মুহাম্মদ বিন কাসিম ও তৎকালীন ভূ-রাজনীতি
মুহাম্মদ বিন কাসিমের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জী
সমরশাস্ত্র, সমরাস্ত্র এবং সে যুগের অবস্থাদির একটি সংক্ষিপ্ত খসড়া চিত্র তুলে ধরার পরে আমরা মুহাম্মদ বিন কাসিমের জীবন নিয়ে আলোচনা করছি।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের পূর্ণ নাম ইমদাদ উদ্দীন মুহাম্মদ। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম।
শৈশবাবস্থায়ই পিতার স্নেহ-ছায়া মাথার উপর থেকে উঠে যায়। তাঁর মা একজন সুশিক্ষিতা মহিলা ছিলেন। তিনি শিশুর নৈতিক ও চারিত্রিক প্রশিক্ষণ নিজেই দেন এবং মসজিদে লেখাপড়া শেখান। মুহাম্মদ ঘোড়ায় চড়া, দৌড়াদৌড়ি এবং সমরশাস্ত্রে প্রশিক্ষণ গ্রহণে খুবই আগ্রহী ছিলেন। তাই তাঁর মা তাঁকে তাঁর খালার নিকট পাঠিয়ে দেন। তাঁর খালা ছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফের স্ত্রী। সম্পর্কের দিক দিয়ে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ মুহাম্মদের খালু এবং আপন চাচা হতেন। সেখানে তিনি তাঁর আগ্রহের নিবৃত্তি ঘটাবার মওকা পাবেন—এটাই ছিল তাঁর মায়ের ঐকান্তিক আকাঙ্ক্ষা।
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ প্রথম জীবনে একজন শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বভাবগত ঝোঁক ছিল রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন ও ব্যবস্থাপনার দিকে। ফলে সে যুগে শিক্ষকতা একটি সম্মানজনক পেশা ও জীবিকার্জনের মাধ্যম হওয়া সত্ত্বেও তিনি পুলিশের চাকুরী গ্রহণ করেন। শীঘ্রই পুলিশ বিভাগে তিনি তাঁর যোগ্যতা ও প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। তাঁর এ প্রতিভা দৃষ্টে খলীফা ‘আবদুল মালিক তাঁকে সামরিক বিভাগে অফিসার হিসেবে নিয়োগ করেন যাতে তিনি সেনাবাহিনীকে সুশৃংখল ব্যবস্থাপনার অধীনে নিয়ে আসতে পারেন। এ বিষয়ে ইতিপূর্বেও আমরা আলোচনা করেছি।
হেজাযে ‘আবদুল্লাহ বিন যুবায়র (রা) উমাইয়া খিলাফতের বিরুদ্ধে (তাদের অত্যচার ও অনাচারের কারণে) বিদ্রোহের পতাকা উড্ডীন করে রেখেছিলেন। এই বিদ্রোহ উমাইয়া খিলাফতের জন্য খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। ‘আবদুল মালিকের পূর্ববর্তী দু’জন খলীফা খুবই দুর্বল থাকায় রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে অরাজকতা ও বিশৃংখলা দেখা দেয়। শক্ত হাতে এই বিশৃংখলা দমনের প্রয়োজন ছিল যাতে অন্য কেউ মাথা তুলতে সাহসী না হয় এবং এ দৃষ্টান্ত থেকেই প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
‘আবদুল মালিক হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে যোগ্য বিবেচনা করে তার উপরই একাজের দায়িত্ব অর্পণ করেন। হাজ্জাজ স্বীয় ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ বিন কাসিমকে খুবই আদর ও স্নেহ করতেন। তিনি তাঁর দূরদৃষ্টি দ্বারা পরিমাপ করতে পেরেছিলেন যে, এই বালক একদিন অবশ্যই যোগ্যতম মুজাহিদ হিসেবে পরিগণিত হবেন। তিনি মুহাম্মদ বিন কাসিমকে অল্প বয়স থেকেই সমরশাস্ত্রে অভিজ্ঞ করে তুলবার জন্য যুদ্ধ ও সংঘর্ষের প্রতিটি পর্যায়ে নিজের সঙ্গে রাখেন যেন সে সমরশাস্ত্রকে হাতে কলমে আয়ত্ত্ব করে নিতে পারে।
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কৌশলে ‘আবদুল্লাহ বিন যুবায়র (রা)- এর দু’পুত্র হামযা এবং হাবীবকে স্বপক্ষে টেনে নেন। এই বিদ্রোহ দমনের জন্য তিনি কোথাও কঠোরতা—আবার কোথাও কোমলতার আশ্রয় নেন এবং সত্বরই তা দমন করতে সক্ষম হন। হাজ্জাজও ‘আবদুল মালিককে রাজনৈতিক কূটকৌশল অবলম্বনের এবং উদার ব্যবহার দ্বারা হেজাযবাসীদের অন্তর জয় করার উপদেশ দেন। অনন্তর ‘আবদুল মালিক হেজায এলাকায় পানির ন্যায় দু’হাতে টাকা ছড়ান। ফলে কেবল হেজাযেই নয়, বরং সিরিয়া এলাকায়ও শান্তি ফিরে আসে। রোম সম্রাট, যিনি সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, এ অবস্থাদৃষ্টে স্বীয় অপবিত্র বাসনা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন।
এই সাফল্যে হাজ্জাজের খ্যাতি দারুণভাবে বৃদ্ধি পায়। ইরাকে গোলযোগ দেখা দিলে ‘আবদুল মালিক হাজ্জাজকে সেখানকার গভর্নর নিযুক্ত করে পাঠান। ইরাকের গোলযোগ খুবই বিপজ্জনক রূপ পরিগ্রহ করেছিল। তাওয়াবীন (অনুতপ্ত ও অনুশোচনাকারী), যারা ইমাম হুসায়ন (রা)-কে কুফায় আহ্বান করে অগণিত শত্ৰু পরিবেষ্টিত অবস্থায় একাকী ছেড়ে গিয়েছিল—এখন তারাই বনু উমাইয়াদেরকে সিংহাসন চ্যুত করার উদ্দেশ্য নিয়ে শহীদ ইমামের হত্যাকারীদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের কৃত্রিম মহড়া দিচ্ছিল। তাওয়াবীনগণ হাজ্জাজের হাতে চরম মার খেয়ে ‘আবদুর রহমান বিন আশ’আছকে তাদের শিখণ্ডী নিযুক্ত করে সারা দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে থাকে। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তাদের এ হাঙ্গামা কঠোরভাবে দমন করেন।
মুহাম্মদ বিন কাসিম নানা প্রতিকূল অবস্থার ভেতরও আপন পিতৃব্যের সাথে থেকে অনেক কিছুই শেখেন। সে যুগে মুসলিম ফৌজ তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে রাখতেন। ফলে মুহাম্মদ বিন কাসিম তাঁর খালাতো বোন হাজ্জাজের একমাত্র কন্যার সাথে শৈশব কাটান। তাদের দু’জনের শৈশব ও বাল্যের এই বন্ধুত্বই বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রেম ও ভালবাসায় পরিণত হয়। কূফার চতুর্দিকে শান্তি-শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত হলেই হাজ্জাজের দৃষ্টি মুসলিম রাষ্ট্রের বাইরে গিয়ে পড়ে। একদা ভারতের রাজা দাহির আরব বণিকদের বাণিজ্য কাফেলা লুট করে। হাজ্জাজ মাকরানের গভর্নর সাঈদ বিন আসলাম বিন যার‘আকে রাজা দাহিরের নিকট পাঠান যাতে বিষয়টির একটি নিষ্পত্তি করা যায়। কেননা সে সময় খুরাসানে মুসলিম ফৌজ জিহাদে মশগুল ছিল এবং হাজ্জাজ সেই চিন্তায় ছিলেন বিভোর। এদিকে মুহাম্মদ বিন কাসিমও নিশ্চিন্ত ও নিরূপদ্রব জীবনে হাঁপিয়ে উঠেন। জিহাদের উদ্দেশ্যে খুরাসান, খাওয়ারিয্ম ও তুর্কিস্তান অভিমুখে রওয়ানা হন তখন মুহাম্মদ বিন কাসিমও এই খ্যাতিমান জেনারেলের সঙ্গী হন। সেখানে তিনি তাঁর মেধা, প্রতিভা, সাহসিকতা, বীরত্ব ও শৌর্য-বীর্যের এমনই পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন যে, সেনাপতি কুতায়বা তাঁকে পদোন্নতি দিয়ে স্বীয় সহকারী নিযুক্ত করেন।
স্বীয় সহকারী হিসাবে ৯২ হিজরীতে কুতায়বা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে হাজ্জাজের নিকট একটি জরুরী পরামর্শের জন্য পাঠান। নিরাপদ ও শান্তি এলাকায় অগ্রাভিযান কোন দিক থেকে করা হবে—সে বিষয়ে হাজ্জাজ ও কুতায়বার মধ্যে ভিন্নমত সৃষ্টি হচ্ছিল বলে অনুমিত হয়। কুতায়বা এবং হাজ্জাজ বসরা থেকে রওয়ানার পূর্বে একটি পরিকল্পনার উপর ঐক্যমতে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে মুহাম্মদ বিন কাসিম সিপাহসালার কুতায়বাকে নিজ যুক্তি-প্রমাণের সাহায্যে এতখানি প্রভাবিত করেন যে, তিনি তাঁর প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। আর এই পরিবর্তনের কারণেই শত্রু পরাজিত হয়। কিন্তু হাজ্জাজ তাঁর অনুমতি ছাড়া পরিকল্পনা পরিবর্তন করায় কুতায়বার উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। তিনি কুতায়বার নিকট এ ব্যাপারে কৈফিয়ত তলব করেন। জবাবে কুতায়বা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে হাজ্জাজের কাছে পাঠিয়ে দেন—যাতে করে তিনি হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে এই প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার পরিবর্তনের কারণগুলো সম্বন্ধে বুঝিয়ে বলতে পারেন এবং আরও প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের ব্যাপারে অনুমতি চাইতে পারেন। কেননা সকলেই হাজ্জাজের কঠোরতার কারণে আতংকিত ছিল। কুতায়বা সমীচীন মনে করেন যে, এ ব্যাপারটি চাচা-ভাতিজা মিলিতভাবে নিষ্পত্তি করুন, অধিকন্তু হাজ্জাজ তাঁর ভাতিজার যোগ্যতা সম্পর্কেও অবহিত হোন। শেষ পর্যন্ত চাচা-ভাতিজার মোলাকাত খুবই মধুর ও চিত্তাকর্ষক হয়। চাচা ছিলেন আত্মগর্বী বিখ্যাত জেনারেল। এতদ্ভিন্ন তিনি মুহাম্মদ বিন কাসিমকে তাঁর শাগরিদ ও মকতবের ছাত্র ভেবেছিলেন। এদিকে মুহাম্মদ বিন কাসিম তখনও ষোল-সতের বছর বয়সের তরুণ মাত্র। তবু তিনি অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী, অটুট মনোবল সম্পন্ন, শান্ত ও স্থির মস্তিষ্ক এবং যুক্তিবাদী বক্তা হিসাবে প্রমাণিত হন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ মুহাম্মদ বিন কাসিমের সুদূরপ্রসারী প্রতিরক্ষা ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব অনুধাবন করে নিজের পরাজয় স্বীকার করেন এবং মুহাম্মদ বিন কাসিমের প্রস্তাব সমর্থন করে তাকে পুনরায় কুতায়বার কাছে পাঠিয়ে দেন এবং তাকে একটি চিঠিও দেন। ঐ চিঠিতে হাজ্জাজ কুতায়বাকে লিখেন যে, তিনি যেন মুহাম্মদ বিন কাসিমকে বসরায় ফেরত পাঠিয়ে দেন। কেননা ঠিক তখনই ‘উবায়দুল্লাহ্র—যাকে হাজ্জাজ রাজা দাহিরের নিকট পাঠিয়ে ছিলেন, তার হত্যার খবর কুফায় এসে পৌঁছে। সে সময় হাজ্জাজ মুহাম্মদ বিন কাসিমকে কুতায়বার নিকট পাঠাতে যাচ্ছিলেন। হাজ্জাজ তখন রাজা দাহিরকে পর্যুদস্ত করবার জন্য মুহাম্মদ বিন কাসিমকেই নির্বাচিত করে ফেলেন।
প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার উপর আলোচনা-সমালোচনা হাজ্জাজের মনের উপর খুবই প্রভাব ফেলেছিল। তিনি মুহাম্মদ বিন কাসিমের সম্পর্কে তাঁর শৈশবকাল থেকেই আশান্বিত ছিলেন বটে, তবে তাঁর ভেতর এই অতিরিক্ত উন্নতি লক্ষ্য করে তিনি বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েন এবং খুবই আনন্দিত হন। কেননা প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার যে স্বপ্ন তিনি এতদিন মনে মনে এঁকে রেখেছিলেন তার সত্যায়ন এভাবে দেখতে পান যে, একদিক থেকে কুতায়বা দুনিয়ার সর্বাধিক জনবহুল এলাকা চীনের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন, আর অন্য দিক দিয়ে তাঁর যুবক ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ বিন কাসিম জিহাদের পতাকা উড্ডীন করে ভারতবর্ষ পদানত করে কুতায়বার সাথে মিলিত হচ্ছে।
মুহাম্মদ বিন কাসিম খাওয়ারি থেকে ফিরে এলে হাজ্জাজ তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকে খলীফার দরবারে পাঠান যাতে এই প্রতিশ্রুতিশীল সমরনায়ক আরব রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে সিন্ধুতে অভিযান পরিচালনার যৌক্তিকতা খোদ আমীরুল মু’মিনীনকে বুঝাবার সুযোগ পান।
হাজ্জাজ খলীফাকে এও লিখে দিয়েছিলেন যে, আমীরুল-মু’মিনীন যত অর্থ বায়তুল মাল থেকে এই অভিযানের জন্য ইরাকের শাসনকর্তাকে কর্জস্বরূপ দেবেন—তার দ্বিগুণ অর্থ বায়তুল মালে ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
মুহাম্মদ বিন কাসিম এমন সময় দামিশকে পৌঁছান যখন সেখানে যুদ্ধ ও খেলাধূলার বার্ষিক প্রতিযোগিতামূলক মহড়া অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। মুহাম্মদ বিন কাসিম খলীফার দরবারে হাযির হন। হাজ্জাজের পত্র পাঠের পর খলীফা দীর্ঘক্ষণ ধরে মুহাম্মদ বিন কাসিমকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করেন। অতঃপর তাঁকে সম্বোধন করে বলেন, “প্রথমে কিছু চিত্তাকর্ষক খেলাধুলায় অংশ গ্রহণ কর। আর যদি সাহস হয় তাহলে প্রতিযোগিতামূলক যুদ্ধে ও অবতরণ কর। এতে লোকে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের ভাতিজাকে দেখবার সুযোগ পাবে। আর তুমিও তোমার অশ্বারোহণের ক্ষিপ্রতা ও তলোয়ারবাজীর নৈপুণ্য দেখাতে পারবে।”
মুহাম্মদ বিন কাসিম এই আনুষ্ঠানিক ও সংক্ষিপ্ত আলোচনায় অসন্তষ্ট হন। তাঁর অন্তরের লালিত আকাঙ্ক্ষা অন্তরেই থেকে গেল। কেননা খলীফা তখন পর্যন্ত সিন্ধুর উপর হামলা, তার গুরুত্ব ও সমর পরিকল্পনার উপর আলোচনা করার কোন সুযোগই তাকে দেন নি। দামিশকের কৃত্রিম যুদ্ধের আখড়ায় সুলায়মান বিন আবদুল মালিক তাঁর বন্ধু বান্ধব সহ উপস্থিত ছিলেন। সুলায়মান তাঁর মুসাহিবদের তলোয়ারবাজী, নেযাবাজী ও বর্শা লড়াইয়ের অপূর্ব দক্ষতায় খুবই গর্বিত ছিলেন। তাঁর আশা ছিল, ওয়ালীদ বিন ‘আবদুল মালিকের পর তিনি খলীফা হবেন, যদিও ওয়ালীদ তাঁর পুত্রকেই খলীফা বানাতে চাইতেন।
সুলায়মানের দলবল আখড়ায় নেমে তাদের মুকাবিলায় অবতরণের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানায়। যে-ই সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুকাবিলায় নামছিল সেই পরাজিত হ’চ্ছিল। সুলায়মানের বন্ধু-বান্ধব একের পর এক প্রতিযোগিতায় অবতরণ করছিল। কিন্তু খলীফা ঐ সব ক্রীড়াশৈলীতে খুশী হতে পারছিলেন না।
মুহাম্মদ বিন কাসিম এ সব কিছুই নেহায়েত অধৈর্যের সঙ্গে অবলোকন করছিলেন। শেষাবধি তিনি ময়দানে সুলায়মানের ঐ তলোয়ারবাজের মুকাবিলায় এগিয়ে আসেন—যে উপর্যুপরি কয়েক বছর যাবত প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হচ্ছিল এবং কেউই তার মুকাবিলায় এগিয়ে আসার সাহস পাচ্ছিল না। এ দুই প্রতিযোগীর মধ্যে ছিল আসমান-যমীনের ফারাক। সুলায়মানের মুসাহিব সর্বোত্তম অশ্ব, উন্নত মানের সমরাস্ত্র ও লৌহবর্মে সজ্জিত ছিল। এদিকে মুহাম্মদ বিন কাসিমের ঘোড়া ছিল মামুলী ধরনের। আর তাঁর সাজ-সামানও সফরের কারণে জীর্ণ-শীর্ণ দেখাচ্ছিল। লোকেরা এই অখ্যাত নওজোয়ানকে আখড়ার সর্বাধিক অভিজ্ঞ যোদ্ধার মুকাবিলায় নামতে নিষেধ করে। যাই হোক, মুকাবিলা হ’ল এবং মুহাম্মদ বিন কাসিম তাতে জয়ী হলেন। তলোয়ার যুদ্ধের পর নেযাবাজীর মুকাবিলায়ও মুহাম্মদ বিন কাসিম অপরাজিত থাকেন।
খলীফা সব কিছুই দেখছিলেন। সেখানেই তিনি মুহাম্মাদ বিন কাসিমকে সিন্ধু গমনরত বাহিনীর সিপাহসালার নিযুক্তির ঘোষণা দেন। তিনি হাজ্জাজের পত্রটিও সজোরে পাঠ করবার নির্দেশ দেন এবং প্রকাশ্যে জিহাদ ঘোষণা করেন। খলীফা সন্ধ্যা-বেলা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে দরবারে ডেকে পাঠান এবং সে সুযোগে তাঁকে তাঁর চাচার (হাজ্জাজের) প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা সকলের সামনে তুলে ধরার মওকা দেন। মুহাম্মদ বিন কাসিম এ দায়িত্ব সুন্দর ও সুচারুরূপে পালন করেন। আমীরুল মু’মিনীন খুবই খুশী হন এবং তাঁকে খেলাত দ্বারা সম্মানিত করেন।
দামিকশ্ক থেকে প্রায় দু’হাযার মুজাহিদ নিয়ে তিনি বসরা পৌঁছেন। বসরা পৌঁছুতেই তাঁর চাচা আপন কন্যাকে তাঁর সাথে বিয়ে দেন। মুহাম্মদ বিন কাসিম এবার আপন বাহিনী তৈরীতে মনোনিবেশ করেন। এটা ছিল সেই সময় যখন ‘আবদুল মালিকের ফৌজ মিসর, সিরিয়া ও তুর্কিস্তানের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল এবং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের ক্ষতচিহ্নও খুব একটা নিরাময় হয়ে ওঠেনি। এমতাবস্থায় মুজাহিদদের একত্রে সমাবেশ খুব একটা সহজ কাজ ছিল না।
অতএব এই অতিরিক্ত অভিযান পাঠানো থেকে ‘আবদুল মালিকের সুদৃঢ় ইচ্ছা-শক্তি, ধীর-স্থির মিযাজ ও উন্নত মানের মনোবলের পরিচয় পাওয়া যায় এবং বোঝা যায়, নামকরা খলীফা কত সত্বর সমস্ত অভ্যন্তরীণ অবস্থার উপর কাবু জমিয়ে বাইরের অব্যাহত বিজয়ের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন এবং জিহাদের ন্যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের স্পৃহাকে মুসলমানদের মধ্যে পুনরায় কিভাবে জাগিয়ে তুলেছিলেন।
হাজ্জাজের অবদান কেবল উমাইয়া হুকূমতের জন্যই নয় যে, তিনি তাদের ভেঙে পড়া ফৌজকে ধসে যাওয়া ও বিবর্ণ হওয়ার হাত থেকে সজীব করে তুলে একটি বিশ্ববিজয়ী ফৌজে রূপান্তরিত করেছিলেন, বরং তাঁর অবদান গোটা মুসলিম বিশ্বের জন্যও বটে যে, তিনি মুসলমানদের মধ্যে জিহাদী প্রেরণা ও উদ্দীপনাকে পুনরায় অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে জাগিয়ে তুলেছিলেন। তিনি মুসলমানদেরকে দ্বিতীয়বারের মত একটি সুশৃঙ্খল জাতিগোষ্ঠীতে পরিণত করেন। এ অবস্থা সৃষ্টিতে কিছু কঠোর ও নির্মম ব্যবস্থা তিনি নেন। অবশ্য তাঁর এই কঠোর আচরণ সে ধরনেরই কঠোর ও নির্মম আচরণের ন্যায় যা কোন অচল অঙ্গ-প্রতঙ্গ কেটে কিংবা ছেঁটে ফেলার মুহূর্তে একজন অভিজ্ঞ সার্জন করে থাকেন, এই উদ্দেশ্যে যেন অন্যান্য সুস্থ অঙ্গ-প্রতঙ্গে রোগ সংক্রামিত হতে না পারে এবং অসুস্থ রোগী রোগের হাত থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে। সে যুগের অবস্থা সম্পর্কে ন্যায় ও ইনসাফের দৃষ্টি নিয়ে গভীরভাবে ভেবে দেখলে নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে হবে যে, তৎকালীন অবস্থার মুকাবিলা করে পরিস্থিতি আয়ত্তাধীনে আনবার জন্য কার্যকর কৌশল ও প্রয়াসের সঙ্গে জোর-যবরদস্তীরও দরকার ছিল।
সে যাই হোক, মুহাম্মদ বিন কাসিম খুবই যোগ্য উস্তাদের কাছে সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ করেন। এই সঙ্গে তিনি কোমল ও কঠোর ব্যবহারের উপকারিতা ও অপকারিতার সঠিক পরিমাপ করতেও শেখেন। এ দু’টি বিষয় তিনি কোন মাদ্রাসা কিংবা কোন মকতব থেকে শেখেননি বরং যুদ্ধক্ষেত্রে লাভ করে কর্মক্ষেত্রে তা পরীক্ষা করেন।
এই অল্প বয়সেই তিনি নিজের উপর এতখানি আস্থাশীল ছিলেন যে, হাজ্জাজ ও কুতায়বার মত খ্যাতিমান অধিনায়কদের সামনে স্বীয় প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা সম্পৰ্কীয় মতামত অত্যন্ত নিৰ্ভীক ভাবে প্রকাশ করেন। তিনি চিন্তার ক্ষেত্রে স্বচ্ছ, ভাষার ক্ষেত্রে নির্ভীক এবং দৈহিক ও শারীরিক দিক দিয়ে পরিশ্রমী ছিলেন। তিনি বিলাসিতাকে পসন্দ করতেন না। সৈনিক জীবনের জন্য যে সব অভ্যাস ও স্বভাবের দরকার—তার সম্মান ও কদর বুঝতেন। হাজ্জাজের শিক্ষানবীশী করার ফলে তিনি ফৌজের শাসন-শৃংখলা, প্রশিক্ষণ, বিন্যাস এবং মূলনীতি সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিফহাল হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।
অশ্বারোহণ, তলোয়ারবাজী, অপরিসীম ধৈর্য্য, সহিষ্ণুতা, মনোবল, সাহসিকতা ও বীরত্বের ন্যায় মহামূল্যবান সম্পদের কিছু তো তাঁর প্রকৃতিগতই ছিল। অনুশীলন ও চর্চার ফলে সেগুলোর ঔজ্জ্বল্য আরো বৃদ্ধি পায়। ফলে একজন সর্বাধিনায়ক হওয়া তাঁর পক্ষে বিস্ময়কর কিছু ছিল না বরং এমনটিই হওয়াই তাঁর দরকার ছিল এবং তিনি তা হয়েও ছিলেন।
সর্বাগ্রে মুহাম্মদ বিন কাসিমের যুগে সিন্ধুর অর্থাৎ রাজা দাহিরের এলাকার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও বিবরণ পেশ করা প্রয়োজন মনে করছি। এতে আমরা ঐসব সমস্যা চিহ্নিত করতে পারব, এই মহান মুসলিম সিপাহসালার তাঁর প্রতিরক্ষা ও রাজনৈতিক মূলনীতি, শাসন-শৃংখলা ও সমরশাস্ত্রের পন্থা-পদ্ধতি কার্যকর করতে গিয়ে যেগুলোর সম্মুখীন হয়ে ছিলেন এবং অত্যন্ত সাফল্যের সাথে তার সমাধানও করেছিলেন।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের পূর্বে ঐ এলাকা ছিল গ্রীক ও পারসিকদের অনুরাগ ও উচ্চাশার ক্রীড়াক্ষেত্র। ধাতব দ্রব্য, তলোয়ার, উত্তম মদ, উন্নত মানের কাপড়, স্বর্ণ-রৌপ্য নির্মিত গহনা-পত্র প্রভৃতির ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ঐ এলাকা সমগ্র এশিয়া ও য়ুরোপের মধ্যে বিখ্যাত ছিল। এই বাণিজ্য কেন্দ্রটি দখল করবার উদ্দেশ্যে আলেকজাণ্ডার ভারতবর্ষে আক্রমণ পরিচালনা করেন। কিন্তু তাঁর ফৌজ শতদ্রু নদী পার হয়ে সম্মুখে অগ্রসর হতে অস্বীকার করে এবং তিনি সিন্ধুনদের পথ ধরে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ঐ সময় তিনি সিন্ধুনদের (মিহরান) পাড়ে একটি বন্দর গড়ে তোলেন এবং তার নাম রাখেন পাটাল।
অনেক ঐতিহাসিক সিন্ধু সমেত ঐ এলাকাকে যা কেপমুন্ থেকে মুলতান পর্যন্ত বিস্তৃত—মিহরান নামে অভিহিত করেন। শুধু সিন্ধু এলাকা থেকে নয় বরং গোটা ভারতবর্ষ থেকেই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে খতম করে দিয়েছিল এবং এখান কার অধিকাংশ রাজার ধর্ম বৌদ্ধ ধর্মে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু অবতরণের পূর্বে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে এবং ব্রাহ্মণ্য শক্তি ক্রমান্বয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদেরকে সমগ্র ভারতবর্ষ থেকে বহিষ্কার করতে শুরু করে। বৌদ্ধরা বর্মা, তিব্বত, সিন্ধু এবং পেশাওয়ারের দিকে স্থানান্তরিত হতে থাকে।
যে যুগে মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুর উপর হামলা করেন সে যুগে সিন্ধুর রাজা দাহির এবং তাঁর সহযোগী রাজন্যবর্গ ও অধিকাংশ সর্দার হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন। সিন্ধু, মুলতান প্রভৃতি এলাকার প্রজাবৃন্দও ছিল প্রধানত হিন্দু। অনেক বৌদ্ধও ছিল। তবে এদের সাথে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ব্যবহার ছিল খুবই খারাপ। অবশ্য সিন্ধুনদের পশ্চিম তীরের এলাকা— যা দাদু, জ্যাকবাবাদ, বেলুচিস্তান, মাকরান, খারান, লাসবেলা প্রভৃতি নামে পরিচিত, সেখানকার অধিকাংশ সহযোগী রাজন্যবর্গ ও প্রজাকুল ছিল বৌদ্ধধর্মের অনুসারী।
বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী করদ রাজন্যবর্গের এবং প্রজাবৃন্দের অধিকাংশই ছিল জাট ও মিও জাতিগোষ্ঠিভুক্ত। ব্রাহ্মণ্যকুল এদেরকে জাতি হিসেবে ব্রাহ্মণ ও রাজপুতদের তুলনায় নীচু শ্রেণীর মনে করত। জাট ও মিও জাতি খুবই বীর ও যুদ্ধবাজ ছিল। এরাই আলেকজাণ্ডারকে বিব্রত ও ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল এবং এরাই প্রথমে মুহাম্মদ বিন কাসিমের সর্বাধিক বিরোধী ছিল। অবশ্য পরবর্তীকালে তারা সহযোগীর ভূমিকা গ্রহণ করে। এই জাটেরাই সুলতান মাহমুদ গযনবীকে সোমনাথ থেকে ফিরবার পথে বেশ খানিকটা বিব্রত করেছিল। এদের এই অপকর্মের শাস্তি দানের জন্যই মূলত পরবর্তী বছরই তাঁকে পুনরায় সিন্ধুর উপর আক্রমণ পরিচালনা করতে হয়।
এ যুগের কিছু আগে ইরানের সাসানী হুকুমত দুর্বল হতেই তারা বিভিন্ন রাজন্যবর্গের নিকট সাহায্যপ্রার্থী হয় এবং সে সময়ই সাসানী বংশের শাহযাদা বাহরাম গোরের বিয়ে জনৈকা হিন্দু রাজকুমারীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। এ ভাবেই সে দেশে গোদরহন বংশের ভিত্তি স্থাপিত হয়। বলা হয় যে, বাহমনাবাদ এই বংশেরই আবাদকৃত শহর। ইরানী ও ভারতীয়দের মধ্যকার এই ঐক্য ২২৬ ঈসায়ী থেকে ৬৫০ ঈসায়ী পর্যন্ত খুবই নিবিড় ছিল।
৬২০ ঈসায়ীতে সিন্ধু এলাকার রাজা ছিলেন রায়সহিংস। রাজা রায় চাচ নামীয় একজন ব্রাহ্মণকে তাঁর পরামর্শদাতা নিযুক্ত করেন। চাচ সায়িজ নামক জনৈক গরীব ব্রাহ্মণের সন্তান ছিলেন। তিনি (চাচ) ছিলেন খুবই সুপুরুষ, ধী-শক্তিসম্পন্ন ও যোগ্য। ৬৩০ ঈসায়ীতে রাজা রায়-এর মৃত্যু হলে তাঁর তরুণী সুন্দরী বিধবা স্ত্রী রাণী শুদ্ধানী চাচের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। অতঃপর চাচ নিজেকে সিন্ধুর রাজা বলে ঘোষণা করেন। চিতোরে সে সময় রাজা মহতরাজ রাজত্ব করছিলেন। তিনি ছিলেন রাজা রায়ের ভাই। স্বাভাবিকভাবেই চাচের রাজা হওয়া এবং তাঁর মৃত ভাই-এর বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করা মহতরাজের বিরক্তি উৎপাদন করে। তিনি রাজা চাচের বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করেন। কিন্তু যুদ্ধে রাজা মহত মারা যান এবং পরিণামে রাজা চাচ রাজা হিসেবে ৪০ বছর যাবত অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে রাজ্য শাসন করেন। তাঁর সাম্রাজ্য বিপাশা নদীর তীর ধরে বাবীহ, মুলতান, সিন্ধু প্রভৃতি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
৬৭০ ঈসায়ীতে রাজা চাচের মৃত্যু হলে তদস্থলে তাঁর ভাই চন্দ্ৰ সিংহাসনে আরোহণ করেন। ৬৭৮ ঈসায়ীতে রাজা চন্দ্র মারা গেলে চাচের কনিষ্ঠ পুত্র দাহির সিংহাসনে উপবেশন করেন। দাহির রাজা হয়েই জ্যোতিষীদের নির্দেশ মুতাবিক আপন বোনকে বিয়ে করেন। রাজার এই নৈতিকতা বিরোধী কর্মে তাঁর প্রজাকুল খুবই ক্ষুব্ধ হয়; কিন্তু রাজার ভয়ে নীরব থাকে।
রাজা দাহিরের করদ রাজ্যসমূহ
রাজা দাহিরের অধীনে নিম্নোক্ত করদ রাজ্যসমূহ ছিল :
রাজন্যবর্গের নাম | রাজধানী |
রাজা জাহীম বুদ্ধ | দেবল |
রাজা সুমানা | নীরূনকোট |
রাজা বিজওয়া (রাজা চন্দ্রের পুত্র) | সহওয়ান |
লৌহানা সম্প্রদায়ের রাজা | বাহমনাবাদ |
বুদ্ধ (রাজা দাহিরের পুত্র) | সিবী |
রাজা দাহিরের রাজধানী ছিল আলোর।
বিখ্যাত কেল্লা
আওজ, মিথিলো, হ্রদ, সোরাই, দেবল, নীরূন, সিবী, বাহমনাবাদ, বেলা, স্কালিন্দার ও মুলতান।
সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশ
রাজা দাহিরের সাম্রাজ্য নিম্নোক্ত প্রদেশগুলোতে বিভক্ত ছিল :
(১) আরোর : (আলোর) সিন্ধু এবং হিন্দের রাজধানী।
(২) সুস্তান : বুদ্ধিয়া, ঝানকান, কোহিস্তান, রেজিয়ান (সিবী অথবা সিব্বী), সীমান্ত মাকরান।
(৩) কারওয়ান : কায়কান (কালাত), হাস, তুরান।
(৪) ব্রাহ্মণাবাদ : দেবল, নীরূন, লোহানা, মুখ্যাপত, সুমানা।
(৫) স্কালিন্দা : চাচপুর, সুওয়ারিয়া, জাজপুর, ডোহিস্ত, বাবীনা।
(৬) মুলতান : ব্রহ্মাপুর, ইশতিহার ও কুম্ভ, দক্ষিণ কাশ্মীর, সুখাকুৰ্দ।
প্রাকৃতিক বিভাগ
প্রাকৃতিক দিক দিয়ে রাজা দাহিরের সাম্রাজ্য নিম্নোক্ত ভাগে বিভক্ত ছিল :
১. উত্তর এলাকা : বর্তমান বেলুচিস্তান এবং (বেলুচিস্তানী ইউনিয়ন) যা নদী তীর থেকে উঁচু। এটি পার্বত্য এলাকা; এ এলাকায় শীতকালে প্রচণ্ড শীত পড়ে। এ এলাকায় প্রাকৃতিক ঝর্ণাধারা রয়েছে। তবে পানীয় জলের পরিমাণ খুব কম। বেশীর ভাগ এলাকা ঊষর ও বসতিহীন। সে যুগে পাহাড় খুব ঘন ঝোপঝাড় ও বৃক্ষপূর্ণ ছিল।
২. মধ্য এলাকা : সেই অংশ যাকে সিন্ধুনদ উর্বরতা দান করে। সিন্ধুনদের কিছু অংশকে মেহরান এবং কিছু অংশকে বুঘ বলা হ’ত। এখানে পানি প্রচুর জমি খুবই উর্বর ও শস্য-শ্যামল।
যখন নদীতে প্লাবন আসত তখন ঐ প্লাবনের পানি দ্বারা প্রচুর পরিমাণে গম, জোয়ার, পন্না ইত্যাদি উৎপন্ন হ’ত। অবশ্য মশার উপদ্রবের কারণে এখানে জ্বরের প্রকোপ ছিল বেশী।
৩. মরু এলাকা অর্থাৎ পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এলাকা : এখানে ও পানির স্বল্পতা ছিল। কুয়ার পানিও ছিল লবণাক্ত। এটা ছিল আরবের মরু এলাকার অনুরূপ।
৪. সিন্ধুনদের নিকট তীরবর্তী সেই অংশ যা চড়াই পূর্ণ ছিল : এটা ছিল লালাজ নামে পরিচিত। আজকাল এ অংশের বিখ্যাত শহর লারকানা, দাদু প্রভৃতি। এ এলাকা খুবই উর্বর ও শস্য-শ্যামল ছিল। তবে আবহাওয়া ছিল খুবই আৰ্দ্ৰ। এসব মানুষ ও জীব-জানোয়ার উভয়ের জন্য ক্ষতিকর, বিশেষ করে আরবদের জন্য ছিল খুবই কষ্টকর। কেননা আরবরা ছিল মরু এলাকার বাসিন্দা। আর মরু এলাকার আবহাওয়া সাধারণত শুষ্ক হয়ে থাকে।
আরবদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সিন্ধুর বাণিজ্য শহর
আরব সিপাহীরা সিন্ধুর নানাবিধ ধাতব পদার্থ, তলোয়ার, কাপড়, কর্পূর, তেল, নীল, নারকেল, খাদ্য-দ্রব্য, খেজুর, ইক্ষু, আম, কয়লা, গম, লেবু ও চাউলের খুবই প্রশংসা করেছেন।
সিন্ধুর সেই এলাকা যাকে আজকাল কাশমূর বলে, জ্যাকবাবাদের একটি তহসীল ছিল। এখানকার চামড়া শিল্প ছিল খুবই বিখ্যাত। এই এলাকা তখন বুদ্ধিয়া নামে পরিচিত ছিল। কাযাওয়ার (খফদার কালাতে অবস্থিত) ছিল তুরানের রাজধানী এবং আঙ্গুর, আনারস, সেব, নাশপাতি ইত্যাদি ফলের জন্য খুব বিখ্যাত ছিল। অবশ্য কাযাওয়ারের পানি সম্পর্কে আরবদের অভিযোগ ছিল যে, এই পানি পান করলে দেহ ফুলে যায়। এ শহর খোরাসান ও বসরার পথের সংযোগ স্থলে হবার কারণে একটি প্রসিদ্ধ ক্রয়-বিক্রয় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
মাহমূদ গযনবী এই রাজ্যকে ভারতবর্ষ আক্রমণের পথে প্রতিবন্ধক জেনে একেবারে ধ্বংস করে দেন যাতে করে শত্রুর বিপদাশঙ্কা চিরদিনের তরে তিরোহিত হয়ে যায়। এখন এ শহর আবার গুরুত্ব লাভ করছে। কেননা এর আশেপাশে খনিজ সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে।
ইরাক ও সিন্ধুর মধ্যবর্তী শাহী সড়ক
স্থলপথ— (১) ইরাক থেকে কিরমান, কসর কন্দ, পহলপুর, আস্কা, ওয়ার্কা, পন্ধগোর, (একে ফেজপুর এবং ভাজপুর নামেও ডাকা হয়), কীযকান (কালাত)—এখান থেকে কোয়েটার পথে কান্দাহার, অতঃপর দেবল। (২) কমরকুন্দ : কীয মাকরানের রাজধানী (কীয মাকরান—কীযে কিওয়ান)।
নৌপথ— বাগদাদ থেকে বস্রা, খার্ক উপদ্বীপ, লাওয়ান, চিনান, হরমুয, নারা, দেবল।
বিভিন্ন প্রকার জীব-জানোয়ার
ইরান প্রভৃতি দেশের সঙ্গে এই রাজ্যের ব্যবসায়-বাণিজ্য ছিল। এখানে দুই কুঁজওয়ালা উটের খুব চাহিদা ছিল। কৃষকেরা খুব আগ্রহ ভরে পরিশ্রম ও যত্ন সহকারে বহুল পরিমাণে তা পালতো। সিন্ধুর বাসিন্দারা আরবী ঘোড়া নিয়ে এসে নিজেদের দেশে উত্তম জাতের ঘোড়া পয়দা করত। এখানকার গাভী এবং মহিষও খুব প্রসিদ্ধ ছিল। ইরান, সিরিয়া ও ইরাকে এর খুব চাহিদা ছিল।
এ-ব্যবসায় ছিল জার্ট ও মিওদের হাতে। মুহাম্মদ বিন কাসিম জাট অধিবাসীদের একটি অংশকে কিরমান ও বসরায় জীব-জানোয়ারের বংশ বৃদ্ধির জন্য পাঠিয়ে দেন। তারা সেখানে বসতি স্থাপন করে। বর্তমানেও তাদের বংশধর সেখানেই বাস করছে। এজন্য এই এলাকায় বোঝা বহনের উত্তম জাতের পশু আজও অধিক পরিমাণে পাওয়া যায়।
মৌসুমী আবহাওয়া
আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, পাহাড়ী অর্থাৎ উত্তর এলাকায় শীতকালে মৌসুম শুষ্ক এবং খুবই ঠাণ্ডা হ’ত। এই মৌসুমে সাধারণত বরফপাত ও বৃষ্টি হয়ে থাকে। মাকরান ও বেলার প্রান্তর এলাকা খুবই শুষ্ক এবং গ্রীষ্ম মৌসুমে খুবই গরম। এখানে দিনের বেলা সফর করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
সিন্ধু উপত্যকায় শীত মৌসুমে ঠাণ্ডা পড়ে। কিন্তু এতটা নয়, যতটা হলে খারাপ লাগতে পারে। তথাপিও গ্রীষ্ম মৌসুমে নিম্ন এলাকায় মৌসুম খুবই গরম ও আর্দ্র থাকে। বর্ষাকালের পশুর মধ্যে এক ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। একে আজকাল ‘সারা’ বলা হয়। এ রোগ খুবই ধ্বংসাত্মক। মানুষও অধিকাংশ সময় জ্বর-জ্বালা ও আমাশয় রোগে আক্রান্ত হয়।
ভারতীয় ফৌজে সমরাস্ত্র
সিন্ধী ফৌজের নিকট উন্নত ধরনের তলোয়ার ছিল। তীর, ধনুক, বর্শা, ভালা এবং ঢাল ছাড়াও প্রায় সমস্ত সৈনিকের নিকটই সাধারণত লৌহ বর্ম থাকত। সিন্ধুতে রথের প্রচলন ছিল। অসংখ্য স্যাঁতসেঁতে নদী-নালা থাকার কারণে ফৌজে হাতীর সংখ্যা ছিল প্রচুর। এসব হাতীকে আক্রমণ ও দুর্গ ভেঙে ফেলার কাজে ব্যবহার করা হ’ত।
সিন্ধী অশ্বারোহী বাহিনীর কাছে সাধারণত তলোয়ার ও খঞ্জর থাকত। নেযা কিংবা বল্লমের রেওয়াজ খুব কম ছিল। আরোহী বাহিনী ঘোড়া কিংবা হাতীর পিঠে আরোহণ করত।
ভারতীয় সৈনিক
ভারতীয় সৈনিকরা আত্মোৎসর্গী ও নির্ভীক হ’ত। কিন্তু দুর্বল ও অযোগ্য সিপাহসালারের কারণে তাদের এই সাহসিকতা, বীরত্ব ও আত্মোৎসর্গের প্রেরণা অনেক সময় ভীষণ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াত।
ভারতীয় সিপাহসালার
ভারতীয় সিপাহসালাররা বিলাসী ও আরামপ্রিয় ছিল। অবশ্য স্বীয় মর্যাদা রক্ষার্থে জীবনের বাজী ধরাকে তাঁরা নিজ দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত মনে করত। সেনাপতির পদ সাধারণত শাহী প্রভাব ও সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল ছিল। এ ধরনের অধিনায়কের সামরিক যোগ্যতা ছিল খুবই নীচু মানের।
প্রতিরক্ষামূলক দৃষ্টিভঙ্গি
নিজেদের দুর্গের মযবুতী, রসদ-সম্ভার ও সমরাস্ত্রের প্রাচুর্যের কারণে ভারতীয় সেনারা খুবই অহংকারী ছিল। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষিপ্রতা, বিদ্যুৎবেগে হামলা এবং কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই অগ্রাভিযান পরিচালনা ইত্যদি জাতীয় সমস্যা নিয়ে তারা কখনো গভীরভাবে মাথা ঘামায় নি। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এই যে, যেহেতু আমরা কেল্লার মধ্যে দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ হয়ে বসে থাকতে পারি, তাই আক্রমণকারীরা ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে একদিন না একদিন পালিয়ে যাবেই।
হামলা
ঐসব কেল্লার ভিতরে অবস্থান করে তারা শত্রুর উপর চরকীর সাহায্যে পাথর নিক্ষেপ ও রেণ্ডীর তেলে ভেজা জ্বলন্ত মশাল ছুড়ে মারত। এ ধরনের অন্যান্য পন্থায়ও তারা হামলাকারীদের উপর অগ্নিবৃষ্টি বর্ষণ করত।
সিন্ধীরা হাতীর সাহায্যেও শত্রুর উপর আক্রমণ করতে জানত। হাতীগুলোকে লৌহ-বর্ম দিয়ে সুরক্ষিত করা হ’ত। হাতীর শুড়ের সঙ্গে দু’দিক দিয়ে তলোয়ার বেঁধে দেওয়া হ’ত এবং হাতী শুড় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আক্রমণ করে শত্রু ব্যুহ তছনছ করে ফেলত। এমনি ধরনের দু’ধারী তলোয়ারকে ‘কর্ণেল’ নামে অভিহিত করা হ’ত। এসব হাতীর শুড়কে সাধারণত রেশমী গেলাফ দ্বারা আচ্ছাদিত করে শত্রুর তলোয়ারের কোপ থেকে রক্ষা করা হ’ত।
প্রতিটি হাতীর সঙ্গে প্রায় ৫০০ পদাতিক ও আরোহী সৈনিক মোতয়েন করা হ’ত। হাতী শত্রু ব্যুহে ঢুকে পড়ে বিশৃংখলা সৃষ্টি করত এবং সৈনিকরা শত্রুর উপর তলোয়ার নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে তাদের কচু কাটা করে ছাড়ত।
প্রায় এমনি ধরনের পন্থা পাশ্চাত্যের দেশগুলো বিশ্বযুদ্ধে অবলম্বন করে ছিল। অর্থাৎ ট্যাংকের আড়ালে ও ছত্র ছায়ায় তাদের পদাতিক বাহিনী সামনে অগ্রসর হয়ে শত্রুর উপর ঝাপিয়ে পড়ত।
সিন্ধী ফৌজ
লড়াইয়ের মুহূর্তে বিভিন্ন সর্দার এবং রাজা নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে জমায়েত হ’ত। প্রকৃতপক্ষে এই ফৌজ সামগ্রিকভাবে সুসংহত, সুশৃংখল ও একাত্ম হতে পারত না। কেননা প্রতিটি সেনাবাহিনীতেই অশ্বারোহী বাহিনী, উষ্ট্রারোহী বাহিনী, হস্তী বাহিনী, পদাতিক সৈন্য থাকত যারা ছোট ছোট কোম্পানী ও ব্যাটেলিয়ানে বিভক্ত হয়ে লড়ত। অধিকাংশ সময় এমনও হয়েছে যে, ভারতীয় ফৌজে সাকুল্যে ২০ হাজার ঘোড় সওয়ার, ২০ হাজার উষ্ট্রারোহী, পাঁচশ’র মত হাতী এবং ৫০ হাজারের মত পদতিক বাহিনী থাকত, কিন্তু এরা ছোট ছোট গ্রুপে নিজ নিজ সর্দারের অধীনে বিভক্ত থাকার কারণে চরম মুহূর্তে পরস্পর থেকে ছিটকিয়ে পড়ত। রাজা দাহিরও এ ভুল করেছিলেন। তিনি তাঁর ফৌজকে সমবেত করতে চেষ্টা করেননি। এ ভুলের পরিণতি ও ফলাফল কি হয়েছিল তা আমরা যুদ্ধের ঘটনাবলীতে দেখব। এখানে আমরা বলতে চাই যে, শাসন-শৃংখলা, ব্যবস্থাপনা, বিন্যাস, প্রশিক্ষণ, চলাচল ও গতিবিধির যোগ্যতাকে যে অধিনায়ক সঠিকভাবে ব্যবহার করেন তিনি হামেশাই সফল হন।
এটা আশ্চর্যের ব্যাপার যে, রাজা দাহির নদী পথে নৌ-মাধ্যম ব্যবহার করেন নি। তিনি সিন্ধুনদের মাধ্যমে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশকে পরস্পরের সঙ্গে মেলাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি, বরং তাঁর রাজধানীকেও সিন্ধুনদের দুটি স্বতন্ত্র অংশে বিভক্ত করে রেখেছিলেন।
ফারুকী (রা) খিলাফত আমলে সিন্ধু এলাকার গোয়েন্দা রিপোর্ট
“সেখানকার পানি অগভীর, ফল বিস্বাদ এবং চোরেরা সাহসী ও বীর পুরুষ। ফৌজ যদি কম হয় তাহলে নষ্ট হয়ে যাবে আর বেশী হলে না খেয়ে মারা যাবে।”
হযরত ‘উছমান (রা)-এর খিলাফত যুগে জনৈক আরববাসীর একটি পত্র:
“আরে! তুমি মাকরান যাবে কি নিয়ে আসবার জন্য? সেখানে আছেই বা-কি! এটা এমন জায়গা যেখানে না যুদ্ধের মজা আছে, না আছে ব্যবসা-বাণিজ্যের। ওখানকার লোক ক্ষুধার্ত, আর অল্প-স্বল্প যা কিছু স্থান (সেনাছাউনী) আছে তা খুবই বিপজ্জনক।”
রাজা দাহিরের রাজ্যের কতিপয় মশহূর শহর
মুহাম্মদ বিন কাসিমের হামলার গুরুত্ব উপলব্ধি করবার জন্য সে সব শহরের সাথে পরিচিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন যে সব শহর তখনো ছিল এবং যে-গুলোর কিছু কিছু এখনো বিদ্যমান আছে।
ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এ অভিযান খুবই গুরুত্বের দাবীদার। আরবরা এ এলাকার উপর তিন শ’ বছরেরও অধিক কাল শাসন-কর্তৃত্ব চালায় এবং এ এলাকাকে ইসলামী রঙে এমনভাবে রঞ্জিত করে যে, তার প্রভাব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও অত্যন্ত সন্তোষজনক রূপে বিদ্যমান ছিল। মুহাম্মাদ বিন কাসিমের অভিযানের পর উক্ত এলাকার ইতিহাস অধ্যয়ন থেকে প্রমাণিত হয়, ‘ইসলাম তলোয়ারের জোরে বিস্তার লাভ করেছে’ শত্রুদের এ প্রচার-প্রোপাগাণ্ডা কত ভ্ৰান্ত ও ভিত্তিহীন। মুসলমানদের ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের হামলার সামনে ব্রাহ্মণদের জাতিভেদ প্রথা এবং অস্পৃশ্যদের সাথে তাদের নির্যাতনমূলক ব্যবহারের খারাপ দিকগুলো প্রকাশিত হয়ে পড়ে এবং ভারতীয় জাতিগোষ্ঠি দেখতে পায় উদারতা, সহিষ্ণুতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং ঈমানদারী কাকে বলে।
মুহাম্মদ বিন কাসিম বসরা থেকে সিন্ধু অভিমুখে রওয়ানা হন। বসরা ছিল ইরানের শাসনকর্তার রাজধানী। বর্তমানেও এটি ইরাকের একটি মশহূর শহর। পথিমধ্যে এরপর শীরায পড়ে। এটি তেজারতী কাফেলার বিখ্যাত কেন্দ্র এবং ইরানে অবস্থিত। বর্তমানেও এর গুরুত্ব যথেষ্ট, তবে বাণিজ্যিক দিক দিয়ে এখন খুব বেশী প্রসিদ্ধ নয়। এখান থেকে রাজা দাহিরের রাজ্যের সীমারেখা শুরু হয়।
১. ফীরোযপুর
ফীরোযপুর বা ভাজপুর যাকে আজকাল “পাঞ্জুগোর” বলা হয়—বর্তমানে মাকরান রাজ্যের রাজধানী। পায়ে চলা কাফেলা আজও এই রাস্তা দিয়ে মাকরান থেকে খেজুর নিয়ে আসে। শহরের আবহাওয়া বাকী এলাকার চেয়ে মাঝামাঝি রকমের এবং বেশ আরামদায়ক।
২. আরমল
সম্ভবত ইহা সেই শহর যা আজকাল দীবেজী নামে পরিচিত। কোন কোন ঐতিহাসিকের ধারণা, মুহাম্মদ বিন কাসিম এখান দিয়েই নদী পার হয়েছিলেন এবং এই রাস্তা ধরেই আজকাল পায়ে চলা কাফেলা কালাত ও কোয়েটা গমন করে। এ রাস্তা দিয়েই আজকাল পশম, দুম্বা ও বকরী সাবেক বেলুচিস্তান থেকে আসে।
৩. দেবল
রাজা দাহিরের আমলে এ শহর ছিল একটি বিখ্যাত বন্দর নগরী। অনুমান করা হয় যে, সেখানে আজকাল ‘ঘারো১’ নামে একটি ছোট পল্লী বিদ্যমান এবং ১৯৪৭ ঈসায়ীর পূর্বে এখানে যথেষ্ট পণ্য-সামগ্রী সমুদ্র পথে ইরান ও বাহরাইন থেকে আমদানী-রফতানী হ’ত। এখানকার হিন্দু বণিকেরা খুব ধনী ছিল। এখন আর এ শহরের অস্তিত্ব নেই।
ঘারোর ব্যাপারে অনুমান এ জন্য যে, ঐতিহাসিকেরা একে কুম্ভ নদীর নিকটবর্তী লিখেছেন এবং এ নদীকে সিন্ধুনদের শাখা বলেছেন। বর্তমানে এটি হায়দারাবাদের দক্ষিণ দিকে ৭৫-৮০ মাইল দূরত্বে অবস্থিত। এখানে রাজা দাহিরের যুগেও বেশীর ভাগ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী বণিক অবস্থান করত। এ নদী শত শত বছর ধরে নদী বাহিত পলিমাটির দ্বারা ভরাট হয়ে গেছে।
8. নীরূন
এখানে একটি মযবুত দুর্গ ছিল। এটা ছিল রাজা সুমানার রাজধানী। এ দুর্গ নদী পথে এবং সুস্তান, তুরান এবং মাকরানের স্থল পথে হবার কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দাদু এবং দুহালিয়া ছিল এর নিকটবর্তী কেল্লাঘেরা শহর। এখানকার রাজাসহ অধিকাংশ অধিবাসীই ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।
৫. সহওয়ান অথবা জীবন
এটা রাজা চন্দ্রের পুত্র রাজা বজ্রের রাজধানী ছিল। এ শহর রাজা দাহিরের চাচা তাঁর পুত্রকে এ-জন্য দিয়েছিলেন যাতে সে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এলাকার করদ রাজাদের উপর চাপ সৃষ্টি করে রাখে। কিন্তু এখানকার বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী অধিবাসীরা বজ্ৰ ও তার ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট ছিল।
তাই যুদ্ধ কালে তারা সঙ্গত কারণেই তাদের রাজার সঙ্গে বিশ্বস্ততার পরিচয় দেয়নি। মুহাম্মদ বিন কাসিম যখন ইসলামী মূলনীতি অনুযায়ী তাদের উপাসনালয়ের প্রতি উদারতা প্রদর্শন করেন এবং তাদের ধর্মীয় পুরোহিতদের সাথে সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করেন তখন আশেপাশের বাসিন্দারা স্বতস্ফূর্তভাবে তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে এবং তাঁর অগ্রাভিযানেও সহায়তা প্রদান করে।
৬. সহওয়ান
যদি আমরা কোটরী থেকে কোয়েটার দিকে রেলপথে যাই তাহলে এ শহর পথে পড়বে। আজকাল এটি সিন্ধুর দাদু জেলায় অবস্থিত। মুহাম্মদ বিন কাসিমের হামলার সময় কুম্ভনদী এ শহর থেকে ১০ মাইল দূরত্বে ছিল। আজকাল এখানে একটি রেলওয়ে স্টেশন আছে।
৭. সীম অথবা সিব্বী
আজকাল এটা সিব্বী নামে পরিচিত। কচ্ছ নদীর একটি শাখার উপর ছিল এর অবস্থান। রাজা কাকার পুত্র বুদ্ধ এখানকার করদ রাজা ছিলেন। এটি বুদ্ধিয়া এলাকার কেন্দ্র ছিল। আজকাল শীত মৌসুমে বেলুচিস্তানের রাজধানী এখানে স্থানান্তরিত হয়ে থাকে।
৮. সিবী
সিবী থেকে মুহাম্মদ বিন কাসিম তন্দাবীল, ইশহার, জাহ্ম এবং কোটালের শহরগুলো জয় করতে করতে ঠাঠ গিয়ে পৌঁছেন। ঠাঠকে আজকাল ঠাঠ্টা বলা হয়। এ শহর পরবর্তীকালে (মুসলিম শাসকদের আমলে) রাজধানীও ছিল। এখানে আবিষ্কৃত বহু বিখ্যাত ধ্বংসাবশেষ এর ঐতিহ্যমণ্ডিত অতীতের সাক্ষ্য দিচ্ছে।
৯. সাকেরাহ
আজকাল মীরপুর সাকরো নামে পরিচিত। এখানে বহুদিন পর্যন্ত মুহাম্মদ বিন কাসিমের ছাউনী ছিল। এর নিকট দিয়েই মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুনদ পার হয়েছিলেন। এ এলাকা খুবই উর্বর।
১০. ভেট
সিন্ধু নদের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। এটি খুব উর্বর ও জনবহুল এলাকা ছিল। কিন্তু বর্তমানে অনুর্বর ও ঊষর এলাকায় পরিণত হয়েছে।
১১. নারানী অথবা নারায়ণ
এর অবস্থান সম্ভবত নওয়াব শাহ ও খায়েরপূরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে ছিল। গোরী, ওয়াহ অথবা জয়পুরও এই অঞ্চলেই কোথাও ছিল।
১২. রাওর, আরোর বা আলোর
রাজা দাহিরের রাজধানী ছিল। অনুমানের উপর ভিত্তি করে একে রোহড়ীও বলা যেতে পারে। রাজা দাহিরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ফেনীর নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। এ শহরের আলোচনা আমরা আগামীতে করব।
১৩. সুকরালীদ
মেদ-এর পুল; আজকাল শুক্কুর নামে পরিচিত। শুক্কুরের পুল বর্তমানেও প্রতিরক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঈসায়ী ৭১২ সনের জুন মাসে মুহাম্মদ বিন কাসিম এই পুল দিয়ে সিন্ধুনদ পার হয়েছিলেন।
১8. বাহারো
এর অবস্থান এখন অজানা। সে যুগের বিখ্যাত শহর এবং কেল্লা ছিল। দহলীলা ও কেল্লাবন্দ একটি বিখ্যাত শহর ছিল।
১৫. বাহ্মনাবাদ অথবা বাহমনওয়া
লোহানা সম্প্রদায়ের রাজার রাজধানী। সম্ভবত বর্তমান নারা নদীর তীরে ছিল এর অবস্থান। মীর খাসের নিকটে কোথাও এই বসতি থাকা সম্ভব। প্রতিরক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে এ শহর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কেননা কাথিয়াওয়াড় এবং গুজরাটের প্রান্তর পথে এ শহর ছিল তত্ত্বাবধায়ক। এ গুরুত্ব বর্তমানে মীরপুর খাস লাভ করেছে।
১৬. বাহরা
বাহরার দিকে মুহাম্মদ বিন কাসিম যখন পুনরায় প্রত্যাবর্তন করেন তখন ৯ই অক্টোবর, ৭১২ ঈসায়ীতে পার্শ্ববর্তী এলাকার মিঠাল, সুমাসনও, লোহানা সুইটাসের বাশিন্দারা নিজেরা স্বতঃস্ফুর্তভাবেই তাঁর অধীনতা স্বীকার করে নেয়।
১৭. স্কালিন্দাহ
মুলতানের রাস্তায় একটি মশহূর কেল্লা ছিল।
১৮. মুলতান
এটি একটি বিরাট প্রদেশের রাজধানী ছিল। মুহাম্মদ বিন কাসিম এখানে বিরাট পরিমাণ গুপ্তধন পান। মুলতানের নিকট শিখা নামে একটি বিরাট কেল্লা ছিল। আজকাল মুলতান একটি বিরাট বড় শহর।
১৯. বাবিয়া
মুলতান থেকে মুহাম্মদ বিন কাসিম বিপাশা নদীর তীরে অবস্থিত বাবিয়ার দিকে অগ্রসর হন এবং ফিরবার পথে ভীলম্যান অর্থাৎ গুজরাটের কাথিয়াওয়াড়-এর দিকে যান।
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
- জেনারেল হেগ সিন্ধু নদের জলস্রোতের নদীপথ গভীরভাবে পরীক্ষা করেছেন! তাঁর ধারণা, শত শত বছর ধরে নদী-বাহিত পলিমাটির দ্বার ঘারো নদীর গভীরতা কমে গেছে। এজন্য বন্দর হিসাবে এর প্রসিদ্ধি আর তেমন নেই। তাঁর ধারণা মতে, সিন্ধু নদের পূর্ব-নদী সম্ভবত বর্তমান নার নদী কচ্ছ উপসাগরে (Bay of Kutch) গিয়ে পড়ত। আমি এই নদীর তীর এবং রান অব কচ্ছ পর্যন্ত সফর করে দেখেছি এবং আমিও জেনারেল হেগের সঙ্গে একমত যে, এ নদী শুক্কুর বাঁধের পূর্বেই গুরুত্বের দাবীদার ছিল। যেখানে এই নদী কচ্ছ উপসাগরে গিয়ে পড়ত, সেখানে একটি বিরাট হ্রদ ছিল। এ-এলাকার পাহাড়ী অংশে নগর পারকার শহর অবস্থিত। এখানে সুলতান মাহ্মুদ গযনভী নির্মিত একটি মসজিদ অদ্যাবধি বর্তমান! এই হ্রদের নিকট দিয়ে আলেকজাণ্ডার সিন্ধু নদ পার হয়ে ছিলেন। সোমনাথ বিজয়ের পর সুলতান মাহ্মূদ এ রাস্তা দিয়েই প্রত্যাবর্তন করেছিলেন এবং এখানেই জাটেরা তাঁকে উত্যক্ত করে তুলেছিল। এ মসজিদের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ৯০% ভাগ হিন্দু ঠাকুরের বাস এবং তারা আল্লাহ্র এই ঘরের দেখাশোনা খুবই ভক্তি-শ্রদ্ধার সঙ্গে করে থাকে। তারা গভীরভাবে বিশ্বাস করে যে, মসজিদের গাছের পাতা খেলে সব রকমের রোগ-ব্যাধির নিরাময় হয়।