» » একুশ

বর্ণাকার

একুশ

কলিকাতার দুইজন খ্যাতনামা বিচক্ষণ চিকিৎসক ব্রজবাবুকে বিশেষ ভাবে পরীক্ষান্তে চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করিয়া কলিকাতায় প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন। বিমলবাবু আরও কয়েকদিন তাঁহার নিকটে আছেন। ব্লাডপ্রেশার আর একটু কমিলেই ডাক্তারের নির্দেশমত ব্রজবাবুকে কলিকাতায় লইয়া যাওয়া হইবে।

মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি কোনও জায়গায় পর্য্যাপ্ত আলো-বাতাসযুক্ত একখানি ছোট বাড়ি ভাড়া করিবার জন্য বিমলবাবু কলিকাতার পত্র লিখিয়াছেন। তাঁহার কর্মচারীরা সমস্তই ঠিক করিয়া রাখিবে।

কলিকাতার চিকিৎসকেরা আসিয়া রোগীর ব্যবস্থা করিয়া যাইবার পর হইতে ব্রজবাবু অনেকটা সুস্থ বোধ করিতেছেন। সকলেরই মন বেশ উৎফুল্ল।

ব্রজবাবু বৈকালে উত্তরদিকের বারান্দার একখানি ডেক চেয়ারে শুইয়া ছিলেন। পাশের চৌকিতে বিমলাবাবু খবরের কাগজ হাতে বসিয়া। উভয়ের মধ্যে কথাবার্তা চলিতেছিল জগৎব্যাপী ট্রেড্-ডিপ্রেশন বা ব্যবসায়ের দুরবস্থা লইয়া।

এই আলোচনা-প্রসঙ্গে ব্রজবাবু বলিলেন, আপনি যখন প্রথম আমার কাছে এসে আমার ব্যবসায় কিনে নেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন, আমার মনে হয়েছিল সাধারণ বড়লোকের মতোই ব্যবসায়-সম্বন্ধে আপনার শুধু সৌখীন আগ্রহ-উৎসাহই আছে, সূক্ষ্ম-ভবিষ্যৎবৃষ্টি ও ভালোমন্দ জ্ঞান— অর্থাৎ থাকে ব্যবসায়বুদ্ধি বলে, তা আপনার নেই। তার পরে যখন আপনার অন্যান্য সব প্রচুর লাভজনক বড় বড় ব্যবসায়ের বিবরণ শুনলাম, তখন আশ্চর্য্য না হয়ে পারিনি। আশ্চর্য্য হয়েছিলাম এইজন্য যে, এতবড় ব্যবসায়ী লোক হয়েও আপনি কি দেখে আমার ভরা-ডোবা ব্যবসা অত চড়া দামে কিনতে চাইছিলেন!

বিমলবাবু হাসিলেন।

ব্রজবাবু পুনরায় বলিলেন, আচ্ছা বিমলবাবু, সত্যি করে বলুন তো, আপনি কি বুঝতে পারেননি ও-ব্যবসা সে অবস্থায় কিনে নেওয়া দূরে থাক্ যেচে সেধে হাতে তুলে দিলেও কেউ নিতে চাইতো না ওর দেনার পরিমাণ দেখে? সে অবস্থায় ওর ভার নেওয়া মানে ইচ্ছে করে টাকাগুলো গঙ্গাগর্তে ফেলে দেওয়া।

বিমলবাবু তেমনই মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলেন, এবারও কোনও জবাব দিলেন না।

ব্রজবাবু বলিলেন, আশ্চৰ্য্য মানুষ আপনি!

এবার বিমলবাবু কথা কহিলেন। বলিলেন, আমার চেয়েও অনেক বেশী আশ্চৰ্য্য মানুষ আপনি!

কিসে বলুন তো?

আপনি জেনে-শুনেও অবিশ্বাসী ও প্রতারক আত্মীয়দের হাতে আপনার নিজ হাতে গড়া বৃহৎ ব্যবসা তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন।

ম্লান হাসিয়া ব্রজবাবু বলিলেন, সংসারে মানুষকে বিশ্বাস করা কি এতই অপরাধ বিমলবাবু? বিশ্বাস আমি কোনও কারণেই হারাতে চাইনে।

বার বার ক্ষতি-স্বীকার ও দুঃখভোগ করেও কি বিশ্বাস বজায় রাখা সম্ভব?

তা জানিনে, কিন্তু রাখা ভালো। অবিশ্বাসীর কোথাও আশ্রয় নেই, কোনও সান্ত্বনা নেই।

আপনার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় এই কি সত্য জেনেচেন?

হাঁ। আমি বিশ্বাস করে ঠকিনি। বাইরে থেকে মানুষ আমাকে বার বার নির্ব্বোধ বলেচে, কিন্তু আমি জানি আমি ভুল করিনি, তারাই ভুল করেচে।

বিমলবাবু তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ব্রজবাবুর মুখের পানে তাকাইয়া রহিলেন।

দূরদিগন্তে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া ব্রজবাবু বলিতে লাগিলেন, আমার সমস্ত কাহিনী একদিন বলবো আপনাকে। আপনি অন্যের মুখে কতদূর কি শুনচেন তা জানিনে, তবে আমার মুখে সেদিন যেটুকু শুনেছিলেন, তা কিন্তু সমস্ত নয়। নিজের কথা বলবার আগে আপনাকে আমার কিছু জিজ্ঞাসা করবার আছে।

বলুন, কি জানতে চান?

আপনার যা আর্থিক অবস্থা, তাতে আপনাকে লক্ষ্মীর বরপুত্র বলা যেতে পারে। আপনি সবল সুশ্রী স্বাস্থ্যবান পুরুষ, ভাগ্যদেবী সকল দিক দিয়েই আপনার প্রতি প্রসন্ন—অথচ এত বয়স পর্যন্ত সংসারে প্রবেশ করেননি, এর যথার্থ কারণটা জানতে পারি কি? অবশ্য যদি বলতে আপনার বাধা না থাকে।

বলতে কিছুমাত্র বাধা নেই। কারণটা নেহাৎ সোজা। প্রথমতঃ সময় ও সুযোগের অভাব, দ্বিতীয়তঃ বিবাহে অনিচ্ছা।

প্রথমটা হয়তো একদিন সত্য ছিল, কিন্তু আজ তো আর তা নয়? তখন ব্যবসায়ের উন্নতির চেষ্টায় দেশ-দেশান্তর ঘুরে বেড়িয়েছিলেন, সংসার পাতার ভাবনা ভাববার অবকাশ ছিল না। কিন্তু তার পরে?

বললুম তো এই মাত্র, রুচি হয়নি।

রুচি-অরুচির কথা উঠলে আর কোনও প্রশ্ন চলে না বিমলবাবু। তবু আমার আর একটি জিজ্ঞাসার জবাব দিন। এখন কি সংসারী হবার কোনও বাধা আছে আপনার?

ব্রজবাবুর প্রশ্নে বিমলবাবু বিস্ময়রোধ করিতেছিলেন যতখানি তারও বেশি করিতেছিলেন কৌতুকবোধ। চাপা হাসিতে তাঁহার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছিল। বলিলেন, বাধা কোনদিনই ছিল না ব্রজবাবু, আজও নেই। হয়তো বা আমার বিবাহের পথ এত বেশী অবাধ বলেই স্বয়ং প্রজাপতি পথ আগলে বসে রইলেন; নববধূর আর শুভাগমন হ’লো না।

ব্রজবাবু বলিলেন, আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না।

দেখুন, আমাদের দেশে একটা মেয়েলী প্রবাদ হয়তো শুনেচেন,

অতিবড় ঘরণী না পায় ঘর।

অতিবড় সুন্দরী না পায় বর॥

আমারও হয়েচে তাই। বিবাহের পাত্র হিসাবে নাকি আমি সকলদিক দিয়েই উপযুক্ত, এ-কথা অনেকেই বলেচেন, অন্ততঃ ঘটক সম্প্রদায় তো বলেনই। তবুও যার সারা-যৌবনে বিয়ের ফুল ফুটলো না, সে-স্থলে প্রজাপতির বাধা ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে বলুন?

কিন্তু এতদিন ফোটেনি বলেই যে কোনদিনই ফুটবে না, এও তো নয়।

সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেছে দাদা। অকালে কি আর ফুল ফোটে? জোর করলে তার বিকৃতি ঘটানো হয় মাত্র। বিবাহ ব্যাপারটা অনেকটা মরশুমী ফুলের মতো, ঠিক নিজের ঋতুতে আপনি ফোটে। মরশুম চলে গেলে আর ফোটে না, তখন সে দুর্লভ।

ব্রজবাবু একটু চিন্তা করিয়। হাসি-মুখে বলিলেন, ভাল মালী চেষ্টা করলে অসময়েও ফুল ফোটাতে পারে; কিন্তু সে-কথা থাক, বিবাহটা যে ঠিক মরশুমী ফুল, আমি মানতে পারলাম না। বিয়ের ফুল ফোটা বলে একটা কথা এদেশে আছে, কিন্তু কোনও দেশেই ওটা যে ফুলের চাষের নিয়ম মেনে চলে এমন প্রমাণ বোধ হয় নেই।

বিমলবাবু বলিলেন, না না, তা নয়। আমি বলতে চাইচি, জীবনে বিবাহের একটি নির্দিষ্ট শুভ লগ্ন আছে। সে লগ্নটি উত্তীর্ণ হয়ে গেলে আর বিবাহ হয় না। যাঁরা তার পরেও বিবাহ করেন, সে ঠিক বিবাহ নয়।

সেটা তাহলে কি?

সেটা শুধু স্ত্রী-পুরুষের একত্র বসবাস মাত্র। কোনও ক্ষেত্রে বংশ-রক্ষার প্রয়োজনে কোনও ক্ষেত্রে সংসার-যাত্রা নির্ব্বাহের কিংবা সুখ-সুবিধা ও আরামের প্রয়োজনে— কোন ক্ষেত্রে কেবলমাত্র হৃদয়-মনের বিলাসিতা চরিতার্থের জন্য।

বিস্মিত কৌতূহলে ব্রজবাবু প্রশ্ন করিলেন, ঐ সকল বাদ দিয়ে বিবাহটিকে আর অন্য কি বস্তু বলতে চান আপনি?

সেটা ঠিক বুঝিয়ে বলা একটু কঠিন। সংসারে দেখা যায় সমাজ অনুমোদিত পুরুষ ও নারীর মিলনকে বিবাহ বলা হয়; কিন্তু আমি তা মনে করি না। মানুষের জীবনে এমন একটা বসন্ত ঋতু আসে, এমন একটা আনন্দকাল আসে যে পরমক্ষণে নর-নারীর ঈপ্সিত মিলন, দেহে মনে অপূর্ব্ব রসে ও রঙে রঙীন হয়ে ওঠে। দুটি প্রাণের, দুটি দেহ-মনের সেই যে রস-মধুর বর্ণরাগ—তাকেই বলি বিবাহ। সূর্য্যাস্তের পর-মুহূর্ত্তেই, যখন সন্ধ্যা হয়নি অথচ দিন অবসান হয়েচে, সেই সুন্দর সন্ধিলগ্ন, সেইটুকু আয়ু অতি অল্পক্ষণমাত্র স্থায়ী। তাকে আমরা গোধূলিক্ষণ বলি। সেই রমণীয় সময়টুকুর মধ্যে পশ্চিমের আকাশে জেগে ওঠে অপরূপ আলোর লীলা, আর অফুরন্ত রঙের বৈচিত্র্য যা সমস্ত দিবা-রাত্রির দীর্ঘ সময়ের মধ্যে আর কোনক্রমে কোন মুহুর্ত্তেই ধরা যায় না। সে ঐ বিশেষ ক্ষণটুকুর সামগ্রী। মানুষের জীবনে বিবাহও তাই।

ব্রজবাবু মৃদু হাসিয়া বলিলেন, বুঝেচি। কিন্তু আপনি যা বললেন বিমলবাবু, তা হয়তো আপনাদের কল্পনা-কাব্যের পাতায় লেখে, বাস্তব জীবনের হিসাবের খাতার লেখে না।

সেইজন্য তো আমাদের বিবাহিত জীবনের পাতায় এত গরমিল জমে ওঠে, হিসাব মেলে না কিছুতে।

অর্থাৎ, আপনি বলচেন বিবাহ ব্যাপারটা কাব্যের খাতায় ছন্দের অন্তর্গত, হিসাব খাতার অঙ্কের অন্তর্গত নয়?

সে-কথার জবাব এড়াইয়া গিয়া বিমলবাবু বলিলেন, আপনিই বলুন না দাদা। বিবাহের অভিজ্ঞতা আমার নিজের জীবনে একবারও ঘটেনি, কিন্তু আপনার ঘটেচে একাধিকবার। আপনি ও-বিষয়ে আমার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ।

আমার কথা মানেন তো বলি।

বলুন।

বিয়ের ফুল ফোটার দিন আজও আপনার অটুট আছে।

তার মানে? আপনি কি বলতে চান এই বয়সে—

বিমলবাবুর বাক্য সমাপ্ত হইবার পূর্ব্বেই ব্রজবাবু হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন, আপনি সত্যিই হাসালেন কিন্তু বিমলবাবু।

কেন বলুন তো?

আপনার বিয়ের আর বয়স নেই, এ-রকম একটা অসম্ভব ধারণা কি করে হলো? তা হলে আমরা তো—

কিন্তু আপনার বেশী বয়সে বিবাহের অভিজ্ঞতা যে একবারও সুখের হয়নি এও তো সত্য!

আপনি ভাগ্য মানেন কি?

কতকটা মানি বৈ কি। তবে অন্ধ অদৃষ্টবাদী নই।

‘জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ’ এই তিনটে ব্যাপার যে সম্পূর্ণ ভাগ্যের ’পরে নির্ভর করে এটা স্বীকার করেন কি?

না। এ যুগে বিজ্ঞানের সাহায্যে জন্ম ও মৃত্যুকে সম্পূর্ণ না হলেও কতকটা ইচ্ছা-নিয়ন্ত্রিত করতে পেরেচে মানুষ, যদিও জন্ম-মৃত্যু ব্যাপারটা একেবারেই প্রকৃতির নিয়ম। জীবমাত্রেই প্রকৃতির নিয়মের অধীন ৷ সুতরাং ও-দুটো বাদ দিয়ে বিবাহটাই ধরুন। ওটা সামাজিক সুবিধার জন্য মানুষের গড়া নিয়ম। কাজেই ও ব্যাপারটায় অদৃষ্টের বিশেষ হাত নেই। মানুষের ইচ্ছাই এক্ষেত্রে প্রধান।

এ-সকল যুক্তিতর্ক ব্রজবাবুর হয়তো ভাল লাগিতেছিল না। সুতরাং তিনি এ আলোচনায় আর যোগ না দিয়া নীরবে চক্ষু মুদিয়া ডেক-চেয়ারে পড়িয়া রহিলেন।

বিমলবাবুও হস্তস্থিত সংবাদপত্রে মনোনিবেশ করিলেন।

সন্ধ্যা ঘনাইয়া উঠিতেছিল, সংবাদপত্রের অক্ষরগুলি ক্রমশঃই অস্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে। বিমলবাবু দুই একবার মুখ তুলিয়া তাকাইয়া দেখিলেন আলো জ্বালা হইয়াছে কিনা।

অর্দ্ধশায়িত ব্রজবাবু মুদ্রিত-নয়নে কি ভাবিতেছিলেন কে জানে। হঠাৎ সোজা হইয়া উঠিয়া বসিয়া ডান হাত বাড়াইয়া বিমলবাবুর একখানি হাত চাপিয়া ধরিলেন। ব্যগ্রকণ্ঠে কহিলেন, বিমলবাবু, তা হলে আপনি সত্যই বিশ্বাস করেন, বিবাহ নিয়তির অধীন নয়, মানুষের ইচ্ছার অনুগত?

বিমলবাবু অত্যন্ত বিস্মিত হইয়া বলিলেন, হাঁ, আমার নিজের বিশ্বাস তাই বটে। কিন্তু আপনি হঠাৎ এ নিয়ে এত চঞ্চল হয়ে উঠলেন কেন ব্রজবাবু?

বলচি। কিন্তু তার আগে আপনি কথা দিন আমার অনুরোধ রক্ষা করবেন? না—না, অনুরোধ নয় প্রার্থনা, এ আমার ভিক্ষা। ব্রজবাবু ব্যাকুল হইয়া বিমলবাবুর ছুটি হাত চাপিয়া ধরিলেন।

অতিমাত্রায় বিপন্ন হইয়া বিমলবাবু বলিলেন, আপনি কি বলচেন? আমি আপনার ছোট ভাইয়ের মতো। যে-আদেশ যখনি করবেন পালন করবো। এমন অনুচিত কথা উচ্চারণ করে আমাকে অপরাধী করবেন না।

না না, কথাটা শুনলে আপনি বুঝতে পারবেন এ আমার অনুরোধ নয়, একান্তু প্রার্থনাই। বলুন আমার মিনতি রাখবেন?

সাধ্যের মধ্যে হলে নিশ্চয়ই রাখবো। বিমলবাবু কথাটা বিশেষ উৎকণ্ঠিত হইয়াই বলিলেন।

অশ্রুপূর্ণলোচনে ব্রজবাবু বলিলেন, গোবিন্দ আপনার মঙ্গল করবেন। আমার জন্ম-দুঃখিনী মেয়েটার ভার আপনি নিন বিমলবাবু! ওকে আপনার হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাই।

বিমলবাবু স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করেন নাই, ব্রজবিহারী বাবু তাঁহাকে বিবাহের পাত্ররূপে নিজ কন্যার জন্য নির্ব্বাচন করিতে পারেন। ক্ষণকাল নিৰ্ব্বাক থাকিয়া বলিলেন, আপনি আগে একটু সুস্থ হয়ে উঠুন ব্রজবাবু, ও-সব আলোচনা পরে হবে।

ব্ৰজবাবু সকাতরে বলিতে লাগিলেন, আপনি উদার প্রকৃতির, মন আপনার উন্নত। অন্য কারু কাছেই আমি ভরসা করে এ প্রস্তাব করতে পারতাম না। আমার জীবনের দুঃখ-দুর্দ্দশার কাহিনী আপনি সমস্তই জানেন। দেবতার নির্ম্মাল্যের মতোই মেয়ে আমার নিষ্পাপ। তার গুণের সীমা নেই, রূপও নিতান্ত অবজ্ঞার নয়। অথচ এমন মেয়েরও ভাগ্যে বিধাতা এত দুঃখ লিখেছিলেন! আপনি হয়তো জানেন না, রেণুর বিবাহ হওয়াই এখন দুর্ঘট। আমার না আছে আজ অর্থবল, না আছে লোকবল, না আছে কুলের গৌরব। ওর বিবাহের আশা-ভরসাই নেই।

অতিশয় আশায় আগ্রহান্বিত হইয়া ব্রজবিহারীবাবু এতক্ষণ কথা কহিতেছিলেন, কিন্তু বিমলবাবু নতমুখে নিরুত্তরে বসিয়া আছেন দেখিয়া অকস্মাৎ তিনি ভগ্নোৎসাহে চক্ষু মুদিয়া আরাম-কেদারায় এলাইয়া পড়িলেন। অল্পক্ষণ পরে যুক্তকর ললাটে ঠেকাইয়া নিরুপায়ের মতো বলিলেন, গোবিন্দ তোমারই ইচ্ছা পূর্ণ হোক!

সারদা বারন্দায় লণ্ঠন লইয়া আসিল।

বিমলবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, মা, রাজু কি বাড়ি আছে?

সারদা বলিল, না, একটু আগে ডাক্তারখানায় গিয়েচেন। এখুনি ফিরবেন। ব্রজবাবুর দিকে চাহিয়া বলিল, কাকাবাবু, আপনার কমলালেবুর রস আনবো কি?

ব্রজবাবু ইশারায় হাত নাড়িয়া মানা করিলেন।

বিমলবাবু বলিলেন, না কেন দাদা, আপনার কমলার রস খাওয়ার সময় হয়েচে যে নিয়ে আসবে বৈকি। আনো সারদা-মা।

ব্রজবাবু আর নিষেধ করিলেন না। মুদ্রিত-চক্ষে নির্জ্জীবভাবে পড়িয়া রহিলেন। লণ্ঠনের মৃদু আলোকে বিমলবাবু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করিলেন, অসুস্থ ব্রজবাবুর রক্তহীন মুখমণ্ডল পাংশু বিবর্ণ। মুদিত চক্ষুর দুই কোণে দুই বিন্দু অতি ক্ষুদ্র অশ্রুকণা ফুটিয়া উঠিয়াছে।

প্রাণাধিকা কন্যার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কতখানি গভীর হতাশার গোপন বেদনায় ঐ পরমসহিষ্ণু মানুষটির নেত্রকোণে আজ অশ্রুকণা নিঃসৃত হইয়াছে, বিমলবাবুর বুঝিতে বাকী রহিল না। নিরুপায় বেদনায় তাঁহার সমস্ত অন্তর ব্যথিত হইয়া উঠিল। নীরবে বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন, সান্ত্বনা দিবার উপায় বা ভাষা কিছুই পাইলেন না।

গোবিন্দজীর আরতির কাঁসর-ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল। রেণু নিজে উপস্থিত থাকিয়া পূজারী ব্রাহ্মণের সাহায্যে আরতি করাইতেছে। ব্রজবাবু আরাম-কেদারায় সোজা হইয়া উঠিয়া বসিলেন। যতক্ষণ ঘণ্টা-কাঁসর নিস্তব্ধ না হইল, ললাটে যুক্ত করে ঠেকাইয়া নতশিরে প্রণামরত রহিলেন। ধুপ, ধুনা, চন্দনকাষ্ঠচূর্ণ ও গুস্‌গুলের ধুমসৌরভে শীতল সন্ধ্যার মৃদুবায় সুরভিত হইয়া উঠিয়াছিল। কাঁসর-ঘণ্টা নিঃশব্দ হইলে তাহার পরও ব্রজবাবু অনেকক্ষণ একইভাবে উদ্দিষ্ট ইষ্টদেবতাকে মনে মনে বন্দনা করিয়া পরে চেয়ারের উপর আবার লম্বা হইয়া শুইয়া পড়িলেন।

রেণু আসিয়া তাঁহাকে গোবিন্দের চরণামৃত ও কমলার রস পান করাইল। একটু পরে রাখাল আসিয়া বিমলবাবুর সাহায্যে ব্রজবাবুকে ঘরের মধ্যে লইয়া গেল। দুইজন মানুষের কাঁধে দুই হাতে অপটু শরীরের ভার রাখিয়া অতি-কষ্টে ব্রজবাবু অল্প হাঁটিতে পারেন। এখনও সমস্ত অঙ্গে স্বাভাবিক জোর ফিরিয়া পান নাই।

আহারাদির পর রাত্রে বিমলবাবু কোনও এক সময়ে ব্রজবাবুর শয্যাপার্শ্বে আসিয়া বসিলেন। ব্রজবাবুর রোগশীর্ণ শিথিল হাতখানি নিজ মুঠায় তুলিয়া লইয়া বিমলবাবু চুপি চুপি কহিলেন, আপনি সন্ধ্যাবেলায় যে প্রস্তাব আমাকে জানিয়েছিলেন, সে সম্বন্ধে একটু ভেবে দেখতে চাই। আপনাকে কাল আমি জানাবো।

ব্রজবাবু মাথা হেলাইয়া সায় দিলেন।

বিমলবাবু উঠিয়া গেলে ছায়াছন্ন নির্জ্জন কক্ষে শয্যাশায়ী ব্রজবাবু অস্ফুটস্বরে বারংবার তাঁহার ইষ্টদেবতা গোবিন্দের নাম উচ্চারণ করিতে লাগিলেন।

পরদিন প্রাতে বিমলবাবু যখন ব্রজবাবুর নিকটে আসিয়া বসিলেন, ব্রজবাবু লক্ষ্য করিলেন, একটি পরিতৃপ্ত আনন্দের স্নিগ্ধ দীপ্তি বিমলবাবুর মুখমণ্ডলে পরিব্যাপ্ত। সেই উজ্জ্বল মুখের পানে তাকাইয়া ব্রজবাবু মনে মনে হয়তো অনেকটাই আশান্বিত হুইয়া উঠিলেন, কিন্তু ভরসা করিয়া প্রশ্ন উত্থাপন করিতে পারিলেন না। কহিলেন, খবরের কাগজ এসেচে। রাজু পড়ে শোনাতে চাইছিল, নিষেধ করলাম। কি হবে পৃথিবী-সুদ্ধ লোকের দৈনিক বিবরণ শুনে। তার চেয়ে কোন সদ্‌গ্রন্থ শ্রবণে মনেরও শান্তি, পরলোকেরও কল্যাণ।

বিমলবাবু হাসিলেন। বলিলেন, কোন্ বই শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে বলুন, পড়ে শোনাই।

চৈতন্যচরিতামৃত পড়বেন?

বিমলবাবু বলিলেন, বৈষ্ণব ধর্ম্মশাস্ত্রের মধ্যে ঐ একখানা আশ্চৰ্য্য পুঁথি।

পড়েচেন আপনি? ব্রজবাবুর কণ্ঠে বিস্ময় ও আনন্দ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল।

অল্প-স্বল্প নেড়েচি মাত্র। পড়া হয়েচে ঠিক বলা চলে না।

সে তো নয়ই। চৈতন্যচরিতামৃত যে মানুষ পাঠ করতে পেরেচে অর্থাৎ এর অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেচে, সে তো গোবিন্দ-পাদপদ্মে পৌঁছে গিয়েচে।

বিমলবাবু বলিলেন, এখানে চৈতন্যচরিতামৃত আছে কি?

হাঁ আছে। রেণুকে আমি ভাগবত আর চরিতামৃত সঙ্গে আনতে বলেছিলাম। রেণু নিজেও পুঁথিখানি পড়তে ভালবাসে কি-না।

তাই নাকি? মেয়েকেও তা হলে আপনি ভগবৎ-প্রেমামৃতের আস্বাদন দান করেচেন বলুন?

জিভ কাটিয়া যুক্ত-কর ললাটে ঠেকাইয়া উদ্দেশ্য দেবতাকে প্রণাম করিয়া ব্রজবাবু বলিলেন, ছি, ছি, এমন কথা মুখে আনতে নেই। ওতে আমার অপরাধ হবে। গোবিন্দ-প্রেমের আস্বাদ সে কি মানুষ মানুষকে দিতে পারে বিমলবাবু? জ্ঞান, বুদ্ধি, মেধা সবই সেখানে তুচ্ছ অর্থহীন। কেবল তিনি যাকে নিজে কৃপা করেন, সেই ভাগ্যবানই সংসারে তাঁর প্রেমের দুর্লভ আস্বাদন-লাভে ধন্য হয়।

বিমলবাবু নীরব রহিলেন।

ব্রজবাবু বলিতে লাগিলেন, এই যে কাল সন্ধ্যায় ঐকান্তিক আকাঙ্ক্ষায় আপনার কাছে এক প্রার্থনা জানিয়েছিলাম, আজ সকালে আর তো তার জন্য এতটুকুও আগ্রহ অনুভব করচিনে। এ কি গোবিন্দেরই করুণা নয়? নিরুদ্বেগ সরল হাসিতে ব্রজবাবুর মুখখানি কোমল হইয়া উঠিল।

বিমলবাবু বলিলেন, আমি কাল রাত্রে চিন্তা করে ও-বিষয়ে আমার কর্তব্য স্থির করে ফেলেচি।

ব্রজবাবুর রোগ-পাণ্ডুর মুখমণ্ডলে পরিতৃপ্তির আনন্দ-রেখা ফুটিয়া উঠিল। বলিলেন, আমি জানি তোমাকে উপলক্ষ্য করে গোবিন্দ আমায় ভারমুক্ত করবেন।

বিমলবাবু বলিলেন, কি করে টের পেলেন বলুন তো—কথা কয়টি স্নিগ্ধকৌতুকে সমুজ্জ্বল।

ব্ৰজবাবু মাথা নাড়িতে নাড়িতে বলিলেন, গোবিন্দই যে তাঁর অধম সেবকের সকল ভাবনা নিরাকরণ করেন। তোমাকে পাঠিয়েচেন তিনি আমার কাছে সেই জন্যই। ব্রজবাবুর মুখে অপরিসীম বিশ্বাস ও ভক্তির পবিত্ৰ আভা।

বিমলবাবু চুপ করিয়া রহিলেন।

সংসারে বহুবিধ দুঃখে নিপীড়িত এই রোগাতুর বৃদ্ধের সরল চিত্তের পরিতৃপ্তির প্রফুল্লতাটুকু নষ্ট করিয়া দিতে তাঁহার মন সরিতেছিল না, অথচ কথাটা এখানে না বলিলেও নয়। বৃদ্ধের ভ্রান্ত ধারণা সত্বর দূর করিতে না পারিলে জটিলতা-বৃদ্ধির সম্ভাবনা!

বিমলবাবু বলিলেন, আমি কাল বিশেষভাবে চিন্তা করে দেখেচি আপনার প্রস্তাব সম্বন্ধে। সকল দিক বিবেচনা করে রেণুকে গ্রহণ করাই স্থির করেছি। কিন্তু এ-সম্বন্ধে একটু কথা আছে। আপনি প্রতিশ্রুতি দিন, আমি যা চাইবো আপনি দেবেন?

ব্রজবাবু বিমুঢ়-নেত্রে বিমলবাবুর মুখের পরে চাহিয়া থাকিয়া অস্ফুট-কণ্ঠে কহিলেন, বলুন—

বিমলবাবু বলিলেন, আপনি আমাকে আপনার কন্যা দান করতে চেয়েচেন। আমি তাঁকে স্বেচ্ছায় ও সানন্দে গ্রহণ করতে চাই। যাগ-যজ্ঞ মন্ত্রোচ্চারণ করে ধর্ম্মতঃ সমাজতঃ আইনতঃ পত্নীরূপে গ্রহণ করলে সে আমার গোত্র ও উপাধি নিয়ে আমাদের বংশের অন্তর্ভুক্ত হ’তো। আমার সম্পত্তিতে তার অধিকার বর্ত্তাতো, আমার মরণে তাকে অশৌচ স্পর্শ করতো। আমি যাগ-যজ্ঞে মন্ত্রোচারণ করেই ধর্ম্মতঃ সমাজতঃ ও আইনতঃ তাকে আমার দত্তক কন্যারূপে গ্রহণ করতে চাই। তাতেও সে আমার গোত্রে অধিকার পাবে, আমার সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হয়ে আমার মরণে অশৌচ পালন করবে।

ব্রজবাবু নির্ব্বোধ চাহনিতে বিমলবাবুর দিকে তাকাইয়া রহিলেন, কথা কহিতে পারিলেন না।

বিমলবাবু বলিতে লাগিলেন, রেণু আপনার কত স্নেহের সামগ্রী আমি জানি। আমারও সে কম স্নেহের নয়। ওকে সস্তানরূপেই গ্রহণ করতে আমি প্রস্তুত হয়েছি।

একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বিমলবাবু বলিলেন, বিবাহযোগ্য সৎপাত্র কেউ আমার বংশে থাকলে, তাকে আমার সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী করে রেণুকে আমি পুত্রবধূরূপে নিয়ে যেতাম। কিন্তু সে-রকম আপন-জন কেউ নেই আমার। দূর সম্পর্কে যারা আছে, তারা আমার রেণুমার উপযুক্ত পাত্র নয়। কাজে কাজেই আমি স্থির করেচি সোজাসুজি ওকে আমার দত্তক কন্যারূপে গ্রহণ করবো। রেণু-মাকে উপযুক্ত সৎপাত্রে দান করার ভার এবং ওর ভবিষ্যৎ-সম্বন্ধে ভাবনার দায়িত্ব সমস্ত আমি তুলে নিলাম—আপনার আর নয়।

ব্রজবাবু দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া চক্ষু মুদ্রিত করিলেন, জবাব দিলেন না। তাঁহার মুখমণ্ডলে ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনও রেখাই ফুটিয়া উঠিল না, যেমন নিৰ্ব্বাক ছিলেন তেমনই রহিলেন।

 

দুপুরবেলার রাখাল বিমলবাবুকে একটু অন্তরালে ডাকিয়া লইয়া গিয়া অতিশয় গম্ভীর-মুখে বলিল, আপনার সঙ্গে একটু পরামর্শ আছে।

বিমলবাবু জিজ্ঞাসু-দৃষ্টিতে তাকাইলে রাখাল বুক পকেট হইতে ডাকঘরের মোহরাঙ্কিত একখানি পোস্টকার্ড বাহির করিয়া বলিল, পড়ে দেখুন।

বিমলবাবু কার্ডখানি হাতে লইয়া একবার চোখ বুলাইয়া নাম-সহি লক্ষ্য করিলেন— ‘মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী শ্রীহেমন্তকুমার মৈত্র’। বলিলেন, ইনি কে রাজু? চিনতে পারলাম না তো!

কাকাবাবুর এ-পক্ষের শ্যালক। আমাদের শকুনী-মামা। নাম শোনেননি কি?

ওঃ, ইনিই ব্রজবাবুর কারবারের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন না?

হাঁ। শুধু কারবারের কেন, বিষয়-আশয়ের, ঘর-সংসারের, স্ত্রী-কন্যার সব ভারই তিনি স্বেচ্চায় কাঁধে তুলে নিয়ে কাকাবাবুকে নির্ঝঞ্ঝাটে গোবিন্দজীর পায়ে সমর্পণ করেছিলেন।

নিঃশব্দে নতনয়নে পোস্টকার্ডধানি পাঠ করিয়া বিমলবাবু চক্ষু তুলিয়া রাখালের মুখের পানে তাকাইলেন।

রাখাল বলিল, বলুন দেখি, এ চিঠি এখন কাকাবাবুর হাতে দেওয়া উচিত কি না?

বিমলবাবু নিরুত্তরে চিন্তা করিতে লাগিলেন।

রাখাল পুনশ্চ কহিল, কাকাবাবুর কাছে এ সংবাদ গোপন রাখাও তো আমাদের পক্ষে অনুচিত হবে।

বিমলবাবু বলিলেন, তা তো হবেই।

তারপর একমুহূর্ত্ত চিন্তা করিয়া কহিলেন, এ চিঠি ওঁর হাতে দিয়ে কাজ নেই, পড়ে শোনালেই চলবে। কারণ, চিঠির কতকটা অংশে অনাবশ্যক কটু কথা আছে। ওঁকে সেটা না শোনালেই ভাল হয়।

নিশ্চয়। কোন্ অংশ বাদ দিয়ে কতটুকু এঁকে শোনানো যেতে পারে বলুন তো?

এই যে লিখেচেন, “যে কলঙ্কিত বংশে রাণী জন্মগ্রহণ করিয়াছে, তাহার কলুষের লজ্জা তো তাহাকে চিরদিন বহন করিতে হইবেই জানি। আমার আশঙ্কা হয়, আপনার অপরাধ ও মহাপাপের শান্তি শেষ পর্য্যন্ত আমার নিরপরাধ ভাগিনেয়ীকে স্পর্শ না করে। সেজন্যই তাহাকে যথাসম্ভব সত্বর সৎপাত্রস্থ করিবার ব্যবস্থা করিয়াছি। আপনাকে সংবাদ দিবার প্রবৃত্তি ছিল না, কিন্তু লোকতঃ ও ধর্ম্মতঃ ইত্যাদি।” এ-সব অংশ ওঁকে শোনাবার দরকার নেই।

রাখাল কহিল, রাণীর বিবাহ স্থির হয়ে গেল তার পিতার ইচ্ছা-অনিচ্ছা সম্মতি ও অসম্মতির অপেক্ষা না করেই। আশ্চর্য্য! সংসারে এমন দেখেচেন কি বিমলবাবু?

বিমলবাবু একটু হাসিলেন মাত্র।

রাখাল আবার পড়িতে লাগিল—“অদ্য নির্ব্বিঘ্নে শুভ-গাত্র হরিদ্রা সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। আগামী কল্য গোধূলি লগ্নে শুভ-বিবাহ।” ব্যাস্, এইটুকুমাত্র লিখেচে। কোথায় বিবাহ হচ্চে, পাত্র কেমন, কোন সংবাদই দেয়নি। আক্কেল-বিবেচনা দেখলেন?

বিমলবাবু চুপ করিয়া রহিলেন।

রাখাল বলিল, বড় মেয়ে অবিবাহিতা রইলো, অথচ ছোট মেয়ের ঘটা করে বিয়ে।

বিমলবাবু শান্ত কণ্ঠে কহিলেন, সংসারে এই-ই নিয়ম রাজু। কোনো কিছুই কারো জন্য অপেক্ষা করে থাকে না।

কাকাবাবু ওদের সৰ্ব্বস্ব দিয়ে আজ কপর্দ্দক-শূন্য বলেই এতটা বেশী বাড়াবাড়ি সম্ভব হ’লো, নইলে হতে পারতো না।

উদাস-কণ্ঠে বিমলবাবু বলিলেন, এটাও হয়তো সংসারেরই সহজ নিয়ম।

পত্রখানি পাওয়া অবধি রাখালের অন্তরের মধ্যে জ্বালা করিতেছিল। তিক্তকণ্ঠে কহিল, সংসারের নিয়ম বলে সব কিছুই সহ্য করা যায় না বিমলবাবু।

বিমলবাবু হাসিয়া বলিলেন, কিন্তু সহ্য না করেও তো উপায় নেই রাজু!