ছাব্বিশ
তারকের বিবাহ নির্ব্বিঘ্নে ঢুকিয়া গেল।
বিমলবাবু কলিকাতায় আসিয়াছেন। সবিতা প্রস্তুত হইয়াছেন বিমলবাবুর সহিত তীর্থভ্রমণে বাহির হইবার জন্য। আগামী কল্য তাঁহারা রওনা হইবেন। পুরাতন দরওয়ান মহাদেও ব্যতীত বিমলবাবু দাসী ও রাঁধুনী সঙ্গে লওয়ার ব্যবস্থা করিয়াছেন।
রাখালকে ডাকাইয়া সবিতা তাহার হাতে ব্রজবিহারীবাবুর শিলমোহর করা গহনা সমেত বাক্সটি তুলিয়া দিয়া বলিলেন, এ গহনা রেণুর। সে না নিতে চায়, সংসারে মাতৃহীনা মেয়েদের মধ্যে এ তুমি বিলিয়ে দিয়ো রাজু। এ-সমস্ত আটকে রেখেছিলাম যার জন্য, সেই যখন চরম দারিদ্র্য মাথায় তুলে নিলো, আমি আর এ বোঝা বয়ে মরি কেন? দেড় লক্ষ টাকা দামের যে সম্পত্তি আমার নামে ছিল— সে কেনা হয়েছিল রেণুরই বাপের উপার্জ্জনের টাকায়। সে সম্পত্তি রেণুর নামে ট্রান্সফার করে রেজেস্ট্রি করে দিয়েচি, এই নাও সেই দলিল ও কাগজপত্র। সে না গ্রহণ করে এ সম্পত্তির যে ব্যবস্থা তুমি নিজে ভাল বুঝবে তাই ক’রো। আর এই হাজার-কয়েক টাকার কোম্পানীর কাগজ ও আমার এই হার, বালা, চুড়ি যা বিয়ের সময় আমার বাপের দেওয়া, এ আমি তোমার ঘর করতে যে আসবে, অর্থাৎ আমার বৌমাকে—আমার যৌতুক দিয়ে গেলাম। এ তার শাশুড়ীর আশীর্ব্বাদী। ফিরিয়ে দিয়ো না বাবা।
সারদা দূরে দাঁড়াইয়া রাখালের মুখের পানে চাহিয়া মৃদু হাসিল।
রাখাল বিপন্ন হইয়া বলিল, নতুন-মা, আপনার ছেলের বিদ্যে-বুদ্ধির খবর আপনার অজানা নয়। এতবড় গুরু দায়িত্ব আমার উপর দিয়ে যাচ্ছেন কেন? আমি কি পারবো এ-সবের ব্যবস্থা করতে? তার চেয়ে বরং তারকের কাছে এ-সব গচ্ছিত রেখে যান; সে আইনজ্ঞ মানুষ, বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপার বোঝে সোঝে ভালো, তার হাতে থাকলে সুব্যবস্থা হতে পারে।
সবিতা বলিলেন, আমাকে কি তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে যেতে দিবিনে রাজু? তার পরে গাঢ়-স্বরে বলিলেন, যে উদ্দেশ্য নিয়ে তোমার কাকাবাবুর হাত থেকে এ-সমস্ত একদিন নিজের হাতে নিয়েছিলাম তা সাৰ্থক হ’লো না। তোমার কাকাবাবুর ডুবে যাওয়া কারবারের তলায় এগুলিও সেদিন তলিয়ে গেলেই ভালো হ’তো। হয়তো এর চেয়ে সান্ত্বনা পেতাম তাতে।
রাখাল কুণ্ঠিত হইয়া বলিল, কিন্তু সে যাই বলুন নতুন-মা, আমি কিন্তু এসব আর্থিক ব্যাপারে নিতান্তই অন্ধ। আমাকে দিয়ে—
সবিতা ধীর কণ্ঠে বলিলেন, ভয় পেয়ো না রাজু। তুমি এ-সম্বন্ধে যে ব্যবস্থাই করবে, সেইটাই হবে সুব্যবস্থা। আর শুভ ব্যবস্থা।
সবিতারা প্রথমেই যাত্রা করিলেন দ্বারকা। সেখান হইতে বহু স্থানে ঘুরিতে ঘুরিতে গুজরাট রাজপুতনা প্রভৃতি ভ্রমণ করিয়া আগ্রায় আসিয়া পৌঁছিলে, বিমলবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, মথুরা-বৃন্দাবন দেখবে না সবিতা? এখান থেকে খুব কাছে—
সবিতা বলিলেন, শ্রীকৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র প্রভাস দেখলাম, দ্বারকা দেখলাম, মথুরা-বৃন্দাবনই বা বাকি থাকে কেন—চলো যাই।
মথুরায় বিমলবাবুর পরিচিত এক ধনী শেঠের প্রাসাদে তাঁহারা আসিয়া উঠিলেন। শেঠজী কারবার-সূত্রে বিমলবাবুর সহিত বিশেষ পরিচিত। তাঁহার সুরম্য ‘গেস্ট হাউসে’ বা অতিথি-ভবনে বিমলবাবুদের থাকিবার বন্দোবস্ত তো করিয়া দিলেনই, নিজের একখানি মোটরকার ও বিমলবাবুর সর্ব্বদা ব্যবহারের নিমিত্ত ছাড়িয়া দিলেন।
মথুরা হইতে মোটরযোগে বৃন্দাবন গিয়া বিমলবাবু বলিলেন, সবিতা, ব্রজবাবুদের সঙ্গে দেখা করতে যাবে নাকি?
সবিতা বলিলেন, পাগল হয়েচো! আমরা দেবদর্শন করতে এসেচি, তাই দেখে ফিরে যাবো।
সমস্তদিন বৃন্দাবনের নানা স্থানে ঘুরিয়া ক্লান্ত বিমলবাবু বৈকালে বলিলেন, চলো এইবার মথুরায় ফেরা যাক।
সবিতা বলিলেন, শুনেচি, বৃন্দাবনে গোবিন্দজীর আরতি ভারি সুন্দর, আরতিটা দেখে গেলে হয় না।
বিমলবাবু বলিলেন, আরতি দেখেই ফেরা যাবে। বিস্তৃত একটি মাঠের পাশে গাছতলায় মোটর রাখিয়া তাঁহারা সতরঞ্চি বিছাইয়া বিশ্রাম করিতে বসিলেন। মহাদেও দরওয়ান বিমলবাবুর চায়ের সরঞ্জামপূর্ণ বেতের বাক্স গাড়ি হইতে নামাইয়া স্টোভ জ্বালিয়া গরম জল প্রস্তুত করিতে প্রবৃত্ত হইল। সবিতা চা খান না, কিন্তু নিজ হস্তে চা তৈয়ারী করেন। এলুমিনিয়ম কেটলী হইতে ফুটন্ত জল চীনামাটির চা-পাত্রে ঢালিয়া, চিনি, চা, দুধ প্রভৃতি মহাদেও সবিতার সম্মুখে অগ্রসর করিয়া দিল।
ক্লান্তকণ্ঠে সবিতা বলিলেন, মহাদেও, তুমিই আজ চা তৈরী করো। আমি ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়েচি।
বিমলবাবু উদ্বিগ্ন হইয়া বলিলেন, তোমার শরীর খারাপ ঠেকচে নাকি? তা হলে আজ আর মন্দিরে ভিড়ের মধ্যে গিয়ে কাজ নেই।
সবিতা বলিলেন, না এমন কিছুই হয়নি। আরতি দেখবো সঙ্কল্প যখন করেছি, না দেখে যাবো না।
প্রান্তরের প্রান্তে সূর্য্য অস্তাচলে নামিয়া গেলেন। গাঢ় রাঙা আলোর নীল আকাশ, সবুজ মাঠ আরক্তিম হইয়া উঠিল। কুলায়গামী পাখীর কলকোলাহলে বৃন্দাবনের গাছপালা ও কুঞ্জ মুখরিত হইয়া উঠিয়াছে। সবিতা স্তব্ধ হইয়া মাঠের প্রাপ্তে অন্যমনস্ক দৃষ্টি মেলিয়া বসিয়া আছেন। বিমলবাবু নীরবে সংবাদপত্র পাঠ করিতেছেন। ক্রমে সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিল। কাগজ হইতে মুখ তুলিয়া বিমলবাবু বলিলেন, চলো, এইবার মন্দিরে যাই। পরে গেলে ভিড়ে হয়তো তোমার ঢুকতে কষ্ট হতে পারে!
সবিতা সুপ্তোত্থিতের ন্যায় সচকিতে ফিরিয়া চাহিয়া বলিলেন, চলো।
গাড়িতে উঠিয়া বসিয়া হঠাৎ কি ভাবিয়া বলিলেন, দেখো, একটু পরেই না হয় মন্দিরে যাবো আমরা। আরতির কাঁসর ঘণ্টা বেজে উঠুক আগে। ভিড়ে এমন আর কি কষ্ট হবে?
বিমলবাবু প্রতিবাদ করিলেন না। গাড়ি এদিক সেদিক খানিক ঘুরিবার পরই আলোকিত গোবিন্দজীর মন্দিরে আরতির বাজনা বাজিয়া উঠিল। বিমলবাবুরা মন্দিরে প্রবেশ করিলেন।
গোবিন্দজীর আরতি হইতেছে। সবিতা বিগ্রহ-মূর্ত্তির সম্মুখে দাঁড়াইয়া গলবন্ত্রে আরতি দর্শন করিতেছেন! কিন্তু তাঁহার দৃষ্টি বিগ্রহের প্রতি স্থির নয়, আশে-পাশে চঞ্চল। হঠাৎ দৃষ্টি পড়িল, সেই বারান্দারই এককোণে ব্রজবাবু যুক্তকরে দাঁড়াইয়া নিষ্পলক নয়নে আরতি দর্শন করিতেছেন। ওষ্ঠাধর মৃদু মৃদু কাঁপিতেছে, নাম জপ করিতেছেন সম্ভবতঃ।
আরতি সমাপ্ত হইলে ভিড় কমিয়া গেল। বিমলবাবু অগ্রসর হইয়া ব্রজবাবুর পদধূলি গ্রহণ করিলেন। সর্পদষ্টবৎ সরিয়া গিয়া ব্রজবাবু বলিয়া উঠিলেন, গোবিন্দ! গোবিন্দ! এ কি! প্রভুর মন্দিরে আমাকে প্রণাম! মহাপাপে পাপী হলাম যে!
বিমলবাবু অপ্রস্তুত হইয়া বলিলেন, আমি জানতাম না মন্দিরে প্রণাম করতে নাই। ক্ষমা করুন।
গোবিন্দ, গোবিন্দ, আপনি আমাদের বিমলবাবু না? চলুন চলুন, আঙিনায় তুলসীকুঞ্জের দিকে গিয়ে বসি।
বিমলবাবু বলিলেন, চলুন।
ব্রজবাবু বিগ্রহ-মূর্ত্তির সন্মুখে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাতে শুইয়া পড়িয়া বারংবার আপনার নাসাকর্ণ মলিয়া হয়তো বা বিমলবাবুর প্রণাম-জনিত অপরাধেরই মার্জ্জনা ভিক্ষা করিতে লাগিলেন।
সবিতা স্থিরনয়নে ভূপতিত ব্রজবাবুর পানে তাকাইয়া নিস্পন্দের ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিলেন।
সুদীর্ঘ প্রণাম অন্তে উঠিয়া ব্রজবাবু সবিতা ও বিমলবাবু-সহ মন্দিরের অন্যদিকে গিয়া দাঁড়াইলেন।
ব্রজবাবুর চেহারার পরিবর্ত্তন হইয়াছে। মুখমণ্ডল ও মস্তক ক্ষৌর-মুণ্ডিত। শীর্ষে দুগ্ধধবল শিখাগুচ্ছ ছাড়া কেশের চিহ্নমাত্র নাই। কণ্ঠে তুলসীকাঠের গুচ্ছবদ্ধ মালা। নাসিকা ও ললাটে তিলকরেখা, হাতে হরিনামের ঝুলি, গায়ে নামাবলী। গৌরবর্ণ দীর্ঘছন্দ দেহ রৌদ্রদগ্ধ তামাটে হইয়া বাৰ্দ্ধক্যভারে সম্মুখে অনেকটা নত হইয়া পড়িয়াছে।
বিমলবাবুর কুশল প্রশ্নের উত্তরে ভাবগাঢ়-কণ্ঠে ব্রজবাবু বলিলেন, বিমলবাবু, গোবিন্দ এই দীনহীনকে অনেক কৃপা করেছেন। যে-জন ব্রজধামে এসেচে, ব্রজরেণু মেখেচে, যমুনায় অবগাহন করে শ্যামকুণ্ড রাধাকুণ্ড গিরিগোবর্দ্ধন দর্শন স্পর্শ করেচে, তার কি আর কোনও অকুশল থাকে? বৃন্দাবনে সবই কুশল। ইহলোকে আর আমার কোনও কামনাই নাই। এখানে আমি কৃষ্ণানন্দে বিভোর হয়ে আছি।
সবিতা অগ্রসর হইয়া আসিয়া বলিলেন, রাজুর কাছে শুনেচি তুমি এখানে নাকি কোন বৈষ্ণব বাবাজীর আখড়ার দীক্ষা নিয়েছো? সদাসর্ব্বদা বোধ হয় তাদের নিয়েই মেতে আছো মেজকর্ত্তা?
আমতা আমতা করিয়া ব্রজবাবু বলিলেন, তা কতকটা বটে। কি জানো নতুন-বৌ, আমার শেষের দিনগুলি গোবিন্দ তাঁর চরণ-ছায়ায় টেনে এনে বড় করুণাই করেচেন। এখানে সংসারের সকল দুঃখ-তাপ সত্যিই জুড়িয়েচি!
সবিতা স্তম্ভিত বিস্ময়ে ব্রজবাবুর পানে তাকাইয়া বলিলেন, মেজকৰ্ত্তা, এ যে তোমার রেসে হেরে সর্ব্বস্বান্ত হয়ে মদের নেশায় মশগুল থাকা। এ আনন্দের দাম কি তা জানো?
মন্দিরের অন্যধারে খোল-করতাল যোগে একদল কীৰ্ত্তনীয়া গাহিতেছিল—
“প্রেমানন্দে ডগমগ সুধার সাগরে
ডুবিয়া ডুবিয়া পিয়ে তৃপ্তি না সঞ্চারে॥
কৃষ্ণ প্রাণ, কৃষ্ণ ধন, কৃষ্ণ তনু-মন,
কৃষ্ণ যে সুখের নিধি পরম রতন॥
কুল, শীল, ধৰ্ম্ম, কৰ্ম্ম, লোকলজ্জা, ভয়,
দেহ গেহ সম্পদ যে নাহি কি আছয়,
মদিরা-মদাগ্ধ যেন কটির বসন
আছে কি না আছে তারা নাহি বিবেচন॥”
ব্রজবাবুর দুই চক্ষু ছাপিয়া অশ্রু গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। বিহ্বলকণ্ঠে কহিলেন, নতুন-বৌ, এ মদের নেশা যেন আর না ছোটে এই কামনাই ক’রো।
সবিতা কঠিন কণ্ঠে কহিলেন, তোমার মেয়ে? আমার রেণু?
কে আমার মেয়ে? আর আমিত্বের মোহ রেখো না নতুন-বৌ। সমস্তই তুহুঁ তুহুঁ। ‘আমার’ বলে কিছুই নাই। সেই একমাত্র ‘আমি’ ব্রজনন্দন শ্রীকৃষ্ণই এখানে সব। রেণুকে তাঁরই চরণে অর্পণ করেচি। যতদিন ওকে নিজের বলে ভেবেচি, ভাবনায় হয়ে পড়েচি দিশেহারা। এবার দিন-দুনিয়ার মালিক যিনি, তাঁর হাতে তোমার রেণুকে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েচি। তিনি যে ব্যবস্থা করবেন, কারো সাধ্য নেই তা রদ করবার। ধরো না কেন আমাদের কথাই। মানুষের ব্যবস্থা, মানুষের ইচ্ছা, মানুষের মালিকানা খাটলো কি? আড়াল থেকে সেই পরম রসিক হেসে যেদিকে অঙ্গুলি হেলালেন, সেইদিকেই উল্টে গেল পাশা। পুতুল-বাজীর পুতুল আমরা, নিজেদের কোনও ইচ্ছাই মানুষের খাটতে পারে না, একমাত্র তাঁর ইচ্ছা ছাড়া।
সবিতা কি যেন জবাব দিতে যাইতেছিল, কে ডাকিল, বাবা—
কণ্ঠস্বরে চমকিত হইয়া সবিতা পিছন ফিরিয়া দেখিলেন,—রেণু! শীর্ণ মুখ, রুক্ষ কেশ, চেহারায় দারিদ্রের রুক্ষতা সুস্পষ্ট। পরণে একখানি আধময়লা ছাপা বৃন্দাবনী শাড়ি, তারও কণ্ঠে তুলসীর কণ্ঠী – ললাটে ও নাসিকাগ্রে চন্দন-তিলক।
সবিতা স্তম্ভিত দৃষ্টিতে কন্যার পানে চাহিয়া নিথর হইয়া গেলেন।
রেণু সবিতার দিকে না তাকাইয়া ডাকিল, বাবা, ঘরে চলো, রাত হয়ে যাচ্ছে।
ব্রজবাবু একটু অপ্রস্তুত হইয়া বলিলেন, তোর মাকে চিনতে পারলিনে রেণু?
মাথা হেলাইয়া রেণু বলিল, দেখেচি। মন্দিরে তো প্রণাম করতে নেই।
মায়ের মুখের পানে একবার শান্ত নির্লিপ্ত দৃষ্টিপাত করিয়া আবার ব্রজবাবুর দিকে ফিরিয়া বলিল, চলো বাবা। একাদশীর উপবাস করে রয়েচো সারাদিন, কখন একটু প্রসাদ পাবে?
কন্যার আকৃতি দেখিয়া সবিতার অন্তরে যে আর্ত্তক্রন্দন গুমরিয়া উঠিতেছিল, কন্যার কথাবার্ত্তার ভঙ্গিতে তাহা যেন আরও উদ্বেগ হইয়া উঠিল।
মাতার প্রতি কন্যার এই পরের মত আচরণে ব্রজবাবু মনে মনে কুণ্ঠিত হইয়া পড়িতেছিলেন। হয়তো বা সেইজন্যই সবিতাকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিলেন, নতুন-বৌ গোবিন্দর কুটীরে একদিন তোমরা সেবা করতে পারবে কি?
সবিতা রেণুর নির্লিপ্ত মুখের পানে ক্ষণিক দৃষ্টিপাত করিয়া ব্রজবাবুকে জবাব দিলেন, না মেজকর্ত্তা, তোমার গোবিন্দের কুটীরে আমার মতন মহাপাপীর প্রবেশের উপায় নেই!
জিভ কাটিয়া ব্রজবাবু বলিলেন, গোবিন্দ! গোবিন্দ! দীনদয়াল দীনবন্ধু— পতিত-পাবন তিনি। তিনি যে অশরণের শরণ নতুন-বৌ—
উচ্ছ্বসিত কান্না প্রাণপণে দমন করিতে করিতে সবিতা বলিলেন, শুধু তোতাপাখীর মত মুখেই এসব আওড়ে গেলে মেজকর্ত্তা! তোমাদের ধৰ্ম্ম, তোমাদের যা তৈরি করেচে সে তোমরা নিজচক্ষে দেখতে পাচ্ছো না তাই রক্ষে। যে ধর্ম্মে ক্ষমা নেই, সে ধর্ম্ম অধর্ম্ম থেকে কতটুস্থ আর উঁচু? সবিতা ত্বরিতপদে মন্দিরের বাহিরের দিকে অগ্রসর হইলেন।
বিমূঢ় ব্রজবাবুর সামনে আসিয়া বিমলবাবু বলিলেন, আপনার সঙ্গে আমার একটু কথা ছিল, কখন আপনার সুবিধা হবে জানতে পারলে।
ব্রজবাবু বলিলেন, যখন আপনার সুবিধা হবে তখনই।
বিমলবাবু বলিলেন, বেশ, কাল দুপুরে আমি আসব। আপনার বাসাটা—
এই মন্দির থেকে বেরিয়ে বাঁ-হাতি রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে গিয়ে ডাইনে গলিতে। ঘনশ্যামদাস বাবাজীর কুঞ্জ বললে সকলেই দেখিয়ে দিতে পারবে।
রেণু বলিল, বাবা, কাল যে শ্রীগুরু কুঞ্জে মহারাজের অহোরাত্র নামকীৰ্ত্তন আর বৈষ্ণব সেবা আছে। কাল সারাদিন আমরা তো সেইখানেই থাকবো।
ব্রজবাবু ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, ঠিক মনে করিয়ে দিয়েচিস মা। বিমলবাবু, কাল আমায় মাপ করতে হবে; কাল আমি সারাদিন আমার গুরুদেব শ্রীশ্রীবৈকুণ্ঠ দাস বাবাজীর শ্রীকুঞ্জে থাকবো। আপনি পরশু সকালে এলে অসুবিধা হবে কি?
বিমলবাবু বলিলেন, কিছু না। তা হলে পরশু সকালেই আমি আপনার কাছে আসবো। নমস্কার।
ব্রজবাবু বলিলেন, গোবিন্দ! গোবিন্দ!
মোটরে উঠিয়াই আসনের উপর ক্লান্ত দেহ এলাইয়া দিয়া সবিতা বলিলেন, আর নানা স্থানে ছুটে বেড়াতে ভালো লাগচে না। এইবার বিশ্রাম চাই দয়াময়।
বিস্মিত বিমলবাবু সবিতার মুখের পানে তাকাইয়া বলিলেন, বৃন্দাবনেই থাকবে স্থির করলে নাকি?
না না না! এখানে আমি একদণ্ড টিকতে পারবো না! কণ্ঠস্বরে একটু জোর দিয়াই বলিলেন, আমাকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে চলো।
অত্যন্ত বিস্মিত হইয়া বিমলবাবু বলিলেন, সে কি?
হ্যাঁ—কাল সকালেই যাত্রার সমস্ত ব্যবস্থা করে ফেলো। একদিনও আর বিলম্ব না—সবিতার কণ্ঠে আকুল মিনতি ধ্বনিত হইয়া উঠিল।
বিমলবাবু বলিলেন, এমন অধীর হয়ো না সবিতা। কাল তো যাওয়া হতে পারে না! এ রেলের পথ নয়, জাহাজের পথ। কলকাতা হয়ে যেতে হবে। তা ছাড়া ব্রজবাবুকে কথা দিয়ে এলাম, পরশু সকালে তাঁর সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা করবো। সুতরাং কালকের দিনটা অপেক্ষা না করে তো উপায় নেই। অবশ্য রাতের ট্রেনেই আমরা মথুরা ছাড়তে পারবো—
সবিতা বালিকার ন্যায় ব্যাকুল হইয়া বলিলেন, না না, আমি পারবো না। আমার দম আটকে আসচে এখানে। এদেশ থেকে আমাকে তুমি চিরদিনের মতো বহু দূরদেশে নিয়ে চলো। বহুদূরে— যেখানে রীতি, নীতি, সমাজ, মানুষ সবই অন্যরকম। আমি মুছে ফেলবো আমার সমস্ত অতীত! তাকে এমন করে আমার জীবন দখল করে থাকতে আর দেবো না আমি—
বিমলবাবু কোনও উত্তর দিলেন না। সবিতার মনের অবস্থা বুঝিয়া চুপ করিয়া রহিলেন।
পরদিন প্রাতে বিমলবাবু ঘুম হইতে উঠিয়া দেখিলেন, সবিতার শয়ন কক্ষের দ্বার তখনও বন্ধ। বিমলবাবু চিরদিনই একটু বেশি বেলাতে ওঠেন। কিন্তু সবিতার ভোরে ওঠাই অভ্যাস। এত বেলাতেও সবিতার শয়নকক্ষের দ্বার রুদ্ধ দেখিয়া তিনি শঙ্কিত হইলেন। দুয়ারের সম্মুখে দাঁড়াইয়া দ্বারে ধাক্কা দিবেন কি না ভাবিতেছেন, এমন সময় দুয়ার খুলিয়া সবিতা বাহির হইলেন। দুই চক্ষু রক্তবর্ণ, রাত্রিজাগরণের ক্লান্তি ও কালিমা চোখে-মুখে নিবিড় রেখায় ফুটিয়া উঠিয়াছে। মরণাপন্ন রোগী লইয়া সুদীর্ঘ রজনী মৃত্যুর সহিত যুঝিবার পর প্রভাতে নারীর মুখের চেহারা যেমন বদলাইয়া যায়, এক রাত্রিতেই সবিতার মুখে যেন সেই ছবি ফুটিয়া উঠিয়াছে।
বিমলবাবু একবার সবিতার পানে তাকাইয়া ব্যথিত দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরাইয়া লইলেন। কিছুই প্রশ্ন করিলেন না।
সবিতা ঈষৎ লজ্জিত হইয়া বলিলেন, অনেক বেলা হয়ে গেছে দেখচি। তুমি চা পাওনি নিশ্চয়। কাপড় কেচে এসে আমি তৈরি করে দিচ্চি এখুনি।
বিমলবাবু বলিলেন, ঠাকুর চা করে দিক না আজ সবিতা?
সবিতা বলিলেন, না না, সে ভালো তৈরি করতে পারে না। আমার দেরি হবে না বেশি।
তার পরে নিজেই কৈফিয়তের ভঙ্গিতে সহজ গলায় কহিলেন, রাত্রে ভালো ঘুম হয়নি। কাল মেজাজ এমন বিগড়ে গেছলো, মাথা ধরে ওঠে, রাত্তিরের ঘুমটি মাঝে থেকে মাটি হলো আর কি। যাই চট্ করে স্নানটা সেরে আসি।
সবিতা গামছা হাতে লইয়া স্নানকক্ষের দিকে চলিয়া গেলেন। বিমলবাবু অন্যমনস্ক চিত্তে ভাবিতে লাগিলেন, কতখানি নিদারুণ হতাশা ও মর্ম্মবেদনায় মানুষের চেহারা একরাত্রের মধ্যে এতখানি ম্লান ও বিশুষ্ক হইতে পারে!
চা চালিতে ঢালিতে সবিতা অত্যন্ত সহজভাবে বলিলেন, কাল বেশ ভালো করে ভেবে-চিন্তে কর্ত্তব্য স্থির করে ফেলেচি। বুঝেচো?
বিমলবাবু বলিলেন, কিসের?
ওই ওদের সম্বন্ধে।
এই অনির্দ্দিষ্ট সর্ব্বনাম যে কাহার উদ্দেশ্যে উচ্চারিত হইল বিমলবাবু বুঝিতে পারিলেন। কতখানি গভীর বেদনার ফলেই অতি প্রিয় নাম আজ সর্ব্বনামে রূপান্তরিত হইয়াছে, তাহাও তাঁহার অজ্ঞাত রহিল না। বলিলেন, কি স্থির করলে সবিতা?
সিঙ্গাপুরে যাওয়াই স্থির করলাম।
আরও দিনকতক তীর্থভ্রমণে বেড়ানো যাক—তারপরেও যদি ইচ্ছে করো, যাবে। কেমন?
না, আর তীর্থে নয়। মানুষের হাতে গড়া এই পুতুল খেলার তীর্থে ঘুরে ঘুরে শুধু ঘোরার নেশায় খানিক সময় কাটে মাত্র, অন্তরের প্রকাণ্ড জিজ্ঞাসার উত্তর মেলে না। এ খেলায় আর যারই মন ভুলুক, যে সত্য চায়, তার মন ভোলে না। এবারে বিশ্রাম চাই।
বিমলবাবু একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন, কিন্তু যেখানে বিশ্রামের আশায় যেতে চাইচো, সেখানে গিয়ে যদি তা না পাও?
সে ভয় করো না। এবার আর আমার ভুল হবে না। তোমার হাত দিয়ে ভগবান আমার জীবনের দিনান্তে যে সামগ্রী আমাকে পাঠিয়েচেন, তা সামান্য নয়। বোঁটা থেকে যে ফুল ছিঁড়ে পড়ে গেছে মাটিতে, সে ফুল আর কখনো শাখার বাঁধনে ফিরে আসে না। আলেয়ার পিছনে ছুটে বেড়ানো যে শুধু দুঃখই বাড়ানো—এবার তা আমি বুঝতে পেরেচি।
অনেকক্ষণ নিস্তব্ধে কাটিয়া গেল। বিমলবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, তা হলে টেলিগ্রাম করে দিই, সিঙ্গাপুরের জাহাজে দুটো কেবিন রিজার্ভের জন্য?
সবিতা মাথা হেলাইয়া সম্মতি জানাইলেন।
পরদিন সকালে বিমলবাবু মথুরা হইতে মোটরযোগে যখন বৃন্দাবনে রওনা হইলেন, সবিতাকে বলিলেন, ব্রজবাবু তোমাকে তাঁর বাসায় নিমন্ত্রণ করেছিলেন। একবার ঘুরে আসবে নাকি?
সবিতা অসম্মত হইলেন। বিমলবাবু একাই বাহির হইয়া গেলেন। বৃন্দাবনে ব্রজবাবুর ঠিকানা খুঁজিয়া বাসায় পৌঁছিয়া দেখিলেন, রেণু পূর্ব্বদিন রাত্রি হইতে কলেরায় আক্রান্ত হইয়াছে। চিকিৎসা ও শুশ্রূষার উপযুক্ত বন্দোবস্ত কিছুই হয় নাই। রোগীকে হরিনাম সংকীর্তন শোনান হইতেছে। ব্রজবাবু ঠাকুর ঘরে হত্যা দিয়া পড়িয়া আছেন। মধ্যে মধ্যে উঠিয়া আসিয়া মুমূর্ষু কন্যার ওষ্ঠাধরে একটু করিয়া চরণামৃত দিতেছেন, পুনরায় ব্যাকুলচিত্তে ছুটিয়া গিয়া বিগ্রহের সম্মুখে আছড়াইয়া পড়িতেছেন। তাঁহার গুরুদেব ঠাকুরদাস বাবাজীর কুঞ্জে সংবাদ পাঠানোয় তিনি আশ্রমের একজন বৈষ্ণব সেবাদাসী পাঠাইয়া দিয়াছেন রোগিণীর শুশ্রূষার জন্য। সে মথুরা জেলার যুবতী। বাঙলা ভাষা ভাল বুঝিতে পারে না। শুশ্রূষা-সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞান নাই। অসাড় প্রায় রোগিণীকে পিপাসায় জলদান এবং বৈকুণ্ঠদাস বাবাজী দত্ত কবিরাজী বড়ি ও ঠাকুরের চরণামৃত সেবন করাইতেছে। রোগিণীর শয্যা ও বস্ত্রাদিতে উপযুক্ত পরিচ্ছন্নতার অভাব বিমলবাবুর চোখে পড়িল।
ব্যাপার দেখিয়া বিমলবাবু সত্বর সবিতাকে আনিবার জন্য মথুরায় প্রত্যাবর্তন করিলেন। রেণুর অবস্থা যে শঙ্কাজনক তাহা তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন।
বিমলবাবু তাঁহাকে লইয়া কাল বিলম্ব না করিয়া পুনরায় বৃন্দাবনে ছুটিলেন। সংবাদ পাইয়া সবিতা যেন পাথর হইয়া গেলেন।
মোটরে উপবিষ্টা সবিতার মুখের পানে তখন তাকানো যায় না। তাঁহার মধ্যে যেন একটা বিরাট ঝড় স্তব্ধ হইয়া রহিয়াছে।
বহুক্ষণ পরে, জলমগ্ন ব্যক্তির ন্যায় ছট্ফট্ করিয়া রুদ্ধশ্বাসে একবার সবিতা বলিয়া উঠিলেন, উঃ, গাড়িখানা এত আস্তে চলচে কেন? আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসচে যে! বিমলবাবু দুই-একটি সময়োপযোগী কথা কহিলেও তাহা সবিতার কানে পৌঁছিল না। অকস্মাৎ বলিয়া উঠিলেন, দয়াময়, তোমরা তো অনেক দেশের অনেক ইতিহাস পড়েছো। নিজের মা তার সন্তানের এমন দুর্গতির কারণ হয়েছে, পড়েছো কি কোথাও?
বিমলবাবু নিরুত্তর রহিলেন।
পথে এক জায়গায় একটি কূপের সামনে মোটর থামিল, রেডিয়েটরে জল ভরিয়া লইবার জন্য। পথিপার্শ্বে দূরে কৃষিজীবীদের কুটির হইতে বালক-কণ্ঠের কাতর ক্রন্দন ভাসিয়া আসিল।
সবিতা আচমকা ভীষণ শিহরিয়া উঠিয়া ব্যাকুলকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, ওগো, কি হ’লো ওদের? ও যে কান্নার শব্দ— না? শুনতে পাচ্ছো কি?
বিমলবাবু সবিতার মানসিক অবস্থা বুঝিয়া চিন্তিত হইলেন। বলিলেন, ও কিছু নয়। ছোট ছেলে এমনিই কাঁদচে বোধ হয়। কিন্তু তুমি যদি এমন নার্ভাস হয়ে পড়ো সবিতা, কি করে সেখানে রোগীর শুশ্রূষার দায়িত্ব নেবে?
সবিতা অতিশয় ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, না, না, আমি একটুও অস্থির হইনি। যেটুকু হয়েছি, সেখানে গেলে— তাকে একবার বুকে পেলে আমার সব ঠিক হয়ে যাবে। এই পনেরো বছর আমার বুকের ভিতরটা খালি হয়ে রয়েচে যে! করুক সে আমার উপর রাগ, করুক ঘৃণা। করবারই তো কথা। যতোই যা-কিছু ভুল করে থাকি না, তবু আমি তার মা। এটা কি আর সে বুঝবে না? নিশ্চয়ই বুঝবে, দেখে নিও! ও তার রাগ নয়, ঘৃণা নয়, মার উপর অভিমান? মেয়ে যে আমার ছোট-বেলা থেকেই ভারী অভিমানী।
বিমলবাবু দীর্ঘনিশ্বাস চাপিয়া অন্য দিকে চাহিয়া রহিলেন।
যথাসম্ভব দ্রুত তাঁহারা বৃন্দাবনে ব্রজবাবুর বাসায় আসিয়া পৌঁছিলেন।
বাটীর সম্মুখে দড়ির খাটিয়া ও গেরুয়াধারী বৈষ্ণবের দল দেখিয়া বিমলবাবু শঙ্কিত নেত্রে সবিতার পানে তাকাইলেন। স্থির ধীর মুখের ’পরে আর সে চাঞ্চল্য ও উদ্বেগ-ব্যাকুলতার লেশমাত্র নাই। সেখানে গাঢ় বিষণ্ণতা অথচ অতিশয় কঠিন একটি যবনিকা নামিয়া আসিয়াছে। বিমলবাবু চমকিয়া উঠিলেন। মনে পড়িল, সৰ্ব্ব প্রথম যেদিন তিনি সবিতাকে দেখিয়াছিলেন, সেদিন সবিতার মুখে একরকম আশ্চৰ্য কঠিন অথচ নিগূঢ় বিষাদব্যঞ্জক ছায়া দেখিতে পাইয়াছিলেন।
সবিতা এতটুকুও অস্থিরতা প্রকাশ করিলেন না। মোটর হইতে নামিয়া বাসায় ভিতর চলিয়া গেলেন। সদ্য শোকাহত ব্রজবাবু অশ্রুভগ্ন কণ্ঠে বলিলেন, এসেচো নতুন-বৌ। এঁরা সব ব্যস্ত হয়েচেন রেণুকে নিয়ে যাবার জন্য। আমি বলচি, তা হয় না। যার ধন সে আসুক, তারপর তোমরা যা খুশি করো। তোমার গচ্ছিত সামগ্রী আমি রাখতে পারলাম না, হারিয়ে ফেললাম। আমাকে মাপ করতে পারবে কি?
সবিতা কথা কহিলেন না। কম্পিত অধর প্রাণপণে দাঁতে চাপিয়া নিৰ্ব্বাকমুখে অপরিচ্ছন্ন মেঝের একপাশে বিছানাটির দিকে তাকাইয়া রহিলেন। ভূমিতলে মলিন শয্যায় বস্ত্রাবৃত শীতল নিস্পন্দ দেহ পড়িয়া আছে। আশে পাশে জলের লোটা, চরণামৃতের ভাণ্ড, কবিরাজী বড়ি, খল নুড়ি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত।
সবিতা অগ্রসর হইয়া কম্পিত-হস্তে শবদেহের মুখ হইতে মলিন আচ্ছাদন উঠাইলেন। অতিশয় শীর্ণ, বিবর্ণ, রক্তলেশহীন মুখ, কালিমালিপ্ত নিমীলিত চক্ষু গভীরভাবে কোটরে বসিয়া গিয়াছে। চোয়ালের কণ্ঠার হাড় উঁচু হইয়া উঠিয়াছে। তৈলহীন রুক্ষ কেশের রাশি ঘাড়ের নীচে স্তূপীকৃত। স্নেহময়ী জননীর চোখে যেন সে-মুখ বিশ্বের গভীরতম দুঃখ ও বেদনার নিগূঢ় ছায়ায় সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল।
মৃত্যু-মলিন মুখখানার পানে বহুক্ষণ অশ্রুহীন নিষ্পলক নেত্রে তাকাইয়া থাকিয়া সবিতা অবনত হইয়া কন্যার তুষার-শীতল ললাটে গভীর চুম্বন আঁকিয়া দিলেন।
শববাহী দল অগ্রসর হইয়া আসিলে আপনা হইতেই তিনি সরিয়া দাঁড়াইলেন। কিন্তু বৃদ্ধ ব্রজবাবু তাঁর আজীবনের সংযম, সাধনা ও ভগবদ্জ্ঞান ভুলিয়া, আজ শিশুর ন্যায় কাঁদিয়া মাটিতে লুটাইয়া পড়িলেন, মাগো, তোর এ বুড়ো বাপকে কার কাছে রেখে গেলি—
কয়েকদিন অতিক্রান্ত হইয়াছে। দুর্ঘটনার সংবাদ পাইয়া কলিকাতা হইতে রাজু আসিয়াছে।
তার পাওয়া গিয়াছে ব্রজবাবুর কনিষ্ঠা পত্নী অর্থাৎ রেণুর বিমাতা আসিবেন। সম্ভবতঃ ব্রজবাবুর ভার গ্রহণ করিবার নিমিত্তই তিনি আসিতেছেন, এইরূপ সকলের অনুমান।
এই কয়েকদিনেই সবিতার দেহে আকস্মিক বার্দ্ধক্যের চিহ্ন সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। চোখে-মুখে অনিদ্রা ও গভীর শোকের ঘন কালি পড়িয়াছে। শুষ্ক ওষ্ঠাধরে লাবণ্যের লেশমাত্র নাই। মুখভাব অসাড়।
শোকজীর্ণ ব্রজবাবুর সেবার সকল ভার সবিতা নিজহস্তে গ্রহণ করিয়া অহোরাত্র সেই কাজের মধ্যেই আপনাকে নিমগ্ন রাখিয়াছেন।
ঘরের মেঝেয় বসিয়া সবিতা কুলায় করিয়া খই বাছিতেছিলেন ব্রহ্মবাবুর নৈশাহারের জন্য। পরণের শাড়ীখানি অতিশয় মলিন, স্থানে স্থানে তেল, ঘি, কালি ও কাদার দাগ লাগিয়াছে। মাথার সিঁথি এলোমেলো অস্পষ্ট রুক্ষ, একপাশে ছোট ছোট জট বাঁধিয়াছে।
বিমলবাবু আসিয়া দাঁড়াইলেন।
সবিতা মুখ উঁচু করিয়া বলিলেন, তুমি আর কতদিন এখানে থাকবে?
বিমলবাবু বলিলেন, যতদিন বলো।
সবিতা বলিলেন, ছোটগিন্নী আসছেন আজ। বোধ হয় তাঁর আসার আগেই আমার এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত। কি বলো?
বিমলবাবু বলিলেন, সে তুমি বিবেচনা করে দেখ।
সবিতা বলিলেন, কিন্তু আমি যে বুঝতে পাচ্চি, তারা এঁকে শান্তিতে থাকতে দেবে না। এখান থেকে একে কলকাতার টেনে নিয়ে যাওয়ার মতলবেই আসচে।
বিমলবাবু বলিলেন, তাতে ক্ষতি কি?
সবিতা মাথা নাড়িয়া বলিলেন, তা হয় না। এই অসহায়, অক্ষম, রোগে-শোকে-জীর্ণ মানুষটাকে তার শেষ আশ্রয় বৃন্দাবন থেকে টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো নিষ্ঠুরতা আর হতে পারে না। অন্তরের টান থাকলে ছোটগিন্নী এইখানে থেকেই স্বামীর সেবা করতেন।
বিমলবাবু চুপ করিয়া রহিলেন।
সবিতা বলিলেন, এই ধূলোময়লার দেশে তোমার খুবই কষ্ট হচ্চে বুঝতে পাচ্ছি। তুমি ফিরে যাও। আমি এখানেই রয়ে গেলুম।
বিমলবাবু বলিলেন, আচ্ছা।
বিমলবাবু চলিয়া যাইতেছিলেন, পিছন হইতে সবিতা ডাকিলেন, শোনো।
বিমলবাবু ফিরিলে সবিতা তাঁহার পানে বেদনাবিহ্বল দৃষ্টি তুলিয়া বলিলেন, একটা কথার উত্তর দিয়ে যেতে পারবে আমাকে?
বিমলবাবু বলিলেন, বলো।
জন্ম-জন্মান্তরেও কি আমাকে এই ক্ষমাহীন গ্লানির বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে?
সবিতার কণ্ঠ বাম্পারুদ্ধ হইয়া আসিল। বলিলেন, কিন্তু রেণু যে বড় হয়েও একদিন আমাকে ‘মা’ বলে ডেকেছিল, আপন হাতে সেবা-যত্ন আদর করেছিল, তাতেও আমার কালি মুছে যায়নি?
বিমলবাবু বলিলেন, তোমার মনই এর সঠিক উত্তর দেবে সবিতা।
আচ্ছা, আর একটা কথা। মানুষের অন্তরের প্রধান অবলম্বন যখন এমনি করে ভেঙে যায় মানুষ তখনও বেঁচে থাকে কেমন করে— কি নিয়ে জানো?
আমার মনে হয় তুমি যা হারিয়েছো সংসারের সকল অভাগাদের মধ্যে, সকল দুঃখীজনের মধ্যে তা খুঁজে পাবে।
সবিতা যাহা বলিয়াছিলেন হইলও ঠিক তাহাই। ছোটগিন্নী তাঁহার এক বোন-পোকে লইয়া আসিয়াছিলেন ব্রজবাবুকে কলিকাতায় লইয়া যাইবার জন্য। ব্রজবাবু কোনও কথা কহিবার পূর্ব্বে সবিতা বলিলেন, এঁর এই দেহ-মন নিয়ে আর কলকাতায় ফেরা সম্ভব নয়। শেষ বয়সের শোকার্ত দিনগুলো এইখানে তবু কতকটা শান্তিতে কাটাবে।
ছোটগিন্নী বলিলেন, এখানে একজন তো বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারালো। অসুখ হলে দেখবে কে, সেবা করবে কে? তা ছাড়া পাঁচজনেই বা আমাকে বলবে কি?
সবিতা বলিলেন, সেবার জন্য তুমি নিজে এখানে থাকতে পারো। ওঁকে টেনে নিয়ে যাওয়া চলবে না।
ছোটগিন্নী বলিলেন, আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারচিনে!
সবিতা বলিলেন, আমি তোমাদের শ্বশুরবাড়ির লোক, আত্মীয় হই। তুমি আমাকে কখনও দেখোনি। চিনবে কেমন করে?
ছোটগিন্নী লোকটি নেহাত খারাপ নয়। একটু নির্ব্বোধ, সাদাসিদা আরামপ্রিয় মানুষ। সুক্ষ্মভাবে কোনও কিছু বুঝিতে বা উপলব্ধি করিতে পারেন না।
ছোটগিন্নী বলিলেন, দাদার মোটে মত নয় আমি বৃন্দাবনে থাকি। এই কয়েক-দিনের জন্য এখানে এসেচি কত তাঁর হাতে-পায়ে ধরে। ওঁকে নিয়ে যাওয়াই কিন্তু আমার পক্ষে সব দিক দিয়ে সুবিধা।
সবিতা বলিলেন, তা জানি; কিন্তু সেটা ওঁর নিজের পক্ষে যে খুবই অসুবিধার।
ছোটগিন্নী বলিলেন, উনি যদি আমার সঙ্গে না যান, এখানে ওঁর দেখাশুনা করবে কে? আমার তো কালকের মধ্যে ফিরতেই হবে।
সবিতা বলিলেন, যখন তোমরা কেউই ওঁর আপনার ছিলে না, ওঁকে চিনতেও না, তখন যে-লোক ওঁর সব-কিছু দেখাশোনার ভার নিয়ে থাকতো, সেই লোকই ওঁর ভার নিয়েচে! তোমার দাদাকে বলো।
ছোটগিন্নী বিস্মিত হইয়া বলিলেন, তিনি কে?
তুমি চিনবে না ভাই, তোমার দাদাকে বললে তিনি ঠিক চিনবেন। ছোটগিন্নী বোনপোর সহিত কলিকাতায় ফিরিয়া গেলেন।
বিমলবাবুও সিঙ্গাপুরে প্রত্যাবর্ত্তনের ব্যবস্থা করলেন।
যাত্রার পূর্ব্বক্ষণে সবিতা আসিয়া প্রণাম করিলেন। শোকশীর্ণা সবিতার পানে চাহিয়া বিমলবাবু অস্ফুটে কি শুভকামনা করিলেন বোঝা গেল না।
সবিতা মৃদুকণ্ঠে অপরাধীর মতোই বলিলেন, তুমি আমাকে ভুল বুঝো না! জীবনে বারে বারে আশ্রয়-ভ্রষ্ট হওয়াই বোধহয় আমার নিয়তি।
বিমলবাবুর বৃহৎ মোটর বৃন্দাবনের রক্তিম ধূলিজালে দিক আচ্ছন্ন করিয়া সবিতার দৃষ্টির অন্তরালে অদৃষ্ট হইয়া গেল। স্তদ্ধমূর্ত্তি সবিতার রক্তলেশহীন মুখের পানে চাহিয়া রাখাল ভীতকণ্ঠে ডালি, মা –মা—নতুন-মা—
রাখালের আহ্বানে দৃষ্টি ফিরাইয়া সবিতা অকস্মাৎ উচ্ছ্বসিত ক্রন্দনে মাটিতে লুটাইয়া পড়িলেন। বলিলেন, রাজু, আমার রেণু যখন আমাকে ক্ষমা করেনি, তখন বেশ জেনেচি, সংসারে কারো কাছেই আমি ক্ষমা পাবো না।
মাস-খানেক পরে এডেন বন্দরের পোস্ট অফিসের মোহরাঙ্কিত একখানি পত্র সবিতার নামে বৃন্দাবনে আসিল। বিমলবাবু লিথিয়াছেন—
রেণুর মা,
তোমার দেশ-ভ্রমণ শেষ হইয়াচে। আমি পৃথিবী-ভ্রমণে চলিয়াছি। তোমার প্রতি বিন্দুমাত্র দুঃখ বা ক্ষোভ অন্তরে রাখিয়াছি, এ সন্দেহ করিও না। সমস্ত জীবন, বৃহৎ ব্যাপ্তির মধ্যে ব্যাপৃত থাকিয়া বৰ্ত্তমান জীবনের এই স্বল্পপরিসরতা আমাকে যেন সঙ্কুচিত করিয়া ফেলিতেছে, তাই এই যাত্রা।
অন্তরের অভিজ্ঞতার দিক দিয়া তোমার সহিত আমার পরিচয়ের মূল্য অনেক; কিন্তু যাহা পুরুষের জীবনকে বাহিরেও যথেষ্ট বিস্তৃত, উন্নত ও উন্মুক্ত করিয়া তুলিতে পারে না, তাহা পুরুষের পক্ষে কল্যাণকর নহে। জীবনে কখনও গৃহ লাভ করি নাই। অর্থ ও ঐশ্বর্য্যই লাভ করিয়াছি মাত্র। পথিকবৃত্তিতেই সারা কৈশোর ও যৌবন কাটিয়াছে। আজ প্রৌঢ়ত্বও শেষ হয় হয়। জীবনের এই অবেলায়, গৃহের আনন্দ উপলব্ধি তোমার নিকট হইতে লাভ করিয়া পরিতৃপ্ত হইয়াছি। সেজন্য অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা জানাই।
তোমার প্রতি গভীর সহানুভূতি ও অসীম শ্রদ্ধা অন্তরে লইয়া তোমা হইতে বহুদূরে সরিয়া চলিলাম। এইটুকু ভরসা রহিল, আজিকার এই যাত্রা-তরী যে সুদূর অকূলে ভাসিয়াছে, তাহার কুলের নোঙ্গর রহিলে তুমি।
যেদিন যখনই, যে-কোনও কারণে আমাকে তোমার প্রয়োজন হইবে, টমাস কুক্ কোম্পানীর কেয়ারে টেলিগ্রাম করিয়া দিয়ো। জীবিত থাকিলে, পৃথিবীর যে-প্ৰান্তেই থাকি, বিমানযোগে সত্ত্বর প্রত্যাবর্ত্তন করিব।
আর ইহাও জানি, এমন একজন মানুষ পৃথিবীতে রহিল, আমার শেষ বিদায়-দিন সমাগত হইলে, যে সকল বাধা তুচ্ছ করিয়া আমার পার্শ্বে উপস্থিত হইতে পারে! এই জানাটাই কি অস্তাচলমুখী একটি জীবনের পক্ষে যথেষ্ট সম্বল নহে!