?

কেন পারবে না? দীন-দুঃখীরাও তো তাদের নিজের মতন সংসার পেতে নেয়।

কিন্তু এও তো দেখা যায় সারদা, গরীব দুঃখী হয়তো অভাব অনটনের মধ্যেও সংসার করবার সুযোগ পেলো, কিন্তু মহাধনী প্রাচুর্য্যের মধ্যে থেকেও সে সুযোগ পেলো না। সকলের ভাগ্যে সব সুখ-সাধ পূর্ণ হয় না। ধরো না, তোমারও তো চেষ্টার ত্রুটি হয়নি, কিন্তু তুমিই কি সংসার করতে পাচ্চো?

স্বচ্ছন্দ-স্বরে সারদা জবাব দিল, আমার কথা ছেড়ে দিন। অত অল্প বয়সে বিধবা যদি না হতাম, আজ তো আমার মস্ত সংসার হ’তো। তার পরেও তো আবার খোদার উপরে খোদকারীর দুর্ব্বুদ্ধি নিয়ে নতুন সংসার পেতেছিলাম। স‍ইল না, তা কি করবো!

রাখাল বলিল, তা হলেই বোঝ—ভাগ্যং ফলতি সৰ্ব্বত্রম্!

সারদা রাখালের যুক্তিতে কর্ণপাত না করিয়া বলিল, আপনি বিয়ে করার পরে যদি সংসার গড়ে না উঠতো, অথবা সংসার পাতবার মুখে, বৌটি যদি মারা যেতো বা অন্য কিছু হ’তো—তা হলে ও-কথা মানতাম। আপনি তো আজ পর্য্যন্ত কোনো চেষ্টা করেননি!

রাখাল বলিল, চেষ্টা করলেই কি হয় নাকি? বিয়ে হওয়া না-হওয়াটাও যে ভাগ্যেরই উপর নির্ভর করে এটা বুঝি তুমি মানতে চাও না? দেখ সারদা, ঐ সব ইতিহাস ভূগোল পড়া, আর গালচে-সতরঞ্চির টানা-পোড়েন শেখা দিন-কতক বন্ধ রেখে তোমার একটু লজিক পড়া দরকার।

কিচ্ছু দরকার নেই। করুন দেখি তৰ্ক, কেমন না আপনাকে হারিয়ে দিতে পারি, দেখে নিন্।

রাখাল হাতজোড় করিয়া বলিল, আমি হার স্বীকার করে নিচ্ছি। একে স্ত্রীলোক, তায় অল্পবিদ্যা—এ যে কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার, তা সকলেই জানে। তর্কশাস্ত্র প্রণেতাগণ স্বয়ং এলেও হার মানবেন, আমি তো তুচ্ছ; ওকথা রেখে কাজের কথার জবাব দাও দেখি? নতুন-মা যে কলকাতার বাসা উঠিয়ে দিয়ে তীর্থযাত্রা করচেন, তোমার ব্যবস্থা কি হচ্ছে? তুমিও কি নতুন-মার সঙ্গেই যাচ্চো?

সারদা হাসিয়া বলিল, ধরুন, তাই যদি যাই—তাতে খুশী হবেন না অখুশী?

রাখাল একটু চিন্তা করিয়া বলিল, খুশী না হলেও অখুশী হবারই বা আমার কি অধিকার?

অধিকার যদি পান তা হলে?

রাখাল হাসিয়া বলিল, ও জিনিসটা অত তুচ্ছ নয়! অধিকার এমন বস্তু, যা দানের সাহায্যে এলে দুর্ব্বল হয়ে পড়ে; কাজেই মর্য্যাদা হারায়। অধিকার যেখানে আপনি সহজভাবে জন্মায়, সেইখানেই তার জোর খাটে।

সারদা বলিল, তবে আর আমারও অনধিকার চর্চ্চায় কাজ নেই। কিন্তু মোটের উপরে এটা বেশ বোঝা যাচ্চে যে, আমি মার সঙ্গে বিদেশে গেলে আপনি একটুও খুশী হন না।

সে শুধু তোমারই ভবিষ্যৎ কল্যাণের জন্য সারদা।

রাখালের কণ্ঠস্বর গাঢ় হইয়া উঠিল। বলিল, এতে আমার নিজের কিছু স্বার্থ আছে মনে করো না।

সারদা উদাসভাবে অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া বলিল, সংসারে কার যে কোথায় স্বার্থ, কি করে বুঝবো বলুন?

রাখাল ব্যাকুল হইয়া বলিল, আমি মিথ্যে বলিনি সারদা—

সারদা এবার হাসিয়া ফেলিল। স্নিগ্ধ মধুর সে হাসি। বলিল, শুনুন, নতুন-মা বলেচেন, যতদিন না পড়াশুনো শেষ হয়, আমাকে স্কুলের বোর্ডিংয়ে রাখবার ব্যবস্থা করে যাবেন।

রাখাল বলিল, সে বেশ সুব্যবস্থা।

সারদার মুখ অন্ধকার হইয়া উঠিল। অনুযোগের সুরে বলিল, কিন্তু আমার যে এ ইস্কুল-ফিস্কুল মোটে ভালো লাগে না দেব্‌তা!

কি ভালো লাগে বলো?

সারদা নতমুখে নিরুত্তর রহিল।

রাখাল বলিল, মোটা মোটা বই পড়ে থিওরিটিক্যাল জ্ঞান লাভের চেয়ে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে হাতে-কলমে কাজ শেখা তো বেশ ইন্টারেষ্টিং; ওটা তোমার ভালো লাগা উচিত।

সারদা নতচোখেই বলিল, আমার কিছুই শিখতে ভালো লাগে না।

রাখাল বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিল, কি তোমার ভালো লাগে সারদা।

বিষণ্ণ স্বরে সারা বলিল, সে বলে লাভ নেই। আপনি শুনে হয়তো ঠাট্টা করবেন।

রাখাল বলিল, সারদা, তোমার জীবনের সুখ-দুঃখের কথা নিয়েও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করবো এতবড় পাষণ্ড আমি নই।

অপ্রতিভ হইয়া সারদা বলিল, দেব্‌তা তা নয়। আমার কি যে ভালো লাগে আমি নিজেই তা বুঝতে পারি না। তবে এইটুকু বলতে পারি, নির্দ্দিষ্ট সময় যন্ত্রের মতো ইস্কুলে গিয়ে পড়াশুনা, শিল্পকৰ্ম্ম বা ধাত্রীবিদ্যা শেখার চেয়ে, বাড়িতে ঘর-সংসারের কাজ করতে আমার অনেক ভালো লাগে। সংসারকে নিখুঁত শৃঙ্খলায় সাজিয়ে, গুছিয়ে পরিপাটি রাখতে আমার উৎসাহের অন্ত নেই। এজন্য আমি সকাল থেকে রাত্রি পর্য্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করতে পারি। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আমার সবচেয়ে আনন্দের সামগ্রী। দেখেচেন তো নতুন-মার পুরোনো বাড়িতে থাকতে, ভাড়াটেদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা আমার কাছেই থাকতো, খেলা করতো, ঘুমাতো, পড়াশুনা করতো।

অল্পক্ষণ থামিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া সারদা বলিল, নিজের হাতে আপনজনদের সেবা যত্ন করার মধ্যে যে কত তৃপ্তি, কত আনন্দ, তা মেয়েমানুষ ভিন্ন আর কেউ বুঝবে না।

রাখাল ব্যথিত হইয়া বলিল, সারদা, তুমি নিজের সংসার বলতে কিছু পাওনি বলেই সংসারের দিকে তোমার এত আকর্ষণ।

সারদা বলিল, হয়তো তাই হবে। সেই জন্যেই তো মিনতি করে বলচি দেব্‌তা আপনি বিয়ে করুন, সংসারী হোন। আমি আপনার সংসার নিয়ে থাকবো। আপনাদের দুজনকে প্রাণ ঢেলে সেবা-যত্ন করব। নিজের হাতে এমন সুন্দর করে ঘর-সংসার সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখবো, দেখবেন লোকে সুখ্যাতি করে কি না। তারপর খোকা-খুকুদের মানুষ করার ভার পুরোপুরিই নেবো আমার হাতে। এই যে সেলাই, বোনা, শিশুপালন এত কষ্ট করে শিখচি, এ কি সত্যিই হাসপাতালে বা লোকের দোরে দোরে চাকরি করে বেড়াবো বলে? তা মনেও করবেন না।

রাখাল-বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া সারদার কথাগুলি শুনিতেছিল।

সারদা বলিতে লাগিল, ইস্কুলের এত কড়া নিয়ম আমার আদপেই বরদাস্ত হয় না। তবুও জোর করে শিখচি কেন জানেন? সংসার করবো বলে। আমি আপনার বিয়ে দেবোই। নিজে মেয়ে পছন্দ করবো। সংসার পাতবো নিখুঁত করে। মানুষ করবো ছেলে-মেয়েদের—ভগবান না করুন— যদি সংসারে অভাব অনটন ঘটে, তার জন্য কারো কাছে গিয়ে হাত পাততে হবে না, নিজেই সেটুকু পূর্ণ করে নিতে পারবো।

রাখাল বলিল, তুমি কি এই কল্পনা নিয়েই শিক্ষার প্রবেশ করচো, সারদা?

রাখালের মুখের পানে তাকাইয়া সারদা বলিল, আপনি থাকতে সত্যই কি আমি অন্নের জন্য পরের দুয়ারে হাত পেতে চাকরি করতে বেরুবো ভেবেচেন? কি দুঃখে যাবো? বয়ে গেছে আমার—

সারদার কণ্ঠের প্রগাঢ়তায় রাখালের অবিশ্বাস করিবার মত কিছুই রহিল না।

সারদার মুখের পানে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাইয়া রাখাল ধীরকণ্ঠে বলিল, সারদা, তুমি কি বলতে চাও—সমস্ত জীবনটা তোমার এমনি করে পরের সংসারেই বিলিয়ে দিয়ে যাবে? নিজের সংসার, নিজের স্বামী, নিজের সন্তান না পেলে জীবনে সংসারের সাধ কি সম্পূর্ণ সাৰ্থক হয়?

সারদা মৃদুস্বরে বলিল, এ আমি আপনাকে তর্ক করে বোঝাতে পারবো না দেব্‌তা—আমি জেনেচি, স্বামী, গৃহস্থালী, সন্তান মেয়েদের জীবনে সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষার সামগ্রী। যে মেয়ে সত্যি করে একে ভালবাসে, সে কখনো এতে এতটুকু কালি লাগতে দিতে পারে না। কোন মেয়েই চায় না, তার নিজের সন্তানের কপালে বাপ-মায়ের কোনরকম কলঙ্কের ছাপ থাকুক। যে জন্যই হোক, আর যার দোষেই হোক এ কথা তো কোনদিন ভুলতে পারিনে যে আমার জীবনে অশুচির ছোঁয়া লেগেচে। নিজের স্বামী-পুত্রকে খাটো করে নিজে স্ত্রী হবো—মা হবো— ততবড় স্বার্থপর আমি নই। নাই বা পেলাম স্বামী, সন্তান, যাকে অন্তরের সঙ্গে ভালোবাসি, ভক্তি করি, তাঁর সন্তান কি নিজের সন্তানের চেয়ে কম স্নেহের? তাঁর সংসার কি নিজের সংসারের চেয়ে কম আনন্দের?

রাখাল নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল।

অনেকক্ষণ পরে সারদা আস্তে আস্তে বলিল, দেব্‌তা, আমি নির্ব্বোধ নই। আপনি বিয়ে করুন। আপনার বৌকে আমি ভালবাসতে পারবো। আমি ঈর্ষাকে ঘৃণা করি। তা ছাড়া সবচেয়ে বড় কথা কি জানেন? সে-ই যে আমাকে সব দেবে। আপনার সংসার– আপনার সন্তান— আমার আনন্দের সকল অবলম্বন যে তারই হাত থেকে পাবো! — আমার জীবনের সত্যিকারের সার্থকতা সে যে তারই দান।

নিরুত্তর রাখাল একইভাবে চিন্তাচ্ছন্ন হইয়া বসিয়া রহিল। বহুক্ষণ নিঃশব্দে কাটিয়া গেলে রাখাল নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া মুখ তুলিয়া অস্ফুট-কণ্ঠে বলিল, তোমার অনুরোধ আজ সত্যই আমার ভবিষ্যৎ জীবন সম্বন্ধে ভাবিয়ে তুললে সারদা! আমি দেখবো চিন্তা করে—আজ চললাম। নতুন-মা এলে ব’লো আমি এসেছিলাম।