» » আঠার

বর্ণাকার

আঠার

পরদিন যখন রাখালের ঘুম ভাঙিল বেলা অনেক হইয়া গিয়াছে। ফেরিওয়ালার উচ্চ হাঁকে গলি মুখরিত। দেওয়ালের ঘড়ির দিকে তাকাইয়া রাখাল একটু লজ্জিতভাবে উঠিয়া পড়িল। মুখ-হাত ধোওয়া হইলে কামাইবার সরঞ্জাম বাহির করিয়া পরিপাটিরূপে দাড়ি কামাইয়া ফেলিল। ফর্সা ধুতি-পাঞ্জাবি বাহির করিয়া জামা-কাপড় বদলাইয়া লইল। মনোযোগের সহিত চুল ব্রাস করিতে করিতে চা-পিপাসায় ঘন ঘন তাহার হাই উঠিতে লাগিল। হাসিয়া স্টোভটির পানে তাকাইয়া রাখাল মৃদুকণ্ঠে কহিল, তোমার এ-বেলা ছুটি।

খুঁটিনাটি কাজ-কৰ্ম্ম যথাসম্ভব দ্রুতহস্তে সম্পন্ন করিয়া বার্নিশ করা ঝক্‌ঝকে জুতা জোড়া পরিত্যক্ত ময়লা রুমালে সযত্বে ঝাড়িয়া পায়ে দিবার উদ্যোগ করিতেছে, এমন সময়ে বাহির হইতে পিওন হাঁকিল– টেলিগ্রাম—

রাখাল জুতা ফেলিয়া রাখিয়া উৎসুক আগ্রহে ছুটিয়া আসিল। সহি করিয়া দিয়া টেলিগ্রাম খুলিয়া পাঠ করিতে করিতে দুর্ভাবনায় মুখ তাহার অন্ধকার হইয়া উঠিল। ব্রজবাবু বিশেষ পীড়িত। রেণু তাহাকে সত্বর যাইতে অনুরোধ করিয়াছে। টেলিগ্রামখানি হাতে লইয়া অল্পক্ষণ দ্বিধাগ্রস্তভাবে সে ঘরের মধ্যে দাঁড়াইয়া রহিল। ভাবিতে লাগিল সারদার সহিত আজ আর দেখা করিতে যাইবে কি-না। টাইম-টেবল বাহির করিয়া ট্রেনের সময় দেখিয়া ফেলিল। বেলা ন’টায় একটা ট্রেন আছে বটে, কিন্তু তাহা ধরিতে পারা যাইবে না। এখন সাড়ে আটটা। বেদানা আঙুর কমলালেবু প্রভৃতি ফলমূল এবং রোগীর প্রয়োজনীয় অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীও কিছু কিনিয়া লইতে হইবে সুতরাং ন’টার ট্রেন পাওয়া অসম্ভব। পরের ট্রেন বেলা সাড়ে বারোটায়— যথেষ্ট সময় রহিয়াছে। দ্বারে তালা বন্ধ করিয়া রাখাল চিন্তিতমুখে সারদার সহিত দেখা করিতে চলিল। কলিকাতা ত্যাগ করিয়া বাইরে যাইবার পূর্ব্বে একবার তাহাকে জানাইয়া যাওয়া উচিত। ইচ্ছা, সেইখানেই সত্বর চা পান করিয়া ফিরিবার মুখে প্রয়োজনী সামগ্রীগুলি কিনিয়া লইয়া সাড়ে বারোটার ট্রেনে রওনা হইবে।

সারদার বাসায় পৌঁছিয়া রাখাল দেখিল রোয়াকে মাদুর পাতিয়া সারদা চার-পাঁচটি ছোট ছোট ছেলে-মেয়েকে পড়াইতেছে। কেহ শ্লেটে লিখিতেছে, কেহ বানান শিখিতেছে, কেহ বা করিতেছে ছড়া মুখস্থ। রাখালকে দেখিয়া সারদা ব্যস্ত অথবা আশ্চর্য্য হইল না। আস্তে আস্তে উঠিয়া ছেলেদের বলিল, যাও, তোমাদের এখন ছুটি। দুপুরবেলায় আজ পড়তে হবে।

ছেলেরা চলিয়া গেলে সারদা রোয়াক হইতে উঠানে নামিয়া রাখালকে প্রণাম করিয়া বলিল, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, ঘরে বসবেন চলুন।

রাখাল শুষ্ক-কণ্ঠে কহিল, নাঃ, বসবার সময় নেই। দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করেই চলে যাব।

রাখাল হয়তো মনে মনে আশা করিয়াছিল সারদা তাহাকে অভাবিতরূপে দেখিতে পাইয়া বিস্ময়ে আনন্দে অভিভূত হইবে। কিন্তু সারদার ব্যবহারে মনে হইল রাখাল যে আজ এই সময়ে আসিবে তাহা যেন সে পূৰ্ব্ব হইতে জানিত।

একে রেণুর টেলিগ্রাম পাইয়া মন ছিল উদ্বিগ্ন চঞ্চল, তাহার উপর সারদার সহজ শান্ত অভ্যর্থনা রাখালের চিত্ত বিরূপ করিয়া তুলিল। মনের ভিতরে এমন একটা অহেতুক অভিমান গুমরাইতে লাগিল যাহার কারণ স্পষ্ট নির্দ্দেশ করা কঠিন।

রাখাল বলিল, তুমি মার সঙ্গে হরিণপুর যাওনি শুনলাম।

সারদা চুপ করিয়া রহিল।

উত্তর না পাইয়া রাখাল পুনরায় বলিল, কেন গেল না জানতে পারি কি? সারদা তথাপি নিরুত্তর।

রাখাল কহিল, নতুন-মাকে একলা না পাঠিয়ে তাঁর সঙ্গী হওয়া তোমার উচিত ছিল না কি?

সারদা কোনই উত্তর দেয় না দেখিয়া রাখালের মনের মধ্যে উত্তাপ উত্তরোত্তর বাড়িতেছিল। মৌনতা ভাঙাইবার জন্যই বোধ হয় একবার বলিয়া বসিল, আমার ঋণ তো সেদিন কড়ায় গণ্ডায় শোধ করে দিয়েচো, সুতরাং কথার উত্তর না দিলেও চলে, কিন্তু নতুন-মার ঋণও এরই মধ্যে শুধে ফেলেচ নাকি সারদা?

সারদার মুখে বেদনার চিহ্ন সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল। তবুও সে এই কঠিন উপহাসের উত্তর দিল না। মৃদুকণ্ঠে বলিল, আপনার যা বলার আছে ঘরে এসে বলুন। এখানে দাঁড়িয়ে হাটের মাঝখানে বলবেন না। ঘরে গিয়ে বসুন। আমি এখুনি আসচি। চলে যাবেন না আমার অনুরোধ রইলো।

কথাগুলি বলিতে বলিতেই সারদা মুহূর্ত্তমধ্যে রোয়াকের অন্য পাশে বেড়া-দেওয়া অপর ভাড়াটের অংশে অন্তর্হিত হইয়া গেল। বিরক্ত রাখাল তাহার উদ্দেশে ব্যস্ত সুরে বলিতে লাগিল, না না, বসবার আমার মোটেই সময় নেই। এখুনি যেতে হবে। যা বলতে এসেচি– শুনে যাও—

কিন্তু সারদা তখন চলিয়া গিয়াছে। রাখাল অল্পক্ষণ উঠানে দাঁড়াইয়া চলিয়া যাইবে কি আরও একটু অপেক্ষা করিবে দ্বিধা করিতে লাগিল। অবশেষে বিরক্ত চিত্তে সারদার ঘরে গিয়া বসিয়াই পড়িল। পাঁচজনের বাড়ির মাঝে চেঁচাইয়া সারদাকে বার বার ডাকাও যায় না, দাঁড়াইয়া থাকাটা আরও অশোভন। রাখাল ঘরে গিয়া বসিবার এক মিনিটের মধ্যেই সারদা ক্ষুদ্র এলুমিনিয়ম কেট্‌লির হাতলে শাড়ির আঁচল জড়াইয়া মুঠি করিয়া ধরিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। ঢাকনি চাপা দেওয়া কেট্‌লি হইতে অল্প অল্প গরম ধোঁয়া বাহির হইতেছিল। ঘরের কোণে কেট্‌লি নামাইয়া রাখিয়া দ্রুত-হস্তে জানালার মাথার তাকের উপর হইতে একটি ধবধবে শাদা পাতলা কাচের পেয়ালা পিরিচ একখানি নূতন চামচ নামাইল। ক্ষুদ্র চায়ের টিনও একটি নামাইল। চায়ের টিনটি একেবারে নূতন, প্যাক খোলা হয় নাই। সারদা লেবেল ছিড়িয়া ক্ষিপ্রহন্তে টিন খুলিয়া ফেলিয়া কেট্‌লির জলে চা-পাতা ভিজাইয়া ঢাকনি চাপা দিল। তার পর পেয়ালা পিরিচ ও চামচ বাহির হইতে ধুইয়া আনিল এবং সেই সঙ্গে লইয়া আসিল কাগজের মোড়কে চিনি ও ক্ষুদ্র কাঁসার গ্লাসে টাটকা দুধ।

চৌকিতে বসিয়া রাখাল নিঃশব্দে সারদার কার্য্যকলাপ দেখিতেছিল। বেলা হইয়াছে যথেষ্ট, অথচ চা পান করা হয় নাই। মাথাটি বেশ ধরিয়া উঠিবার উপক্রম হইয়াছে। সুতরাং সারদার চায়ের আয়োজন দেখিয়া তাহার বিরক্তি ও অভিমান অনেকখানি কমিয়া গিয়াছিল। তথাপি সম্ভ্রম বজায় রাখিবার জন্যই বলিল, এত সমারোহ করে চা তৈরী হচ্ছে কার জন্যে?

সারদা পেয়ালায় চা ছাকিতে ছাকিতে মৃদু হাসিয়া ঘাড় ফিরাইয়া একবার রাখালের পানে তাকাইল। তার পর আবার নিজের কাজে মন দিল।

মনে মনে লজ্জিত হইলেও রাখাল তখন বলিতে পারিল না— আমি উহা খাইব না। সারদা ততক্ষণে দুধ-চিনি মিশ্রিত সোনালী বর্ণ গরম চায়ে চামচ নাড়িতে নাড়িতে পিরিচ-সমেত পেয়ালাটি রাখালের সামনে তুলিয়া ধরিয়াছে।

লইতে ঈষৎ ইতস্ততঃ করিয়া রাখাল বলিল, এর জন্য এতক্ষণ আমাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখা তোমার উচিত হয়নি সারদা। কিছু দরকার ছিল না এর।

সারদা নিতান্ত নিরীহের মত মুখ করিয়া কহিল, আমি তা জানতাম না। আচ্ছা তবে থাক্, ফিরিয়ে নিয়ে যাই।

ঠোঁটের প্রান্তে চাপা দুষ্ট হাসি। রাখাল ঐ হাসি চেনে। তাহার বুকের মধ্যে কাঁপিয়া উঠিল। হাত বাড়াইয়া বলিল, নাঃ, করেইচ যখন আমার নাম করে, ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।

সারদা এইবার ঠোঁট টিপিয়া হাসিতে হাসিতে চায়ের পেয়ালা হাতে তুলিয়া দিয়া নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেল। অল্প একটু পরে শাদা কাচের একখানি প্লেটে খানকয়েক গরম শিঙাড়া ও গোটা-দুই টাট্‌কা রাজভোগ রসগোল্লা লইয়া ফিরিয়া আসিল।

রাখাল প্লেটের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল, ও-সব আবার আনলে কেন সারদা? সারদা গম্ভীর-মুখে বলিল, চায়ের সঙ্গে জলযোগের জন্য। কিন্তু চায়ের পেয়ালাটি যে খালি করে দিতে হবে এবার। আর এক পেয়ালা চা আপনাকে ছেঁকে দেব। আমার অন্য পেয়ালা আর নেই।

রাখাল এবার আর আপত্তি তুলিল না। এক নিশ্বাসে অবশিষ্ট চা-টুকু পান করিয়া লইয়া পেয়ালাটি মেঝেয় নামাইয়া দিল। তাহার পর নির্ব্বিকারে তুলিয়া লইল খাবারের প্লেটখানি।

সারদা দ্বিতীয় পেয়ালা চা লইয়া সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলে রাখাল খাবার খাইতে খাইতে মুখ না তুলিয়াই প্রশ্ন করিল, আচ্ছা সারদা, তুমি নিজে তো চা খাও না। ঘরে চায়ের সরঞ্জাম রেখেচ কার জন্যে?

সারদা নিরীহ-মুখে বলিল, এই ধরুন, তারকবাবু-টাবু—

রাখাল বলিল, ও—বুঝেছি। অৰ্দ্ধ-সমাপ্ত শিঙাড়াটি শেষ করিয়া খাবার সমেত প্লেটখানি রাখাল নামাইয়া রাখিল।

সারদা ব্যস্ত হইয়া ঝুঁকিয়া পড়িয়া অকৃত্রিম ব্যগ্রতায় বলিয়া উঠিল, ও কি? রসগোল্লা মোটে ছুঁলেনই না যে! না না, তা হবে না দেব্‌তা! তুলে নিন রেকাবি। সবগুলি না খেলে আমি মাথা খুঁড়ে মরবো কিন্তু বলে রাখচি।

অকস্মাৎ সারদার এই আন্তরিক চাঞ্চল্যে রাখাল হতভম্ব হইয়া বিমুঢ়ের মত পরিত্যক্ত প্লেট তুলিয়া লইয়া বলিল, কিন্তু আমার যে সত্যি খেতে রুচি নেই সারদা! সমস্ত খাবারগুলি না খেলে কি যথার্থই তোমার কষ্ট হবে?

সারদা আরক্ত মুখে কহিল, হ্যাঁ-হ্যাঁ, হবে। আপনি খান বলচি। রসগোল্লা আপনি কত ভালবাসেন আমি জানিনে বুঝি? সকালে গরম শিঙাড়া চায়ের সঙ্গে রোজই তো আনিয়ে খান? বলুন, খান না?

রাখাল বিস্মিত কৌতুকে বলিল, কিন্তু তুমি এ-সব গুপ্ত সংবাদ জানলে কেমন করে?

সারদা শান্তভাবে কহিল, আমি জানি। তারপরে হাসিতে হাসিতে বলিল, আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো এক পেয়ালা চায়ে আপনার কোনও দিন তেষ্টা মেটে? দু’পেয়ালা চা না হলে মন খুঁৎখুঁৎ করে না কি?

রাখাল রসগোল্লাভরা গালে ভারী গলার বলিল, হুঁ, বুঝেছি। কিন্তু আমি যে বাসায় চা খাই ঠিক এইরকম বড় পেয়ালায়, তারক কি সে খবরটাও তোমাকে দিয়ে গেছে?

সারদা জবাব দিল না। রাখালের চা ও খাবার খাওয়া হইয়া গেলে মুখ ধোওয়ার জল ও সুপারি এলাচ আনিয়া দিল।

হাত মুখ মুছিবার জন্য একখানি পরিচ্ছন্ন গামছা হাতে দিয়া সারদা বলিল, উঠানের মাঝখানে দাড়িয়ে উঁচু-গলায় যা বলতে চাইছিলেন, এইবার উঠানে নেমে তা বলবেন চলুন।

রাখাল লজ্জিত হইয়া বলিল, সারদা, তুমি দেখছি আজকাল আমাকে প্ৰতি কথায় উপহাস করো।

জিভ কাটিয়া সারদা বলিল, বাপ রে? কি বলেন দেব্‌তা? এতবড় দুঃসাহস আমার নেই। ব্রহ্মতেজে ভস্ম হয়ে যাবো না?

রাখাল গম্ভীর-মুখে বলিল, আমি জানতে এসেছিলাম তুমি নতুন-মাকে একা হরিণপুরে পাঠিয়ে কি গুরুতর প্রয়োজনে কলকাতায় রইলে? তোমাকে সত্যি করে এর জবাব দিতে হবে।

সারদা অল্পক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। পরে বলিল, আগে আপনি আমার একটি কথার সত্যি করে জবাব দেবেন বলুন?

দেবো।

যে-প্রশ্ন আমাকে আপনি জিজ্ঞাসা করেচেন, নিজে কি তার জবাব সত্যিই জানেন না?

রাখাল মুস্কিলে পড়িল। আমতা আমতা করিয়া বলিল, আমি যা অনুমান করচি সেটা ঠিক কি-না জানবার জন্যেই তো তোমাকে জিজ্ঞেসা করচি সারদা!

সারদা বলিল, তাহলে জেনে রাখুন, মনের কাছ থেকে যে জবাব পেয়েচেন, সেইটেই সত্যি। নিজের অন্তর কখনও মানুষকে ঠকায় না।

রাখাল চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। সারদা উচ্ছিষ্ট পেয়ালা পিরিচ ও রেকাবি উঠাইয়া বাহিরে যাইবার উদ্যোগ করিতেছে, সেইদিকে তাকাইয়া রাখাল কহিল, তবুও নিজের মুখে বুঝি স্পষ্ট বলতে পারলে না কেন যাওনি!

সারদা হাসিয়া হাতের উচ্ছিষ্ট পেয়ালা প্লেটগুলি ইঙ্গিতে দেখাইয়া বলিল, এরই জন্যে যাইনি। এইবার স্পষ্ট জবাব পেলেন তো? বলিয়া বাহির হইয়া গেল।

রাখাল চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। ভাবিতে লাগিল, কিছুদিন পূর্ব্বে সে বলিয়া ছিল– দুনিয়ার সারদাদের সে অনেক দেখিয়াছে। কিন্তু সত্যই কি তাই? এই সারদার সমতুল্য কি আর একটি মেয়েরও জীবনে দেখা পাইয়াছে? জীবনদানের মূল্যে এমন করিয়া নিঃশব্দে জীবন উৎসর্গ আর কে করিতে পারে?

ধোওয়া বাসনগুলি আনিয়া তাকের উপরে সাজাইয়া রাখিতে রাখিতে সারদা বলিল, প্রথম যেদিন আমার ঘরে পায়ের ধূলো দিয়েছিলেন দেব্‌তা, আপনাকে চা তৈরী করে খাওয়াতে চেয়েছিলাম। আপনি বলেছিলেন, অসময়ে চা খাওয়া আমার সহ্য হয় না। জলখাবার আনিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, আমার আগ্রহ দেখে আপনার দয়া হয়েছিল। বলেছিলেন, আবার যেদিন সময় পাবো, আমি নিজে চেয়ে তোমার চা, তোমার জলখাবার খেয়ে যাবো। সেই থেকে আমি চায়ের সরঞ্জাম ঘরে যোগাড় করে রেখে দিয়েচি। জানতাম একদিন না একদিন আপনি এই ঘরে বসে আমার হাতের চা জলখাবার গ্রহণ করবেনই। কিন্তু বলেছিলেন নিজে চেয়ে নিয়ে খাবো। আমার ভাগ্যে সেটা আর হ’লো না।

রাখাল স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। মনে পড়িল সে আজ বাসা হইতে বাহির হইয়াছিল চা জলখাবার খাইবে বলিয়াই।

অনেকক্ষণ নিঃশব্দে কাটিয়া গেল। রাখালের হঠাৎ মনে পড়িল বাজার করিয়া শীঘ্র বাসায় ফেরা প্রয়োজন। সচকিতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আজ আমি যাই সারদা। সাড়ে-বারোটায় আমাকে ট্রেন ধরতে হবে।

সারদা আশ্চর্য্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কোথায় যাবেন?

কাকাবাবুর বড় অসুখ। রেণু যাওয়ার জন্যে তার করেছে।

সারদা চিন্তিত-মুখে বলিল, নতুন-মাকে খবর দিয়েচেন?

না। নতুন-মা তো হরিণপুরে। তুমি তাঁর চিঠিপত্র পাও নাকি?

হাঁ। তিনি প্রতি চিঠিতেই কাকাবাবু ও রেণুর সংবাদ জানতে চান। আপনার কুশলও প্রতি পত্রেই জিজ্ঞেসা করেন।

রাখাল বলিল, তা হলে খবরটা তুমিই তাঁকে লিখে দাও। আমায় তিনি চিঠি-পত্র দেননি।

সারদা বলিল, তা দেব। কিন্তু একটু অপেক্ষা করুন দেব্‌তা। আমার ফিরিতে বেশি দেরি হবে না।

সারদা টিনের তোরঙ্গটি খুলিয়া কতকগুলি কাপড় বাহির করিয়া লইয়া ঘরের বাহিরে চলিয়া গেল। রাখালকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইল না। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সারদা মিলের ফর্সা শাড়ি ও মোটা সেমিজে পরিচ্ছন্ন বেশে একটি পুঁটুলি হাতে ঘরে ঢুকিল।

বিস্মিত রাখাল সারদার মুখের পানে চাহিতে সারদা কহিল, আমাকেও যে আপনার সঙ্গে যেতে হবে দেব্‌তা।

রাখাল অতিরিক্ত আশ্চর্য্য হইয়া বলিল, তুমি কোথায়া যাবে আমার সঙ্গে?

কাকাবাবুর অসুখ। রেণু ছেলেমানুষ, একলা। আমি গেলে অনেক দরকারে লাগতে পারবো।

রাখাল ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া কহিল, কিন্তু —

বাধা দিয়া সারদা বলিল, অমত করবেন না দেব্‌তা, আপনার দুটি পায়ে পড়ি। কাকাবাবু আমায় চেনেন, রেণুও আমায় জানে। আমি গেলে ওঁরা অসন্তুষ্ট হবেন না, দেখবেন। সারদার কণ্ঠস্বরে নিবিড় মিনতি ফুটিয়া উঠিল।

রাখাল দাঁড়াইয়া চিন্তা করিতে লাগিল। ভাবিয়া দেখিল সারদাকে সঙ্গে লইয়া গেলে লাভ ব্যতীত ক্ষতি হইবে না। বলিল, আচ্ছা, চলো তা হলে; কিন্তু তোমার খাওয়া তো হয়নি? আমি বাজার করে ফিরে আসছি! তুমি এগারোটার মধ্যে স্নানাহার করে তৈরী হয়ে নাও।

সারদা কহিল, আপনার খাওয়ার কি হবে?

আমি স্টেশনে রেস্তোয়ায় খেয়ে নেবো ঠিক করেচি।

আমার রান্না চড়ে গেছে। আপনি সাড়ে দশটার মধ্যে খাবার তৈরী পাবেন। এখানেই আজ দুটি খেয়ে নিন না দেব্‌তা।

না, না, আমার খাওয়ার জন্য তোমাকে হাঙ্গামা করতে হবে না। আমি দোকানে খাবার খেয়ে নিতে পারবো।

আপনাকে ভাত খেতে হবে না। গরম লুচি ভেজে দেবো। লুচি খেতে আপনার আপত্তি কি?

আপত্তি কিছু নেই। এই তো সেদিন রাত্রে নিমন্ত্রণ খেলাম তোমার কাছে। এখনও পেটের ভিতর চা-জলখাবার হজম হয়নি।

তা হলে খান-কতক লুচি ভেজে দিই?

খাই যদি ভাতই খাব, লুচি নয়। জাতের বালাই আমার নেই। আমি এখনও তারকবাবু হয়ে উঠতে পারিনি।

সারদা হাসিয়া বলিল, তারকবাবুর উপর এত বিরূপ কেন দেব্‌তা?

রাখাল বলিল, নিশ্চয়ই তুমি জানো, তারক যার তার হাতে অন্নগ্রহণ করে না।

সারদা হাসিতে লাগিল, জবাব দিল না।

রাখাল বলিল, চললুম তা হলে। জিনিস পত্র কিনে একেবারে বাসা থেকে স্নান সেরে বাক্স-বিছানা নিয়ে ফিরবো এখানে? তুমি প্রস্তুত থেকো?

রাখাল বাহির হইয়া গেল। ফিরিয়া আসিল প্রায় পৌঁনে বারোটায়। একটি ফলের টুকরিতে কমলালেবু, বেদানা, আঙুর প্রভৃতি ফল, তালমিছরি, বার্লি, পার্লসাগু, এক- টিন উৎকৃষ্ট মাখন, একটিন রোগীর পথ্য হাল্‌কা বিস্কুট ইত্যাদি কিনিয়া আনিয়াছে। এ-ছাড়া, বেডপ্যান, হট্‌ওয়াটার ব্যাগ, আইস ব্যাগ, অয়েল ক্লথ প্রভৃতি রোগীর প্রয়োজনীয় কতকগুলি দ্রব্যসামগ্রীও কিনিয়াছে। আর আছে তার বিছানা ও বাক্স।

রাখাল ফিরিয়া আসিয়াই ভাত চাহিল। সারদা ঘরের মেঝেয় আসন পাতিয়া ঠাঁই করিয়া রাখিয়াছিল। রাখালকে হাত-পা-ধুইবার জল ও গামছা আগাইয়া দিয়া ভাত বাড়িয়া আনিল।

রাখাল জিজ্ঞাসা করিল, তুমি তৈরী তো সারদা?

সারদা জবাব দিল, আমি তো অনেকক্ষণ তৈরী?

রাখাল আসনে বসিয়া নিঃশব্দে আহারে মন দিল। আহারের আয়োজন অতি সামান্যই। কিন্তু তাহার অন্তরালে যে আন্তরিকতা ও সযত্ন আগ্রহ বর্ত্তমান, তাহার পরিচয় রাখালের অন্তরে অজ্ঞাত রহিল না। তৃপ্তিপূর্ব্বক ভোজন করিয়া উঠিলে সারদা আঁচাইবার জল হাতে ঢালিয়া দিল। রাখাল জীবনে কোনও দিন এরূপ সেবা- গ্রহণে অভ্যস্ত নহে। সুতরাং তাহার যথেষ্ট বাধ বাধ ঠেকিতে ছিল। কিন্তু সারদার এই ঐকান্তিক আগ্রহ যত্নে বাধা দিতে প্রবৃত্তি হইল না। আঁচাইবার জল হাতে ঢালিয়া দাঁত খুঁটিবার খড়িকা দিল। তারপরে গামছাখানি রাখালের হাতে তুলিয়া দিয়া সারদা গুটিকয় টাটকা সাজা পান আনিয়া সামনে ধরিল।

রাখাল কহিল, একেই বলে বিধাতার মাপা। কোথায় স্টেশনে কেনা খাবার, আর কোথায় সারদার হাতের রান্না অমৃতোপম অন্নব্যঞ্জন! মায় আঁচাবার জল, দাঁত খোঁটার খড়কে, হাত মোছার গামছা, ঘরে সাজা পান! আজ কার মুখ দেখে যে উঠেছিলুম!

সারদা মৃদু হাসিল, কিছু বলিল না। রাখালের উচ্ছিষ্ট থালা-বাটী বাহিরে লইয়া যাইতে যাইতে বলিয়া গেল, আপনি একটু বসুন। আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসচি।

রাখাল একটি সিগারেট ধরাইয়া লইয়া শূন্য তক্তাপোষের এককোণে বসিয়া পরিতৃপ্তিপূর্ব্বক টানিতে প্রবৃত্ত হইল। চাহিয়া দেখিল, সারদা একখানি ক্ষুদ্র সতরঞ্চি-মোড়া বিছানার ছোট বাণ্ডিল তক্তাপোষে রাখিয়া গিয়াছে। চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিল কাপড়-চোপড়ের পুঁটুলি বা বাক্স নাই।

সারদা ফিরিয়া আসিল সত্য সত্যই দশ মিনিটের মধ্যে। রাখাল জিজ্ঞাসা করিল, তোমার খাওয়া হয়েচে সারদা?

সারদা বলিল, খেতেই তো গিয়েছিলাম।

সে কি? এরই মধ্যে খাওয়া হয়ে গেল? নিশ্চয়ই তুমি ভাল করে খাওনি।

সারদা হাসিয়া কহিল, আজ আমি সবচেয়ে ভাল করে খেয়েচি। দেব্‌তার প্রসাদ কি হেনস্তা করে খেতে আছে? এখন নিন, উঠুন। সব প্রস্তুত। আপনার তো দেখচি লগেজ অনেকগুলি। একটি সুটকেস, একটি এটাচি কেস, একটি বিছানা, একটি ফলের ঝুড়ি, একটি প্যাকিং বাক্স, মায় একটি জীবন্ত লগেজ পর্য্যন্ত।

রাখাল সারদার পরিহাসের জবাব না দিয়া বলিল, তোমার তো বেডিং প্রস্তুত দেখচি। কাপড়-চোপড়ের বাক্স কই?

সারদা বলিল, খান-তিনেক শাড়ি আর গোটা-দুই সেমিজ ঐ বিছানার সঙ্গেই বেঁধে নিয়েচি।

রাখাল বিস্মিত হইয়া কহিল, ওতে কুলোবে কেন?

সারদা মৃদু হাসিয়া বলিল, যথেষ্ট। ময়লা হলে সাবান দিয়ে সাফ করে নেবো, যা নিত্য এখানে করি।

রাখাল একটুখানি গুম হইয়া রহিল। বারংবার মনে হইতে লাগিল, বলে, কাপড়ের তোমার এত অভাব, এটা কি আমাকে জানালে তোমার অপমান হতো সারদা? কিন্তু মুখ ফুটিয়া কিছুই বলিতে পারিল না। রাগের ঝোঁকে টাকা লইবার কথা মনে পড়ায় নিজেকে অপরাধী মনে হইতে লাগিল। রাখাল উদাস কণ্ঠে কহিল, তা হলে এবার ট্যাক্সি নিয়ে আসি।

সারদা সচকিতে বলিয়া উঠিল, ওমা– বলতে একেবারেই ভুলে গেছি দেব্‌তা— আপনি বাজার করতে বেরিয়ে যাবার একটু পরেই বিমলবাবু এসেছিলেন। তিনি বলে গেছেন একটা জরুরী কাজে যাচ্ছেন, এখনই ফিরে আসবেন। আপনার সঙ্গে তাঁর দরকার আছে। তিনি তাঁর মোটরে আমাদের স্টেশনে পৌঁছে দেবেন বলে গেলেন।

রাখালের মুখ-ভাবের কোমলতা অন্তর্হিত হইল। শুষ্ক-স্বরে কহিল, আজকে আর তাঁর সঙ্গে দেখা করবার সময় নেই সারদা, ফিরে এসে দেখা হবে। দেরি করা চলে না, আমি ট্যাক্সি আনতে চললুম।

রাখালের কথা শেষ হইবার পূর্ব্বেই সদর দরজার সম্মুখে মোটরের হর্ণ শোনা গেল এবং উঠান হইতে বিমলবাবুর আওয়াজ পাওয়া গেল— সারদা-মা—

সারদা বাহির হইয়া বলিল, আসুন—

বিমলবাবু ঘরে প্রবেশ করিয়া বলিলেন, এই যে রাজু এসে গেছো। ভাগ্যে আজ এদিকে একটা দরকারে এসেছিলাম। মনে হ’লো পাশেই যখন এসে পড়েছি, সারদা-মাকে একবার দেখে যাই। এসে শুনলাম ব্রজবাবুর অসুখের তার পেরে তোমরা আজই রওনা হচ্চো। চলো তোমাদের পৌঁছে দিয়ে আসি; বড় গাড়িটাতেই আজ বেরিয়েচি, মালপত্র নেওয়ার অসুবিধা হবে না।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাখাল আপত্তি করিতে পারিল না। জিনিসপত্র গাড়ীতে উঠানো হইলে বিমলবাবু রাখালের হাত ধরিয়া বলিলেন, রাজু, আমার একটি অনুরোধ রেখো, ব্রজবাবুর অসুখে যদি কোনও রকম সাহায্যের প্রয়োজন বোঝ, আমাকে তার করতে ভুলো না। রোগে অর্থবল ও লোকবল দুয়েরই দরকার। তুমি জানালে তৎক্ষণাৎ বড় ডাক্তার নিয়ে রওনা হতে পারবো। আমি ব্রজবাবু ও রেণুর অকৃত্রিম হিতার্থী, বিশ্বাস করতে দ্বিধা ক’রো না।

বিমলবাবুর কণ্ঠের দৃঢ়তায় রাখাল বোধ হয় একটু অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল, তাই ঈষৎ আশ্চর্য্যভাবেই তাঁহার মুখের পানে তাকাইল।

ম্লান হাসিয়া বিমলবাবু বলিলেন, আমি জানি রাজু, তোমার চেয়ে বড় বন্ধু আজ তাঁদের আর কেউ নেই। তবুও আমার দ্বারা যদি তাঁদের কোনও দিক থেকে কোনও উপকার বিন্দুমাত্রও সম্ভব মনে করো, খবর দিতে ভুলো না। এইটুকু তোমার জানিয়ে রাখলাম।

রাখাল কি-যেন বলিতে যাইতেছিল, বিমলবাবু বলিলেন, রেণু আর ব্রজবাবু আজ কত বেশি অসহায় আমি তা জানি রাজু।

রাখালের দুই চোখ সজল হইয়া উঠিল। বলিল, আপনার প্রতি অবিচার করেচি আমাকে ক্ষমা করবেন। কাকাবাবুর অসুখে যদি কোন সাহায্যের প্রয়োজন হয় আপনাকে সংবাদ দেব।