তেইশ

বিমলবাবু সিঙ্গাপুর হইতে কলিকাতায় ফিরিয়াছেন।

তারকের পত্রে সবিতার শারীরিক কৃচ্ছ্রসাধনের সংবাদ পাইয়া তাহাকে লিখিয়াছিলেন, “তোমাদের নতুন-মা নিজে যাহা করিয়া তৃপ্তি পান, তাহাতে আমার বাধা দেওয়া সঙ্গত নয়!”

তারক এই পত্র পাইয়া একরূপ বাঁচিয়া গেল। কারণ নূতন আইন প্র্যাক্‌টিস লইয়া সে অহরহ ব্যস্ত, অন্যদিকে মনোযোগ দিবার মতো অবকাশ এখন তাহার নিতান্ত সঙ্কীর্ণ।

নতুন-মার স্নানাহারের নিত্য অনিয়ম, উপবাস ও পরিশ্রমের কঠোর অত্যাচার, কোনও কিছুর জন্যই সে আর এখন একটিও শব্দ উচ্চারণ করে না। গম্ভীর মুখে ও যথাসম্ভর নীরবে নিজের স্নানাহার সম্পন্ন করিয়া বহির্বাটীতে চলিয়া যায়।

সবিতা হাসেন। একদিন কাছে ডাকিয়া বলিলেন, তারক, মায়ের উপর রাগ করেচো বাবা?

মুখ অন্ধকার করিয়া তারক জবাব দিল, সে অধিকার তো আমার নেই নতুন-মা। আমি একজন পথের কাঙাল বৈ তো নয়।

সবিতা সস্নেহে বলেন, ছিঃ, ও-কথা বলতে নেই।

তারক আরও গোটা-কয়েক বাঁকা বাঁকা কথা ঠেস দিয়া শুনাইয়া দিতে উদ্বৃত্ত হইয়াছিল, কিন্তু সারদাকে আসিতে দেখিয়া সরিয়া পড়িল। সে ভালই জানে, নতুন মা কিছু না বলিলেও সারদা ইহা সহ্য করিবে না। এমন অনেক অপ্রিয় সত্য হয়তো এখনও অসঙ্কোচে সুস্পষ্ট বলিয়া বসিবে যাহা সহ্য করা তারকের পক্ষে একান্ত কঠিন, প্রতিকারেরও উপায় নাই।

বিমলবাবু তাঁহার কলিকাতার প্রত্যাবর্ত্তনের সংবাদ সবিতাকে পত্র-দ্বারা এবং তার যোগেও জানিইয়াছিলেন। সবিতার নিকট সে সংবাদ শুনিয়া তারক তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিবার জন্য সকালে উঠিয়াই জাহাজ-ঘাটে উপস্থিত হইয়াছিল। গিয়া দেখিল, বিমলবাবুর ছোট ও বড় দুইখানি মোটরগাড়ি লইয়া তাঁহার ম্যানেজার সরকার ও দ্বারবানেরা উপস্থিত রহিয়াছে। বিমলবাবু তাহাকে দেখিতে পাইয়া নিজের গাড়ির মধ্যে ডাকিয়া লইলেন।

মোটরে বিমলবাবু তারককে সর্ব্বপ্রথম প্রশ্ন করিলেন, রাজু ভাল আছে তো তারক?

বিস্মিত হইয়া তারক জবাব দিল, কেন, তার কি হয়েচে?

না এমনি জিজ্ঞাসা করচি। আমি তাকে লিখেছিলাম কিনা যদি তার অসুবিধা না হয়, যেন জেটীতে আমার সঙ্গে এসে দেখা করে!

তারকের মুখের দীপ্তি মুহূর্ত্তে নিভিয়া গেল। শুষ্ক-কণ্ঠে প্রশ্ন করিল, কোনও জরুরি প্রয়োজন ছিল বোধ হয়?

হ্যাঁ। আসেনি দেখে মনে হচ্চে হয়তো বা অসুস্থ হয়ে পড়েছে, কিংবা কলিকাতার বাইরে গেছে। আমার চিঠি পায়নি।

তারক বলিল, না, পরন্তু সন্ধ্যাতেও তাকে আমাদের বাসায় দেখেচি।

বিমলবাবু বলিলেন, তা হলে সম্ভবতঃ কোনও কাজে আটকে পড়ে আসতে পারেনি। ড্রাইভারকে বলিলেন, শিউচরণ, পটলডাঙায় চলো।

তারক বলিল, একটু আগে আমাকে নামিয়ে দেবেন বিমলবাবু, আমার আজ একটা জরুরী কন্‌সাল্‌টেশন আছে এ-পাড়ায়।

তোমার প্র্যাক্‌টিস তা হলে বেশ জমে উঠেছে বলো?

তা আপনার আশীর্ব্বাদে নেহাৎ মন্দ নয়। প্রায় রোজই এন্‌গেজড আছি।

বেশ, বেশ, তুমি জীবনে উন্নতি করতে পারবে।

তারক বিনম্রহাস্যে বিমলবাবুর পা ছুঁইয়া প্রণাম করিয়া গাড়ি হইতে নামিয়া গেল। পটলডাঙায় আসিয়া দেখা গেল, রাখালের বাসা ডবল তালায় রুদ্ধ। সংবাদ পাইবারও কোনও উপায় সেখানে নাই।

বিমলবাবু সেখান হইতে ফিরিয়া সবিতার বাসায় আসিয়া নামিলেন। তাঁহার কণ্ঠের সাড়া পাইয়া সারদা তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিয়া হাসিমুখে প্রণাম করিল। বিমলবাবুর পানে তাকাইয়া বলিল, আপনি ভারি রোগা হয়ে গেছেন। কালোও হয়েচেন খুব। সে-দেশের জল-হাওয়া বুঝি ভাল নয়?

বিমলবাবু সহাস্যে জবাব দিলেন, দুনিয়ার মায়েদের নজর চিরকাল ধরে এই একই কথা বলে আসচে। ছেলে কিছুদিন ঘরের বাইরে ঘুরে ঘরে ফিরলে, মায়েরা তার আপাদ-মস্তক নিরীক্ষণ করে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলবেনই, আহা বাছা, আমার আধখানা হয়ে ফিরেচে। আমি যে এর চেয়ে কম কালো ছিলাম বা বেশি মোটা ছিলাম তার উপযুক্ত প্রমাণ কৈ সারদা-মা?

সারদা লজ্জিত হইয়া পড়িল। বিমলবাবুর কথা এড়াইয়া বলিল, বসুন, মাকে ডেকে দিচ্চি।

ডাকিতে হইল না। রান্নাঘর হইতে সবিতা বাহির হইয়া আসিলেন। পরিধানে আধময়লা মোটা মিলের শাড়ি, শুভ্র ললাটের ’পরে ও কানের পাশে কেশগুচ্ছ রুক্ষ রেশমের ন্যায় দুলিতেছে। চেহারা আগের চেয়ে অনেক শীর্ণ। আয়ত নয়নদ্বয়ের নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে চাপা বিষণ্ণতার ছায়া।

সবিতার শরীর এত বেশি খারাপ দেখিবেন বিমলবাবু বোধহয় আশা করেন নাই, তাই চকিত হইয়া বলিলেন, এ কি, তোমার শরীর এত বেশী খারাপ হয়ে পড়লো কি করে? অসুখ করেনি তো?

ভোরের অন্ধকার আকাশে পাণ্ডুর আলোর মতো মৃদু হাসিয়া সবিতা বলিলেন, অসুখ করেনি; কিন্তু তুমি যে আমাকে লিখেছিলে জাহাজ থেকে নেমে নিজের বাড়িতেই উঠবে। সেখানে স্নানাহার সেরে বিকেলের দিকে এখানে আসবে! অথচ এ তো দেখচি একেবারে ধুলো-পায়েই উত্তরণ।

সারদা অন্যত্র চলিয়া গেল। গমনশীলা সারদার পানে একবার দৃষ্টিপাত করিয়া কণ্ঠস্বর একটু নিম্নে নামাইয়া বিমলবাবু বলিলেন, ধূলো-পায়েই দেবীদর্শন যে শাস্ত্রের বিধি।

তাই নাকি?

বিশ্বাস না হয় পঞ্জিকা খুলে দেখতে পারো। কিন্তু সে-কথা থাক। আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।

কি প্রশ্ন?

শরীর এত বেশি খারাপ হ’লো কেন?

ঠোঁটের কোণে সবিতার চাপাহাসি ফুটিয়া উঠিল। বিমলবাবুরই ক্ষণপূর্ব্বে সারদাকে বলার অবিকল ভঙ্গিতে কহিলেন, দুনিয়ার দয়াময়দের নজর অসহায় দীন-দুঃখীদের সম্বন্ধে চিরকাল ধরে ঐ একই কথা বলে আসচে।

সবিতার মুখে আপনার কথার অনুকৃতি শুনিয়া বিমলবাবু উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিলেন। সবিতাও হাসিতে লাগিলেন। অস্পষ্ট বেদনা-ছায়াচ্ছন্ন গৃহের আকাশ-বাতাস যেন বহুদিন পরে আজ উন্মুক্ত হাসির স্বচ্ছ ধারায় মালিন্যহীন হইয়া উঠিল।

বিমলবাবু বলিলেন, তোমার কাছে হার মানচি সবি—রেণুর মা।

‘সবিতা’ বলিতে গিয়া বিমলবাবু যে তাড়াতাড়ি সেটা সামলাইয়া ‘রেণুর মা’ বলিলেন, সবিতা তাহা লক্ষ্য করিয়াই শুধু একটু হাসিলেন। বলিলেন, কোথায় স্নানাহার করবে? এখানে না বাড়িতে?

তুমি যেখানে বলো।

বাড়িই যাও।

সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকবার কেউ নেই তুমি জানোই। আছে শুধু চাকর-বাকর আর কর্ম্মচারীর দল। দূর সম্পর্কের এক মাসিমা থাকেন বটে তাঁর জড়বুদ্ধি ছেলেকে নিয়ে, কিন্তু তার কাছে আমার আসাটা প্রীতির ব্যাপার কিংবা ভীতির ব্যাপার সঠিক নির্ণয় করা কঠিন।

তা হোক, বাড়ি যাও। যাঁরাই থাকুন সেখানে, সকলেই যে তাঁরা তোমার আসার প্রতীক্ষা করচেন এটা সঠিক; তা প্রীতিতেই হোক বা ভীতিতেই হোক সরাসরি এখানে এসে ওঠা ভাল দেখাবে না।

নিন্দে হবে বুঝি? কার হবে? তোমার না আমার?

কার মনে হয়?

হয় যদি দুজনেরই নামে জড়িয়ে হবে।

তা হলে আর দেরি করছো কেন?

ভাবচি, মনের অবস্থাবিশেষে নিন্দাও অনেক সময়ে প্রশংসার চেয়ে বেশি প্রলুব্ধ করে।

দার্শনিক তত্ত্ব থাকুক। বাড়ি যাও এখন।

যাচ্চি। কিন্তু তুমি দেখচি আমাকে—

বিমলবাবুর মুখের কথা কাড়িয়া লইয়া সবিতা বলিলেন, তাড়াতে পারলেই যেন বাঁচি। কেমন তো? হ্যাঁ, তাই। এখন তারই সাধনা করচি যে দয়াময়। কণ্ঠস্বর শেষের দিকে ভারি হইয়া উঠিল।

বিমলবাবু বিচলিত হইলেন। অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ে এই অসতর্ক মুহূর্ত্তে তাঁহারই মুখ দিয়া বাহির হইয়া আসিল– সবিতা!

সকরুণ হাস্যে বিমলবাবুর পানে তাকাইয়া সবিতা কহিলেন, পরে সব বলবো এখন আমায় কিছু জিজ্ঞাসা ক’রো না।

না, আমি সমস্ত না জেনে বাড়ি যাবো না। তোমাকে বলতে হবে কি হয়েচে?

বলবো। বিকেলে এসো। রাতে বরং এখানে খেয়ো। আমি এখন নিজের হাতেই রাঁধচি।

বিমলবাবু বলিলেন, তাই হবে। কিন্তু দেখো, তখন যেন আমাকে ফাঁকি দিয়ে অন্য কথায় ভুলিয়ো না।

ভয় নেই। জীবনে একমাত্র নিজেকে ফাঁকি দেওয়া ছাড়া আর কাউকে দিয়েচি বলে তো মনে পড়ে না। সবিতার কণ্ঠস্বর কাঁপিয়া উঠিল।

বিমলবাবু লক্ষ্য করিলেন, সবিতা আজ সহজ পরিহাসের উত্তরেও কি যেন শুধু বেদনায় গম্ভীর হইয়া উঠিতেছিল। ইহা যে তাহার অন্তর্গূঢ় কোনও একটা বিক্ষোভেরই বহিলক্ষণ, ইহা বুঝিতে ভুল হইল না। তাই আর কোনও কথা না কহিয়া বিকালেই আসিবেন বলিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।

 

সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে বিমলবাবু যখন আসিলেন, সবিতা এবেলার রন্ধন শেষ করিয়া সন্ধ্যাস্নান সমাপনান্তে পরিচ্ছন্নবাসে তেতলার ছাদে একখানি ডেক্‌-চেয়ারে বসিয়াছিলেন। সামনে আর একখানি চেয়ার পাতা। শুভ্র আবরণে ঢাকা একটি ছোট টিপয়ের উপর স্বচ্ছ কাচের গ্লাসে চাপা দেওয়া পরিষ্কার পানীয় জল, সদ্য ঢাকনি খোলা এক-টিন বিলাতি সিগারেট, যে ব্রাণ্ডের সিগারেট বিমলবাবু সর্ব্বদা ব্যবহার করেন। টিপয়ের ’পরে একবাক্স নূতন দেশলাই ও ছাই ঝাড়িয়া ফেলিবার একটি পিতলের ঝকঝকে ক্ষুদ্র আধার।

বিমলবাবু আসিয়া দাঁড়াইলে, মৃণালদণ্ডের মত দেহলতা নত করিয়া সবিতা বিমলবাবুর দুই পায়ে হাত ঠেকাইয়া প্রণাম করিলেন।

কি পাগলামি—

আয়ত চক্ষু দুইটি উজ্জ্বল করিয়া সবিতা বলিলেন, পাগলামি নয়, তোমার প্রধান প্রশ্নের উত্তর যে আমার এই। প্রভাতে করেছি আমন্ত্রণ, সন্ধ্যায় নিবেদন করলাম প্রণাম। আর আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না তো দয়াময়?

সবিতার কণ্ঠস্বরে এমনই এক অশ্রুতপূর্ব্ব মাধুর্য্য ক্ষরিত হইল যে, বিমলবাবু অল্পক্ষণ অভিভূতের ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিলেন। মনে হইল, এ যেন তাঁহার পূর্ব্ব পরিচিতা সে-সবিতা নয়, যে অসহায়কে তিনি রমণীবাবুর সুসজ্জিত অট্টালিকায় দিনের পর দিন নিগূঢ় বেদনায় মৌন ছায়াতলে বিষণ্ন প্রতিমার মত বারংবার দেখিয়াছেন। আজও সকালে রান্নাঘরের সম্মুখে যাহার স্নান ক্লিষ্ট মূৰ্ত্তি দেখিয়া বুকের মধ্যে বেদনা মোচড় দিয়া উঠিয়াছিল—এ যেন সে সবিতাও নয়। সুগৌর শীর্ণমুখে একটি প্রশান্ত কোমল মেদুরতা। সে মুখে হৃদয়াবেগের আতিশয্যজনিত উচ্ছ্বাসদীপ্তি নাই, সলজ্জ প্রেমিকের প্রণয়সুলভ সরমরাগের রক্তিমাভা নাই।

সুকুমার ওষ্ঠাধরে প্রীতিস্নিগ্ধ সংযত হাস্যের মাধুর্য্যময় সুষমা। বিষাদ-শান্ত নয়ন-যুগলে বিচ্ছুরিত হইতেছে সুদূরপ্রসারিত দৃষ্টি। সকল অঙ্গভঙ্গির রেখায় রেখায় বিকশিত হইয়া উঠিতেছে আজ এমন একটি সুচারু-সুন্দর অথচ সম্ভ্রমসূচক অভিব্যক্তি যাহাতে স্নেহ ও শ্রদ্ধা বিশ্বাস ও নির্ভরতার সম্মিলিত ব্যঞ্জনা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। নারীর এ মূর্ত্তি সংসারে একান্তই দুর্লভদর্শন। বিমলবাবুর বিচিত্র জীবনে এমনটি তিনি আর কোথাও দেখেন নাই।

সবিতার মহিমময়ী মূর্ত্তির পানে চাহিয়া আজ সর্ব্ব প্রথম বিমলবাবুর মনে হইল তিনি এ-জগতে যে স্তরের মানুষ, সবিতা তাহার অনেক উর্দ্ধলোকের অধিবাসিনী। মানবজীবনের যে অন্তরতম অনুভূতি, চরম দুর্য্যোগের মধ্যে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা, দুঃখের দুর্গম পথে বিক্ষত পদযাত্রীর যে ভূয়োদর্শন আজ তাঁহার অন্তর-বাহির ঘিরিয়া এমন একটি মহিমাকে রূপায়িত করিয়া তুলিয়াছে যাহাকে শুধু যথেষ্ট ব্যবধান হইতে মাথা নত করিয়া প্রণাম করাই চলে, পাশে দাঁড়ানো চলে না।

বিমলবাবুর এই অভিভূত ভাব লক্ষ্য করিয়া সবিতা মনে মনে কুণ্ঠিত হইলেও সহজ-মুখেই সম্ভাষণ করিলেন, কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে, ব’সো!

বিমলবাবু নিঃশব্দে নিৰ্দ্দিষ্ট চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন বটে, কিন্তু তখনও সবিতার পানে অপলক-নয়নে তাকাইয়া রহিলেন। তাঁহার সে চাহনিতে আজ আর বিমুগ্ধের বিহ্বল আকুলতা নাই, আছে অনুরাগীর সশ্রদ্ধ বিস্ময়। এ যেন বাঞ্ছিত দেবমূর্ত্তির প্রতি ভক্তের বন্দনা-সুন্দর সদৰ্শন।

সবিতা সঙ্কুচিত হইয়া বলিলেন, একদৃষ্টে চেয়ে দেখচো কি?

তোমাকেই দেখচি।

আমাকে কখন দেখোনি?

আজকের তোমাকে সত্যিই কখনও দেখিনি! যাকে দেখ চি সে এ-তুমি নও।

সে কোন্ আমি দয়াময়?

সে অনন্ত তুমি। দুঃখের পীড়নে বিচলিতা, অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ ভাবনায় কাতর তুমি। আত্মচিন্তায় আত্মহারা অসহায় তুমি।

আর আজকের আমি?

এ তুমি আর এক নতুন মানুষ। আজই প্রথম দেখা পেলাম। এর সাথে সত্যিই আমার পরিচয় ঘটেনি এতদিন। সিঙ্গাপুরে লেখা তোমার চিঠি গুলির মধ্যে এর চরণধ্বনি শুনতে পেয়েচি বটে; আজ এসে দেখলাম অননুপূর্ব্ব আবির্ভাব।

সবিতা হাসিলেন। সে হাসি উদার। গোধূলির রক্তিম আলোকে দূরাগত বাঁশির পুরবী সুর যেমন মানুষের চিত্তকে ক্ষণেকের জন্যও অকারণ উদাস করিয়া তোলে, সবিতার এই হাসিতে সেই মুহূর্ত্তের উদাস করিয়া তোলার আশ্চর্য্য মায়া নিহিত। বলিলেন, কি জানি হতেও পারে! এক জন্মেই যে কত জন্মান্তর ঘটে যায় মানুষের, তার কি হিসাব আছে?

বিমলবাবু কথা কহিলেন না। বিস্মিত নয়নে লক্ষ্য করিতে লাগিলেন, সবিতার পরিধানে একখানি খয়েরীপাড় দুধেগরদ শাড়ি। কাৰ্য্যোপলক্ষে একবার কাশী গিয়া বিমলবাবুই এই গরদের শাড়িখানি পূজা-আহ্নিকে ব্যবহারের জন্য সবিতাকে আনিয়া দিয়াছিলেন। শাড়িখানি পরিবার জন্য অনুরোধ করিলে সবিতা হাসিয়া জবাব দিয়াছিলেন, এখন থাক। সময় হলে পরবো।

আজ সেই শাড়িখানি পরিয়াই তিনি বিমলবাবুর জন্য অপেক্ষা করিতেছিলেন। বিমলবাবু বলিলেন, জন্মান্তর মানতাম না, কিন্তু তুমি আমায় মানালে। সত্যি বটে ওটা এই জীবনেই ঘটে। তাই এতদিন পরে তোমার তো সময় হয়েচে আমার এ-জন্মেই আমার দেওয়া শাড়ি পরবার।

সবিতাকে নিরুত্তর দেখিয়া বিমলবাবু বলিলেন, হয়তো ভুল বলচি। সময় হয়েচে না বলে সময় ফুরিয়েচে বলাই উচিত ছিল আমার না সবি—রেণুর মা?

বিমলবাবুর প্রশ্নের জবাব এড়াইয়া সবিতা মৃদু হাসিয়া বলিলেন, কিন্তু তুমি এই বিড়ম্বনা আরও কতদিন ভোগ করবে বল তো? ভিতর থেকে যে ডাকটা আপনা হতে বেরিয়ে আসচে, তাকে বারে বারে গলা টিপে ঠেলে সরিয়ে অন্যের মুখের ডাক আওড়াতে চেষ্টা করচো! কতবারই তো ঠোক্কর খেলে! তবু ছাড়বে না?

বিমলবাবু অপ্রতিভ হইয়া পড়িলেন।

সবিতা বলিতে লাগিলেন, আগে ডেকেচো নতুন-বৌ, সেটা তোমার নিজের মুখের ডাক নয়। ও নামে প্রথম যিনি ডেকেচেন তাঁরই মুখে ওটা মানায়। তোমার মুখে বেসুরো শোনালো। তার পরে ডাকতে চেষ্টা করেচো ‘রেণুর মা’, সেও তোমার মুখে বার বার বাধা পাচ্ছে, স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠতে পারোনি, পারবেও না কোনদিন।

তবে কি বলে তোমায় ডাকবো বলে দাও তুমি!

কেন ‘সবিতা’! যে ডাক আপনা হতে সহজে মুখে আসচে।

তাই না হয় ডাকবো। কিন্তু ‘রেণুর মা’ বলে ডাকতে তুমিই যে আমাকে বলেছিলে একদিন। আচ্ছা সত্যি করে বলো, না জেনে কোনোদিন অমর্য্যাদা ঘটিয়েচি কি সে-ডাকের?

ও-কথা মনেও এনো না। তোমাকে ও-নামে ডাকতে বলা আমারই ভুল হয়েছিল। তোমার কাছে আমার তো ও-পরিচয় নয়। কোনদিনই ও-ডাকটা তাই তোমার কণ্ঠে সজীব হয়ে উঠলো না। দেখো, অনেক দুঃখ পেয়ে, একটা কথা আমি এখন বেশ বুঝেচি, যার যা, তার ভাই ভালো। তোমার মুখে সবিতা ডাক যত সহজ-সুন্দর, এমন অন্য কিছুই নয়।

বিমলবাবু হাসিয়া বলিলেন, আমার অন্তরের আনন্দ-নির্ঝরে যে নামের বুদবুদগুলি আপনা হতেই রামধনু রঙ নিয়ে ফুটে উঠে আপনি ভেঙে ভেঙে বিলীন হয়ে যাচ্চে, সেই নাম দিয়েই এবার থেকে ডাকতে অনুমতি দাও তাহলে; কিন্তু বুদবুদের ভাঙা-গড়ার বিরাম নেই জানো তো!

জানি।

তুমি কি সইতে পারবে রেণুর মা? হোক না সে জলবিন্দুর বুদবুদমাত্র, তবুও তোমাকে হয়তো বিঁধবে, আমার ভয় করে।

সবিতার মুখে ছায়া নামিয়া আসিল। বলিলেন, ঐ তো তোমাদের দোষ। মেয়েদের সম্পর্কে কোনদিনই সহজ হতে পারো না তোমরা। হয় অতিভক্তি অতিশ্রদ্ধায় গদগদ হয়ে বহু সম্ভ্রমে উঁচুতে তুলে ধরতে চাইবে, না হয় একেবারে নর-নারীর আদিম সম্পর্ক পাতিয়ে ঘনিষ্ঠতা করে বসবে। পুরুষ আর নারীর মধ্যে মানুষের সহজ-সুন্দর সম্বন্ধ পাতানো যায় না সত্যিই?

বিমলবাবু শান্ত গলায় বলিলেন, তোমার আমার সম্বন্ধের মধ্যে এ প্রশ্ন ওঠবার সময় যদিও আজও আসেনি সবিতা, তবুও তোমাকে জিজ্ঞাসা করচি, বলতে পারো কি, কেন এমন হয়?

একটু চিন্তা করিয়া সবিতা বলিলেন, ঠিক জানিনে! তবে অনুমান হয়, সমাজ-বিধির মনের নীচেই এর বীজ পোতা আছে হয়তো। নইলে সৰ্ব্বত্র সকলক্ষেত্রেই একই বিষময় ফল ফলে ওঠে কি করে? দেখো, সমাজের বাইরে এসে আজ আমার চোখে সমাজের কল্যাণ ও অকল্যাণের দুটো দিকই সুস্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেচে। ওর ভেতরে থাকতে এমন করে দোষ ও গুণ দুটো দিক দেখতে পাইনি!

বিমলবাবু নিবিষ্টচিত্তে সবিতার কথা শুনিতেছিলেন, নিজে কথা কহিলেন না। সবিতা বলিতে লাগিলেন, মানুষ নিজের মন নিয়ে কতই না বড়াই করে, কিন্তু কতটুকুই বা তার পরিচয় সে জানে? জীবনের প্রতি অঙ্কে অঙ্কেই তার রূপ বদলাচ্চে।

এই তো সেদিন পৰ্য্যন্ত মনে ভেবেচি, আমার মত স্বামীকে ভক্তি জগতে বুঝি আর কোনও মেয়েই কখনও করেনি। স্বামীকে আমার মত এতটা ভালবাসতেও হয়তো অন্য কোনও কেউ পারবে না। বাইরের পৃথিবী বিপরীত সংবাদ জানলেও, আমার আপন অন্তরের খবর আমি তো ভাল করেই জানি; কিন্তু এতদিন পরে আজ সে-ধারণা বদলে গেছে আমার। আপন অন্তরের যথার্থ অর্থ এতকাল বাদে বুঝতে পারচি।

আশ্চৰ্য্য হইয়া বিমলবাবু বলিলেন, কি বুঝচো সবিতা?

কতকটা আত্মগতভাবে সবিতা বলিলেন, ঠিক স্পষ্ট করে সেটা বলা শক্ত। আজ শুধু এইটুকু আমি বেশ বুঝতে পারচি, অন্তরের শ্রদ্ধা, ভক্তি এবং সংস্কারগত ধারণা আর হৃদয়ের প্রেম একই বস্তু নয়।

কিন্তু আমি শুনেচি অনেক সময় শ্রদ্ধা-ভক্তিই তো হয়ে দাঁড়ায় প্রেমের ভিত্তি।

হাঁ, তা হয়। করুণা মমতা বা সমবেদনাও অনেকক্ষেত্রে হয়তো প্রেমকে গড়ে তোলে; কিন্তু আমার বিশ্বাস নারী ও পুরুষের পরস্পরের মধ্যে ভিতর ও বাহিরে স্বাভাবিক মিল না থাকলে প্রেম স্ফূর্ত হলেও সুসাৰ্থক হয় না। তা ছাড়া, আরও একটা কথা। অনেক সময়ে শ্রদ্ধা-ভক্তিকে কিংবা স্নেহ-মমতাকে মানুষ প্রেম বলে ভুলও করে।

তুমি কি বলতে চাও, স্নেহ বা মমতা হতে যে প্রেমের উদ্ভব তা সত্য কিংবা সার্থক নয়?

এমন কথা কেন বলবো? নিশ্চয় তা সত্য, এবং সত্য হলেই সার্থক না হয়ে পারে না। আমি বলছি স্নেহ-মমতা যথার্থই যদি প্রেমে পরিণত হয়, তবেই সত্য। সাগরে গিয়ে পৌঁছুতে পারলে তখন সকল জলই এক, ঝর্ণার জলও যা, বৃষ্টির জল, বন্যার জলও তাই।

বিমলবাবু সবিতার পানে স্থির দৃষ্টি স্থাপিত করিয়া বলিলেন, আচ্ছা, এ-সকল কথা তুমি জানলে কেমন করে?

অল্পক্ষণ নিরুত্তর থাকিয়া সবিতা মুক্ত আকাশে দৃষ্টি প্রসারিত করিয়া কহিল, নিজেরই বিড়ম্বিত জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে জেনেছি দয়াময়।

বিমলবাবু প্রশ্নপূর্ণ নয়নে তাকাইয়া রহিলেন।

সবিতা বলিলেন, বলবো তোমাকে একদিন আমার সমস্ত কথাই।

বিমলবাবু অনুযোগের সুরে বলিলেন, তুমি সমস্ত কথাই অন্য একদিন বলবো বলে সরিয়ে রেখে দাও। কবে তোমার সেই অন্য এক দিন আসবে সবিতা? একদিন বলেছিলে, তোমাকে আমার স্বামীর সমস্ত কথা শোনাবো, সে শুধু আমিই জানি, আর কেউ নয়।

সবিতা বলিলেন, বলতে ইচ্ছা হয়, কিন্তু বলা হয়ে উঠে না। নিজেকে সংবরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে; কিন্তু সে সব কথা শুনে লাভই বা কি? স্বেচ্ছায় স্বামী ত্যাগ করে যে-মেয়ে অকুলে ভেসেচে—স্বামীর প্রতি আজও তার মনোভাব কেমনতরো, জানতে বুঝি কৌতূহল হয়?

ছি—ছি—পরিহাস করেও এমন কথা আমাকে বলা তোমার উচিত নয়, এ কি তুমি জানো না সবিতা?

জানি। মাপ করো। তোমাকে অকারণ আঘাত করলাম, আমার অপরাধের শেষ নেই। তারপর অন্যমনস্কচিত্তে সবিতা কি যেন ভাবিতে লাগিলেন।

বিমলবাবু নীরবে একদিকে তাকাইয়া রহিলেন।

অনেকক্ষণ নিঃশব্দে কাটিয়া গেল।

বিমলবাবু ডাকিলেন, সবিতা —

কি বলচো?

সত্যি করে বলো, তুমি কি আমায় ভয় করো?

কি জন্য ভয়? সবিতার কণ্ঠে বিস্ময় ধ্বনিত হইল।

বিমলবাবু জবাব দিতে ইতস্ততঃ করিতেছেন দেখিয়া সবিতা ম্লান হাসিয়া বলিলেন, তোমাকে ভয়ের তো আমার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। কি ক্ষতি বাকী আছে এখনও যার জন্য ভয় করবো!

বিমলবাবু বলিলেন, জীবনের উপর এত বড় অভিমান আর যে করে করুক তোমাকে করতে দেবো না। মানুষের যা-কিছু মর্য্যাদা জীবনের একটা কোনও আকস্মিক দুর্ঘটনায় নিঃশেষে ভষ্ম হয়ে যায় না। যতক্ষণ বেঁচে থাকে মানুষ, ততক্ষণ তার সবই থাকে। কোন কিছুই ফুরিয়ে যায় না।

সবিতা মৌন রহিলেন। কতক্ষণ পরে স্থির-গলায় বলিলেন, তোমাকে ভয় একটুও করিনে। বরং তোমার সম্বন্ধে নিজের এই একান্ত নির্ভরতাকে ভয় করেচি এতদিন। এখন সে ভয়ও কেটেচে। তোমাকে আমি বিশ্বাস করি। আমার মনে হয়, সংসারে আর বুঝি কোনও মেয়েই এমন কোনও নিঃসম্পর্কীয় পুরুষকে নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করতে পারেনি।

অল্প থামিয়া কণ্ঠস্বর একটু নীচু করিয়া সবিতা আবার বলিলেন, আমি জানি তুমি কোনদিন আমাকে নীচে নামাতে পারো না। পুরুষদের কাছে মেয়েদের অপমান ও অবহেলা যা হতে ঘটে, তা তুমি কখনও ঘটতে দেবে না। সবার চেয়ে বড় কথা, আমাকে বুঝতে তোমার ভুল হয়নি।

বিমলবাবু মৃদুকণ্ঠে কহিলেন, মানুষ মানুষই, দেবতা তো নয়। তার সমস্ত ভালো মদ দোষ গুণ; বলিষ্ঠতা দুর্ব্বলতা নিয়েই তার সমগ্র রূপ। সুতরাং তার উপরে কি এতটা বেশি বিশ্বাস রাখা সঙ্গত?

কি সঙ্গত আর কি অসঙ্গত জানিনে। বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে জানতে চাইওনে। যা নিজের অন্তরের মধ্যে একান্তভাবে অনুভব করেছি তাই বললাম মাত্র।

বিমলবাবু বলিলেন, তোমার সংস্পর্শে এসে কি আমার লাভ হয়েছে জানো সবিতা? আমি সর্ব্বপ্রথম অনুভব করেছি, অকল্যাণের ভিতর দিয়েও পরমকল্যাণ এসে জীবনকে স্পর্শ করে।

সবিতা বলিলেন, মানি এ-কথা আমি। অকল্যাণের পথেই আমার দীর্ঘ চলার ক্লান্ত সাঁঝে তোমার সঙ্গে হয়েছিল হঠাৎ সাক্ষাৎ। হয়েছিল বিরুদ্ধ আবেষ্টনের মধ্যে অবাঞ্ছিত পরিচয়। ভাগ্যে জোর করে তুমি সেদিন দেখতে এসেছিলে আমাকে!

বিমলবাবু আহত হইয়া অকৃত্রিম দুঃখিত স্বরে বলিলেন, এ ধারণা তোমার সত্য নয় সবিতা। জীবনের অজ্ঞাত পথে মানুষের সাথে মানুষের নিবিড় পরিচয় কবে কোনদিন কোথা দিয়ে কেমন করে ঘটে যায়, কেউই জানে না। কথাটা আমি আমার নিজের দিক থেকেই বলেছিলাম। এতদিন নিজেরও অতীতের অপরিচ্ছন্ন অংশটার পানে তাকিয়ে হয়েচে বিতৃষ্ণা, হয়েছে ঘৃণা, ক্ষোভ, লজ্জা। কতবার ভেবেচি, জীবনের অশুচি অংশটাকে যদি কোনও উপায়ে ধুয়ে সাদা করে ফেলা যেতো! ছিঁড়ে নিশ্চিহ্ন করা যেতো স্মৃতির খাতা থেকে ঐ গ্লানিময় দিনগুলির পৃষ্ঠা! কিন্তু আজ সৰ্ব্বপ্রথম মনে হচ্চে, ভগবান মঙ্গলই করেছেন, ঐ দিনগুলির দুরপনেয় কালির দাগ এঁকে দিয়ে এ জীবনে।

বিস্মিত সবিতা মুখ উঁচু করিয়া বলিলেন, তার মানে?

বুঝতে পারলে না? আজ আমার লোভের অশুচিস্পর্শ থেকে আমিই তোমাকে রক্ষা করতে পারবো। নিজের জীবনের এই কলঙ্কিত আঙিনায় তোমাকে এনে দাঁড় করাতে পারবো না আমি। এখানে তোমার উপযুক্ত আসন নেই যে!

সবিতা অস্ফুট স্বরে কহিলেন, সোনায় কলঙ্ক লাগে না দয়াময়! কলঙ্কের কণামাত্র স্পর্শেই চিরমলিন হয়ে যাই আমরাই নিকৃষ্ট ধাতু।

বিমলবাবু গম্ভীর-কণ্ঠে বলিলেন, আমি তা একটুও মানিনে। দেখ সবিতা, আর যার কাছে যাই হও, আমার জীবনে পরম কল্যাণরূপিণী তুমি, এ-কথা মিথ্যা নয়। জীবনে ঘটেছে আমার বহু বিচিত্র নারীর সাক্ষাৎ; কিন্তু তোমার সাথে হ’লো সন্দর্শন। আমার মধ্যে যে সত্যি মানুষটা এতকাল ঘুমিয়ে ছিল, তুমি তার ঘুম ভাঙিয়ে জাগিয়ে তুললে সেদিন, তোমার স্বতঃ অভিজাত প্রকৃতির আপন স্বরূপ, সেই বিষণ্ণ ম্লান অনুতাপদগ্ধ অথচ সহজ মৰ্য্যাদামহিম রূপের প্রথম দর্শনেই চিনতে পারলাম। রমণীবাবুর প্রমোদ-আমন্ত্রণে দেখতে গিয়েছিলাম এক, দেখলাম তার বিপরীত। তোমার জীবনের ইতিহাস আজ আমার নিজের জীবনের ভোগ তুলিয়ে দিয়েচে সবিতা। সংসারে আমারই অনুরূপ অনুভূতি ঘটেচে এমন মানুষ এই প্রথম দেখলাম, সে তুমি—যে নিজের প্রকৃতি হতে বিভিন্ন হয়ে অবাঞ্ছিত অন্যতর জীবন অনিচ্ছাসত্ত্বেও —স্বেচ্ছায় যাপন করতে বাধ্য হয়েছে। নিজের স্বভাবকে চাপা দিয়ে, পারিপার্শ্বিক অবস্থার দাবী মিটিয়ে, আয়ুকে কোনও গতিকে শেষের পানে টেনে চলা বৈ তো নয়। অনুভূতির ক্ষেত্রে তুমি আর আমি এইখানে একই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি। হয়তো বা এইজন্যই তোমার অন্তরের সাথে আমার অন্তরঙ্গতা যা সম্ভবপর ছিল না, তা সম্ভব শুধু নয়, সহজও হয়েচে।

সবিতা নত-নেত্রে নীরবে শুনিতেছিলেন। এখনও অবনত নয়নে মৌন রহিলেন। বিমলবাবু ধীর-কণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, আজ আমার কাছে জীবনের অর্থ গেছে বদলে। মনের পুরনো ধারণাগুলির উপর থেকে বহুদিনের সঞ্চিত পুরু ধূলো নিঃশেষে যাচ্ছে মুছে। দীর্ঘকাল উপেক্ষায় পড়ে থাকা আয়নার উপরে জমাট ময়লা তার যে স্বচ্ছতাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, সে যেন আজ কোন নব-গৃহলক্ষ্মীর সযত্ন-মার্জ্জনায় একেবারে নির্ম্মূল হয়ে উঠেচে। সমস্ত পৃথিবী আমার কাছে অভিনব ঠেকচে আজ। এ যৌবনের উদ্দাম হৃদয়াবেগ নয়, দেহের শিরায় শিরায় তরুণ রক্তের চঞ্চল-নৃত্য নয়। এ আমার হিমকঠিন অন্তরলোকে মূর্চ্ছিত আত্মার জাগরণ, হৃদয়ের কুয়াসাচ্ছন্ন আকাশে নবচেতনার প্রথম সূর্য্যোদয়!

স্বভাবতঃ স্বল্পভাষী বিমলবাবু যে এমন করিয়া আপন অন্তরের গভীর অনুভূতিগুলিকে ভাষায় প্রকাশ করিতে পারেন, সবিতার কল্পনাও ছিল না। সংসারে বুঝি সব-কিছুই সম্ভব। তাই অত্যন্ত ধীরে, প্রায় অস্পষ্ট স্বগতোক্তির মতোই সবিতা বলিতে লাগিলেন, এ তো তোমার নিজের মনের রচনা করা— আমি। ওর সঙ্গে সত্যিকার আমার মিল কতটুকু, সে সন্ধান তুমিও জানো না, আমিও জানিনে। নাই থাক সে জানাজানি, ভগবান করুন, তুমি যে আমাকে দেখেচো সে যেন তোমার কাছে মিথ্যা না হয়।