ষোল

পরদিন সকালবেলায় হরিণপুর যাত্রার আয়োজন যখন সম্পূর্ণ, সবিতা সারদাকে ডাকিয়া বলিলেন, তোমার বাক্স-বিছানা এইবেলা উপরে পাঠিয়ে দাও সারদা, সমস্ত মাল-পত্র তারক লিস্ট করে নিচ্চে।

সারদা কুণ্ঠিত হইয়া কহিল, আমার বাক্স-বিছানা যাবে না মা।

একটি নীচু টুলে বসিয়া তারক নোটবুকের পৃষ্ঠায় দ্রুতহস্তে মালপত্র ফর্দ্দ লিখিয়া লইতেছিল। সারদার উত্তর তাহার কানে পৌঁছিল। অনবত মুখ উঁচু করিয়া তারক বিস্মিত-স্বরে বলিল, বাক্স-বিছানা যাবে না কি-রকম!

সবিতাও বিস্মিত হইয়াছিলেন। নিম্নস্বরে বলিলেন, নেয়ার মত বাক্স-বিছানাকি তোমার নেই সারদা? তা হলে আগে বললে না কেন, বন্দোবস্ত করতাম।

স্নান হাসিয়া সারদা বলিল, বিছানা আমার পুরানো এবং ছেঁড়াও বটে, তা হলেও সেগুলো সঙ্গে নিতে লজ্জা ছিল না, হরিণপুরে আমার যাওয়া হবে না মা।

তারক ও সবিতা প্রায় এক-সঙ্গেই বলিয়া উঠিলেন, সে কি?

সারদা শুষ্ক হাসিয়া বলিল, আমার কোথাও নড়বার উপায় নেই। নইলে মাকে সেবা করার থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে এই শূন্যপুরীতে একলা পড়ে থাকার দণ্ড আমি ভোগ করতাম না।

নিৰ্ব্বাক্ সবিতা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সারদার মুখের পানে তাকাইয়া কি যেন খুঁজিতে লাগিলেন।

তারক উত্তেজিত হইয়া বলিয়া উঠিল, কি রকম! কালও নতুন-মার সঙ্গে আপনি হরিণপুরে যেতে প্রস্তুত ছিলেন, আর আজ সকালেই এ-বাড়ি ছেড়ে নড়বার উপার নেই স্থির করে ফেললেন! না, ও-সব বাজে ওজর চলবে না, কোনও মেয়েছেলে সঙ্গে না গেলে সেই পাড়াগাঁয়ে একলাটি নতুন-মা—না, না, সে হতেই পারে না।

সারদা বিষণ্ন-কণ্ঠে কহিল, আমি সত্যি বলচি তারকবাবু, আমার যাবার উপায় নেই। এ বাজে ওজর নয়।

অবিশ্বাসপূর্ণ-কণ্ঠে তারক কহিল, কেন শুনি? এখানে আপনার কি কাজ?

সারদা স্থির-নেত্রে পাষাণ-প্রতিমার ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিল, কোনও জবাব দিল না। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করিয়া তারক কহিল, জবাব দিচ্ছেন না যে?

সারদা তথাপি নিরুত্তর রহিল।

তারক হতাশভাবে হাতের নোটবুকখানি ঘরের মেঝেতে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া বলিল, তা হলে আর কি করে দুপুরের ট্রেনে আপনার যাওয়া হবে নতুন-মা? মেয়ে ছেলে কেউ সঙ্গে না থাকলে সেই পাড়াগাঁয়ে নির্বান্ধব স্থানে একলাটি টিকতে পারবেন কেন?

সবিতা এতক্ষণ কথা কহেন নাই। মৃদু হাসিয়া কহিলেন, তারক, গাঁয়ে আমার জন্ম, জীবনের বেশির ভাগ গাঁয়েই কেটেছে, সেখানে আমার কষ্ট হবে না।

রুক্ষচোখে সারদার পানে তাকাইয়া তারক বিদ্রূপ-স্বরে বলিল, কে সে মাতব্বর লোকটি জানতে পারি কি, যাঁর বিনা হুকুমে আপনি নতুন-মার সঙ্গেও এ-বাড়ি ছেড়ে যেতে পারেন না? রাখালবাবু নিশ্চয়ই নয়?

তারকের অসংযত উক্তিতে সারদার মুখ অপমানে রাঙা হইয়া উঠিল। অন্য দিক পানে স্থিরনেত্রে তাকাইয়া শান্তকণ্ঠে বলিল, যিনি আমাকে এই বাড়িতে রেখে গেছেন তাঁর বিনা হুকুমে অন্যত্র যাওয়া আমার সম্ভব নয় তারকবাবু। আপনি অকারণ রাগ করচেন।

সারদার উত্তরে সবিতা চমকিয়া উঠিলেন। কিন্তু তারক কণ্ঠস্বর অনেকখানিই নিম্নগ্রামে নামাইয়া বিস্মিয়বিমিশ্র সুরে কহিল, কিন্তু তিনি তো বহুদিন নিরুদ্দেশ।

সারদা তারকের প্রতি দৃকপাত না করিয়া সবিতার সামনে আসিয়া নত হইয়া প্রণাম করিয়া বলিল, মা, আর সকলে আমাকে ভুল বুঝুক, আপনি ভুল বুঝবেন না নিশ্চয় জানি।

সবিতা গভীর স্নেহে সারদার মাথায় হাত বুলাইয়া দিয়া আঙুল ক’টি আপন ওষ্ঠাধরে ঠেকাইলেন। অত্যন্ত গাঢ় অথচ মৃদুস্বরে বলিলেন, সোনাকে পিতল বলে চিরদিন কেউ ভুল করতে পারে না সারদা। আজ না বুঝুক মা, একদিন সকলেই তোমাকে বুঝতে পারবে।

সারদার চোখে জল আসিয়া পড়িয়াছিল, কি যেন বলিতে গিয়াও বলিতে পারিল না। অবনত-মুখে প্রবল চেষ্টায় নিঃশব্দে অশ্রুসংবরণ করিতে লাগিল।

সবিতা সারদাকে কাছে টানিয়া লইয়া বলিলেন, তোমাকে কিছু বলতে হবে না সারদা। আমার সঙ্গে না যেতে পারা তোমার যে কতবড় দুঃখ, আমি তা জানি।

ট্রেন ছাড়িবার ঘণ্টা-দেড়েক পূর্ব্বে তারক স্টেশনে সবিতাকে লইয়া উপস্থিত হইল। মালপত্র গনিয়া, কুলি ঠিক করিয়া, পুরাতন দরওয়ান মহাদেবের হেফাজতে দেওয়া হইয়াছে। ব্রেকভ্যানের মালগুলি ওজনান্তে রেলওয়ে কোম্পানীর দায়িত্বে অর্পণ করিয়া রসিদখানি সযত্নে পকেটে পুরিয়া তারক নিশ্চিন্ত-চিত্তে সেকেণ্ড ক্লাশ লেডিস্ ওয়েটিং রুমের সামনে আসিয়া ডাকিল, নতুন-মা—

সবিতা ঘরের ভিতর হইতে দরজার সামনে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

তারক রুমাল দিয়া কপালের ঘাম মুছিতে মুছিতে বলিল, মালপত্র ওজন করে ব্রেকে দিয়ে রসিদ নিয়ে এলাম। এধারের ঝামেলা চুকলো। এখন ট্রেনটা প্ল্যাটফৰ্ম্মে ঢুকলেই হয়। আপনাকে বিছানা পেতে বসিয়ে দিতে পারলে তবে নিশ্চিত্ত হওয়া যাবে।

সবিতা মৃদু হাসিয়া বলিলেন, নতুন-মার পাছে হরিণপুরে যাওয়া না হয়, এজন্যে তোমার ভয় আর ভাবনার অন্ত নেই, না তারক?

স্মিতমুখে তারক জবাব দিল, নিশ্চয়ই। যে পর্য্যন্ত না ছেলের কুঁড়ে ঘরে মায়ের পায়ের ধুলো পড়ছে, ততক্ষণ নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস করিনে মা!

ছাড়িবার নির্দ্দিষ্ট সময়ের আধঘণ্টা পূর্ব্বে ট্রেন প্ল্যাটফর্ম্মের ভিতরে আসিয়া দাঁড়াইল।

ব্যতিব্যস্তভাবে তারক ওয়েটিং-রুমের দ্বারে আসিয়া উচ্চকণ্ঠে ডাকিল, নতুন-মা, বেরিয়ে আসুন ট্রেন এসে গেছে।

মহাদেব দরওয়ান ওয়েটিং রুমের বাহিরে কতকগুলি বাক্স-বিছানার বাণ্ডিলের উপর বসিয়া খৈনি টিপিতেছিল। তাড়াতাড়ি খৈনি মুখে ফেলিয়া পাগড়ী ঠিক করিতে করিতে শশব্যস্তে প্রস্তুত হইয়া দাঁড়াইল ৷

আপাদমস্তক সিল্কের চাদর-মণ্ডিতা সবিতা শিবুর মা ঝি-সহ ট্রেন অভিমুখে তারকের অনুসরণ করিতে করিতে বলিলেন, আমাকে তুমি ইণ্টার ক্লাশে মেয়েদের কামরায় তুলে দিও তারক। শিবুর মাও আমার সঙ্গে থাকবে।

তারক থমকিয়া দাড়াইয়া বলিল, আমি আপনার জন্যে সেকেণ্ড ক্লাশের টিকিট কিনেচি নতুন-মা ; ইণ্টার ক্লাশে অপরিষ্কার জেনানা কম্পার্টমেণ্টের দুর্গন্ধের মধ্যে টিকতে পারবেন কেন?

সবিতা বলিলেন, কিন্তু মেয়ে-কামরায় যাতায়াত করাই আমার অভ্যাস ছিল বাবা।

তারক বারংবার জিদ করিয়া একাধিক অসুবিধা ও কষ্টের অজুহাত দেখাইয়া দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরাতে সবিতাকে উঠাইয়া দিল।

ছোট কামরা। তখনও পৰ্য্যন্ত অন্য কোনও আরোহী উঠে নাই । তারক ব্যস্তভাবে গাড়ির মধ্যে উঠিয়া নিজের ধুতির কোঁচা দিয়া প্ল্যাটফর্ম্মের দিকের বেঞ্চখানির ধুলা ঝাড়িয়া সযত্নে পরিষ্কার বিছানা বিছাইয়া দিল। হাওড়া স্টেশন হইতে যাওয়া হইবে মাত্র বৰ্দ্ধমান । কিন্তু তারক যাত্রাপথের আয়োজন করিয়াছে দিল্লী বা লাহোর পর্য্যন্ত যাইতে হইলে যেমন করা উচিত।

সবিতা অন্যমনস্ক-চিত্তে বিছানার উপর গিয়া বসিলেন। তারক হয়তো মনে মনে আশা করিতেছিল নতুন-মা তাহার এই সতর্ক যত্ন সেবা সম্বন্ধে বিশেষ কিছু সস্নেহ অনুযোগ করিবেন। কিন্তু ধোপদন্ত ফর্সা ধুতির কোঁচা বেঞ্চির ধুলিলিপ্ত হইয়া মলিন বর্ণ ধারণ করা সত্ত্বেও নতুন-মা একটিও কথা কহিলেন না। ইহাতে তারকের মন অনেকখানিই ক্ষুণ্ণ হইয়া পড়িল। তথাপি মহা উৎসাহে সে উপরের বাঙ্কে ট্রাঙ্ক, হাতবাক্স, সুটকেশ প্রভৃতি সাজাইয়া রাখিল। বেঞ্চির নীচে ফলের টুকরি ও অন্যান্য দ্রব্য সাবধানে সুরক্ষিত করিল। কুলিদের বিদায় দিয়া তারক সবিতার সামনে আসিয়া ক্লান্ত-কণ্ঠে কহিল, আপনি একটু বসুন নতুন-মা। আমি এক গ্লাস লেমনেড বরফ দিয়ে নিয়ে আসি আপনার জন্যে। কিংবা এক প্লেট আইসক্রিম নিয়ে আসি—কি বলেন?

সবিতা এতক্ষণ বাহিরে জনাকীর্ণ প্ল্যাটফর্ম্মের পানে উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টি মেলিয়া তাকাইয়া ছিলেন। তারকের কথায় যেন সম্বিৎ ফিরিয়া পাইলেন। ব্যস্তস্বরে বলিলেন, না তারক, কিছুই আনতে হবে না। তেষ্টা আমার পায় নি।

তারক সে নিষেধে কর্ণপাত না করিয়া মাথা নাড়িয়া বলিল, বাঃ, তা কি হয়? তেষ্টা পায়নি বললে শুনবো কেন নতুন-মা? মুখ আপনার কি রকম শুকিয়ে উঠেচে সে দেখতেই পাচ্ছি—

সবিতা মৃদু হাসিয়া শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বলিলেন, লেমনেড সোডা বা আইসক্রিম ও-সব আমি কখনও খাইনে। ট্রেনে জলস্পর্শ করাও জীবনে কোনও দিন ঘটেনি। তুমি ব্যস্ত হয়ে অনর্থক ও-সব কিনে এনো না বাবা।

সকল বিষয়ে প্রতিবাদ করা এবং নিজের ইচ্ছাকে অপরের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার বিরুদ্ধে তর্ক-যুক্তি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করাই তারকের প্রকৃতি। কিন্তু নতুন-মার এই কণ্ঠস্বর তাহাকে কোনোটাতেই প্রবৃত্ত হইতে ভরসা দিল না। সুতরাং সে মনে মনে দুঃখ অপেক্ষা অস্বস্তিই অনুভব করিতে লাগিল বেশী।

প্ল্যাটফর্ম্মের কর্ম্মব্যস্ত জনতায় নিবন্ধদৃষ্টি সবিতার চক্ষুদ্বয় অকস্মাৎ উজ্জল হইয়া উঠিল। দূরে বিমলবাবুকে আসিতে দেখা গেল। প্রশান্ত সৌম্যমূৰ্ত্তি, পদক্ষেপ ঈষৎ দ্রুত। ট্রেনের কামরাগুলির মধ্যে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি মেলিয়া অগ্রসর হইয়া আসিতেছেন। দেখিতে দেখিতে সবিতার মুখ-চোখ আনন্দের স্নিগ্ধ কিরণে ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল।

বিমলবাবু প্রসন্ন-হাস্যে সবিতার কামরার সামনে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তারক তাড়াতাড়ি প্ল্যাটফর্ম্মে লাফাইয়া পড়িয়া পুলকিত-কণ্ঠে কহিল, এই যে আপনি স্টেশনে এসেচেন দেখচি। আমরা আশা করেছিলাম বাড়িতেই দেখা করতে আসবেন। ট্রেন- টাইম পৰ্য্যন্ত এলেন না দেখে কিন্তু ভাবনা হয়েছিল।

বিমলবাবু সবিতার মুখের পানে দৃষ্টি স্থাপন করিয়া শান্তকণ্ঠে তারককে প্রশ্ন করিলেন, তোমরা মানে?

বিমলবাবুর প্রশ্নে তারক সবিতার দিকে চাহিয়া হঠাৎ লজ্জায় অপ্রস্তুত হইয়া পড়িল। কথাটা বহুবচনে না বলিলেই বোধ হয় শোভন হইত। ছিঃ, নতুন-মা হয়তো কি মনে করিলেন!

কিন্তু তারকের এ লজ্জা হইতে পরিত্রাণ করিলেন নতুন-মাই! স্নিগ্ধ হাসিয়া কহিলেন, তারক ঠিকই বলেচে। আজ সকালবেলায় আমার ওখানে তোমার আসা সম্ভব মনে করেছিলাম। সারদাও বলছিল তোমার কথা।

বিমলবাবু সবিতায় কামরার মধ্যে একবার দৃষ্টি বুলাইয়া লইয়া বলিলেন, সারদা কোথায়?

সবিতার উত্তর দিবার পূর্ব্বেই তারক রুক্ষস্বরে বলিয়া উঠিল, হ্যাঁ, তিনি নাকি সহরের কলের জল ইলেকট্রিক আলো ছেড়ে পচা পাড়াগাঁয়ে বাস করতে যাবেন? তবে সেটা দয়া করে গোড়াতে বললেই ভাল করতেন, আমরা এতটা অসুবিধায় পড়তাম না।

বিমলবাবু বিস্মিত হইয়া বলিলেন, সারদা কি তোমার সঙ্গে হরিণপুরে যাচ্চে না?

সবিতা উদাস হাসিয়া নীরবে মাথা নাড়িয়া ইঙ্গিতে জানাইলেন, সারদা আসিতে পারে নাই।

বিমলবাবু ত্রস্ত হইয়া উঠিলেন। বাম হাতখানি উল্টাইয়া মণিবন্ধে বাধা সোনার রিস্টওয়াচের পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া ব্যক্ত-স্বরে বলিলেন, যথেষ্ট সময় আছে। এখনি মোটর নিয়ে গিয়ে সারদাকে তুলে আনি নতুন-বৌ। আমি গিয়ে বললে সে ‘না’ বলতে পারবে না।

সবিতা বাধা দিয়া বলিলেন, তুমি অনুরোধ করলেও সে আসতে পারবে না। শুধু তার দুঃখ বাড়বে মাত্র।

বিমলবাবু থমকিয়া দাড়াইয়া বিস্মিতকণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন, তার মানে?

সবিতা বলিলেন, আর একদিন শুনো।

বিমলবাবু সবিতার মুখের পানে ক্ষণকাল তাকাইয়া থমকিয়া বলিলেন, ব্যাপারটা কি নতুন-বৌ?

সবিতা বলিলেন, তার আসার উপায় নেই দয়াময়। নইলে আমার সঙ্গে আসা থেকে আমি নিজেও তাকে নিবৃত্ত করতে পারতাম কি-না সন্দেহ। যাই হোক, আমার আরও একটি অনুরোধ তোমার ’পরে রইলো। সারদা একলা থাকলো, মধ্যে মধ্যে তুমি তার খোঁজ-খবর নিও।

সারদার ব্যবহারে তারক তার প্রতি এত বেশি অসন্তুষ্ট হইয়াছিল যে নতুন-মা সারদার অকৃতজ্ঞতার উল্লেখমাত্র না করিয়া বরং বিমলবাবুকে তার তদারক করিতে অনুরোধ করিলেন দেখিয়া মনে মনে জ্বলিয়া গেল। মনের বিরক্তি ইহাদের সম্মুখে পাছে প্রকাশ হইয়া পড়ে সেজন্য এখান হইতে সরিয়া যাইবার ইচ্ছায় বলিল, শিবুর মা আর দারওয়ানটা ঠিক উঠেচে কি না আমি একবার দেখে আসি নতুন-মা। এই বলিয়া অনাবশ্যক দ্রুতপদে অন্যদিকে চলিয়া গেল।

বিমলবাবু সবিতার পানে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি মেলিয়া বলিলেন, কি হয়েচে বলো ত? তারককে একটু উত্তেজিত বলে মনে হচ্চে যেন।

সবিতা মৃদু হাসিয়া বলিলেন, সারদা আমার সঙ্গে না আসায় তারক তার উপরে বিষম অসন্তুষ্ট হয়েচে। ওর ধারণা আমি পল্লীগ্রামে নানা অসুবিধার মধ্যে যাচ্ছি, সারদা সঙ্গে থাকলে হয়তো আমার অনেক সুবিধা হোতো।

বিমলবাবু বলিলেন, সেটা শুধু তারকই যে ভাবচে তা তো নয়। আমিও যে ঠিক ওই ভাবনাই ভাবচি নতুন-বৌ!

সবিতা করুণ হাসিয়া বলিলেন, কিন্তু আমি আজ ঠিক এর উল্টে৷ ভাবনাই ভাবচি।

বিমলবাবু সবিতার মুখে এত করুণ হাসি পূর্ব্বে দেখেন নাই। তাঁহার বুকের ভিতরটা বেদনায় যেন মোচড় দিয়া উঠিল। সবিতার মুখের পানে স্থিরদৃষ্টিতে তাকাইয়া বলিলেন, আমি শুনতে পাইনে নতুন-বৌ?

ক্লান্ত-কণ্ঠে সবিতা বলিলেন, সমস্ত কথাই তোমায় একদিন বলবো ভেবেচি। আর কেউই তো আমার এ অন্তর্দ্দাহ বুঝতে পারবে না, বিশ্বাস করতে হয়তো চাইবে না। আমার অনেক জানাবার আছে। এই তেরো বৎসর ধরে দিনের পর দিন রাতের পর রাত ক্রমাগত যে-প্রশ্ন আমার বুকের ভিতর আছড়ে-পিছড়ে মরচে, আজও তার জবাব পাইনি। ভগবানের চরণে বারবার জানিয়েচি, ঠাকুর, তোমার অজানা তো কিছুই নেই। এতবড় নির্ম্মম জিজ্ঞাসা আমার জীবনে তুমিই পাঠিয়েচ। তার জন্য তোমাকে অভিযোগ করবো না, শুধু এর সত্য উত্তরটাও তুমি এই জীবনে আমাকে দিয়ে দিও। এ-ছাড়া প্রার্থনার আর কিছুই তো রাখিনি! যত বৃহৎ দুঃখই দাও না কেন, আমি তাকে তোমার হাতের দান বলে মেনে নিয়ে সোজা হয়েই চলতে পারতাম। কিন্তু আমার জীবনে তো তুমি দুঃখ পাঠাওনি; পাঠিয়েচো শুধু তীব্র পরিহাস। মানুষের পরিহাস সওয়া কঠিন নয়, কিন্তু তোমার এ নিষ্ঠুর পরিহাস যে স‍ হয় না!

বিমলবাবুর আনন্দসৌম্য মুখে একটা কঠিন বেদনাভূতির ছায়া নিবিড় হইয়া উঠিল। তিনি একটিও কথা কহিলেন না, অন্য একদিকে দৃষ্টি মেলিয়া স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া রহিলেন। সে দৃষ্টি যেন ইহলোক হইতে লোকান্তরে নিরুদ্দিষ্ট।

 

অনেক সময় কাটিয়া গেল। সবিতা অস্ফুট মৃদুস্বরে ডাকিলেন, দয়াময়।

বিমলবাবু ফিরিয়া চাহিয়া স্নেহস্নিগ্ধ গাঢ়কণ্ঠে উত্তর দিলেন, নতুন-বৌ!

সবিতা হঠাৎ চমকিয়া উঠিলেন। মুখে উদ্বেগ ও বেদনার চিহ্ন ফুটিয়া উঠিল। বিমলবাবুর মুখের পানে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাইয়া সানুনয় কণ্ঠে বলিলেন, একটি কথা বলবো? বলো, কিছু মনে করবে না?

বিমলবাবু সবিতার কথার সহসা কোনও উত্তর দিতে পারিলেন না। অল্পক্ষণ নীরব থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, নতুন-বৌ, আজ তুমি ‘কিছু মনে করার’ ধাপ উত্তীর্ণ হয়ে উপরে উঠতে পারোনি, জানতাম না। কিন্তু থাক সে-কথা, কি বলতে চাও বলো, কিছু মনে করবো না।

নতদৃষ্টি সবিতা বলিলেন, তুমি আমাকে নতুন-বৌ বলে ডেকো না।

বিমলবাবু কিছুক্ষণ সবিতার পানে তাকাইয়া থাকিয়া শান্ত-স্বরে বলিলেন, তাই হবে।

এবার মুখ তুলিয়া বিমলবাবুর পানে চাহিতে দেখা গেল সবিতার সুন্দর চোখ ছুটি শিশিরসিক্ত পদ্মপাপড়ির মত অশ্রুভারে টলমল করিতেছে।

বিমলবাবুকে কি একটা কথা বলিতে গিয়া বলিতে পারিল না, বাধিয়া গেল। বিমলবাবু তাহা লক্ষ্য করিলেন।

প্ল্যাটফর্ম্মের উপর হইতে কামরার মধ্যে উঠিয়া আসিয়া সবিতার সামনের বেঞ্চে বসিলেন। তারপরে স্নেহকোমল অথচ সম্ভ্রমপূর্ণ স্বরে বলিলেন, তোমাকে নাম ধরে ডাকার অধিকার আমার দিতে পারবে কি তুমি? সঙ্কোচ ক’রো না। যদি কোনও বাধা থাকে, একটুও আমি দুঃখিত হবো না জেনো। শুধু বলে দিও, কি বলে ডাকলে তোমার মনে বাজবে না, স্মৃতির দাহ জেগে উঠবে না। আমি তো বেশী কিছু জানিনে। হয়তো না জেনে আঘাত দিচ্চি তোমাকে।

সবিতা এবারে উদ্গত অশ্রু সংবরণ করিতে পারিলেন না, ঝর ঝর করিয়া ঝরিয়া পড়িল। তাড়াতাড়ি চোখ মুছিয়া মুখ ফিরাইয়া লইলেন। কি যেন একটা কথা বারংবার বলিবার চেষ্টা করিয়াও লজ্জায় ও দুঃখে কণ্ঠ রোধ হইয়া আসিতে লাগিল। বিমলবাবু আবার বলিলেন, কুণ্ঠিত হ’য়ো না। বলো, কি বলে ডাকলে তুমি সহজে সাড়া দিতে পারবে?

সবিতা তথাপি নিরুত্তর রইলেন। তার পরে বিপুল সঙ্কোচ প্রাণপণে ঠেলিয়া মৃদুস্বরে কহিলেন, আমাকে রেণুর মা বলে ডেকো।

বিমলবাবুর মুখে কোমল সহানুভূতির কারুণ্য পরিস্ফুট হইয়া উঠিল। স্নিগ্ধকণ্ঠে বলিলেন, সত্যি! ভারী সুন্দর। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি এই ভেবে, তোমার এতবড় পরিচয়টা এতদিন আমার মনে হয়নি কেন বলো তো?

সবিতা চুপ করিয়া রহিলেন।

বিমলবাবু আনন্দ মধুর-কণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, এ যে তুমি কতবড় দান আজ আমাকে দিলে, তা হয়তো তুমি নিজেও জানো না রেণুর মা! তোমার দেওয়া এই সম্মান এই বিশ্বাসের যেন মর্য্যাদা রাখতে পারি। আমার আর কোনও কামনা নেই।

বিমলবাবু হয়তো আরও কিছু বলিতেন, ট্রেন ছাড়িবার সঙ্কেতসূচক দ্বিতীয় ঘণ্টা পড়িয়া গেল। হাতঘড়ির পানে চাহিয়া তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, যাই এবার। হরিণপুরে থাকতে যদি ভালো না লাগে, চলে আসতে দ্বিধা ক’রো না যেন। তারক যদি পৌঁছে দিয়ে যেতে ছুটি না পায়, খবর দিও। রাজু গিয়ে নিয়ে আসবে। প্রয়োজন হলে আমিও যেতে পারি।

বিমলবাবু গাড়ি হইতে নামিয়া গেলেন। তারক দ্রুতপদে আসিতেছিল। হাতে এক গ্লাস বরফখণ্ডপূর্ণ রঙীন পানীয়। সিরাপ জিঞ্জার বা ঐরূপ কিছু। বিমলবাবুর হাতে গ্লাসটি তুলিয়া দিয়া বলিল, নতুন-মাকে তো একফোটা জলও মুখে দেওয়াতে পারলাম না। আপনি যেন এটা রিফিউজ করবেন না।

বিমলবাবু হাসিয়া বলিলেন, দাও।

গ্লাসটি বিমলবাবুর হাতে তুলিয়া দিয়া তারক পকেট হইতে কলাপাতা-মোড়া পানের দোনা বাহির করিল।

শেষষণ্টা পড়িয়া গার্ডের হুইসেল শোনা গেল। সবিতা বলিয়া উঠিলেন, গাড়ি যে এখনি ছাড়বে তারক! উঠে এসো এইবার। তোমার এই অতিথিবাৎসল্যের মধ্যে আমি যে কি করে দিন কাটাবো তাই ভাবচি।

বিমলবাবু তাঁর পানীয় তখনও শেষ করিতে পারেন নাই। হাসিতে গিয়া বিষম খাইলেন।

সবিতা ব্যগ্রভাবে বলিয়া উঠিলেন, আহা—

বিমলবাবু মুখ হইতে গ্লাসটি নামাইয়া সবিতার দিকে চাহিয়া এইবার উচ্চহাস্য করিয়া উঠিলেন।

ট্রেন তখন চলিতে শুরু করিয়াছে ৷ ‘নমস্কার!’ বলিয়া তারক চলন্ত ট্রেনে উঠিয়া পড়িল।