» » উপমহাদেশ

বর্ণাকার

আল মাহমুদ

উপমহাদেশ

গ্রন্থকথা

‘উপমহাদেশ’ কবি আল মাহমুদ রচিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার জীবনচিত্রকে আশ্রয় করে লেখা উপন্যাসটিকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা না গেলেও যুদ্ধের ভয়াবহতা, হিংস্রতা, যুদ্ধের মাঝে প্রেম, দেশপ্রেম সব কিছুরই প্রতিচ্ছবি সত্যনিষ্ঠ ভাবে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন লেখক। এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হিসেবেই বিবেচিত।

মুক্তিযুদ্ধের এমন একটি দিক এ উপন্যাসে উঠে এসেছে যেদিকটা নিয়ে সাধারণত আলোচনা হয় না। ইতিহাসের প্রধান স্রোতের অনালোচিত এই দিকটি তুলে ধরাই এই উপন্যাসের একমাত্র সার্থকতা।

কবি হাদী মীর। ঢাকায় পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলের লাইব্রেরিয়ান তিনি। ঢাকা যখন পুরোপুরিভাবে পাকিস্তানিদের দখলে চলে গেছে, চারিদিকে পাকিস্তানিদের অমানবিক অত্যাচার ও লুটপাটের কারণে লোকেরা ঢাকা ছেড়ে প্রথমে গ্রামে এবং গ্রামেও না টিকতে পেরে ভারতে পাড়ি দেন। সেই দলের একজন কবি সাহেব। তিনি তার স্ত্রীর থেকে বিছিন্ন হয়ে তার জন্য বেশ কিছু দিন অপেক্ষা করে থেকে ভারতে যাবার সিদ্দান্ত নেন। কবির বোন ও ভগ্নিপতি একজন মুক্তি যোদ্ধাকে দিয়ে চিঠি লিখে দিয়ে কবিকে খুব শীঘ্র ভারতে চলে যেতে বলেন। তিনি অন্য এক মুক্তিযোদ্ধার মাধ্যমে জানতে পারেন যে কবির স্ত্রী হামিদা নিরাপদে কলকাতায় পৌঁছে গেছে।

ভৈরব ও আশুগঞ্জে যখন পাক হানাদরেরা এসে অত্যচার শুরু করলে সেখানকার সকলে নবাবপুরে এসে পালিয়ে বাঁচে এবং সেখান থেকেই নৌকায় করে ভারতে যাবার জন্য রওয়া দেয়। এদেরই সাথে কবি আছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা আনিস এদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন। নৌকায় মোট ৩০জন লোক যেতে পারে কিন্তু সেখানে ৩২ জন্য ওঠার পরেও দুটি মেয়ে সীমা ও নন্দিনী এসে কান্না কাটি শুরু করে। সীমার স্বামী ঢাকায় গিয়ে আর ফিরতে পারে নি। সীমা একটা স্কুলের শিক্ষিকা। হিন্দুদের বাড়ীতে থাকাটা এখন খুব কঠিন হয়ে যাওয়াতে স্বামীর ফেরার অপেক্ষা না করে বোন নন্দিনীকে নিয়ে সে পথে বের হয়েছে। দুই বোন এসে অনেক কান্না কাটি করার পর কবি জোর করে আনিসকে বলে তাদেরও নৌকায় তুলে নেয়।

কিছু দূর যাবার পর গুলির শব্দ শুনে সবাই খুব ভয় পেয়ে যায়। পাকিস্তান টহলদারের তাদের নৌকাটা অন্ধকারে দেখতে না পারলেও অনুমান করতে পেরেছে। অনেক সাবধানে তারা একটা ঘাটে এসে নৌকা ভিড়িয়ে উপরে উঠলে চারিদিক থেকে কিছু লোক তাদের ঘিরে ধরে। সবার হাতে অস্ত্র থাকলেও তারা মুক্তি বাহিনীর লোক নয়। নকশাল বাহিনীর লোক। অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধা সাথে আছে জানলে বিপদ হতে পারে ভেবে আনিস পানিতে ডুব দিয়ে পালিয়ে চলে যায়। নন্দিনীকে স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়ে এবং কাছাকাছি কোন গ্রামে কবির পরিচিত আত্মীয়ের কথা বলে তাদের হাত থেকে বেঁচে যায় তারা।

অন্ধকারের মাঝে লাইন ধরে একজন আর একজনের কাপড় ধরে পথ চলতে চলতে সকলে একটা মাঠের কাছে এসে পৌঁছায়। কিন্তু এখানে এসে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে যায়।

সাথে যে কয়জন মহিলা ছিল তার সবাই নিম্ন শ্রেণীর কৃষক পরিবারে। এর মাঝে সীমা ও নন্দিনী সম্ভ্রান্ত পরিবারের,  তার উপর দেখতে সুন্দরী। রাজাকারদের সাথে কবির তর্কাতর্কির ফলে সবাইকে ছেড়ে দিয়ে কবি, সীমা ও নন্দিনীকে আটকে রাখে। সীমা ও নন্দিনীর পরনের শাড়ী খুলে কবিকে খুব শক্ত করে বেঁধে নির্জন গ্রামের একটি বাড়ীর ঘরে আটকে রাখে তাদের। কবির পাশের ঘরে সীমা ও নন্দিনীকে।

কবিকে অনেক শারীরিক অত্যচার সহ্য করতে হয় ফলে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। হঠাৎ করে কবির কানে ভেসে আসে কোন নারীর আর্ত চিৎকার ও গোংরানি। এটা কি সীমা ও নন্দিনীর রাজাকারদের হাত থেকে সম্মান বাঁচানোর জন্য প্রতিবাদ না কি কবির স্বপ্ন…?

মুক্তিযুদ্ধকে ভিত্তি করে রচিত হয়েছে অনেক উপন্যাস, সেগুলোর প্রতিটি নিজস্ব স্বকীয়তা উদ্ভাসিত। বিষয়বস্তু এক হলেও অনুভূতি সবসময় নতুন। লেখকের বর্ণনাতে চোখের সামনে চলে এসেছে সেই সময়টা। তবে লেখক ‘উপমহাদেশ’ উপন্যাসটিতে মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি দেশের সংখ্যালঘু রাজনৈতিক দলের আর্দশ ও উদ্দেশ্যকে সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন। একই সাথে সেই সময় তাদের অবস্থা ও সরকার পক্ষের সাথে তাদের সম্পর্কটাও।

আরও একটা নাড়া দেবার মত একটা বিষয় লেখক তুলে ধরেছেন, সেই সময়ের ভারতীয় কবি সাহিত্যিকদের মানসিক অবস্থা ও আমাদের দেশের পরিস্থিতি নিয়ে তাদের উদ্বেগ ও সহযোগিতা।

পাঠক উপন্যাসটিকে প্রশংসা যেমন করেছেন তেমনি নিন্দাও করেছেন কেউ কেউ—কৃত্রিম সংলাপ, এলোমেলো বাক্য বিন্যাস, উদ্ভট ও অন্তঃসারশূন্য কাহিনী, সর্বোপরি কাঁচা হাতে জোরপূর্বক লেখা। কারও মতে ‘বাস্তবতা বহির্ভূত একেকটা ঘটনার অবতারণা’! মাত্র কয়েকদিন আগে রাজাকারদের হাতে সারারাত ধরে নির্যাতিতা নন্দিনী কী করে হাদী মীর বা তার পরিবারের সাথে এতো স্বচ্ছন্দ মেলামেশা করে অথবা হাদী মীরের স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও কী করে তাঁর সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়াতে এত আগ্রহী হয় ‘একজন বীরাঙ্গানা’? যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন বা যারা নীলিমা ইব্রাহিমের “আমি বীরাঙ্গনা বলছি” বা শাহীন আখতারের “তালাশ” পড়েছেন, তাদের কাছে ‘উপমহাদেশে’র কাহিনী উদ্ভট এবং বাস্তবতা বহির্ভূত মনে হওয়াই স্বাভাবিক।

অপরদিকে হাদী মীর এমন একজন দুর্বল চরিত্রের মানুষ, বোন-দুলাভাইয়ের বাসায় একটা বিবাহিত মানুষ পরনারীকে নিয়ে তাদের সামনে শুয়ে থাকছে! আদব লেহাজ বলে যদি এদের কিছু থাকে! যুদ্ধের দোহাই দিয়ে কত কিছুই না দেখালেন এই বইতে আল মাহমুদ! আর শেষটায় তো দুই নারীকে নিয়ে হাদী মীরের সংসারকেও জায়েজ করে দিলেন ধর্মের দোহাই দিয়ে। হামিদা নারী মুক্তিযোদ্ধা বলে যতটা না সম্মান আদায় করে নিয়েছিল, শেষটায় এসে ওর এই ব্যাপারটা একদমই ভাল লাগল না। বইয়ের সমাপ্তির প্রয়োজনে কত কীই না করেছেন লেখক!

সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা কবি আল মাহমুদ, যুদ্ধের সময় কলিকাতাতে তাঁর কবিতা চর্চা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। এমন সমালোচনা একেবারে অমূলক নয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি বর্তমান থাকলেও যুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না। এর প্রমাণ রয়েছে ‘উপমহাদেশ’ উপন্যাসের পরতে পরতে।

গল্পে যুদ্ধের আবহ তৈরি করতে লেখক ব্যর্থ, হয়ত সেই চেষ্টাও করেননি তিনি! বইয়ের দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে রয়েছে অদ্ভুত, অবাস্তব, যুক্তিহীন এক প্রেমকাহিনী। পাশাপাশি লম্বা লম্বা অসংলগ্ন সংলাপ অপ্রাসঙ্গিক লেগেছে অনেকাংশেই। মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থী নেতাকর্মীদের অবদানের যে চিত্র আল মাহমুদ ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন সেটাও ফিকে হয়ে গেছে প্রেমকাহিনীকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে!

‘উপমহাদেশ’ থেকে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করছি—

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের সাথে নীতিগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বেশ কিছু স্বতন্ত্র দলের অংশগ্রহণের কথা আমরা জানি। বামপন্থী এরকম একটি দলের (সম্ভবত কাল্পনিক) কার্যক্রমের কথা উঠে এসেছে এই বইতে। ভারতের নকশাল পন্থীদের সাথে যোগাযোগ থেকে শুরু করে তাদের কিছু অপারেশনেরও কথা বইতে এসেছে। বিষয়টি একেবারে অনৈতিহাসিক।

বইয়ের শুরুতেই একটা জায়গায় দেখা যায় জিঘাংসা বশত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা একজন রাজাকারের কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণ করছে। এটা আসলে সম্ভব ছিল? অথবা এমন ঘটনার কল্পনা করে তিনি কি মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকারদের একই সারীতে দাঁড় করালেন?

উপন্যাসের শেষের দিকে এসে— নন্দিনী যে ক্যাম্পে ট্রেইনিং নিতে যায় ওখানেও দেখা যায় ‘মেয়ে মুক্তিযোদ্ধা মানেই পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের দেহ দান করলেই কর্তব্য শেষ’ এইরকম একটা অনাচার। এই ব্যাপারগুলো কতটুকু সত্যি বলে বিশ্বাস করা যায়? এই ঘটনার কথা ইতিপূর্বে কেউ বলেছেন বা লিখেছেন কিনা আমার জানা নেই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যে এমন ঘটনার উল্লেখ আর কোথাও আছে বলে আমাদের জানা নেই। তবে আল মাহমুদ যে খানিকটা “Devil’s Advocacy” করেছেন এদিক থেকে ব্যাপারটা ভালই লেগেছে।

এখানে লক্ষ্য করার মত আরেকটা ব্যাপার হল, ইমাম আর পারুলের পরিবারের অবস্থা—যারা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতে আশ্রয় নিয়েও দেখা যায় সরকারের বড় পদে চাকরী করার দরুন রাজার হালে দিনাতিপাত করছেন—তাদের টেবিলে রুটি-মাখন, মুরগী, কলের বিশুদ্ধ পানি এবং তাদের মেয়ে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ছে। এই ব্যাপারটা বেশ চোখে লাগে। তবে এই পরিবারটিতে সম্ভবত সেই পরিবারের ছায়া পড়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় আল মাহমুদ যে পরিবারে আশ্রয় পেয়ে বাবুগিরি করে কলকাতায় সময় কাটিয়েছিলেন—

আল মাহমুদ মূলত একজন কবি। কবি হলেও কথাসাহিত্যে পারদর্শীতা কম নয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে। তবে যতগুলো পড়েছি এই বইটা ভিন্ন মনে হয়েছে। একটা যুদ্ধ ব্যক্তিগত জীবন ও সম্পর্কে কতখানি প্রভাব ফেলে তা বোঝাতে চেয়েছেন লেখক। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিভিন্ন দলের মধ্যে আদর্শগত দ্বন্দ্ব এবং তাদের সংঘাতের যে ইঙ্গিত দিয়েছেন তা বোধকরি খুব কম ঔপন্যাসিকই লিখেছেন। তবে যে জিনিসটা অন্য কোথাও পাইনি তা হ’ল মুক্তিযোদ্ধা কর্তৃক প্রতিশোধ স্বরূপ রাজাকার পরিবারের উপর পাশবিক অত্যাচার। এমন ঘটনা যুদ্ধের সময় ঘটেছিল কিনা জানা নেই।

সৈয়দ হাদী মীরকে খুবই দূর্বল চিত্তের মানুষ মনে হয়েছে, যখন তিনি দুইটি নারীর দিকেই ঝুঁকেছেন তবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। তবে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের বেলায় সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। হামিদা বানু ও নন্দিনী ভট্টাচার্য দুইজনই স্বাধীনচেতা নারী হলেও স্বভাবে বৈপরীত্য রয়েছে। কবির ভগ্নিপতি ও ভগ্নি— তৌফিক ইমাম ও পারুলের আরাম আয়েশের জীবন যুদ্ধকালীন কলকাতায় অবস্থানরত উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গের জীবনযাপনের চিত্র হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।

‘উপমহাদেশ’ উপন্যাসটি উৎসর্গ করা হয়েছে “মিলন ইসলাম”কে।

এই উপন্যাস সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য হুবহু তুলে দিচ্ছি— “এ বইয়ের সকল চরিত্রই কাল্পনিক। তবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন কবি সাহিত্যিক, আমলা, বুদ্ধিজীবীর নাম উপন্যাসে ব্যবহৃত হয়েছে কেবল মুক্তিযুদ্ধে তাদের সম্পৃক্ততাকে সম্মানিত করতে। তারা সর্বস্ব ত্যাগ করে এই সংগ্রামে সামিল হয়েছিলেন বলেই। প্রকৃতপক্ষে উপন্যাসের কাহিনীর সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। উপন্যাস তো উপন্যাসই। —লেখক।

আমরাও কবি আল মাহমুদের ‘উপন্যাস তো উপন্যাসই’ কথাটাকে গুরুত্ব দিয়ে মেনে নিচ্ছে, ‘উপমহাদেশ’ উপন্যাসই, এতে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা বা ইতিহাসের ছিঁটেফোটা খুঁজে দেখার প্রয়োজন নেই।