উমর ফারুক
তিমির রাত্রি –‘এশা’র আজান শুনি দূর মসজিদে,
প্রিয়হারা কার কান্নার মত এ-বুকে আসিয়া বিঁধে!
আমির-উল-মুমেনীন,
তোমার স্মৃতি যে আজানের ধ্বনি–জানে না মুয়াজ্জিন!
তকবির শুনি শয্যা ছাড়িয়া চকিতে উঠিয়া বসি,
বাতায়নে চাই–উঠিয়াছে কি রে গগনে মরুর শশী?
ও-আজান ও কি পাপিয়ার ডাক, ও কি চকোরীর গান?
মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ও কি ও তোমারই সে আহ্বান?
আবার লুটায়ে পড়ি!
‘সেদিন গিয়াছে’–শিয়রের কাছে কহিছে কালের ঘড়ি!
উমর! ফারুক! আখেরী নবীর ওগো দক্ষিণ-বাহু!
আহ্বান নয়–রূপ ধরে এসো!–গ্রাসে অন্ধতা-রাহু
ইসলাম-রবি, জ্যোতি আজ তার দিনে দিনে বিমলিন!
সত্যের আলো নিভিয়া–জ্বলিছে জোনাকির আলো ক্ষীণ!
শুধু অঙ্গুলি-হেলনে শাসন করিতে এ জগতের
দিয়াছিলে ফেলি মুহম্মদের চরণে যে-শমশের,
ফিরদৌস ছাড়ি নেমে এস তুমি সেই শমশের ধরি,
আর একবার লোহিত-সাগরে লালে লাল হয়ে মরি!
নওশার বেশে সাজাও বন্ধু মোদের পুনর্বার
খুনের সেহেরা পরাইয়া দাও হাতে বাঁধি হাতিয়ার!
দেখাইয়া দাও–মৃত্যু যথায় রাঙা দুলহিন-সাজে
করে প্রতীক্ষা আমাদের তরে রাঙা রণ-ভূমি মাঝে!
মোদের ললাট-রক্তে রাঙিবে রিক্ত সিঁথি তাহার,
দুলাব তাহার গলায় মোদের লোহু-রাঙা তরবার!
সেনানী! চাই হুকুম!
সাত সমুদ্র তের নদী পারে মৃত্যু-বধূর ঘুম
টুটিয়াছে ঐ যক্ষ-কারায় সহে না ক’ আর দেরি,
নকিব কণ্ঠে শুনিব কখন নব অভিযান ভেরি!…
নাই তুমি নাই, তাই সয়ে যায় জমানার অভিশাপ,
তোমার তখ্তে বসিয়া করিছে শয়তান ইনসাফ!
মোরা ‘আসহাব-কাহাফে’র মত দিবানিশি দিই ঘুম,
‘এশা’র আজান কেঁদে যায় শুধু–নিঃঝুম নিঃঝুম!
কত কথা মনে জাগে,
চড়ি কল্পনা-বোর্রাকে যাই তের শ’ বছর আগে
যেদিন তোমার প্রথম উদয় রাঙা মরু-ভাস্কর,
আরব যেদিন হল আরাস্তা, মরীচিকা সুন্দর।
গোষ্ঠে বসিয়া বালক রাখাল মুহম্মদ সেদিন
বারে বারে কেন হয়েছে উতলা! কোথা বেহেশ্তি বীণ
বাজিতেছে যেন! কে যেন আসিয়া দাঁড়িয়েছে তাঁর পিছে,
বন্ধু বলিয়া গলা জড়াইয়া কে যেন সম্ভাষিছে!
মানসে ভাসিছে ছবি–
হয়ত সেদিন বাজাইয়া বেণু মোদের বালক নবী
অকারণ সুখে নাচিয়া ফিরেছে মেষ-চারণের মাঠে!
খেলায়েছে খেলা বাজাইয়া বাঁশি মক্কার মরু বাটে!
খাইয়াছে চুমু দুম্বা-শিশুরে জড়াইয়া ধরি বুকে,
উড়ায়ে দিয়েছে কবুতরগুলি আকাশে অজানা সুখে!
সূর্য যেন গো দেখিয়াছে–তার পিছনে অমারাতি
রৌশন-রাঙা করিছে কে যেন জ্বালায়ে চাঁদের বাতি।
উঠেছিল রবি আমাদের নবী, সে মহা-সৌরলোকে,
উমর, একাকী তুমি পেয়েছিলে সে আলো তোমার চোখে!
কে বুঝিবে লীলা-রসিকের খেলা! বুঝি ইঙ্গিতে তার
বেহেশ্ত-সাথী খেলিতে আসিলে ধারার পুনর্বার।
তোমার রাখাল-দোস্তের মেষ চরিত সুদূর গোঠে,
হেথা ‘আজ্নান’-ময়দানে তব পরাণ ব্যথিয়া ওঠে!
কেন কার তরে এ প্রাণ-পোড়ানি নিজেই জান না বুঝি,
তোমার মাঠের উটেরা হারায়, তুমি তা দেখ না খুঁজি!
ইহারই মাঝে বা হয়ত কখন দুঁহুঁ দোঁহা দেখেছিলে,
খেজুর-মেতির গল-হার যেন বদল করিয়া নিলে,
হইলে বন্ধু মেষ-চারণের ময়দানে নিরালয়,
চকিত দেখায় চিনিল হৃদয় চির-চেনা আপনায়!
খেলার প্রভাত কাটিল কখন, ক্রমে বেলা বেড়ে চলে,
প্রভাতের মালা শুকায়ে ঝরিল খর মরু বালুতলে।
দীপ্ত জীবন-মধ্যাহ্নের রৌদ্র-তপ্ত পথে
প্রভাতের সখা শত্রুর বেশে আসিল রক্ত-রথে।
আরবে সেদিন ডাকিয়াছে বান, সেদিন ভূবন জুড়ি,
‘হেরা’-গুহা হতে ঠিকরিয়া ছুটি মহাজ্যোতি বিচ্ছুরি!
প্রতীক্ষমাণ তাপসী ধরণী সেদিন শুদ্ধস্নাতা
উদাত্ত স্বরে গাহিতেছিল গো কোরাণের সাম-গাথা!
পাষাণের তলে ছিল এত জল, মরুভূমে এত ঢল?
সপ্ত সাগর সাতশত হয়ে যেন করে টলমল!
খোদার হাবিব এসেছে আজিকে হইয়া মানব-মিতা,
পুণ্য-প্রভায় ঝলমল করে ধরা পাপ-শঙ্কিতা।
সেদিন পাথারে উঠিল যে মৌজ তাহারে শাসন-হেতু
নির্ভীক যুবা দাঁড়াইলে আসি ধরি বিদ্রোহ-কেতু!
উদ্ধত রোষে তরবারি তব ঊর্দ্ধে আন্দোলিয়া
বলিলে, ‘রাঙাবে এ তেগ মুসলমানের রক্ত দিয়া!’
উন্মাদ বেগে চলিলে ছুটিয়া! –একী এ কী ওঠে গান?
এ কোন লোকের অমৃত মন্ত্র? কার মহা আহ্বান?
ফতেমা–তোমার সহোদরা–গাহে কোরান-অমিয়-গাথা,
এ কোন মন্ত্রে চোখে আসে জল, হায় তুমি জান না তা!
উন্মাদ-সম কেঁদে কও, ‘ওরে, শোনা পুনঃ সেই বাণী!
কে শিখাল তোরে এ গান সে কোন বেহেশ্ত হতে আনি
এ কী হল মোর? অভিনব এই গীতি শুনি হায় কেন
সকল অঙ্গ শিথিল হইয়া আসিছে আবেশে যেন!
কী যেন পুলক কী যেন আবেগ কেঁপে উঠি বারে বারে,
মানুষের দুঃখে এমন করিয়া কে কাঁদিছে কোন পারে?’
‘আশ্হাদু আন-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলি
কহিল ফাতেমা–‘এই যে কোরান, খোদার কালাম গলি
নেমেছে ভুবনে মুহম্মদের অমর কণ্ঠে, ভাই!
এই ইসলাম, আমরা ইহারই বন্যায় ভেসে যাই!’…
উমর আনিল ইমান।–গরজি গরজি উঠিল স্বর
গগন পবন মন্থর করি–‘আল্লাহু আকবর!’
সম্ভ্রমে-নত বিশ্ব সেদিন গাহিল তোমার স্তব–
‘এসেছেন নবী, এত দিনে এল ধরায় মহামানব!’
পয়গম্বর নবী ও রসুল–এঁরা তো খোদার দান!
তুমি রাখিয়াছ, হে অতি-মানুষ, মানুষের সম্মান!
কোরান এনেছে সত্যের বাণী, সত্যে দিয়াছে প্রাণ,
তুমি রূপ–তব মাঝে সে সত্য হয়েছে অধিষ্ঠান।
ইসলাম দিল কি দান বেদনা-পীড়িত এ ধরণীরে,
কোন নব বাণী শুনাইতে খোদা পাঠাল শেষ নবীরে,—
তোমারে হেরিয়া পেয়েছি জওয়াব সেসব জিজ্ঞাসার!
কী যে ইসলাম, হয়ত বুঝিনি, এইটুকু বুঝি তার
উমর সৃজিতে পারে যে ধর্ম, আছে তার প্রয়োজন!
ওগো, মানুষের কল্যাণ লাগি তারই শুভ আগমন
প্রতীক্ষায় এ দুঃখিনী ধরা জাগিয়াছে নিশিদিন
জরা-জর্জর সন্তানে ধরি বক্ষে শান্তিহীন!
তপস্বিনীর মত
তাহারই আশায় সেধেছে ধরণী অশেষ দুখের ব্রত।
ইসলাম–সে তো পরশ-মাণিক তারে কে পেয়েছে খুঁজি!
পরশে তাহার সোনা হল যারা তাদেরেই মোরা বুঝি।
আজ বুঝি–কেন কেন বলিয়াছিলেন শেষ পয়গম্বর—
‘মোর পরে যদি নবী হত কেউ, হত সে এক উমর!’
পাওনি কো ‘ওহী’, হওনি কো নবী, তাই তো পরান ভরি
বন্ধু ডাকিয়া আপনার বলি বক্ষে জড়ায়ে ধরি!
খোদারে আমরা করি গো সেজদা, রসুলে করি সালাম,
ওঁরা ঊর্ধ্বের, পবিত্র হয়ে নিই তাঁহাদের নাম,
তোমারে স্মরিতে ঠেকাই না কর ললাটে ও চোখে-মুখে
প্রিয় হয়ে আছ তুমি হতমান মানুষ জাতির বুকে।
করেছ শাসন অপরাধীদের তুমি করনি কো ক্ষমা,
করেছ বিনাশ অসুন্দরের। বলনি কো মনোরমা
মিথ্যাময়ীরে। বাঁধনি কো বাসা মাটির ঊর্ধ্বে উঠি।
তুমি খাইয়াছ দুঃখীর সাথে ভিক্ষার খুদ খুঁটি!
অর্ধ পৃথিবী করেছ শাসন ধুলার তখ্তে বসি
খেঁজুর পাতার প্রাসাদ তোমার বারে বারে গেছে খসি
সাইমুম-ঝড়ে। পড়েছে কুঠির, তুমি পড়নি কো নুয়ে,
ঊর্ধ্বের যারা–পড়েছে তাহারা, তুমি ছিলে খাড়া ভুঁয়ে!
শত প্রলোভন বিলাস বাসন ঐশ্বর্যের মদ
করেছে সালাম দূর হতে সব, ছুঁইতে পারেনি পদ।
সবারে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়া তুমি ছিলে সব নিচে,
বুকে করে সবে বেড়া করি পার, আপনি রহিলে পিছে!
হেরি পশ্চাতে চাহি–
তুমি চলিয়াছ রৌদ্রদগ্ধ দূর মরুপথ বাহি
জেরুজালেমের কিল্লা যথায় আছে অবরোধ করি
বীর মুসলিম সেনা দল তব বহু দিন মাস ধরি।
দুর্গের দ্বার খুলিবে তাহারা, বলেছে শত্রু শেষে–
উমর যদি গো সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করে এসে।
হায় রে আধেক ধরার মালিক আমিরুল-মুমেনিন
শুনে সে খবর একাকী উষ্ট্রে চলেছে বিরামহীন
সাহারা পারায়ে! ঝুলিতে দু’খানা শুকনো ‘খুব্জ’ রুটি,
একটি মশকে একটুকু পানি খোর্মা দু-তিন মুঠি!
প্রহরীবিহীন সম্রাট চলে একা পথে উটে চড়ি
চলিছে একটি মাত্র ভৃত্য উষ্টের রশি ধরি!
মরুর সূর্য ঊর্ধ্ব আকাশে আগুন বৃষ্টি করে,
সে আগুন-তাতে খই সম ফোটে বালুকা মরুর পরে।
কিছুদূর যেতে উট হতে নামি কহিলে ভৃত্যে, ‘ভাই
পেরেশান বড় হয়েছে চলিয়া! এইবার আমি যাই
উষ্ট্রের রশি ধরিয়া অগ্রে, তুমি উঠে বস উটে;
তপ্ত বালুতে চলি যে চরণে রক্ত উঠেছে ফুটে!’
…ভৃত্য দস্ত চুমি
কাঁদিয়া কহিল ‘উমর! কেমনে এ আদেশ করো তুমি?
উষ্ট্রের পিঠে আরাম করিয়া গোলাম রহিবে বসি
আর হেঁটে যাবে খলিফা উমর ধরি সে উটের রশি?’
খলিফা হাসিয়া বলে,
‘তুমি জিতে গিয়ে বড় হতে চাও, ভাই রে এমনই ছলে!
রোজ-কিয়ামতে আল্লা যেদিন কহিবে ‘উমর! ওরে,
করেনি খলিফা মুসলিম-জাঁহা তোর সুখ তরে তোরে!’
কী দিব জওয়াব, কি করিয়া মুখ দেখাব রসুলে ভাই?
আমি তোমাদের প্রতিনিধি শুধু! মোর অধিকার নাই
আরাম সুখের,–মানুষ হইয়া নিতে মানুষের সেবা!
ইসলাম বলে সকলে সমান, কে বড়ো ক্ষুদ্র কে-বা!’
ভৃত্য চড়িল উটের পৃষ্ঠে উমর ধরিল রশি,
মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধুলায় নামিল শশী!
জানি না, সেদিন আকাশে পুষ্পবৃষ্টি হইল কি-না,
কী গান গাহিল মানুষে সেদিন বন্দি, বিশ্ববাণী!
জানি না, সেদিন ফেরেশতা তব করেছে কি না স্তব,–
অনাগত কাল গিয়েছিল শুধু, ‘জয় জয় হে মানব!’…
আসিলে প্যালেস্টাইন, পারায়ে দুস্তর মরুভূমি,
ভৃত্য তখন উটের উপরে, রশি ধরে চল তুমি!
জর্ডন নদী হও যবে পার, শত্রুরা কহে হাঁকি–
’যার নামে কাঁপে অর্ধ পৃথিবী, এই সেই উমর নাকি?’
খুলিল রুদ্ধ দূর্গা-দুয়ার! শত্রুরা সম্ভ্রমে
কহিল–‘খলিফা আসেনি, এসেছে মানুষ জেরুজালমে!’
সন্ধিপত্র স্বাক্ষর করি শত্রু-গির্জা-ঘরে
বলিলে, ‘বাহিরে যাইতে হইবে এইবার নামাজ তরে!’
কহে পুরোহিত, ‘আমাদের এই আঙিনায় গির্জায়,
পড়িলে নামাজ হবে না কবুল আল্লার দরগায়?’
হাসিয়া বলিলেন, ‘তার তরে নয়, আমি যদি হেথা আজ
নামাজ আদায় করি, তবে কাল অন্ধ লোক-সমাজ
ভাবিবে–খলিফা করেছে ইশারা হেথায় নামাজ পড়ি
আজ হতে যেন এই গির্জারে মোরা মসজিদ করি!
ইসলামের এ নহে কো ধর্ম, নহে খোদার বিধান,
কারও মন্দির গির্জারে করে ম’জিদ মুসলমান!’
কেঁদে কহে যত ঈসাই ইহুদি অশ্রু সিক্ত আঁখি–
‘এই যদি হয় ইসলাম–তবে কেহ রহিবে না বাকি,
সকলে আসিবে ফিরে
গণতন্ত্রের ন্যায় সাম্যের শুভ্র এ মন্দিরে!’
তুমি নির্ভীক এ খোদা ছাড়া করনি কো কারে ভয়
সত্যব্রত তোমায় তাইতে সবে উদ্ধত কয়।
মানুষ হইয়া মানুষের পূজা মানুষরই অপমান
তাই মহাবীর খালেদেরে তুমি পাঠাইলে ফরমান
সিপাহ-সালারে ইঙ্গিতে তব করিলে মামুলি সেনা,
বিশ্ব-বিজয়ী বীরেরে শাসিতে এতটুকু টলিলে না।
ধরাধাম ছাড়ি শেষ নবী যবে করিল মহাপ্রয়াণ,
কে হবে খালিফা–হয়নি তখনও কলহের অবসান,
নবী-নন্দনী বিবি ফাতেমার মহলে আসিয়া সবে
করিতে লাগিল জটলা–ইহার পরে কে খালিফা হবে!
বজ্রকণ্ঠে তুমিই সেদিন বলিতে বলিতে পারিয়াছিলে–
‘নবীসূতা! তবে মহল জ্বালাব, এ সভা ভেঙে না দিলে!’
মানব-প্রেমিক! আজিকে তোমারে স্মরি,
মনে পড়ে যত মহত্ত্ব-কথা–সেদিন সে বিভাবরী
নগর-ভ্রমণে বাহিরিয়া তুমি দেখিতে পাইলে দূরে
মায়েরে ঘিরিয়া ক্ষুধাতুর দুটি শিশু সকরুণ সুরে
কাঁদিতেছে আর দুঃখিনী মাতা ছেলেরে ভুলাতে, হায়,
উনানে শূণ্য হাঁড়ি চড়াইয়া কাঁদিয়া অকূলে চায়!
শুনিয়া সকল–কাঁদিতে কাঁদিতে ছুটে গেলে মদিনাতে
বয়তুল-মাল হইতে লইয়া ঘৃত আটা নিজ হাতে,
বলিলে, ‘এসব চাপাইয়া দাও আমার পিঠের পরে,
আমি লয়ে যাব বহিয়া এ-সব দুখিনী মায়ের ঘরে!’
কত লোক আসি আপনি চাহিল বহিতে তোমার বোঝা,
বলিলে, ‘বন্ধু, আমার এ ভার আমিই বহিব সোজা!
রোজ-কিয়ামতে কে বহিবে বল আমার পাপের ভার?
মম অপরাধে ক্ষুধায় শিশুরা কাঁদিয়াছে, আজই তার
প্রায়শ্চিত্ত করিব আপনি!’ – চলিলে নিশীথ রাতে
পৃষ্ঠে বহিয়া খাদ্যের বোঝা দুখিনীর আঙিনাতে।
এত যে কোমল প্রাণ,
করুণার বশে তবু গো ন্যায়ের করনি কো অপমান!
মদ্যপানের অপরাধে প্রিয় পুত্রেরে নিজ করে
মেরেছ দোররা, মরেছে পুত্র তোমার চোখের পরে।
ক্ষমা চাহিয়াছে পুত্র, বলেছ পাষাণে বক্ষ বাঁধি–
‘অপরাধ করে তোরই মত স্বরে কাঁদিয়াছে অপরাধী!’
আবু শাহমার গোরে
কাঁদিতে যাইয়া ফিরিয়া আসি গো তোমারে সালাম করে।
খাস দরবার ভরিয়া গিয়াছে হাজার দেশের লোকে,
‘কোথায় খলিফা’ কেবলই প্রশ্ন ভাসে উৎসুক চোখে,
একটি মাত্র পিরান কাচিয়া শুকায়নি তাহা বলে
রৌদ্রে ধরিয়া বসিয়া আছে গো খলিফা আঙিনা-তলে!
… হে খলিফাতুল-মুসলেমিন! হে চীরধারী সম্রাট!
অপমান তব করিব না আজ করিয়া নান্দী পাঠ,
মানুষেরে তুমি বলেছ বন্ধু, বলিয়াছ ভাই, তাই
তোমারে এমন চোখের পানিতে স্মরি গো সর্বদাই!
বন্ধু গো, প্রিয়, এ হাত তোমারে সালাম করিতে গিয়া
ওঠে না ঊর্ধ্বে, বক্ষে তোমারে ধরে শুধু জড়াইয়া!…
মাহিনা মোহররম–
হাসান হোসেন হয়েছে শহীদ, জানে শুধু হায় কৌম্,
শহীদি বাদশা! মোহর্রমে যে তুমিও গিয়াছ চলি
খুনের দরিয়া সাঁতারি– এজাতি গিয়াছে গো তাহা ভুলি!
মোরা ভুলিয়াছি, তুমি তো ভোলনি! আজও আজানের মাঝে
মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে বন্ধু, তোমারই কাঁদন বাজে!
বন্ধু গো জানি, আমাদের প্রেমের আজও ও গোরের বুকে
তেমনি করিয়া কাঁদিছ হয়ত কত না গভীর দুখে!
ফিরদৌস হতে ডাকিছে বৃথাই নবী পয়গম্বর,
মাটির দুলাল মানুষের সাথে ঘুমাও মাটির ’পর!
হে শহীদ! বীর! এই দোয়া কর আরশের পায়া ধরি–
তোমারই মতন মরি যান হেসে খুনের সেহেরা পরী।
মৃত্যুর হতে মরিতে চাহি না, মানুষের প্রিয় করে
আঘাত খাইয়া যেন গো আমার শেষ নিঃশ্বাস পড়ে!
কলকাতা
১৬ই পৌষ, ১৩৩৪