চন্দননগরে আলাপ-সভায়[১]

শরৎবাবু বলিলেন– “আপনাদের এখানে আসার ইচ্ছা আমার বরাবরই ছিল। নানা কাজের ঝঞ্ঝাটে আর শরীর ভাল নয় বলে আসা হয়ে ওঠেনি। বক্তৃতা আমি করতে জানি না। আমি সে-বার যখন এখানে আসি, তখন বিশেষ কিছু বক্তৃতা দিইনি। অনেক সভাসমিতিতে যাই, কিন্তু মামুলী ধরণে দু-চারটা কথা বলে যাওয়া–ও আমি পারি না। সে-বার কারও সঙ্গে বিশেষ আলাপ পরিচয় হয়নি। তাই আর একদিন এসে আলাপ করার ইচ্ছা ছিল। বলেছিলুম, লিখে কিছু বলে যাব। তাও ঘটে উঠল না।

চারুবাবু আমাকে প্রশ্ন করার ভার আপনাদের উপর দিয়েছেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা–যা এক হয়ে রূপ নিয়েছে আমার লেখার মধ্যে, আমার সাহিত্যে–তাই নিয়ে কিছু বলতে পারি। এ-রকম (আলোচনা-সভা) যদি হয়, আর যাঁরা সাহিত্যিক, সাহিত্য সম্বন্ধে যাঁদের কৌতূহল আছে, তাঁরা যদি আমায় (কোন লেখাদি সম্বন্ধে?) কি করে হয়, কেমন করে হয় প্রশ্ন করেন–আমার জ্ঞানগম্য হলে যথাসাধ্য উত্তর দিতে চেষ্টা করব। তবে এমন নয় যে, সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি পারব, কিংবা উত্তর দিতে আমি বাধ্য।

ছেলেবেলায় এখানে একবার আসি। খুব faint মনে আছে–আমার বয়স তখন চার কি পাঁচ। বোড়াই চণ্ডীতলায়–একতলা বাড়ি, কাছে পুকুর–কুণ্ডুমশাইয়ের বাড়ি–এমনি দু-চারটা কথা ছাড়া আর বিশেষ কিছু মনে নেই। ঠাকুর-মা রাগ করে এখানে চলে আসেন। আমিও তাঁর সঙ্গে আসি। সে অনেক দিনের কথা। এখন আমার বয়স ৫৫ বৎসর। About fifty years–প্রায় ৫০ বৎসর আগেকার কথা। এই দিক দিয়ে আপনাদের সঙ্গে আমার একটা আত্মীয়তা থাকার কথা বলা যায়। এখন একেবারে বাইরে গিয়ে পড়েছি। আমার মতামত প্রভৃতি (সম্বন্ধে?) যদি কিছু জিজ্ঞাসা করেন (ভাল) যদি না হয় আপত্তি নেই–(এতে আর কিছু না হয়) আলাপ পরিচয় হয়। মতিবাবুর কথাও কিছু আজকে শুনতে চাই।”

শ্রীযুক্ত বসন্তকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তখন অনুরোধ করিলেন,– “আপনি আপনার বংশ পরিচয় ও সাহিত্যিক career-এর landmarks-এর কথা কিছু আমাদের বলুন।”

শরৎবাবু বলিলেন,– “বংশ-পরিচয় আপনাকে কিছু দিয়েছি বলে সবাইকেই দেব না-কি? শুনলে দুঃখ বোধ হবে–বংশের কোনও গৌরবই আমি রাখি না … … যাঁরা আমাদের প্রাচীন ইতিহাস মাটি খুঁড়ে, পাথর খুঁড়ে বার করেছেন আর বলেছেন– এই দেখ আমাদের এই ছিল, ঐ ছিল–আমি তাদের কথায় খুশি হই না। আমার বুক তাতে ফুলে ওঠে না। আমি বলি–আমাদের কিছুই ছিল না। এতে দুঃখ করবার কিছু নেই। নিজের জীবনের পরিচয় দিই না। দু-হাজার বছর আগে আমাদের কি ছিল না-ছিল–তার কথা পাথর মাটি খুঁড়ে আমাদের শুনিয়ে কাজ নেই। আমার কথা পুরান জিনিস নিয়ে গৌরব করে কাজ হবে না। নূতন গড়ে তোল। জাত সম্বন্ধেও তাই, নাই বা থাকল জাত–এমন ছেলে দেখা যায়, যার বংশ-পরিচয় দেবার কিছু নেই–সে নিজের জোরে বড় হয়েছে, successful হয়েছে–আমারও মনের ভাব তাই। আমার একখানা বই বন্ধ হয়ে আছে–“শেষ প্রশ্ন”, তাতে এই সম্বন্ধেই আলোচনা করেছি। যা কিছু বর্তমানে চলছে তার অনেক-কিছুর উপর তাতে কটাক্ষ আছে, attack আছে। মতিবাবু হয়ত খুবই রাগ করবেন–তিনি ত রেগেই আছেন–বইখানা এখনও শেষ হয়নি–বোধ হয় দু-চার দিনের মধ্যে লেখা শেষ হবে। শেষ হলে তা পড়লে হয়ত তিনি খুশী হবেন না।

ধর্ম সম্বন্ধে আমাদের বংশের একটা খ্যাতি আছে। আমাদের বংশে আটপুরুষ ধরে একজন করে সন্ন্যাসী হয়ে আসছে। আমার মেজ ভাই সন্ন্যাসী। আমার মাতুল-বংশ ধর্মভীরু বংশ। মাতামহ খুব গোঁড়া হিন্দু ছিলেন। আমিও খুব … এমন কি চার-পাঁচবার সন্ন্যাসী হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। ভাল ভাল সন্ন্যাসীরা যা করে থাকেন–অর্থাৎ গঞ্জিকা-সেবনাদি–তা অনেক করেছি। এখন একেবারে উল্টা। এই ধর্ম নিয়ে চলার যে একটা পথ–মতিবাবু যা করেন–তিনি যে line নিয়ে চলেছেন–বোধ হয় এ-সম্বন্ধে কিছু বলা এখানে শোভন হবে না। ওপথ আমার মোটেই নয়।

মতিবাবুর বই আমি খুবই পড়ি–ওঁর যা-কিছু লেখা খুব মন দিয়েই পড়েছি। এই দেশটাকে তিনি আবার পুরাতন ধর্মের উপর দাঁড় করাতে চান–নূতন জাত গড়তে চান, কিন্তু basis হ’ল ধর্ম–ভগদ্ভক্তি–এই সমস্ত। শাস্ত্রে-টাস্ত্রে অনেক সাধনার কথা আছে,–আমার unfortunately মনটা একেবারে উল্টা দিকে গেছে–সাধনার আর কোন মূল্য খুঁজে পাই না। শাস্ত্র-সাধনা যা ছিল, সবই যদি এত বড় ছিল আমরা এত ছোট হলুম কেন? নানা লোকে নানা কথা বলবে। চোখের উপর দেখছি সব জাতিই–যাদের আত্মসম্মানেরবোধ খুব বেশি–তারা স্বাধীন বলে পৃথিবীতে নিজের পরিচয় দিচ্ছে। আমরা এত বড় হয়েও একবার পাঠান, একবার মোঘল, একবার ইংরেজের জুতোর তলায় পিষে মরছি! কেন–তার কোন ­­জবাব দিতে পারি না। আমরা বলি–আমাদের আধ্যাত্মিক জীবন খুব বড়–কিন্তু বাহিরের লোক সে-কথা বিশ্বাস করে না। মনে মনে হাসে কি-না–জানি না। এতই যদি বড় ত ছোট হয়ে যাচ্ছি কেন? এই যে দেশটা ত্যাগের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, আমার মনে হয়, ঠিক এরই মধ্যে কোথায় একটা গলদ ঢুকে আছে–সেটা খুঁজেও পাচ্ছি না। ক্রমশঃ (অবনতির স্তরে) নেমেই যাচ্ছি। আমার বইখানা শেষ হয়ে গেলে (দেখবেন) তাতে এই সব মতের আলোচনা করেছি। পাঁচজনকে আহ্বান করে বলছি বলে দিন–এই হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের দুর্দশা কেন হ’ল? এটা কেমন করে সম্ভব হ’ল–কেউ যদি বা’র করতে পারেন–দেশের মহা উপকার হবে! কোন উপায় চোখের উপর দেখতেও পাই না। নিজের শক্তিতে প্রতিষ্ঠা করতে পারি না, কিছু বিশ্বাস নেই–এটাই যদি বড় জিনিস হয়, কি আশা আছে? আপনারাই বলুন–এর ভিতর কি গলদ আছে? মতিবাবুকেও বলি, এই আলোচনা-সভায় বলুন–কোনখানটায় গলদ আছে–যার জন্য এত বড় শাস্তিভোগ করছি? আমি মনে করেছি–politics-এ আর থাকব না। কোন দিনই বেশি (সম্বন্ধ) ছিল না। আমি এই lineই নেব–ধ্বংস করার কাজ নেব। সমস্ত জিনিস ছোট করে দেখব। খুব বড় ছিলাম অথচ result nil! আমাদের কিছুই ছিল না। তার জন্য দুঃখও নাই। বড় হয়ে ওঠে, যে পথে আর দশ জনে বড় হয়ে উঠেছে। আমাদের সঙ্গে তাদের মেলে না–তারাই বড়–এ কথা বললেই চলবে না–আমরা যা বলি, তা করি না–মিথ্যাবাদী–এটা বড় অসত্য বটে, তবু এটাই একমাত্র কারণ নয়। (এ-সম্বন্ধে) আলোচনা হোক। আমি এ পন্থাই নেব। আমাদের কিছুই ছিল না। ২০০০ বছর আগে কি ছিল, তা নিয়ে গর্ব করব না। যাদের ছিল তাদের সঙ্গে আমাদের কোন যোগ নেই–রক্তেরও যোগ নেই, ধর্মেরও যোগ নেই–শুধু এক দেশে বাস করি, এইমাত্র। তাদের সঙ্গে সম্পর্কের কথা মৌখিক পড়ি, যোগ দেখতে পাই না। কেউ যদি বুঝিয়ে দিতে পারেন–এইটা এই রকমই বটে, তা হলে আলাদা কথা। নহিলে মনে হতে পারে, আমার লেখার ভিতর দিয়ে ক্ষতি হতে পারে। বছর তের-চৌদ্দ আগে অনেকেই মনে করেছিলেন যে, আমি সাহিত্য নষ্ট করে দিলাম। এমন কি বড় বড় লোকের মনেও ধারণা জন্মেছিল যে, আমি যা লেখা আরম্ভ করেছি, তাতে বুঝি সমস্তই ধ্বংস হয়ে যাবে। এখন সেই মত নাই–এখন অনেকে বলেন–বিশেষ young menরা–“আপনি ভাল পথই নিয়েছেন–আপনার কথা মনে নেব।” যে জিনিসটা বললুম, জানি হয়ত তার প্রতিবাদ উঠবে। স্পষ্টই বললুম,–রেখে ঢেকে নয়। যদি আপনারা বলেন–এ পথটা ঠিক নয়–কেন যদি দেখিয়ে দিতে পারেন, তা হলে আবার ভেবে দেখব। মতিবাবুকেও এ-কথা বলছি। মোট কথা এই, আমি সংস্কারের পক্ষপাতী নই। পুরান জিনিসটার পোষাক বদলে নেওয়া আমি চাই না। ‘পথের দাবী’তে বুঝিয়েছি–সংস্কার জিনিসটার মানে কি। ওটা ভাল কিছু নয়। যেটা খারাপ জিনিস অনেক দিন চলে ধড়ধড়ে নড়নড়ে হয়ে পড়েছে–সেটা মেরামত করে আবার দাঁড় করান। যেমন গভর্ণমেণ্টের শাসন-সংস্কার–reforms–আর এক দল যারা revolution চাইছে–revolution মানে অন্য কিছু নয়, একটা আমূল পরিবর্তন। আমাদের বৃদ্ধের দল এটা চান না, তাঁরা চান reforms অর্থাৎ মেরামত করা। আমার মনে হয়–মেরামত করে জিনিসটা ভাল হয় না। যা আছে তারই পরমায়ূ বাড়িয়ে তোলা হয়। যেটা অচল হয়ে পড়ছে, সেটা negleot-দ্বারা হয়ত আপনি ধ্বংস হয়ে যেত–সেটা শক্ত মজবুত করে আবার খাড়া করা হয়। যেটা খারাপ, তাকে মেরামত করে সংস্কার করে আবার দাঁড় করান উচিত নয়। মতিবাবুও মনে করেছেন–আমাদের ধর্মটাকে সংস্কার করে মেরামত করে সেইটাকেই আবার দাঁড় করাবেন। আমি বলি–মেরামত নয়–ঐটিকেই বাদ দাও। আবার তাকে মেরামত করে খাড়া করবার দরকার কি? ছ-সাত শ’ বছরের পুরানো জিনিসটা আবার যদি দাঁড় করাও, আবার সেটা হাজার বছর ধরে চলবে। আচ্ছা মতিবাবুই বলুন–এ-সম্বন্ধে উনি কি মনে করেন।”

মতিবাবু–“শরৎবাবু আমার কাছ থেকে কিছু শুনতে চেয়েছেন। … তবে ধর্ম সম্বন্ধে তিনি যা বললেন সে-সম্বন্ধে দু-একটা কথা আমি না বলে পারি না! ধর্মকে তিনি নাকচ করতে চেয়েছেন। ফরাসী জাতিও ধর্মকে নাকচ করতে চেয়েছিল, তবু তার পরিবর্তে তারা দিয়েছিল সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা–negation-এর পর একটা positive কিছু দেওয়া ত চাই। শরৎবাবু ধর্মকে নাকচ করে তার পরিবর্তে কি দিয়ে যাবেন? এটা জিজ্ঞাসা করার আমার অধিকার আছে। আমি ধর্মকে মেরামত করে, ঝড়তি পড়তি বাদ দিয়ে দাঁড় করাতে চাই না। আমার সাহিত্যের মধ্য দিয়ে আমি এইটাই বলেছি–ধর্ম আমরা পাইনি। আমাদের দেশ ধর্মকে ঠিক অধিকার করতে পারেনি–ধর্ম কর্ম মোক্ষবাদকেই পুরোভাগে ধরে রেখেছে। ভারতের ৬০ লক্ষ সন্ন্যাসী এই মোক্ষের আকাঙ্ক্ষী হয়ে বনে-জঙ্গলে গিরিকন্দরে বাসা নিয়েছে। এই ৬০ লক্ষ সন্ন্যাসীকে বাদ দিয়েও ভারতের ৩২ কোটী ৪০ লক্ষ (যদি ৩৩ কোটি মোটামুটি অধিবাসীর সংখ্যা ধরা হয়) মানুষ যারা সংসারে বাস করছে, তারাও ধর্মের পরিণাম মোক্ষবাদই জানে। কর্মক্ষয় হলে মানুষের মোক্ষপ্রাপ্ত হবে–এই ধারণাই বদ্ধমূল হয়ে আছে। ধর্ম বলতে যদি মোক্ষবাদই একমাত্র বুঝায়, জীবনকে বাদ দিয়েই ধর্ম হয়, তবে ধর্মবস্তু খুব অসার হয়ে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই। ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ এ নয়। ধর্ম বলতে realisation, যা fact, যা reality, তারই উপর দাঁড়াতে হবে। ধ্বংসের রুদ্র হয়ে যদি আপনি এসে থাকেন, আপনি সব ভেঙ্গে যেতে পারেন; কিন্তু আমার মনে হয়, ধ্বংসের গানের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠার চিন্তাও আপনার মধ্যে রয়েছে। উদীয়মান জাতির পক্ষ থেকে, আপনার কাছ থেকে একটা Positive something চাইছি। আপনি আঘাত দিতে পারেন, কিন্তু আমার বিশ্বাসকে ‘না’ করতে পারেন না। আপনারও যেমন একটা বিশ্বাস আছে, আপনার ‘হাঁ’-কে আমি ‘না’ করাতে পারব না, তেমনি আমারও একটা বিশ্বাস আছে।

ধর্মকে মেরামত নয়, আমি ধর্মের নূতন রূপ দিতে বলি! ধৰ্ম মোক্ষবাদ নয়–হিন্দু আজ ধৰ্ম বলতে (জীবনকে বাদ দিয়ে?) আত্মপ্রতারণা করছে। এত বড় insincerity হিন্দুর মত আর কোথাও নেই। অক্ষমতা যার মূল ভিত্তি, সে জাতি কখনও প্রতিষ্ঠা পায় না। … আপনার লেখার মধ্যে যে বাস্তবতার পরিচয় পাই–ধ্বংসনীতিরও মধ্য দিয়ে সেই রকম একটা Positive কিছুর সন্ধান আপনাকে দিতে হবে। ‘শেষ প্রশ্নে’র পরও আপনাকে লেখনী ধরতে হবে। শেষ আলো আপনাকে দিয়ে যেতেই হবে, বলতে হবে– “ধ্বংসের পর কি দিয়ে গেলেন!”

শরৎবাবু–“মতিবাবুর কথায় আমার কথার ঠিক উত্তর পেলুম না। আমার কথাটা বোধ হয় ধরতে পারছেন না? আমি এই কথাই বলতে চাই–মেরামত করে কিছু দাঁড় করাচ্ছেন–(এটা ভাল নয়?)”

মতিবাবু–“বলেছি–ভারতের ধর্ম মোক্ষ নয়। মুক্তির অর্থ– বাসনা ও অহঙ্কার থেকে মুক্তি–জীবন থেকে মুক্তি নয়। মুক্তি–মুচ্ ধাতু থেকে–অহং ও বাসনা গেলে, এই জীবনেই মুক্তির আস্বাদ পাওয়া যেতে পারে, জীবনকে লয় করে নয়। বাসনা-অহঙ্কার-মুক্ত মানুষ Infinite Power-এর সঙ্গে যুক্ত হবে – Bliss and Light-এর reflection জীবনকে অধিকার করবে। মুক্তির আস্বাদ ইহজীবনেই লাভ না করতে পারলে ধর্ম্মের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। শ্রদ্ধা-বস্তুর একটা সনাতন রূপ আছে–যে জিনিসটার উপর কোটী কোটী লোকের শ্রদ্ধা আছে, সেটাকে ভাঙ্গবার চেষ্টা না করে, তার যোগ্য ব্যবহার করতে পারলেই আমরা অধিকতর ফল লাভ করব। এ-সম্বন্ধে বিশেষ আলোচনা পরে হবে। এই সভায় অধিক আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়ে আপনার মহামূল্য উপদেশ থেকে বঞ্চিত হতে চাই না।”

শরৎবাবু–“মহামূল্য  উপদেশ কিছু দিতে পারব না। আমি যেটা করব বল্লুম–(?)

অহঙ্কার ও বাসনা হতে মুক্তির কথা যা বল্লেন–সেগুলির দরকার। তবে আর আর জাত– যারা (আমাদের মাথায় পা দিয়ে বেড়াচ্ছে (?) তারা সব যেভাবে বড় হয়েছে, সেইভাবে (আমাদের বড় হতে হবে?)”–

মতিবাবু–“তাঁদেরই মত হতে বলছেন! রোমও একদিন খুব বড় সভ্য জাতি হয়েছিল, কিন্তু তাদের সে সভ্যতার এখন কতটুকু অস্তিত্ব আছে!”

শরৎবাবু–“দেখুন এ-কথায় আমি সান্ত্বনা পাই না। তাদের মত করেও যদি আমরা বড় হতে পারি–(তাতে ক্ষতি কি?)”

মতিবাবু–“তাতে নিশ্চিহ্ন হবার আশঙ্কা আছে।”

শরৎবাবু–“পৃথিবীর সমস্ত জাতি নিজের পায়ে ভর করে দাঁড়াচ্ছে–বড় হয়ে উঠছে; আমরা পারি না, নিতান্ত নিরুপায়। সেই অবস্থায় আরও ৫০০ বছর পরে কি হবে ভাবতে যাব না। রোমের মত ধ্বংস হয়ে গেলেও (এখন কিভাবে উন্নতি হবে তাই ভাবতে চাই)। আমার বলবার উদ্দেশ্য–আমি বড় চিন্তায় পড়েছি। Politics এ যোগ দিয়েছিলুম। এখন তা থেকে অবসর নিয়েছি। ও হাঙ্গামায় সুবিধা করতে পারিনি। অনেক সময় নষ্ট হ’ল। এতটা সময় নষ্ট না করলেও হ’ত। যা গেছে তা গেছে – খানিকটা অভিজ্ঞতা জমা হয়ে রইল। (এখন থেকে আমি আমার লেখা নিয়েই থাকব?) আমার কথাটা বোধ হয় আপনারা ঠিক বোঝেননি–”

এই সময় শ্রীযুক্ত ব্রজেন্দ্রনাথ গোস্বামী প্রশ্ন তুলিলেন–

গোস্বামী মহাশয়–“আমাদের কিছু যে ছিল না, তার প্রমাণ কি?”

শরৎবাবু–“প্রমাণ আমাদের অবস্থা।”

গোস্বামী–“কি-রকম প্রমাণ। আচ্ছা ধরুন–আমার বাপ-পিতামহ বড়লোক ছিলেন, খুব ঘটা করে দোল-দুর্গোৎসব করে গেছেন; আমি আজ গরীব হয়েছি বলেই কি বলব, আমার বাপ-পিতামহ দোল-দুর্গোৎসব করে নি? সেটা কি সত্য হবে?”

শরৎবাবু–“আমি তা বলব না। কিন্তু এ-কথা বলব যে, তাঁরা তাঁদের ঐ দোল-দুর্গোৎসবের মধ্য দিয়েই আমাকে এই দুর্দ্দশায় এনে ফেলেছেন।”

চারুবাবু–“দু-ই ঠিক এক কথা নয়…কিছু না থেকে কিছু হওয়ার প্রশ্ন উঠেছে। আপনি এইবার আপনার সাহিত্যিক জীবন সম্বন্ধে আমাদের কিছু বলুন–কেমন করে আপনার সাহিত্যচর্চ্চার স্পৃহা কিছু নয়, অর্থাৎ অসাহিত্যিক থেকে আপনাকে বিশ্ববিশ্রুত সাহিত্যিক রূপে পরিণত করে তুলল, তার ক্রমবিকাশের কথা বলুন।”

শরৎবাবু–(স-রহস্যে) “ভুল, আমি সাহিত্যিক নই–পেটের দায়ে সাহিত্যিক!”

চারুবাবু–“আপনার এই কথাটা আমরা বিশ্বাস করব না। জানতে চাই, আপনার সাহিত্য-জীবনের সূত্রটা কি করে ক্রমবিকাশের ফলে উচ্চশিখরে এসে দাঁড়িয়েছে।”

শরৎবাবু–“সাহিত্যের গোড়ার কথা হ’ল ‘সহিত’ থেকে– অর্থাৎ সকলের সহিত সহানুভূতি দরকার। এইটাই মূল কথা।

আমার কি-রকমে কি হ’ল তা জানি না। ছেলেবেলা থেকেই লেখাপড়ার একটা ঝোঁক ছিল। মনের ভিতর থেকে একটা বাসনা হ’ত–যা বাইরে পাঁচ রকম দেখছি শুনছি তার একটি রূপ দেওয়া যায় না? হঠাৎ একদিন লিখতে শুরু করে দিলাম। প্রথমটায় অবশ্য এ’র ও’র চুরি করেই অধিকাংশ লিখতাম। অভিজ্ঞতা না থাকলে ভাল কিছুই লেখা যায় না। অভিজ্ঞতা লাভের জন্য অনেক কিছুই করতে হয়। অতি ভদ্র শান্ত শিষ্ট জীবন হবে, আর সমস্ত অভিজ্ঞতা লাভ হবে–তা হয় না। বলেছি –ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক—আমাকে চার-পাঁচবার সন্ন্যাসী হতে হয়েছিল। ভাল ভাল সন্ন্যাসীরা যা করেন সবই করেছি। গাঁজা মালপো কিছুই বাদ যায় নি।”

[শ্রোতৃমণ্ডলীর মধ্য হইতে একজন টিপ্পনী করিয়া বলিল– “বিদ্যে খুব পেকেই তবে এসেছে–দেখছি!”

শরৎবাবু উপযুক্ত উত্তরই দিলেন– “ওসব বিদ্যে না পাকলে কিছুই হবার জো নেই মশাই।”

তারপর বলিতে লাগিলেন।

“বিশ বছর এটাতে গেল। ঐ সময় খানকতক বই লিখে ফেললুম। ‘দেবদাস’ প্রভৃতি ঐ আঠার-কুড়ির মধ্যে লেখা। তারপর গান-বাজনা শিখতে লাগলুম। পাঁচ বছর ঐতে গেল। তার পর পেটের দায়ে চলে গেলাম নানা দিকে। প্রচণ্ড অভিজ্ঞতা তাই থেকে। এমন অনেক কিছু করতে হ’ত যাকে ঠিক ভাল বলা যায় না। তবে সুকৃতি ছিল, ওর মধ্যে ডুবে পড়িনি। দেখতে থাকতাম, সমস্ত খুঁটিনাটি খুঁজে বেড়াতাম। অভিজ্ঞতা জমা হ’ত। সমস্ত Islandগুলা (বৰ্ম্ম, জাভা, বোর্নিয়ো) ঘুরে বেড়াতাম। সেখানকার লোক অধিকাংশ ভাল নয়– smugglers. এই সব অভিজ্ঞতার ফল— ‘পথের দাবী’। বাড়িতে বসে আর্থ-চেয়ারে বসে সাহিত্য-সৃষ্টি হয় না, অনুকরণ করা যেতে পারে। কিন্তু সত্যিকার মানুষ না দেখলে সাহিত্য হয় না। এঁরা করেন কি–বই থেকে একটা ‘ক্যারেক্‌টার’ নিয়ে তাকেই একটু অদল-বদল করে আর একটা ক্যারেক্‌টার সৃষ্টি করেন। মানুষ কি, তা মানুষ না দেখলে বোঝা যায় না। অতি কুৎসিত নোংরামির ভিতরও এত মনুষ্যত্ব দেখছি যা কল্পনা করা যায় না। সে-সব অভিজ্ঞতা আমার মনের ভেতর থাকতে লাগল। আমার memoryটা বড্ড ভাল। ছেলেবেলা থেকে intact আছে, নষ্ট হয়নি। জানবার ইচ্ছা আমার বরাবর আছে। মানুষের ভিতরকার সত্তাটা realise করাই আমার উদ্দেশ্য। যার একটা স্খলন হ’ল, মানুষ তাকে একেবারে বাদ দেবে–এ কেমন কথা?

আমি মানুষের ভেতরটা বরাবর দেখি। এ বললে, সে বললে, পরের মুখে ঝাল খাওয়া, পরের অভিজ্ঞতাকে নিজের করে নেওয়া–এ আমার কোনদিন ছিল না। অতি বড় দুর্ভাগ্যই এ করবে! সত্যিকারের জীবন দেখতে গেলে শুচিবাইগ্রস্ত হলে চলে না। যে অভিজ্ঞতার ফলে গোর্কি, টলষ্টয়, শেক্সপিয়ার পর্যন্ত অত গুচিগ্রস্থ হতে পারেননি। তাঁদেরও শুচিবাই ছিল না। Concrete রচনা করতে গেলে কল্পনা চলে না। নিজের অভিজ্ঞতা চাই। পরের লেখা সাহিত্য আমি খুব কম পড়েছি। ও আমার ভাল লাগে না। আমার বাড়িতে যে বই আছে, তার অধিকাংশ সয়েন্সের বই। সেই জন্যই আমার বইয়ে যুক্তির অবতারণা বা synthetic result বেশী। রূপের বর্ণনা, স্বভাবের বর্ণনা বইয়ের মধ্যে নেই। ও আমি দু-এক কথায় সেরে নিই, বেশী নজর দিই না। আসল বস্তু তার সত্তা বা মন যাই বলুন–সেটা মানুষের ভিতরটা। সেইটা উপলব্ধি করবার জন্য চাই প্রচণ্ড অভিজ্ঞতা। আমার অভিজ্ঞতা কি করে সঞ্চয় করেছি তার details বলবার প্রয়োজন নেই—সব বলবার মতও নয়। মানুষ (সংস্কারবশতঃ বা দুর্ব্বলতা-হেতু) সে-সব সহ্য করিতে পারে না। রবীন্দ্রনাথের সেই গানটায় (?) যেমন আছে (বিষ যেটা) সেটা শুধু আমারই উপর পড়ল–তা থেকে যা বেরিয়ে এল, সেটা সকলকে দিয়েছি (আমার সাহিত্যের মধ্য দিয়ে) অনেকে বলে থাকেন এবং rightly বলে থাকেন–‘আপনার চরিত্রগুলি পড়লে মনে হয় যেন এরা কল্পনার বস্তু নয়।’ আমার চরিত্রগুলির 90% basis সত্য। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, সত্যি মাত্রই সাহিত্য নয়। এমন অনেক সত্যি আছে যা সাহিত্যপদবাচ্য হতে পারে না। কিন্তু ‘ সত্যের উপর বনেদ না খাড়া করলে চরিত্র জীবন্ত হয় না। বনেদ নিরেট হলে আর ভয় নেই–যাই বললে অস্বাভাবিক, অমনি বদলে ফেলতে হয় না। আমি যে চরিত্র দেখেছি, পারিপার্শ্বিক অবস্থার ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তার যে পরিণতি দেখছি তাই লিখেছি। তাই আমার ভয়ের কারণ নাই। লোকে সেগুলোকে অস্বাভাবিক বললেই আমি মানব না। এই রকম করে আমার সাহিত্য জীবন গড়ে উঠেছে।

চারুবাবু প্রশ্ন করিলেন–“আপনার যেটা গভীরতর সাহিত্যিক বস্তু, সেটা করে গড়ে উঠল? ভাবকে আপনি রূপ দেন কি করে? বলবার যে ভঙ্গি, যে গড়ন, আগাগোড়া যে রস, যে আকাঙ্ক্ষা (?) যে লালিত্য— এ ভাষা কোথায় পেলেন? আপনার মুখের ভাষার সঙ্গে আপনার বইয়ের ভাষার কোন মিল নেই– না এ ‘পথের দাবী’র ভাষা, না অন্য কোন বইয়ের ভাষা।”

শরৎবাবু বলিলেন– “সেটা বলতে পারি না। ভাষাটা আপনি আসে, আমার লেখার ধরণটা সাধারণ থেকে আলাদা। পূর্ব্বেই বলেছি–আমার স্মরণশক্তি খুব তীক্ষ্ণ। অবাল্য যা দেখেছি শুনেছি, সবই যে সব সময়ে মনে থাকে তা নয়, তবে প্রয়োজন হলে এসে পড়ে। প্রথমে চরিত্রগুলি আমি ঠিক করে নিই–এক, দুই, তিন করে। গল্পের আরম্ভ করা বা চরিত্রগুলিকে ফোটানো আমার পক্ষে অতি সহজ। অনেকে বলে–‘আমরা প্লট পাই না বলে লিখি না।’ আমি অবাক্‌ হই, এত বড় প্ৰকাণ্ড পৃথিবীটা পড়ে রয়েছে, এত বৈচিত্র্য–আর এরা প্লট খুঁজে পায় না! তার কারণ, তারা মানুষটাকে খোঁজে না, গল্প নিয়েই ব্যস্ত থাকে, কিসে লোকের মনোরঞ্জন হয়–আমি সেটা করি না। এই যেমন চারুবাবুকে দেখলুম–তার মন-বস্তুটা নষ্ট করি না, ঘটনাও না। আমার ভাষাটা বোধ হয় সায়েন্সের বই পড়ার দরুন ঐ-রকম হয়ে থাকবে। আমি ভাষা ভাল জানি না— vocabulary খুব কম– (তবু) লোকের ভাল লাগে কেন, জানি না। যা বোঝাতে চাই তা মনে (?) রাখি, তার জন্যে অনেক পরিশ্রম করি। ‘সে’ ও ‘তিনি’–(প্রয়োগ খুব যত্ন করে করতে হয়)। লেখা অনেক ঘষামাজা করতে হয়–স্বতঃ উৎসের মত বেরোয় না। যারা বলে–যা লিখে যাব, তাই ভাল–তারা প্রকাণ্ড ভুল করে। মানুষের বলার মতন লেখাতেও অনেক irrelevant কথা থাকে। সেদিকে নজর রাখতে হয়। আমি যা-তা করে কোন কাজ করি না। সেই জন্য ভূমিকা করে আমার মত বুঝাতে হয় না। আমার কোন বইয়ে ভূমিকা নেই। চার-শো পাতা বই পড়ে যে বুঝলে না, সে চার পাতা ভূমিকা পড়ে বুঝবে? আমি বইয়ের মধ্যেই বোঝবার চেষ্টা করি–কোন কথা দ্ব্যর্থক না হয়, সেদিকে নজর রাখি। আমার সঙ্গে মতের মিল না হতে পারে; কিন্তু কেউ বলতে পারবে না যে, আপনার লেখা বুঝতে পারলাম না।

আর একটা জিনিস বরাবর দেখেছি–সাহিত্যরচনার গোটাকতক নিয়ম-কানুনও আছে। দেখতে হয়, রসবস্তু অশ্লীলতা-পর্যায়ে না এসে পড়ে। শ্লীলতা-অশ্লীলতার মধ্যে এমন একটি সূক্ষ্মরেখা আছে, যার এক ইঞ্চি ওদিকে পা পড়লেই সব vulgar–নষ্ট হয়ে যায়। একটু পা টলেছে ত আর রক্ষে নাই। অবশ্য আমি রসিক লোকের কথাই বলছি। vulgar সাহিত্য সর্ব্বদা বর্জ্জনীয়। মনোরঞ্জনের জন্য আমি কখনও মিথ্যে বলব না, এ-জিনিসটা আমি পারতপক্ষে করি না। কঠোর সমালোচনা আমি খুবই পেয়েছি। গলাগালির বন্যা বয়ে গেছে; দেশ বুঝে না, গ্রন্থকার, কবি, চিত্রকর–এঁদের জীবন সাধারণ থেকে ভিন্ন, এখানকার লোকে তা জানে না। জানে না যে, এঁদের স্নেহের প্রশ্রয় দিয়েই বাঁচিয়ে রাখতে হয়। মানুষ চায় এঁদের অভিজ্ঞতা লাভও হোক, আর আমাদের মতন শান্তশিষ্ট ভদ্র জীবন যাপন করুক। তা হয় না। আর ব্যথার বিষয়, আমাদের দেশের সমালোচনার মধ্যে ব্যক্তিগত ইঙ্গিতই থাকে বারো আনা। এ-সব সমালোচনা হয় মনুষটার, বইটার নয়। এই জন্যে অনেকে ভয় পেয়ে যায়। ‘বামুনের মেয়ে’ বলে আমার একখানা বই আছে। অনেকে হয়ত পড়েননি। লেখার সময়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথাবার্তা হয়; তাঁকে বলি, এই রকম একখানা বই লিখতে ইচ্ছা হয়; এ-সম্বন্ধে আমার অনেক ব্যক্তিগত experience আছে। তিনি বললেন, ‘এখন ত আর কৌলিন্য নেই, একজনের ১০০টা বিয়ে নেই, plot-এর ত ভাবনা নেই–তবে আর এটাকে ঘেঁটে কি হবে? তবে যদি সাহস থাকে লেখো, কিন্তু কিছু মিছে কল্পনা ক’রো না।’ পুরানো ছাই ঘাঁটা আমারও উদ্দেশ্য নয়। কৌলিন্য প্রথাটা আমার বড় লেগেছিল। যাঁরা ব্রাহ্মণ বলে নিজেদের ভারি গৌরব বোধ করেন আর ভাবেন–ব্রাহ্মণের রক্ত অবিমিশ্রভাবে বয়ে এসেছে, তাঁদের সেটা মস্ত বড় ভুল ধারণ। ইংরাজীতে যাকে ‘blue-blood’ বলে, তা আর নেই। কৌলিন্য নিয়ে গোলমাল নিজের চোখে কত দেখেছি। ইতিহাসের কথা নয় নিজে যা দেখেছি তাই লিখেছি। এক-আধটা নয়, অনেক। এক বাড়িতে, নেমন্তন্ন পৰ্য্যন্ত খেয়ে এসেছি। কৌলিন্য ভাল কি মন্দ–সে বিচার আমার নয়, ও আমি বলিও না। আমি এ-কথা কখনও বলি না যে, বৈদ্যের সঙ্গে কায়েতের বিয়ে দাও। তবে কেউ যদি দেয়, কালচার (শিক্ষাদীক্ষা) মেলে, তা হলে এটা বলি–‘তাকে বাধা দিও না।’ সে ভাল করলে কি মন্দ করলে সে আমার কথা নয়–অন্ততঃ সে মিথ্যাচারী নয়, এটা ত বলব। সে যেটা ভাল বুঝেছে, করেছে–সামাজিক তর্ক তুলে তাকে বাধা দেওয়া উচিত নয়। অনেকে মুখে বলেন, মেয়ের বিধবা-বিবাহ দাও; কিন্তু যেমনি নিজের মেয়ে বিধবা হ’ল, অমনি বলতে শুরু করেন–দেখুন, ও আমি পারব না; আমার আর পাঁচটা মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এ-রকম মিথ্যাচার ভাল বলি না। রবীন্দ্রনাথ–যার মত অত বড় প্রতিভা পৃথিবীতে আর জন্মাবে কি না সন্দেহ— উনিও তাই বললেন–‘লেখো, কিন্তু মিথ্যার আশ্রয় নিও না’–কুলিন ব্রাহ্মণ আমি, আমারও লাগবে, ও-রকম করো না। (মিথ্যা করে চরিত্র গড়াও যায় না; যেখানে গড়া হয় সেইটাই মিথ্যা হয়, অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে)। বইখানা বেরুলে উঃ, সে কি আক্রমণ! চারিদিক থেকে চিঠি আসতে লাগলো।”

[সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিতে, কথা প্রায় শেষ হইয়া আসিতেছিল]

শ্রীযুক্ত নারায়ণচন্দ্র অনুরোধ করিলেন, – ‘politics সম্বন্ধে আপনার মত কি? বৰ্ত্তমান political movement সম্বন্ধে কিছু বলুন। এ movement কেমন চলছে বলে আপনার মনে হয়?”

শরৎবাবু—“কেন, আপনি চালান-টালান না কি? চলছে বেশ! কিন্তু এ-সম্বন্ধে আমি কিছু বলতে পারব না।”

[তাঁর লেখার প্রসঙ্গে কি কথায় তিনি বলিলেন]

“লেখার সময় যেন Transported হয়ে যাই। বাড়িতে বলে রেখে দিয়েছি—যখন লিখব, কেউ কিছু জিজ্ঞাসা ক’রো না। করলে যা উত্তর পাবে তা বিশ্বাস ক’রো না।” (সকলের হাস্য)।

“ভাষা আপনি আসে। যার আসে না, তার বড় মুস্কিল। কি করে কথা যোগায়, তা বলাও মুস্কিল।”

[Style-এর কথায়]

“এই গূঢ় (?)–এটাকেই না আপনারা style বলেন? এটা নিজেরই হয়। অনুকরণ করে হয় না।”

[সেই গোস্বামী মহাশয় পূর্ব্বাপর সমস্ত আলোচনা শ্রবণান্তে সহসা আবার কহিলেন]

গোস্বামী–“আপনি মুখে যাই বলুন, আপনার লেখা পড়ে আমার মনে হয়, আপনি সনাতন ধর্ম্মের মর্যাদা হানি করতে চাননি। যখন দেখি ‘চরিত্রহীন’ বইখানার সেই মেয়েটি স্টীমারের উপর একটি বালকের সহিত এক বিছানায় থেকেও নিজের দেহকে নষ্ট হতে দিল না, তখনও কি আমরা বলব—আপনি সনাতন ধৰ্ম্মটা মানেননি? আপনার অন্তরের অলৌকিক ধর্মবিশ্বাসটাই কি ঐ মেয়েটির চরিত্ররক্ষার কারণ নয়?”

শরৎবাবু উত্তর করিলেন–“আপনি আমার উদ্দেশ্যটা ঠিক ধরতে পারেননি। আপনি যা বলছেন, ওভাবে আমি কিছুই করিনি। মেয়েটি যদি দেহ নষ্টই করত, তাতে আমার কিছু ক্ষতি ছিল না। কিন্তু ঐ চরিত্রটা একেবারে অসত্য হয়ে যেত। অমন লেখাপড়া-জানা সুশিক্ষিত মেয়ে, আর যে বালকের সঙ্গে সে কেবল একটা জিদের বশে পালিয়ে এলো, সে একটা অপোগণ্ড শিশু বললেই হয়, যাকে সে কোন দিক দিয়েই নিজের সমকক্ষ মনে করে না, তাকে দিয়েই যদি সে নিজের দেহটা নষ্ট হতে দিত তা হলে ও চরিত্রটাই মাটি হয়ে যেত।”

অতঃপর শরৎবাবু বলিলেন—“এ আলোচনায় আনন্দ পেলুম। শুধু আমাদের জন্য নয়, এ-রকম আলোচনা-সভার একটি সত্যিকার প্রয়োজনও আছে। দেশটাকে কিভাবে বড় করে তোলা যায়, নানা লোকের নানা মত রয়েছে। মাঝে মাঝে এই রকম পাঠক ও লেখক জড় হয়ে বিভিন্ন চেষ্টায় একটা সামঞ্জস্য করা দরকার। এতে লাভ আছে। আজকাল অনেকেই লিখছে; কিন্তু তাদের অনেককেই ঠিক লেখক বলা চলে না। তাদের লেখায় সংযম দেখা যায় না। যৌন সম্বন্ধ নিয়ে তারা এমন একটা গোলমাল করছে যে, তাদের লেখা সাহিত্যপদবাচ্য কি-না সন্দেহ। এ-সমস্ত লেখার অধিকাংশই বাহির থেকে আমদানি করা। নিজেদের অভিজ্ঞতা নেই–তাই পরের ধার-করা জিনিস চালাতে গিয়ে একটা বিশ্রী কাণ্ড করে তুলছে। কেহ কিছু বললে তারা জিদের বশে বলে– ‘খুব করব, লিখব, বলব।’ কিন্তু সেটা ঠিক নয়। এ-রকম সভা-সমিতি করে যদি তাদের সঙ্গে আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়, তা হলে তা থেকে ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে।”

[শরৎবাবু কথা প্রসঙ্গে এই কথাটি খুব জোর দিয়াই বলেন]

আমি মানুষকে খুব বড় বলেই মনে করি। তাকে ছোট করে আমি মনে করতে পারি না।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. চন্দননগরে আলাপ-সভার অনুলিখিত বিবরণ সর্বপ্রথম ১৩৩৭ সালের কার্তিক সংখ্যা ‘প্রবর্তকে’ প্রকাশিত হয়। ‘শরৎচন্দ্রের পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত রচনাবলী’র অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রথম প্রকাশিত হয় শ্রাবণ, ১৩৫৮ সালে। পরবর্তীতে ‘শরৎ সাহিত্য-সংগ্রহ’, ষষ্ঠ সম্ভারে রচনাটি গ্রন্থিত হয় এবং যে-সকল স্থানে অনৈক্য, অস্পষ্টতা বা অসঙ্গতি-দোষ আছে বলে মনে হয়েছিল, সেই সকল স্থলে সংশয়-চিহ্ন দেওয়া হয়েছিল।