সতের

ব্রজবাবুর আপন ভাইপো এবং খুড়তুতো ছোট ভাই নবীনবাবু, যাঁহারা এই দীর্ঘ বারো-তেরো বৎসর দেশের বাড়ি-ঘর নিশ্চিন্ত হইয়া ভোগদখল করিতেছিলেন, এতদিন পরে সকন্যা ব্রজবাবুর দেশে প্রত্যাবর্ত্তন আদৌ প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করিতে পারেন নাই।

গ্রামে ব্রজবাবুর নিজের দোতলা কোঠাবাড়ি, বাগান, পুকুর, জমিজমা সপরিবারে তাহারাই এতদিন অধিকার করিয়া বসবাস করিতেছিলেন। যিনি প্রধান সরিক, বলিতে গেলে প্রকৃত মালিক আজ হঠাৎ স্বয়ং আসিয়া উপস্থিত, সুতরাং বিচলিত হইবার কথা। কিন্তু তবুও ব্রজবাবুর ভাইপোরা ও খুড়তুতো ভাই নবীনবাবু ব্রজবাবুর দেশে আসার প্রতিবাদ করিতে ভরসা করেন নাই। কারণ, মাত্র কয়েক মাস পূৰ্ব্বে এই ব্রজবাবুই তাঁহাদের একখানি মূল্যবান তালুক লেখাপড়া করিয়া দান করিয়াছেন, যাহার আয় বার্ষিক প্রায় হাজার টাকার কাছাকাছি। কিন্তু তাই বলিয়া তাহারা নিজেদের সংসারে বাসগৃহের অন্তঃপুরে তো ব্রজবাবু ও রেণুকে স্থান দিতে পারবে না। সে কারণে অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া যুক্তি-পরামর্শ করিয়া ব্রজবাবুকে তাঁহার বাড়ির সদর অংশ ছাড়িয়া দিয়াছিলেন।

সদরবাড়ি একতালা কোঠা। দুইখানি বড় বড় ঘর। ঘরের কোলে ভিতর দিকে দর-দালান, বাহিরের দিকে খোলা রোয়াক। দালানের দুই প্রান্তে দুইখানি ছোট ঘর। একখানি চাকরদের তামাক সাজিবার, অন্যখানি আলোবাতি রাখিবার ফরাস-ঘর। এই সদরবাটী।

ঘরগুলি ঝাঁটপাট দিয়া ধোয়াইয়া, খান-দুই তক্তপোষ পাতাইয়া মাটির নূতন কলসীতে পানীয় জল তুলাইয়া রাখিয়া কর্ত্তব্যনিষ্ঠ ভ্রাতুষ্পুত্রগণ তালুকদাতা খুড়ার প্রতি কৰ্ত্তব্য সম্পাদন করিয়াছিলেন।

গ্রামে আসিয়া পৌঁছিলে ব্রজবাবু ও রেণুর সেদিন একবেলার আহারাদির ব্যবস্থাও আসিয়া তাঁহাদের নিকট হইয়াছিল; কিন্তু তাহা বাটীর মধ্যে হয় নাই। খাদ্যসামগ্ৰী বহিৰ্বাটীতে পৌঁছিয়া দেওয়া হইয়াছিল।

ব্রজবাবু বিশেষ লক্ষ্য না করিলেও এ ব্যবস্থার অর্থ বুঝিয়া লইতে বুদ্ধিমতি রেণুর বিলম্ব হয় নাই। কিন্তু সে আজন্মকালই স্বল্পবাক্ ও সহিষ্ণু-প্রকৃতির মেয়ে। কোনও ব্যাপারে মনে আঘাত কিংবা অপমান বোধ করিলেও তাহা লইয়া চঞ্চলতা প্রকাশ করা তাহার প্রকৃতিবিরুদ্ধ।

খুড়া দেশের বাড়িতে পদার্পণ করিবামাত্র ভ্রাতুষ্পুত্রগণ প্রণাম ও কুশল-প্রশ্নাদির পর প্রথমেই জানিতে চাহিলেন, কি কারণে তিনি এতদিন পরে বাড়িতে ফিরিয়াছেন? কথাবার্ত্তার পর যখন জানা গেল যে, বিশিষ্ট ধনী খুড়া ব্রজবাবু আজ সৰ্ব্বস্বান্ত গৃহহীন হইয়া অনুঢ়া বয়স্থা কন্যাসহ গ্রামে ফিরিয়াছেন, অবশিষ্ট জীবদ্দশা এইখানেই কাটাইবার সঙ্কল্প লইয়া—তখন তাঁহারা রীতিমত ভীত হইয়া পড়িলেন। ব্রজবাবুর শরীরের যেরূপ অবস্থা, শেষ পর্য্যন্ত ঐ বয়স্থা অবিবাহিতা কন্যা তাঁহাদের স্কন্দ্বে না পড়িলে হয়। তালুক দান করিয়া অবশেষে খুড়া কি তাঁহার থুবড়া মেয়েটিরও দায়িত্বভার ভাইপোদেরই দান করিয়া যাইবেন নাকি? এমনি হইলেও বা হইত, কিন্তু কুলত্যাগিনী জননীর ঐ অনুঢ়া কন্যাকে সংসারে আশ্রয় দিয়া কে বিপদের ভাগী হইবে?

ব্রজবাবু তাঁহার গৃহদেবতা গোবিন্দজীউকে সঙ্গেই আনিয়াছিলেন। পারিবারিক ঠাকুর ঘরে গোবিন্দজীউকে লইয়া যাইতে উদ্যত হইলে কনিষ্ঠ ভ্রাতা নবীনচন্দ্র ভ্রাতুষ্পুত্রগণের মুখপাত্রস্বরূপ সম্মুখে আসিয়া জোড়-করে ব্রজবাবুকে বলিলেন, মেজদা, একটা কথা আপনাকে না জানালে নয়। মুখে আনতে যদিও বুক ফেটে যাচ্ছে, তবুও না জানিয়েও উপায় নেই। আপনি ভরসা দিলে আমরা খুলে বলতে পারি।

নির্ব্বিরোধী ব্রজবাবু ভ্রাতার এই সবিনয় ভূমিকায় চঞ্চল হইয়া উঠিলেন; বলিলেন, সে কি নবীন! ভরসা আবার দেব কি? বলো বলো, এখুনি বলে ফেলো, কি তোমাদের সুবিধা অসুবিধা হচ্ছে? তাই তো—কি মুস্কিল—তোমরা কি না শেষকালে—

ব্রজবাবু সমস্ত কথা ভাষায় ব্যক্ত করিতে না পারিলেও তীক্ষ্ণবুদ্ধি নবীনচন্দ্র এবং ভ্রাতুষ্পুত্রদল তাঁহার মনোভাব বুঝিয়া লইলেন। উৎসাহিত হইয়া নবীনচন্দ্র আরও সাড়ম্বরে অতিবিনয়-সমেত দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকা ফাঁদিলেন। বহু অবান্তর কথা এবং নিজেদের নির্দ্দোষিতার ভুরি ভুরি প্রমাণ-সহ যাহা জানাইলেন তাহার সারমর্ম্ম এই যে, ব্রজবাবু ও রেণুকে যদি নবীনবাবুরা সংসারে স্থান দেন, তাহা হইলে গ্রামে তাহাদের পতিত হইতে হইবে। গ্রাম-শুদ্ধ সকলেই জানে, এই রেণুকে তিন বৎসরের শিশু অবস্থায় ফেলিয়া রাখিয়া তাহার জননী দূরসম্পর্কের নন্দাই রমণীবাবুর সহিত প্রকাশ্যে কুলত্যাগ করিয়াছিল। আজ বারো-তোরো বৎসর পূর্ব্বের ঘটনা। গ্রামের কেহই আজও তাহা বিস্মৃত হয় নাই।

ব্রজবাবু বিবর্ণমুখে নতশিরে বসিয়া রহিলেন। তাঁহার সেই অসহায় মুখ দেখিলে অতি-বড় কঠিন হৃদয়ও ব্যথিত না হইয়া পারে না। নবীনচন্দ্রেরও হৃদয়ে আঘাত লাগিল। কিন্তু তিনিই বা কি করিতে পারেন! একমাত্র আশা ছিল, ব্রজবাবু বিশিষ্ট অর্থশালী ব্যক্তি—গ্রামে অর্থব্যয় করিতে পারিলে অনেকেরই মুখে চাপা দেওয়া যায়। কিন্তু ব্রজবাবু আজ নিঃস্ব অর্থহীন। সুতরাং বয়স্থা কন্যাকে এতকাল অনুঢ়া রাখার অপরাধ গ্রামের কেহই ক্ষমা করিবেন না—বিশেষতঃ যে কন্যার গাত্রহরিদ্রা হইয়াও বিবাহ হয় নাই, জননী যাহার কলঙ্কিনী।

নতুন-বৌ গৃহত্যাগ করিলে গ্রামের কুৎসা-আন্দোলনই যে ব্রজবাবুকে দেশের বাড়ি ছাড়িয়া গোবিন্দজীউ ও শিশুকন্যাসহ কলিকাতাবাসী করিতে বাধ্য করিয়াছিল, বাড়িতে আসিবার পূর্ব্বে এ-কথা যে তাঁহার কেন মনে পড়ে নাই ইহা ভাবিয়া ব্রজবাবু সত্যই বিস্ময়াপন্ন হইলেন।

দেশের এ অপ্রিয় আন্দোলনের সংবাদ রেণু জানিত না। জানিলে সে ব্রজবাবুকে গ্রামে আসিবার পরামর্শ দিত না; কিন্তু এ অবস্থায় এখানে থাকাও তো চলে না। এখন যাইবেনই বা কোথায়?

ব্রজবাবুর চিন্তাজালে বাধা দিয়া নবীন ও কৃতজ্ঞ ভ্রাতুষ্পুত্রগণ বারংবার দুঃখ প্রকাশ করিয়া বলিতে লাগিলেন, তাঁহারা সম্পূর্ণ নিরপরাধ। সকন্যা ব্রজবাবুকে নিজেদের মধ্যে সসম্মানে গ্রহণ করিতে একান্ত আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও উপায় নাই, ইহা তাঁহাদের দুর্ভাগ্য ভিন্ন অন্য কিছু নহে।

কুণ্ঠিত হইয়া ব্রজবাবু বলিলেন, নব, তোমরা লজ্জিত হ’য়ো না। আমি সমন্তই বুঝতে পারচি। এটা আগেই আমার বিবেচনা করা উচিত ছিল ভাই। যাই হোক, এটাও বোধ হয় গোবিন্দজীর পরীক্ষা। দেখি তাঁর ইচ্ছা আবার কোথায় নিয়ে যান।

ব্রজবাবুর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতুষ্পুত্র বলিলেন, কিন্তু মেজকাকা, সবচেয়ে ভাবনা আমাদের রেণুর বিয়ের জন্যে।

ব্রজবাবু ধীর-কণ্ঠে জবাব দিলেন, কিছু চিন্তা ক’রো না বাবা, আমি ওকে আর আমার গোবিন্দজীকে নিয়ে বৃন্দাবন যাত্রা করবে। গোবিন্দজীর রাজ্যে মায়ের অপরাধের জন্যে মেয়েকে কেউ দোষী করেন না। যে পর্য্যন্ত না যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি, এখানে এই বৈঠকখানা বাড়িতেই পৃথকভাবে থাকবো। কার কোনও অসুবিধা ঘটাবো না।

জ্ঞাতিদের কথাবার্ত্তায় বুঝা গেল, বাস্তুবাটীর ঠাকুর ঘরে গোবিন্দজীউ তাঁহার পূর্ব্ব বেদীতে অধিষ্ঠিত হওয়ার বাধা নাই, বাধা রেণুর ঠাকুর-ঘরে প্রবেশের এবং ঠাকুরের ভোগ রন্ধনের।

মুখে যাহাই বলুন না কেন, এই ঘটনায় ব্রজবাবু যথার্থই মর্ম্মাহত হইলেন। তাঁহার সমস্ত জীবনের প্রধান লক্ষ্য, পরম প্রিয়তম গোবিন্দজীউ নিজ পূজামন্দিরে প্রবেশ করিতে পারিলেন না, বৈঠকখানা-বাড়িতে পড়িয়া রহিলেন, এই ক্ষোভে ও দুঃখে ব্রজবাবু মূহ্যমান হইয়া পড়িলেন। সংসারে নানা বিপর্য্যয় এমন কি সৰ্ব্বস্বান্ত গৃহহারা অবস্থাও তাঁহার অন্তরকে এমন রিক্ত করিতে পারে নাই।

গ্রামে আসিয়া পর্য্যন্ত রেণুর মোটে অবকাশ রহিল না। গোবিন্দজীর সেবা এবং পিতার যত্ন ও শুশ্রূষা লইয়া তাহাকে সর্ব্বদা ব্যস্ত থাকিতে হয়। অন্য কোনও ব্যাপারে তাহার দৃষ্টি দিবার সময় বিরল, হয়তো ইচ্ছাও নাই।

সদরবাটীর দুইখানি ঘরের একখানি গোবিন্দজীউর জন্য, অন্যখানি পিতার জন্য সে নির্দ্দিষ্ট করিয়া লইয়াছে। পিতার শয়নগৃহেরই একপ্রান্তে একখানি সরু তক্তাপোষে নিজের শয়নের ব্যবস্থা করিয়াছে। ছোট ছোট দুখানি কক্ষের একখানি ভাঙার এবং অপরখানি রন্ধন কক্ষ হইয়াছে। উঠানের এককোণে একটুখানি জায়গা বেড়া দিয়া ঘিরিয়া রেণু স্নানের স্থান নির্দ্দিষ্ট করিয়া লইয়াছে।

ব্রজবাবু ব্যাকুলচিত্তে চিন্তা করেন– গোবিন্দ, তোমাকে তোমার আপন মন্দির থেকে বাইরে এনে অসম্মানের মধ্যে ফেলে রাখলাম শেষকালে! এ কি আমার উচিত হ’লো প্রভু? কিন্তু আমার রেণুর যে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। তাকে তোমার সেবায় বঞ্চিত করলে সে কি নিয়ে বেঁচে থাকবে? পতিতপাবন, তুমিও কি অবশেষে আমাদের সাথে পতিত সেজে রইলে?

সন্ধ্যারতির ক্ষণে আরতি করিতে করিতে ব্রজবাবু আত্ম-বিস্মৃত হইয়া পড়েন, এই ধরণের ভাবনায়। দক্ষিণ হাতের পঞ্চপ্রদীপ, বাম হাতের ঘণ্টা নিশ্চল হইয়া যায়। গণ্ড বাহিয়া অশ্রু গড়াইয়া পড়ে, খেয়াল থাকে না।

রেণু ডাকে, বাবা—

ব্রজবাবুর চমক ভাঙ্গে। সলজ্জে ত্রস্ত-হস্তে আবার আরদ্ধ আরতিতে পুনঃপ্রবৃত্ত হন। কখনও বা সংশয়-উদ্বেল চিত্তে ভাবেন—গোবিন্দ, সন্তানস্নেহে অন্ধ হয়ে তোমার প্রতি ত্রুটি করে প্রত্যবায়ভাগী হলাম না তো প্ৰভু?

এইরূপ অত্যধিক মানসিক সংঘাতে ব্রজবাবু যখন বিপর্য্যস্ত-চিত্ত, সেই সময়ে ঘটিল এক দুর্ঘটনা। দ্বিপ্রহরে একদিন পূজার ঘর হইতে বাহির হইয়া ব্রজবাবু মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া মূর্চ্ছিতপ্রায় হইলেন। রেণু ভয়ে ও উদ্বেগে কাতর হইলেও স্বভাবগত ধীরতার সহিতই অৰ্দ্ধ-চেতন পিতাকে জিজ্ঞাসা করিল, বাবা, নবুকাকুকে কিংবা দাদাদের ডাকবো কি?

ব্রজবাবু অতিকষ্টে শুধু বলিলেন, রাজু—

রেণু সেদিনই রাখালকে আসিবার জন্য টেলিগ্রাম করিয়া দিল।

গ্রামের চিকিৎসকটি মেডিক্যাল কলেজের ষষ্ট বার্ষিকে এম. বি. ফেল। গ্রামের পশার মন্দ জমে নাই। ব্রজবাবুকে পরীক্ষা করিয়া তিনি বলিলেন, মাথায় রক্তের চাপ অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় এইরূপ হইয়াছে। সতর্কতা-সহকারে শুশ্রূষা ও চিকিৎসা হইলে এ-যাত্রা বাঁচিয়া যাইবেন। কিন্তু ভবিষ্যতে পুনরায় এইরূপ ঘটিলে জীবনের আশা অল্পই। এখন হইতে বিশেষ সাবধানতা প্রয়োজন।

রাখাল তাহার বন্ধু যোগেশের মেস্ হইতে সেদিন বাসায় ফিরিল রাত্রি প্রায় সাড়ে এগারোটায়। যোগেশ কোনও মতে রাখালকে ছাড়ে নাই, খাওয়াইয়া দিয়াছে।

দিল্লীতে কয়েকটি বিবাহযোগ্য অনুঢ়া পাত্রী রাখালকে তাহার আপত্তি সত্ত্বেও দেখানো হইয়াছিল। তাহাদেরই মধ্যে একটি পাত্রীর কাকা কলিকাতার অফিসে চাকরি করেন। দিল্লী হইতে পাত্রীর পিতার তাগিদ অনুসারে পাত্রীর খুড়া আসিয়া যোগেশকে ধরিয়াছেন। রাখাল-রাজবাবুর সহিত তাঁহার ভাইঝির বিবাহ দিয়া দিতেই হইবে। সে ভদ্ৰলোক নাকি যোগেশকে এমনভাবে অনুনয়-বিনয় করিতেছেন যে, নিজে বিবাহিত এবং অন্য জাতি না হইলে যোগেশ হয়তো এই অরক্ষণীয়াটির রক্ষণভার গ্রহণ করিয়া তাহার খুড়ার অনুনয়-বিনয়ের উৎপাত হইতে আত্মরক্ষা করিয়া ফেলিত।

পাত্রীর একখানি ফটোগ্রাফও যোগেশ রাখালকে দেখাইয়াছে। যদি চেহারা ঠিক মনে না পড়ে সেজন্য খুড়া এই ফটোখানি যোগেশের নিকট রাখিয়া গিয়াছেন।

রাখাল প্রথমে তো হাসিয়াই উড়াইয়া দিয়াছিল, কিন্তু যোগেশচন্দ্র না-ছোড় ৷ সে প্রাণপণ তর্ক ও যুক্তি দ্বারা বুঝাইতে লাগিল, যদি পাত্রীর বয়স, চেহারা, শিক্ষা, এবং তাহার পিতৃকুল-সম্বন্ধে রাখালের কোনও অপছন্দ না থাকে, তবে সে কেন বিবাহ করিবে না?

যোগেশ জানে, রাখাল বিবাহের পণ-গ্রহণ প্রথাকে অকৃত্রিম ঘৃণা করে। সংসারে রাখালের অপেক্ষা অনেক অল্প আয়ের মানুষও বিবাহ করিয়া স্ত্রী-পুত্র-কন্যা প্রতিপালন করিতেছে। স্বয়ং যোগেশচন্দ্রই তো তাহাদের অন্যতম উদাহরণ। তবে মধ্যবিত্ত বিবাহিত ব্যক্তির জীবনযাত্রাপ্রণালী বড়লোকদের অনুকরণে হয়তো চলে না, যেমন চলে তাহা অবিবাহিত অবস্থায়। বন্ধুর বিবাহে বান্ধবীর জন্মদিনে নিউ মার্কেটের ফুলের বাস্কেট উপহার, কিংবা মরক্কো-বাঁধাই মূল্যবান সংস্করণের রবীন্দ্রনাথ অথবা শেলি ব্রাউনিঙের গ্রন্থ উপহার দেওয়ার বাধা ঘটিতে পারে। বিলিতি সেলুনে আট আনার চুল ছাটার পরিবর্ত্তে দেশী নাপিতের কাছে আট পয়সার চুল ছাঁটিতে তখন হয়তো বাধ্য হইতে হয়। কিন্তু বিবাহের যোগত্যাসম্পন্ন পুরুষ যদি বিবাহোপযোগী বয়সে কেবলমাত্র দায়িত্বভার বহনের ভয়ে অথবা নিজের বিলাস ও অবাধ মুক্তির বাধা ঘটিবার আশঙ্কায় বিবাহে পরাঙ্মুখ হয়, তবে তার চেয়ে কাপুরুষ সংসারে বিরল। হিসাব করিলে দেখা যায়, বিবাহে অনুপযুক্ত ব্যক্তি বিবাহ করিয়া যতখানি অপরাধ করে তাহাদের চেয়ে বেশী দোষী এবং অশ্রদ্ধেয়—যাহারা যোগ্যতা সত্ত্বেও মুক্তির বিঘ্ন আশঙ্কায় এবং দায়িত্ব এড়াইবার জন্যই চিরকুমার থাকিতে চায়, ইত্যাদি।

রাখাল নির্ব্বিকার হাসিমুখে বন্ধুর যুক্তি এবং ভর্ৎসনা নিঃশব্দে পরিপাক করিয়া গেল। শেষে আহারাদির পর বাসায় ফিরিবার সময় যোগেশের বারংবার পীড়াপীড়ির জবাবে বলিল, আমাকে একটু ভেবে দেখতে সময় দাও ভাই!

যোগেশ উৎসাহিত হইয়া বলিল, বেশ বেশ, এ তো ভাল কথা। তা হলে কবে আন্দাজ তোমার উত্তর পাওয়া যাবে বলে দাও। আসছে পরশু? কেমন?

রাখাল হাসিয়া বলিল, এত বেশি সময় দিচ্ছো কেন? বলো না, আসচে ভোরে— যোগেশ একটু লজ্জিত হইয়া বলিল, না না, তা নয়। তবে জানো কি ওদের কন্যাদায় কি-না। একটু বেশি-রকম ব্যাকুল হয়ে রয়েচে। তোমার এই ভেবে দেখার সময়টুকু ওদের কাছে খুনী আসামীর জজের রায়ের জন্য অপেক্ষার মতই শ্বাসরোধকর প্রতীক্ষা। তাই বলছিলাম।

রাখাল বলিল, তুমি ব্যস্ত হ’য়ো না, আমি কয়েকদিনের মধ্যে তোমাকে জানিয়ে যাবো।

যোগেশকে প্রসন্ন করিয়া রাখাল তাহার মেস হইতে যখন বাহির হইল তখন রাত্রি দশটা বাজিয়া গিয়াছে। বন্ধুর সনির্ব্বন্ধ অনুরোধের কথাটাই ভাবিতে ভাবিতে রাস্তা চলিতেছিল।

বিবাহের পাত্রীটি সে দিল্লীতে নিজ-চক্ষে দেখিয়া আসিয়াছে। বয়স আঠারো-উনিশ হইবে। বেশ মোটাসোটা গোলগাল। রং ফর্সা না হইলেও কালো বলা চলে না। চেহারার স্বাস্থ্যের লাবণ্য আছে। লেখাপড়া মোটামুটি শিখিয়াছে। সুচী-শিল্প ও রক্ষনাদি গৃহকর্ম্মে সুনিপুণা বলিয়া পাত্রীর পিতা উচ্ছ্বসিত সার্টিফিকেট নিজ-মুখেই অযাচিত দাখিল করিয়াছিলেন।

মেয়েটি রাখাল ও যোগেশকে নমস্কার করিয়া অভিশয় গম্ভীর-মুখে অত্যধিক অবনত শিরে আড়ষ্ট হইয়া বসিয়াছিল। সেই মেয়েটি যদিই প্রজাপতির দুর্ব্বিপাকে তাহার পত্নী হইয়া গৃহে আসে, কেমন মানাইবে? মেয়েটির সেই অতি গম্ভীর মুখ ও উঁচু করিয়া বাধা ঢিপির মত মস্ত খোঁপা-সমেত অতি-অবনত মাথাটি মনে পড়িয়া রাখালের অকস্মাৎ অত্যন্ত হাসি আসিল।

জীবনের সর্ব্ব অবস্থায় সকল প্রকার সুখে-দুঃখে পার্শ্বে দাঁড়াইয়া হাসি-মুখে আশ্বাস দিতে পারে, আনন্দ ও তৃপ্তি পরিবেশন করিতে পারে, এমনতর ভরসা করা যাইতে পারে কি ঐ মেয়ের ‘পরে? দূর দূর!

দিল্লীতে আরও যে কয়টি পাত্রী রাখালকে দেখানো হয়েছিল তাহারাও কম-বেশী তথৈবচ। রাখালের মানসপটে চিন্তায় চিন্তায় বহু বালিকা কিশোরী তরুণীর রকমারী রূপচ্ছবি ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। কিন্তু তাহাদের মধ্যে এমন একজনকেও সে মনে করিতে পারিল না যাহার উপরে চিরদিনের মতো আপন জীবনের সুখ-দুঃখের সকল ভার তুলিয়া দিয়া নিশ্চিন্ত নির্ভরতা লাভ করা সম্ভব।

সমস্ত মুখগুলিকে আড়াল করিয়া একখানি কোমল শান্ত অথচ বুদ্ধি-দীপ্ত সুন্দর মুখ বারংবার তাহার মানসপটে ভাসিয়া উঠিতে লাগিল। অথচ বিবাহের পাত্রী নির্ব্বাচন ব্যাপারে সে-মুখ স্মরণে জাগিবার কোন অর্থই হয় না, তাহা আর যে-কেহ অপেক্ষা রাখাল নিজেই ভাল করিয়া জানে। কিন্তু সে যাহাই হউক, রাখালের প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস ও শ্রদ্ধায় সে মুখের কান্তিই অন্যবিধ; যাহা আর কাহারো সহিত তুলনা করা চলে না।

শুধু বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাই নয়, একান্ত আপনজন সুলভ নিবিড় হৃদ্যতার মাধুর্য্য সেই চক্ষুদ্বয়ের স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে, অনাবিল হাসির ভঙ্গীতে যাহা স্বতঃই ক্ষরিত হইয়া পড়িত, তাহার সহিত সংসারে আর দ্বিতীয় কাহারো কি উপমা চলে? রাখাল যে তাহারই ঐকান্তিক শ্রদ্ধা-জড়িত অকুণ্ঠ নির্ভরতা লাভ করিয়াই আজ নিজেকে বিবাহের দায়িত্ব-সম্পন্ন ব্যক্তি বলিয়া ক্ষণেকের তরেও চিন্তা করিতে সমর্থ হইয়াছে।

ভাবিতে ভাবিতে ভাবনার মূল সূত্র হারাইয়া ফেলিয়া রাখাল সারদার ভাবনাই ভাবিয়া চলিল।

সারদা সেদিন রাত্রে তাহাকে বলিয়াছিল– আপনি অনেকের অনেক করেন, আমারও করেছিলেন, তাতে ক্ষতি আপনার হয়নি। বেঁচে যদি থাকি এইটুকুই কেবল জেনে রাখতে চাই।

কিন্তু সত্যই কি তাই? রাখাল অনেকরই অনেক করে এ কথা হয়তো সত্য, সারদারও সে সামান্য কিছু উপকার বা সাহায্য করিয়াছে, কিন্তু তাহাতে রাখালের কি কোনও ক্ষতিই হয় নাই! তাহা যদি না-ই হইবে তবে কেন সে সেদিন রাত্রে এমনভাবে আত্মসংবরণে অক্ষম হইল? শুধু সারদাকেই যে রূঢ় তিরস্কার করিল তাহাই নহে, তাহার মাতৃস্বরূপিণী নতুন-মাকে পৰ্য্যন্ত দু-কথা শুনাইয়া ছিল একজন অপর ব্যক্তির সম্মুখেই।

তারককে সারদা যদি যত্ন আদর করে, তাহাতে রাখালের ক্ষুব্ধ হইবার কি আছে। সারদার নিকট রাখালও যে, তারকও সে। বরং রাখাল অপেক্ষা তারক বিদ্বান, বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ। তাহার এইসকল গুণেরই সেদিন উল্লেখ করিয়াছিল সারদা, তাহাতে এমন কি অপরাধ সে করিয়াছে যাহার জন্য রাখাল অমন জ্বলিয়া উঠিল? কেন সে অকস্মাৎ নিজেকে বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত অনুভব করিল?

ভাবিতে ভাবিতে মুখ চোখ ও কান উত্তপ্ত হইয়া জ্বালা করিতে লাগিল। নিকটস্থ একটা পার্কের মধ্যে প্রবেশ করিয়া নিরিবিলি কোণের একটি শৃঙ্গ বেঞ্চিতে রাখাল সটান শুইয়া পড়িল।

চোখ বুজিয়া ভাবিতে লাগিল, দিন দুই-তিন পূর্ব্বে এস্‌প্ল্যানেডের মোড়ে সে ট্রামের জন্য অপেক্ষা করিতেছিল। একখানি চলন্ত মোটর হইতে ঝুঁকিয়া বিমলবাবু হাত নাড়িয়া তাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিলেন। রাখাল বিমলবাবুর পানে তাকাইলে তিনি মোটর থামাইয়া হাত ইসারায় তাহাকে নিকটে ডাকিয়া গাড়ি হইতে রাস্তায় নামিয়া পড়িয়াছিলেন। রাখাল নিকটে গেলে বিমলবাবু সর্ব্বপ্রথম প্রশ্ন করেন— তোমার কাকাবাবুর ও রেণুর চিঠিপত্র পেয়েচো কি রাজু?

অতিমাত্রায় বিস্মিত হইয়া রাখাল বলিয়াছিল, কেন বলুন তো?

বিমলবাবু বলিলেন, তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। দেশে গিয়ে তাঁরা কেমন আছেন খবর পাইনি, তাই তোমাকে জিজ্ঞেসা করচি।

রাখাল জবাব দিয়াছিল, তাঁরা ভালই আছেন।

বিমলবাবু বলিয়াছিলেন, তুমি কবে চিঠি পেয়েচ?

সে উত্তর দিয়াছিল, দিন-চারেক হবে। তার পর মৌখিক সৌজন্যে বিমলবাবুকে প্রশ্ন করিয়াছিল, আপনি কোনদিকে চলেছেন?

বিমলবাবু উত্তর দিয়েছিলেন, একবার সারদা-মার খোঁজ নিতে যাচ্ছি।

ইহাতে অতিমাত্রায় বিস্ময়াপন্ন হইয়া সে অকস্মাৎ প্রশ্ন করিয়া ফেলিয়াছিল, কোন্ সারদা?

বিমলবাবু ঈষৎ আশ্চর্য্য হইয়া জবাব দিয়াছিলেন, সারদাকে তো তুমি চেনো। রাখাল শুষ্ককণ্ঠে বলিয়াছিল, সে তো এখানে নেই। নতুন-মার সঙ্গে হরিণপুরে তারকের কাছে গেছে।

বিমলবাবু বলিয়াছিলেন, সে কি! তুমি কি জানো না সারদা তোমার নতুন-মার সঙ্গে হরিণপুরে যায়নি?

রাখাল উত্তর দিয়াছিল, না! এ-খবর আমি শুনিনি।

আমি তাদের যাবার আগের দিন রাত্রি পর্য্যন্ত সারদার সেখানে যাওয়াই স্থির দেখে এসেছিলাম।

বিমলবাবু বলিয়াছিলেন, তাই স্থির ছিল বটে, কিন্তু আমি স্টেশনে গিয়ে দেখলাম সারদা আসেনি। তোমার নতুন-মা বললেন, তার যাওয়ার উপায় নেই। আমাকে বলে গেলেন, সারদা একা থাকলো, মাঝে মাঝে তার খোঁজ-খবর নিও। তাই মাঝে মাঝে তার খবর নিতে যাই।

রাখাল পুনরায় প্রশ্ন করিয়া বলিল, সারদা কেন হরিণপুরে গেল না, জানেন কি?

বিমলবাবু বলিলেন, সারদাকে জিজ্ঞাসা করে শুনলাম, মালিকের হুকুম ভিন্ন এ-বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র নড়বার তার উপায় নেই।

রাখাল বিমূঢ়ভাবে বলিয়া ফেলিল, কে মালিক?

বিমলবাবু উত্তর দিয়াছিলেন, ঠিক জানি না। হয়তো তার নিরুদ্দিষ্ট স্বামী বলেই মনে হয়।

রাখাল মুদ্রিত-চক্ষে পার্কের বেঞ্চে শুইয়া এস্‌প্ল্যানেডে বিমলবাবুর সহিত সাক্ষাৎ ও কথাবার্ত্তাগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খ চিন্তা করিতে লাগিল। সারদা হরিণপুরে নতুন-মার সহিত কেন গেল না? বলিয়াছে মালিকের হুকুম ব্যতীত তাহার অন্যত্র যাওয়ার উপায় নাই। সে মালিক কে? বিমলবাবু কিংবা আর কেউ সারদার নিরুদ্দিষ্ট স্বামী জীবনবাবুকে সেই ব্যক্তি অনুমান করুন না কেন—একমাত্র রাখাল নিজে নিশ্চিতরূপে জানে, আর যাহাকেই সারদা তাহার মালিক বলিয়া নির্দেশ করুক, পলায়িত বিশ্বাসঘাতক জীবন চক্রবর্ত্তীকে কখনই করে নাই!

বুঝিতে কিছুই তাহার বাকী রহিল না। তবুও রাখালের মনের মধ্যে কোথায় যেন কি একটা বিরোধ বাধিতে লাগিল।

এগারোটা বাজিলে পার্কের রক্ষক আসিয়া রাখালকে উঠিয়া যাইতে অনুরোধ করিল। উঠিয়া ভারাক্রান্ত মনে সে বাসায় যখন পৌঁছিল তখন সাড়ে এগারোটা বাজিয়া গিয়াছে। বিছানায় শুইয়া ঘুমাইবার পূর্ব্বে মনে মনে স্থির করিয়া ফেলিল কাল সকালে উঠিয়াই সারদার সহিত একবার সাক্ষাৎ করিয়া আসিবে। চা বাসায় খাইবে না। সারদাকেই চা তৈয়ারী করিয়া দিতে বলিবে।

এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইবার পর রাখাল মনে মনে অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিতে লাগিল। তারপর নানারূপ অসম্ভব কল্পনা করিতে করিতে ঘুমাইয়া পড়িল।