» » চিরঞ্জীব জগলুল

বর্ণাকার

চিরঞ্জীব জগলুল

প্রাচী’র দুয়ারে শুনি কলরোল সহসা তিমির-রাতে,

মেসেরের শের, শির, শমশের–সব গেল এক সাথে!

সিন্ধুর গলা জড়ায়ে কাঁদিতে–দু’ তীরে ললাট হানি

ছুটিয়া চলেছে মরু-বকৌলি ‘নীল’ দরিয়ার পানি!

আঁচলের তার ঝিনুক মাণিক কাদায় ছিটায়ে পড়ে,

সোঁতের শ্যাওলা এলো কুন্তল লুটাইছে বালুচরে!…

মরু-‘সাইমুম’-তাঞ্জামে চড়ি কোন পরীবানু আসে?

‘লু’ হাওয়া ধরেছে বালুর পর্দা সম্ভ্রমে দুই পাশে!

সূর্য নিজেরে লুকায় টানিয়া বালুর আস্তরণ,

ব্যজনী দুলায় ছিন্ন পাইন-শাখার প্রভঞ্জন।

ঘূর্ণি-বাঁদিরা ‘নীল’ দরিয়ায় আঁচল ভিজায়ে আনি

ছিটাইছে বারি, মেঘ হতে মাগি আনিছে বরফ-পানি।

ও বুঝি মিশর-বিজয়লক্ষ্মী মূরছিতা তাঞ্জামে,

ওঠে হাহাকার ভগ্ন-মিনার আঁধার দীওয়ান-ই-আমে!

কৃষাণের গরু মাঠে মাঠে ফেরে, ধরে নাকো আজ হাল,

গম ক্ষেত ভেঙে পানি বয়ে যায় তবু নাহি বাঁধে আল।

মনের বাঁধেরে ভেঙেছে যাহারা চোখের সাঁতার পানি

মাঠের পানি ও আলেরে কেমনে বাঁধিবে সে, নাহি জানি!

হৃদয়ে যখন ঘনায় শাঙন, চোখে নামে বরষাত,

তখন সহসা হয় গো মাথায় এমনই বজ্রপাত!…

মাটিরে জড়ায়ে উপুড় হইয়া কাঁদিছে শ্রমিক কুলি,

বলে,– ‘মা গো, তোর উদরে মাটির মানুষই হয়েছে ধূলি,

রতন মাণিক হয় না তো মাটি, হীরা সে হীরাই থাকে,

মোদের মাথায় কোহিনূর মণি–কী করিব বল তাকে?

দুর্দিনে মা গো যদি ও-মাটির দুয়ার খুলিয়া খুঁজি,

চুরি করিবি না তুই এ মাণিক? ফিরে পাব হারা পুঁজি?

লৌহ পরশি করিনু শপথ, ফিরে নাহি পাই যদি

নতুন করিয়া তোর বুকে মোরা বহাব রক্ত-নদী!’

আভীর-বালারা দুধাল গাভীরে দোহায় না, কাঁদে শুয়ে,

দুম্বা-শিশুরা দূরে চেয়ে আছে দুধ ঘাস নাহি ছুঁয়ে।

মিষ্টি ধারাল মিছরির ছুরি মিশরি মেয়ের হাসি,

হাঁসা পাথরের কুচি-সম দাঁত,—সব যেন আজ বাসি!

আঙুর-লতার অলকগুচ্ছ– ডাঁশা আঙুরের থোপা,

যেন তরুণীর আঙুলের ডগা–হুরী বালিকার খোঁপা,

ঝুরে ঝুরে পড়ে হতাদরে আজ অশ্রুর বুঁদ সম!

কাঁদিতেছে পরী, চারিদিকে অরি, কোথায় অরিন্দম!

মরু-নটী তার সোনার ঘুঙুর ছুঁড়িয়া ফেলেছে কাঁদি,

হলুদ খেজুর-কাঁদিতে বুঝি বা রয়েছে তাহারা বাঁধি।

নতুন করিয়া মরিল গো বুঝি আজি মিশরের মমি,

শ্রদ্ধায় আজি পিরামিড যায় মাটির কবরে নমি!

মিশরে খেদিব ছিল বা ছিল না, ভুলেছিল সব লোক,

জগলুলে পেয়ে ভুলেছিল ওরা সুদান-হারার শোক।

জানি না কখন ঘনাবে ধরার ললাটে মহাপ্রলয়,

মিশরের তরে ‘রোজ-কিয়ামত’ ইহার অধিক নয়।

রহিল মিশর, চলে গেল তার দুর্মদ যৌবন,

রুস্তম গেল, নিষ্প্রভ কায়খসরু-সিংহাসন।

কী শাপে মিশর লভিল অকালে জরা যযাতির প্রায়,

জানি না তাহার কোন সূত দেবে যৌবন ফিরে তায়।

মিশরের চোখে বাহিল নতুন সুয়েজ খালের বান,

সুদান গিয়াছে–গেল আজ তার বিধাতার মহাদান!

‘ফেরাউন’ ডুবে না মরিতে হায় বিদায় লইল মুসা,

প্রাচী’র রাত্রি কাটিবে না কি গো, উদিবে না রাঙা উষা?

* * *

শুনিয়াছি, ছিল মমির মিশরে সম্রাট ফেরাউন,

জননীর কোলে সদ্যপ্রসূত বাচ্চার নিত খুন!

শুনেছিল বাণী, তাহারই রাজ্যে তারই রাজপথ দিয়া

অনাগত শিশু, আসিছে তাহার মৃত্যু-বারতা নিয়া।

জীবন ভরিয়া করিল যে শিশু-জীবনের অপমান

পরের মৃত্যু-আড়ালে দাঁড়ায়ে সে-ই ভাবে, পেল প্রাণ!

জনমিল মুসা, রাজভয়ে মাতা শিশুরে ভাসায় জলে,

ভাসিয়া ভাসিয়া সোনার শিশু গো রাজারই ঘাটেতে চলে।

ভেসে এলো শিশু রাণীরই কোলে গো, বাড়ে শিশু দিনে দিনে,

শত্রু তাহারই বুকে চড়ে নাচে, ফেরাউন নাহি চিনে।

এল অনাগত তারই প্রাসাদের সদর দরজা দিয়া,

তখনও প্রহরী জাগে বিনিদ্র দশ দিক আগুলিয়া!

– রসিদ খোদার খেলা,

তারই বেদনায় প্রকাশে রুদ্র যারে করে অবহেলা।…

মুসারে আমরা দেখিনি, তোমায় দেখেছি মিশর-মুনি,

ফেরাউন মোরা দেখিনি, দেখেছি নিপীড়ন ফেরাউনি।

ছোটে অনন্ত সেনা-সামন্ত অনাগত কার ভয়ে,

দিকে দিকে খাড়া কারা-শৃঙ্খল, জল্লাদ ফাঁসি লয়ে।

আইন-খাতায় পাতায় পাতায় মৃত্যুদণ্ড লেখা,

নিজের মৃত্যু এড়াতে কেবলই নিজেরে করিছে একা!

সদ্যপ্রসূত প্রতি শিশুটিরে পিয়ায় অহর্নিশ

শিক্ষা দীক্ষা সভ্যতা বলি তিলে-তিলে-মারা বিষ।

ইহারা কলির নব ফেরাউন ভেলকি খেলায় হাড়ে,

মানুষ ইহারা না মেরে প্রথমে মনুষ্যত্ব মারে!

মনুষ্যত্বহীন এই সব মানুষেরই মাঝে কবে

হে অতি-মানুষ, তুমি এসেছিলে জীবনের উৎসবে।

চারিদিকে জাগে মৃত্যুদণ্ড রাজকারা প্রতিহারী,

এরই মাঝে এলে দিনের আলোক নির্ভীক পথচারী।

রাজার প্রাচীর ছিল দাঁড়াইয়া তোদের আড়াল করি,

আপনি আসিয়া দাঁড়াইলে তার সকল শূন্য ভরি!

পয়গম্বর মুসার তবু তো ছিল ‘আষা’ অদ্ভুত,

খোদ সে খোদার প্রেরিত–ডাকিলে আসিত স্বর্গ-দূত।

পয়গম্বর ছিলে নাকো তুমি–পাওনি ঐশী বাণী,

স্বর্গের দূত ছিল না দোসর, ছিলে না শস্ত্র-পাণি,

আদেশে তোমার নীল দরিয়ার বক্ষে জাগেনি পথ,

তোমারে দেখিয়া করেনি সালাম কোনো গিরি-পর্বত।

তবুও এশিয়া আফ্রিকা গাহে তোমার মহিমা-গান,

মনুষ্যত্ব থাকিলে মানুষ সর্বশক্তিমান!

দেখাইলে তুমি, পরাধীন জাতি হয় যদি ভয়হারা,

হোক নিরস্ত্র, অস্ত্রের রণে বিজয়ী হইবে তারা।

অসি দিয়া নয়, নির্ভীক করে মন দিয়া রণ জয়,

অস্ত্রে যুদ্ধ জয় করা সাজে–দেশজয় নাহি হয়।

ভয়ের সাগর পাড়ি দিল যেই শির করিল না নিচু,

পশুর নখর দন্ত দেখিয়া হটিল না কভু পিছু,

মিথ্যাচারীর ভ্রুকুটি-শাসন নিষেধ রক্ত-আঁখি

না মানি–জাতির দক্ষিণ করের বাঁধিল অভয় রাখি,

বন্ধন যারে বন্দিল হয়ে নন্দন-ফুলহার,

না-ই হল সে গো পয়গম্বর নবী দেব অবতার,

সর্ব কালের সর্ব দেশের সকল নর ও নারী

করে প্রতীক্ষা, গাহে বন্দনা, মাগিছে আশিষ তারই!

* * *

‘এই ভারতের মহামানবের সাগর-তীরে’ হে ঋষি,

তেত্রিশ কোটি বলির ছাগল চরিতেছে দিবানিশি!

গোষ্ঠে গোষ্ঠে আত্মকলহ অজাযুদ্ধের মেলা,

এদের রুধিরে নিত্য রাঙিছে ভারত-সাগর-বেলা।

পশুরাজ যবে ঘাড় ভেঙে খায় একটারে ধরে আসি

আরটা তখনও দিব্যি মোটায়ে হতেছে খোদার খাসি!

শুনে হাসি পায়, ইহাদেরও নাকি আছে গো ধর্ম জাতি,

রাম-ছাগল আর ব্রহ্ম-ছাগল আরেক ছাগল পাতি!

মৃত্যু যখন ঘনায় এদের কসায়ের কল্যাণে,

তখনও ইহারা লাঙুল উঁচায়ে এ উহারে গালি হানে।

ইহারে শিশু শৃগালে মারিলে এরা সভা করে কাঁদে,

অমৃতের বাণী শুনাতে এদের লজ্জায় নাহি বাধে!

নিজেদের নাই মনুষ্যত্ব, জানি না কেমনে তারা

নারীদের কাছে চাহে সতীত্ব, হায় রে শরম-হারা!

কবে আমাদের কোন সে পুরুষে ঘৃত খেয়েছিল কেহ,

আমাদের হাতে তারই বাস পাই,আজও করি অবলেহ!

আশা ছিল, তবু তোমাদেরই মত অতি-মানুষেরে দেখি

আমরা ভুলিব মোদের এ গ্লানি, খাঁটি হবে যত মেকি।

তাই মিশরের নহে এই শোক এই দুর্দিন আজি,

এশিয়া আফ্রিকা দুই মহাভূমি বেদনা উঠেছে বাজি!

অধীন ভারত তোমার স্মরণ করিয়াছে শতবার,

তব হাতে ছিল জলদস্যুর ভারত-প্রবেশ-দ্বার!

হে ‘বনি ইসরাইলে’র দেশের অগ্রনায়ক বীর,

অঞ্জলি দিনু ‘নীলে’র সলিলে অশ্রু ভাগীরথীর!

সালাম করারও স্বাধীনতা নাই সোজা দুই হাত তুলি

তব ‘ফাতেহা’য় কী দিবে এ জাতি বিনা দুটো বাঁধা বুলি?

মলয়-শীতলা সুজলা এ দেশে–আশিস করিও খালি–

উড়ে আসে যেন তোমার দেশের মরুর দু-মুঠো বালি।

* * *

তোমার বিদায়ে দূর অতীতের কথা সেই মনে পড়ে,

মিশর হইতে বিদায় লইল মুসা যবে চিরতরে,

সম্ভ্রমে সরে পথ করে দিল ‘নীল’ দরিয়ার বারি,

পিছু পিছু চলে কাঁদিয়া কাঁদিয়া মিশরের নরনারী,

শ্যেন-সম ছোটে ফেরাউন-সেনা ঝাঁপ দিয়া পড়ে স্রোতে,

মুসা হল পার, ফেরাউন ফিরিল না ‘নীল’ নদী হতে।

তোমার বিদায়ে করিব না শোক, হয়ত দেখিবে কাল

তোমার পিছনে মরিছে ডুবিয়া, ফেরাউন দজ্জাল!

কৃষ্ণনগর

১৬ ভাদ্র ১৩৩৪