নারীর লেখা

নাক ডাকিতেছিল বলিয়া জাগাইয়া দিলে পুরুষমানুষ অপ্রতিভ হইয়া পাশ ফিরিয়া শোয়। মুখে স্বীকার করে না,—হয়ত বা, মনে মনে রাগও করে। এবং মিনিট-দুই পরেই এ-পাশ ফিরিয়া যাহা করিতেছিল ও-পাশ ফিরিয়াও তাহাই করিতে থাকে। এটা পুরুষের স্বভাব। কিন্তু স্ত্রীলোক একেবারে মারিতে আসে। দিব্যি করিয়া বলে, কক্ষণ না; যে যাই বলুক ও-দোষটি তাহার নাই—নাক তাহার ডাকিতেই পারে না। অতঃপর তর্ক নিষ্ফল। করিলে কলহ হয়—আর কিছু হয় না। ঘুমন্ত অবস্থায় একটুখানি শব্দ করিয়া শ্বাস গ্রহণ করিয়াছিল বলায় যে মারাত্মক অপবাদ দেওয়া হয় না, এ কথা স্ত্রীলোক অপরের বেলায় যত সহজেই বুঝুক নিজের বেলায় বোঝে না। এটি তাহাদের স্বভাব।

সুতরাং, আমার বক্তব্য যদি তাহাদের নিকটে অবোধ্য রহিয়াই যায়, তাহাতে বিশেষ আশ্চর্য হইব না। ইহার প্রায় জোড়া আর একটা ব্যাপার আছে—সেটা অনুকরণ করা। পূর্বেরটা শরীরের ধর্ম, পরেরটা মনের। অতএব, অনিচ্ছাতেও যেমন নাক ডাকে, ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও তেমনি অনুকরণ করা হয়। ‘ডাকানো’ অর্থে যেমন ইচ্ছা করিয়া ডাকান নয়, ‘অনুকরণ করা’ মানে ইচ্ছা করিয়াই করা এমন অর্থ না হইতেও পারে। অথচ, নাক ডাকিতেছিল বলিলে খুশী হই না, কেন করিতেছিলাম দেখাইয়া দিলেও কৃতজ্ঞতায় বুক ভরিয়া উঠে না। এসব জানি, কিন্তু একটু সতর্ক হইয়া পাশ ফিরিয়া শোওয়া কি উচিত নয়? এখন কথা যদি উঠে, এ দুইটার কোনটার উপরে সত্যই যদি হাত নাই, এবং ইচ্ছা করিয়াও করি না, এবং দেহ-মনের ইহারা অতি স্বাভাবিক ক্রিয়াই হয়, তবে লজ্জা পাওয়াই বা কেন, আর লজ্জা দেয়ই বা কে! অবশ্য, লজ্জা পাওয়া না-পাওয়া স্বতন্ত্র কথা, কিন্তু লজ্জা দিবার অধিকার তাহার আছেই, যে ব্যক্তি তখনও জাগিয়া আছে এবং ডাকের জ্বালায় ব্যতিব্যস্ত হইয়া বিশ্রামের অবসর পাইতেছে না। সুতরাং, স্বেচ্ছায় করিতেছি না বলিলেই সংসারে সব জিনিসের যে জবাবদিহি হয় না, এ কথা তাহাকে বলিয়া দেওয়া আবশ্যক, যে লোক ঘুমাইতেছে এবং যে লোক নকল করার মধ্যে একেবারে মগ্ন হইয়া গিয়াছে। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, শ্বাস-প্রশ্বাসের চলিত প্রথাটা অতিক্রম করিয়া গেলেও লোক বিরক্ত হয়, এবং ভাল জিনিসের অনুকরণ কর্তব্য এবং স্বাভাবিক হইলেও তাহার নির্দিষ্ট সীমা ডিঙাইয়া গেলেও লোকে নিন্দা করে।

ভাল’র অনুকরণ করিও না, এমন কথা বলিবার অধিকার নিশ্চয়ই কাহারো নাই। কিন্তু, “আর না,—থামো!” এ কথা বলিবার অধিকার সমাজের লোকের আছেই। একটা দৃষ্টান্ত দিই,—

মিসেস বিশ্বাসের পোশাকের কাট-ছাঁট অতি চমৎকার। তেমনি পোশাকে নিজেকে সজ্জিত করিতে দোষ নাই, কিন্তু তাঁর কোমরের ঘেরটা হয়ত সওয়া-তিন হাত। গাউনে কাপড় লাগে সাড়ে-দশ গজ। হুবহু নকল করিব বলিয়া তোমার কাঠপানা দেহে ঠিক ঐ সাড়ে-দশগজি গাউন জড়াইয়া পথে বাহির হইলে লোকে হাসিবে বৈ কি! ভাল জিনিসের অনুকরণ করিতে গিয়া তুমি ভাল কাজেরই সূত্রপাত করিয়াছিলে মানি, কিন্তু অনুকরণের নেশায় এমনি মাতিয়া গেলে যে, নিজের দেহটার পানেও একবার চাহিয়া দেখিলে না! ইহাতে তোমার যে শুধু নকল করিবার সদুদ্দেশ্যটাই নিষ্ফল হইয়া গেল তাহা নহে, তোমার নিজের সৌন্দর্যও গেল, তোমার কাপড়ের দাম ও মজুরি নষ্ট হইল। পথের লোকের ‘বাহবাটা’ ত ফাউ। রবিবাবুর লেখা খুব ভাল। তাঁকে নকল করার ইচ্ছাও স্বাভাবিক, এবং করিবার চেষ্টাও সাধু। কিন্তু, একেবারে রবিবাবুই হইবে এমন পণ করিতে গেলে চলিবে কেন? দেখিতে পাওয়া উচিত যে, তোমার গায়ে তাঁর সাড়ে-দশগজি গাউন সার্কাসের ঐ কাহাদের মতই মানাইয়াছে। তাঁর লেখার দোষই বল, আর গুণই বল, পড়িলেই মনে হয় এ ত খুব সোজা। লিখিলে আমিও এমন পারি। তাঁর উপমাগুলা এতই স্বাভাবিক এবং সরল যে দেখিবামাত্রই মনে হয়— বাঃ—এ ত আমিও জানি—উপমা দিবার প্রয়োজন হইলে ঠিক এইটি ত আমিও দিতাম। কিন্তু ভ্রান্ত অনুকরণ-প্রয়াসীরা ভাবিয়াও দেখে না যে, কোহিনুরের নকল হয় না—টেটের ডায়মন্ড হয়। আসলটা পাইলে সাত পুরুষ রাজার হালে বসিয়া খাইতে পারে, নকলটার দামে একবেলার বাজার খরচও চলে না।

রবিবাবু কতকগুলা শব্দ প্রায়ই ব্যবহার করেন। সেইগুলা এবং তাঁহার উপমা ও লিখিবার প্রণালী আজকালকার সাহিত্যসেবী নর-নারীরা কিরূপে যে বিকৃত করিতেছেন, তাহা দেখিলে ক্লেশ বোধ হয়।তিনি যাঁহাদের গুরু, তাঁহাদের উচিত তাঁকে বুঝিবার চেষ্টা করা, তাঁকে শ্রদ্ধা করা। ভিতরে ভিতরে ইঁহারা শ্রদ্ধা করেন কিনা, এ কথা অবশ্য বলিতে পারি না; কিন্তু বাহিরে ভ্যাঙচানির চোটে গুরুজীর হাড় পর্যন্ত যে কালি হইবার উপক্রম হইয়াছে, সে কথা বাজি রাখিয়া বলিতে পারি। সে বেচারা যাই বলেন, ব্যাঘ্র! তাঁর ভক্তেরা অমনি ছুটিয়া আসিয়া দুই হাত নাড়িয়া বুঝাইয়া দিয়া যায়—অর্থাৎ, শার্দুল! দুই-একটা নজির দিতেছি। অবশ্য পুরুষদের কথা বলিতে চাহি না।

তাঁহাদের কথা তাঁহারাই বলিবেন—এবং মাঝে মাঝে কেহ বলেনও, কিন্তু ঐ পর্যন্ত। ঐ ডান পাশ আর বাঁ পাশ। আমি শুধু দুই-একটি মহিলা সরস্বতীর কথা উল্লেখ করিয়াই ক্ষান্ত হইব।

আজকাল যাঁহারা বড় লিখিয়ে হইয়া উঠিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে শ্রীমতী আমোদিনী ঘোষজায়া, অনুরূপা ও নিরুপমা দেবীর নাম প্রায় সকলেই জানেন। ইঁহাদের অজস্র গদ্য পদ্য কোন একখানা মাসিক হাতে তুলিয়া লইলেই দেখিতে পাওয়া যায়। আজ ইঁহাদের কথাই বলি। শ্রীমতী ঘোষজায়ার লেখা নাকি রবিবাবুর লেখা বলিয়া অনেকের ভ্রমও হয়। অবশ্য ভ্রমের হেতুও আছে।

আমি পূর্বেই বলিয়াছি, রবিবাবুর সত্য অনুকরণ যত কঠিনই হউক, বিকৃত করা খুব সহজ। ও আর কিছু নয়—আমার নিম্নলিখিত এই তালিকাটি মুখস্থ করিলেই হইবে। যদি মুখস্থ না হয়, বড় বড় অক্ষরে লিখিয়া টেবিলের সম্মুখে টাঙাইয়া দিয়া নিজের রচনার মধ্যে মধ্যে এক একটা প্রবেশ করাইয়া দিলেই কাজ হইবে। হরির লুটের বাতাসা কোঁচড়েই পড়ুক, আর পায়ের নীচেই পড়ুক, নিষ্ফল হইবে না। মুখস্থ করুন—পরিণতি, বিশ্ব, মানব, দেহান্বয়, ভূমিষ্ঠ, গরিষ্ঠ, মুখর, চাই-ই, বনস্পতি, প্রয়োজন হইয়াছে, ফাঁকি, দৈন্য, পুষ্টি-সাধন, দেবতা, অমৃত, শ্রেয়, ভূমা, আশীর্বাদ, অর্ঘ্য, আবহমানকাল, শ্রেষ্ঠ, বাণী, খাঁটি, ভারতবর্ষ, নিষ্ঠা, জাগ্রত, জন্মস্বত্ব, দিন আসিয়াছে, তপশ্চর্যা, বৈরাগ্য, শ্রদ্ধা, যো-নাই, খাটো, পাৎলা, ডাক পড়িয়া গিয়াছে, মুক্তির আনন্দ ও ত্যাগের আনন্দ। বাস, এই কয়টিই যথেষ্ট। একটা রচনার মধ্যে সব ক’টা ব্যবহার করিতে পার উত্তম, না পার ভূমা, অর্ঘ্য, দেবতা, বৈরাগ্য ও ভারতবর্ষ এই পাঁচটি চাই-ই। অন্যথা রচনাই নয়। এখন কেহ যদি অবিশ্বাস করিয়া বলেন, তা কি হয়? শব্দগুলা যদৃচ্ছা গুঁজিয়া দিলে লোকে ধরিয়া ফেলিবে যে! ইহার উত্তরে আমার নজির দেওয়া ছাড়া আর উপায় নাই। গত অগ্রহায়ণের ভারতীতে শ্রীমতী আমোদিনী ঘোষজায়ার আট পাতা জোড়া এক প্রবন্ধ বাহির হইয়াছিল। নাম ‘মনুষ্যত্বের সাধনা’। টাইটেল দেখিয়াই ‘বাপ্‌রে!’ করিয়া উঠিলে চলিবে না। ভক্তি করিয়া পড়া চাই। আমার তালিকার প্রায় সকল শব্দগুলাই ইহাতে আছে, সুতরাং ইহা খুব ভাল, এবং শিক্ষা হইবে। তবে, অভিধানের সাহায্যে সবটুকু পড়িয়া কেহ যদি শেষকালে বলেন, এই আট পাতার ত আট ছত্রেরও মানে হয় না, তাহা হইলে আমি চুপ করিয়া থাকিব বটে, কিন্তু কবুল করিব না, এবং মনে মনে রাগ করিয়া বলিব, তবু তোমার শিক্ষা হইল ত!

যাহা হউক, আমি নজির দিব বলিয়াছি, কিন্তু সমালোচনা করিব বলি নাই। সমালোচনা করা পণ্ডশ্রম। আমি বলিব, তোমার রচনার মানে নাই; তুমি জবাব দিবে, ‘আছে’। আমি বলিব, এই জায়গাটায় বাড়াবাড়ি করিয়াছ; তুমি বলিবে, ‘একটুও না; এমন না করিলে লেখা ফুটিত না’। আমি বলিব, ‘এই স্থানটার আর একটু প্রকাশ করা উচিত ছিল’; তুমি বলিবে, ‘নিশ্চয় না; আর প্রকাশ করিতে গেলে আর্ট মাটি হইয়া যাইত।’ বাস্তবিক, এ-সব তর্কের মীমাংসা হয় না। একেই লেখা বলে এই বিবেচনার উপরেই লেখকের যথার্থ কৃতিত্ব নির্ভর করে। সমালোচনা করিয়া দোষ-গুণ দেখাইয়া নিন্দা বা সুখ্যাতি করা যায় বটে কিন্তু আর কোন কাজ হয় না।

যাহা হউক, যাহা বলিতে চাহিয়াছিলাম তাহাই বলি। উক্ত প্রবন্ধে শ্রীমতী ঘোষজায়া বলিতেছেন, “ভারতবর্ষ অকস্মাৎ আজ স্বপ্ন হইতে জাগিয়া দেখিতেছে, যে জনপদের পথ ধরিয়া সে চলিতেছিল তাহা প্রকৃত নয়, মায়া সৃষ্টি মাত্র, অকস্মাৎ আজ তাহা দিগন্তবিলীন বাণীর ভিতর কোথায় মিলিয়া গিয়াছে।” ভাষা বটে! জনপদের পথ দিগন্তবিলীন বাণীর মধ্যে মিশিয়া গেল! জিজ্ঞাসা করি, রবিবাবু কোথাও কি এমনি করিয়া ‘বাণীর’ শ্রাদ্ধ করিয়াছেন? কিছুদিন পূর্বে লেখিকা ‘বিকাশ’ পত্রিকায় একটি দশ-বারো লাইনের কবিতায় ‘ব্যোম’ -এর সঙ্গে মিলাইবার জন্য ‘শশি সূর্য্য সোম’ লিখিয়াছিলেন। কবিতার কথা না হয় নাই ধরিলাম—কেন না, ‘ব্যোম’-এর ‘ম’ ‘সোম’ ছাড়া মিলিতে চায় না। ‘শশী’টিকেও বাদ দিলে অক্ষর কম পড়ে। কিন্তু, জনপদের পথের ত অমন কোন ধনুকভাঙ্গা পণ ছিল না যে, ঐ ‘বাণী’টি না পাইলে আর মিলিত না! কবিকে অঙ্কুশ দেখাতে নিষেধ আছে তাহা মানি, কিন্তু তার্কিক যখন ঘর ছাড়িয়া লাঠি-হাতে মারিতে আসে তখনও যে একটুখানি আত্মরক্ষার চেষ্টা করিতে নাই এ কথা মানি না। সেটা ‘কাব্যি’! কিন্তু এটা যে দার্শনিক প্রবন্ধ! দার্শনিক প্রবন্ধ যখন এক শ’ টাকা দাবী করে, তখন সে ঐ ক্ষুদ্র তিনটি অক্ষরের ‘এক শ’ টাকাই চাই, তাহাকে ‘নব-নবতি রজত-মুদ্রা’ দিতে গেলে সে হাত পাতিয়া গ্রহণ করে না। কিন্তু আসল কথা এই যে, ‘বাণী’ রবিবাবু লেখেন, সুতরাং সেটা চাই-ই।

যদিও নাটক-নভেলে অত দোষ নাই, তথাপি অনুরূপা ‘পোষ্যপুত্রে’ লিখিলেন “পথে শব্দ মুখর হইয়া উঠিল” তখন ‘শব্দ’ শব্দায়মান হইয়া উঠিল বলা নিশ্চয়ই তাঁহার অভিপ্রায় ছিল না, কিন্তু ‘মুখর’ কথাটার ঠিক মানেটাও ত তাঁর জানা উচিত ছিল। জোর করিয়া ‘নির্লজ্জ’ অর্থ করার চেয়ে বরং বলা ভাল, “কি করিব ওটা যে আমার চাই-ই। ওটা মহতের ইত্যাদি।”

শ্রীমতী অনুরূপা আর একস্থানে লিখিতেছেন—“ক্ষেত্র কর্ষিত হইলে শস্য দান করে, পতিত থাকিলে কণ্টক-গুল্মের আবাসভূমি হয়। সুতরাং ভারতবর্ষের নৈতিক ক্ষেত্রও আকর্ষণে যে কণ্টক-গুল্মে আচ্ছন্ন হইয়া উঠিবে, ইহা কোন স্বভাব-বিরুদ্ধ ব্যাপার নহে। বনস্পতি এ-কাননে পূর্বে বিদ্যমান ছিল বটে, কিন্তু এখন তাহা বল্মীক ও লতাস্তূপে এমন করিয়া ঢাকিয়া পড়িয়াছে, তাহাকে আর চিনিয়া বাহির করিবার বুঝি কোন উপায় নাই।” ছিল ক্ষেত্র এবং শস্য, আসিল কানন ও বনস্পতি। তা আসুক—ক্ষেত্র না হয় বন-জঙ্গল হইতেও পারে, কিন্তু কোন শস্যকেই ত বনস্পতি হইয়া উঠিতে দেখিলাম না। এদিকে ত হয় না—ও-দিকে হয় কিনা বলিতে পারি না। ওদিকে বোধ করি হয় না; কিন্তু ‘বনস্পতি’টি যে চাই-ই। কিন্তু, আমি বলি চাহিবার পূর্বে ও জিনিসটা যে মটর-কলায়ের গাছ নয়, এটা ত জানা উচিত ছিল। এই মহতের আশ্রয় ধরিতে গিয়া অনুরূপা একস্থানে লিখিলেন, “ভূমার সঙ্গে ভূমির, ক্ষুদ্রের সঙ্গে মহতের এই যে যোগ!” অর্থাৎ, ছোট্ট ভূমিটি মহৎ ভূমির সঙ্গে যুক্ত হইতেছে। ‘ভূমা’ কথাটা যে ব্যবহার করা আবশ্যক, আমি তাহা অস্বীকার করি না, কিন্তু কোন্‌টি ক্ষুদ্র, কোন্‌টি মহৎ সে সংবাদটাও কি বই লেখার পূর্বে অনুসন্ধান করা আবশ্যক ছিল না?

১৩১৭ সালের আষাঢ়ের ভারতীতে ‘প্রাচীন ভারতের পূজায়’ শ্রীমতী ঘোষজায়া লিখিয়াছেন,—“আত্মসম্মানের সঙ্গে আত্মসম্মানের সঙ্গে আত্মদানের একটা সাদৃশ্য আছে, এই সাদৃশ্য-সঙ্কট এড়াইবার জন্য, ভারতবর্ষের ধর্মনীতি আত্মসম্মানকে দূরে রাখিয়া আসিয়াছে। ফল যখন পাকে, তখন আপনা হইতেই বোঁটা ছাড়িয়া পড়ে, পাকাইবার জন্য তাহাকে বৃন্তহীন করিলে তাহা বিকৃতই হয়, পরিণত হয় না।” আমি আজ পর্যন্ত বুঝিতে পারিলাম না, এই ‘বোঁটাছাড়ার’ উপমাটির যোগ কাহার সঙ্গে। মৌলিক না হইলেও স্বতন্ত্রভাবে উপমাটি খুব ভাল তাহা স্বীকার করি, কিন্তু এই আগাগোড়া পরিপূর্ণ সুখ্যাতির মধ্যে ভাল যে এখানে সে কাহার করিতেছে তাহা বুদ্ধির অগোচর। “বাবলার মত সর্ববিসারি গুল্ম”টার ন্যায় ‘অহং’ জিনিসটাকে বারংবার নিন্দা করিয়া তাহাকে পরিবর্জন করিয়া প্রাচীন ভারতবর্ষ যেদিন বিরাট ব্যাপার করিয়াছিল, এবং তাহার প্রত্যেক জাতি, প্রত্যেক বর্ণ তাহার বিরাট রাজছত্রতলে স্থান পাইতেছিল, সেই সময়ে এই জোর করিয়া বোঁটাছাড়া অপরিণত ফলটি যে কোন্‌ শ্রেণীর মধ্যে ঢুকিতে গিয়া অন্যায় করিয়াছিল তাহা বুঝিয়া লইবার কোন পথই লেখিকা রাখেন নাই।

সেদিন এই প্রাচীন ভারতের সুখ্যাতি ধরিতেছিল না; হঠাৎ এই বৎসর-দুয়েকের মধ্যে সে যে কি অপরাধ করিয়াছে যে, ঘোষজায়া মহাশয়া ‘মনুষ্যত্বের সাধনার’ ছুতা তুলিয়া এমন করিয়া তাহাকে আজ ভর্ৎসনা শুরু করিয়া দিয়াছেন? বলিতেছেন, “কিছুমাত্র না বুঝিয়া শুক ও তোতার মত কণ্ঠস্থ করা যে বিদ্যাধ্যয়ন নহে, তাহা বলা নিশ্চয়ই বাহুল্যোক্তি, অধুনা শিশুশিক্ষাতেও এরূপ মূঢ় নীতি প্রযুক্ত হয় না। কিন্তু আমাদের এই শ্রদ্ধেয়, পূজ্যপাদ, জ্ঞানগরিষ্ঠ ভারতবর্ষ এখনও তাহার ত্রিশ কোটি নর-নারীকে সেই প্রাথমিক যুগের প্রথম পাঠ পড়াইতেছে, গম্ভীর-মুখে মাথা নাড়িয়া সে বলিতেছে, ‘জিজ্ঞাসা করিবার তোমাদের কোন অধিকার নাই, আজ্ঞাবহের মত তোমরা কেবল আজ্ঞা পালন করিবে, ইহাই তোমাদের মুক্তির মূল্য!” জ্ঞানগরিষ্ঠ ভারতবর্ষের এই জ্ঞানের পরিচয় দিয়া পরে লিখিতেছেন, “কিন্তু প্রাচীন ভারত এই আপেক্ষিকতাকে একেবারেই আমল দেয় নাই, নেশার ঝোঁকে অসাধ্য-সাধনের পরম উল্লাসকে সে এমন বড় করিয়া দেখিয়াছিল যে জীবনের ছোটখাট কর্তব্যগুলি একান্তভাবে সে অবজ্ঞা করিয়াছে।” প্রাচীন ভারতবর্ষ নেশা খাইয়া কি করিয়াছিল, এবং জীবনের ছোটখাট কর্তব্যগুলি একান্তভাবে অবজ্ঞা করিয়াছিল কিংবা করে নাই, এ তর্ক তুলিব না। বিদুষীরা যখন বলিতেছেন, তখন মানিয়াই লইলাম। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, ওই ‘শ্রদ্ধেয়’ ‘পূজ্যপাদ’ প্রভৃতি বিশেষণগুলার কিছু অর্থ আছে, না, ওগুলো শুধু বিদ্যার পরিচয়? নিজের পিতার কোন ভুলের প্রতিবাদ করিবার জন্য তাঁহার মুখের সামনে দাঁড়াইয়া যদি বলা যায়,“হে আমার শ্রদ্ধেয় পূজ্যপাদ জ্ঞানগরিষ্ঠ বাবা! তুমি তাড়ি খাইয়া নেশার ঝোঁকে মাতলামি করিতেছিলে কি জন্যে?” কেমন শুনায়? কে নাকি বাহিরে মার খাইয়া আসিয়া স্ত্রীর কাছে আস্ফালন করিয়া বলিয়াছিল, “হাঁ, কান মলে দিয়েচে বটে, কিন্তু অপমান করেনি।” ঘোষজায়া মহাশয়াও পূজ্যপাদের অপমান করেন নাই শুধু কান মলিয়াছেন। যাহ হউক লেখার হাত বটে!

একস্থানের ইনি Evolution Theory ব্যাখ্যা করিয়া শেষে বলিতেছেন, “প্রবৃত্তিমার্গের শাসন পালন করিয়া তাহা খণ্ডনপূর্বক যাঁহারা নিবৃত্তি-মার্গে আরোহণ করিয়াছিলেন, বর্তমান ভারত তাহার লুপ্ত পদাঙ্ক পুনরুদ্ধার আর করিতে না পারিয়া অন্তভাগশায়ী অবশিষ্ট চিহ্নগুলিকে একান্তভাবে গ্রহণ করিয়াছে ও তাহাকে কৃপণের ধনের মত আঁকড়িয়া ধরিয়া রহিয়াছে।

তাহার পিছনে যে বিস্তৃত মুখগহ্বর অন্ধকারে মুখ ব্যাদিত করিয়া আছে, তাহাকে সে শুধু অসম্ভব প্রয়াসের দ্বারা আড়াল করিয়া রাখিতে চাহিতেছে, কিন্তু তাহার পায়ের নীচের মাটি তাহার ভারে যে খসিয়া পড়িতেছে, তাহার প্রতি তাহার দৃকপাত নাই।” অর্থাৎ ‘অন্ধকার গহ্বর’ ‘অসম্ভব প্রয়াস’ ‘পায়ের নীচের মাটি খসিয়া পড়া’ কথাগুলো লাগাইতেই হইবে। কেন তাহা বলা বাহুল্য। কিন্তু গোল হইতেছে এই যে, অন্তভাগশায়ী চিহ্নগুলিকে আঁকড়িয়া ধরিয়া থাকিবার মাঝখানে এত বড় গহ্বরটাই বা আসে কি সুবাদে এবং পায়ের নীচের মাটিই বা খসিয়া পড়ে কি হেতু? গহ্বরটা যে শুধু সে বেচারাই দেখিতে পায় নাই, তাহা নহে, আমরাও ত কৈ কোনদিকে চাহিয়া চোখে পড়িতেছে না। আর একস্থানে রাশি রাশি শাস্ত্রের দোষ দিয়া লিখিতেছেন, “জীবনের অবস্থা-ভেদে কর্তব্য ও ধর্মের প্রভেদ ঘটিয়া থাকে। পুরুষের যাহা ধর্ম নারীর ধর্ম তাহা হইতে পারে না। অপরন্তু,—সন্ন্যাসী যদি গৃহীর ধর্ম অবলম্বন করে, তবে সন্ন্যাসী ধর্মভ্রষ্ট হয়, এবং গৃহী যদি সন্ন্যাসীর পন্থানুসরণ করে, তবে গৃহীও ধর্ম হইতে স্খলিত হয়। …লোকসমাজে যখন একটা অনুভূতির স্পন্দনোচ্ছ্রয় ঘটিতে থাকে, বিধানের চাপ দিয়া তাহাকে বিমর্দিত করা যায় না, গর্জিত স্রোত তরঙ্গিণীর মত তাহা পথশায়ী প্রতিবন্ধক বিধ্বস্ত করিয়া পথ উন্মুক্ত করিয়া লইয়া অবতরণ করে। সুতরাং গৃহীদের সন্ন্যাসনুপন্থী হইবার সম্বন্ধে প্রবল শাস্ত্র-প্রতিষেধ থাকা সত্ত্বেও সমাজে তাহার প্রভাব অণুমাত্রও হ্রাস হয় নাই।”

আমার বিনীত নিবেদন এই, ‘সুতরাং’টির অর্থ কি? সমাজের বিলকুল গৃহীগুলা কি গৃহিণী ত্যাগ করিয়া বনে যাইবার সঙ্কল্প করিয়াছে? না, লুকাইয়া গেরুয়া কাপড় ছোবাইতেছিল, ধরা পড়িয়াছে। হইলে ভয়ের কথা নিশ্চয়ই, কিন্তু আমাদের বাড়িতে কাহারও ত ওসব লক্ষণ দেখি না। অন্ততঃ বড়কর্তার সম্বন্ধে আমি ত হলফ করিয়া বলিতে পারি। আজ এই ‘সুতরাং’ শব্দটায় বহুদিনের একটা কথা মনে পড়িতেছে। একবার গাড়ি করিয়া রাত্রে বাড়ি যাইতেছিলাম। পথে ডানদিকের মাঠে চাষারা পাট কাচিয়া শুকাইতে দিয়াছিল। পাছে ভয় পাই, এই আশঙ্কায় আমাদের পঞ্চা চাকর গাড়ির উপর হইতে সাহস দিয়া বলিল, “মা-ঠাকরুন ডানদিকে চেয়ে দেখুন,সুতরাং কেমন পাট শুকোচ্চে!” সেদিন বউমানুষের অত হাসি নিশ্চয়ই ভাল দেখায় নাই, কিন্তু ভাল দেখাইবার উপায় ত আমার হাতে ছিল না।

থাক্‌—আর না। এখনো অনেক কথা বলিবার ছিল, কিন্তু কাজ নাই। তা ছাড়া, আমরা মেয়েমানুষ হাঁড়ির একটা ভাতই টিপিয়া দেখি। শ্রীমতী আমোদিনী শিক্ষিতা রমণী, আমরা সেকেলে অশিক্ষিতা মূর্খ মেয়েমানুষ। হয়ত, তাঁহাকে ভুল বুঝিয়াছি। কিন্তু ভুল হোক, নির্ভুল হোক, যাহা বুঝিয়াছি স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছি। যদি আবশ্যক হয় নিজের লেখা তিনি অনায়াসে সমর্থন করিতে পারিবেন। তবে, একটা কথা বলিয়া রাখি। মেয়েমানুষের নাক ডাকে জানি, কিন্তু এত জোরে ডাকিতে শুনিলে অন্য স্ত্রীলোকেও যেন লজ্জা করিতে থাকে। ভয় হয়, এই বুঝি বা পুরুষমানুষে চমকাইয়া উঠিয়া পড়ে। তাই উৎকণ্ঠায় যদি বা একটু নিষ্ঠুরের মতই ঘুম ভাঙ্গাইবার চেষ্টা করিয়া থাকি, সে চেষ্টার মধ্যে আন্তরিক মঙ্গলেচ্ছা ব্যতীত আর কিছুই নাই। কিন্তু তাঁর ভাষা যে অতি সুন্দর, অতি মধুর, তাহা অকপটে স্বীকার করি। প্রতি ছত্র গভীর পাণ্ডিত্যে পরিপূর্ণ। বহুমূল্য ঘড়ির সুগঠিত কলকবজার ন্যায় তাঁহার প্রত্যেক শব্দবিন্যাসটির আশ্চর্য কৌশল দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছি। ঘড়িটি দামী এবং চলিতেছেও। কিন্তু কাঁটা দুটি না থাকায় কবি পোপের মত সময়টা ঠিক ঠাহর করিতে অক্ষম হইয়াছি।

এইবার শ্রীমতী অনুরূপা ও নিরুপমার রচনা সম্বন্ধে দুই-একটা কথা বলিব। যদিও শ্রীমতী অনুরূপার ‘পোষ্যপুত্রে’র গোড়াও পড়ি নাই, শেষও পড়ি নাই, শুধু মধ্যের গুটিকয়েক অধ্যায় মাত্র পড়িবার সুযোগ পাইয়াছি, এবং এত অল্প পুঁজি লইয়া বলিতে যাওয়াও বিপজ্জনক জানি, কিন্তু বুড়ো-মানুষের নাকি বেশি পুঁজির আবশ্যক হয় না, তাই বলিতেছি। ইঁহারও ভাষা যে অতি মধুর তাহাতে সন্দেহ নাই। আমার মেয়ে বলিতেছিল, এত মধুর যে মুখ মারিয়া যায়, আর গিলিতে পারা যায় না। তা’ ভাষা যাহাই হোক, প্রায়ই উপমাগুলিই যে না জানিয়া লেখা তাহা পড়িলেই চোখে ঠেকে। আর একটা জিনিস তার চেয়েও বেশী ঠেকে—সেটা অসহ্য জ্যাঠামো। এ কথা আমার বলিবার ইচ্ছা ছিল না। কেন না, এইখানেই তর্ক বাধে। গ্রন্থকারের তারিফ্‌কারীরা ধরিয়া বসেন, কোথায় জ্যাঠামো দেখাও। আমি যাহাই দেখাই না কেন, তাঁহারা প্রতিবাদ করিয়া বলিবেন— কখ্‌খন না। এটা হিউমার, ওটা উইট্‌, সেটা আর্ট ইত্যাদি।

জ্যাঠামো অন্তরে অনুভব করা যায়, কিন্তু উইট্‌ কোথায় অশ্লীল হইয়া উঠে, আর্ট কোথায় আতিশয্যে ও ছিবলামিতে রূপান্তরিত হয়, সেটা যে-বয়সে বোঝা যায়, ততটা বয়স এখনও লেখিকার হয় নাই। তবে, আশা করি এ দোষ একদিন শুধরাইবে। কিন্তু, তাঁহার না জানিয়া যা-তা উপমা দিবার স্বপক্ষে সে-রকম কৈফিয়ত কিছু নাই। তাই দৃষ্টান্তের মত দুই-একটা উল্লেখ করিব মাত্র।

একস্থানে বলিতেছেন, “বিজন-পথে চলিতে চলিতে অকস্মাৎ পায়ের নীচে দংশনোদ্যত সর্প দেখিলে পথিক যেমন আড়ষ্ট কাঠ হইয়া দাঁড়ায়, ইত্যাদি।” তাই বটে! একটা ন্যাকড়া কিংবা দড়ির টুক্‌রা দেখিলে লাফাইয়া কে কার ঘাড়ে পড়িবে ঠিক থাকে না, আড়ষ্ট হইয়াই দাঁড়ায়! তাও আবার যে-সে সর্প নয়—একেবারে দংশনোদ্যত সর্প! ইনি যে লেখেন নাই, রান্নাঘরে হঠাৎ জ্বলন্ত আগুনের টুকরা পায়ের নীচে মাড়াইয়া ধরিয়া রাঁধুনী যেমন অবাক হইয়া হাঁ করিয়া দাঁড়ায়,—ইহাই পরম ভাগ্য!

আর একস্থানে লিখিতেছেন, “দীপ্ত সূর্য্যালোকের উপর মেঘ আসিয়া পড়িলে তাহা যেমন এক-মুহূর্ত্তেই ম্লান হইয়া যায়, শিবানীর মুখ তেমনি মুহূর্ত্তে অন্ধকার হইয়া আসিল। ”এটা অলঙ্কার না উপমা? কিন্তু দীপ্ত সূর্যালোকের উপর মেঘ আসিয়া পড়িলে কি হয়? সাদা দেখায়। কিন্তু লেখিকা ঐ যে ম্লান বলিয়াছেন, কাজেই তাঁহার অন্ধকার মুখের সহিত সূর্যালোক-পতিত মেঘের তুলনা করিবার অধিকার জন্মিয়াছে! এই কি! আর এক জায়গায় গভীর কৃষ্ণবর্ণ মেঘের গায়ে বক প্রভৃতিকে উড়িতে দেখিয়া তাঁহার মনে হইয়াছে যেন ‘কৃষ্ণতারকা’ উড়িয়া যাইতেছে। কালো মেঘের তলায় বক কি কৃষ্ণতারকার মত দেখায়? তা ছাড়া ‘কৃষ্ণতারকা’ই বা কি? রাত্রে আকাশের পানে চাহিয়া কোনদিন ত কালো কুচ্‌কুচে নক্ষত্র চোখে পড়ে না। আর যদি চোখের তারাই হয়, সেও ত সাদা পদার্থের মাঝখানে থাকে। কালো মেঘের সঙ্গে তাহার সাদৃশ্যই বা কোথায়? প্রকৃতি-দেবীর উপর এই রকমের উৎপাত আরও অনেক আছে—সেইগুলি একটুখানি হুঁশ করিয়া করা উচিত ছিল। কেন না, নিজে যাহা জানি না, তাহা না জানানই বুদ্ধির কাজ।

যা হউক, বইখানি, শুনিয়াছি ৫। ৬শ পাতার; আমি মাত্র ২৫। ৩০ খানি পাতা পড়িয়াছি; সুতরাং আশা করিতেছি, যাহা পড়ি নাই তাহার মধ্যে ভাল ভাল জিনিসই রহিয়া গিয়াছে। মেয়েটাও বলিতেছিল, বইখানি জ্ঞানগর্ভ। বেদ, কোরান, বাইবেল, রামায়ণ, মহাভারত, এথিক্স, মেটাফিজিক্স, রামপ্রসাদী, তন্ত্র, মন্ত্র, ঝাড়ফুঁক, মারণ, উচাটন, বশীকরণ—সমস্তই আছে।

এ-ছাড়া সংস্কৃত, হিন্দী, ইংরেজী—কালিদাস, সেক্সপিয়র, টেনিসন—যাহা কিছু শিক্ষা করা প্রয়োজন একাধারে সমস্তই। বলিতে পারি না, শেষের দিকে রাজাভাষা এবং Clerk’s Guide আছে কিনা। আমার ছোট নাতিটিকে একখানি কিনিয়া দিব মনে করিতেছি।

যদি আমার রাধারানীর কথা সত্য হয়, তবে, আর গোট-দুই প্রশ্ন করিয়াই ক্ষান্ত হইব। জিজ্ঞাসা করি, এত বাড়াবাড়ি ধর্মচর্চা কেন? হিন্দু ধর্মের অত সূক্ষ্ম ভেদগুলি না হয়, নাই দেখান হইত—তাহাতে এমনিই কি ক্ষতি ছিল! এ যে সন্ন্যাসী ফকিরের ভিড়ে পা বাড়াইবার জো নাই, কোথায় দাঁড়াই, কোন্ দিকে চলি, কোন্ মহাত্মার গায়ে এই বুঝি পা দিয়া ফেলি, এই ভেবেই যে সারা হইতে হয়। তার উপর ইংরেজির বুকনি ও ইংরেজি কবিতার লম্বা কোটেশন! এ কথাও ভাবা উচিত ছিল, এটা বাংলা উপন্যাস এবং তাঁহার অধিকাংশ ভগিনীগুলিই ইংরেজি জানেন না। জানি বলিয়া কি তাহা জানাইতেই হইবে! শুনিয়াছি, রবিবাবুও ইংরেজি জানেন, বঙ্কিমবাবুও নাকি শিখিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহারাও নভেলের মধ্যে লোভ সংবরণ করিতে পারিয়াছিলেন! এ-ক্ষেত্রেও লোভ সামলান উচিত ছিল। অন্তঃপুরচারিণী স্ত্রীলোক হইয়াও সর্বতোমুখী পাণ্ডিত্যের বহরে লোকজনের তাক্ লাগাইয়া দিব, এই স্পিরিট্‌টাই নিন্দার্হ। অগ্রহায়ণের ‘ভারতী’তে এক ভদ্রলোক এই বইখানি সমালোচনা করিয়া একস্থানে বলিয়াছেন, স্থানে-অস্থানে অত্যধিক প্রকৃতি-বর্ণনা এবং তাহাতে রসভঙ্গ না কি এমনি একটা দোষ ঘটিয়াছে। আমি কিন্তু এ কথা বলি না। বরং বলি, দুই-তিন পাতা জোড়া প্রকৃতি-বর্ণনা পড়িয়া যে ব্যক্তি একটা কিছু আইডিয়া করিতে চায় সে-ই অরসিক। এ জিনিসটা গয়ায় পিণ্ডি দেবার মত। পুরোহিত ঠাকুরও জানে না, কি বলাইতেছি; যজমানও গ্রাহ্য করে না, কি বলিতেছি! অথচ, উভয়েই জানে কাজ হইতেছে—ভূত ছাড়িতেছে! এ-বিষয়ে শ্রদ্ধা থাকা চাই, বিশ্বাস থাকা চাই; প্রকৃতি-বর্ণনা বুঝিতেছি। ভেলকি-খেলা দেখেন নাই? খেলওয়াড় চোখের ভিতর হইতে হাঁসের ডিম বাহির করিবার আগে হাত-পা নাড়িয়া ভানুমতীর ব্যাখ্যা শুরু করিয়া দেয়—এ তেমনি। বোঝা উচিত, এবার আশ্চর্য কিছু-একটা আসিতেছে। যে সমঝদার সেই জানে এইবার ডিম বাহির হইবে—বোকায় শুধু হাত-পা নাড়া দেখিতেই ব্যস্ত থাকে এবং ভানুমতী ব্যাখ্যার মানে বুঝিতে চায়। আমি ত ৩০ অধ্যায়ের গোড়াতেই বুঝিয়াছিলাম, এবার নতুন কিছু একটা আছে।

লেখিকা লোক-হিতার্থে দয়া করিয়া পেট কামড়ানির মন্ত্র পর্যন্ত শিখাইয়া দিয়াছেন।

“রাম লক্ষ্মণ সীতে যান কিষ্কিন্ধ্যের পথে;
সাথে নিলেন হনুমান আর সুগ্রীব মিতে;
সুগ্রীব বলেন, মিতে আমি মন্তর জানি,
পেটের ব্যথায় অব্যথা হয়ে যায় প্রাণী।”

বাস্তবিক, লোকের কুসংস্কারে হিন্দু-ধর্মের অনেক ভাল জিনিস লোপ পাইতেছে, এটা কোনমতেই হইতে দেওয়া উচিত নয়। শ্রীযুক্ত লালবিহারী দে, গোবিন্দ সামন্তকে সাপের মন্তর শিখাইয়া দিয়াছিলেন। আমিও পেট কামড়ানির একটা মন্তর জানি, যদি কাহারও উপকার হয় তাই লিখিতেছি। অবশ্য আমার মন্তর অব্যর্থ কিনা বলিতে পারি না। এ বাড়ির পুরুষগুলা গোঁয়ার গোছের, ওসব বিশ্বাস করিতে চাহে না—তাই, যাচাই করিয়া লইবার সুবিধা ঘটে নাই—যে বাড়ির পুরুষেরা শিষ্ট শান্ত সেখানে পরখ হইতে পারিবে! মন্তর এই—

“পেট কামড়ানি, পেট কামড়ানি,
ভাল হবি ত হ’;
নইলে কামড়ে কামড়ে কি গরু বাছুর
মেরে ফেলবি!”

রোগীর পেটে হাত বুলাইয়া তিনবার বলিতে হয়।

এবার শ্রীমতী নিরুপমার কথা কিছু বলিব। ইঁহাদের মধ্যে নিরুপমার রচনাকে অনেক দিক হইতেই ভাল বলিতেই হয়। সহজ, সরল ও বিনীত। যাকে ‘পাণ্ডিত্যের হুঙ্কার’ বলে সেটা নাই, এবং স্টেজ আস্ফালনিও কম। কথাবার্তাগুলি কথাবার্তারই মত। লেখায় ভুল যে নাই তাহা নহে। ভুল কাহারই বা না থাকে, এবং থাকিলেই তাহা মহা লজ্জার বিষয় হয় না, যদি না ভুল যাচিয়া ঘরে আনি। যদি না সোজা পথ ছাড়িয়া অজানা পথের মধ্যে গিয়া পথ হারাই! শরীরে ঘা হওয়া এক এবং চুলকাইয়া ঘা করা আর। একটায় মায়া হয়, অপরটায় রাগ করিতে ইচ্ছা করে—মুখে আসিয়া পড়িতে চায়—বেশ হইয়াছে, যেমন কর্ম। যদি পারিবে না, তবে যাও কেন? নিরুপমা এই দোষটি করেন বলিয়া ইঁহার ভুলটা শুধু ভুল, কিন্তু ওঁদের ভুলগুলা ভুল ত বটেই এবং আরো কিছু! যাহারা সোজা পথে চলিয়া ভুল করে, তাদের ভুল একদিন আপনিই শুধরাইয়া যায়, কিন্তু যাহারা বাঁকা পথে চলিতে চায়, অথচ পথ চেনে না, তাদের ভবিষ্যৎ অধিকতর বিপজ্জনক হইয়া উঠিতে থাকে। শ্রীমতী নিরুপমার ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ পড়িবার সময় দুই-একটা সোজা ভুল চোখে ঠেকিয়াছিল, কিন্তু এখন আর তাহা মনে করিতে পারিতেছি না। তবে, একটা মনে আছে, দৃষ্টান্তের মত উল্লেখ করিতেছি। একস্থানে ‘সন্তরণ মূঢ়ের ন্যায়’ না বলিয়া ‘সন্তরণহীন মূঢ়ের ন্যায়’ বলিয়াছেন।

এটা বুঝিবার ভুল। বঙ্কিমবাবু যেমন কৃষ্ণকান্তের উইলের গোড়াতেই ‘ইহলোকান্ত’ না বলিয়া একাধিক বার ‘পরলোকান্তে’ বলিয়াছেন—তেমনি। কিন্তু, এটা যদি রবিবাবুর অনুকরণ করা হইয়া থাকে, তাহা হইলে অন্যায় করা হইয়াছে। তিনি ‘সন্তরণ মূঢ় রমেশ সঙ্গীতের হাঁটুজলে’ ইত্যাদি বলিয়াছেন, ‘সন্তরণহীন’ বলেন নাই। যাহা হউক, এটা ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। কিন্তু ধর্তব্যের মধ্যে সেইটা নিশ্চয়ই, যেটা না জানা সত্ত্বেও লেখা হইয়াছে। যেখানে সতী আফিং এবং বেলেডোনা দু-ই খাইয়াছে। একটা বিষ, আর একটা প্রতিষেধক। বেলেডোনা বিষে ডাক্তারেরা ‘মরফিন্‌’ ইনজেকট করেন। দুইটা বিষ একসঙ্গে সেবন করিলে দুর্ভাগা যে অনেক সময়ে শুধু মরে না, তা নয়, মরিলেও অত শীঘ্র, অত আরামে মমে না। অনেক বিলম্বে অনেক কষ্টে মরে। সেটা নিশ্চয়ই লেখিকার অভিপ্রায় ছিল না। তাছাড়া, দুর্ঘটনার আশঙ্কা যথেষ্ট ছিল। হয়ত, মরিতই না, হয়ত পোড়াইবার সময় চোখ চাহিয়া ফেলিত! যাহা হউক, যখন নির্বিঘ্নে কার্যোদ্ধার হইয়াছে, তখন আর আলোচনার প্রয়োজন নাই। কিন্তু বেলেডোনা যোগাড় করিবার জন্য মালিশের ঔষধ, ডাক্তার, ডাক্তারখানা, বাত ইত্যাদি অনেক অবান্তর কথার অবতারণা করিতে হইয়াছে। সুতরাং, একটুখানি জানিয়া লিখিলে আর এই বাজে মেহন্নতগুলা করিতে হইত না।

আর না। এইবার সমাপ্ত করি। অপ্রিয় কথা অনেক লিখিলাম। আশা করি, ইহাতে সুফল ফলিবে। আর যদি প্রচলিত নিয়মানুসারে লিখক-লেখিকারা এই বলিয়া সান্ত্বনা লাভ করিবার চেষ্টা করেন যে, সমালোচকেরা নিজেরা লিখিতে পারে না বলিয়াই হিংসা করিয়া গ্লানি করে, তাহা হইলে আমি নিরুপায়। কিন্তু সমালোচক মাত্রেই যে লিখিতে পারে না, এবং পারে না বলিয়াই দোষ দেখাইয়া বেড়ায়, এ কথাটার উপরেও তত আস্থা রাখা ঠিক নয়।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. ১৩১৯ সালের ফাল্গুন সংখ্যা ‘যমুনা’ মাসিক পত্রিকায় ‘শ্রী অনিলা দেবী’ ছদ্মনামে প্রকাশিত হয় এবং ‘শরৎচন্দ্রের পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত রচনাবলী’র অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রথম প্রকাশিত হয় শ্রাবণ, ১৩৫৮ সালে।