» » ভাগ্য-বিড়ম্বিত লেখক-সম্প্রদায়

ভাগ্য-বিড়ম্বিত লেখক-সম্প্রদায়[১]

সেদিন গুণে দেখলাম—সত্যিকার সাধনা যাঁরা করেন, সাহিত্য যাঁদের শুধু বিলাস নয়, সাহিত্য যাঁদের জীবনের একমাত্র ব্রত, বাঙলাদেশে তাঁরা ক’জনই বা, সংখ্যা আঙুলে গোণা যায়।

এই-সব সাহিত্যসেবী অক্লান্ত পরিশ্রম করে অনাহারে অনিদ্রায় দেশের জন্য দশের জন্য সাহিত্য সৃষ্টি করেন, সে সাহিত্য শুনেছি নাকি জন-সমাজের কল্যাণ করে, কিন্তু তার কি মূল্য আমরা দিয়ে থাকি?

এই যে সব সাহিত্যিক দেশের জন্য প্রাণপণ করেছেন, তাঁদের পুরস্কার হয়েছে শুধু লাঞ্ছনা আর দারিদ্র। প্রভূত ধন-সম্পত্তি অর্জন করে, বিত্তশালী ধনবান হতে তাঁরা চান না, তাঁরা চান শুধু একটুখানি স্বচ্ছন্দ জীবন, সর্বনাশা দারিদ্র্যের নিদারুণ অভিশাপ থেকে মুক্তি, তাঁরা চান শুধু নিশ্চিত নির্ভাবনায় লিখবার মত একটুখানি অনুকূল আবহাওয়া, অথচ তাঁরা তাও পান না। আজীবন শুধু ভাগ্য-বিড়ম্বিত হয়েই তাঁদের কাটাতে হয়, যাদের কল্যাণ কামনায় তাঁরা জীবন উৎসর্গ করলেন তারা একবার সেদিকে ফিরেও তাকায় না।

দেশের লোক তাঁদের দেয় না কিছু, অথচ, তাঁদের কাছ থেকে চায় অনেক। কোথাও কেউ যদি এতটুকু খারাপ লেখা লিখেছে, অমনি তীব্র সমালোচনার বিষে আর নিন্দার তীক্ষ্ণ শরে তাঁকে জর্জরিত হতে হয়।

এই অতিনিন্দিত গল্প-লেখকদের দৈন্যের সীমা নেই। এঁদের লেখা পড়ে জনসাধারণ আনন্দ লাভ করে সত্য, কিন্তু তাঁদের ঘরের খবর নিতে গেলে দেখতে পাবেন—এই-সব লেখক-সম্প্রদায় কত নিঃস্ব, কত অসহায়। অনেকেরই উপন্যাসের হয়ত দ্বিতীয় সংস্করণ হয় না।

কিন্তু কেন?

এর একমাত্র কারণ, আমাদের দেশের লোক বই পড়েন বটে, কিন্তু পয়সা খরচ করে কিনে পড়েন না। এমন কথা হয়ত উঠতে পারে যে, আমাদের দেশের জনসাধারণ দরিদ্র, বই কেনবার সামর্থ্য তাঁদের নেই। কিন্তু সামর্থ্য যাঁদের আছে, এমন অনেক বড়লোকের বাড়িতে আমি নিজে গেছি, গিয়ে দেখেচি, তাঁদের আছে সবই, গাড়ি আছে, বাড়ি আছে, বিলাস-ব্যসনের সহস্র উপকরণ আছে, নেই কেবল বই। পয়সা খরচ করে বই কেনা তাঁদের অনেকের কাছেই অপব্যয় ছাড়া আর কিছু নয়।

অথচ গল্প-লেখকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের আর অন্ত নেই। সম্প্রতি একটা কথা শুনছি, ভাল লেখা তাঁরা লিখছেন না। কেন লিখছেন না আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করেন ত আমি বলব—শক্তি যাঁদের আছে অর্থের অভাবে দারিদ্র্যের তাড়নায় আজ তাঁরা এমনি নিষ্পেষিত যে, ভাল কিছু লিখবার ইচ্ছা থাকলেও অবসর বা স্পৃহা তাঁদের নেই।

এর প্রতিকার সর্বাগ্রে প্রয়োজন। সর্বাগ্রে আমাদের দেশের সাহিত্যিকদের অভাব-মোচনের ব্যবস্থা করতে হবে, ভাল লেখা যাতে তাঁরা লিখতে পারেন তার অনুকূল আবহাওয়ার সৃষ্টি করতে হবে। তবেই বাংলা সাহিত্য বাঁচবে, নইলে অচির-ভবিষ্যতে কি যে তার অবস্থা হবে, ভগবানই জানেন।

আমাদের দেশের বড়লোকেরা অন্ততঃ কর্তব্যের খাতিরেও যদি একখানা করে বই কেনেন তা হলেও বা এর প্রতিকারের কিছু ব্যবস্থা হয়। বই না কিনেও অনেক রকমে তাঁরা সাহায্য করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারেন। কিন্তু তা তাঁরা করবেন কি?

আগেকার দিনে বড় বড় রাজারাজড়ারা সভাকবি রেখে কবি, সাহিত্যিকের বৃত্তির ব্যবস্থা করে অনেক রকমে দেশের সাহিত্যকে বড় হবার সুযোগ দিতেন। আজকাল তাও নেই।

শখের সাহিত্যিকদের কথা আমি বলচি না। ভগবানের কৃপায় অন্নের সংস্থান যাঁদের আছে, সাহিত্য যাঁদের বিলাসের সামগ্রী, তাঁদের কথা স্বতন্ত্র। তাঁরা হয়ত বলবেন—অন্নচিন্তাটা ভাল্‌গার, সুতরাং সাহিত্যের শ্রী ওতে নষ্ট হবে, সে চিন্তা পরে করলেও চলবে।

পরে চিন্তা করলেও যাঁদের চলে তাঁরা তাই করুন, তাঁদের কথা এখানে তুলব না। আমি শুধু সেই-সব দুর্ভাগাদের কথাই বলছি—যাদের অস্থিতে মজ্জায় সাহিত্যের অত্যুগ্র বিষের ক্রিয়া শুরু হয়েছে, সাহিত্যসৃষ্টি যাদের জন্ম-অধিকার, যাদের রক্তের মধ্যে সৃষ্টির উন্মাদনা।

এই-সব উন্মাদেরা সহস্র দারিদ্র্য-লাঞ্ছনার মধ্যে বসেও লিখবে আমি জানি। না লিখলে তারা বাঁচবে না। তাই যতদিন তারা বেঁচে থাকে তাদের মুখে দু-মুঠো অন্ন তুলে দিতে চাই। এই-সব পরার্থে উৎসর্গীকৃত জীবনের শিখা অন্নাভাবে অকালে যদি নির্বাপিত হয়ে যায়—দেশের কল্যাণ তাতে হবে না, এইটুকু আজ আপনারা জেনে রাখুন।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. ‘বাতায়ন’ ২৭শে ফাল্গুন, ১৩৪৪ শরৎ-স্মৃতি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়; প্রকৃতপক্ষে এই রচনাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৪২ বঙ্গাব্দের ভাদ্র কি আশ্বিন (‘শনিবারের চিঠি’ কার্তিক ১৩৪২ সংখ্যা, পৃষ্ঠা ১০৮-১১০) মাসে। এটি ‘মোয়াজ্জিন’ মাসিক পত্রে স্থান লাভ করেছিল বলে মনে করা হয়। ‘শরৎচন্দ্রের পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত রচনাবলী’র অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রথম প্রকাশিত হয় শ্রাবণ, ১৩৫৮ সালে এবং পরবর্তীতে ‘শরৎ সাহিত্য-সংগ্রহ’, অষ্টম সম্ভারে সঙ্কলিত হয়।