বিদ্রোহী
বলবীর –
বলউন্নত মম শির!
শিরনেহারি আমার নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বলবীর –
বলমহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি,
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি,
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চিরবিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাতৃর!
মমললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বলবীর –
আমিচির-উন্নত শির!
আমিচিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!
আমিমহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
আমিদুর্বার,
আমিভেঙে করি সব চুরমার!
আমিঅনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমিদলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি নাকো কোন আইন,
আমিভরা তরি করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
আমিধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর
আমিবিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাতৃর!
বলবীর –
চির উন্নত মম শির!
আমিঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি,
আমিপথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’।
আমিনৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমিআপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
আমিহাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমিচল-চঞ্চল, ঠমকি ছমকি
পথেযেতে যেতে চকিতে চমকি’
ফিং দিয়া দিই তিন দোল;
আমিচপলা-চপল হিন্দোল।
আমিতাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা,
আমিশত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা,
আমিউন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা!
আমিমহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর;
আমিশাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর!
বলবীর –
চিরউন্নত মম শির!
আমিচির-দুরন্ত দুর্মদ,
আমিদুর্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম হ্যায় হর্দম ভরপুর মদ।
আমিহোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,
আমিযজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।
আমিসৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমিঅবসান, নিশাবসান।
আমিইন্দ্রাণী-সূত হাতে-চাঁদ ভালে-সূর্য
মমএক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর রণ-তূর্য;
আমিকৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা-বারিধীর।
আমিব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
বল বীর –
চির উন্নত মম শির!
আমিসন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক,
আমিযুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক।
আমিবেদুইন, আমি চেঙ্গিস,
আমিআপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!
আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,
আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার,
আমিপিণাকপাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড,
আমিচক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণবনাদ প্রচণ্ড!
আমিক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমিদাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব।
আমিপ্রাণ-খোলা হাসি উল্লাস, – আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস,
আমিমহা-প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস!
আমিকভু প্রশান্ত, – কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমিঅরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী!
আমিপ্রভঞ্জনের উচ্ছ্বাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল,
আমিউজ্জ্বল, আমি প্রোজ্জ্জ্বল,
আমিউচ্ছল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল-দোল!
আমিবন্ধন-হারা কুমারীর বেণু, তন্বী-নয়নে বহ্ণি
আমিষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!
আমিউন্মন মন উদাসীর,
আমিবিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর।
আমিবঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,
আমিঅবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ – জ্বালা, প্রিয় লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের
আমিঅভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,
চিতচুম্বন-চোর-কম্পন আমি থরথরথর প্রথম পরশ কুমারীর!
আমিগোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল-করে দেখা অনুখন,
আমিচপল মেয়ের ভালোবাসা, তার কাঁকন-চুড়ির কনকন!
আমিচির-শিশু, চির-কিশোর,
আমিযৌবন-ভিতু পল্লিবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর!
আমিউত্তরী-বায়ু মলয়-অনিল উদাস পুরবি হাওয়া
আমিপথিক কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া।
আমিআকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি
আমিমরু-নির্ঝর ঝরঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়াছবি!
আমিতুরীয়ানন্দে ছুটে চলি, এ কি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!
আমিসহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!
আমিউত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন,
আমিবিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন।
ছুটিঝড়ের মতন করতালি দিয়া
স্বর্গ মর্ত্য করতলে,
তাজিবোররাক১ আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার
হিম্মৎ-হ্রেষা হেঁকে চলে!
আমিবসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি, কালানল,
আমিপাতালে মাতাল অগ্নি-পাথার-কলরোল-কল-কোলাহল!
আমিতড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া দিয়া লম্ফ,
আমিত্রাস-সঞ্চারি ভুবনে সহসা সঞ্চারি ভূমিকম্প।
ধরিবাসুকির ফণা জাপটি, –
ধরিস্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি!
আমিদেব-শিশু, আমি চঞ্চল,
আমিধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্বমায়ের অঞ্চল!
আমিঅর্ফিয়াসের বাঁশরি,
মহা-সিন্ধু উতলা ঘুম ঘুম
ঘুমচুমু দিয়ে করে নিখিল বিশ্বে নিঝঝুম
মমবাঁশরীর তানে পাশরি।
আমিশ্যামের হাতের বাঁশরি।
আমিরুষে উঠি যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়েসপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ২ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমিবিদ্রোহবাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!
আমিশ্রাবণ-প্লাবন বন্যা,
কভুধরণিরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা।
আমিছিনিয়া আনিব বিষ্ণুবক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমিঅন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমিধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী!
আমিছিন্নমস্তা চণ্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমিজাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!
আমিমৃন্ময়, আমি চিন্ময়,
আমিঅজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়।
আমিমানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,
জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমিতাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি এ স্বর্গ-পাতাল-মর্ত্য!
আমিউন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমিচিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!
আমিউত্তাল, আমি তুঙ্গ ভয়াল মহাকাল,
আমিবিবসন আজ ধরাতল নভ ছেয়েছে আমারই জটাজাল!
আমিধন্য! আমি ধন্য!
আমিমুক্ত, আমি সত্য, আমি বীর বিদ্রোহী সৈন্য,
আমিধন্য! আমি ধন্য!!
আমিপরশুরামের কঠোর কুঠার
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!
আমিহল বলরাম-স্কন্ধে
আমিউপাড়ি’ ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।
মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমিসেই দিন হব শান্ত,
যবেউত্পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না –
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না –
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমিসেই দিন হব শান্ত।
আমিবিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমিস্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমিবিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমিখেয়ালী-বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমিচির-বিদ্রোহী বীর –
আমিবিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!